• ৯ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা (১০২)

    ২০১৯ , নভেম্বর



দাগ
আনুমানিক পঠন সময় : ১৩ মিনিট

লেখিকা : স্বাগতা সরকার
দেশ : India , শহর : জয়নগর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , নভেম্বর
প্রকাশিত ২৩ টি লেখনী ৩১ টি দেশ ব্যাপী ১৯৬৫১ জন পড়েছেন।
মায়ের শেষ ইচ্ছে রাখতে লোকটাকে বিয়ে করতে হয়েছিল আমায় । প্রথম যেদিন লোকটাকে দেখেছিলাম ঘোর কালো রঙ, কুৎসিত মুখ ভর্তি গর্ত আর বসন্তের দাগ। আর আমি এদিকে ডাকসাইটে সুন্দরী ,কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? 

 জানেন ,লোকটাকে 'লোকটা' ছাড়া আর কোনো কিছু দিয়ে সম্মোধন করিনি কোনদিনই। ওর একটা নাম আছে ধরতাম ই না কখনো । ও যেনএকটা থার্ড পারসন। ও যেন একটা কি । বন্ধু বান্ধবীদের কাছে বলেছি ওই কুৎসিত 'লোকটার ' সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার জানিস । লজ্জায়, ক্ষোভে বেশিরভাগ কে ছবি দেখাতেই ঘেন্না করেছে। দু'একজন যারা কাছের ,দেখে বলেছিলো- ইমা এই লোকটা? তুইতো ডাকসাইটে সুন্দরী । 
আমার কষ্ট হয়না? কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? 

 অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি । মা টুকুই তো সম্বল । তখন আমাদের সব যেতে বসেছে। কাকু জেঠু রা কেউ আমাদের দ্যাখেনি।  কাকিমা -জেঠিমা আর আমার রুপ গুণ নিয়ে হিংসে করেছে। মায়ের ঘোর অসুস্থতায় মায়ের পুরনো বান্ধবীর ছেলে ওই 'লোকটা' ছাড়া আর কেউ ছিল না আমাদের। তখন আমরা কি খাবো -দাবো ,মায়ের চিকিৎসা সব দেখতো ওই লোকটা । মায়ের ওষুধের সিংহভাগ খরচ করেছে লোকটা। তাই মায়ের চোখে ওর চেয়ে সুপাত্র ছিল না কেউ। দিনের পর দিন বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছি। সবাই যে বলতো আমি রাজকন্যার মত সুন্দরী, কোনো রাজপুত্র আসবে ঘোড়ায় চড়ে আমাকে নিতে । তবে আমাকে কে এ কোন দানবের হাতে তুলে দিচ্ছ ঠাকুর? শুধু আমরা গরিব বলে?

স্নানের সময় নিজের ফর্সা-সুন্দর নগ্নতা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদেছি কত দুপুর। কম বয়সে সুন্দরী মেয়েরা নিজেরাই নিজের প্রেমে পড়ে। নার্সিসাস প্রেম। ওই রোমশ লোহার মত শক্ত কুৎসিত আঙ্গুলগুলো খেলা করবে আমার শরীরে? নাঃ আর ভাবতে পারিনি । অসহায় হয়ে  কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছি কতরাত । ঐ তো কালো কুৎসিত দানবের মতো শরীর, মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ। কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? 

নাঃ মাকে বাঁচানো যায়নি। মায়ের অসুস্থতা থেকে শেষকৃত্য ওই লোকটা নিজের হাতে দায়িত্ব নিয়ে সামলেছে। বোবা কান্নায় পাথর হয়ে বসে থাকতাম একা। লোকটা আমাকে কোন কাজ করতে দেয়নি । কৃতজ্ঞতাবোধ বড় খারাপ জিনিস। লোকটার থেকে সব উপকার নিয়ে তার মুখের ওপর বলতে পারিনি- আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর বাড়ির লোকেদের যা অবস্থা আমাকে দেখতই বা কে? 

