• ৯ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা (১০২)

    ২০১৯ , নভেম্বর



পোষাক
আনুমানিক পঠন সময় : ২০ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫০ টি দেশ ব্যাপী ৪৩১১৪ জন পড়েছেন।
পোষাক
-----------------------------------

জি০সি০ভট্টাচার্য্য,
======================

‘কাকু, তোমার গাড়ী তো দেখি এতোক্ষণ যা ও বা চলছিল গুড় গুড় করে তা ও বন্ধ করে একেবারে থেমেই গেল। এখন কি করবে বলো তো’?
‘হুঁ’
প্রতিবন্ধী বেশী অপরূপ সুন্দর ছেলে চঞ্চল হেসে উঠে বলল-‘রাত আটটা কিন্তু বেজে গেছে দশ মিনিট আগেই…’
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে চঞ্চলের সানগ্লাশ আর জ্যাকেটের টুপি পরা মুখের দিকে না তাকিয়েই বললুম-‘অন্তত পক্ষে আরো একঘন্টা…’ 
 এই ইন্টারসিটির মতন সব স্টেশনে থেমে চলা গাড়ী চঞ্চলের ঠিক পছন্দ নয়। এই ট্রেনটা ও বাজে। হঠাৎ করে আলোগুলো ও সব কেন তা জানিনা নিভে গেল। আমি চন্চলকে হাত ধরে টেনে এনে সামনের সীট থেকে নিজের পাশে এনে বসিয়ে দিলুম। জিনিষপত্র যায় যাক ক্ষতি নেই অন্ধকারে গোটা ছেলেটাকেই কেউ না লোপাট করে দেয়। কিছুই অসম্ভব নয় এই সব জায়গায়।
দাদা রিসিভ করবার ও থাকবার জায়গার সব ব্যবস্থা করে রাখবে বলেছিল আর আমার চশমার মতন চঞ্চলের সানগ্লাসে ও নাইটভিজন সিস্টেম আছে এই যা ভরসা…তবু ও এই শীতের রাতে অপরিচিত স্থানে কি ভাবে যে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো…বুঝতে পারছিলুম না। স্টেশনে ও নামতে হবে আন্দাজে। বাতাসে ভিজে ভাব আছে তার মানে বৃষ্টি ও হতে পারে। যত সব চোরাচালানকারী খুনে বদমায়েশ ধরবার দায় কি আমাদের? আমরা দাদার টোপ হতে যাই কোন দুঃখে? শয়তানগুলো আমাদের আসল পরিচয়ের খবর পেয়ে গেলেই তো ফরসা …যত্ত সব.. 
সঙ্গে চঞ্চল না থাকলে আমার বিশেষ ভাবনা ছিল না। দাদা অবশ্য বাদলকে সঙ্গে আনতে বলেছিল চঞ্চলকে নয়। তা সে ছেলে এখন সায়েন্স ট্যালেন্ট সা্র্চ আর মেরিট স্কলারশিপের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত… মাধ্যমিকের আগের প্রথম দুটো বছরে বৃত্তি পাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে…পরে ও পাবে, মাষ্টার্স অবধি…. চঞ্চল বড়লোকের মানে দাদার মতন বেশ বড় পুলিশ অফিসারের ছেলে তাই তার বৃত্তির দরকার নেই…অগত্যা সেই জোর করে আমার সঙ্গী হয়েছে….দাদা অবশ্য জানতে পারলে রেগে আগুন তেলে বেগুন হবে। তার আর আমি কি করবো। 
চঞ্চল ছেলেটা একটু বড় হয়ে আজকাল যা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে না একটা …কিছু বললেই বলবে-‘আমার কুষ্ঠিতে যে লগ্নপতি দশমগত আর দশমপতি যুক্ত ও পঞ্চমপতি শুক্র লগ্নে…তুমি তার আর কি করবে কাকু, তাই বলো’। 
কথাগুলো এক জ্যোতিষীর যে ছেলেটাকে হীরে আর পান্না পরাতে বলেছিল। বৌদি তখনি সে ব্যবস্থা করেছে অবশ্য। তবে দুষ্টু ছেলেটা সব মনে করে রেখেছে আর আমি তাকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যাচ্ছি শুনলেই বলে। 
হঠাৎ চঞ্চল বলল-‘কাকু, গাড়ির সিটি বাজছে…হয়তো ছাড়বে…’
তা ঠিকই। গাড়ী চলতে শুরু করেছে। কিন্তু গন্তব্যে হাজির হতে যে রাত দশটা বাজবে, তা কে জানতো? নেমে দেখি স্টেশন জনমানবহীন। সামনের রাস্তার একমাত্র চায়ের দোকানটা ও বন্ধ হয়ে গেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ও পড়ছে। আট দশটা সিঁড়ি ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে দেখি না আছে কোন লোক আর না আছে গাড়ী। এখন উপায়? 
