আমার ভূত দেখা
===================================================================================
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
======================================================================================
আমার নাম চঞ্চল।
আমার কাকু আমাকে নিয়ে অনেক অনেক গল্প লিখেছে। তাই আমার নাম হয়তো এখন অনেকেই জানে।
কিন্তু আজ কয়েক দিন হ’ল হঠাৎ কাকুর শরীরটা বিশেষ ভালো নেই তাই লেখা লিখি সব বন্ধ। কাকুর পল্পগুলো তো কম্প্যূটারে আমিই বসে টাইপ করি। ই-পত্রিকায় পাঠাতে হ’লে তা’তো করতেই হবে। সেইজন্যে কাকু আমাকে একটা ডেলের ল্যাপটপ ও কিনে দিয়েছে। কাকু বলে আজ থেকে বিশ বছর পরে কাগজের অভাবে সব স্কুল বই এমন কি টাকার নোট ও প্ল্যাস্টিকে ছাপা হবে আর পত্র পত্রিকা সব ই- পেপার ও ই- ম্যাগাজিন হয়ে যাবে। গাছ ও নেই আর কাগজ ও নেই।।
তা হোক গিয়ে।
এ’দিকে আমার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গরমের ছুটি ও তো পড়ে গেছে। কাকু তো কোথাও বাইরে বেড়াতে যাবার প্ল্যান ও করে নি এ’বারে। শরীর ঠিক হ’লে হয়তো করবে। আমি ও তাই আব্দার করিনি। কিন্তু মুশ্কিল হয়েছে যে দুপুরভোর আমি এখন বসে করি কী? কাকু তো আমাকে নাইয়ে খাইয়ে দিয়ে কুলার চালিয়ে দিব্যি শুয়ে পড়েছে।
তাই আমার ডায়েরী থেকে একটি ঘটনাকে গল্পের রূপ দিয়ে লেখবার চেষ্টা করছি বসে। কাকু আমাকে স্কুলের পড়ার সাথে বাংলা ও শিখিয়ে দিয়েছে বেশ করে।
কিন্তু কাকুর মতন লেখা তো আর হ’বে না আমার দ্বারা। সেটা অবশ্য ঠিক, তবু ও চেষ্টা করছি।
আমার একমাত্র বন্ধু বাদল দেখলেই নির্ঘাৎ করে বলবে অপচেষ্টা। তা বলুক গিয়ে। বাদল একটা জিনিয়াস ছেলে। ও বলতেই পারে। বিকেলে বাদল এসে গেলে ছাদে গিয়ে খানিকক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেলবো না হয়।
সেবার আমি গোরখপুর থেকে বেনারসে ফিরছিলাম কিষাণ এক্সপ্রেশ ধরে কাকুর সাথে। আমার বয়স তখন বড়জোর নয় কি দশ হবে। আমি ছোট্টবেলা থেকেই কাকুর কাছেই থাকি।
বাদল আদর করে আমাকে উপাধি দিয়েছিল পরীর দেশের রাজকুমার। আমি না কী দারুণ সুন্দর ছেলে, তাই বলে। কাকু আমাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাজাতো কালো চশমা টশমা পরিয়ে, বাইরে কোথা ও নিয়ে গেলেই। ফুল শার্ট, প্যান্ট, টুপী, জ্যাকেট সব পরাতো বসে। এ০ সী০ কোচ ছাড়া যেতো না।
তা তখন ওই গাড়িতে এ০সী০ কোচ থাকতো না তো একটা ও, তাই বাধ্য হয়ে স্লিপার কোচে উঠতে হয়েছিল কাকুকে আমাকে নিয়ে। আগের রাতে ঘুম ভালো না হওয়ায় কাকু বার্থে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে ও পড়েছিল । আমি কাকুর মাথার কাছে জানলার ধারে চুপটি করে বসেছিলাম, যদি ও দু’টো বার্থ রিজার্ভ করিয়েছিল কাকু।
গাড়ী সলেমপুরের পর থেকে বেশ ভালোই চলছিল গড় গড় করে।
গন্ডগোল বাঁধলো ঔঁড়িহারে এসে।
গাড়ী দাঁড়িয়েই আছে তো আছেই। চলে আর না।
কি করি?
