প্রকৃতির কাছে
====
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
-----
গৌরব আমার একমাত্র ছেলে।
আগে একটা গল্পে আমি গৌরবের ছোটবেলার কথা লিখেছিলুম।
ছেলেটা যেমন চকচকে ঝকঝকে তেমনিই মিষ্টি আর দারুণ রকমের সুন্দর। আর সেইসাথে আমার
খুব অনুগত বলে ছেলেটা আমার খুব প্রিয়। তা সে এখন একটু বেশ বড় ও হয়েছে। বছর ছয়েক প্রায়
বয়স হবে। তবে ছেলেটার যে বেশ কিছু অতীন্দ্রিয় অদ্ভূত ক্ষমতা আছে সে ঠিক কথা।
শৈশবেই ছেলেটা এক পথ দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে মাতৃহীন হয়ে আমার জন্য বেশ ঝামেলার সৃষ্টি করেছিল।
আমি তখন একলা নিজের অফিস সামলাবো না ছেলে? অসুবিধা তো হবেই। সরকার তো আজকাল
মহিলা কর্মীদের কত সুবিধাই না দেয়। চাইল্ড কেয়ার লিভ, ডিউটি আওয়ার কম করা, ইনকাম ট্যাক্স
বেনিফিট কত কি। যেন বাচ্ছা মানুষ শুধু মহিলারাই করেন। ছেলে মানে পুরুষেরা কিছুই করে না।
তাই আমি অসহায় হয়ে পড়লে ও কিন্তু আমি ওর মামার বাড়ির প্রস্তাবে রাজী হই নি। নইলে তারাই
এসে বলেছিল যে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করে দেবে। শুনিয়ে ও ছিল যে একলা ঘরে কি বাচ্ছা মানুষ হয়?
তাই শুনে গৌরব হেসে উঠে বলে ফেলে ছিল-‘কেন হয়না, মামা? বাচ্ছারা বুঝি মানুষই নয়?
তাই তাদের মানুষ বানিয়ে দিতে হয়?’
ব্যস। সেই না শুনেই গৌরবের মামা মামী ইয়া তুম্বো মুখে সরে পড়েন। আর ছেলেটা ও এক্কেবারে
আমার ঘাড়ে পড়ে যায়। তখন তাকে রোজ নাওয়ানো, খাওয়ানো, সাজানো, পরানো, পড়ানো, স্কুলে
পাঠানো, তার সাথে খেলা করা, জামা কাপড় কাচা এ’সব কি কম সময় সাপেক্ষ কাজ? তা ক্রমে সব
কিছুই বেশ অভ্যাস হয়ে যায় আমার। তবে খুব বেশী ক্লান্ত লাগলে বা মন খারাপ হ’লে চুপটি করে
বসে থাকতুম আমি খানিক। কি আর করা? গৌরব তা বেশ জানতো।
সেদিন ও তাই হয়েছিলো।
অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে চাইল্ড কেয়ার ডে হোম থেকে নিয়ে বাড়ী এসে হাত মুখ ধুইয়ে পোষাক
বদলে দিয়ে জলখাবার খাইয়ে দিয়েছিলুম গৌরবকে। তারপরে আমি চুপটি করে বসে আছি দেখে ক্যারম
খেলা ফেলে রেখে গৌরব উঠে এসে নিজের ফর্সা চকচকে নরম নরম দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে
ধরে বললো-‘কি হয়েছে বাপী? তুমি খেলে না?’
‘খাবো’
‘তোমার মন খারাপ করছে?’
‘হুঁ, ভালো লাগছে না আজ কিছু’।
‘আমি খাইয়ে দিই তোমাকে, বাপী?’
‘হুঁ..’
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছেলে গৌরব অভ্যাস মতন আবার তাড়াতাড়ি করে নিজের হাত ধুয়ে এসে আমাকে খাওয়াতে
বসলো তখনি। আমি খেয়ে নিয়ে মুখ ধুয়ে এসে গৌরবকে জড়িয়ে ধরে ছেলের বুকে মুখ রেখে আবার চুপটি
করে বসে আছি দেখে একটু পরে বললো-‘বাপী, মন ভালো হ’তে হ’লে কিন্তু যা সচরাচর হয় না তাই হ’য়ে
যেতে হয় বা তেমন কিছু একটা করতে হয়’।
‘তার মানে?’
‘মানে যেমন মনে কর যে কোন খুব গম্ভীর লোক যদি হঠাৎ... হি... হি.... করে হাসতে শুরু করে দেয়
বা কাক যদি গান গায়...’
‘যা ব্বাবা....কাকের গান.....কি কান্ড....’
‘তুমি শুনেছ, বাপী?’
‘জীবনে ও নয়। কেউ আজ অবধি শুনেছে কি না তাও বলতে পারবো না, গৌরব’।
‘তা গান না গাইলে ও কাক কিন্তু অনেক অদ্ভূত সব কাজ করতে পারে। সাধারণ এবং অসাধারণ...দুই...’
‘বুঝেছি। তুমি এখন চেঞ্জ থেরাপির কথা বলছো .....হুম....তা শক থেরাপির মতন চমক দিলে ও
অনেক জটিল রোগ সারে শুনেছি...’
‘এ’বার তুমি একজন বেশ রাগী লোকের নাম বলো তো, বাপী’।
‘আমার অফিসের বস মিঃ বরদ রাজন। খাঁটি একজন রামগরুড়ের ছানা...কেউ গিয়ে একঘন্টার জন্য ছুটি
চাইলে ও সে তার হাফ ডে সি০এল০ কেটে নেবেই...’
‘বাপী, তুমি ফোন করে যদি বসকে বলো যে কাল তুমি আর অফিসের ধারে ও যাচ্ছো না মোটেই, তখন?’
‘ওরে বাবা। আমার সব কটা ছুটি শেষ হয়ে যাবে। আমার সে সাহসই নেই’।
‘তবে আর কি করা? তবে কোথাও বেড়াতে গেলে ও কিন্তু মন ভালো হয়। যাবে?’
‘কোথায় আর যাবো, গৌরব? তোমার মামার বাড়ী?’
‘নাঃ, অন্য কোথাও। বেশ দূরে। কোন নতুন জায়গায়’।
‘কেই বা ডাকছে আমাদের কোথাও, যে যাবো’।
‘আচ্ছা বাপী, কেউ না ডাকলে যেতে নেই, তাই না? তা তোমার হাতে এখন কতো টাকা আছে, বাপী?’
‘হঠাৎ টাকা কেন? তোমার স্কুলে চাই?’
‘নাঃ, তুমি বলোই না। যদি হঠাৎ দরকার পড়ে তখন?’
‘তা খুব বেশী তো নেই। হয়তো তেমন কিছু হ’লে ধার করে টাকা যোগাড় করতে হবে আমাকে’।
‘আরো বেশী করে করো খরচ তোমার এই আদরের ছেলের জন্য। তা তুমি তাই করে টাকা যোগাড় করে
রাখতে পারবে কালকে, বাপী? টাকা পেতে ও তো সময় লাগবে।’
‘কালকেই? কি কান্ড। হঠাৎ করে টাকার দরকারের কারণ কি দেখাবো?’
‘কেন, বাপী? আর কিছু যদি না পাও তো লিখো যে তোমার ছেলের বিয়ে হিঃ.....হিঃ......হিঃ....’
