• ৯ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা (১০৫)

    ২০২০ , ফেব্রুয়ারী



গৌরব
আনুমানিক পঠন সময় : ২৮ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫০ টি দেশ ব্যাপী ৪১২৭১ জন পড়েছেন।
গৌরব
====================

জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী
-----------------------------------
‘বাপী, আজ তোমার মুখ এমন ভার ভার কেন, বলতো?’
সে’দিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরবার সময় যথারীতি ছেলে গৌরবকে স্কুল থেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ফিরে এসে খানিকক্ষণ চুপটি করে বসে ছিলুম আমি।
হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে দেখি যে গৌরব নিজের ফর্সা সুন্দর মুখটা আমার মুখের খুব কাছে এনে নিজের টানা টানা চোখ দু’টোকে বেশ আরো বড়ো বড়ো করে চেয়ে আছে আমার দিকে…..এই বেশ অদ্ভূত ছেলেটার পরিচয় আর মনে হয় নতুন করে আবার দিতে হবে না….
বলে ফেললুম-‘কিছু বুঝতে পারছি না, তাই?’
‘কি বুঝতে পারছো না, বাপী?’
‘অ্যাঁ….কই? কিছু না তো…কি বুঝবো? .মানে …মুখ ভার তো নেই আমার…..এই তো দিব্যি হাসছি আমি…হিঃ…হিঃ…হিঃ…করে….
‘বাপী?’
‘বলো…’
‘তুমি সত্যি কথাটা বলে ফেলো তো টপ করে…’
‘কথা মানে তো কথাই…তার আবার সত্যি মিথ্যে হয় না কি?’
‘বেশ, তাহলে সেই কথাটাই বলো…’
‘কি কথা?’
‘এই যে তুমি রোজ যে সব কাজ চটপট করে ফেলো বাড়িতে এসেই আজ সে সব হচ্ছে না কেন করা? আমার সন্দেহ…..’
‘কি সব কাজ?’
‘এই যেমন মনে করো যে বাড়ী ফিরে এসে অনেক কাজ তো থাকেই করবার ….যেমন এক—নিজের অফিসের সব জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেস হওয়া…দুই—আমার স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুইয়ে দেবার জন্য আমাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া… তিন—বসে একটু জল খাবার খাওয়া…চার—ছাদে ব্যাডমিন্টন খেলতে আমাকে নিয়ে যাওয়া..পাঁচ—আমাকে পড়তে বসিয়ে দেবার পরে কিচেনে গিয়ে…..’
‘ওঃ…ওঃ..ওঃ…   …ওরে বাবা রে…এতো সব কাজ রয়েছে পড়ে আমার করবার জন্য আর আমি….তা বেশ হয়েছে….হচ্ছে সব…এই আমি উঠছি …তুমি চলো বাথরুমে…কি সাংঘাতিক ছেলেরে বাবা….’ 
রাত দশটায় সব কাজ সেরে ডিনারের জন্য গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছি।
হঠাৎ গৌরব বললো-‘বাপী, এক মিনিট….ডিনারের আগে একটু সময় চাই আমার ….ডালটা আমি আবার না হয় একটু গরম করে আনছি এখনই…’
‘কেন? ডাল তো বেশ গরমই আছে এখন ও…’
‘তা আছে, তবু ও…’
‘তবু ও কি?’
‘ওই মানে…আচ্ছা…টেবিল সল্টের শিশিটা ও তো চাই…আমার হাতে তুলে দাও না একটু, বাপী..’
‘তার মানে? কি সব বলে যে এই ছেলেটা….’
বলেই সন্দেহ হ’লো। তৎক্ষণাৎ আমি এক চামচ ডাল তুলে মুখে দিয়েই চমক খেলুম বেশ…নুনই দিই নি আজ ডালে …তা ছেলেটা বুঝলো কি করে রে বাবা? মুখে তো দেয় নি….  শুধু দেখেই…যাঃ
গৌরব খিল খিল করে হাসতে হাসতে ডালের বাউল হাতে নিয়ে কিচেনে চলে গেল।
কাল কি ভাবে কি করবো এই সব ভাবতে ভাবতে রান্না করলে এই হয়। রান্না করা ও একটা আর্ট….মনঃসংযোগ চাই…. 
আজ বলে নয়… মাত্র ছয় বছর বয়সেই এই অপরূপ সুন্দর চকচকে ঝকঝকে গৌরব নামের ছেলেটা নিজে নিজেই নিজের ও ঘরের সব কাজই করতে শিখে নিয়েছে। আমি কিছুটি শেখাই নি আর করতে চাইলে ও আমি কোন কাজই করতে ও দিই না……. কখন কি কান্ড করে বসবে এই ভয়ে…তবে আশ্চর্য এই যে গৌরব যখন যা করে একেবারে নিঁখুত ভাবেই করে…নির্ভূল হিসেবে….শুনেছি এইরকম সেল্ফ লার্নিং আর পারফেক্ট ওয়ার্কি করা সম্ভবপর হয় শুধু হাইলি ট্যালেন্টেড বাচ্ছাদের পক্ষেই। 
আমি গৌরবের আই০কিউ০ আর সৃজনী শক্তির টেস্ট নিইনি ….তাই ঠিক করে কিছু বলা কঠিন তবে মাঝে মাঝে আমার মনে বেশ সন্দেহ হয় যে এই ছেলেটা হয় খুব সরল মানে…. আজকালকার হিসেবে বোকা আর নয়তো অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে আর তাই সাধারণ লোকে এমন ছেলেকে পাগল বলে উপহাস ও করতেই পারে কেননা তাদের কার্য কারণ বিশ্লেষণ করা সাধারণ লোকের পক্ষে হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য….
যাক…ডিনার সেরে নিলুম আজ চুপচাপ। গৌরব ও একটি কথা বললো না। 
রোজ ডিনারের পরে বসে আমি কিছুক্ষণ হয় বই পড়ি আর নয় তো ছেলের সঙ্গে বসে টিভিতে আকবর বীরবল দেখি। ছেলেটাকে খুব খানিকটা আদর টাদর ও করি তখন আর তার স্কুলের গল্প শুনি। আজ কিচ্ছু ভালোই লাগছিল না তাই উঠে গিয়ে নিজের বিছানার বেডকভার সরিয়ে তাড়াতাড়ি বেডসীট বদল করে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়লুম….অবশ্য তার আগেই ছেলের ঘরে গিয়ে তার বিছানা…মশারী  সব রেডী করে দিয়ে এলুম আমি…
কিন্তু শুয়ে পড়লে কি হবে ঘুম আর আসছিলো না…মনে হচ্ছিল একটা বুদ্ধির খেলায় আমি গো হারাণ হারতে চলেছি কাল…. জেতবার চান্স শুধু শতকরা…দশ ভাগ……
একটু পরে দেখি শুধু একটা নেটের সাদা পাতলা স্লিভলেস গেঞ্জী ও ছোট নীল জাঙ্গিয়া পরে গৌরব ও আমার ঘরে এসে হাজির। তার মানে ছেলেটা পোষাক ছেড়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়েছিল হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে…
‘কি হয়েছে. গৌরব?’
‘তোমার যা হয়েছে, তাই বাপী…’
‘তার মানে…আমার আবার কি হয়েছে? কিছুই না তো….’
‘মানে ঘুম আসছে না…মানে এখানে তোমার কাছে আজ আমি একটু শোব..’
‘ওঃ…তাই বলো…তা এসো……তবে তোমার তো আবার ঘুমই হয় না আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলে ….  .’
ছেলেটা এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ে দু’হাতে নিজেই তখন আমার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো--‘ ও বাপী..’
আরেঃ….এ যে দেখি মেঘ ও না চাইতেই জল…
‘কি?’
‘কাল তোমাকে কোথায় যেতে হবে, বলো না, বাপী?’
‘মির্জাপুরে…আরে…আরে…যাঃ….  না…না…আমি আবার কোথায় যাবো? কে বললে যে আমি কোথা ও যাবো? কোথা ও না….’
‘কেউ বলে নি, বাপী ….তা অফিসের কাজে তুমি হঠাৎ যাবে কেন বাইরে? তুমি কি ক্যাশিয়ার না কালেক্টিং অফিসার?’
