অপকারক
জি সি ভট্টাচার্য্য, বারাণসী
============================================================================================
আমি যত না বলি তা সে দেখি শোনেই না। ভালো মুশ্কিল আমার যা হোক ।
সেদিন সকালবেলাতেই সে এক বেশ অকারণ ঝামেলায় পড়েছিলুম ।
বলে কিনা নগদ দশ হাজার দিচ্ছি আমার উপকারটুকু করতেই হবে আপনাকে।
কি গেরো। ভদ্রমহিলা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলেন না। পাড়াতে থাকেন বলে এই আব্দার।
তা আমার কথা কেউ মানবেই বা কেন? আমি কি ভীম ভবানী ভট্টাচার্য্য না বাঁটুল দি গ্রেট?
পরীর দেশের রাজকুমার চঞ্চল পাশের ঘর থেকে সব শুনছে তা জানি কিন্তু করব কি?
বেনারসের পুরনো ধান্ধাবাজির আমরা কি করতে পারি?
সোনার গয়না বাঁধা দিয়ে নিয়েছে টাকা ধার দশ হাজার। গয়না অবশ্য পঁচিশ হাজারের কম নয়। ব্যাংকের ধারে নানা ঝামেলা বলে এই ঘরোয়া ধান্দা অনেকেই এখানে করে। আর ধার নেবার জন্য লোকের অভাব ও হয় না কারোই। সুদ অবশ্য ডবল আর মাসিক রেট। বছরে বারোগুণ হয়। আর একবছরের মধ্যে টাকা শোধ না দিতে পারলে মাল বাজেয়াপ্ত। গলাকাটা ব্যবসাই বটে। তাও লোকে নিতে তো ছাড়ে না দেখি।
সোনা না ফেরৎ পেলে তখন কান্নাকাটি একে তাকে ধরে পড়া। এই সব করে।
বললুম পুলিশে খবর দিন তা ও করতে রাজী না হয় যদি তো আমি নাচার। অবশ্য বেনারসের পুলিশ মনে হয় ভাগ পায় হয়তো তাই নির্বিকার ।
তাঁকে বিদেয় করতেই বেলা দশটা বেজে গেল।
আমাদের চান জলখাবার সব শিকেয় উঠলো।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে আর অভিসম্পাত দিতে দিতে বিদেয় হতে আগে চঞ্চলের চানের ব্যবস্থা করতে গেলুম। জল গরম করতে হবে।
জলখাবার ও কিছু করতে হবে তৈরী।
চঞ্চলকে চান করাচ্ছি হঠাৎ ছেলেটা বলল-‘কাকু, উনি অপকারক খুঁজবেন এইবার উপকারক না পেয়ে’।
বারো বছরের অপরূপ সুন্দর ছেলেটার আজকাল এই এক রোগ হয়েছে। মাঝে মাঝে অদ্ভূত সব কথা বলে বসে এমন যার মাথামুন্ডু নেই।
বললুম-‘নাঃ, এইবারে বাদলকে খবর দিতে হবেই দেখছি’।
শুনে চঞ্চল হিঃ হিঃ করে হাসতে লাগলো উল্টে। দেখ দেখি কান্ড। বাদল জিনিয়াস ছেলে বলে সে চঞ্চলের এইরকম খাপছাড়া কথার মানে ও ঠিক বুঝতে পারে। হুঃ অপকারক? সেটা আবার কি জীব? যত্ত সব।
তা এখন বাথরুমে বসে ফোনই বা করি কি করে? আগে চানটাই শেষ হোক দুধবরণ ছেলের। তারপরে……………………নাঃ জলখাবার পর্ব ও তো আছে মাঝখানে।
আমি চঞ্চলকে দামী সাবান মাখানো শুরু করলুম হতাশ হয়ে।
চঞ্চল যে আর কিছুটি বলবে না তা বলাই বাহুল্য। ছেলেটার ধারাই ওই।
জলখাবার পর্ব শেষ হতেই ফোন করলুম। রবিবার বলে ছেলেটা বাড়িতেই ছিল। বলল-‘কাকু, আমি আসছি। তুমি চঞ্চলকে আজ একটা মেরুন সুট পরিয়ে রেখো। ছেলেটাকে দারুণ দেখতে লাগবে। যা সুন্দর ছেলে না চঞ্চল…..’
আমি বললুম-‘তুমিই বা কম কিসে?’
