পথের বিপদ
জি০সি০ভট্টাচার্য্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
‘কাকু, আজকাল তুমি আর দেখি একলা কোথাও বাইরে যেতেই চাও না। কেন বলোতো?
হয় বাদলকে নয়তো আমাকে ঠিক সঙ্গে নিয়ে যাও তুমি’.....................
‘আমার ভয় করে যে’।
‘যাঃ, এত্তোবড় একটা ছেলের আবার ভয়...তুমি যেন কি, কাকু....হিঃ...হিঃ...হিঃ...’
‘পথে কতো রকমের বিপদ আপদ ঘটে থাকে, একলা মানুষের জন্য সব যেন
ওঁৎ পেতে বসে থাকে তারা.... তা তুমি তো আর এই বাচ্ছা বয়সে সে সব জানো না চঞ্চল,
তাই বলছো...’
‘আমি তেরো বছরের একটা এতো বড় ছেলে হয়ে গেছি, আমি কি বাচ্ছা?’
‘অবশ্যই......অন্তত যতদিন না তোমার নিজের একটা কোন বাচ্ছা হচ্ছে...’
‘অ্যাই ছিঃ কাকু,.....ওসব বাজে কথা ছাড়ো তো ....আমাকে পথের বিপদের
গল্প বলো না তুমি একটা, জব্বর দেখে....’
‘এই তো ঠিকই হয়েছে।...তা চঞ্চল, গল্প কি আর বড়রা শোনে? ...
সুতরাং চঞ্চল হচ্ছে ছোট্ট একটা কচি বাচ্ছা........................কিউ০ ই০ ডি০....
হয়েছে তো প্রমাণ?’
‘অপরূপ সুন্দর দুধের বরণ পরীর দেশের রাজকুমার রূপধন্য ছেলে চঞ্চল নিজের
পাতলা গোলাপী ঠোঁট উল্টে বললো-‘সে তো কাকু, তোমার কাছে।
তুমি তো আমাকে এখন ও রাতে শোবার আগে গল্প শোনাও রোজ.....কোন দিন
কাঁধে বা বুকে ও জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে নাও .....তোমার কাছে দেখি আমার
আর বড় হওয়া ভাগ্যেই নেই, কাকু। সে আর কি হবে? নাও, তুমি এখন শুরু
করো তো, কাকু...’
‘আরে গল্প কি আর একটা, যে বলবো? এই যেমন ধরো আমি সে’বার যাচ্ছিলাম
কোলকাতা। বেনারস থেকে।
এ০সী০ থার্ড বি -ওয়ান কোচের ৮ নম্বর আপার বার্থে।
টিকিট চেকিং শেষ হয়ে বেড রোল পেতেই আমি ওপরে উঠে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে
পড়েছিলুম......একটা ষোল সতেরো বছরের ছেলে সামনের ৪ নম্বর লোয়ার বার্থে
ছিল। কনফার্মড বার্থ। চার্টে আমি দেখে নিয়েছিলাম ।
ছেলেটা ও শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলো। তা নতুন কয়েকজন যাত্রী উঠলেন মোগল সরাই
জংশন থেকে। তাঁরা একসাথেই যাবেন। ছেলেটা একা। ব্যস। তাকে সবাই মিলে সরিয়ে
দিলো আমার নীচের ৭ নম্বর সাইড বার্থে। তাই সই। নিজের জিনিষ পত্র বেড রোল
সব তুলে সরিয়ে নিয়ে সে তো চলে এলো।
আধঘন্টা ও কাটেনি । ট্রেন থামলো দিলদার নগর না কোথায়। উঠলেন এক মহিলা।
জানা গেল যে তাঁর ৬ নম্বর আপার বার্থ। তা তিনি উঠবেন কেন? বড় বয়েই গেছে ।
উল্টে কে একলা যাত্রী আছে সেই খোঁজ শুরু করলেন আর সেই ছেলেটা একলা
আছে জেনে গিয়ে তাকে ঠেলে উঠিয়ে আদেশ করলেন-‘ তুমি ৬ নম্বরে যাও আমি
এই বার্থে যাবো’।
ছেলেটা বার বার জায়গা বদলাতে রাজী না হওয়ায় তিনি তখন চুপ করলেন কিন্তু টি টি
আসতেই কাঁদুনি শুরু করলেন তার কাছে। সব শুনে টি টি উল্টে বললো—
‘এ লেড়কা, তু বুড়বাক হ্যায় ক্যা রে? জেনানা কো প্রাইভেসী চাহিয়ে এ ভি মালুম
নহি তুঝে। যা যা চলা যা উপর নহি তো ফাইন কর দেগা...সি আর পি কো পতা চল
জায়গা কি তু নে জেনানা সে বদতমিজী কিয়া, আউর সিধে অন্দর কর দেগা রে...’