‘তারা সব বোল্ড আউট হয়ে গেছে গত দু’দিনে…..…এই মরেছে…না…না…আজ কি সব যা তা কথা যে খালি বলে ফেলছি আমি ….আমি আউটিংয়ে যেতেই বা যাবো কেন শুনি? …’
‘বাপী….জানো তো…পেটের মধ্যে সব কথা চেপে রেখে দিলে কি হয়?’
‘কি হয়?’
‘হয় জায়গার অভাব আর খাবার হজমই হয় না তখন জায়গার অভাবে…আর তাই ঘুম ও আসে না কেননা হজমই যদি না হয় তো সেই কাজের জন্য শরীরের যে এনার্জি খরচ হয়ে যায় বলে আমাদের ঘুম আসে তার অভাবে আর ঘুম ও আসে না …..হিঃ….হিঃ….হিঃ…’
‘খেয়েছে….তার মানে…আমি হচ্ছি একটা মেয়ে….’
‘যাঃ….কি যে বলো না বাপী…. হিঃ…হিঃ…হিঃ….মোটেই আমি তা বলিনি …তাদের তো ওই দশা হয়েছে যুধিষ্ঠিরের শাপে…তাই না বাপী? তবে ছেলেরা ও কথা লুকিয়ে রাখলে পরের জন্মে হয়তো….’
‘হয়তো আবার কি?’
‘এই মনে করো সে একটা মেয়ে হয়ে জন্মাতেই পারে…’
‘যাঃ….যত্ত সব বাজে কথা রাত দুপুরে…’
‘বাপী…?’
‘বলে ফেলো…’
গৌরব উঠে বসে বললো-‘বাপী, তবে কি সব কথা আমিই এখন গিয়ে জেনে আসবার চেষ্টা করবো আর খানিক পরে এসে সবটা বলে ফেলবো গড় গড় করে…?’
খপ করে গৌরবের চকচকে মসৃণ নরম ডান হাতটা চেপে ধরে আমি বললুম-‘না….না …তার কোন দরকার নেই…এই রাতে কোথাও যাবে না তুমি কিছু জানবার জন্যে…এই রকম প্রায় খালি গায়ে… খবরদার…’
‘তবে বলো তুমি কেন করবে অন্যের কাজ?’    
‘আরে বাবা…বসের….মানে ম্যানেজারের হুকুম …তার আমি কি করবো?....না ….না …ও সব কিছু নয়…তুমি এখন…….’
‘আঃ…বাপী…সে কথা আমি জানি…মানে আগেই বুঝেছি …কি্ন্তু কেন?’
‘বিজন ও সুজন ফেল করেছে বলে…’
‘কি ভাবে ফেল করলো তারা, বাপী?’
‘নাঃ…এ তো বড় মুশ্কিল হয়েছে দেখছি আমার এই এক ছেলে নিয়ে…..কি আর করা যায় এখন? তা সব কথা বলছি, শোন…..’ 
ছেলেটা আবার শুয়ে পড়ে দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কথা শোনায় মন দিলো…
‘গৌরব….তুমি তো জানো যে আমাদের অফিস একটা এম এন সি …ফাইন্যান্স কোম্পানী…লোন দেয়া নেওয়ার অনেক কাজ করা হয়ে থাকে তাই…মির্জাপুরের এল সি কোম্পানী গত বছরে লোন নিয়েছিল ষাট লাখ টাকা….  বছরে বছরে সুদ সহ পেমেন্ট করবে দশ বছরে…এই বছর গত মাসে তাদের সাড়ে দশ লাখ টাকার কিস্তি মানে ইন্সটলমেন্ট দেবার কথা…তা সে সব দেবার নামটি ও নেই …চিঠি দিলে ও উত্তর নেই। তখন ম্যানেজার ফোন করে জানতে চায় শুধু একটা কথা … ‘তবে আমরা কি পুলিশ নিয়ে আসবো?..’
‘আমাদের ম্যানেজার লোকটা আবার বেজায় কড়া আর কারো ধার ধারে না। কোন খাতির ও করে না কাউকে।একেবারে পাক্কা রামগড়ুরের ছানা….ঠিক যেন একটা কটকটে ব্যাঙ….’
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…রামগরুড়ের ছানাদের যে হাসতে মানা তা আমি জানি কিন্তু বাপী…. মানুষ আবার ব্যাঙ হয় নাকি? তা ও আবার কটকটে…যাঃ…তুমি যেন কি, বাপী…’
‘হুঁ…দেখনি তো তাঁকে…মুখখানা একবার দেখলেই ঠিক বুঝতে পারবে…’
‘তা বুঝবো হয়তো….তবে তোমার স্বল্পবাক ম্যানেজারের প্রশ্নটা কিন্তু ধার করা..’
‘কার কাছ থেকে, শুনি?’
‘মনে হয় শার্লক হোমসের কাছ থেকে…’
এই সেরেছে… ছেলেটা বলে কি? নির্ঘাৎ কোনান ডয়েলের কোন গল্পের কথা বলছে…  
‘হুঁ…তা হতে পারে কিন্তু ওই কথাটায় কাজ হয়েছিল বেশ… শোন….তখন ওই এল সির জি০এম০ ভদ্রলোক একেবারে ঠিক উল্টো সেজে বসলো। একেবারে ভদ্রতার অবতার যেন। 
চুপ করে সব শুনে বললো—‘স্যার….স্যার…আপনি কি যে বলেন…আপনার পেমেন্টের চেক তো কবেই রেডী হয়ে গেছে, স্যার। তবে জানেন তো স্যার, যে বাজার ভীষণ মন্দা চলছে …দায়ে পড়ে আমাদের পঞ্চাশভাগ কর্মচারিকেই সব ছাঁটাই করে দিতে হয়েছে….ডাকে যে পাঠাবো সে লোক ও নেই….তাই বলছিলাম কি আপনাদের তো কালেক্টিং করবার জন্যে ও আলাদা স্টাফ আছে, স্যার…যদি কাল তেমন কেউ আসতে পারে তো সঙ্গে সঙ্গে চেক রিসিভ করিয়ে দেবো…তখন আপনি দেখতেই পাবেন যে গত মাসের তারিখেই চেক তৈরী করা হয়েছিল কি না…’
‘তারপরে, বাপী…’
‘তারপরে আর কি? সে’দিন কালেক্টিং স্টাফ খালি ছিলো না কেউ তাই ম্যানেজার ক্যাশিয়ারকেই হুকুম দিলেন মির্জাপুরে যাবার জন্য। তখন বিজন ক্যাশের চার্জ দেয় কাকে? সে এক মহা মুশ্কিল…..
ক্যাশ তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না সারাদিন…আর যাকে তাকে ক্যাশের চার্জ দেবার ও নিয়ম নেই। এক এস০ও০ আর নয়তো ম্যানেজার নিজে নিতে পারে চার্জ।  

অগত্যা আমাকে ক্যাশে বসিয়ে পরশু সে গিয়েছিলো দশটার বাসে। এক্সপ্রেস বাস…বেলা সাড়ে বারোটায় মির্জাপুর পৌঁছে সে ওই অফিসে যেতেই ম্যানেজার নিজে উঠে এসে তাকে চেক দিয়ে রিসিভিং নিয়ে ফাইল করে দেয়। দেখা গেল যে সত্যিই গত মাসের তারিখের চেক…  চেকটার মোবাইলে ফটো তুলে আমাকে ও ম্যানেজারকে তৎক্ষণাৎ বিজন ওয়াটস্ আপ করে দিয়ে তবে ফেরার বাসে ওঠে বেলা একটার পরে….’
‘হুঁ…এই অবধি তো সব ঠিক আছে মনে হচ্ছে ….আচ্ছা, তারপরে কি হ’লো, বাপী?’
‘আরে ছেলে…শোনই না….বেলা সাড়ে তিনটের সময় বাস থেকে নেমেই ব্যাংকে ছোটে বিজন চেকটা জমা দিতে। ফর্ম ফিলআপ করে চেকের ফটো থেকে চেক নম্বর তারিখ ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ নাম সব লিখে দেয়। চেকটা পিনআপ করবার সময় পার্স খোলে সে আর তখনি সে একেবারে আঁৎকে ওঠে। 
‘তার বেশ মনে ছিলো যে সে বাসে টিকিট নিয়েছে টাকা দিয়ে…’ 
‘কিন্তু তখন তার পার্স একেবারেই ফাঁকা ….না আছে টাকা…না বাসের টিকিট ..আর না চেক…ভাগ্যিস বিজন বুদ্ধি করে ওয়াটস আপ করেছিলো আগেই চেকটার কপি নইলে তার চাকরী তো যেতোই জেলে ও পাঠাতো ম্যানেজার । অবশ্য এফ আই আর করানো হ’লো তখনি….তাকে  জিজ্ঞাসাবাদ করা হ’লো এবং সেই এফ আই আরের কপি সহ চিঠি ফ্যাক্স করে দেওয়া হ’লো এল সি কোম্পানিকে। ফোন করে ও সব জানালেন আমাদের ম্যানেজার…’        
‘হুঁ… মনে হয় এটা ওই বাসেতে কোন পকেটমারের কাজ…। তাই না বাপী?’