আমাদের জন্য যে বাড়ী ভাড়া করা হয়েছে সেটা এখানকার ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ির দিকে। ডানদিকের পথ ধরে যেতে হয় । তা জানি কিন্তু পথে লাইটের বালাই নেই। শুধু মোবাইল টর্চ নিয়ে তিন চার মাইল পথ কি করে যাই এখন? বাঁ দিকে গেলে একটা গেষ্ট হাউস আছে জানি তা সেও মাইল দুই পথ…আর এখন খোলা যে নেই তা বলাই বাহুল্য। এই না হলে দাদার ব্যবস্থা। নইলে কি আর একটা চোরাকারবারী বা উগ্রপন্থী ধরতে হ’লেই বাদলকে ডাকতে হয়।
জয় মা দুর্গা বলে চঞ্চলের দুধবরণ ডানহাতটা ধরে কিট ব্যাগ কাঁধে মোবাইল হাতে পথে নেমে পড়লুম। আগেই নেটের উইকিপিডিয়া থেকে সব বিবরণ না পড়ে এলে বিপদ হয়ে যেত। চঞ্চল অবশ্য ঘাবড়ে যাবার মতন ছেলেই নয়।সেই নেট খুলে সব পড়েছে আগে।আমাকে দিয়েছে প্রিন্টআউট। 
বলল-‘বাপির সব কাজ এমনই হয়, কাকু। চলো আজ গেষ্ট হাউসেই থাকি। কাল সেই বিজন ভবনে গেলেই হবে। আমি কলিং বেল বাজিয়ে সবাইকে জাগিয়ে ছাড়বো’।
অন্ধকারে পথ চলা সুবিধের কাজ মোটেই নয়। তেরো বছরের ছেলে চঞ্চলের কষ্ট হলে ও বলবে না জানি। কিন্তু আমার মেজাজ খিঁচড়ে গেছে তখন বেশ।
আমি রাগ করে বললুম-‘দশমপতির না নিকুচি করেছে’।
হিঃ হিঃ করে হেসে ফেলে চঞ্চল বলল-‘কাকু, আমার দশমপতি কিন্তু খুব ভালো। স্বগৃহী ও চন্দ্রযুক্ত। তোমার রাহু মার্কা দুষ্টু পাজী উগ্রবাদিরা কিছু করতে পারবে না….আরে …কাকু, সাবধান…আগে মনে হয় একটা গাড়ী আসছে…পুলিশের গাড়ী কি না তা কে জানে। ডাকাতদের ও হতে পারে। হয়তো লিফ্ট দিতে চাইবে যেচে…এই কলাগাছগুলোর আড়ালে চলে এস…কুইক..দেখে না ফেলে…কলাগাছ গুরু সহায় হোক…’
গাড়িটা সন্দেহজনক ভাবেই আসছে যে তা ঠিক। ধীরে ধীরে এবং পথের দুইধারে টর্চের আলো ও ফেলছে আরোহিরা। হয়তো পুলিশেরই গাড়ী। আর তা না ও হতে পারে। সাবধানের মার নেই। আমি চঞ্চলকে নিয়ে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হলুম। হঠাৎ দড়াম করে একটা জোর শব্দ হয়ে গাড়িটা থেমে গেল। 
‘হুঁ…চাকা গেছে…’
‘এ যাওয়া কিন্তু আপনা আপনি যাওয়া নয় কাকু, মনে হয় সাইলেন্সারযুক্ত রিভলবারের গুলী….….আমি অস্পষ্ট শব্দ শুনেছি। শিগ্গীর উল্টোপথে পালাও…খন্ডযুদ্ধ বাধল বলে এখানে। এইজন্য আমাদের গাড়ী ছিল না স্টেশনে। তখন বুঝতেই পারিনি। আমি একটা গাধা তো …বাদল হলে ঠিক..’
সে’খানে ততক্ষণে দুম দাম দড়াম শুরু হয়ে গেছে সত্যিই। আমি গেষ্ট হাউসের মায়া কাটিয়ে উল্টোপথে বিজন ভবনের উদ্দেশ্যেই দৌড় দিলুম তখনি চঞ্চলের হাত ধরে। পিঠে ভারী কিটব্যাগ না থাকলে চঞ্চলকে তুলে নিতুম…ভারী তো একটা ছোট ছেলে… তা ও রোগামতন…
একঘন্টা পরে পথের আন্দাজ নিয়ে যে নির্জন বাড়িটার কাছে এসে হাজির হলুম তাকে বিজন ভবন বেশ বলা যায়। একেবারে ভূতুড়ে বাড়ী …গেট আছে তবে তালা নেই। ঠেলে ঢোকা যায়। কয়েকবার কেউ আছেন কি না জানবার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষে ঢুকে পড়লুম। সোজা কাঁচা পথ চলে গেছে। দু’পাশে ঝোপঝাড়…আগাছার জঙ্গল…বিরাট জায়গা নিয়ে বাড়ী..  
আর যা ঠান্ডা…কি যে করি…শীতকালে কেউ আসে রাতে এমন অজানা জায়গায়? চঞ্চলের হাতটা তখন বেশ কাঁপছে দেখছি।
ব্যাগ থেকে একটা ছোট শাল বার করে ছেলেটার গায়ে জড়িয়ে দিলুম চট করে।
চলতে চলতে পথের পাশে একটা ভাঙ্গা মতন ঘর পড়ল। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি কতকগুলো কোদাল কুড়ুল শাবল আর ময়লা পোষাক পড়ে আছে। মালিদের পোষাক বলে মনে হলো। একটা পুরনো নীল লুঙ্গি, লাল গামছা, হলদে মতন কোর্তা, কালোমতন ছেঁড়া আলোয়ান এমন কি একটা পুরনো কম্বল আর লন্ঠন ও আছে যার হ্যান্ডেল ভাঙ্গা৷ থাক গিয়ে সব পড়ে….
আমি আবার পথ ধরলুম। দূরে কোথাও একটা কুকুর কাঁদছে…গাছে পেঁচার চেঁচানি শোনা যাচ্ছে। গুলিগোলার শব্দ তখন থেমে গেছে। ঝিঁঝিঁ আর মশার তান ও বেশ জোর শোনা যাচ্ছে।দিব্যি ব্যাঙ ডাকছে কাছেই  কোথাও। মনে হচ্ছে খাঁটি গ্রামবাংলার পথে চলেছি। এখন চলতে চলতে অন্ধকারে ঝপাং করে একটা পুকুর বা ডোবায় পড়তে পারলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়।
এইবার একটা জীর্ণ দু’তলা বাড়ির সামনে এসে পড়লুম আমরা।
পথ শেষ।
সামনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তারপরে একটা তালাবন্ধ বিরাট দরজা।
‘কেউ আছেন?’
‘কে?’