বাদল বলল-‘ডেভিডের কাছে কাফ্রিবালক। হিঃহিঃহিঃ….;
তবে বাদল এসে সব শুনে গম্ভীর হয়ে বলল-’কাকু, চঞ্চল ঠিকই বলেছে। সোনার শোক পুত্রশোকের চেয়ে ও বেশী অসহনীহয় হয় শুনেছি আমি। ওই ভদ্রলোক কাজটা ভালো করেন নি। আমি সব খোঁজ নেব কাকু., তোমার চিন্তা নেই…’
‘তুমি কি কিছু সন্দেহ করছ বাদল?’
‘হুঁ’
‘কি শুনি’
‘পিশাচ মানুষ’
‘সে আবার কি কথা। পিশাচ আবার মানুষ হয় কি করে? তুমি দেখি চঞ্চলের থেকে ও বেশী পাগল’।
‘তুমিই তো বল যে আমি একটা না কি জিনিয়াস ছেলে। তা জিনিয়াসরা বেশ একটু পাগল তো হয়েই থাকে কাকু। হিঃ হিঃ হিঃ..’
‘ও সব চলবে না। মানে বলো আগে’।
‘মানে বলা ভারী মুশ্কিল কাকু। তবে তারা মানুষ বেশে অন্য কিছু। যেমন অর্থপিশাচ বা শাইলক….দয়া,মায়া,মমতা, মানবতা কিছুই নেই বলে হয়তো লোকে পিশাচ বলে অথবা হয়তো….সে যাক। এককথায় মনে হয় অপকারক বলাটাই ঠিক কাকু। তা এখন যদি ওই ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা কিছু তুমি জানো তো আমাকে লিখে দাও কাকু। আর পঞ্চাশটা টাকা দাও। পঞ্চাকে দিলেই সব খবর পেয়ে যাব। ও আমার বন্ধু আর এইসব কাজে ওস্তাদ। ….’
আমি তাই করলুম। বাদল চলে গেল। ছেলেটা বড্ড ছটফটে। চঞ্চলের মতন ধীর স্থির নয়। কি করে ওরা যে বন্ধু হল কে জানে বাবা……
তা সে ছেলের আর পাত্তাই নেই।
আমার আবার বেশ একটু অস্থির স্বভাব। দুটো দিন যেতেই করতে হল ফোন। পূজোর ছুটি পড়ে গেছে। চঞ্চল বাদলের স্কুল ও বন্ধ। করি কী?’
বাদল বলল-‘কাকু, ভদ্রমহিলা তোমাদের পাড়াতেই থাকেন এবং বড়ই শোক পেয়েছেন। আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছিলেন। ওনার একটি মেয়ে আছে। বছর ষোলো বয়স হবে। তার বিয়ের জন্য রাখা গয়না। বিধবা মহিলার কষ্ট ও চিন্তা স্বাভাবিক। তবে মেয়েটা এখন দিনকে দিন খুব সুন্দর হয়ে উঠছে কিন্তু। কাকু তুমি সামলে রেখো জোছনাকে……হিঃহিঃ হিঃ.’
‘কি দুষ্টু ছেলেরে রে বাবা। চঞ্চলকে মেয়ে মানে জ্যোত্স্না বানিয়ে ছাড়লো।
মানুষ আবার নতুন করে সুন্দর হয় নাকি ষোল বছর বয়সে?’
‘হয় কি না তা জানি না, কাকু। তবে যা হচ্ছে তাই বলছি। অপকারকের খোঁজ এখন ও পাই নি আমি। পেলেই ফোন করে জানাবো।’
খুবই সন্দেহজনক ব্যাপার তবে এযাত্রায় আমি দর্শক মাত্র। তাই বাধ্য হয়ে আবার অপেক্ষা ।
তবে তিনদিনের দিন বাদলই হঠাৎ ফোন করে বললো-‘কাকু, পরিচায়ক রূপে অপকারক মঞ্চে এসে গেছে। ওই ভদ্রলোকের ছেলের পরিচয় সে ভদ্রমহিলার মেয়ের সাথে কফি কর্নারে করিয়ে দিয়েছে । কাকু, মনে হয় কিছু একটা অঘটন ঘটবে হয়তো। মেয়েটা এখন একদম পরী হয়ে উঠেছে দেখতে। প্রসাধনে এত হয় না। চঞ্চল কোথায় লাগে? কাকু…….. সাবধান.’
‘পরিচায়কটা কে?’