‘হয়তো…আমি…ঠিক বুঝতে পারছি না, গৌরব…’
‘কি বুঝতে পারছোনা. বাপী? …ওঃ …বুঝেছি …বুঝেছি…’
‘কি বুঝেছো?’
গৌরবের তুলিতে টানা সুন্দর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল একটু। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আস্তে করে সে বললো-‘হুঁ…. খালি পার্সটা…. সন্দেহজনক….তারপর, বাপী?’ 
এল সির ম্যানেজার অবশ্য বললেন—‘স্যার, আমরা অবশ্যই রিসিভ করিয়ে দিয়েছি চেক আপনাদের স্টাফকে। লিগ্যালি আমরা আর অন্য চেক ইসু করতে ও পারি না…বাধ্যতা ও নেই। আপনারা একটু যোগ্য লোককে পাঠাবেন তো। তা সে যাক…মানবতা বোধ বলে ও তো একটা কথা আছেই ….হয়তো অডিট অবজেকশান ও হবে…এক বিষয়ে ডবল পেমেন্ট করলে….। কিন্তু যেই নিয়ে থাক সে মনে হয় ক্যাশের লোভেই পকেট মেরেছে। তবে অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেক তো আর ক্যাশ করাতে পারবে না সে। আর আমরা ও ব্যাংককে এফ আই আরের কপি দিয়ে ওই চেকটার পেমেন্ট ব্লক করে দিতে বলেছি। তাই ডবল পেমেন্ট হবে না …তাই স্যার বলছি কি… আপনি চিন্তা করবেন না …আপনার জন্য আজকের তারিখে আবার অন্য চেক তৈরী করিয়ে রাখছি…যদি দয়া করে একজন একটু সতর্ক আর এক্সপেরিয়েন্সড লোককে পাঠাতে পারেন কাল….’
‘হুঁ….বক্রোক্তি অলংকার ….আচ্ছা … বাপী….ওই খালি পার্সটা অন্য কারো নয়তো ?’
‘না’
‘ঠিক আছে…তারপরে,বাপী?’
‘তাই ঠিক হয়ে গেলো ….আর পরদিন সুজনের ডাক পড়লো…আর তাকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে যেতে বললেন ম্যানেজার…’।
‘কাল সে তাই গিয়ে আবার চেক রিসিভ করে আর যথারীতি ওয়াটস আপ করে দেয়। ফোন ও করে ম্যানেজারকে। তাঁর কাছে জানতে চায় যে খুব কাছেই স্টেট ব্যাংকের মির্জাপুর শাখা রয়েছে… সে’খানেই গিয়ে চেকটা জমা দিতে পারে কি না সে? বস বলেন তা গিয়ে দেখতে পারো তবে রসীদ নিয়ে নিয়ো। সে চলে যায়। চেক জমা করে হাতে হাতে রসীদ মানে কাউন্টার ফয়েলে স্ট্যাম্প মেরে দিতে বলে। তারা বলে আমাদের চেক ড্রপ বক্সে ফেলে দিয়ে চলে যান।এখন আর রিসিভিং দেবার নিয়ম তো নেই আমাদের..….’।
‘তখন আবার ফোন করে সে ম্যানেজারকে….তিনি বলেন –‘আরে….এক তো রিসিভিং দেবে না বলছে এস বি আই …তাই চেক জমা দেওয়ার কোনই আইনগত প্রমাণ থাকছে না আমাদের কাছে….আর দ্বিতীয়তঃ অনেক সময় ও লাগবে চেক ক্লিয়ারিংয়ে চলে গেলে… আর ওরা যে বি ও আইয়ের চেক দিয়েছে সেই ব্যাংকেরই বেনারসের শাখায় আমাদের ও একটা অ্যাকাউন্ট রয়েছে ….তারা রিসভিং ও দেয় আর সময় মতন চেক জমা দিলে আজই টাকা ও এসে যাবে অ্যাকাউন্টে….তুমি ছেড়ে দাও…আর চলে এসো…’.
নির্দেশ  মতন সুজন এসে তখন গাড়িতে ওঠে চেক জমা না দিয়ে।গাড়ী ছেড়ে দেয় ফুল স্পীডে….’
‘চুণার ক্রস করে গাড়ী মাত্র একঘন্টা সময়ের মধ্যে। কেলহট বাজারের খানিক আগে একটা লেভেল ক্রসিং আছে। রেল গেট তখন ট্রেন আসবে বলে বন্ধ ছিল। তাই ট্যাক্সি থেমে যায়। তখনি একটা ট্রেন ও এসে বেরিয়ে যায় তবে আরো একটা ট্রেন যাবার ছিলো বলে গেট খুলতে আরো দশ মিনিট লেগে যায়…… সেই দেরির ফলে সে’খানে গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায় স্বাভাবিক ভাবেই…. ট্রাক জীপ ট্রাক্টর আর অন্য সব গাড়ির। আধঘন্টা কেটে গেলে ও গাড়ী আর এগোয় না। 
বসে থাকতে থাকতে সুজন এক ফেরিওয়ালার দেখা পায়। সে তার কাছ থেকে ঝাল মুড়ি আর টুকরো নারকোল কিনে তাই খেতে থাকে ক্ষিধে মেটাতে… ড্রাইভারকে ও দেয়… আর কিছুই সেখানে ফেরী করছিলো না যে তারা কিনে খাবে’।
‘আরো বিশ মিনিট পরে লেভেল ক্রসিং পার হয়ে গাড়ী আবার চলতে থাকে…’।
‘সুজন বেশ সজাগ ছিল তবে মনে হয় বসে বসেই তার কখন যেন একটু তন্দ্রামতন এসে গিয়েছিল। হঠাৎ সে দেখে একটা টি স্টলের সামনে তার গাড়িটা থেমেছে আর ড্রাইভার তাকে ডেকে বলছে-‘স্যার…কি জানি কেন আজ এই অসময়ে হঠাৎ আমার বড্ড ঘুম আসছে ..আমি এক কাপ চা খেয়ে নিই বরং…নইলে হয়তো দুর্ঘটনা হয়ে যাবে, স্যার…’  
সুজন বলে-‘আরে…সত্যিই তো…তা এই নাও টাকা আর আমার জন্য ও এক কাপ এনো তো… হঠাৎ ভীষণ ঘুম আসছে আমার ও…
ড্রাইভার নেমে গেলো আর …..বসে বসেই সুজনের আবার একটু ঘুম এসে ছিল মনে হয়…তার ঠিক মনে নেই…. তবে পাঁচ মিনিট পরেই চা নিয়ে চালক আসতে….সুজন ট্যাক্সিতে বসেই চা খেয়ে নেয়।  তখন তারা আবার স্টার্ট দেয় গাড়িতে ….তারপর সে সোজা অফিসে এসে ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে হাতের ফোলিও ব্যাগ খোলে চেক দিতে কিন্তু তখনই সে এক চিৎকার দিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। দেখা গেল যে তার ব্যাগ একদম খালি…কিচ্ছু নেই…’
‘হিঃ….হিঃ….হিঃ….এ আর পকেটমার নয়, বাপী …একেবারে ব্যাগ মার…মানে ব্যাগের জিনিষ মার……… বেশ মজা তো বাপী….তারপর?’
‘তারপর আর কি? আবার সব আগের দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে হ’লো….ম্যানেজারের উঁচু মাথা আর বড় মুখ নীচু….সব মিটে যাবার পরে ফোনে এল সি কোম্পানিকে আবার সব জানালো হ’লো …. তবে এই বার কথা হ’লো পুলিশের মাধ্যমে……তা সব কথা শুনে সেই ম্যানেজার খুব দুঃখ করে বললেন-‘আ….হা …হা….রে…. বলেছিলাম না একটু সজাগ আর সতর্ক লোককে পাঠাতে….আর এক ঘুম কাতুরেকে পাঠালেন… .ছিঃ…ছিঃ… তা কি আর করবেন বলুন, স্যার। মির্জাপুরের চোর আর ডাকাত দুই তো বিশ্ব বিখ্যাত… তাদের টেক্কা দিতে পারে এমন লোক কি আর বেনারসের মতন ধর্ম প্রধান মানে আধ্যাত্মিক জায়গায় আছে, স্যার?...’.