পরে শুনি সেই মহিলা একখানা অর্ডিনারী টিকিট কেটে নিয়ে এ০সি০ কোচে উঠেছেন।
রিজার্ভেশনের বালাই নেই। টি টির সঙ্গে বসে হিসেব করতে ফাইন সমেত ভাড়া উঠলো
সাতশো টাকা আর তখন তিনি অবলীলায় একশো টাকার খান তিনেক নোট বটুয়া থেকে
বার করে টি০টি০ইর সাইড পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েই খিল খিল করে হেসে উঠলেন আর
টি টি সাহেব আরে ....আরে ...নহি নহি জী ...করতে লাগলেন। কনফার্ম টিকিট গোল্লায় গেলেন’।
পাতলা গোলাপী গেঞ্জী পরা চঞ্চল দুই নরম মসৃণ চকচকে বাহু দিয়ে তার কাকুর গলা জড়িয়ে
ধরে হিঃ হিঃ করে হেসে উঠে বললো-‘ধ্যাৎ কাকু, এই বিপদের ভয়ে তুমি...... যাঃ...’
‘আরে..... আরো আছে অনেক। তুমি শোনই না। তা আমি সে’বার কানপুর যাচ্ছি চৌরিচৌরা ধরে।
ভোরের গাড়ী। চারটে দশে বেনারস ছেড়েছে। জায়গা আছে দেখে একজন মাঝ বয়সী লোক
একটা বার্থে শুয়ে পড়েছিল। একটু পরেই তার বেশ একটু ঘর ঘর করে নাক ডাকতে শুরু করে’।
সামনের বার্থে এক জবরদস্ত মহিলা সবে আড় হয়েছিলেন। বার্থটি যে ভেঙে পড়ে যায় নি,
এই রক্ষা। কিন্তু দশ মিনিট ও গেলো না। তিনি লাফিয়ে উঠলেন। সেই লোকটিকে ঠেলে তুলে
দিয়ে সঙ্গে কে আছে ? কোথায় যাবে? টিকিট কই? এই সব জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলেন।
ঘুম চোখে কি যে হয়েছে তাই বুঝতে পারছে না সে বেচারা তখন ও। সব শেষে টিকিট ও
একখানা তার কাটা আছে দেখে সেই মহিলা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের একজন কোন
লোককে ডেকে বললেন-‘আরে বুধিয়া, তু এহি সীট পর আকে লেট যা আউর ইসে দরবাজে
কে পাস কঁহি পর লে জাকর বৈঠা দে। ই সোই তো বাজা বজি....অউর হামার নীঁদ টুটি.....আ... আ যা...’
তাই করা হয়ে গেল তখনি। আর খানিক পরেই সেই ডাকা বুকো চেহারার বুধিয়ার বিকট
নাক ডাকা ও শুরু হয়ে গেলো এক্কেবারে ঠিক কামান গর্জনের মতন। কে কি বলবে তাকে সাহস করে?
সে যেন ‘গর্জিলা মোহনলাল........ অবস্থা’
মহিলার ঘুমের কিন্তু আর কোনও ব্যাঘাত তো হ’লোই না। উল্টে তার নাক ও সমান
তেজে সঙ্গত শুরু করে দিলো তখন। সে কি গেরো রে বাবা। আমি পালাই পালাই ডাক
ছাড়া শুরু করলুম। কিন্তু ট্রেন ছুটছে। কোন সীট ও দেখি আর খালি নেই। যাই কোথায়?
আমার তখন ‘....বল মা তারা দাঁড়াই কোথা, আমার যে কেউ নাই শঙ্করী
হেথা অবস্থা ....’