খানিক পরে দেখি ট্রেনে একটা আমারই বয়সী অন্ধ ছেলে উঠলো। ভিখিরী ছেলে। তবে তার মিষ্টি গান শুনেই সবাই একটাকা দু’টাকা করে তার ফরসা মতন হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল। অত শীতে ও ছেলেটা পরে ছিল একটা সাদা শার্ট, ছেঁড়া সবুজ হাফ সোয়েটার আর তালিমারা সূতোর প্যান্ট। দেখে আমারই শীত করছিলো।
ছেলেটা আমার কাছে আসতে আমি তার হাতে একটা পাঁচ টাকার কয়েন দিলুম। ছেলেটা আমার আর ও কাছে এসে ইসারায় কিছু খেতে চাইলো। আমি তখন তাকে কি দিই? ট্রেনের জানলা দিয়ে একজন ভেন্ডারকে ডেকে দশ টাকার দু’প্লেট পকৌড়া কিনে ছেলেটাকে দিলুম।
ঔঁড়িহারের পকৌড়া না কি বিখ্যাত।
‘তুমি খাবে না?’
‘না ভাই। আমি খাবার খেয়েছি দুপুরে, তুমি খাও। বাইরের যা তা খাবার খেলে আমার কাকু না রেগে আগুন হবে হিঃ…হিঃ…হিঃ……তা ভাই, তোমার কি শীত করছে না, এই পোষাকে?’
ছেলেটা উত্তর দিলো না। একটু হাসলো মাত্র।
আমি চোখ থেকে রোদ চশমাটা খুলে রেখে নিজের গায়ের দামী জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে বললুম –‘তুমি না হয় আমার এই জ্যাকেটটা পরো ভাই, আমি অন্য একটা পরে নেব ব্যাগ থেকে বার করে’।
ছেলেটা বাঁ হাত দিয়ে আস্তে করে আমার হাতটা আটকে দিলো তখন।…
মুখে বললো--‘না’
‘কেন?’
ছেলেটার ফর্সা হাতটা আমার চকচকে, নরম, মসৃন, দুধ সাদা হাতের ওপরে পড়ে বেশ কালো মতন দেখাচ্ছিল, মনে আছে। তবে ছেলেটা আমার হাতটা চেপে ধরে নি এই যা রক্ষা নইলে আমার হাতের স্টিলের চকচকে বালাটা সক্রিয় হয়ে উঠে মারতো এক বৈদ্যুতিক ঝটকা…
ছেলেটা আমার বড় বড় টানা টানা চোখের দিকে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সান গ্লাশটা তুলে নিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি করে পরিয়ে দিয়ে বললো- ‘তুমি না ভাই দারুণ সুন্দর আর খুব খুব সরল ছেলে। আমি তো লোক ঠকাই। সে সব তুমি বুঝবে না। তুমি অতো দামী জ্যাকেটটা আমাকে পরতে দিলে ও, আমার তো কিছু লাভই হবে না। আমাকে এই পোষাকেই শীতে কাঁপতে হবে। মাঝখান থেকে ওটা কালকেই পুরোণো বাজারে বিক্রি হয়ে যাবে জলের দরে আর টাকাটা যাবে মালিকের পকেটে। এরা কফিনটুকু ও ছাড়ে না’।
‘কে সেই মালিক? তুমি বলোই না।’
‘সে আছে একজন। তার নাম বলা নিষেধ। আমাকে বাড়ী থেকে চুরি করে এনে চোখ অন্ধ করে দিয়ে ভিক্ষে করায়। একটা চোখে অল্প দেখতে পাই। পালাতে গেলে পুরো অন্ধ করে কোন মন্দিরের বাইরে বসিয়ে দেবে। এটা ও’দের ব্যবসা। আমার গানের গলা ভালো দেখে এই ব্যবস্থা করেছে। পুলিশের সাথে ব্যবস্থা করাই আছে। কেউ কিচ্ছু বলে না। তিনদিন অন্তর আমার ট্রেন বদলে দেয়। তবে অন্যদের মতন আমাকে বেচে দেয় নি বিদেশে। এই যা। তোমার মতন দারুণ সুন্দর ছেলের কিন্তু আরব ও অন্য বড়লোকের দেশে অনেক দাম, শুনেছি। বেশ কয়েক হাজার ডলার। একটা বাজে দেখতে ছেলেই বিশ হাজার ডলারে বিক্রি হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। তুমি কিন্তু খুব সাবধানে থাকবে, ভাই।’।
‘তোমার রোজগার তো…’
‘হ্যাঁ, ভালোই হয়। তবে রাত্রে ওরা সব কেড়ে নেয়। তার বদলে দিনান্তে দু’টো খেতে দেয়। আমি যাই। বেশীক্ষন গান বন্ধ থাকলে সন্দেহ করবে। আমার পিছনে ওদের লোক আছে তো…’
ছেলেটা চলে গেল গান গাইতে গাইতে। তার একটু পরে গাড়ী ও ছাড়লো।
তবে তার কথা শুনে আমি বেশ বুঝে গেলুম যে আমি ভগবানের দয়ায় এই যে খুব সুন্দর ছেলে হয়ে জন্মেছি এটা কিন্তু এই দেশে আমার এক মস্ত দোষ বা অপরাধ, গুণ মোটেই নয়। এই দুনিয়ায় অনেক অনেক পাজী দুষ্টু লোক আছে। তাই হয়তো আমার কাকু আমার জন্য এতো ভয় পায়। আমাকে স্কুলের মাঠে খেলতে ও পাঠায় না। ফিল্মের লোকেরা ও পেলে আমাকে মনে হয় লুফে নেবে। তা আমার কাকু দিলে তো…’
কাকু উঠে পড়ল খানিক পরেই।
আমাকে জিজ্ঞাসা করলো-‘চঞ্চল, তুমি কি টয়লেটে যাবে?’