‘হুঁ….বিখ্যাত না ছাই…. কুখ্যাত।….তখন কি হ’লো, বাপী?’
তিনি আরো জানালেন-‘তা স্যার… আমি না হয় পাঠিয়েই দেব চেক আবার তবে মাসখানেক সময় চাই কেননা সামনের সোমবার অন্য একটা পেমেন্টের …মানে পারচেজ সেক্সানের কাজে আমাকে কোলকাতায় যেতেই হবে…কাল শনিবার ….হাফ ডে …..চেক আবার তৈরী করিয়ে দিতে পারি….আর কালই যদি পারেন তবে নিয়ে যান আবার এসে আপনাদের চেক। আর তা না হ’লে একমাস পরে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো আপনাকে আপনার চেক……’
ম্যানেজার শুনে চুপ…..অপমানে মুখ লাল……….তাই কাল নিজেই যাচ্ছেন সঙ্গে গান ম্যান নিয়ে আর আমাকে ও সঙ্গে যেতে হবে ….হুকুম দিয়েছেন…আটটার সময় গাড়িতে উঠতে হবে …’
‘তিনি নিজেই যখন যাচ্ছেন তখন আবার তোমাকে যেতে হবে কেন, বাপী?’
‘তিনি নিজে ও আমার সিকিউরিটি সেজেই সঙ্গে যাবেন ….ম্যানেজার হয়ে নয়…আমাকে পাহারা দেবেন শুধু আর চেক রিসিভ করা থেকে সবকিছুই আমাকে সই করে করতে হবে….বেলা একটার মধ্যে ব্যাংকে গিয়ে চেক জমা ও আমাকে দিতে হবে ….মানে আমিই ডেপুটেড হয়েছি কালকের জন্য…টি এ… ডি এ… ও .সব পাবো আর সফল হতে পারলে হয়তো পারচেজ কন্ট্রোলারের মতন লাভজনক পোষ্টে আমার প্রোমোশন পাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না….’
‘আর তা না পারলে…তখন কি হবে, বাপী?’
‘সে তো আর কিছু বলে নি….তবে মনে হয় হয়তো সোজা ঘাড়ধাক্কা দেবে… যতোই হোক…প্রাইভেট কোম্পানী তো…’
‘হিঃ…হিঃ….তা এই রকম ব্যবস্থা কেন করা হয়েছে, বাপী?’
‘পুলিশের সন্দেহ হয়েছে যে এটা আর সাধারণ কোন পকেটমারের কাজ নয়। কোন প্রি প্ল্যান করা অপরাধ। তবে মোটিভ মানে স্বার্থ বোঝা কঠিন….  আর সরকারী কোম্পানী না হ’লে তারা তো আর আাদের মতন কোন প্রাইভেট কোম্পানিকে ডাইরেক্ট পুলিশ প্রোটেকশান দিতে পারে না…তাই…’
‘তবে বলেছে যে স্পেশাল পারমিশান দিতে পারে গাড়িতে একটা হুটার হর্ণ লাগাবার জন্যে …..এই…যা’… 
‘তা কাল তোমরা যাবে কি ভাবে. বাপী?’
‘ম্যানেজার নিজের গাড়িতে যাবেন ….ড্রাইভার থাকবে…মনে হয় সে ও সশস্ত্র থাকবে….তাই ভাবছি কাল আবার কি এক নতুন ফ্যাসাদ ঘটবে….কে জানে?’
‘কি আবার হবে, বাপী?’
‘খন্ডযুদ্ধ ও হতে পারে তো…ও রে বাবা?’
‘তা হয়তো না হতে ও পারে…তবে একটা কথা বলি, বাপী?’
‘বলে ফেলো …আমার সোনা ছেলে…’
‘কাল আমি ও তোমার সঙ্গে যাবো। গাড়ী আমাদের বাড়িতে এসে পিক আপ করবে আমাদের…’
আমি বেশ চমকে উঠে বললুম…. ‘ওরে খাইছে রে…খাইছে….এক্কেরে খাইয়া ফ্যালাইছে আমারে…’
 ‘হিঃ….হিঃ….হিঃ…কেউ খায়নি এখন ও…তবে আমি না গেলে কেউ হাঁ করে খেতে আসতেই পারে …’
‘কাকে খাবে? কখন খাবে? কেন খাবে?’
‘খাবে চেক…খাবে ফেরবার সময়…আর কেন যে খাবে তা জানা যাবে তুমি ব্যাংকে গিয়ে চেকটা জমা দিয়ে দিতে পারলে তার পরে… আগে নয়……’
‘আর একটা কচি বাচ্ছা ছেলে সঙ্গে থাকলে আর কেউ কিছুটি করতে পারবে না বলছো। লোকে শুনলে যে হাসবে আর পাগল ও বলবে আমাকে…’
‘তা বলতে হয় তো বলবে….বললে তার আর আমি কি করতে পারি?’
‘মনে হয় তুমি কিছু সন্দেহ করেছো, গৌরব…’
‘খুবই বাজে আর বুদ্ধিহীনের মতন….মানে অকলমন্দির কাজ…আর কি, বাপী ..’
‘নাঃ….এই ছেলেটাকে নিয়ে আর তো পারা যায় না দেখি। বলে কি না বুদ্ধিহীনের মতন কাজ মানে অক্লমন্দির কাজ….যাঃচলে…এ একেবারেই পাগল…’
‘কেন, বাপী? অক্ল মানে বুদ্ধি নয়?’
‘হ্যাঁ….বুদ্ধি….তো….কি হ’লো তাইতে?’
‘আর মন্দ মানে কম নয়?’
‘হ্যাঁ ….কমই তো… ’
‘বাপী….একে বলে রাষ্ট্রভাষা…..এ তোমার বংগলিয়াদের ভাষা তো আর নয়। অক্লমন্দ যে হবে তার অক্ল মানে বুদ্ধি আর মন্দ মানে কম….বুদ্ধি কম আছে যাহার…তাইতো? তা  সে বুদ্ধিমান হয় কি করে বলো তো, বাপী?’
‘ওঃ…ওঃ ..ও রে বাবা…এই সেরেছে রে কর্ম…এই ছেলের সাথে তর্ক করতে গেলেই দফা ফরসা….হিন্দী তে যেমন ঊর্দু ঢুকেছে তেমনি এই ছেলে এখন ব্যাকরণ ঢুকিয়ে…..ওঃ….আমি সামলে নিয়ে বললুম-‘তা আমি যাবো অফিসের ডিউটিতে…একটা কচি বাচ্ছা ছেলে সঙ্গে নিয়ে যাবো কোন সুবাদে তাই শুনি?’
‘তোমার ছেলের সুরক্ষার জন্য…কাল শনিবার…আমার স্কুল নেই….তুমি মনে করে নাও যে আমার মামার বাড়ির সবাই  গেছেন বেড়াতে …মানে…আমি এই  বলতে চাইছি যে এমন কোন আত্মীয় নেই তোমার যার কাছে ছেলেকে রেখে তুমি যেতে পারবে…আর একলা বাড়িতে রেখে যাবার ও সাহস তোমার নেই…তাই আর কি। তুমি…বলোই না… আছে তোমার সে সাহস?’
‘ওরে বাবা….না…না…কে বলে আছে? নেই..নেই ..সাত জন্মে ও নেই…’ 
আমি শুনেছি সাধারণতঃ লোকে না কি নিজের বৌকে ভয় করে চলে খুব আর ওঠে বসে ও তাদের হুকুম মতন …জোরু কা গোলাম ও হয়ে থাকে অনেকেই…এমনকি অনেক বড়ো বড়ো রাজা বাদশা ও বাদ যায় না…আর আমার ভাগ্যে সেটুকু ও দেখি নেই…তাই শেষে কি না….ভাগ্যে হ’তে হবে ছেলের গোলাম …কোন মানে হয়? 
‘তবে এখন চুপটি করে শুয়ে ঘুম করো দেখি, বাপী…আর একটা ও কথা নয়। কাল ভোরে উঠে তৈরী হতে হবে…আর তোমার বসকে ফোনে সব জানিয়ে দিলেই হবে…. আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা….  ঠেসে জলখাবার খেয়ে বেরোতে হবে আমাদের…..ব্যস…..’