শুনেই চঞ্চল হিঃ........হিঃ........হিঃ...........করে হেসে এক্কেবারে গড়িয়ে পড়লো
আমার বুকে। দারুণ মিষ্টি হ’লে কি হয়, চঞ্চল তো বেশ রোগা ছেলে একটা।
আমার কোন অসুবিধাই হয় না ছেলেটাকে তুলতে।
একটু পরেই সামলে নিয়ে ছেলে নিজের পদ্মপত্রের মতন আকর্ণ বিস্তৃত চোখ তুলে
বললো-‘নাঃ কাকু, এ’তে ভয় কোথায়? শুনি? তবে আর ও কিছু আছে মনে হয়।
তুমি বলো তো....’
‘তা সে ও আছে। শোনো.................’ ছেলেটাকে নিয়ে ঘরে পায়চারী করতে
করতে আবার বলতে শুরু করলুম অন্য এক ঘটনার কথা।‘আমি সে বার মধ্যপ্রদেশ
মানে এখনকার ছত্রিশগড়ের পহন্ডোর বলে এক অখ্যাত জায়গায় গিয়ে ট্রেন লেট
হয়ে রাত বারোটায় পৌঁছে কোথায় যাই, ভাবছি। তখন একজন এসে জিজ্ঞাসা
করলেন-‘একা না কী? ঘোর অন্যায়। তা এতো রাতে কোথায় যাওয়া হবেন?’
বললুম—‘বিষন সিংহের বাড়ী...’
‘তা সে একটু দূর তো আছে। কোশখানেক হ’বে। রিক্সা তো এখন আর পাবেন না।
কিন্তু পূর্ণিমার রাত তো তাই বেশ জ্যোৎস্না আছে। হেঁটে যেতে পারলে যেতে পারেন।
অসুবিধা হবে না। পথে রিক্সা ও হয়তো পেয়ে যেতে পারেন। অন্য দিক থেকে আসতে
পারে। তা হ’লে আপনি সেই রিক্সায় চড়তে ও পারবেন। কষ্ট ও কম হবে। কোন ভয়
নেই কিন্তু ভাড়া কত লাগবে জিজ্ঞাসা করবেন না আর ভূলে ও অন্য সওয়ারী
উঠাবেন না যেন সেই রিক্সায়’।
‘কেন বলুন তো?’
তিনি কোন উত্তর ও দিলেন না। হন হন করে হাঁটতে লাগলেন আর বাঁকের মুখে অদৃশ্য
হয়ে গেলেন অস্বাভাবিকভাবে..
আমি ও পথে নামলুম দুর্গা বলে। সারা রাত ফাঁকা ছাদ বিহীন প্ল্যাটফর্মে
কোথায় বসে থাকবো রে বাবা?
জোর পায়ে হাঁটছি। অনেকটা এগিয়ে গেছি।
হঠাৎ পেছনে শুনি ক্রিং ক্রিং.....
নির্ঘাৎ একখানা রিক্সা আসছে
‘ও ভাই। পলাশপুর যাবে। ঠাকুর সাহেবের বাড়ী...’
চালক কোন উত্তর দিলো না তবে দেখি রিক্সাখানা নিঃশব্দে এসে থামলো। আমি ও উঠে
বসলাম। গাড়ী ছুটলো...
মাইল খানেক যেতেই কিষণপুরের মোড়। রিক্সা ঘুরছে। হঠাৎ পাশ থেকে কে
একজন বললো-‘বাবুজী, আমি খঞ্জ মানুষ। পলাশপুরে আমার বাড়ী। যেতে পারছি না।
সন্ধ্যা থেকে বসে আছি। বাবু দয়া করুন..............আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিন।
আমি অর্ধেক ভাড়া ও দেব...’
রিক্সাওয়ালা আমার মুখের দিকে চাইল। বললুম—‘নাঃ, সে নিয়ম নেই। আমার তাড়া ও
আছে। দুই সওয়ারী নিয়ে ছুটলে স্পীড কমে যাবে রিক্সার’।
‘তা কে শোনে কার কথা। নিজের কথাই বলতে লাগলো সে একটানা। কাকুতি মিনতি
পায়ে হাতে ধরা....ও বাদ গেলো না। মহা বিপদ হ’লো আমার। শেষ মেষ আমাকে
নিমরাজী হ’তেই হ’লো আর সে পেল্লায় এক মোট নিয়ে লাফিয়ে রিক্সায় উঠে বসে
বললো—‘সোজা, মোঞ্জামগেট চলো.’
‘তার মানে? আমি তো আগে যাবো পলাশপুর.’