‘আমরা যারা ভাড়া নিতে চাই এই বাড়ী’।
‘দাঁড়ান….আসছি…’
যাক। ভয় নেই …লোক আছে তবে…হয়তো ঘুমিয়ে ছিল।
নাঃ দরজা খুললো না। বাড়ির কোন ঘেঁষে এক মূর্তি লন্ঠন হাতে এগিয়ে এল। পরনে লুঙ্গি গায়ে কোর্তার ওপরে মোটা আলোয়ান এক হাতে লাঠি অন্য হাতে সুতলি দিয়ে হ্যান্ডেল বাঁধা মিটমিটে হ্যারিকেন্। খালি পা।
‘মালিকের কাছ থেকে দরজার চাবি এনেছেন, বাবু?’
‘হ্যাঁ’
‘দিন তবে। সদর খুলতে হবে। আপনাদের ঘর বাথরুম ও খুলে দিই। আসুন। ঘর দোর সাফ করাই আছে। অসুবিধে হবে না তবে এত রাতে এলেন। খাবেন কি’?
‘খাবারের কোন দরকার নেই’
‘সঙ্গে কে? আপনার ছেলে?’
‘হুঁ’
‘প্রতিবন্ধী…’
‘হুঁ…’
‘তবু সঙ্গে না আনলেই পারতেন। এই সব জায়গা তো ভালো নয়। বাচ্ছা ছেলেকে সামলাতে পারবেন?  এ’খানে বড় ঝামেলা চলছে এখন। খালি গুলী গোলা চলছে…সে যাক। এনেছেনই যখন, একটু সাবধানে থাকবেন। দরজা খুলে রাখবেন না ভূলে ও আর একলা ও ছেড়ে দেবেন  না ছেলেকে। একমিনিট ও নয়। বিপদে পড়ে যাবেন খুব। জঙ্গী হামলা হতেই পারে।বুঝতে পারছেন?’
‘হুঁ…’
‘আমি এখানে কিন্তু রাতে থাকি পাহারায়। তবে দিনে অন্য কাজ করি। যা দরকার হবে আগে বলে দিলে আমি সন্ধ্যের সময় এনে দিতে পারি’।
‘আচ্ছা, আমি কাল সব বলে দেব। তুমি এখন যাও’।
‘ঠিক আছে বাবু। একটু সাবধানে থাকবেন ছেলেকে নিয়ে…দরকার পড়লেই ডাকবেন।’
তা সে বাড়িতে লাইটের বালাই নেই বটে কিন্তু বেশ বড় বড় ঘর। রান্নাঘর…বৈঠকখানা..বাথরুম সহ শোবার ঘর। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন…কে বলে ভূতুড়ে বাড়ী? বাথরুমে জল ছিল বালতিতে আর খাটে গদী সহ বেডকভার ও কম্বল। আর কি চাই। দুটো বেডরুম ছিল। আমি একটাই খুলতে বললুম। সে টেবিলে বাতিটা রেখে চলে যেতে আমি আগে দরজা এঁটে দিয়ে ব্যাগ খুলে ব্রাশ পেষ্ট সাবান রাত পোষাক ও খাবার বার করে বাথরুমে গেলুম। বেশ বড় বাথরুম। একদিকে বেসিন শাওয়ার কল জলের বালতি মগ ও অন্যদিকে বাথটব আর ড্রেস ক্যাবিনেট। দরজা নেই অবশ্য তার। খোলা। সে যা হোক।তখন ও একবার আমার মনেই হ’ল না যে বন্ধ বাড়িতে এতো সব ব্যবস্থা করলে কে আর কি ভাবে?
 তাড়াতাড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে ঢিপ করে বিছানায় লম্বা হলুম। তখন আমার বেশ শীত করছে। কম্বল টেনে নিয়ে বললুম-‘চঞ্চল, এখানে কিন্তু রাতে খুব ঠান্ডা। জ্যাকেট পরেই এসে শুয়ে পড়ো আজ’।
‘যাঃ, কাকু,তুমি না যেন কি। ভীষণ শীত কাতুরে ছেলে একটা। কাল হয়তো বলবে জামা প্যান্ট পরেই চান করে আয়…হিঃ…   হিঃ…   হিঃ…’
রাগ করে বললুম-‘ তা বেশ তো বাপু। শীত নেই তোমার কাছে সে তো ভালো কথাই। তবে তুমি না হয় কিছু না পরেই এসে শোও। আমার কি? হুঁ….’
নিজের চশমা ঘড়ি জ্যাকেট আর জামা প্যান্ট খুলে একটা চেয়ারের ওপর রেখে চঞ্চল নিজের টানা টানা চোখ দুটোকে আর ও বড় বড় করে বলল-‘এ মা ছিঃ… আমি কি তোমার কাছে একটা কচি বাচ্ছা ছেলে…আমার বয়স তেরো কবে পুরো হয়ে গেছে না….তা কাকু, যে লোকটা আমাদের ঘর খুলে দিল ও কে জানো?’
‘নাঃ…মনে হয় কেয়ার টেকার..বলছিল তো পাহারা দেয়’
‘আচ্ছা, ওর পোষাকটার দিকে তুমি নজর দিয়েছিলে কি, কাকু?’
‘নাঃ, অতি সাধারণ পোষাক তো। আলোয়ানটা অবশ্য…’
‘কালো?’
‘রাতে কি ঠিক রং বোঝা যায়? এখন ঘুমোও তো। তা জ্যাকেট না হয় শার্ট প্যান্টটা অন্তত পরে শুলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না কিছু এই ঠান্ডাতে। শুধু অন্তর্বাসের ওপর এই পাতলা সিল্কের রাত পোষাকে শীত করবে যখন তখন বুঝবে। তায় অপরিচিত জায়গা …কখন যে কি হয়…হুঁ…’    
দিব্যি ঘুমোচ্ছিলুম । ভোর রাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল আমার। লন্ঠনটা মনে হ’ল নিভে গেছে। ঘর অন্ধকার। আর বাইরের দিকের বন্ধ জানলায় খুট খুট করে শব্দ হচ্ছে থেমে থেমে…জানলা বন্ধ..গরাদে ও আছে…কেউ ঢুকতে পারবে না সহজে…তবে?  