মনে আছে বিয়ের আগের দিনও সারারাত কেঁদে চোখ লাল হয়ে গেছিল আমার। সকালে যখন উঠি মাথায় তখন তীব্র যন্ত্রণা।  তিনকুলে কেউ ছিলনা ওর এক মাসতুতো দিদি ছাড়া। বিয়েতে সাজিয়েছিল সেই দিদি ই।'লোকটা'র দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলেছিল- ভাইটা আমার কালো হলে হবে কি ,আহা কি সুন্দরী বউ হয়েছে তোর। 

ফুলশয্যার রাতে একবুক উৎকণ্ঠা ,ভয়, ঘেন্না ,সংকোচ নিয়ে বসেছিলাম সেরাত।এই রাত সব মেয়েদের জীবনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসে। আমারও ছিল । সেই ছাই হয়ে যাওয়া স্বপ্ন গুলোর ধ্বংসস্তূপে বসেছিলাম চুপ করে । সে ঘরে এসে কাছে বসে ছিল ,আমার ঘোমটা তুলেছিল ,আমায় একটু কাছে টেনে কপালে চুমু ও দিতে চেয়েছিল, হালকা সোনালি আলোয় খুব কাছ থেকে তার মুখ দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল কুৎসিত খুব কুৎসিত দানবের মত এক মুখ, মুখ ভর্তি গর্ত,বসন্তের দাগ । আর আমি ডাকসাইটে সুন্দরী। কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? 
সজোরে ধাক্কা মেরেছিলাম তাকে । নিজের সমস্ত তাচ্ছিল্য ,ঘৃণা কেন্দ্রীভূত করে ধিক্কার দৃষ্টি দিয়ে তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম । ককিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম। গোঙানির মতো আর্তনাদ করেছিলাম । 

নাঃ লোকটা কিছুই করেনি। আমিই ওভার রিয়েক্ট করেছিলাম । রাতে ওকে অনেক অপমান করেছিলাম। সারারাত বারান্দায় শুয়ে ছিল সে । সকালে আমার জন্যে চা জলখাবার এনেছিল 'লোকটা'। আমি ছুঁয়ে ও দেখিনি।

খবর রাখিনি, আমি খাইনি বলে লোকটার ও খাওয়া হয়নি কতদিন । সেও বোধ হয় না খেয়ে অফিস চলে যেত । খাবার চাপা দিয়ে যেত আমার জন্য। আর আমি শুধু কাঁদতাম। নীরব অভিযোগ জানাতাম ভাগ্যের কাছে।মরা মায়ের কাছে। কেন মা কেন তুমি এমন করলে? আমার মরা মা বোধহয় উপর থেকে কাঁদত আর বলত, -এ তবু তো তোকে আশ্রয় দিয়েছে, সুরক্ষা দিয়েছে ,নয়তো লোলুপ পুরুষেরা তোকে ছিঁড়ে খেত। মায়েরা সন্তানের খারাপ করে না  কখনো।

নাঃ প্রাথমিক ভয়টা কেটে গিয়েছিল 'লোকটা'র থেকে। লোকটা দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েনি কোনদিন। নাঃ লোলুপ লোভী পুরুষের মতো নানা অছিলায় ছুঁতেও চায়নি কখনো। 
লোকটা মনে হয় স্নেহ করতো আমাকে। কি জানি আমার জন্য মায়া হতো হয়তো ওর। তাই অফিস ফেরত পথে আমার জন্য চকলেট ,খাবার আনতে ভুলত না কখনো। আমার কষ্ট হবে ভেবে দুটো কাজের লোক রেখেছিল সে। আমার একটু একটু ভরসা হতো তাই আমি বলায় বারান্দা  ছেড়ে ঘরের সোফাতে  শুয়ে পড়তো সে।

একদিন প্রস্তাব দিয়েছিল কি একটা রোমান্টিক মুভি দেখতে যাওয়ার । নীল অন্ধকারে যদি ও চুমু খেতে চায় জোর করে ?না আমাকে ছোঁয়ার পারমিশন ওকে দেবার কথা ভাবতে পারি না। কখনো নয় । ওর পাশে হাঁটতে ইচ্ছে করে না আমার। ঘোর কালো রঙ, কুৎসিত মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ আর আমি এদিকে ডাকসাইটে সুন্দরী। কি করে মেনে নেব বলতে পারেন ?

কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা টা শুরু করলাম আবার। লোকটাকে বলেছিলাম কিছু টাকা দেবেন? পরে চাকরি পেলে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব । লোকটা কোন কথা বলে নি । ওর এটিএম কার্ডটা দিয়ে দিয়েছিল নীরবে। কলেজে এসে আমি ইদানিং সিঁদুর ও পড়তাম না। আধুনিক মেয়ে। কলেজে এত বন্ধুবান্ধব। রূপ গুণ প্রতিভা কম ছিল না কোনো কালে। শুধু গরীব ছিলাম। দারিদ্র্যের চেয়ে বড় অভিশাপ কি হয় বলুন? পড়াশোনাটা চালু হয়ে এইসব হতাশা অনেকটাই ভুলে অন্য এক জীবনে যেন প্রবেশ করলাম । এক অন্য জগত। অন্য মায়া। 
লোকটার সঙ্গে এক সমুদ্র ব্যবধান তখন আমার। পড়াশোনা কলেজ আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে পড়ে থাকি। আড্ডা মারি । পড়াশোনা করি। মাঝে মাঝে এসে খবর নেয়  লোকটা -কেমন চলছে, কোন কিছু লাগবে কিনা ,তাচ্ছিল্যের, ভৎর্সনা র দু একটা উত্তর জুটত তার কপালে, মাথা নিচু করে চলে যেত।সময় সময় হাতের কাছে দরকার গুলো মিটিয়ে যেত লোকটা । মুখে সব সময়ের প্রশান্তির হাসি নিয়ে সে দেখতো আমায়। আমার ভৎর্সনার উত্তরেও তার অফুরন্ত ভালোবাসা দিত সে। অমন কালো রং, কুৎসিত মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ । অমন লোকটা'র ভালোবাসা কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? 

ফার্স্ট ইয়ারের শেষে এসে জীবনটা বদলে গিয়েছিল জানেন। এক লহমায় । অন্য ডিপার্টমেন্টের একটি ছেলে- পার্থ ,লম্বা -সুন্দর- একরাশ কোকড়ানো চুলের স্মার্ট ছেলে পার্থ ।দারুন আবৃত্তি করে। দারুন গান গায় । তুখোড় পড়াশোনায় । টিচার্স ডে রিহার্সালে নিজেই এসে আলাপ করল সে আমার সঙ্গে । সে তখন তৃতীয় বর্ষ। আমি প্রথম বর্ষের । সাদাকালো ধূসর হতাশাগ্রস্ত জীবনটা হঠাৎ করেই যেন রঙিন হয়ে গেল । বন্ধু বান্ধবীরা সবাই পার্থকে নিয়ে আমাকে, আর আমাকে নিয়ে পার্থকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করল। কথাবার্তা- মুগ্ধতা -বন্ধুত্ব পেয়ে বসলো দু'জনকেই। পার্থ আমার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। আমিও পার্থকে ভালোবেসে ফেললাম। দুজনের মধ্যে বাধা হয়ে গেল আবার 'লোকটা'। ওই 'লোকটা'।হ্যাঁ হ্যাঁ আবার ওই 'লোকটা'।মনে হয়েছিল আমার জীবনটা নরক করে দেবে এই লোকটা। 
আবার শুরু হল কান্নার দিন। দ্বন্দের রাত। পার্থ আর আমি দুজনের জন্য দুজনে পাগল। কিন্তু পার্থকে বলতে পারছিনা আমি বিবাহিত, আমার অবস্থা। যদি পার্থ আমাকে বলে আমি ঠকিয়েছি, যদি পার্থ আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তবে আমার কি হবে? আমি তো পাগল তখন। আমি তখন মোহগ্রস্ত নেশাগ্রস্ত প্রেমিকার মত প্রেমের ঘোরে। পার্থ আমার পৃথিবী । পার্থ আমার সবকিছু ।  যদি পার্থ আমায় ছেড়ে যায় তবে ওই 'লোকটা'র জন্যই যাবে। ওই লোকটা। কালো কুৎসিত বসন্তের দাগ ভর্তি  জান্তব ওই লোকটা । 