আমি একটু হাসলুম।
কাকু বুঝে নিয়ে বললো--‘চলো’
কাকু উঠে এসে আমার হাত ধরে নিয়ে চললো। কাকু বেশ জোরেই আমার হাতটা ধরেছিল। কিন্তু বালাটা কাকুকে কিচ্ছুটি বললো না। আসলে ওটার মেমোরী চিপে কাকুর ফটো ও স্কিন টাচ আই০ডি০ লোড করা আছে। কাকু তাই আমাকে ধরে আদর করলে বা টেনে কোলে তুলে নিলে ও কিছুই হয় না। এই বালাটা আমার হাতে পরানো থাকলে মা বা আমার বাপী পর্যন্ত সে কাজ করতে পারবে না। করতে গেলেই এক ইলেক্ট্রিক শক খাবে মোক্ষম রকমের। বিদেশী সুরক্ষা উপকরণ আর কি। কাকু আমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও যেতে হ’লেই এ’টা আমার হাতে পরিয়ে দেয়।
ট্রেন ধীরে ধীরে চলে আর থেমে সারনাথে আসতেই রাত দশটা হয়ে গেল। শীত ও দারুণ বাড়তে লাগলো আর কুয়াশা ও ঘন হয়ে উঠলো বেশ। তরে প্রায় এগারোটা বাজিয়ে ট্রেন গিয়ে বেনারসের সিটি স্টেশনে পৌঁছেই দারুণ শীতে একদম ঘুমিয়ে পড়লো দেখে কাকুর মাথায় হাত। ট্রেন না কি আর যাবে না। ইঞ্জিন ফেল। ক্যান্ট স্টেশন চার মাইল দূরে। বোঝ ঠ্যালা।
জব্দ হয়ে ব্যাগ কাঁধে নামল কাকু। সাথে আমি ও । দু’জনে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি সর্বনাশ। রাস্তা নির্জন ও প্রায় অন্ধকার। রিক্সা বা অটো একটি ও নেই।
কাকু বললো-‘ও চঞ্চল, সেরেছে দফা। ক্যান্ট অবধি এখন দেখছি হেঁটেই যেতে হবে আমাদের। পথে আলোও নেই আর সড়কের পথ তো অনেক ঘুরে গেছে। এর চেয়ে রেললাইন ধরে হাঁটাই তো ভালো’।
আমরা আবার স্টেশনে ফিরে এলুম।
জনহীন তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে খালি কিষাণ এক্সপ্রেস তখন ও দাঁড়িয়ে আছে।
প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে শেষে খোয়া ছড়ানো রেলপথ ধরে আমরা সোজা হাঁটা শুরু করলুম। কাকু আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে, কুয়াশার মধ্যে সাবধানে। দশ হাত দূরে সব কিছুই সাদামতন দেখাচ্ছে। কাকু না সঙ্গে থাকলে আমার যে বেশ ভয় করতো, তা ঠিক। আমরা চলেছি তো চলেইছি। পথ আর শেষ ও হয় না। একটা মালগাড়ী পর্যন্ত চলছে না।
অনেকক্ষণ পরে মনে হ’লো সামনে একটা রোড ওভার হেড রেল পোল আসছে। আন্ধ্রা পোল মনে হয়। এরপরে পড়বে নদেসর পোল।
ব্রিজে স্থান সংকীর্ণ। লাইনের পাশ দিয়ে চলা যায় না আর লাইনের ওপরে উঠলে ও মুশ্কিল আছে। স্লিপারের মাঝে মাটি নেই। ফাঁকা স্থান। সাবধানে পা না ফেললেই বিপদ। রেললাইনে উঠেই পার হতে হবে। কোন গাড়ী এসে গেলেই চিত্তির।