নাঃ, উঠে দেখতে হবেই একটু যে ব্যাপারখানা কি হচ্ছে কিন্তু কি করে উঠি? চঞ্চল দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে অভ্যাসমতন। এখন আমি উঠতে গেলেই ছেলেটার ঘুম ভাঙবে আর কথা বলে ফেলবে । এখন আমার লাইটার পদ্ধতি ব্যবহার করতেই হবে। আমার দাদার আমদানী… বিদেশে তৈরী একটা স্প্রেয়ার। অ্যানেস্থেটিক। খুব সামান্য প্রয়োগ করলেই ঘুম গাঢ় হয় বেশ। বিদেশে সব চুরি অপহরণকারিরা ব্যবহার করে আজকাল।
চঞ্চলের হাত সরিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে জানলার কাছে যেতেই একটা মি্ষ্টিমতন উগ্র গন্ধ পেয়ে চমকে উঠলুম। ওরে বাবা। জানলার পাল্লার ফাঁক দিয়ে নল দিয়ে ক্লোরোফর্ম দিচ্ছে না কি অন্য বিষাক্ত কোন গ্যাস। এই সেরেছে। আমরা ধরা পড়ে গেছি তবে। এখন দম বন্ধ করে ঘুমন্ত ছেলে চঞ্চলকে নিয়ে বাইরে পালাতে হবে তিন সেকেন্ডের মধ্যে।   
নাঃ, জানলাওয়ালা ঘরের বিপদ কম নয় দেখছি। আগে কম্বল কাঁধে ফেলে তারওপর চঞ্চলকে তুলে নিয়ে কম্বলে জড়িয়ে এক লাফে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম ঘর থেকে। তবু ও সামান্য যা গ্যাস নাকে গেছিল তাতেই তখন আমার মাথা ঘুরছে। বুঝতেই পারছি ক্লোরোফর্ম নয় বিষাক্ত গ্যাস কোন। বসবার ঘর অবধি এসেই ডিভানে আমি কাত হয়ে পড়লুম চঞ্চল সমেত। 
আচ্ছন্ন অবস্থায় মনে হ’ল বাইরে তখন জাগছে দুম দাম শব্দ আর কাদের অন্তিম আর্তনাদ।তারা কারা? আর কেনই বা চেঁচায় অমন করে? আর কিছু আমার মনে রইল না।
যখন হুঁশ ফিরল তখন ভোর হয়ে গেছে। ছ’টা বাজছে। চঞ্চল পাশে তখন ও শুয়ে ঘুমন্ত। সব মনে পড়ল রাতের ব্যাপার একে একে। আগে চঞ্চলকে জাগিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালুম। শোবার ঘরের সামনে আগাছার বাগান দেখা গেল কিন্তু কেউ নেই। সেই কেয়ারটেকারের ও পাত্তা নেই কোথা ও। কাল রাতে আমি স্বপ্ন যে দেখিনি তা ঠিক কিন্তু এখন কিং কর্তব্য? সব জায়গাটা চট করে ঘুরে দেখে নিতে হবে তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। 
তাই করলুম। কেয়ারটেকার বা চৌকিদার বেপাত্তা। ফিরে এসে ব্রাশ করে নিয়ে আগে খাবার দাবার কি মেলে কোথায় তাই দেখতে যেতে হল। চঞ্চলকে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে দিলুম। বেরিয়ে দেখি ধারে কাছে কোন দোকানপাট নেই। সেই স্টেশন এলাকায় যেতে হবে হয়তো। রিক্সা ও নেই। হেঁটেই যাচ্ছি। এক জায়গায় দেখি লোকজন জটলা করছে। কাছেই একটা ঘর। দরজা খোলা। ভেতরে দু’জন লোক মাটিতে পড়ে আছে। জীবিত না মৃত কে জানে? এবং একটা আধভাঙা লম্বা গ্যাস সিলিন্ডার আর পাইপ পড়ে আছে। ভীড়ের মধ্যে এক রিক্সাওয়ালা ও আছে দেখে তাকে ডেকে বাজারে চল বলে উঠে বসলুম। আমার বুঝতে তখন বাকি নেই যে কাল রাতে এই দুই মাহাত্মারই আগমন হয়েছিল আমাদের পরপারের যাত্রায় পাঠাবার জন্য। হয়তো দৈবযোগে সিলিন্ডার ফেটে নিজেরাই মরেছে কি্ন্তু তাদের সবসুদ্ধু এখানে টেনে আনলে কে?
কিছু খাবার দাবার কিনে নিয়ে রিক্সায় ফেরবার সময় দেখি তিন চার জন পুলিশ এসে ব্যস্ত হয়ে কি সব জিজ্ঞাসাবাদ করছে লোকজনদের আর ভীড় হাল্কা হয়ে আসছে। আমি সোজা সেই বিজন ভবনের সামনে এসে নামলুম। ডাকতে চঞ্চল এসে দরজা খুলে দিল। দেখা গেল তখনো বাড়িতে কেউ নেই আর।
নাঃ, ব্যাপার সুবিধের নয় বলে মনে হচ্ছে। দুপুরেও কিছু জোটবার আশা নেই বরাতে। এমন বাড়িই দাদা ঠিক করেছে একটা…. জনমানবহীন…  জলখাবার খেয়ে দাদাকে ফোন করলুম। তা সে ও দেখি চলে না খালি সোঁ সোঁ শব্দ হয় আর কে যেন রেগে মেগে বলছে- ট্রেনের চাকার নীচে ফেলে দে শালাদের আজ রাতে…। 
ওরে বাবা…বলে কিনা এই শীতের রাতে রেললাইনের ধারে…আবার চাকার নীচে উঃ উঃ …
চঞ্চল হিঃ হিঃ করে হেসে বলল-‘কাকু, ও তোমাকে বলছে না …ক্রস কানেকশান…বুঝছো না কেন?’