সৎ সাহস নিয়ে পার্থকে সেদিন বলতে গেছিলাম সবটা। প্রচন্ড ঝগড়া করলো পার্থ । সারাজীবন ভাগ্যের পরিহাসে ভুগেছি। জীবনের প্রথম প্রেম এভাবে বিসর্জন দিতে পারব না । 

-বিশ্বাস করো পার্থ লোকটাকে ছুঁতে দিইনি কোনদিন। ওই লোকটাকে এক্ষুনি ডিভোর্স দিতে পারি পার্থ । যেকোনো দিন । যেদিন তুমি বলবে। বিশ্বাস করো ওই লোকটার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই । 

রাগে ক্ষোভে অভিমানে আমার গালে সপাটে চড় কষিয়ে ছিল পার্থ । আমার পৃথিবী অন্ধকার দেখেছিলাম তখন । ভেবেছিলাম জীবন শেষ করে দেব। তারপর একটা  গাড়ির সামনে গিয়ে পড়ি .....গাড়ি এক্সিডেন্ট....ডান পা টা ভেঙে গেল আমার। চোট এটুকুই। সব ওই 'লোকটা'র জন্য। ডাক্তার বললেন ,একমাস বেড রেস্ট । 

ওই 'লোকটা' দিনদিন বিষিয়ে যাচ্ছিল আমার চোখে। কুৎসিত ঘৃণা হতো ওকে দেখে। সামনে এলেই অকথ্য কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হতো। পার্থকে হারানোর বেদনায় তখন আমি নিঃস্ব রিক্ত । কতদিন কতরাত কেঁদেছি হতাশাগ্রস্ত পাগলের মতো । মৃত্যু কামনা পর্যন্ত করেছি ওই 'লোকটা'র। 

 এক এক রাতে আধো ঘুমের মধ্যে চোখ খুলে দেখেছি, লোকটা পায়ের কাছে বসে। মনে হতো কাঁদছে। ও কি কাঁদত?  আমার ঘুমের মধ্যে ও মনে হতো লোকটা আমার ভাঙা ডানপায়ে আস্তে আস্তে হাত বোলাচ্ছে। কে জানে। আমার পায়ে যন্ত্রণা হলে ওর ও যন্ত্রনা হতো কি। কে জানে । 

লোকটাকে 'লোকটা' ছাড়া আর কিছু বলে সম্মোধন ই করিনি কোনদিন। ও যেন একটা থার্ড পারসন ।  ও যেন একটা কি। আসলে ওকে ভালোইবাসিনি কোনোদিন। ঘোর কালো রং, কুৎসিত মুখটা জুড়ে গর্ত আর বসন্তের দাগ আর আমি এদিকে ডাকসাইটে সুন্দরী । কি করে মেনে নেব বলতে পারেন ?

পার্থ র জন্য ডেসপারেট হয়ে পড়ছিলাম দিনদিন। লোকটাকে একদিন বলে দিলাম পার্থর কথা। বলে দিলাম ডিভোর্স চাই । জানিয়ে দিলাম কেন সেদিন সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম।লোকটা কি দুঃখ পেল ?কে জানে। একদিন ছুটির দুপুরে আমাকে কাঁদতে দেখে লোকটা'র কি মনে হলো জানিনা ,বলেছিলো- পার্থ বাবুর সঙ্গে দেখা করব । সব বোঝাবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব  ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব । তুমি চিন্তা করো না । তোমরা সুখী হবে। 

