রোজ অফিসে যাওয়ার পথে রিমি দেখতে পায় হরি কাকুর বাড়ির উঠোনের কলটা খোলাই থাকে। টাইম কল তাই টাইম মতোই জল আসে, কিন্তু কলের মুখটা হরি কাকু কখনো বন্ধ করেনা।
রোজ অফিসে যাওয়ার পথে রিমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে কলটা বন্ধ করে দেয়। অনেকবার হরি কাকুকে বলা সত্ত্বেও তেনার কোন হেলদোল হয়নি। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে জল আসে তা যত খুশি নষ্ট হোক অসুবিধা তো কিছু নেই। উল্টো রিমিকেই ভালো-মন্দ দু চার কথা শুনিয়ে দিতেন হরি বাবু। তবুও রিমি তার দায়িত্ব পালন করত।
চারদিকে জল অপচয় নিয়ে বড্ড হইচই। কত রাজ্যে কত লোক জলের অভাবে ধুকে ধুকে মরছে। খবরের কাগজে টিভির খবরে অনবরত একই কথা বলছে তাও হরি কাকুর কান পর্যন্ত কিছুই আর পৌছচ্ছে না। যতদিন জল পাব ততদিন এভাবেই অপচয় করব এরকমই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি।
একদিন হরি কাকু হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। একা মানুষ হরি কাকু। একজন কাজের লোক এসে দুবেলার রান্না করে দিয়ে যায়। সেদিন কাজের লোক টাও আসতে দেরি করছিল। এদিকে রিমি যথারীতি অফিসে যাওয়ার পথে কলটা বন্ধ করতে ঢুকলো। ঢুকে গোঙানির শব্দ শুনে ঘরের ভেতরে উকিঁ মারল। দেখল হরি কাকু ফিসফিস করে কিছু একটা বলছেন। কিন্তু শোনার মত কেউ নেই সেখানে। রিমি ধীরে ধীরে হরি কাকুর মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে পেল উনি জল চাইছেন। ওনার চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে জলের জন্য। গলা শুকিয়ে কাঠ।
রিমি সামনে জল থাকা সত্ত্বেও হরি কাকুকে এক ফোটাঁও জল দিলনা। বেশ কিছুক্ষণ রিমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অফিসে দেরি হওয়া সত্ত্বেও। একটু জলের জন্য মরণাপন্ন অবস্থা। কিন্তু উঠে জল খাওয়ার মত অবস্থা তার ছিলনা। অনেকক্ষণ পর রিমি হরি কাকুকে বলল, "দেখলে তো কাকু,জলের জন্য প্রাণটা কেমন ছটফট করে। জল ছাড়া বেঁচে থাকা কতটা দুর্বিষহ। আজ যদি এক ফোঁটা জল না পাও ভেবে দেখোতো প্রাণটা বাঁচবে তোমার?? রোজ কত জল নষ্ট করো তুমি আর সেই জলের অভাবে কত লোকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। হা হুতাশ করছে এক ফোঁটা জলের জন্য।"
কথাগুলো বলে এক গ্লাস জল এনে হরি কাকুকে খাইয়ে দিল। ততক্ষণে রান্নার লোকটাও এসে হাজির। রিমি ওনাকে দায়িত্ব দিয়ে এবং প্রয়োজনে অবশ্যই যেন রিমি কে খবর দেয়া হয় সেটা জানিয়ে রিমি চলে গেল নিজের কাজে।
পরের দিন যথারীতি অফিসে রওনা হল রিমি। যাওয়ার পথে হরি কাকুর বাড়ির সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। জল পড়ার সেই চেনা শব্দ টা আজ কানে এলনা রিমির। এই প্রথম বার রিমি হরি কাকুর বাড়ির কলটা বন্ধ দেখল। ভেতরে চোখ পড়তেই দেখল হরি কাকু দাঁড়িয়ে আছে। যেন রিমির জন্যই অপেক্ষা করছিল। রিমিকে দেখে বললেন, "আর তোকে আমার বাড়ির কল বন্ধ করতে হবেনা। এই দায়িত্বটা আজ থেকে আমিই নিলাম। অন্য কোথাও কল খোলা দেখলে সেটাও গিয়ে বন্ধ করব।" -- বলে হেসে ফেলল হরি কাকু।
অজান্তেই চোখের কোণটা ভিজে গেল রিমির। অন্তত একজনকেতো জলের মূল্য বোঝাতে পেরেছে এটাই অনেক বড় পাওয়া রিমির কাছে।
রচনাকাল : ১/১১/২০১৯
© কিশলয় এবং মনি রায় ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।