গৌরবের দুষ্টুমিতে রাগ করতে গিয়ে ও আমি হেসে ফেললুম বটে তবে ওই ছেলেকে তো আমি চিনি খুব।
কি ভেবে বা কি জেনে বুঝে ও যে কি বলে কখন তা বলা মুশ্কিল।
এখন এই টাকার ব্যাপারখানা যে আসলে কি তা নিজের ছেলেকে ও জিজ্ঞেস করতে বাধলো।
তাই বেশ অন্যমনস্ক ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে টেনে কোলে তুলে নিয়ে ঘরেই পায়চারী করতে শুরু
করলুম আমি। গৌরবের সে’ দিন আর খেলা করা হয়ে উঠলো না। তা গৌরব অবশ্য কিছুটি বলবে না সেই
জন্যে, তা আমি জানি।
বললো ও না। কি বুঝলো কে জানে? চুপটি করে রইলো।
তবে একটু পরে গৌরবকে বুকে নিয়ে হঠাৎ করে আমি আদর করতে শুরু করতে তখন ছেলে হেসে ফেলে
বললো-‘আচ্ছা বাপী, বলো তো উত্তরবঙ্গ কোন রাজ্য?’
‘তেমন কোন রাজ্য তো এখন ও নেই। রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গই। রাজ্যের উত্তর দিকটাকে পাহাড়িরা
দখল করে নিয়ে উত্তরাঞ্চলের মতন একটা গোরখাল্যান্ড বা উত্তরবঙ্গ কিছু একটা বানাতে চাইছে।
এ’জন্য অনেক বন্ধ, ধরনা ও গন্ডগোল হয়েছে’।
‘তা হঠাৎ উত্তরবঙ্গ কেন, গৌরব?’
‘তুমি সে’খানে যাবে তো বাপী? অবশ্য করে কেউ যদি ডাকে, তখনই’।
‘হুঁ, তা যেতে পারি.....’
‘
শুনেই হাততালি দিয়ে হিঃ...হিঃ...হিঃ....করে হেসে ফেলে গৌরব বললো--‘কি মজা...বেড়ানোও হবে
আবার মন ভালো ও হবে। তবে মিছে অনেক পয়সা নষ্ট হবে তো, বাপী’।
‘তা হোক গিয়ে। কিন্তু সে’খানে তো আমাদের নিজেদের লোক বলতে ও তেমন কেউ নেই যে ডাকবে...’
‘থাকতে ও তো পারে কেউ, বাপী’।
মিষ্টি ছেলের অপরূপ সুন্দর মুখের দুষ্টু হাসি দেখে আর কথা শুনে আমি চুপ।
আমাদের বংশে তো কেউ ছিলো না তেমন ওই সব দিকে। তবে কি গৌরবের মামার বাড়ির দিকের কেউ আছেন?
তা হতে পারে কিন্তু সে’সব তো গৌরবের ও জানবার কথাই নয়। আর সেজন্য তো যেতে হ’লে ওর
মামার পক্ষের কেউ না কেউ তো আছেই। আমি যাই কোন সূত্রে?
নাঃ, আমার এই ছেলেটা একটু বেশী সুন্দর হ’লে কি হয়, এ তো দেখি বড়ই অদ্ভূত ছেলে হয়েছে।
মাঝে মাঝে এমন এক একটা কথা কয় বা কান্ড করে বসে যে তার ধাক্কা সামলাতে আমার তো মাথা
ঘুরে যাবার দাখিল হয়। এ আমি গৌরবের সেই আরো ছোট্টবেলা থেকেই দেখে আসছি। কিন্তু করি কি?
পরদিন যথারীতি নিয়ম মাফিক সময় ধরে অফিসে যেতেই মি০ বরদরাজনের ডাক এলো।
জানতে চাইলেন কি হয়েছে? কাল রাতে কি তুমিই আমাকে ফোন করে ছুটি চাইছিলে? কেমন অদ্ভূত
গলার আওয়াজ। ঠিক ধরতে পারি নি আমি। তা কেন? কেউ কি অসুস্থ?’
আমি চমকে গিয়ে আমতা আমতা করে বললুম---না মানে ইয়ে,.... কি বলে একটু শ্বশুর বাড়ির
দিকে যাবার দরকার ছিলো। আমার শালার...’
‘হাঃ হাঃ হাঃ ....তা যাবে বই কি....আরে ভাই, আমরা তো সমাজে বাস করি। তাই পরষ্পরকে না দেখলে
কি চলে? কবে যাবে? তুমি দরখাস্ত করে দিও তো। হয়ে যাবে। চিন্তা কোরো না। যাও....’
এ সব কি কান্ড রে বাবা? আমি আবার কাল কখন ফোন করলাম বড়বাবুকে? ছুটি চাইলাম? আর সব চেয়ে
বড় কথা আমাদের বিদঘুটে বস আজ অতি উদার হয়েছেন। তিনি আবার দেখি হাসছেন ও? আজ কি
সূর্যোদয় তবে পশ্চিমেই হয়েছে? কে জানে? ওরে বাবা। এ হয়তো ঠিক গৌরবের শক থেরাপী ...উঃ.....’
‘বাড়ী ফিরেই গৌরবকে কথাটা জিজ্ঞাসা করতে ছেলে হাসতে হাসতে বলেছিল-‘আমি তো কিছুটি করিনি,
বাপী তবে মা তো দেখি তোমার জন্য বেশ চিন্তা করে। হয়তো তোমার মন ভাল করতে কিছু করেছে............’
বোঝ ঠ্যালা। এখন ভূতের কান্ড বলে আমাকে মানতে হবে ব্যাপারটাকে। যে মানুষই নেই সে আবার কি করে
ফোন করে....যত্তো সব। তা গৌরব এমন সব কথা প্রায়ই বলে....সে যাক গিয়ে। বাচ্ছার কথায় কান দিতে নেই....
দিন তিনেক পরের কথা।
সে’দিন আমার অফিসে কিসের জন্য যেন একটা ছুটি ছিলো। গৌরবের স্কুল ও বন্ধ। তা ভারী তো ওয়ান
ক্লাশে পড়ে ছেলে। টু’তে উঠবে। পরীক্ষা হয়ে গেছে।
তা এমনিতেও আমি বাড়ী থাকলে সে’দিন আর ছেলেটাকে স্কুলে আমি পাঠাতেই চাই না।
খুব একলা লাগে তখন আর আমার বেশ মন খারাপ ও হয়ে যায়। এটা না কি লোনলিনেস সি্ড্রোম না
কি একটা ছাই মানসিক অসুখ। নিঃসঙ্গতা রোগ।
এমনটি না কী একলা থাকলে হয় কিন্তু আমি কি একলা আছি? আমার এই রোগ হয় কোন সুবাদে?