কেউ কোন উত্তর দিলো। রিক্সাখানা তখন যেন হাওয়ার বেগে ছুটতে শুরু করলো।
কোথায় কতোদূরে যে যাচ্ছি তাও বুঝলাম না।
তবে যে স্পীডে যাচ্ছি সে’ভাবে চললে একঘন্টায় অন্ততঃ পনেরে ষোলো কি০মি০ তো
অনায়াসে পার হয়ে যাবে। বিশ ও হ’তে পারে।
হঠাৎ একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়ে রিক্সা থেমে গেলো আর লোকটা লাফিয়ে নেমে পড়লো
বোঝাটা নিয়ে। কোন কথা না বলে সে একদিকে হাঁটা দিলো আর রিক্সাওয়ালা ও তার
পিছনে চলে গেল। হয়তো অর্দ্ধেক ভাড়া আদায় করতে। কে জানে?
আমি বসেই আছি। আর কিই বা তখন আমি করতে পারি?
হঠাৎ সেই অন্ধকারে একেবারে কানের কাছে রেল ইঞ্জিনের তীক্ষ্ণ হুইশেল শুনে আমি চমকে
উঠে একলাফে ছিটকে পড়লুম গিয়ে সামনের একটা ঘন ঝোপের মধ্যে আর আমার চোখের
সামনে দিয়ে একের পর এক ট্রেন কোচ ছিটকে চলে যেতে লাগলো সট সট করে। দারুণ স্পীডে।
রিক্সাখানার কোন পাত্তাই নেই। হয়তো ট্রেনের ধাক্কায় দূরে কোথাও ছিটকে গিয়ে পড়ে আছে।
আমাকে সঙ্গে নিতে পারে নি এই যা রক্ষা। মহা বিপদ তো। গেটবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ের
ঠিক ওপরে এনে রিক্সা থামিয়ে রেখেছিল । ব্যাটা বদমায়েসকে কে তখন একবার হাতে পেলে
মামার বাড়ী দেখিয়ে ছাড়তুম ঠিক।
চঞ্চল একটু গম্ভীর হয়ে বললো-‘কাকু, নির্ঘাৎ কোনো দুষ্টু লোকের কান্ড। তুমি একটু
সাবধান হ’লে অবশ্য এই সব দুর্ঘটনা আর হ’তে পারতো না। তা ঠিক, কাকু.’
আমার তখন বেশ ঘুম পাচ্ছিল চঞ্চলের আদরে। তাই আর দেরী না করে আমি ছেলেটাকে
নিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে শুয়ে পড়ে বললুম-‘এহ বাহ্য, চঞ্চল। এমন সব বিচ্ছিরী কান্ড
ও হয়েছে যা অবিশ্বাস্য.......’
‘তুমি বলো, কাকু...’
আমি মিষ্টি ছেলে চঞ্চলকে আগে বেশ খানিকক্ষণ কষে আদর টাদর করে নিয়ে বললুম-
‘এই ঘটনাটা কিন্তু রাজস্থানের । কি যে ব্যাপার হয়েছিলো, তা ঠিক বুঝতে পারি নি।
আমি যাচ্ছিলুম উদয়পুর। রাণাপ্রতাপ নগর থেকে বেশী দূর নয়। ট্রেন একদম খালি।
তখন ও সে’খানে লোকেরা সূর্যাস্তের আগেই যে যার খাবার খেয়ে নিতো আর বেশী
রাতে পুরুষেরাও কেউ ঘর থেকেই বেরোতোই না। মেয়েদের তো কথাই নেই। গ্রাম্য অন্ধ
বিশ্বাস বা সংস্কার আর কি। এখন তো সবই বদলে গিয়েছে। জনসংখ্যা বেড়েছে শহরে ও।
সে’সব নিয়ম ও হয়তো আর নেই।
তা ট্রেন ছাড়বার পরেই সেই যে মাঝপথে খানিক গিয়েই ঝপ করে থামলো আর সে চলেই না।
আধঘন্টার জায়গায় তিনঘন্টা কাটলো।
আমাদের কোচে একজন স্বাস্থ্যবান যুবক ছিলেন। মনে হয় গুজরাট বা অন্য কোন প্রদেশের
লোক তিনি। লোকাল নন। তিনি –‘ভাই, আমার জিনিষগুলো একটু তুমি দেখো, আমি
পতা লাগিয়ে আসছি কি হয়েছে...’ বলে নেমে গেলেন।
আমি কোচের ম্লান আলোর দিক চেয়ে ঠায় বসেই আছি একলাটি।
খানিক পরে ফিরে এসে তিনি বললেন-‘কোন এক আদিবাসী মহিলা একলা লাইন পার
হ’তে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় লাইনে ছিটকে পড়ায় গাড়ী আটক হয়ে ছিল। সুশ্রুষায় তিনি
চোখ খুলেছেন দেখে এলাম, তাই এখন ট্রেন চলবার পথ ক্লিয়ার হয়েছে’।
তাই শুনে আমি বললুম—‘ভাই, রাত এখন তো অনেক হয়েছে। এখানে তো শুনি রাত হয়ে
গেলে আর কেউ পথ চলে না বা কিছু খায় ও না। পুরুষেরা ও সব ঘরে ঢুকে বসে থাকে।
তা এখন এই সময় পথে একলা মহিলা কোথা থেকে এলো? আর ট্রেন অবরোধের লোক
সবই বা জুটলো কোথা থেকে? এই দেশ অতি রহস্যময়। তুমি বিদেশী। খুব সাবধান।
রাত বিরেতে অমন হুট করে যেখানে সেখানে একদম যেও না কিন্তু..................’
