যেদিন বধু বেশে বাড়ি ছাড়লাম সেদিন একটুও বুঝতে পারিনি অন্য বাড়ি টাতে মা-এর গন্ধ টা আর পাব না।সকাল দুপুর রাত ভাত খেয়ে মায়ের আঁচলে হাত মুছঁতাম।অন্য বাড়ি টাতে মা এর আঁচল টাও আর নেই।মা হেঁটে গেলে একটা রিনঝিন শব্দ হয় ।মা এর হাতের শাখা পলা চুড়ির শব্দ।ওই শব্দ টা আর নেই অন্য বাড়িটায়।সারা বাড়ি জুড়ে মা এর গলার আওয়াজ গমগম করত।কখনো আমায় বকতো কখনো বা ভাই কে।বকুনি থেকে বাবা ও বাদ যেত না।সেই বকুনি টাও নেই অন্য বাড়ি তে।সারাদিন পর বাড়ি ফিরে বাবা সেই দরজা থেকেই আমার নাম ধরে ডাকত।কোনদিন আমার পছন্দের খাবার কোনদিন আবার প্রিয় লেখকের বই নিয়ে আসত হাতে করে।আমিও সারাদিন অপেক্ষা করে বসে থাকতাম।বাবা এসে কখন ডাকবে আমার ডাকনাম ধরে।
"কিরে খেয়েছিস তো?জিজ্ঞেস করত ফিরেই।
মা কে বলত-ওকে রান্না ঘরে ঢুকতে দিও না কিন্তু।। অন্য বাড়িতে গেলে সেই তো রান্না ঘরে ঢুকতেই হবে।হাত পুড়িয়ে রান্না তো করতেই হবে।
বাবা একটুও কাদেঁনি সেদিন।একটা ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল।বাবারা আসলে কাঁদতে পারেনা ওদের বুক ফেটে যায় তবু ওরা মুখ ফুটে বলতে পারেনা।
মা বাবা কে ছাড়াও থাকা যায়,মা বাবা কে ছাড়াও বাঁচা যায়, এটাও কখনো ভাবতে হবে সেটা ভেবে দেখিনি কখনো।
ওই অন্য বাড়ি টাতে অনেক কিছু আছে।একটা অন্য মা ও আছে।কিন্তু সেই মা এর গায়ের গন্ধ বড্ড অচেনা।সেই মা এর আঁচল টাও আমার জন্য নয়।একজন কে বাবা বলে ডাকি কিন্তু সে কখনো জানতে চায়না আমি খেয়েছি কিনা।বৌমা বলে ডাকে।ডাকনাম টা হয়ত জানেই না ঠিক করে।
একটু একটু করে বুঝেছি মা বাবার কোন বিকল্প হয়না।
অন্য কাউকে মা বাবা ডাকা হয়ত যায় কিন্তু তাদের গায়ে বাবা মা এর গন্ধ পাওয়া যায় না।
মা কে ছেড়ে কোথাও রাত কাটাইনি কখনো।মা কোথাও একা ছাড়তই না।মা বলত 'তুই না থাকলে বাড়ি টা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আচ্ছা মা এখন সেই ফাঁকা বাড়ি টাতে আমায় ছাড়া কি করে থাকো?জানতে চেয়েছিলাম অনেকবার।
মা কোন উত্তর দেয়নি শুধু আঁচলে চোখ মুছেছে আমায় আড়াল করে।মেয়ে বড় হলে চলে যেতেই হয়।তাতে সে মা কে ছেড়ে থাকতে পারবে কিনা,মা এর জন্য মন খারাপ করবে কিনা সেটা ভেবে দেখা বারণ।জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা যে বাড়িতে,মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠা যে বাড়িতে,একদিন সেই বাড়িটাকে ছাড়তে হয় এটাই নিয়ম।নিজের ঘর,পড়ার টেবিল,জানালার পর্দা,খুব প্রিয় ডায়েরি টা, সবকিছুই ছাড়তে হয়।
ভাই কিন্তু মা বাবার কাছেই রয়ে গেছে।ভাই যতদিন ইচ্ছে মা বাবার কাছেই থাকবে।এতে কোন বারন নেই।
বারন ছিল শুধু আমার বেলাতেই।
মা বলেছিল 'এখন থেকে ওই বাড়িটাই তোর নিজের বাড়ি 'খুব হেসেছিলাম আমি।যে বাড়িতে জন্ম হল সেটাই যখন আমার বাড়ি নয়।তখন হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা বাড়ি টা আমার কি করে হয়??
আসলে কোন বাড়িই আমাদের নয় মা।আমরা হলাম পরগাছা।শক্ত ডাল পেলেই আঁকড়ে ধরি।
আমরা হলাম জলের মত।যখন যে পাত্রে রাখে তখন সেই পাত্রের আকার ধারণ করি।
যে পদবি টা জন্ম থেকে নামের পাশে বসত,এক মূহুর্তে সেই পদবি টা বদলে যায়।শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা হয় আমাদের পরিচয়।বুকের ভেতর টা হু হু করে ওঠে।নিজেকে বড্ড অবাঞ্ছিত মনে হয়।
তবুও সব নিয়ম মেনে একটা অন্য বাড়ির বাসিন্দা হতে হয়।অচেনা ঘর,অচেনা দরজা জানালা, অচেনা ঘরের গন্ধ,অচেনা বিছানা।
শুরু হয় একটু একটু করে চিনে নেয়ার পালা।
আদৌ কি চেনা হয়ে ওঠে কোনদিন?
অচেনা দের চিনতে গিয়ে চেনা মানুষ গুলো ও অচেনা হয়ে যায়।আমরা মেয়ে তাই নিয়ম মাফিক আমাদের এই সবেই অভ্যস্ত হতে হয়।মা কে ছেড়ে থাকা অভ্যেস করতে হয়।বাবার কাছে আবদার ভাই এর সাথে খুনসুটি সবটা ভুলে যেতে হয়।
নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখতে হয় নিজেদের প্রতি মূহুর্ত।
কারণ সেই অন্য বাড়িটায় আমাদের যে অনেক দায়িত্ব।সবেতেই থাকে হাজার একটা বারণ।
আমরা যে মেয়েমানুষ এটাই হল কারণ।
রচনাকাল : ১৪/১১/২০১৯
© কিশলয় এবং মনি রায় ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।