ডঃঅনিন্দ্য সরকার প্রত্যেক রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা শুধু মাত্র পথশিশুদের চিকিৎসা করতেই ব্যস্ত থাকেন।ওই দিন আর অন্য কোন কাজ রাখেন না।রাস্তায় থাকা যে বাচ্চাদের বাবা মা নেই সেই বাচ্চা গুলো কে নিজের দায়িত্বে তার তৈরি আশ্রমে নিয়ে যান তিনি।সারাদিন আশ্রমেই কাটান ছোট ছোট বাচ্চা দের সাথে।ওদের পড়াশুনা খাওয়া দাওয়া সবকিছুর দিকে কড়া নজর তার।
পথ শিশুদের প্রতি একটা অদ্ভুদ টান রয়েছে ডাক্তার অনিন্দ্য সরকারের।বন্ধুরা জানতে চেয়েছিল অনেকবার কিন্তু অনিন্দ্য এর উত্তর কাউকে দেয়নি কোনদিন।তাই অনেকেই জানেনা অনিন্দ্য কেন ওদের প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল। কেন ওদের কষ্ট গুলো ওর নিজের মনে হয়। একটা অতীত যেটা তার একান্ত নিজের একান্ত ব্যক্তিগত।তাই কাউকে কোনদিন সেই অতীতের কথা জানায় নি।নিজেও তো ভুলেই থাকতে চায় কিন্তু পারে কোথায়।তার অতীতের ছায়া কখনোই তার পিছু ছাড়েনি।
কখনো কখনো চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে সেই ভয়াবহ অতীতটা।যেটা সে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারেনা।চাইলেও অস্বীকার করতে পারেনা।
আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে একটা দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে গনেশ যখন দরজার ফাঁক দিয়ে ওর মাকে বস্তির এক মাতালের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছিল সেদিনই বাড়ি ছেড়েছিল বারো বছরের গনশা।বেশ কদিন ধরেই মা এর ঘরে অন্য পুরুষের আনাগোনা চলছিল।ঘেন্নায় গা গিনগিন করত।অনেকবার মাকে বারন করেছিল।অভাবের সংসার তাই এসব করেই সংসার চালাতে হত।মাতো অন্য বাড়িতে কাজ করেও সংসার টাকে চালাতে পারত,এটাই কেন?কোন উত্তর মেলেনি মা এর কাছ থেকে। কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল বাবা।সেই থেকেই অভাবের ভয়ঙ্কর থাবা গ্রাস করছিল ওদের।
কিন্তু সেদিন আর সহ্য করতে পারেনি মাকে ওভাবে দেখে।সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছে।ছোট বলে কেউ কোন কাজেও রাখেনি।সারাদিন খালি পেটে ঘুরে রাতে যখন ফুটপাতে এসে শুয়ে পড়েছিল তখন নিজেকে পথ শিশু বলেই মন হয়েছিল গনশার।অমন মাএর কাছে থাকার চেয়ে পথ শিশুর আখ্যা নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক বেশি সম্মানের মনে হয়েছিল ছোট্ট গনশার কাছে।
টানা একবছর পথেই জীবন কাটিয়েছে গনশা।কেউ যদি দয়া করে খেতে দিত তবেই পেটে পড়ত।নয়ত জল খেয়েই দিন কেটে যেত।বই এর ব্যাগটা নিয়ে এসেছিল আসার সময়,তাই ফুটপাতে গনশাকে বই হতেই দেখা যেত সবসময়।
কথায় বলে ভাগ্য সবসময় একরকম থাকেনা।
একটা এনজিও সংস্থা প্রত্যেক বছর রাস্তা থেকে অনাথ বাচ্চা দেরকে একটা আশ্রমে পাঠায়।ওদের থাকা খাওয়া এবং অবশ্যই পড়ালেখা ব্যবস্থা থাকে সেখানে।গনশার পড়ার প্রতি এত আগ্রহ দেখে ওকে আশ্রমে নিয়ে যায় ওরা।
পড়াশুনা করতে বড্ড ভালোবাসত গনশা।তাই আশ্রমে গিয়ে গনশার একটাই স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, ওকে অনেক বড় হতে হবে।বড় হয়ে ওর মত অসহায় বাচ্চা দের পাশে দাঁড়াতে হবে। আশ্রমে গিয়ে নিজের নামটাও বদলে ফেলেছিল যাতে অতীত টাকে ভুলে থাকা যায়। কিন্তু পারেনি। স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন থেকে যখন ডাক্তার হয়ে আসে তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল নিজের কাছে।পথ শিশুদের পাশে সবরকম ভাবে থাকবে।আর গনশা ওরফে ডাক্তার অনিন্দ্য সরকার মনে মনে এটা বিশ্বাস করে যে শিশুদের কোন জাত হয়না।পথে থাকলেই তারা পথ শিশু হয়না।কিছু উঁচু শ্রেনীর মানুষ ওদেরকে পথ শিশুর আখ্যা দিয়ে মানসিক শান্তি পায়।কিন্তু ওদের পথ শিশু হয়ে ওঠার গল্প জানতেও পারেনা কখনো।
"মনি রায় ঘোষ"
রচনাকাল : ৪/১২/২০১৯
© কিশলয় এবং মনি রায় ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।