ছেলে সঙ্গে থাকতে আমি একলা হয়ে থাকি কখন? আমি তো আবার গৌরবকে যখন নেহাৎ প্রয়োজন,
তখন ছাড়া কাছছাড়া করতে ও চাই না। এমন ও হয় অনেক সময় যে আমি ওর খেলা বা বেড়ানো সব
মাটি করে দিয়ে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপটি করে বসেই থাকি বা পায়চারী করি
অথবা আচমকা ছেলেটাকে ধরে খুব আদর করতে থাকি। অন্য সাধারণ কোনো ছেলে হ’লে রাগ
করতো আমার ওপরে, আমাকে এড়িয়ে চলতো বা কষ্ট পেতো বেশ মনে।
গৌরব ভীষণ বুদ্ধিমান ছেলে। তা ঠিক কথা।
ছেলেটা আমাকে কিছুটি বলে না কিন্তু বেশী আদরে বাঁদর ও হয় না আর মাথায় ও ওঠে না।
কে যে ওকে সব বোঝায়, শেখায় ও শাসন করে কে জানে বাবা? তবে কিছু একটা রহস্য তো আছেই
নইলে গৌরব আর ঠিক মতন মানুষ না হয়ে অমানুষ তৈরী হ’তো একটা। আমার সাধ্যই ছিলো না
ছেলেটাকে অতো সুন্দর ভাবে সব ভাবতে, বুঝতে, চিন্তা করতে এবং বড়দের চেয়ে ও নিঁখুত কাজ করতে শেখানোর।
প্রত্যেক অসাধারণ বালকের সাথেই হয়তো এমন কোন এক অসাধারণ শক্তির সাহায্য থাকে।
আমরা কতটুকুই বা তার জানি? সবই শক্তি বা এনার্জি কোয়ান্টমের খেলা। তার নাম যে যা পায়
তাই দেয়....দেবতা, অপদেবতা, উপদেবতা, অতিপ্রাকৃত....।
একদিন রাতে শুয়ে পড়ার পরে ঘুম না আসায় ছেলেকে বেশ কয়েকটা চুমু খাবার পরেই জিজ্ঞেস
করে ও ফেলে ছিলাম কথাটা। গৌরব শুনে হেসে উঠে বলেছিল—‘তা আর কি করবো বাপী? আমার ভাগ্য।
মোটেই অসুবিধা হয় না আমার। আমি যে দু’জনের ভাগের আদর একলা পাই’।
বোঝ ঠ্যালা। গৌরবের বয়স তখন পাঁচ বছর মাত্র।
তা সে’দিন দুপুরে ডাক পিওন এসে হঠাৎ একখানা রেজিষ্টরী চিঠি দিয়ে গেলো। পড়ে দেখি সুদূর জলপাইগুড়ি
থেকে কে একজন পঞ্চায়েত প্রধান জানাচ্ছেন যে কিছু বৈষয়িক ব্যাপারে আমাকে সে’খানে একবার যেতে
আগ্রহ জানানো হচ্ছে। পত্রপাঠ যাত্রা করলে ভালো হয়। তবে একটু সাবধানে গেলে আরো ভালো হবে।
ঠিকানা দেওয়া আছে। জায়গাটা ঠিক শহরে অবশ্য নয়। আর পঞ্চায়েত তো গ্রামেই হয়।
শিলিগুড়ি যাবার পথে পড়ে এই জায়গাটা। কি কিশানপুর না কি নাম ও লিখেছে তবে পাঠোদ্ধার কঠিন।
স্টেশন থেকে অটো রিজার্ভ করে গেলে অসুবিধা হবে না। চল্লিশের মতন ভাড়া পড়বে। ট্যাক্সি অবশ্য শ’দুয়েক হাঁকবে।
তা সে না হয় হ’লো কিন্তু দরকারটা যে কি সেটি তো স্পষ্ট করে জানাবে, নইলে যাই কি করে?
তাও একটা ছোট্ট কচি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে।
এই এক ভালো মুশ্কিল তো হয়েছে দেখি আমার। খুলে কেউ কিছুটি তো বলতেই চায়না দেখি।। তায় শুনেছি
ওদিকে না কী বর্ডার এলাকা। নানারকম ঝামেলা হয়।
সাবধানতার দরকার কি সেই জন্যে। কে জানে? তা আমি যে এখন কি করি?
গৌরবকে চিঠির কথা জানালুম।
বাচ্ছা ছেলেটা তো আল্হাদে আটখানা বেড়াতে যাবার নামেই। আমি যে কি করি? পরামর্শ দেবার ও কেউ নেই আমার।
আর জানা নেই শোনা নেই হঠাৎ বিদেশে কি অমনি গেলেই হ’লো। বাধ্য হয়ে ইন্টারনেটে আই আর সি টি সির
নিজের অ্যাকাউন্টে টিকিট মেলে কি না তাই দেখি বলে বসে দেখি সে’খানে ও লম্বা লিষ্ট ওয়েটিংয়ের আর তৎকালের
টিকিট পাব পরদিন সকাল দশটার পরে। হাওড়া অবধি যেতে পারলে নিউ জলপাইগুড়ী শতাব্দীতে উঠলেই হবে।
পরদিন তো আবার আমাকে অফিস ও যেতে হবে। টিকিট কাটবো কি করে? নাঃ, দিন দশ বারো ছুটি নিতেই হবে মনে হয়।
গৌরবের নতুন ক্লাশ ও শুরু হয় নি স্কুলে। ছুটি নিলে অসুবিধা হবে না বিশেষ।
তাই করলুম ব্যবস্থা।
অফিসে বলে দিলুম যে দার্জিলিংয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, তাই ছুটি চাই। ছুটি পাওনা ছিলো কিন্তু টাকা লোন
নিতে অনেক ঝামেলা দেখে ফান্ড থেকেই বেশ কিছু টাকা তুলে নিলুম। বিদেশ বিভুঁই জায়গা বলে কথা।
তৃতীয় দিন টিকিট পেতে ও কিন্তু বেশ ঝামেলা হ’লো। তৎকালে ও দেখি কোন ট্রেনের টিকিট আর মেলে না।
জ্বালাতনের একশেষ। তাই দেখে শেষে রাজধানীর টু টিয়ার কোচে টিকিট পেয়ে তাই কেটে নিলুম। ছেলের
পাঁচ বছর বয়স তো হয়ে গেছে তাই একখানা হাফ টিকিট ও কেটে নিতে হ’লো। এখন সেই মোগলসরাই
যেতে হবে অটো রিজার্ভ করে ট্রেন ধরতে এই যা ঝামেলা, তবে সাবধানী কাজ করে আমি একটু নিশ্চিন্ত।
রাজধানী এক্সপ্রেস সুরক্ষিত গাড়ী। শুধু হওড়াতে একটা দিন থাকতে হবে বলে হোটেল অশোকে একটা রুম বুক করতে হবে।
তা এইবার দেখা যাক যে বেড়ালে কেমন মন ভালো হয় আমার।
রাত বারোটার পরে রাজধানী মোগল সরাই ছাড়লো । তবে পরদিন এগারোটায় হাওড়া না গিয়ে লেট
করে দু’টো বাজিয়ে দিলো। আর শতাব্দী ছাড়ে হাওড়া থেকে বেলা দেড়টায়। তার পরদিনের টিকিট না
কাটলে ট্রেন ফেল হয়ে যেতো। রাজধানী না ছাইদানী এক্সপ্রেস। হাওড়ার অশোক হোটেলে ঢুকে পড়লুম গৌরবকে নিয়ে।
পরদিন শতাব্দিতে ও রাত সাড়ে দশটা বাজলো আমাদের নিউ জলপাইগুড়ী পৌঁছতে। তখন অতো রাতে
আমরা যাই কোথায়? স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে দরজা বন্ধ হ’বার মুখে গিয়ে কোনমতে আশ্রয়
নিলুম আমরা। বাজে হোটেল। তবে রাত এগারোটা সে’খানে অনেক রাত। একটি ও রেস্তোঁরা কোথাও খোলা নেই।
কি গেরো। ভাগ্যিস শতাব্দিতে এসেছি, খাবার দিয়েছিলো, নইলে আমাদের রাতভোর উপোষ দিতে হ’তো।
পরদিন সকালে স্নানাহার সেরে নিয়ে হোটেল থেকেই একটা রিজার্ভ গাড়ী ভাড়া নিয়ে সেই গ্রাম পঞ্চায়েত
প্রধানের বাড়ী গিয়ে দেখা করতেই এক্কেবারে শত প্রশ্নবানের মুখে পড়ে গেলুম।
‘মহেশ্বর বাবু আপনার কে হ’তেন, বলুন? আপনি কোথা থেকে আসছেন? সঙ্গে কে? ছেলে না ভাইপো না ভাগ্নে?
এর বয়স কতো? আপনার পরিচয়পত্র কোথায়? আপনি কি করেন? কোথায় আদি নিবাস?’