‘হুম…বিকেলের আগে আমি এখন আর এই শীতে কোথাও বেরুচ্ছি না বাবা। আমি এখন ঘুমোতে চাই…রাত ভোর যা ঝামেলা গেছে…’
‘রাতে কিসের ঝামেলা গেছে, কাকু?’
‘উঃ যা শীত….চল, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে সব বলছি…’
সব শুনে চঞ্চল বলল-‘কাকু, এই জায়গাটা ঠিক ভালো নয়। মনে হয় আশে পাশে কেউ বা কারা আমাদের ওপরে সব সময় নজর রাখছে’।
‘রাখুক গিয়ে…দিনের বেলা কিছু করতে সাহস পাবে না। তাই এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।  রাতে তো রেল লাইন নাচছে কপালে…’
তা চৌকিদারের আর পাত্তা নেই দেখে বাধ্য হয়ে বিকেলে আবার বেরুতেই হ’ল আমাকে। 
চট করে কিছু খাবার দুধ ফল জোগাড় করেই ফিরে এসে দেখি অন্ধকার হয়ে আসছে আর চঞ্চল দরজাই খুলছে না। বার তিনেক ডেকে চিন্তায় পড়ে গেলুম বেশ। কি করি ভাবছি, হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে হলদে টি শা্র্ট আর শাদা প্যান্ট পরে চঞ্চল দাঁড়িয়ে হাসছে। 
ছেলেটার মুখটা অন্ধকারে ঠিক দেখতে পেলুম না তবে পোষাকটা চঞ্চলেরই। আমি চিনি।
রাগ করে কিছু বলবার আগেই ছেলেটা নীচের তলার একটা অন্ধকার ঘরে ছুটে পালাল মনে হল। সঙ্গে টর্চ নেই তাই আমি ওপরে উঠে এলাম আগে। এসে খাবার রেখে টর্চ নিয়ে নীচে যাব বাথরুমে জল পড়বার শব্দে চমকে থেমে যেতে হল। 
বাথরুমে কে? 
চঞ্চল তো নীচে…বাথরুমে তবে কে? মনে হ’লো আমার আর শীত লাগছে না উল্টে গরম হচ্ছে যেন। কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে আমার অনুপস্থিতিতে। আমি আমার লাইটার বার করে হাতে নিয়ে বাথরুমের দরজা একটু ফাঁক করেই চমকে উঠলুম। দিনের বেলায় আজ ছেলেটাকে নিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম তাই এখন দেখি চঞ্চল দিব্যি করে নিজের চান সেরে নিচ্ছে ভিতরে…. যেন গরম কাল পড়েছে। আমি চুপ। তখন আমার মাথা ঘুরছে বেশ। সামনে লন্ঠনটা না জ্বললে সন্দেহ হতে পারতো যে ছেলেটা চান করছে সে চঞ্চল কি না। এখন আর সে অবকাশ নেই।
চঞ্চল চান শেষ করে তোয়ালে দিয়ে গা মুছে ড্রেস ক্যাবিনেটের কাছে গিয়েই চমকে উঠে বলল-‘আরে যাঃ, এ কি কান্ড রে বাবা? আমার পোষাক? এইখানেই তো রেখেছিলাম আমি। গেল কোথায়?...তবে কি ভূলে ঘরেই ফেলে রেখে চলে এসেছি? এমন ভূল তো আমার হয় না কখনো চানের সময় । অবশ্য কাকুর জন্য নিজে নিজে চান করা অভ্যাস নেই তাই ভূল হতেই পারে।এখন আমি পরবো কি? তোয়ালেটা ও তো ছাই ভিজে গেছে দেখছি গা মুছতে গিয়ে। কাকু ও নেই যে অন্য ড্রেস এনে দেবে ব্যাগ খুলে।…ভালো মুশ্কিল হচ্ছে তো আমার’
আমি চট করে সরে এলুম বাইরে। চঞ্চল ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে খালি গায়ে লন্ঠন হাতে ঘরে এসেই আবার বলে উঠল-‘এই সেরেছে…ঘরে ও তো কোথাও নেই আমার জামা প্যান্ট। এখন উপায়? ..কাকুর কম্বল ভরসা দেখছি …’
তখন আমি ঘরে ঢুকতেই চঞ্চল বলে উঠল-‘বাঃ, আমার ভাগ্য ভালো দেখছি কিন্তু কাকু তুমি এলে কি করে? সদর দরজা তো আমি বন্ধ করে…’
আমি আগে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ব্যাগের তালা খুলে চঞ্চলের অন্য কাচা জামা প্যান্ট বার করতে বসে বললুম-‘চঞ্চল, তুমি যে পোষাক বাথরুমে রেখেছিলে তার রং কি ছিল?’
‘একটা তো হলদে টি শার্ট…’
‘আর শাদা প্যান্ট তো?’
‘তু…তুমি কি করে জানলে, কাকু? তুমি তো যখন পোষাক বার করেছি আমি তখন দেখই নি…’
‘তখন দেখিনি ….এখন দেখেছি বলে জানি…’
অপরূপ সুন্দর ভ্রুজোড়া কুঁচকে আর চোখ বড় বড় করে ছেলে বললো-‘তার মানে, কাকু?’
‘তার মানে হচ্ছে এই ….যে এটা হচ্ছে শীতকাল…আর ভিজে তোয়ালে পরে বেশীক্ষণ থাকলে নিমোনিয়া হয়… আর শীতকালে অন্তর্বাস পরতেই হয় আর সোয়েটার ও লাগে…যা তুমি ব্যাগ থেকে বের করতে ভূলেছিলে বিকেলে …যখন আমি বাথরুমে ছিলাম তখন…আর তোমার সেই পোষাক এখন হয়তো নীচে কোথাও পড়ে আছে… এখানে নেই… ‘
‘নীচে? তার মানে? কাকু, আমি তো কিছুই…’
‘এই না…চুপ…আর কোন কথা নয় এখন..’ 