‘তা এখন ও আমি জানি না। কোথা থেকে এসেছে কোথায় থাকে তা ও কেউ বলতে পারছে না। মনে হয় না সে এখানকার লোক তবে সে সবাইকে বেশ চেনে। খুব চটপটে মানে স্মার্ট লোক। কালো ভূত লম্বা রোগামতন চেহারা। কিন্তু গায়ে খুব জোর তার। ছেলেটা তার সঙ্গে কফি কর্নারে যেতেই চায় নি প্রথমে বলে তার হাতটা ধরে একটুমাত্র টেনেছিল ……আরে এসোই না। তোমার খুব ভালো লাগবে…….এই বলে আর তাইতেই জোয়ান ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠেছিল বাবা রে বলে।
তবে সে একজনের হুকুমে কাজ করছে বলে মনে হয়। হয়তো কিছু টাকা আর ও নষ্ট হবে তোমার কাকু। কোন লাভই হবে না। এখন বল তুমি কি করবে?’
‘যা করছি। কাল এসে টাকা নিয়ে যেও।‘
‘পরদিন বাদল এসে টাকা নিয়ে চঞ্চলকে খানিক ক্ষেপাল জোছনা বলে তারপরে বলল-‘হয়তো নৈশ অভিয়ানে যেতে হতে পারে নিজের চোখে এই অদ্ভূত রহস্য দেখে বুঝতে হলে। তবে পরী টরী অচল। কি করবে কাকু?’
‘যাব’
‘আমি ও যাব’ চঞ্চল বলল।
‘পথে জোছনা বিবর্জ্যতে…….হিঃহিঃ হিঃ….’
‘ব্যস লেগে গেল দুই প্রাণের বন্ধুজনের মধ্যে । বাদল অবশ্য মারে না চঞ্চলকে। মার খায় আর হাসে……বললেই বলবে জোছনাকে মারবো কি করে কাকু?’
‘তোমরা এখন থাম দেখি। কবে অভিযান করতে হবে তাই বলো। বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসিয়ে তবে যাবো। দাদাকে বলতে হবে’।
‘ক্লাইম্যাক্স এখন ও শুরু হয় নি, কাকু। দিন সাতেক অন্তত লাগবে তবে পরিণতি হয়তো খুব একটা ভালো হবে না কাকু’।
তা বাদল খুব একটা ভূল বলে নি।
দিন দশেক পরে ফোন করে বাদল নিজেই আবার বললো-‘কাকু, আজি রজনীতে হয়েছে সময়……রাত এগারোটায় তৈরী…’
আমি ও দাদাকে ফোন করে দিয়ে নিজের নৈশ অভিযানের ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বসে গেলুম। চঞ্চলকে পুলিশ পাহারায় বাড়িতেই রেখে যেতে হলো।
পায়ে হেঁটে গেলুম। অনেকটা দূরেতে যেতে হল আমাদের। সেই অসী ছাড়িয়ে। এদিকটা এখন সব না কি তান্ত্রিকদের দখলে হয়ে গেছে। কেন যে বাদল রিক্সা বা অটো নিতে দিলো না তা কে জানে। হয়তো সাক্ষী রাখতে চায় না তাই।
অন্ধকার একটা বাড়ির বন্ধ গেট অনায়াসে টপকে পার হয়ে ছাদে উঠে গেলুম একটা ঝুলিয়ে রাখা নাইলনের দড়ি ধরে জলের পাইপের খাঁজে পা রেখে । ছাদের দরজার খিল ও খোলা।
এ সবই পঞ্চার কাজ। সে এখন এই বাড়িতে নতুন চাকরী নিয়েছে বাদলের পরামর্শে। চাকরের কাজ।
মাঝের তলার একটা বড় ঘরের একটা জানলার কাচে দুটি ফুটো। কাচটা সম্প্রতি বদলানো হয়েছে বলে মনে হলো। আর সব দরজা জানলা বন্ধ । ভেতরে দুজন মহিলা। একজন কে তো চিনলাম সেই তিনি আমাদের বাড়িতে যিনি এসেছিলেন আর দ্বিতীয়জন অপরিচিতা রক্তাম্বরা জটাজুট সমাযুক্তা পুজায় নিরত।
মনে হলো এই রে দিনটা তবে নির্ঘাৎ করে আজ অমাবস্যাই হবে। ইনি তান্ত্রিক। আমাদের আসাটা ঠিক হয় নি বাদলের মতন একটা বাচ্ছা ছেলের কথায় এমনভাবে। এখন ধরা পড়লে ট্রেসপাশিং তো বটেই চুরির চার্জে ও পড়তে হতেই পারে।
পঞ্চা অবশ্য পাহারায় আছে …..সাহায্য ও হয়তো করতে পারে পালাতে। তবু ও…………….