গ্রামের লোকেদের ধরণ ধারন দেখে বেজায় রাগ করে বলতে যাচ্ছি মহেশ্বরবাবু আমার সম্বন্ধী মানে শালা হতেন।
শশ্মান (মানে কাশী) থেকে আসছি। সঙ্গে আমার ঠাকুরদা। এর বয়স আদি অনন্তহীন শত্রুর (রিপু) সমান মানে ছয়।
এখন গোলামী করি আর যমালয় আমার আদি নিবাস।
তা আমার সদা সতর্ক ছেলে গৌরব আমাকে সে সব কিছু বলতে দিলে তো।
গম্ভীর মুখে ছেলে আগেই বললো-‘ওয়ান বাই ওয়ান, প্লীজ। তিনি আমার দাদু হ’তেন।
আমার নাম গৌরব কুমার। বাবার নাম কিশলয় কুমার। আপনি তা জানেন তো?’
‘তা পদবী কী?’
‘শিব’
‘সে আবার কী? শীল পদবী হয় তা তো শুনেছি কিন্তু...’
‘তবে শংকর বা সংকর মনে করুন’
‘তার মানে?’
‘মিশ্র’
‘ওরে বাবা রে? কি সাংঘাতিক। তা তোমার সঙ্গে কে?’
‘মালিক...’
‘মানে?’
‘বাল্যকালে ছেলের মালিক হয় তার পিতা। ইনি এইখানের ও মালিক,,,’
‘তার মানে? আমি তো এখন ও প্রয়োজন বিষয়ে কোন কথাই বলি নি’।
‘আপনাকে সে আর বলতে হবে না। আমি সব অবগত আছি............’
‘ওরে বাবা। তার মা...মানে...’
‘মানে শিব নগরী থুড়ি কাশী থেকে আমরা আসছি। আপনিই তো আসতে বলে ছিলেন সেইজন্যে।
এই দেখুন চিঠি। ঠিক আছে? আমি স্কুলে পড়ি আর ইনি রাজার দাসত্ব করে গ্রাসাচ্ছাদন করে থাকেন
মানে চাকরী করেন। সরকারের লৌহযান কার্যালয়ে ...মানে রেল অফিসে। পরিচয় পত্র ও আছে। এই দেখুন।
আর কিছু...?’
আমি শুনে মনে মনে গৌরবের তারিফ করলুম। কি দুষ্টু ছেলেরে বাবা। আগে থেকেই বাংলা অভিধান
দেখে সব কঠিন শব্দগুলো বেশ মুখস্ত করেছে। আর এখন এই ঝানু পঞ্চায়েত প্রধানের পঞ্চত্ব পাবার
মতন অবস্থা করে ছেড়েছে যে। এরপরে আর বেশী ঝামেলা করবার সাহস হবে না মনে হয়।
তাই বটে। তখন আদর আপ্যায়ন শুরু হ’লো।
পরে জানা গেল যে মহেশ্বর বাবু বেশ কয়েকদিন আগে দেহ রক্ষা করেছেন। এই গ্রামে তাঁর বিস্তর
বিষয় আশয় আছে। বসত বাড়ী, বাগান, পুকুর, কুলদেবতা কৃষ্ণের মন্দির ও বেশ কয়েক বিঘে ধান
জমি ও আছে। প্রায় বিঘে চল্লিশের মতন। তিনি উইল করে সমস্ত বিষয় না কী শেষে এই অধম মানে
আমাকে দিয়ে গেছেন যদি ও পাবার কথা গৌরবের মামার। মায়ের ও একটা অংশ থাকতো জীবিত থাকলে।
এই পঞ্চায়েত বাড়িটি ও তিনিই পাকা করিয়ে দেন। জমি ও তাঁর। তবে দানপত্র করা হয়ে আর ওঠে নি ।
তাই এখন ও আইনতঃ এটি ও তাঁর সম্পত্তির মধ্যেই পড়ে।
বুঝলুম গৌরব ঠিকই বলেছিল। এ’খানের ও মলিক।
‘রাতে আপনি কি আমার বাড়িতে কষ্ট করে থাকবেন মানে আমরা কায়স্থ তো। তাই বলছিলাম যে....
কাল সকালে উকিলবাবুকে আসতে বলে দিই যদি। তাই.....
‘কেন? বসত বাড়িটি কি বাসের অযোগ্য?’
‘না না। তবে একটু দূরে তো। জায়গাটা বেশ নির্জন ও। বিরাট কম্পাউন্ড তবে চারদিক খোলা তো।
গাঁ গঞ্জে বাড়ির পাঁচিল তো আর নেই তাই কোনো সুরক্ষা নেই। পাশেই বিরাট বাগান। পুকুর।
চৌকিদার ও এখন নেই। ওনার খাস চাকর হলধর এখন ও বসে আছে। আপনার আশায়।
যদি আপনি এসে তাকে চাকরিতে বহাল রাখেন’।
শেষে ফিস ফিস করে বললেন--‘তবে বিষয় মানেই বিষ তা জানেন তো। এরই মধ্যে আরো একজন
দাবীদার এসে জুটেছেন। তিনি মহেশ্বর বাবুর না কী প্রথম পক্ষের ছেলে। দ্বিতীয় পক্ষের দুই ছেলে মেয়ে
মানে আপনার স্ত্রী ও শ্যালক। তাই তাঁর ও অধিকার আছে। তিনি চান নিজের ভাগ হাতে পাওয়া
মাত্রই সব বেচে দিতে কিন্তু সম্পত্তি ভাগ না হ’লে তিনি সেই অধিকার তো আর তিনি পাবেন না।
আর উইলে ভাগাভাগির নামগন্ধও নেই। মহেশ্বর বাবু একইঞ্চি জমি ও বিক্রী করবার বা প্রোমোটারদের
হাতে দিয়ে হাইরাইজ তোলবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি চাইতেন গ্রাম- প্রকৃতির কাছে থাকতে,
বুক দিয়ে গাছপালা, খেত খামার সব আগলাতে। তিনি লোক পাঠিয়ে আপনার বিষয়ে সব খবরাখবর
নিয়েছিলেন। খেয়ালী মানুষ ছিলেন। তো তাই কাউকেই সহজে বিশ্বাস বা পছন্দই করতেন না তবে
কেন জানি না আপনাকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে উইল করে ফেললেন আর সেই উইলে
আমি, উকিলবাবু, ডাক্তারবাবু সবাই সাক্ষী আছি... সুতরাং বুঝতেই পারছেন তো কেন আপনাকে সাবধানে আসতে বলা’।
বললুম-‘তা বেশ তো । আপনি হলধরকে ডাকুন। দেখি। ভালো মনে হ’লে বহাল করেই রেখে যাবো।
আমি তো আর এ’খানে বসে থাকতে পারবো না। তবে পরিষ্কার টরিষ্কার যা করতে হবে তার জন্য ও
কয়েকজন বিশ্বাসী লোককে লাগিয়ে দিন। যা লাগবে দিয়ে দেব। বাড়িটা একটু বাসযোগ্য যদি হয়ে ওঠে
তো রাতে ও’খানেই থাকা যাবে। এখন সবটা একটু ঘুরে দেখে নিতে চাই। দিনের বেলায় .....’।
সে আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন। আমার দায় সাবধান করে দেওয়া। প্রতুল ছেলেটি ও তো খুব সুবিধের নয়।
শুনেছি না কি বোমা টোমা মানে ওইসব কুসঙ্গে মিশে যা হয়ে থাকে আর কি ।হলধরকে সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি না হয়....’
তারপরে উঠে গিয়ে আগে গাড়িটা ছেড়ে দিলুম জিনিষপত্র নামিয়ে নিয়ে। কয়েক দিন থাকতেই হবে
বলে মনে হয় এখন। বেশ নতুন এক ঝন্ঝাট হ’লো যা হোক। জিনিষগুলো একজন বয়স্ক লোক এসে
নিয়ে গিয়ে প্রধানের ঘরে রেখে ফিরে এসে নমস্কার করে বললো-‘আজ্ঞে, আমার নাম হলধর।
বাবু বললেন যে আপনি ডাকতেছেন, তাই.........’