পার্থ আর আমার মধ্যে ঠিকঠাক হয়ে যেতে লাগলো সব আবার। এই একমাস পার্থ আমার খোঁজ নেয় নি । হয়তো রাগে। যাইহোক আমি আর পার্থ মিলে গিয়েছিলাম। আবার । কতদিন পর পার্থ আবার আমাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরেছিল । ওর বারুদের মতো ঠোঁট দুটো চেপে ধরেছিল আমার ঠোঁটে। সুখবর এর পর সুখবর। খুশির পর খুশি । কিছুদিন পরই একটা ভালো চাকরি পেল পার্থ । এই প্রথম আমি এত খুশি হয়েছিলাম । 
'লোকটা' ? দূর লোকটাকে তো ভুলেই গেছি । পার্থ বলল- তোমায় একলা করে নিজের করে পেতে চাই । চলো না কোথাও ঘুরে আসি । পাহাড়ে। আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম । আমি পার্থ আর কিছু বন্ধুবান্ধব । লোকটাকে জানিয়েছিলাম বটে ,তবে সেটা না জানানোর মতই। 

দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটছিল। পার্থর ঠোঁট পাগলের মত আদর করত আমায়। আলিঙ্গনে আশ্লেষে  আবেগে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম । লোকটা' মেসেজ করে জানতে চাইত ,আমি ঠিক আছি কিনা। আমি সিন ই করতাম না। ফেরার আগের রাতে পার্থ জীবনে প্রথম ড্রিঙ্ক করতে শেখালো আমায়। আমাতে মিশে যেতে চাইল পার্থ । ওর সমস্ত আদর অনুভূতি দিয়ে উদ্দামতা দিয়ে পাগল করে দিতে চাইল আমায় । আমার লাস্যময়ী দৃষ্টিতে ওকে পুড়িয়ে দিচ্ছিলাম । বেশ বুঝতে পারছিলাম অজানায় কোন অজানায় ভেসে যাচ্ছি দুজনে। একাত্ম হতে যাচ্ছিলাম আমরা, একাত্ম হতে চাচ্ছিলাম আমরা । ওই সময়ে হ্যাঁ ওই সময় আমার সেলফোনে বেজে ওঠে আবার । 'লোকটা'। বেজে যায় ফোনটা । আমরা তখন মত্ত । লোকটা আবার ফোন করে । ফোনটা আমি তুলি। তখন খেয়াল ছিল না কার ফোন ধরছি ,লোকটা চেনা গলায় বলে -কোনো মেসেজ সিন করছ না, ভয় পেয়ে গেছিলাম। ঠিক আছ তো তুমি ?

পার্থর মুডটা কি প্রচণ্ড রকমের বিগড়ে গেছিল। আবারও প্রচন্ড ঝগড়া করলো পার্থ । ও আমাকে নিয়ে পজেসিভ। সহ্য করতে পারছে না লোকটা'কে।এটাই তো ভালোবাসা । 
পার্থ ঝগড়ার রেশ সহজে কাটে না । পরদিন সকালে আমার গাড়িতে কিছুতেই গেল না পার্থ । আরেকটা গাড়িতে উঠে পড়ল রাগ করে। ওর খুব জেদ। আমার সাধাসাধি তে ও আমার সঙ্গে এলোনা পার্থ ।

তখনো জ্ঞান আছে একটু একটু ,পুরোপুরি অজ্ঞান হইনি দেখছি পার্থর গাড়িটা আমাদের সামনে ঠিক এগিয়ে যাচ্ছে ,আর আমাদের গাড়িটা আমি যেটাই বসেছিলাম গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে খাদের দিকে। মৃত্যুর দিকে। আমি পড়ে যাচ্ছি খুব উঁচু থেকে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে কোথাও। কিছু বুঝতে পারছিনা । মৃত্যুর আগের মুহূর্তে কি  এই রকম অনুভূতি হয়????