অগত্যা…তাই সই…এই অলোকসামান্য রূপবান পুত্র রত্নের যা আদেশ…আর সে আদেশ না মানলে যে বেজায় ঠকতে হয় বিলক্ষণ তা আমার অজানা নয়…
পরদিন সকালে ফোন করতেই দেখি যে আরো এক অবাক কান্ড…কটকটে ব্যাঙ এককথায় রাজী…বলে –‘তা ঠিক আছে…সকাল আটটায় আসছি…রেডী থাকবেন…আমার গাড়ী সেভেন সীটার ….ইনোভা…রাস্তা খুব একটা খারাপ না হলে ঘন্টায় একশো সওয়াশো কি০মী০ অনায়াসে যেতে পারে …হাইওয়েতে দেড়শো কি০মী০ ও কোন ব্যাপারই নয়….কোন অসুবিধা নেই…তবে আমি গার্ড নিয়ে ভেতরের সীটে বসে থাকবো…গোপনে …আপনারা সামনে থাকবেন… .’
সাতটার সময়েই আমরা জলখাবার খেয়ে দেয়ে রেডী…নিজের শুধু সিলভার পিন সমেত রেমন্ডের স্যুটের ম্যাচিং মেরুন কালার টাইটা পরা বাকী ছিল…হাতে আর কাজ নেই…করি কি? 
তাই গৌরবকেই অভ্যাসমতন খুব করে সাজাতে বসলুম…বডি লোশন…ক্রীম …পাউডার… কাজল… চন্দন… ডিও… দামী জেন্টস সেন্ট …… নানান রকমের সব দামী বিদেশী প্রসাধন নিয়ে…দামী একটা ঘড়ি বাঁ হাতে আর গলায় নিজের সোনার চেনটা ও পরিয়ে দিয়ে শেষে দামী ব্র্যান্ড জকির অন্তর্বাসের ওপরে ফুলহাতা ক্রীম কালারের একটা সাফারী স্যুট পরিয়ে দিলুম গৌরবকে ……শার্টের হাতায় আলাদা করে সিলভারের কাফ লিংক আর সব বোতাম লাগিয়ে দিয়ে আমার কাজ শেষ…শুধু মোচির লেসছাড়া বুট পরা বাকি রইলো গৌরবের… 
সাড়ে সাতটার পরে আমি সাজিয়ে টাজিয়ে ছেলেটাক ছেড়ে দিতে তখন দেখি সে কয়েকটা রঙীন বেলুন নিয়ে খেলতে বসলো….এক এক করে সব বেলুনগুলোকে ফুলিয়ে তার মুখে সুতো বাঁধতে লাগলো…..প্রায় একডজন বেলুন…বাচ্ছার খেলা …আর কি? 
আমি বসে দেখছি…কি আর করি? আটটা বাজতেই দরজায় তালা বন্ধ করে নীচে নেমে আসতেই একটা দুধ সাদা ইনোভা কার সাঁ করে এসে দাঁড়ালো সামনে…কি দারুণ সময়জ্ঞান রে বাবা….দরজা খুলে ধরলো অবাঙালী এক ড্রাইভার….
আমি নমস্কার করলুম…ম্যানেজার ভদ্রলোক ও অবাঙালী… তবে বেশ চটপটে মানে স্মার্ট হলে কি হয়…তিনি পাকা রংওয়ালা মানে বেজায় কালো আর মুখশ্রী ও তেমনি ধারা…সত্যি বলতে কি মুখ দেখলেই ঠিক যেন মনে হয়… কোলাব্যাঙ…
তিনি হাঁ করে গৌরবের দিকে চেয়ে রইলেন প্রায় তিন মিনিট সময় এমনভাবে যেন জীবনে প্রথমবার তাজমহল দেখছেন। তাঁর মুখশ্রী দেখে গৌরবের অনিন্দ্যসুন্দর মুখে ক্ষণিকের জন্য যে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল তার ভাষ্য আমি ঠিক জানি….সে হলো…   ‘ওরে বাবা রে…এ তো সত্যিই কটকটে….’
ঝপ করে নীচু হয়ে তাঁকে প্রণাম করে ফেলে গৌরব এমনভাবে সামলে নিলো পরিস্থিতি যে আমি হাঁ করে রইলুম আর তিনি গৌরবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন……  ‘মাই সন…মাই প্লেজার…এসো…’
আমি আমার ডিজিটাল লক ব্রীফকেস আর গৌরব বেলুনের ঝাঁক নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ী সচল হ’লো..তবে কতো যে স্পীড নিলো এই কাঁচ বব্ধ এ০সী০ গাড়িতে বসে দেখি তা ঠিক বোঝাই যায় না…তবে শহরের ভেতরে তিরিশ চল্লিশের  বেশী নয় মনে হলো…
শহর পার হতেই আধ ঘন্টা লাগলো…তারপর রামনগর হয়ে নারায়ণপুর এসে গেল দেখতে দেখতে …তখন গাড়ির বেশ স্পীড বেড়েছে….
খানিকপরে গৌরব মুখ নীচু করে খুব ধীরে আর বাংলাতেই বললো-‘বাপী…. আশী… .অনুসরণ…. সব…বজ্জাতের একশেষ…’
‘হুঁ…মনে হয় কোন বাইক হবে…আমাদের ফলো করছে…’
গাড়ী বেশী স্পীড নেয় নি তাই তাদের সুবিধে …নব্বই কি০মী০ পথ….ওই অফিস শহর ছাড়িয়ে বেশীর চেয়ে বেশী আরো দশ কি০মী০ ধরলে ও যেতে আসতে দু’শোর বেশী নয়…
চুণার এসে গেলো …মাত্র আটটা চল্লিশ….
ম্যানেজার বললেন-‘আমরা এখানে পাঁচ মিনিট থেমে একটু চা খেয়ে নিতেই পারি…সকাল সাতটায় বেরিয়েছি তাই চা খাওয়া হয়ে ওঠে নি আমার…. আর আমাদের হাতে অনেক সময় ও আছে…তবে বাইরের চা নয়….ফ্লাস্কে সঙ্গে আছে….ভালো কেক আর বিস্কুট ও আছে….বাজার ক্রস করে গাড়ী থামাও ড্রাইভার …আর…গার্ড….বী এলার্ট….’
গৌরব কিছু বললো না আর কিছুই খেলো ও কিন্তু ম্যানেজারের অনুরোধের খাতিরে আমাকে শুধু এক কাপ চা অন্তত খেতেই হলো।
ধীরে সুস্থে গাড়ী চললো আবার।তবে বেশ হেলে দুলে আর এঁকে বেঁকে। আর বিশ মিটার গিয়েই ব্রেক কষে গাড়ী থামিয়ে চালক নেমে পড়লো। সে তখনি ফিরে এসে বললো-‘স্যার, পাংচার…’
গৌরব মুখ নীচু করে অতি ধীরে বললো-‘ঘেঁচু…’
উঃ…এই অদ্ভূত শব্দটা শুনলেই আমার আবার দারুণ রকমের হাসি পায়। কিন্তু এখন হেসে ফেললেই বেগতিক…এই ছেলেটা সব সময় খালি কি যে মুশ্কিলে ফেলে দেয় না আমাকে ….কচুর অনুবাদ হিন্দিতে করা সম্ভব…………কিন্তু ঘেঁচুর অনুবাদ করা?...সে অসম্ভব… কিন্তু অর্থ পরিষ্কার….এখন ঘেঁচু মানে …রাবিশ…. সে ভাবে বললে সবাই বুঝে ফেলবে…অর্থাৎ এটা সাবোটাজ ….পাংচার নয়…পরিণাম …স্টেপনি চেঞ্জ..আর সকলের গাড়ী থেকে নীচে অবতরণ…আর ..উদ্দেশ্য…আমাদের লোকবল জেনে ফেলা….গান ম্যান ও নামলো তবে বন্দুক রেখে…আমাকে শুরুতেই হারতে হ’লো….কি গেরো বলোতো….