‘হুঁ, তা বেশ। তবে তুমি আগে কয়েকজন লোক লাগাও দেখি, বাড়িটা সাফ সুতরো করতে তো হবে।
তারপরে আমাদের সব দেখিয়ে দাও ঘুরিয়ে...’
‘বাবু, ধান জমি টমি না হয় পরে দেখবেন। বেলাবেলি আজ আপনি বাগান, পুকুর আর মন্দির সব দেখে নিতে পারেন...’
‘ঠিক আছে.... তাই চলো’
গ্রামের কাঁচা পথ ধরে প্রথমেই অনেকটা হেঁটে একটা বড় বাগানে গিয়ে হাজির হতেই গৌরব
চুপি চুপি বললো—‘বাপী, এই বাগানে কাক বা শকুন টকুন কিছু একটা বাসা করে আছে
মনে হয় আমার..........বিশেষ সুবিধার নয় সে....’
হলধর শুনে বললো—‘গ্রামের বাগান তো। তিন বিঘের মতন জায়গা। অনেক গাছপালা...
বহু পশু পক্ষী, পোকা মাকড়, সাপ খোপ কি না আছে, ভাই?’
গৌরব বললো-‘তা থাকতেই পারে। অবশ্য থাকুক। আমার আপত্তি নেই। ওদেরই তো জায়গা।
আমরাই মালিক সেজে দখলদার হয়েছি। তবে মনে হয় একটাই কাক...বাকী সব অন্য পাখী ...
আর কয়েকজন দুষ্টুলোক ও আছে। সাবধানে চলো... আরে... আরে.... আংকল, তুমি একটু দাঁড়াও,
আর এগিও না... সর্বনাশ, কি হ’লো, আংকল? পড়ে গেলে? তা তুমি শিগ্গীর করে পিছিয়ে
চলে এসো তো। খবর্দার। এগিয়ে যেতে
যেও না.. ’
দেখি চলতে চলতে হলধর থামবার আগেই সে ঘন গাছপালার মধ্যে পায়ে একটা সরু লতা
জড়িয়ে গিয়ে হঠাৎ করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মাটিতে দমাস করে। আর পড়েই সে ওঠবার চেষ্টা না
করে গৌরবের নির্দেশ শুনেই পিছনে গড়িয়ে চলে এল অনেকটা গড়গড়িয়ে...আর সে’খানে ওপর
থেকে তৎক্ষনাৎ একটা বড় গাছের ডাল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে এসে নীচে পড়লো ধড়াম করে...’
কোনমতে সামলে নিয়ে উঠে ডালটা দেখে হলধর বলল-‘এ’ কারো নষ্টামী, বাবু। ডালটা আগেই
কেটে রেখে এই ফাঁদটা পাতা হয়েছিল লতা দিয়ে বেঁধে রেখে। আপনার ছেলে যে কি করে বুঝলো...’
তার পরে খুব সাবধানে পুরো বাগানটা ঘুরে দেখতে দেড় ঘন্টা লেগে গেল। শেষ প্রান্তে বেশ বড় সড়
একটা পুকুর। তাকে দিঘী বলাই ঠিক। বেশ পরিষ্কার জল। পাড়ে আম জাম কাঁঠাল লিচু অনেক ফলের গাছ।
একটা কি গাছের ডালে পাতার ফাঁকে বেশ বড়সড় কি একটা লালচে হলদে মতন ফল ঝুলছে দেখে
গৌরব জানতে চাইলো—‘আংকল, ওটা কি ফল বলো তো? আম?’
‘কই?’
‘ওই তো, সামনে।
‘আম তো মনে লয় না। আমি দেখে আসি তো এগিয়ে গিয়ে...’
‘না আংকল। থাক...’
‘কেন?’
‘যদি ওটা অন্য কিছু হঃ? .....আরে একটা কাক উড়ে আসছে.....ওঃ বাবা। কতো বড়ো কাক,
হুঁ এই কাকটাই থাকে হয়তো বাগানেতে.....তা এখন তুমি চলো বাপী এ’খান থেকে....আর দেরী নয়।
আংকল, বাড়িতে চলো তো...তাড়াতাড়ি.......’
আমরা ফিরে চললুম।
গৌরব একবার পিছন ফিরে দেখে নিয়ে বলল--‘কাকটা ওই গাছেই বসেছে, বাপী, কুইক, দৌড়োও ...
আংকল ছুটে চল...বিপদ হয়ে যেতে পারে......’
শুনেই আমি গৌরবের চকচকে ফর্সা ডান হাতটা শক্ত করে ধরে নিয়েই দৌড় দিলে ও হলধর
হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলো আর কিছুক্ষন পরেই এক বজ্র নিনাদের সাথে একদিকে ছিটকে পড়লো।
আমরা ততক্ষনে অনেকটা দূরে চলে এসেছি বলে বেঁচে গেলুম। প্রচন্ড বিস্ফোরণ।
গৌরব বললো---‘বাপী, ফলটা কি বুঝেছো তো, বড় আম........হিঃ....হিঃ....হিঃ.....
আমাদের প্রতিপক্ষ খুব সজাগ তবে কা...’ বলেই গৌরব থেমে গেল।
হলধর খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলো খানিক পরে। আছাড় খেয়ে পায়ে বেশ লেগেছে তার। ভয়ে ভয়ে
গৌরবের দিকে দেখছে সে। আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচে সে তখন। হলধর পথ দেখাতে আগে আগে চললো।
আমি গৌরবকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে কোলে তুলে নিলুম। আবার না কোন আপদ ঘাড়ে এসে পড়ে, এই ভয়ে ।
তাই দেখে ছেলেটা একটু হেসে খুব ধীরে বললো-‘এখন আর কোন অভ্যর্থনা হবে না, বাপী।
চিন্তা নেই। তুমি চলো.... যা হ’বার সে হবে রাতে..................’ বলেই ছেলে চুপ।
বাড়িটা বেশ বড়ো। দু’মহলা। তবে ভাঙা চোরা নয়। ততক্ষনে তিনজন প্রাম্য লোক মিলে সব
আবর্জনা ঝেঁটিয়ে সাফ করে জায়গাটাকে বসবাসের যোগ্য করে তুলেছে । কিন্তু রাতে একলা
অপরিচিত দেশ পাড়া গাঁ জায়গায় থাকতে আমার মন ঠিক সায় দিচ্ছিল না।
হলধররের কান বাঁচিয়ে গৌরবকেই জিজ্ঞেস করলুম-‘এখন কি করা উচিৎ আমাদের বলতো,
গৌরব? এ’খানে রাতে থাকবো?’
‘হুঁ...;
‘খাবো কি আমরা?’
‘কেন বাপী? কাঠের জ্বালে ভাত ডাল সব দিব্যি হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। তুমি বলে দিলেই হবে।
হলধর আংকলকে..... অন্যের ঘরে না খেয়ে নিজের জায়গায়....অবশ্য রাত হ’লে ..
সে যা হয় তখন দেখা যাবে। তুমি কিন্তু ভয় পেও না বাপী। ....’
‘রাতে কি হবে গৌরব? বোমা মারবে?’
‘নাঃ, তবে অপহরণ করা, লুঠপাট ও চুরি ডাকাতী এ’সব তো করতেই পারে, বাপী। তোমার
ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে অন্তত দু’টুকরো করে ফেরৎ এনে দিলে ও ভবিষৎ মালিকের ...
দফা রফা ....হিঃ.....হিঃ.....হিঃ..............কিন্তু ...কা...’
