আজ থেকে তিনবছর আগে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়।সেদিন সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা ছিল বড্ড বেশী।সময় যত এগোতে লাগল গুমোট ভাবটা তত বাড়তে লাগল।বেলা আন্দাজ বারোটা নাগাদ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল।সাথে মেঘের গর্জন আর মাঝে মাঝেই কানফাটানো বিদ্যুতের ঝলকানি।দুপুরে মায়ের হাতের রান্না করা গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা সহযোগে ভোজনটা মাত্রাতিরিক্ত বেশীই হয়ে গেল,তার থেকেও বেশী হয়ে গেল ভরা পেটে ভাতঘুমটা।সন্ধ্যারদিকে মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুমটা ভাঙল।দেখলাম বৃষ্টি একটুও কমেনি বরং তার তেজ আরও বেড়ে গেছে।নিজের ঘরে জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম আর জানলার পাল্লাটা দিলাম খুলে।একরাশ বৃষ্টির ঝাপটা চোখে মুখে লেগে সারাটা গা একেবারে ভিজিয়ে দিল।অন্ধকার ঘরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা।মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরল।বাবার হুকুম আমাকে পাড়ার দোকান থেকে গরমা গরম তেলেভাজা আনতে যেতে হবে এক্ষুণি।নিমরাজি হয়ে ছাতা হাতে বেরোলাম।দেখলাম বৃষ্টির তেজে ছাতা খাটানো আর না খাটানো একই ব্যাপার।কাকভেজা হয়ে মনে মনে গজরাতে গজরাতে এগিয়ে চলেছি এমনসময় রাস্তায় কিউ-কিউ শব্দ শুনে থেমে গেলাম।দেখলাম একটা বাচ্চা কুকুরছানা রাস্তার পাশে একটা গাছের তলায় বসে আছে।বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে একসা হয়ে গেছে বেচারা।আর ঠান্ডায় সমানে কিউ-কিউ করে চলেছে।আমি কাছে যেতেই একলাফে এগিয়ে এল আমার কাছে।পায়ের কাছে বসে গা ঘষতে লাগল আর ছোট্ট লেজটা নাড়াতে লাগল টিং-টিং করে।মনে মনে ঠিক করে নিলাম একে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব।নাহলে বেচারা হয়ত ঠান্ডাতে মড়েই যাবে।বললাম-"কি রে যাবি আমার সাথে?"কি বুঝল জানি না দেখলাম আমার সাথে তেলেভাজার দোকান অবধি গেল আবার সেখান থেকে বাড়ি অবধিও আমার পিছু পিছু লেজ নাড়তে নাড়তে এল।ভেবেছিলাম মা আমার ওপর রাগ করবে।কিন্তু দেখলাম মা কিছুই বলল না।বাচ্চাটাকে যত্ন করে কাপড় দিয়ে মুছিয়ে ছোটো বাটিতে গরম দুধ খেতে দিল।সে তো পরম তৃপ্তিতে ভোজন করে বাবার পায়ের নীচে সোফাতে হেলান দিয়ে গোল পাকিয়ে শুয়ে পড়ল।তারপর????তারপর আর কি বিগত তিন বছর ধরে সে আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী।রোজ সকালে বাবার সাথে ঘুম থেকে উঠে মর্নিংওয়াকে যাওয়া থেকে তার দিনের শুরু,সারাদিন মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরা আমার সাথা মারপিট-খেলাধুলা আর রাতে আমার সাথে বিছানায় গোল হয়ে ঘুমানো এই তার নিত্যদিনের রুটিন।ঝম্-ঝম্ বৃষ্টিতে তাকে পেয়েছিলাম বলে নাম দিয়েছিলাম ঝুমঝুমি।কিন্তু আজ সকাল থেকেই তার পাত্তা নেই।এমনিতে বাড়ি থেকে একাএকা খুব একটা সে বেড়োয়ও না।আর বিগত তিনদিন ধরে তার শরীরও ভালো নেই,খুব জ্বর তার।ডাক্তার দেখে ওষুধ দিয়েছেন বটে তবে বলেছেন ওর ভালোভাবে যত্ন নিতে।আজও সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।বাইরে বেড়িয়ে যে দেখব সে উপায়ও নেই।সারাটা সকাল উদ্বিগ্নভাবে কাটালাম।বিকেলের দিকে রমেনকাকু খবর দিল অামাদের ঝুমঝুমি নাকি রাস্তার পাশে পড়ে আছে।আমি আর বাবা তড়িঘড়ি ছুটলাম।দেখলাম যেখান থেকে ওকে নিয়ে এসেছিলাম সেই গাছের নীচেই শুয়ে আছে।কাছে গিয়ে দেখলাম সারাশরীর ঠান্ডা।বুঝলাম সে আর নেই।কোলে করে আবার সেদিনের মতো আজও বাড়ি নিয়ে এলাম তাকে।তবে এবার আর বাড়ির ভিতর সে গেল না, বাগানের এককোণে টগর গাছের নীচে তার ঠাঁই হল।সেদিনের মতো আজও তার মুখে হাসি শুধু আফসোস একটাই সেই লেজটা আর নড়ছেনা টিং-টিং করে।যতই ডাকি ঝুমঝুমি বলে ঘুমের দেশের ওপার থেকে কেউ আর সাড়া দেবেনা। তবে আমি জানি একদিন দেখা আমাদের হবেই যেদিন আমিও রওনা দেব ঘুমের দেশে। ততদিন নাহয় অপেক্ষা করি।
রচনাকাল : ১৬/১২/২০১৯
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।