চল্লিশ মিনিট সময় গচ্ছা গেলো…সাড়ে ন’টা বাজছে তখন। আমরা গাড়িতে উঠতেই গাড়ী ছেড়ে দিলো চালক…আর কয়েক মিনিটেই বেশ বোঝা গেল ….গাড়ির স্পীড একশো ছাড়িয়ে গেছে….বিশেষ ঝাঁকুনি নেই… তবে দু’পাশের গাছপালা বেগে পিছনে চলে যাচ্ছে….গৌরব একটু সামনে ঝুঁকে বললো-‘এক চার পাঁচ…’
সর্বনাশ…মানে গাড়ির স্পীড এখন ঘন্টায় একশো পঁয়তাল্লিশ ……ছোট গাড়ী হ’লে এতোক্ষণে চাকা মাটি ছেড়ে লাফিয়ে উঠতো….     
আমরা ঠিক বেলা দশটার সময় এল০সী০ অফিসে পৌঁছে গেলাম। আমি ব্রিফকেস হাতে নেমে পড়লুম……  গৌরব ও বেলুনগুলো রেখে নেমে পড়লো। সবাই হাঁ …হাঁ…করে উঠলো…আরে তুমি কেন নামছো বেটা…গাড়িতে উঠে বসো…
‘না…আমি ও যাবো…’
‘কেন, বেটা? তুমি গিয়ে কি করবে?’
‘ওই ভদ্রলোককে একবার দেখতে চাই আমি….’         
শুনে সবাই চুপ একদম…যেন এই ছেলেটাই মালিক …যার কথার ওপরে কোন কথা বলাই চলে না…
ম্যানেজার বললেন-‘দেন…ও কে…গো…’
আমরা কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে মেন গেট পার হয়ে লিফ্টে উঠলাম…তিনতলায় অফিস…গেটে একজন বিশাল বপু আর্দালী ছিল…সে আমার হাতে একটা সাদা স্লিপ ধরিয়ে দিলো…আমি কি আর করি? নিজের নাম, ঠিকানা মানে অ্যাফিলিয়েশন আর প্রয়োজন লিখে দিলাম…সে স্লিপ নিয়ে ভেতরে গিয়ে গেট বন্ধ করে দিলো। আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়েই আছি ….কেউ আর আসেই না…দশ মিনিট কাটলো…পনেরো মিনিট কাটলো……. গৌরবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠলো…
শেষে আমি যখন ভাবছি সেলফোন বের করে দিই বসকে সব রিপোর্ট করে তখন দরজা খুলে একজন অন্য লোক বেরিয়ে এসে বললো-‘আপ অন্দর জাইয়ে সাহাব…লেকিন আপ অকেলে…ইহ লেড়কা…’
গৌরব এমন কঠোর দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালো যে সে মুখ নীচু করে বললো-‘আচ্ছা ববুয়া, তুম ভি চলা যাও…’
‘তুম নহি আপ কহনা শিখিয়ে সাহেব…মুঝে হি আজ ভেজা গয়া হ্যায় চেক লেনে কে লিয়ে …সমঝে… মেরে সাথ ইহ সাহাব মেরা হি গার্ড হ্যায়…..ফির সে স্লিপ দেনা হো তো কহিয়ে?...’
‘আ…আপ …এক বচ্চা…’
‘শাট আপ…’
গৌরব ভেতরে ঢুকে পড়লো ঠিক একজন অফিসারের স্টাইলে…পিছনে আমি…সরু করিডোর…..দু’পাশে নেমপ্লেট লাগানো সারি সারি দরজা…প্রথমটাতেই জি এম লেখা দেখে নক করলুম..
‘ইয়েস…প্লীজ কম ইন..’
‘স্যার…আমি…’
‘গট ইয়োর স্লিপ, স্যার…আই নো..আই নো…হিয়ার ইজ ইয়োর চেক…দিস ইজ থার্ড টাইম… হাঃ…হাঃ…হাঃ…কাইন্ডলি সাইন ওভার হিয়ার, স্যার….’
আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করে দিলুম…তিনি ফাইল থেকে পিন করা লাল চেকটা খুলে সেখানে আমার সই করে দেওয়া রিসিপ্টটা পিন করে রেখে ফাইল বন্ধ করলেন…
‘টি অর কফি, স্যার?’
‘নো থ্যাংক্স, স্যার…জাস্ট টেকেন…’
‘ও কে…দেন হ্যাভ ইট…’
একটা সাদা খামে চেকটা ভরে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি তাঁর টেবিলে রেখে নিজের ব্রিফকেস খুললুম।
তার ভেতরে চেক সহ খামটা রেখে তাঁর সামনেই ডিজিট গুলো ঘুরিয়ে দিলুম ডালা টেনে বব্ধ করে দিয়ে। 
‘মেনী মেনী থ্যাংক্স, স্যার..’
‘নো মেনশন প্লীজ…ইটস মাই প্লেজেন্ট ডিউটি, স্যার…বাট বি এ লিটল বিট কেয়ারফুল…বেস্ট অফ ইয়োর লাক….’
‘সো আই অ্যাম…’
হঠাৎ এই কথাটা বলেই গৌরব উঠে দাঁড়ালো আর দু’হাত তুলে… ‘ নমস্তে ..’ বলে গট গট করে বাইরে বেরিয়ে এলো।
সেই অতি বিনয়ী আর স্মার্ট ভদ্রলোকের মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল আর পরক্ষণেই তাঁর চোখদুটো কেমন যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো…কিন্তু  গৌরব যেন দেখে ও দেখলো না কিছুই…
বাইরে এসে গৌরব খুব ধীরে দ্রুত বললো-‘বাপী….তাড়াতাড়ি…চেকটা বের করে এখনি ওয়াটস আপ করো আগে এইখানে দাঁড়িয়েই…তারপরে ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রেখে অন্য নাম্বার কোডে আবার বন্ধ করে দাও…তারপর গিয়ে লিফ্টে উঠতে হবে…আর তুমি চেকটা গাড়িতে উঠেই ওনাকে গছিয়ে দিও…অবশ্য উনি নেবেন না তা ঠিক…. ব্যাংকে তোমাকেই গিয়ে চেক জমা করতে হবে এই ছুতোয়… তখন আবার ব্রিফকেসে চেক রেখে লক ঘুরিয়ে দিও ওনার সামনে …কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিট…তারপরেই ব্রিফকেসটা আমার সীটের নীচে ঠেলে দিও …তবে ডিজিট্যাল লক খুলে দিয়ে… দেখি কি হয়? ওরা শেষ চেষ্টা তো করবেই….’
‘সে কী? কেন?’
‘বাপী, চুপ…সিসিটিভি…..’
আমি যথারীতি কাজ করে মেন গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে নীচে নামতেই আমাদের গাড়িটা সামনের পার্কিং লট থেকে উল্কাবেগে এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেল নিঃশব্দে…আমরা উঠে পড়তেই গাড়ী যেন উড়ে বেরিয়ে গেল।
‘এই নিন, স্যার …..চেক..’
‘থ্যাংক ইয়ু….এখন আপনার কাছেই রেখে দিন…আমাকে একেবারে ব্যাংকের রসীদটা দিলেই হবে…’
আমরা ফেরার পথ ধরেছি তখন…
মির্জাপুর শহর পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে…তবে আমি যেন বেশ বিপদের গন্ধ পাচ্ছি তখন …গাড়ী এতো স্পীডে ছুটছে যে বাইক তো ছার অন্য কোন গাড়িই একে ওভারটেক করে এগিয়ে যেতে পারবে না কেননা তা হচ্ছে অসম্ভব….ম্যানেজারের প্ল্যানটা আমি বেশ বুঝতে পারছি …কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে এখন আর বিপদ পেছনে নেই….ওভারটেক কেউ করবে ও না তাই …. সে আছে সামনে… তাই স্পীড বাড়িয়ে তাকে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে সুকঠিন…
এই মরেছে ….পাঁচের জায়গায় তো দশ মিনিট ও কখন পার হয়ে গেছে….আমি গৌরবের বলে দেওয়া কাজটা করতে তো ভূলেই গেছি… দূর ছাই….দ্রুত হাতে ব্রিফকেসের লক খুলে ফেলে আস্তে করে সেটা গৌরবের সীটের নীচে ঠেলে দিলুম।..