একঘন্টা ধরে পূজো হোম হবার পরে শুরু হলো ধ্যান। ঘরে হয়তো এগজস্ট ছিল তাই ধোঁয়া নেই। তবে ফ্যান ও নেই। প্রদীপ নেভার ভয়ে। দ্বিতীয়জন হাতপাখার বাতাস করতে রইলেন সমানে। চারপাশে গদী আর পাশ বালিশ বসিয়ে ধ্যানের সুবিধা করে দিলেন যাতে পড়ে না যান তিনি। একটুপরে সত্যিই ধ্যানরতার অসাড় দেহটা মৃতদেহের মতন সেই গদি বালিশের ওপরে এলিয়ে পড়ে গেল।
নিঃস্পন্দ শরীর।
আমি হতবাক।
একঘন্টা কাটলো। দুই…ক্রমে তিনঘন্টা ও কেটে গেল।
কোন পরিবর্তন নেই। আমরা স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে আছি। ভোরের একটু আগে জোরে এলার্ম বাজার মতন শব্দ হলো ঘরে আর সেই অসাড় মৃতদেহটা নড়লো একটু….আবার একটু নড়লো…পাশ ফিরলো । তাকে দুহাত ধরে টেনে সোজা করে বসিয়ে দিলেন অন্যজন। একটা পাত্রে কি লালমতন তরল পদার্থ এনে একটু একটু করে খাইয়ে দিয়ে আবার বাতাস করতে লাগলেন।
ভোর হবার ঠিক আগে তিনি হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন। সেই ভদ্রমহিলা তখন একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে মনে হল দশ হাজার টাকা সব একশো টাকার নোটের বান্ডিল তাঁর পায়ের কাছে রেখে উঠে দাঁড়াতেই বাদল আমার হাত ধরে টানলো। আমরা তখনই যঃ পলায়তি সঃ জীবতিঃ করে ফেললুম নিজেদের পথে।
একদিন পরে কাগজে একটা দুঃসংবাদ পড়লুম।
সেই টাকা ধার দেওয়া ভদ্রলোকের একমাত্র ছেলে পারিবারিক কলহের কারণে হঠাৎ কি সল্ফাস না কি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
বাদলকে তখুনি ফোন করলুম-‘বাদল পারিবারিক কলহের কারণ জানো?’
‘জানি কাকু
‘কি?’
‘গয়না চুরী’
‘কবে?’
‘অমাবস্যার ঘোর রাতে’
কি করে?’
‘ছেলেটা একদম পাগল হয়ে গেছিল ওই অতি সুন্দর মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে। টাকা পয়সার জন্য বিয়ে হবে না বলায় ছেলেটা রাতে নিশিতে পাওয়ার মতন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে বাবার চাবী চুরী করে সিন্দুকে যত বন্ধকী সোনা ও গয়না ছিল সব নিয়ে পুঁটলী বেঁধে সেই রাতেই পায়ে হেঁটে গিয়ে দিয়ে আসে মেয়েটার হাতে। পঞ্চার এক বন্ধু সারারাত পাহারায় ছিল বলে সে দেখে ফেলেছে।
মেয়েটার মা সেই রাতে বাড়িতে ছিল না। একজন অসুস্থ আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সেবা করে ভোর হবার পরে রিক্সা করে বাড়িতে ফিরে আসে। মেয়েটা তাই তখন ও জেগেই বসে ছিল। বেল বাজতেই গিয়ে দরজা খুলে দেয়। পঞ্চা ও এসেছিল অন্য একটা রিক্সা চড়ে। সে ও তার বন্ধু লুকিয়ে মেয়েটার আবার একটা ফটো তুলে নিয়েছে।
এই নিয়ে তিনখানা ফটো তোলা হলো।
প্রথম আর তৃতীয় ফটোতে কোন প্রভেদ নেই। অতি সাধারণ শ্যামা এক কিশোরী মেয়ের ফটো।
আর দ্বিতীয়খানা দেখলেই মাথা ঘুরে যায় সবার। দারূণ সুন্দরী এক মেয়ের ফটো। এ যে কী প্রহেলিকা তা আমি ও জানি না কাকু। তবে তুমি দেখে যদি কিছু বোঝো তো আমাকেও বুঝিয়ে দিও একটু না হয়।
‘তা দেখবো। তবে এটা কি হলো বাদল?’
‘সুদ শুদ্ধু ধার শোধ হয়তো, কাকু। আর মানুষের একটা অমূল্য জীবন ফাউ হিসেবে গেল। আর একটা পরিবার ও।
০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২৫/৯/২০১৬
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।