শুনে একটু চমকে উঠলুম। ছোট হ’লে কি হয়, ছেলেটা অনেক কিছু বেশ জানে।
জানতে চাইলুম—‘কা কি গৌরব? কাক?’
‘হুঁ, তবে খুব সুবিধের নয়। বেশ রাগীমতন আছে। ঠোঁটে খুব জোর, বাপী। আমার কথা ও বেশ বুঝতে পারে।’
‘তুমি কি করে জানলে, গৌরব?’
‘আমটা কি করে একটু পরীক্ষা করে দেখা যায়, ঠিক করতে না পেরে ডাকতেই ঠিক তো এসে পড়ল, দেখলে তো বাপী’।
‘হুঁ। বেশ মজা তো। যাক, আমি তোমার কথামতন যাতে কিছু খাবার অন্তত জোটে আমাদের,
সেই ব্যবস্থাই করছি। বাড়ির মালিকের শয়নকক্ষটি বেশ তো ঝকঝকে তকতকে হয়েছে। থাকা চলে।
বিছানা, খাট, মার্বেল টপ টেবিল, মেহগনি কাঠের আলমারী, দেওয়ালে পেন্টিং সব আছে। কিচেন ও সব
ঠিকঠাক। তবে গ্যাস মানে বায়ো গ্যাস নেই। তাই লন্ঠনের আলো ও কাঠের আগুন ভরসা। আমি বলে দিচ্ছি....’
আদেশ মাত্র সব ব্যবস্থা করতে ছুটলো হলধর নইলে তার চাকরী নট হবে যে। সন্ধ্যের আগেই রান্না শেষ।
গরম গরম ভাত, মুগের ডাল, আলু কচু ভাতে, পাঁপর ভাজা আর গ্রাম্য লাড্ডু জুটলো ভাগ্যে।
তা মন্দ ভোজ হ’লো না। বনভোজন ঠিক হয়ে উঠলো না বটে তবে গ্রামভোজন বলা চলে অনায়াসে।
গৌরবের কথায় নতুন জিনিষ যখন, তখন আমার মন ভালো হ’তেই হবে।
তবে সবটাই এ’খানে যা যা ঘটেছে তা আমার মন ভালো করবার জন্যই কি না তাই বা কে জানে?
গৌরব যা ছেলে, সব জানলে ও নিজে থেকে তো কিছুটি বলতেই চায় না দেখি। জিজ্ঞাসা করলে অবশ্যই বলবে।
তা বার বার সব কথা সব সময় জানতে চাইতে আমার ভালোই লাগে না। তা সে নিজের ছেলের কাছে হ’লেই বা কী?
নিজেকে কেমন ধারা বেশ বোকা হাঁদা মনে হয় আমার।
হলধর ও অন্য লোকগুলোকে ও খেয়ে নিতে বলে দিয়েছিলুম। তারা সানন্দে রাজী। গ্রামে এই সামান্য খাবারের
ও কদর আছে বেশ বোঝা গেলো। খেয়েদেয়ে অন্য সবাই প্রত্যেকে চল্লিশ টাকা করে হিসেবের মজুরী
নিয়ে চলে গেলো কিন্তু হলধর রয়ে গেল আমাদের নিচের তলার একটা ঘরে।
তার মাইনে আগে ছিলো না কি মাসে পাঁচশো। আমাকে কিছু বাড়াতে বলতে গৌরব রাগ করে বললো—
‘একশো তো বাড়িয়েই বললেন আপনি, আংকল। আরো চাই? আমি তখন বলেছি না আপনাদের যে
আমার সব জানা আছে। তবু পরীক্ষা করছেন কেন?’
শুনে হলধর তো হাঁ।
আমি বললুম—‘ঠিক আছে, হলধর। তবে শর্ত এই যে তুমি মিথ্যে কথা একদম বলবে না আর চুরি টুরী
ও করবে না। তখন কিন্তু শাস্তি পাবে। নাঃ, আমি না দিলে ও তুমি কিন্তু ঠিক পাবে শাস্তি। সাবধান’।
আমরা দু’তলায় মালিকের শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলুম লন্ঠন জ্বেলে নিয়ে।
তখন আর তো কোনো কাজ নেই।
ঘুম ও আসতে সেই রাত দশটা। করি কি? একটা বাচ্ছা ছেলের সাথে বসে লুডো খেলা ও শেষে গল্প করে
সময় কাটানো ছাড়া করবার কিছুটি নেই। তাও বেশ গোটা কয়েক বাচ্ছা থাকলে বা একটা অন্তত বছর
বারো চৌদ্দোর ছেলে থাকলে ও মজা হ’তো বেশ। তার সাথে হৈ চৈ করা যেতো। তাকে ক্ষ্যাপানো যেতো
কিছু দুষ্টুমী করে তার সাথে। সেও আমার ভাগ্যে নেই। গৌরব ছোট্ট হ’লেও বেশ গম্ভীর ছেলে।
দিব্যি আমার অভিভাবক সাজতে পারে।
গৌরব বললো—‘বাপী, রাতে যদি চোর বা খুনে আসে? তোমার লাঠি কই? যোগাড় করেছো?’
‘কই, না তো, গৌরব’।
‘পাশের ঘরে থাকতে ও পারে। টর্চ নিয়ে চলো তো বাপী, আমরা গিয়ে খুঁজে আনি। বেশ
খানিকটা সময় কাটবে আর মজা হবে...’
‘তাই যাই চলো’
‘বাপী, এক মিনিট দাঁড়াও। এই দু’টো পাশ বালিশ কে এখন দু’টো মানুষ সাজালে কেমন হয় বলোতো।
হিঃ...হিঃ...হিঃ...আমার ব্যাগে দু’টো মানুষ- মুখোশ আছে। তাই দিয়ে....’
বলেই দ্রুত হাতে গৌরব নিজের পরনের শার্ট আর প্যান্ট সব খুলে ফেলে একটা পাশ বালিশকে তুলে পরাতে বসলো।
শেষে মুখোশ ও পরালো। বেশ একটা ঠিক ঘুমন্ত ছেলে মনে হ’তে লাগলো সেটাকে বিছানায় রাখতেই...বেশ মজা তো।
ছেলের দেখাদেখি আমি ও নিজের পোশাক খুলে আর একটা মানুষ বানিয়ে ফেললুম। তারপর তাদের খাটে
শুইয়ে দিয়ে মাত্র অন্তর্বাস পরিহিত গৌরবকে কোলে তুলে নিয়ে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে,
লন্ঠন হাতে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লুম।
সে ঘরে ও খাট বিছানা ছিলো একটা। লাঠিও পাওয়া গেলো।
গৌরব বললো—‘বাপী, তুমি না খুব অসাবধান ছেলে হয়েছো। মা তো ঠিকই বলে দেখি। তুমি কিন্তু
ওই শোবার ঘরের জানলার গ্রিলটা একটু ও পরীক্ষা করে দেখোই নি। নইলে আমার এই ঘরে লাঠি খ
ুঁজতে আসা খেলার রহস্য তুমি ঠিক ভেদ করতে পারতে। দিনে ঘর পরিষ্কার করবার সময় কেউ
ওটা আলগা করে রেখে গিয়েছে। বাইরে থেকে টানলেই হিঃ....হিঃ...হিঃ....তা মশা তো বেশ আছে
গাছপালার দৌলতে। তুমি এই নাও চাদর। গায়ে জড়াও, বাপী।। আমি বিকেলেই রেখে গিয়েছিলাম।
তোমার ওডোমসের টিউব ও এনে রাখা আছে। লাগাবে, বাপী?’
‘হুঁ, তা তো দেখছি লাগাতেই হবে ....তবে আগে একটু আমার ছেলেটাকে আদর করে তো নিই।
এই সব তো আমার দেখবার কথা ছিলো....’