চঞ্চলের ঠান্ডা চকচকে মসৃণ দুধসাদা নরম ডান হাতটা ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নিলুম আমি। শীতে ছেলেটা কাঁপছে ঠকঠক করে তবে তার অপরূপ সুন্দর মুখ নির্বিকার।ছেলের পরণের ভিজে তোয়ালেটা খুলে সরিয়ে রেখে দিয়ে আমি বললুম-‘এখন আগে সব পোষাক পরে নাও…..তারপরে…..’ ।
এক এক করে সব পোষাক ও একটা পুলোভার পরিয়ে দিয়ে চঞ্চলের হাতে চশমাটা দিয়ে বললুম-‘পরে নিয়ে নীচে চল তোমার পোষাক গুলো আনতে হবে তো’।
আমার কথা শুনে কিছুই না বলে শুধু মুখে একটা অপরূপ ভঙ্গি করলো ছেলে। 
যার মানে আমি জানি। মানেটা হচ্ছে আমি কিন্তু কিছুই বুঝছি না তোমার কথা।
খুব কম কথা বলে কিন্তু অতি রূপবান ছেলে মেয়েদের সুন্দর মুখের এমন অনেক সুদৃশ্য ভঙ্গি থাকে যার মানে বোঝাই দায়। এক তাদের মা বাবা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতেই পারবে না। যেমন চন্চল এতোবড়ো ছেলে হয়েছে কিন্তু ছোটবেলার মতন কখনো আমার কোলে বা পিঠে উঠতে ইচ্ছে হলে লজ্জায় মুখে কিচ্ছুটি বলে না শুধু একবার নিজের পাতলা গোলাপী ঠোঁট উল্টে হাসে….বা গল্প শুনতে হলে আমার গলা ডানহাত দিয়ে একবার জড়িয়ে ধরে চোখ বড় করে আর হাতটা সরিয়ে নেয় নিমেষে।বেড়াতে যেতে হলে বাঁ হাতে আমার হাতধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি শুধু ছেলের এই ভাষা।   
নীচে গিয়ে আমি টর্চ জ্বেলে যে ঘরে সেই ছেলেটাকে গিয়ে ঢুকতে দেখেছিলাম সোজা সেই ঘরে ঢুকে পড়লুম। টর্চের আলোতে    দেখেই চঞ্চল বলে উঠল-‘আরেঃ…. এই তো আমার জামা প্যান্ট…ধূলোর মধ্যে পড়ে…যাঃ সব নোংরা হয়ে গেছে…’
‘চল… ও’গুলো নিয়ে ওপরে যাই। তার আগে দেখে যাই এই ওয়ারড্রোবে কি আছে?’
‘ও…ওরে বাবা…সব পুরণো পোষাকে ভর্তি দেখছি যে…এমন কি খাকি পোষাক ও আছে দেখছি অনেকগুলো। হয়তো কোন পুলিশের ড্রেস হবে….’
‘আমার কি্ন্তু কেমন ভয় ভয় করছে, কাকু…এতো সব পোষাক কাদের? ব্যাপার দেখে মনে হয় …’
‘কিচ্ছু মনে হয় না…তবে আজ ও আক্রমণ হবেই…আর প্রতিফল ও পাবেই তারা হাতে হাতেই। তোমার বাপী অতি চালাক পুলিশ অফিসার…ইচ্ছে করেই এই বাড়িটা জোগাড় করেছে খুঁজে পেতে আমাদের জন্য… ওপরে চল….খাবার দাবার খেয়ে নিয়ে সব বলছি…নইলে যা ঠান্ডা…রাতে রেল লাইনের ধারে আমি যাচ্ছি না বাবা….হুঁ…সে যে যাই বলুক…বড় জোর একটা গাছে চড়া যেতে পারে ’
চঞ্চল চোখ দুটো বড় বড় করেই সামলে নিয়ে বলল-‘আমি গাছে চড়তে পারি,কাকু…’
খেয়ে দেয়ে উঠে কম্বল জড়িয়ে বসে সব বলতে হলো। শুনে চঞ্চল বলল-‘কাকু, সেই ছেলেটা তবে কে ছিল?’
আমি চঞ্চলকে কম্বল দিয়ে ভালোকরে জড়িয়ে নিয়ে বললুম-‘কে জানে? তবে তার কাছে ছোট ছেলের পোষাক যে ছিল না তা ঠিক…আর আজ রাতে আমাদের ঘুম ও নাস্তি। অতিথিদের স্বাগত করতে হবে যে…’ 
রাত বাড়ছে সাথে ঠান্ডা ও। আমি সেই লন্ঠনটাই জ্বেলে নিয়েছিলাম।           
দশটা বাজলো…..এগারোটা….বারোটা….নাঃ আর অপেক্ষা নয়। পুরো গরম পোষাক পরে ব্যাগ নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে সামনের বাগানে একটা গাছে আগে চঞ্চলকে তুলে দিয়ে নিয়ে নিজে ও উঠে পড়লুম।কোথা ও জনমানবের সাড়া নেই। আকাশ ও মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি যদি হয় তো হবে সঙ্গে রেনকোট আছে …..দেখা যাক আজ কি হয়।
অনেকক্ষণ বসে বসে ঝিমুনি এসে গেছিল আমার। 
হঠাৎ কিসের শব্দে চটকা ভেঙ্গে দেখি আমার গায়ে স্ট্র্যাপ আটকানো। এটা ছেলের কাজ তা ঠিক যাতে আমি পড়ে না যাই। তার মানে আমি ঘুমিয়ে ঢুলে পড়ছিলুম আর ছেলেটা ঠায় জেগে বসে আছে……তবে শব্দটা কিসের? 