সে আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলো। বললো-‘শ্রমিক মহিলা হবে। কাজ সেরে
ফিরছিলো হয়তো......................’
তবে সত্যিই ট্রেন ছাড়লো কয়েক মিনিট পরে ।
আর তখনি কোচের বাইরে গেটে কে যেন নারী কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো—‘বচা ও...জান বচাও...’
যুবকটি লাফিয়ে উঠে ছুটে গেলো। ফিরলো পাঁচ মিনিট পরে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রায়।
সঙ্গে এক রাজস্থানী যুবতী। চোলি ঘাঘরা পরা।
যুবকটি কোনমতে বললো-‘ভাই, তুমি সব জিনিষপত্র একটু নজরে রেখো। আমি
একটু শুয়ে আরাম করবো এখন। এই মেয়েটি গাড়ির পাদানীতে ঝুলছিল। ট্রেন হঠাৎ
ছেড়ে দিতে উঠতেই পারে নি। আর একটু হ’লেই নীচে পড়ে যেত। আমি ও কে টেনে
তুলতে গিয়ে একদম সে বেদম হয়ে গেছি। দম নিকলে গেছে আমার। তবে একটা
জান বেঁচে গেছে, এই খুশী আমার............’।
এই বলে সে শুয়ে পড়লো...
আমি বললুম –‘ভাই, এ’খানে তো কোন স্টেশান নেই যে যাত্রী উঠবে এসে।
তায় এতো রাতে... আর দেখছি এ’তো অল্পবয়সী মেয়ে একটা। তুমি একে টেনে
তুলতে এতো কাহিল হ’লে কি করে? ....’
আমার কথা সে যেন শুনতে ও পেলো না। কিন্তু মুহূর্তের জন্য যেন সেই মেয়েটির চোখ
জোড়া আমার দিকে ফিরলো আর তাইতে যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠলো। আমি চমকে
উঠলাম তাই দেখে। মনে মনে বিপদের আঁচ পেলুম।
যুবকটি তখনি তার বাঁ হাত দিয়ে চোখ আড়াল করতে চাইলো যেন। কারণ বোঝা গেলো না।
তাই দেখেই মেয়েটি বললো-‘আংকল, আপ বত্তি বন্দ কর দে, উনকি আঁখ
মে পরেশানী হো রহী হ্যায়...’
কি আর করি? আমাকে কুপের একমাত্র জ্বলন্ত আলোটি নিভিয়ে ঘোর অন্ধকারে
বসে থাকতে হ’লো। খানিক পরে কেমন বিশ্রী চক চক চুক চুক শব্দে আমি চমকে উঠলুম।
ঠিক যেন বিড়ালে দুধ খাচ্ছে।
ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে টিপে দিলুম। খট করে
শব্দ হ’লো কিন্তু আলো জ্বললো না। মনে হ’লো আমি পাখার সুইচ হয়তো অন করেছি।
বেশ যেন হাওয়া লাগছে গায়ে। অনেক হাতড়ে ও আলোর সুইচ খুঁজেই পেলুম না আমি।
তখন তো আর মোবাইল টর্চ ছিলো না আর বিড়ি সিগারেট কিছুই আমি খাই না বলে
পকেটে দেশলাই ও ছিলো না।
হঠাৎ আমার মনে হ’লো যে আমার হাতঘড়িটার তো লুমিনেসেন্ট ডায়াল আছে।
ভবল ব্যাটারীতে চলে। একটা ব্যাটারী শুধু আলোর জন্যই লাগে।
আমি ঘড়িটা ঘুরিয়ে ধরে সুইচ টিপতেই মৃদু সবুজ আলো ঝলসে উঠলো সেই ঘোর অন্ধকারে
আর সেই স্বল্প আলোতে আমি যা দেখলুম, তা সারা জীবন আমার মনে থাকবে’।
‘কি? কি দেখলে তুমি, কাকু?’