নাঃ মরিনি। শেষ পর্যন্ত লোকটা আমাকে মরতে দিল না । সাতদিন পরে জ্ঞান ফিরে প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলতে  যাকে দেখলাম, সেই কালো কুৎসিত মুখ বসন্তের দাগ ভর্তি মুখ। আমার 'লোকটা'। 'লোকটা'র চোখে জল । আমার কপালে ,মুখে, চোখে সারা শরীরে তখন বীভৎস যন্ত্রণা। নিজের মুখ দেখেই নিজের শিউরে উঠছি।পাথরে থেঁতলে মুখের বামদিক টা রক্তাক্ত। বাম চোখ টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । বাম হাতটা ভেঙে গেছে। কোমরে হাঁটুতে ভয়ংকর চোট লেগেছে । খাদে পড়ার আগে আটকে গেছিলাম একটা বড় পাথরে। মাথা ফেটে রক্তারক্তি অবস্থা । দেখি 'লোকটা' আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে । আমার গাড়িতে থাকা সহযাত্রীরা সবাই আহত। না কেউ মরে নি । তবে আমার আঘাত গুরুতর।পার্থ রা সবাই ঠিকই আছে। পার্থ নাকি কি কাজে কলকাতায় ফিরে গেছে। আমার থেকে ইম্পর্টেন্ট সেই কাজ ?আমি অজানা জায়গার একটা অজানা নার্সিংহোমে মরছি আর পার্থ? সেই প্রথম পার্থ কে ঘৃণা হলো আমার । দেখি লোকটা তখনো পায়ের কাছে বসে কাঁদছে । এই প্রথম লোকটার প্রতি মায়া হলো আমার। প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও অদ্ভূত এক ভালোলাগায় ভরে গেল মনটা । গোঙাতে  গোঙাতে লোকটাকে বললাম, 
-তোমার অফিস? 

ও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল- চুলোয় যাক । 

আজ এক বছর হতে যায় লোকটা দিনরাত এক করে সেবা করেছে আমায়। আমিতো ডাকসাইটে সুন্দরী নিজের মুখটা দেখলে শিউরে উঠতাম । ক্ষতবিক্ষত। বাম চোখে দেখতে পেতাম না ঠিক করে । এই একটা বছর লোকটা কি করে নি আমার জন্য ?সারারাত না ঘুমিয়ে, সেবা করেছে ,রান্না করেছে, খাইয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে, ভরসা দিয়েছে ,বলেছে আমার  চোখ যদি না ঠিক হয় ও ওর চোখটা দিয়ে দেবে। বোবা দর্শকের মত নির্বাক অবাক আমি দেখেছি। লোকটাকে । আগে দু চোখে দেখতাম ঠিক দেখতে পেতাম না হয়তো। এখন এই এক বছরে এক চোখেও স্পষ্ট দেখছি লোকটাকে । ওই বসন্তের দাগ ওয়ালা কালো রংয়ের মুখে দুটো মায়াবী বড় বড় স্বপ্নীল চোখ ছিল যে কখনো দেখতেই পাইনি। আঙুলগুলো দৈত্যের মতো নয় ,লোহার মতোও শক্ত নয়। বরং মায়ের হাতের মত নরম।  চোখ দুটো  লোভ-লালসায় কামার্ত নয় স্নেহে আর্দ্র মমতায় সিক্ত। এই এক বছরে ওকে দেখেছি নির্বাক হয়ে। ওভারটাইম করে, পুরনো জমি-বাড়ি বেচে, নিজের শেষ সম্বল দিয়ে, পশুর মত পরিশ্রম করে ,বাড়িতে টিউশন করে, সেরা ডাক্তার বদ্যি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে লোকটা । অমানুষিক পরিশ্রম করে যত্নে ভালোবাসায় আমাকে সারিয়ে তুলেছে লোকটা। আমার 'লোকটা' । 

এক একটা রাতে শুধু যখন ঘুম ভেঙে যেত ,দেখেছি আমার পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে লোকটা । রাতে উঠে দেখছে আমার চাদর ঠিক আছে কিনা । আমার যন্ত্রণা হচ্ছে কিনা । আমার গালে কাটার ওষুধ লাগাতে লাগাতে দেখি আমার লোকটার  চোখ ও ভিজে ভিজে উঠছে। 

আজ আমি পুরোপুরি সুস্থ। শরীরে- মনে ।লোকটার মনে ছিল । সকালে অফিস যাওয়ার আগে বলল- তোমার কবে ডিভোর্স লাগবে বল। এখন শরীর ঠিক হয়ে গেছে। পার্থর উপরে  রাগ করে থেকো না। কথা বোলো ফোনে । আর ডিভোর্সের ব্যাপারে কবে যাবে আমার সাথে ?