এই বলে ছেলের হাতে পায়ে বেশ করে ওডোমস ঘষে চাদর জড়ালুম দু’জনে।
‘বাপী, তুমি ততক্ষন একটু ঘুম করো । আমি জেগে আছি। এতো কান্ড করে এখন রাত দশটা বাজে সবে,
আমার হাত ঘড়িতে। মনে তো হয় যে রাত বারোটার আগে কেউ আসবেই না আমাদের মুন্ডু কাটতে...হিঃ...হিঃ....হিঃ......’
আমি অভ্যাস মতন এই বারে গৌরবকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে তুলে নিয়ে শুয়ে পড়লুম।
গৌরবকে আমি এইভাবেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে তবে ঘুমোই রোজ। গৌরব ও অভ্যাসবশতঃ আর
একলা ঘুমোতে পারেই না।
আমাকে আদর করতে করতে ছেলে বললো—‘বাপী, এই ঘরটায় অ্যাটাচ বাথ নেই কিন্তু।
তবে পাশের ঘরে আছে। এই ঘর থেকে একটা দরজা ওই বাথরুমের জন্য ও লাগানো হয়েছে।
বাথরুমটা কমন। তবে আমাদের রাতে দরকার হ’লে খুব সাবধানে যেতে হবে। আমি দরজাটা
খুলে রাখতে পারি যাতে পরে শব্দ না হয়। কিন্তু আজ এখন সেটা সম্ভব তো নয়।’।
আজ রাতে জেগে থাকবার কথা ও তো আমারই। তা সে’খানে ও ব্যতিক্রম। গৌরব আমাকে শেষে বার
কয়েক মিষ্টি করে চুমু খেলো আর অভ্যাস মতন আমার ঘুম এসে গেলো। নাঃ, এই কচি ছেলেটাকে নিয়ে
এই অ্যাডভেঞ্চারে এসেই ভূল করেছি দেখছি....
আমার ঘুম ভাঙলো অনেক পরে গৌরব আমার কানে কানে... ‘ও বাপী, ওঠো....’ বলে ডাকছে শুনে।
সজাগ তো ছিলুমই। উঠে বসেই শুনি যে কোথাও মৃদু খট খট করে শব্দ হয়ে চলেছে।
‘তিনি আসছেন মনে হয়, বাপী। ঘরে লন্ঠনের আলো কম করা থাকলে ও বেশ দেখা যায়। কেউ আমাদের
দেখে ফেলতেই পারে। তাই আমাদের এইবার খাটের নীচে ঢুকে যাওয়াই ভালো...’
‘তাই যাই না হয় চলো তবে ওই শব্দটা...?
‘বাপী. আমরা নীচের তলায় থাকলে ও’টুকু শব্দ ও হতো না...’
‘তার মানে...?’
‘বুঝলে না, বাপী। রন পা...’
‘কি সর্বনাশ...’
‘এসো, বাপী....’
খটাং ...খট ...করে জানলার গ্রিলে মৃদু একটা শব্দ শোনা গেল.........তারপরে ...ধপপ্...... পাশের
ঘরে কেউ যেন লাফিয়ে পড়লো। তার খানিক পরেই ঘপাস.... ঘপাস.... ফ্যাঁসস....
ঠক ঠক ঠক ঠক....ঠকাস ঠকাস ...কেমনধারা সব বিশ্রী শব্দ সাড়া সব একের পর এক হতেই রইলো একটানা।
গৌরব বললো—‘পাখী এইবার ফাঁদে পড়েছে, বাপী। তবে সে মরিয়া হয়ে হয়তো নীচে লাফিয়ে পড়ে পালাবে।
রেন পাইপ তো ঘরের জানলার কাছে নেই.....’
তা সত্যিই একটু পরেই পাশের ঘরের জানলার নীচে জোর ধপাস্ করে শব্দ হ’লো আর পরক্ষনেই
কেউ পরিত্রাহী চিৎকার করে উঠে হুড়মুড় দুড় দাড় শব্দে পালাতে গেল। কিন্তু তার চিৎকার
বন্ধ হ’লো না তবে কিছু পরে দূরে মিলিয়ে গেল।
এতো শব্দ সাড়াতে ও হলধর কিন্তু নিঃশব্দ।
আমি সেই কথা বলতে গৌরব হেসে ফেলল—‘ও তো কুম্ভকর্ণ আংকল? জেগে ঘুমোয় ভয়ে। নইলে
গ্রিলটা খুলে ফেলবার শব্দে বা বালিসে ছোরা গেঁথবার শব্দে না হ’লে রন পা দু’টো ঠুকরে নীচে ফেলে
দেবার শব্দে বা আততায়ির নীচে লাফিয়ে পড়ার শব্দে বা তার ওই পরিত্রাহী চিৎকারে অন্তত তার জেগে ওঠা উচিৎ ছিলো, বাপী....ঠিক কি না?’
‘ঠুকরে? তার...মানে?’
‘হ্যাঁ, ঠোঁট দিয়ে আর কি করবে সে বলো না তুমি, বাপী। অবশ্য আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে নখ
দিয়ে আঁচড়ে মুখ চোখ ফালা ফালা করে দিলে তখন যে কেউ হোক তাকে তখন তো চেঁচাতেই
হয় বাপী...হিঃ....হিঃ.........হিঃ....... তবে ঘরে বোমা রেখে গিয়ে থাকলে আমাদের এখন
নীচে চলে যাওয়াই ভালো, বাপী।’
‘নিজের এই পোষাকে আর এতো রাতে একটা মাত্র জাঙিয়া পরা একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নীচে যাব?
তার চেয়ে না হয় আমি গিয়ে দেখে আসছি আগে যে সত্যিই ওই ঘরে কোন বোমা রাখা আছে কি না?’
‘এই না বাপী, একদম না। ছেলেমানুষী করে তুমি সে রিস্ক নেবেই না। কি দরকার? আমি না হয় বলে দিই
যদি সত্যিই বোমা থেকে থাকে তো ওটাকে নিয়ে গিয়ে দিঘির জলেতে ঝুপ করে ফেলে দিতে এখনই।
আজকাল তো টাইমার দেওয়া সব প্ল্যাস্টিক বোমা হয়। বেশী ভারী হবার তো কথা নয়। নিয়ে যেতে ঠিক পারবে...’
‘তুমি কাকে বলবে, গৌরব?’
‘কেন কা আংকলকে’।
‘তিনি আসলে কে, গৌরব?’
‘তা তো ঠিক জানি না, বাপী। তবে তাঁর যা এখনকার রূপ দেখতে পাচ্ছি আমরা, তেমন সাধারণ
কোন জীব তিনি ঠিক নন, তা তো বোঝাই যায়’।
‘তবে এই নিয়ে তিনি আজ দু’বার আমাদের প্রাণ বাঁচালেন। তুমি বাড়ী, বাগান, পুকুর সব ঘিরিয়ে
দিয়ে যেয়ে যেও তো একটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে। খরচ তো তোমার কিছু হবেই। অন্য লোক ও সব রাখতে হবে।
একজন বিশ্বাসী হেড পাহারাদার ও কয়েকজন সিকিউরিটি চাই এতো বড় জায়গার জন্য। তা একটু পরে
পাখা ঝাপটানোর শব্দ হ’লেই সব বোঝা যাবে ...’