আরেঃ….. গেটটা আস্তে আস্তে আপনিই খুলে যাচ্ছে যে। ভূত না কি। নাঃ তিন চারটে জন্তুর মতন কিছু গেট ঠেলে ঢুকছে। কি জন্তু ওগুলো? কুকুর না শেয়াল?চন্চলের দুধসাদা হাতদুটো অন্ধকারে ও দেখা গেলো। 
সে হঠাৎ নীচু হয়ে গাছের একটা ডাল দু’হাতে চেপে ধরেই ছেড়ে দিলো।তার মানে ওরা জন্তু নয় মোটেই….মানুষ….তবে হামাগুড়ি দিচ্ছে …ওঃ হরি ….এই ব্যাপার তবে। ভূত ও নয় জন্তু ও নয়। চার পাঁচটা জন্তু একটা ঝোপে ঢুকতেই বাড়ির দরজাটা খুলে গেল আর আকাশে জাগলো ঘন ঘন বিজলীর চমক আর মেঘের ডাক….যা  আসলে বাজের শব্দ…সেই আলোতে দেখি খাকি পোষাক পরা একজন পুলিশ বেরিয়ে এলো দুহাতে দুটো পিস্তল নিয়ে। 
দড়াম দড়াম শব্দ শুরু হলো আর…ঝোপের মধ্যে জাগলো আর্ত চিৎকার….
ভীষণ শব্দে বোমা ফাটলো একটা ….ঝোপ থেকে ঠিকরে এসে। একেবারে খাকি পোষাক টুপি পরা লোকটার কাছে। 
ঝপ করে পড়ে গেলো সে। পরক্ষণেই আবার উঠে দাঁড়ালো। তৎক্ষণাৎ পেট্রল বোমা এসে পড়লো তার গায়ে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। মুহুর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো পুলিশের সেই লোকটা।       
গেট দিয়ে আবার এসে ঢুকলো তিন চারটে কুকুর আবার আর বাড়ীর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো সেই পাহারাদার। সেই কালকের পোষাক….
হাতে সেই লন্ঠন। আলোটা সে একটু উঁচু করলো । আলোটা জোর হয়ে উঠলো….হু হু করে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো আর হাওয়ায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়ায় সবদিক যেন আরো ঘোর অন্ধকার করে তুললো।
কুকুর মানুষদের সবারই দম আটকে যাবার মতন অবস্থা হতেই গুলী চালাতে শুরু করলো ঝোপ থেকে আগন্তুকের দল আর পাহারাদার নৃত্য শুরু করলো ।বন বন করে ঘুরছে সে।দেখাই যাচ্ছে না তাকে।বাধ্য হয়ে আবার পেট্রল বোমা ছুঁড়ে তার গায়ে দাউ দাউ করে আগুন ধরিয়ে দিতেই সে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। নিশ্চিন্তি মনে সবাই বেরিয়ে এলো ঝোপ থেকে আর তখনি আবার খুলে গেল দরজা।
পিস্তল হাতে বেরিয়ে এলো সেই পুলিশ ইন্সপেক্টার আর এসেই গুলী বর্ষণ। কুকুরগুলো খতম। তিনজন লোক । 
একজন লাইট মেশিনগানের মতন কিছু চালাতে শুরু করলো।ঝাঁঝরা হয়ে গেল পুলিশ। গড়িয়ে পড়ে নিশ্চল হয়ে গেল সে মাটিতে ।আবার খুলে গেল দরজা আর হাতে লন্ঠন নিয়ে যেই এক পাহারাদার বেরিয়ে এসেছে অমনি …বাবা রে… মা রে…. বলে বিকট চিৎকার করে পালাতে শুরু করলো সে হাতের অস্তর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।
ধীরে সুস্থে পাহারাদার গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে লন্ঠনটা একটু বাড়িয়ে দিলো আর কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে এসে সব অন্ধকার করে দিলো। বাইরে যারা ছিলো তারা বেদম হয়ে কাশতে আরম্ভ করলো আর একটা গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিলো সেই পাহারাদারকে দড়াম ধাঁই শব্দে।
ধীরে ধীরে তখন আবার বাড়ির দরজাটা খুলতে শুরু করেছে আর হাতে দুই পিস্তল নিয়ে দিব্যি সেই পুলিশ বাবাজী বেরিয়ে আসছেন নাচতে নাচতে। আবার গুলী গোলা বর্ষণ…..কিন্তু ভয় বড় শত্রু….পাহারাদার আর পাহারাওলার শেষ নেই দেখে অতি বড় সাহসী ও পালাতে বাধ্য হবেই। তাই হ’লো। তবে সে মাত্র একজন……….. ছুটে পালিয়ে গেলো।
তখন গুলীবর্ষণ থামিয়ে পুলিশ তার পিছনে হাঁটতে লাগলো আস্তে ধীরে।   
লোকটা যতো ছোটে ততই সে হেঁটে এগিয়ে যায় তার কাছে। নদীর কাছে গিয়ে সে একটা ঝোপে অদৃশ্য হলো।
ততক্ষণে আমি গাছ থেকে নেমে একলাই তার পিছু নিয়েছি চন্চলকে না সঙ্গে নিয়ে।
এরা বড় ভয়ঙ্কর …ছেলেটাকে গাছ থেকে নামতে বারণ করে এসেছি কিন্তু এসে দেখি কোথায় পুলিশ?সেই পাহারাদার লন্ঠন হাতে ঝোপটা পরীক্ষা করছে…আমাকে দেখে বললো-‘একবেটা সরে পড়বার তাল করছে….তা আপনার ছেলে কোথায়, বাবুজী?’
‘বাগানে আছে….’
কিন্তু সে তখন দূরাগত কোন শব্দ কান খাড়া করে শুনছে….হঠাৎ বললো –‘বাবুজী, লোকটা বিদেশী শয়তান। মতলব ভালো নয়।ওপারেই অন্য দেশ। মনে হয় নদী পার হয়ে এসেছে তবে ওপর দিয়ে নয় নীচে দিয়ে। 
‘টানেল?’
‘’মনে হয়। আপনি এক্কা চালাতে  পারেন?’