উত্তেজনায় চঞ্চল আমার বুকের ওপরে উঠে বসলো শোয়া অবস্থা থেকে।
তারপর একটু উত্তেজিত ভাবে বললো-‘কাকু, আমার কিন্তু খুব গরম লাগছে। কেন কে জানে?’
আমি চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললুম--‘ভয় পেলে তো শুনেছি যে শীত করে।
তা তোমার গরম লাগছে যে, চঞ্চল?’
‘তুমি কিন্তু একদম ঠাট্টা করবে না, কাকু। তোমার গল্পের ক্ল্যাইম্যাক্স খুব স্ট্রং হয়।
তবে আমি তো বড় হয়েছি তাই কিন্তু মোটেই ভয় পাই নি, কাকু। এটা তার পূর্বাবস্থা।
তুমি বলে যাও....’
পরী ছেলে চঞ্চলকে আমার বুকে চেপে ধরে বললুম-‘সে তো বেশ ভালো কথা,
চঞ্চল......তা শোন......’
‘দেখি ....যেন একটা অজগরের মতন মোটা সাপের মতন কিছু একটা তখন
সেই যুবকটির বুকের ওপরে লম্বা হয়ে পড়ে আছে আর লকলকে চেরা জিভ দিয়ে
যুবকটির গালে মুখে চাটছে। আমি ভয়ে উঠে দাঁড়ালুম লাফিয়ে। চলন্ত ট্রেন এই ভয়ানক
জীব হঠাৎ এসে হাজির হ’লো কি করে? হয়তো ট্রেন থেমে থাকবার সময়ে অন্ধকারে
জানলা দিয়ে ঢুকেছে বা কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে’।
‘আলো নিভে গিয়েছিলো। আবার সুইচ টিপলুম আর দ্বিতীয়বার দারুণ চমক খেয়ে
প্রায় আঁৎকে উঠলুম আমি। কি সর্বনাশ? সাপ কোথায়? এ তো দেখি সদ্য আগতা সেই
মেয়েটা যাকে যুবকটি বাঁচিয়েছিল। সে তখন ঠিক যেমন তুমি আমার বুকের ওপরে
এখন শুয়ে আছো চঞ্চল, গল্প শুনবে বলে, সে ও তেমনি যুবকটির বুকের ওপরে
উঠে শুয়েছিল, আর সেই যুবকটিকে শক্ত করে দুই হাতে ঠিক আমি যেমন তোমাকে
জড়িয়ে ধরে রেখেছি, তেমনি করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। আর ও অদ্ভূত কান্ড। সেই
যুবকটি তার কবল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে যেন নিঃশব্দে কিন্তু প্রাণপনে চেষ্টা করছিল।
কিন্তু অতো স্বাস্থ্যবান হয়ে ও সে কিছুই করতে পারছিল না কেননা তিনি অপিরিচিত
সেই যুবকটির গালে, বুকে, মুখে, কপালে সর্বত্র চুমু খাচ্ছিলেন যেমন করে আমি
তোমাকে চুমু খাই। তাঁর এই অশোভনীয় আচরণের ফলে দেখি সেই যুবকটি যেন
কেমন অবশ অসহায় ভাবে নেতিয়ে পড়ছে........’
‘যুবকটির নড়া চড়া ক্রমে বন্ধ হ’লো এবং সে আর ও কেমন অসাড় আর
নিস্তেজ হ’য়ে পড়ে রইল তারপরে। তখনি ঘটল এক ভয়ংকর ঘটনা। কেউ বিশ্বাসই
করতে চাইবে না শুনলে’।
‘হঠাৎ সেই মেয়েটা চোলির মধ্যে থেকে একটি ছোট্ট সরু সুতীক্ষ্ন ছুরি বার করে
তাই দিয়ে যুবকটিরর গলায় ওপরে ইঞ্চি তিনেক মতন জায়গা কুচ করে একটানে
চিরে দিলো আর গলগল করে বেরিয়ে আসা লাল তাজা রক্তের ধারার ওপরে নিজের
পাতলা ঠোঁট চেপে ধরলো সজোরে........’