আমি লোকটাকে বললাম- তুমি আজ অফিস থেকে ফিরে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। 

আমার জীবন মৃত্যু টানাটানিতে পার্থ খোঁজ নেয়নি একদিনের জন্য। কে পার্থ?কেউ না।

আমি আমার 'লোকটা'কে ছাড়া আর যে থাকতেই পারবো না । বরাবর আমার জন্য চকলেট ফুল কিনে এনেছে সে আজ আমি অনেক গোলাপ কিনব, অনেক চকলেট ,শুধু ওর জন্য । গোলাপের পাপড়ি, মোমবাতি দিয়ে ঘর সাজাবো। বিছানা সাজাবো। নতুন একটা শাড়িতে খুব সুন্দর করে সাজবো । এতদিন ভাবতাম এমন কালো রঙের কুৎসিত মুখ ঘিরে বসন্তের দাগ আর আমি এদিকে ডাকসাইটে সুন্দরী কি করে মেনে নেব বলতে পারেন? এখন আর ভাবি না সত্যি। সত্যি ভাবি না। 

এই বসন্তের দাগ ওয়ালা মানুষটা এভাবে আমার মনে ভালোবাসার দাগ কেটে যাবে ভাবতেই পারিনি । 

আজ  অফিস থেকে ফিরলে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলব ---ভালবাসি । 
ওর মায়াভরা নরম স্নেহের হাত দুখানি তুলে আমার দু গালে এনে রাখবো।
আবারো বলবো- ভালোবাসি ভালোবাসি । 

আজ হোক আমাদের সত্তিকারের ফুলশয্যা । মুখের বসন্তের দাগ ওয়ালা 'লোকটা'র ঠোটের -আঙ্গুলের -হাতের আদরের দাগ সারা গায়ে মাখবো আজ সারারাত
আর সারাটা জীবন। 

সত্যি ঐ কালো মুখ ওয়ালা লোকটা,মুখ জুড়ে বসন্তের দাগ ওয়ালা মানুষটা ,এভাবে আমার মনে কখন ভালোবাসার এমন গভীর দাগ কেটে যাবে ,
বুঝতেই পারিনি । 
রচনাকাল : ১৬/১১/২০১৯
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Canada : 81  China : 14  France : 1  Germany : 7  Hungary : 1  Iceland : 1  India : 378  Ireland : 24  Russian Federat : 4  
Saudi Arabia : 3  Sweden : 9  Ukraine : 30  United States : 411  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Canada : 81  China : 14  France : 1  
Germany : 7  Hungary : 1  Iceland : 1  India : 378  
Ireland : 24  Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 3  Sweden : 9  
Ukraine : 30  United States : 411  
লেখিকা পরিচিতি -
                          স্বাগতা সরকার ২রা মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪-পরগণা জেলাস্থিত বিখ্যাত জয়নগর শহরের মাজিলপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।

বর্তমানে তিনি প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে পাঠরতা। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আবৃত্তিতে, শ্রুতিনাটকে, সঙ্গীতে, চিত্রাঙ্কনে তিনি সমানভাবে পারদর্শীনী। তার লেখা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে যেমন কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, শ্রুতিনাটক ইত্যাদিতে এনার লেখনীর পারদর্শীতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিভিন্ন অনলাইন পত্র-পত্রিকাতেও লেখালেখি করেন। 
                          
  • ৯ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা (১০২)

    ২০১৯ , নভেম্বর


© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
দাগ by Swagata Sarkar is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৬৪০০
fingerprintLogin account_circleSignup