আমি তখন শীতে কাঁপছি। আমার ডান হাতটা কাকু ধ’রে ছিল বলে হয়তো বুঝে ফেললো। ব্যাগটাকে বাঁ কাঁধে নিয়ে কাকু নীচু হয়ে আমাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটানে নিজের কোলে তুলে নিলো তিন চার বছরের ছোট্ট বাচ্ছা ছেলের মতন। অন্য সময় আর রাস্তার লোকের সামনে হ’লে আমি তো লজ্জা পেয়ে না… না …না করতুম ঠিক। এখন কিচ্ছুটি না বলে ডান হাত দিয়ে কাকুর গলা জড়িয়ে ধরলুম আমি।
কাকু দু’দিক দেখে নিয়ে দ্রুত রেললাইনে উঠে পড়ে একটার পর আরেকটা স্লিপারে পা ফেলে ফেলে পোল পার হয়ে এলো। কিন্তু আমাকে আর নীচে না নামিয়েই সোজা এগিয়ে চললো হয়তো সামনের নদেসর পোলের জন্যেই।
আমি কাকুর কানে কানে বললুম- ‘কাকু, সাবধান। দেখো, সামনে সাদামতন ওটা কি পড়ে রয়েছে?’
থমকে দাঁড়িয়ে কাকু বললো-‘আরে তাই তো। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি তো…’
‘আরে, এ তো মনে হয় একটা লোক। হয় পাশের কোন গাছ থেকে আর নয় তো কোন চলন্ত ট্রেন থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছে মনে হয়। অজ্ঞান হয়ে গেছে আর নয় তো মৃত। চিৎ হয়ে হাতে একটা পুঁটলী নিয়ে পা ছড়িয়ে পড়ে আছে’।
কাকু এগিয়ে যাচ্ছিল।
আমি আবার কাকুর কানে কানে বললুম-‘কাকু, খুব সাবধান। তুমি কিন্তু আর এএদম এগিয়ো না। বরং চট করে বাঁ দিকের ঝাঁকড়া মতন গাছটার আড়ালে চলো। সামনে থেকে আর একজন কেউ আসছে। এতো রাতে কোন ভালো লোক হতেই পারে না’।
কাকু তৎক্ষণাৎ তাই করলো।
আগন্তুক দেখতে পায়নি আমাদের ।
সে পড়ে থাকা লোকটার কাছে গিয়ে থামলো।
নীচু হয়ে তার নাড়ী পরীক্ষা করলো তারপর বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বললো -‘শালা তো দেখছি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। বেশ ভালো কথা। তা ঠান্ডাই যদি মেরে গিয়েছ বাবা, তখন আর তোমার ওইসমস্ত গরম জামা কাপড়গুলো কি কাজে লাগবে? আর তোমার হাতের ওই পুঁটলিটা কি স্বর্গে নিয়ে যাবার মতলবে আছ না কী বাবা? ও’সব এখন আমার’। বলেই সে পুঁটলিটা ছিনিয়ে নিল মৃতের হাত থেকে।
উবু হয়ে সেখানে সে এইবারে বসলো।
পুঁটলী খুলে কি সব বার করে একে একে নিজের পকেটে চালান করে দিলো। তারপরে লোকটার সব পকেট হাতড়ে যা পেলো সে’সব ও আত্মসাৎ করলো। শেষে মৃতের গরম জামা কাপড়গুলো ও খুলে নেবার জন্য টানাটানি শুরু করে দিল দেখে আমার মনে পড়ল এরা মৃতের কফিন ও ছাড়ে না।
সে তার টুপিটা টেনে খুলে নিজের মাথায় পরে নিয়ে তার শালটা ও কেড়ে নিয়ে সে গায়ে দিলো আর অন্য সব সোয়েটার, মাফলার খুলে নিয়ে ভাঁজ করে সে পুঁটলী বাঁধলো একটা। শেষে কি মনে করে মৃতের দু’টো হাত ধরে উঁচু করে তুলে তার গায়ের শার্টটা ও খুলতে বসলো। শেষে প্যান্টটাই বা সে আর ফেলে যায় কেন?