‘সে কী, কাকু? এ কি করে হ’তে পারে?’ চঞ্চল চেঁচিয়ে উঠলো।
‘তা জানি না চঞ্চল, তবে তাই না দেখে ভয়ে আমি অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলুম।
হাত কেঁপে গিয়ে আলো নিভে গেলো। অ্যাটাচী ফেলে রেখে আমি দৌড় দিলুম দরজার
দিকে পাগলের মতন। সে’খানে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। হু হু করে হাওয়া আসছে
কেননা পূর্ণবেগে ছুটছে ট্রেন। লাফিয়ে নেমে পড়া ও হচ্ছে তখন অসম্ভব। হাঁ করে
আমি দাঁড়িয়ে আছি কতক্ষন তা জানি না । তারপরেত হঠাৎ করে আমার মনে হ’লো
যে আমি কি বোকা। ঘড়ির সামান্য আলোতে কি দেখতে কি না দেখে মিছে ভয় পাচ্ছি কেন?
সেই অকারণ ভয় না পেয়ে বরং ঘড়ির আলোতে সুইচ খুঁজে নিয়ে আলোটা জ্বাললেই তো হয়’।
‘যা ভাবা সেই কাজ। ফিরে গিয়ে আলো জ্বাললুম। দেখি কোন সাপ বা মহিলার চিহ্ন ও নেই
কোচে তখন আর। আমার অ্যাটাচিটা নীচে পড়ে আছে । যুবকের ব্যাগ দু’টো ও ঠিক আছে
আর সে নিজে সামনের সীটে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, যন্ত্রনা বিকৃত ভয়ংকর মুখ হাঁ করে’।
‘তবে এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন ও নেই কোথাও। যুবকটির বুক কিন্তু তখন একদম স্থির।
ঘুমন্ত মানুষের বুকের মতন কোন ওঠা নামা নেই সেই বুকে। আমি তাকে জোরে জোরে
ডাকলুম কয়েকবার কিন্তু সে কোন সাড়া দিল না। তার নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে
ও শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষীণ আভাষ ও পেলুম না। তাকে ছুঁয়ে পরীক্ষা করবার সাহস আমার
হ’লো না, শেষে পুলিশের হাতে খুনী হিসেবে ধরা পড়বার ভয়ে’।
‘আমি কোচে কাউকে দেখতে না পেয়ে ছুটে গিয়ে আগে এক এক করে সব ক’টা
বাথরুম চেক করে এলুম। কোথা ও কেউ নেই দেখে আমি সব বেঞ্চের নীচে ও দেখে
নিলুম । মনে হ’লো সেই চলন্ত ট্রেনে আমিই তখন একদম একলা কোন জীবিত প্রাণী
বসে আছি যেন আর মৃত্যুর প্রহর গুনছি’।
‘শেষে সেই অভিশপ্ত কোচে আর কেউ নেই জেনে একটু নিশ্চিন্ত হ’য়ে তখন নিজের
অ্যাটাচিটা তুলে নিয়ে গিয়ে কোচের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালুম’।
‘তখন স্পীড কমছে ট্রেনের। আরো স্লো হ’তেই আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লুম ট্রেন প
্ল্যাটফর্মে ঢোকবার ঠিক আগেই...................অন্ধকারের মধ্যে......’।
‘পড়ে গিয়ে বেশ আঘাত ও লাগলো। তবে আমি সামলে নিয়ে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালুম
আর লেভেল ক্রসিং দিয়ে শহরে ঢুকে একটা অটোয় উঠে বসে কানে নাকে খত দিলুম
এই বলে যে ফের যদি ভূলে ও কখনো একলা পথে বেরোই। বাপ রে বাপ। আর একটু
হ’লেই খুনের দায়ে আমাকে জেলে যেতে হতো আজ, তা ঠিক। শেষে হয়তো ফাঁসী ও হ’তো’।
‘পথে একলা মানুষের জন্য কি সব বিপদ রে বাবা’।
০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২৫/৩/২০১৪
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।