ছেলেটা ফিরে ও তাকালো না…. একমনে সে তখন বেলুন নিয়ে খেলায় ব্যস্ত……আরো দু’টো নতুন বেলুন ফোলাচ্ছে সে জোরে ফুঁ দিয়ে…
চুণার পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে গেছে…বাজার আর বাস স্ট্যান্ড দ্রুত কাছে চলে আসছে…বাধ্য হয়ে স্পীড কমাতে হচ্ছে তাই গাড়ির…তবু ও সেই সংকীর্ণ পথে যে স্পীডে গাড়ী ছুটছে তা বিস্ময়কর…
চুণারের পাহাড়টা পার হচ্ছি এইবার আমরা….তবে আমার চি্ন্তা তখন সেই অপয়া লেভেল ক্রসিং নিয়ে…. আমি ট্রেনের টাইম টেবিল দেখে এসেছি…এই সময়ে কোন যাত্রীগাড়ী নেই তা ঠিক তবে মালগাড়ী তো যেতেই পারে…সে আর জানছি কি করে আমি?
জারগো নদীর পোল পার হচ্ছি আমরা উল্কাবেগে…..স্পীড কম করে ও তখন দেড়শো হবে….আসছে রেল গেট…. দূরে হঠাৎ বেজে উঠলো ট্রেনের হুইশল…. এইবার ব্রেকে চাপ দিলো চালক….দেখতে দেখতে একশোয় নেমে এলো স্পীড…নব্বই….আশী….সত্তর….ষাট….পঞ্চাশ….চল্লিশ…তিরিশ…নামছে কাঁটা….
রেল গেট বন্ধ হয়তো ছিলো না কিন্তু তার অনেক আগেই পথের সামনে হঠাৎ জাগলো দমাস… ধাঁই… ধড়াম… বিকট শব্দের ভয়ংকর ঝনঝনা…..সঙ্গে সঙ্গে সাদা গাঢ় ধোঁয়ার কুন্ডলী..উঠে এলো এমন যে সামনে চোখে আর কিছুই দেখা যায় না …..
‘বাপী…. মনে হয় গ্যাস বোমা….রুমাল চাই…’
আমি চট করে প্যান্টের দু’পকেট থেকে দুটো রুমাল টেনে বের করে একটা গৌরবকে দিয়ে অন্যটা নিজের নাকে চাপা দিলুম।  
সব গাড়ী ততক্ষণে থেমে গিয়েছে…আর আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে….চোখ জ্বালা করছে আর বেশ মাথা ঘুরতে শুরু করেছে…..তবে ড্রাইভার আর গার্ড বেশ সাহসী লোক …তারা গাড়ির দরজা খুলে বাইরে লাফিয়ে নেমে পড়লো কিন্তু বন্দুক তোলবার আগেই থম মেরে দাঁড়িয়ে গেল আর পরক্ষণেই দমাদম করে রাস্তায় আছড়ে পড়ে গেলো…
আমার মাথা ও ভোঁ ভোঁ করছে তখন…তাড়াতাড়ি কোনমতে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করতে গেলুম টেনে কিন্তু লক করবার আগেই কারা যেন বাইরে থেকে ছুটে এসে সেটা আবার টেনে খুলে ফেলল.. …টানের চোটে আমি গৌরবের গায়ের ওপরে গড়িয়ে পড়ে গেলাম… তারপরে কি যে হয়ে গেলো তার কিছুই আর হুঁশ বোধ রইলো না আমার তখন….শুধু মনে হলো আবার আমি হেরে যাচ্ছি….অসহায়ের মতন…. 
যখন আমার আবার হুঁশ হলো তখনো গাড়িতে সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে…
আর শুধু আমরাই নই …বাইরে ও অনেক  লোক …ডজন ডজন বাইক চালক…সাইকেল আরোহী…পথের জনতা…জিনিষ পত্র সাইকেল বাইক সব সমেত পথে পড়ে আছে….আশে পাশে আরো অনেক গাড়ী…সব নিশ্চল …অনড়… গাড়িগুলোর মধ্যে ও সবাই অজ্ঞান….ধীরে ধীরে তাদের জ্ঞান ফেরা শুরু হ’লো। 
ততক্ষণে আমাদের চালক আর গার্ড ও রাস্তা থেকে ঝেড়ে মেড়ে উঠে এসে দু’জনে মিলে সব জিনিষপত্র চেক করে বুঝে গেছে যে আমাদের গাড়িতে অনেক কিছুই আর নেই। আমাদের রুপোর টাইপিন, কাফ লিকং এমন কি গৌরবের সোনার চেনটা ও দেখি যে ঠিক আছে কিন্তু সেই খাবারের প্যাকেট, চায়ের ফ্লাস্ক…এমন কি গাড়ির ডকুমেন্ট চেম্বারের সব কাগজপত্র ও উধাও হয়ে গেছে। ম্যানেজারের হ্যান্ড ব্যাগ এমন কি সকলের পকেট থেকেও দরকারী আর অদরকারী সব কাগজই হয়েছে অদৃশ্য। আমার সেই দামী ডিজিট্যাল ব্রিফকেসের ও চিহ্ন মাত্র নেই কোথাও …শুধু পড়ে আছে আধ খালি দু’টো মিনারেল ওয়াটার বটল আর গৌরবের সেই খেলবার বাজে বেলুনগুলো….    
সব কথা শুনে আর এই দৃশ্য দেখেই আমাদের ম্যানেজার সাহেব ও তখন এক্কেবারে নিশ্চুপ…অসাড়…হয়ে গেলেন….একেবারে নির্বাক…যেন ঠিক পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছেন তিনি…. 
‘স্যার…এখন কি করবো?’
‘…..’
‘স্যার, বলুন , এখন কোথায় যাবো?’
 ‘………….’
‘কোন কথাই আর বলেন না তিনি….আমরা তো হতভম্ব….কি করি? এ যে দেখি সেই যাকে বলে…বাক্যি হরে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়েছে ম্যানেজারের… হঠাৎ বেশী শক পেলে এমন অবস্থা হয় তা আমি শুনেছি…আর …. গাড়ির অবস্থা? সেই কান্ডারী বিহনে তরী ঘুরিতে লাগিল…. থুড়ি অচল হইল…
 শেষে চালক আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন-‘স্যার …আপনিই বলুন, এখন কি করবো?….’
আমি ও চুপ…বলি কি?
আশেপাশের গাড়ী বাইক সব তখন আবার সচল হয়ে উঠেছে…আাদের পেছনের অেক গাড়ির হর্ণ ও বাজতে শুরু করেছে…
হঠাৎ গৌরব বলে উঠলো-‘আংকল…আমাদের প্ল্যান কি ছিলো?
‘ব্যাংকে যাওয়ার…’
‘তবে তাই চলুন না আপনি…মাঝপথে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছেন কেন? অবশ্য খানিকটা সময় দুর্ঘটনায় পড়ে আমাদের নষ্ট করতে হয়েছে তা ও ঠিক… কিন্তু এখন ও তো সময় আছে….. স্টার্ট দিন….স্পীড তুলুন ….কুইক…সবাই দেখুন তাড়াতাড়ি এ’খান থেকে চলে যাচ্ছে ….কেননা যা যাবার সে তো গেছেই কিন্তু পুলিশ এসে পড়বার আগেই এ’খান থেকে সরে না পড়তে পারলে কপালে আর ও দুঃখ আছে তা ঠিক….আর অকারণে বেশী দেরী করলে যদি কোন ক্ষতি হয় কোম্পানির …জবাবদিহি করতে হবে তো আপনাকেই…’
‘কিন্তু গিয়ে কি হবে আর এখন ব্যাংকে?’
‘সেটা দেখবার দায়িত্ব কি আপনার, ড্রাইভার আংকল? সেটা তো আমার বাপীর দায়ি্ত্ব…আপনার কাজ সময়ের মধ্যে তাঁকে ব্যাংকে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া….তাই তো? তা সে কাজ করতে ও যদি আপনি না পারেন তবে পাশের সীটে চলে যান…আমার বাপী গাড়ী চালাতে বেশ জানে….’
সঙ্গে সঙ্গে  হ্যান্ডব্রেক নামিয়ে ইগনিশনের চাবী ঘুরিয়ে দিলো গাড়ির চালক…
আর কি উপায়? এখন এই বিপরীত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সব সামাল দিতে কঠোর হাতে সব কিছু পরিচালনা করাই পথ আর তাই করতে শুরু করেছে একটা এই ছেলে…যার নাম গৌরব …আর বেশ জোর বকুনি ও দিয়েছে একখানা…
আমাদের তরীর মানে গাড়ির কান্ডারীর থুড়ি পরিচালকের ভূমিকায় উঠে এসেছে সে এখন…
চার চারজন বড়ো মানুষ যেখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পুতুল হয়ে বসে আছে….আর গাড়ী ও অচল  হয়ে পড়েছে তাই ……সেই সময় এই নির্ণায়কের ভূমিকায় নেমেছে সে…তবে পরিণাম হয়েছে ভালোই ….এখন চলতে শুরু করেছে সেই অচল গাড়ী….আর শুধু চলাই নয়…সে ছুটছে …বেগে… বিশ…. ত্রিশ… চল্লিশ… পঞ্চাশ… ষাট… বাড়ছে স্পীড…একশোর ঘর ও পার হয়ে গেল স্পীডোমিটারের কাঁটা দেখতে দেখতে….