প্রায় আধ ঘন্টা পরে আমি সত্যিই সেই শব্দ পেলাম।
এ দেখি বেশ মজা তো। গৌরব বেশ অদ্ভূত ছেলে। কি ভাবে যে কি করে আর কি বলে সে
অনেকেই বুঝতে ও তো পারবে না।
পরদিন জমি জমা সম্পত্তির রেজিষ্ট্রির ও মিউটেশন করে নাম বদলানোর সরকারী কাজে লেগে যেতে
হ’লো উকিলবাবু আসতেই। সব মিটতে চার পাঁচ দিন লেগে গেলো। ইতিমধ্যে বিরাট পাঁচিল তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ।
মধ্যে আর কোন গন্ডগোল না হ’লেও আমরা সদা সতর্ক থেকেছি সব সময়।
কি করবো? প্রকৃতির কাছে থাকাকে অনেকেই যে ভালো চোখে দেখেন না আজকাল কেননা হাই
রাইজ তুললে প্রতিটি ফ্ল্যাটে বহু লাভ হয়। আমাদের যে গ্রামে ও শহর চাই। বিজলী বাতি, মার্বেল ফ্লোর,
জলের পাম্প, এ০সী০, ফ্রিজ সব সুখ সুবিধে ও কৃত্রিম পরিবেশই আজ আমাদের খুব বেশী পছন্দ।
কুয়োর জলে কুয়োতলায় বা দিঘিতে নেমে চান করা শহরের লোকের কাছে এক দুঃস্বপ্ন।
গ্যাস না হ’লে আবার যে রান্না হয়, অনেকে তা বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু সেই সব সুবিধা ভোগ করে
আজ তো আমার এই রূপবান ছেলেটা দেখি রোগা টিঙ টিঙ
করছে । আমার ও গ্যাস আর অম্বলের বুক জ্বালায় মোটেই ক্ষিধে হয় না। ঘুম ও কমে গেছে।
কিন্তু এই ক’দিন গ্রামে এসে কাঠের জ্বালে ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত খেয়ে দেখি যে খানিক পরেই আবার
বেশ ক্ষিধেমতন পাচ্ছে। কি সব কান্ড রে বাবা।
ধান জমির সেচ ও ফসলের জন্য ও সব ভাগ চাষের ব্যবস্থা করতে আর পাঁচিল তৈরী চলবার জন্য
হেড মিস্ত্রিকে টাকা পয়সা সব আগাম বুঝিয়ে দিয়ে কাজ শেষ করতে আরো দিন কয়েক যেতে আমরা
মাসখানেক পরে আবার চলে আসবো ঠিক করে ফেরার পথ ধরে নিলুম।
তা সে’খানে ফেরবার পথে অটোই ভরসা। ট্যাক্সি ও শুনি যে মেলে না। তাই সই । প্রধান লোক
দিয়ে অটো আনিয়ে দিলেন। জিনিষপত্র নিয়ে আমরা উঠতেই অটো ছেড়ে দিলো।
অনেকটা পথ। যেতে দু’ঘন্টা। জোরে ছুটলো অটো।
একঘন্টা পরে মাঝপথে অটো থামিয়ে চালক নেমে বলল-‘আমার পুরনো অটো। ওয়াটার কুল্ড ইঞ্জিন।
আমি জল নিয়ে আসি আপনারা দু’মিনিট বসুন।
আমি কিছু বলবার আগেই গৌরব বললো—‘বেশ তো, আংকল। আপনি জল আনতে যান। আমরা বসে আছি অটোতেই’।
আমার তখন সেই পাহাড়তলির গাছ পালার সবুজে ছাওয়া পথে ভ্রমণে মন বেশ ফুরফুরে।
তবে চালক এগিয়ে যেতেই গৌরব নীচে নেমে হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে বলল—‘বাপী, কুইক। জিনিষ নামাও।
আমাদের ুটতে হবে। হয় তো দু’মিনিট সময় আর হাতে আছে’।
‘দূরে একটা অন্য অটো রয়েছে দেখছি। তোমার সেই বালিসে গাঁথা অস্ত্র রেডি রাখো। আমরা ওই
অটোটা এখনই দখল করবো আগে। দরকার হ’লে ভয় দেখাতে হবে। এইটুকু পথ আসতেই অটোর
ইঞ্জিন গরম হওয়ার কথা মোটেই নয়। কিছু ব্যাপার আছে, বাপী’।
‘হুঁ, চলো। লোকজন কেউ আপত্তি করলে তাদের জব্দ করতে হবে’।
তা দেখি আপত্তি কেউ করলোই না। খালি অটো। লোকই কেউ নেই। আমি চালকের আসনে বসে
অটো ছেড়ে দিতেই দূরে কয়েকজন লোক হৈ হল্লা করে উঠলো। আমি বেপরোয়া হয়ে গৌরব যা বলছে,
তখন তাই করছি বিনা প্রশ্নে।
হঠাৎ গুড়ুম গুড়ুম দারুণ শব্দে আমি চমকে উঠতে গৌরব বললো—‘ওরা সশস্ত্র বাপী, গুলী ছুঁড়ছে
তবে চিন্তার কিছু নেই বাপী। তুমি একটু এঁকে বেঁকে চললেই হবে’।
আমি স্পীড নিয়ে জিগ জ্যাগ ড্রাইভিং করে চললুম ফাঁকা রাস্তা পেয়ে। কানের পাশ দিয়ে গুলী
ছুটছে সমানে জোর হাওয়ার সাথে। দ্বিতীয় অটো ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ গৌরব বললো-‘বাপী, ফুল স্পীডে চালিয়ে পালাও। বিপদ’।
আমি পুরো জোর দিয়ে অ্যাক্সিলেটার চেপে ধরলুম ঝুঁকে পড়ে। গিয়ার দেওয়াই ছিলো। আমার
মনে হ’লো বিকট এক বিস্ফোরণ হয়ে আমাদের অটোটা যেন উড়ে চলেছে।
দশ মিনিট পরে গৌরব বলল-‘বাপী, এখন স্পীড কমিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হ’য়ে চলো।
আর কোনো চিন্তা নেই। প্রচন্ড বিস্ফোরণে ওই অটোটা উড়ে গেছে। ডকুমেন্ট ক্যাবিনেটেতে লুকিয়ে
কেউ বিস্ফোরকের বড় একটা প্যাকেট ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছিলো মনে হয়’।
‘ঠিক হয়েছে। লোকটা তো আচ্ছা মিথ্যেবাদী....বজ্জাত...’
‘হ্যাঁ বাপী, চালক জল আনতে মোটেই যায় নি। মনে হয় নিজের প্রাপ্য আদায় করতে গেছিলো
কথা মতন। তবে চালক মশাই সময় ঠিক রাখতে পারেননি। স্পীড নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় মিনিট
পাঁচেক আগেই এসে পৌঁছে ছিলেন। নইলে আমাদের পৌঁছবার আগেই উড়ে যাবার কথা।
প্রাপ্য হাতে পাবার আগেই তিনি সোজা ওপরে হিঃ.......হিঃ..............হিঃ তবে মনে হয় বেচারা
আসল কথা কিছুই জানতো ও না যে তারই অটোতে....’
‘তা ঠিকই হয়েছে, নইলে তো আমরাই উড়ে যেতুম বাপী...হিঃ....হিঃ.....হিঃ...’
‘তা তো হ’লো গৌরব, কিন্তু আসল দুষ্টু যে লোক মানে কাউকে না জানিয়ে যে বোমাটা রেখেছিলো
হাত সাফাই করে, সে তো বেঁচেই রইলো’।
গৌরব হেসে বললো—‘তা এখন না হয় একটু থাক বাপী। একসাথে বেশী কিছু হওয়া ভালো নয়’।
‘বাপী, বেনারসের মতন শহরে থেকে তোমার আবার মন খারাপ হ’লে তখন না হয় এক মাস পরে
গ্রামে ফিরে এসে তোমার ওই গ্রামভোজনের সঙ্গে আবার তার সাথে ও বোঝাপড়া করলেই হবে।
হিঃ .... হিঃ .... হিঃ ....’।
============================================
০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ১৪/২/২০১৪
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।