মৃত লোকটাকে নিজের পায়ের ওপর উল্টে ফেলে তার প্যান্টটা খুলতে সচেষ্ট হ’লো সে।
দূরে এতোক্ষণে একটা ট্রেনের হুইশেল বেজে উঠলো। লোকটা সেসব কানে ও নিলো না। নিজের কাজে এতো সে ব্যস্ত।
কাকু ও চুপটি করে পুতুলের মতন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে গাছের আড়ালে।
লোকটা ধীরে সুস্থে তার সব কাজ শেষ করে হাতে জামাকাপড়ের পুঁটলি তুলে নিয়ে যখন মৃতদেহটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন দূরে আগত ট্রেনের শব্দ জাগছে। ক্যান্ট স্টেশন থেকে কোন ট্রেন ঝমাঝম শব্দে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে তখন ও তার পায়ের ওপরে মৃতদেহটা পড়ে আছে দেখে রাগে এক ধাক্কা মেরে তাকে দূরে সরিয়ে দিলো।
গড়িয়ে পড়ে গেল মড়া।
লোকটা সামনে পা বাড়ালো আর তখনি সে চেঁচিয়ে উঠলো-‘আরে, ই কা? হামার গোড় …..আরে ছোড় বে শালে…’
আমি ভয়ে ভয়ে ফিস ফিস করে বললুম- ‘ও কাকু, ওই পড়ে থাকা লোকটা কি এখনো মরে নি? দেখ …দেখ…কাকু, ও কেমন লোকটার একটা পা মুঠিতে চেপে ধরেছে। ও কি ভূত হয়েছে মরে গিয়ে? আমার কিন্তু দেখে খুব ভয় করছে, কাকু’।
জীবিত মানুষ তখন মৃতের হাত থেকে নিজের পা ছাড়াবার জন্য প্রাণপণে টানা টানি লাগিয়েছে আর কিছুতে ছাড়াতে না পেরে মড়া টেনে নিয়েই এদিক থেকে ও’দিকে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে সমানে।
উলঙ্গ মৃতদেহটাকে টেনে নিয়ে সে রেল লাইনে গিয়ে উঠলো তারপরে যদি রেলের লাইনের ইস্পাতে ঘষে সেই হাত ছাড়াতে পারে হয়তো এই আশায়। বহু চেষ্টা ও করলো সে কিন্তু মড়া তার পা তো ছাড়লোই না উল্টে টানাটানিতে তার অন্য পা টা ও কি ভাবে আটকে গেল রেল লাইনের জয়েন্টে।
সেই লাইনেই ট্রেন আগত প্রায় তখন।
লোকটা দারুণ চীৎকার করছে তখন ভয়ে আর নিজের পা ছাড়াবার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করছে সমানে। ঘোর কুয়াশায় ট্রেনের চালক তা দেখতে ও পেলো না ।
সশব্দে আগত বিরাট এক মালগাড়ির ইঞ্জিনের জোর ধাক্কায় সে উল্টে পড়লো লাইনের অন্যধারে। একের পর এক মালগাড়ির বন্ধ ওয়াগনগুলো সট সট করে পার হয়ে যেতে থাকলো আমাদের সামনে দিয়ে। জোর হুইশেল বাজছে তখন ট্রেনের, সেই শব্দে লোকটার চিৎকার শোনা ও গেল না।
আশিটা ওয়াগন পার হয়ে যেতে ট্রেনটা ফুরিয়ে গেল।
তখন লোকটা আর চিৎকার করছে না।
তার শরীরটা লাইনের ওপারে ছিটকে চলে গিয়েছে তবে একখানা পা দু’ টুকরো হয়ে গিয়ে লাইনের এইধারেই পড়ে আছে, দেখা গেল । আর সেই কাটা পা টা তখন ও রয়েছে সেই মৃতের মুঠিতে ধরা।
রক্তে ভাসছে জায়গাট।
চাঁদের স্বল্প কুয়াশাঢাকা আলোতে সেই দৃশ্য দেখেই আমি আর্তনাদ করে উঠলুম দারুণ ভয়ে …..‘ও.কাকুউ …’ বলে।
কাকু সোজা দৌড় লাগালো সামনের দিকে আর কোনদিকে না তাকিয়ে, আমি ভয় পেয়েছি দেখে।
মিনিট দশেকের মধ্যে অনেকটা দূরে বেনারস ক্যান্ট স্টেশনের আলো দেখা গেল।
কাকু খানিকপরে সেখানে পৌঁছে গেল ও স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো পেয়েই উঠে পড়লো, আমাকে বসিয়ে দিয়ে।