এইবার কেলহট বাজার আসছে ….এক নিমেষের মধ্যে যেন উড়ে পেরিয়ে গেল অতো জনাকীর্ণ বাজার…পুরুষোত্তমপুর বা পরসোধা আগত…  ওঃ…ওই পেছনে পড়ে রইলো….আসছে এইবার নারায়ণপুর….একটানা এমারজেন্সী হর্ণ বাজছে গাড়ির…এই হর্ণের জন্যই পুলিশ বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলো আর ম্যানেজার তাই লাগিয়ে ও ফেলেছেন দেখা গেল …অনেকটা পুলিশের অগ্রগামী গাড়ির হুটারের মতন…
গাড়ী রামনগর ও পার হয়ে এলো….এইবার গঙ্গা পার হলেই বারাণসী….
কয়েক মিনিটে পেরিয়ে গেল অতোবড় গঙ্গার পোল…শহর এসে যেতে তখন ইনোভার দুর্দান্ত স্পীড একটু কমলো…
‘বাপী?’
‘অ্যাঁ…কি ? কি বলছো?’
‘তৈরী হও, বাপী…ব্যাংক আসছে…..বারোটা পঁচিশ হয়ে গেছে…’
‘কি্ন্তু আমি সে’খানে গিয়ে কি জমা দেব?…’
‘কোন কিন্তু নয়…বি রেডী….ওই আসছে তোমাদের বি ও আই…’
গাড়ী থামছে তখন…টপ করে আমরা নেমে পড়লুম…আমি আর গৌরব…
‘চলো, বাপী…’
কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গৌরব বললো-‘বাপী…..এই টেবিলে এসো …….এই নাও ফর্ম…ফিলআপ করো …আমি চেকের ডিটেল সব বলছি…মোবাইল দেখে…’
গৌরব যেমন যেমন বলছে আমি তাই করে যা্ছি তখন যন্ত্রচালিতের মতন…আমার ফর্ম ভরা শেষ হ’লো…নীচে যথাস্থানে সই ও করে দিলুম শেষে….
‘বাপী, তুমি ফটো তুলে নাও এইবার ওই পুরো স্লিপটার ও……’
আমি তাই করলুম। 
প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে হাত বের করলো গৌরব- ‘এই নাও ধরো …স্টেপলার…পিন করতে লাগবে… আর…….’
‘আর কি, গৌরব?’
এইবারে ডান পকেট থেকে ও হাত বের করে সরু রোল করা একটা কাগজ খুলতে খুলতে বললো গৌরব-‘আর এই তোমার সেই মিসিং চেক….নাও… ফর্মের সাথে স্টেপল করে জমা করে দাও, বাপী… কুইক… সময় শেষ হয়ে আসছে…’
‘কিন্তু….কি করে? এ হয় কি করে? এ তো অসম্ভব…’
‘বাড়ী গিয়ে সব কথা আমি তোমাকে বলবো, বাপী……আমি বেলুনগুলো কি শুধুই খেলা করবো বলে সঙ্গে নিয়েছিলাম, বাপী?…আমি কি তোমার এতোই কচি বাচ্ছা ছেলে একটা….?
গৌরবের কথা শুনে মনে মনেই বললুম-‘ওরে..বাবা রে…না..না…না…কে বলে এই ছেলেটাকে বাচ্ছা? 
উঃ … এই যদি বাচ্ছা ছেলে হয় তো বড়ো কে?’ 
চোর থুড়ি…ওই ডাকাতগুলো যদি যায় ডালে ডালে তবে এই ছেলেটা দেখি যায় পাতায় পাতায়…হুঁ …এইবার সব যেন আমি ও একটু একটু করে বেশ বুঝতে পারছি….হুম…সমস্ত কাগজের জিনিষ ও টুকরো অবধি বা যার মধ্যে কাগজ রাখা হ’তে পারে এমন সব জিনিষই ডাকাতগুলো নিয়ে গেছে…আমাদের পকেট ও তারা হাতড়েছে কিন্তু কোনো দামী জিনিষ তারা নেয় নি মোটেই….এইবার এই ডাকাতির মোটিভ বেশ বোঝা যাচ্ছে তবে এটা ও ঠিক যে প্রায় খালি জলের বোতল আর বাচ্ছাদের খেলার বেলুন চুরী বা ডাকাতি করে নিয়ে যাবার কথা কখনোই কারো মনেই আসবে না…আসতে পারে না…আর কেউ তা দরকার বলে ও মনে করবে না…আমি যার বাপী হয়ে ও নিজেই কিছু বুঝতে পারিনি সেই ছেলের পুরো প্ল্যান অন্য কে বুঝতে পারবে? সে হচ্ছে অসম্ভব কথা…..  ’
হঠাৎ মাথা নীচু করে আর বেশ অপরাধীর মতন মুখ করে গৌরব বললো-‘বাপী, এই যাত্রায় শুধু তোমার দামী ব্রিফকেসটা গেল…এই যা…সে আর কি করা যাবে বলো? ….. আপৎকালে অর্ধেক ত্যাগের নিয়ম আছে…আমাদের দেশে তো…এ ও মনে করো তাই…ওই যে রিসিভিং অফিসার আংকল স্ট্যাম্প মেরেছে কাউন্টার ফয়েলে… নিয়ে নাও, বাপী’। …
‘তারপরে বাপী…. আবার তোলো ওই রসীদের ও একটা ফটো আর পাঠাও ওয়াটস আপ করে…. ব্যস… তোমার ডিউটি এখন ওভার। ওরিজিনাল রসীদটা শুধু গিয়ে দিয়ে দিলেই তোমার ছুটি….ততক্ষণে ঠিক ধাতস্থ হয়ে যাবেন ম্যানেজার আংকল…বিশেষকরে তুমি ওই রসীদটা নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেই কাজ হবে…’ 
‘সত্যি?’
‘চলো, বাপী….সে তুমি এখনই দেখতে পাবে…’। 
‘তারপরে গৌরব?’
‘তারপরে আর কি? সন্ধ্যা নাগাদ ঠিক জানাই যাবে যে ওই চেক ক্যাশ হয় না ছাই হয়…আমি ঠিক জানি তো….সব জেনেশুনেই…   আর তাও একবার নয় তিন তিন বার এক একটা করে ভূয়ো মানে ফালতু বাউন্সেবল চেক দিয়ে হয়রাণ আর অপমান করা হয়েছে আমাদের। এইবার সেই কর্মফল টের পাবেন ওনারা ঠিক…পুলিশ গিয়ে ঠিক মামার বাড়ী দেখিয়ে ছাড়বে… এখন একবার এই রসীদটা আর ব্যাংকের চেক বাউ্সিংয়ের রিপোর্টটা পুলিশ হাতে পেলেই হয়…কেস ডায়েরী তো করাই আছে …তাও একবার নয়…দু’…দু’বার……………’
‘হুঁ…যত্ত সব বাজে অক্লমন্দির কাজ…. এই বাজে কাজ করতে করতে এখন বেশ তেষ্টা পেয়ে গেছে আমার…..  আর কিছু খেতে ও তো হবে……..হ্যাঁ না তো….’
---------------------------

০৯৪৫২০০৩২৯০
================
          

 
  
  
   
  .    




    .         


ঁু





রচনাকাল : ২৮/১/২০২০
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 19  China : 29  France : 3  Germany : 4  India : 238  Ireland : 28  Russian Federat : 7  Saudi Arabia : 4  Sweden : 7  Ukraine : 8  
United Kingdom : 1  United States : 284  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 19  China : 29  France : 3  Germany : 4  
India : 238  Ireland : 28  Russian Federat : 7  Saudi Arabia : 4  
Sweden : 7  Ukraine : 8  United Kingdom : 1  United States : 284  
  • ৯ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা (১০৫)

    ২০২০ , ফেব্রুয়ারী


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
গৌরব by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৬২৪২৩
fingerprintLogin account_circleSignup