‘না…’
‘তবে ছুটে বাগানে চলে যান এখনি আর গিয়েই ছেলেকে নিয়ে সামনে যদি বাইক পেয়ে যান তো ভালো নইলে এক্কাটায় উঠে পড়বেন। সাবধানে। বহু পুরণো গাড়ী….ভাঙাচোরা….তবে চলবে…সময় খুবই কম …ওরা টানেলটা আমাদের খুঁজে পেতে দেবে বলে মনে হয় না…উড়িয়ে দিলে কিছুই করবার নেই….কেন যে কচি ছেলেটাকে সঙ্গে করে আনতে গেলেন আপনি….এখন আর ওদের পিছনে ছুটতে পারবো না …নদী পার হতে অন্তত বিশ মিনিট লাগবে…যতই দৌড়ে যাক…আর তার মিনিট পাঁচেক তো কেটেই গেছে আপনার সাথে বাজে কথায়…এখন দৌড় দিন …তিন মিনিটে গাড়িতে উঠে পড়া চাই….’
আমি পিছন ফিরে দৌড় দিলুম…নাঃ বাইক কোথায়?একটা খালি এক্কা গাড়ী পড়ে আছে গেটের সামনে তবে কোন ঘোড়া  ও নেই…এখন উপায়? ভাঙ্গা গাড়িটা হয়তো আগে ও ছিলো পড়ে, আমিই দেখি নি।
শিষ দিয়ে চন্চলকে ডাকলুম।ছেলেটা গাছ থেকে নেমে ছুটে এলো। আমি গাড়িটা সোজা করে দিলুম একটা পাথরের ওপরে গাড়ির সামনের বাঁকা হাতলদুটো রেখে….তিনমিনিট কাটছে ….ঘড়ি দেখে আমি ও উঠে পড়লুম এক্কাতে…চঞ্চলকে আগে তুলে দিয়ে। .একটা কালো জিনিষ ছুটে এলো তীরবেগে আমাদের দিকে….পাহারাদার না কি?না ঘোড়া? 
কুঁজো হয়ে গেছে সে যেন ছোটবার বেগে…ঝাঁকি দিয়ে এক্কা সোজা হয়ে গেল…উঁচু হয়ে উঠলো ঠিক যেন ঘোড়া যুতে দিলো কেউ আর তখনি ঝপাত করে ধূলোমাখা একগাদা পোষাক মানে কুর্তা আলোয়ান এই সব এসে আমাদের মুখ মাথায় পড়ে হাওয়ায় জড়িয়ে গেল….প্রচন্ড গতিতে ছুটছে তখন এক্কাগাড়ী…..
আমি একহাতে চন্চলকে ও অন্য হাতে এক্কার হুড শক্ত করে চেপে ধরলুম …পিঠের ভারী কিটব্যাগটা হাওয়ায় যেন উড়ে যাবার মতন হ’লো….সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে হাওয়া কানের দু’পাশ দিয়ে…মনে হয় ঘন্টায় একশো মাইল বেগে….
দূরে হঠাৎ করে জাগলো ভয়ানক এক বিস্ফোরণের শব্দ….সড়ক ধরে অনেকটা ঘুরে নদীর পাকা পুল পার হচ্ছে তখন এক্কা উল্কাবেগে….খটাং খটাং করে জোর শব্দ হচ্ছে চাকায়….বিরাট সেতু….এক মিনিট কাটলো …দুই…তিন…চার মিনিট…..শেষ বার দুই খটাং খটাং হয়ে চাকার শব্দ থামলো….আর ভয়ানক এক জলোচ্ছাসের সঙ্গে হুড়মুড় ধড়াম ধাঁই শব্দ হলো….পিছন ফিরে দেখি অতোবড়ো লোহার সেতুর চিহ্নমাত্র নেই…ভীমবেগে ছুটে আসছে প্রলয় পয়োধি…আমি এক্কার কাঠের পাটাতনে চন্চলকে ফেলে তার পিঠের ওপরে শুয়ে পড়লুম…যত জোরে পারি দুইহাতে এক্কার কাঠ চেপে ধরে…নইলে এই রাজধানী এক্সপ্রেস থেকে উড়ে যেতে হবে আমাদের…….
=নাঃ…সেই ভয়ানক জলস্রোত পিছিয়ে গেছে …আমরা বিপদসীমা পার হয়ে এসেছি…ছেলেটার প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে এ’যাত্রা কাউকেই ধরতে পারলুম না বটে কিন্তু সে চেষ্টা করলে যে ভেসে যেতে হতো আমাকে ও তাও সুনিশ্চিত ছিল ওই ভয়ংকর জলোচ্ছাসে…..নদীর নীচের টানেল বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি এই প্রলয়ের…..যাক…….সুন্দর মুখের জয় হয়েছে চন্চলের….তা ঠিক …এখন এই গাড়ী থামলে বাঁচি …দূরে আলোকমালা দেখা যাচ্ছে মনে হয় কোন টাউন বা বড় শহর আসছে ….মালদা না কি?কে জানে বাবা …..কোথায় এসে পড়লুম আমরা…..

      
=======================
09452003290
=======================
।         












            
রচনাকাল : ২২/১০/২০১৯
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 3  Canada : 14  China : 25  Germany : 2  Hungary : 1  India : 276  Ireland : 4  Poland : 4  Russian Federat : 14  
Saudi Arabia : 5  Sweden : 7  Ukraine : 29  United Kingdom : 2  United States : 422  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 3  Canada : 14  China : 25  
Germany : 2  Hungary : 1  India : 276  Ireland : 4  
Poland : 4  Russian Federat : 14  Saudi Arabia : 5  Sweden : 7  
Ukraine : 29  United Kingdom : 2  United States : 422  
  • ৯ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা (১০২)

    ২০১৯ , নভেম্বর


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
পোষাক by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০০২৫
fingerprintLogin account_circleSignup