অটো চলতে একটু রেষ্ট নিয়ে কাকু আমার পিঠে হাত রেখে বললো-‘চঞ্চল, তুমি তো বিজ্ঞান পড়েছ, তাই বলছি যে ভূত মনে করে ওই লোকটার মতন ভয় পেও না। ওটা কিন্তু মোটেই ভূত নয়। ঘটনাটা দেখে অনেকেই তাই ভাববে বটে, কিন্তু ওই ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় রিগর মর্টিস সেট ইন করা’।
‘মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরে এটা হয় আর তখন শরীরের সমস্ত হাড় শক্ত হয়ে লোহার মতন হয়ে যায়। পেশী ও। তখন মৃতদেহের হাতের বা পায়ের মধ্যে যা কিছু আটকা পড়ে, তাকে আর ছাড়ানোই যায় না’।
‘লোহার রড ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে ও সেই হাতের আঙুল তখন আর সোজা করা যায় না। কয়েক ঘন্টা থাকে মৃতদেহ এই অবস্থায় যতক্ষণ না সেট আউট করছে রিগর মর্টিস। তখন মৃতদেহ এলিয়ে পড়ে আর পচন ও শুরু হয়ে যায় তারপরে’।
‘চোরটা এ’সব না জেনে মৃতের জামা কাপড় খুলছিল অসাবধান হয়ে। সেই সময় তার একটা পা মৃতের মুঠিতে আটকে গিয়েছিল কি ভাবে বেকায়দায় পড়ে। মৃতদেহ এইভাবে নাড়াচাড়া করা তা ও আবার নিজের গায়ের বা পায়ের ওপরে রেখে, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। এই জন্য মড়া ছুঁতে নেই’।
‘টানাটানিতে হাতের আঙুল মুড়ে যেতেই পারে নরম অবস্থায় থাকবার সময়ে। তারপরে সেই মুঠি শক্ত হ’য়ে লোহার মতন হ’য়ে গেলে তখন আর সেই লৌহ মুষ্টি থেকে পা টেনে ছাড়ানো হচ্ছে, অসম্ভব কাজ। আর ভয় পেয়ে সেই অসম্ভব চেষ্টা করতে গিয়ে লোকটার যা হাল হ’লো, সে তো তুমি দেখতেই পেলে, চঞ্চল। বেশী ভয় পেয়ে লোকটা অতো লাফালাফি না করলে নিজের পা টা হারাতো না। আর মনে হ’লো লোকটা মাথাতে ও বেশ চোট পেয়েছিল ট্রেনের জোর ধাক্কায়, সুতরাং বাঁচবার সম্ভাবনা খুবই কম’।
আমি মনে মনে বললুম- ‘কাকু হয়তো ঠিকই বলছে কিন্তু ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, অত তাড়াতাড়ি কি শরীর অত শক্ত হয়ে যেতে পারে কখনো? তবে হয়তো মৃতদেহে কিছু আগে থেকেই সেট ইন করেছিলো রিগর মর্টিস। তারপরে ক্রমে হাত ও শক্ত হয়ে উঠেছে। এইজন্যেই হয়তো মড়ার ভার বেড়ে যায় মৃত্যুর খানিক পরে। কিন্তু সে’সব আমাকে না বুঝিয়ে তখন আসলে কাকু বিজ্ঞানের যুক্তি তর্কের সাহায্যে আমার ভয় কাটাতে চাইছিলো। কিন্তু আমি ঠিক দেখেছি যে মৃতদেহের হাতের আঙুলগুলো চোরটার পা টা ধীরে ধীরে মুঠি করে ধরছিল ঠ্যালা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে’।
‘রিগর মর্টিসে কি এটা হ’তে পারে?
আর তাইতে হাতের আঙুল শক্ত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বেঁকে যাবে কি করে আপনা আপনি? আর মুঠি বন্ধই বা হবে কি করে?’
‘সবই কি হয়েছে শুধুই লোকটার টানাটানিতে না গড়িয়ে পড়ে যাবার সময় মৃতের হাতের আঙুলে উল্টো দিক থেকে বেকায়দায় কোন চাপ পড়ে?’
‘আরে দ্যুৎ, সে আবার হয় না কী? আর যদি তা নাই হয়, তা’হলে???????????’
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ১৪/৫/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।