ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকটা আকস্মিকভাবেই সেদিন। তাই সাবধান হ’তে পারেনি কাকু বা আমি কেউই ।
হয়তো অসাবধানতা ও ছিলো একটু আমাদের। ফলে বেশ হেনস্থা ও হয়েছিল আমাদের।
আর তারপরেই আমার বাপী আমার সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়।
ব্যাপারটা একটু আমি খুলেই বলি।
আমি যে চঞ্চল তা মনে হয় আর বলে দিতে হবে না।
ছত্রিশগড় রাজ্যটা যে নক্সালদের ডেরা সে তো সবাই জানে। আমার বাপীর তো আবার পুলিশের চাকরী।
তাও আবার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে। তখন ও বাপী ডি০সি০ডি০ডি০ হয় নি।
তাই প্রায়ই যেতে হ’তো সেই বিপদজনক রাজ্যে সেনাদের সাথে সাহায্যের জন্য।
কাকুর সঙ্গে সেবার আমি ও গিয়েছিলাম। অবশ্য যেখানে এনকাউন্টার হয় সে’খানে যাই নি আমরা।
সম্ভব ও ছিল না যেতে পারা, তবে বনপথে অনেকটা পথ বেড়াবার নামে সঙ্গে গিয়েছিলাম।
কিন্তু হঠাৎ রেড সিগন্যাল আসতে ফিরতে হয় আমাদের। কেননা কাছেই কোথাও আস্তানা ছিল উগ্রপন্থিদের।
তা আমি ফিরে আসবার আগে বাপীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে এ’খানে তো দেখছি টাওয়ার নেই,
সেল ফোন তো এ’খানে অচল তবে সিগন্যাল আসছে কি করে?
বাপী গম্ভীরভাবে শুধু বলেছিল-‘স্যাটেলাইটের মাধ্যমে’।
‘তবে তো নক্সালদের ও সেইরকম কিছু উন্নত মানের ব্যবস্থা অবশ্য আছে পরষ্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য।
আক্রমনের আগে সেই ব্যবস্থাটা অকেজো করা বা জ্যাম করা যায় না, বাপী?’
আমার কথা শুনে বাপী অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মিনিটখানেক সময় প্রায় আর
তারপরে এগিয়ে এসে কাকুর মতন আদর করতে শুরু করলো।
তখন আমার যা লজ্জা করছিলো না, সে আর কি বলবো।
আমার যে তেরো বছর বয়স কবে পুরো হয়ে গেছে, সে’কথা যেন বাপীর মনেই থাকে না নইলে
কেউ সবার সামনে এইভাবে ….ছিঃ…
তা বাপী ততক্ষনে আমার একটা দুধসাদা হাত কাকুর হাতে দিয়ে বলেছিল-‘সিদ্ধার্থ, এ’টা বিরাট একটা
স্ট্র্যাটেজিক ফল্ট ছিল আমাদের প্ল্যানে। চঞ্চল ভাগ্যে বলে ফেলল, নইলে আমাদের অনেক ক্ষতি হ’তো।
তা তুই এখন এই পরীর দেশের সুন্দর ছেলেটাকে নিয়ে ফিরে যা। কেননা জানিস তো যে সরষের মধ্যেই ভূত থাকে।
ফলে চঞ্চলের বিপদ হ’তেই পারে খুব। আমি কম্যান্ডারকে গিয়ে বলছি যে আগে সিগন্যাল সিস্টেম
জ্যামিংয়ের ব্যবস্থা করে তবে এনকাউন্টার শুরু হবে। এখন নয়’।
কাকু সাবধানে আমাকে নিয়ে ফিরে এলো।
সে’যাত্রা কিন্তু টানা তিন ঘন্টার এনকাউন্টারে পুলিশ ও সেনার জয় হয়েছিল আর দশজন উগ্রপন্থী নিহত ও
পনেরো জন বন্দী হয়। সে এক বিরাট সাফল্য। বাপী বন্দীদের নিয়ে দিল্লী চলে গেল আর কাকু আমাকে
নিয়ে বেড়াতে গেল রাজপুরে।
রাজপুর কিন্তু বেশ বাজে জংলা জায়গা।
একটা লজ পেয়ে সেখানে ওঠা গেল তবে দেখার মতন কিছু নেই। দশমাইল দূরে একটা জলপ্রপাত আছে
না কী আর সেখান থেকে মাইল দুই হাঁটা পথে গেলে একটা মন্দির আছে রুদ্রনাথের। একজন সাধুর আস্তানা ও আছে।
এইসব দেখতে বাসে উঠলো কাকু।
প্রায় মাইল তিরিশের বাসভ্রমণ।
তা যাবার সময় সর্টকাটে বাস গেল। সেই পথে জলপ্রপাত পড়লো না তখন। পড়লো পান্ডবগুহা।
সেই গুহা দেখে সোজা রুদ্রনাথ।
শিব ঠাকুরের দর্শন ও পূজো দিয়ে ফেরবার পথে সেই সাধুর আশ্রম ও দেখতে গেলুম আমরা। তা দেখা
গেল যে তিনি এক্কেবারে মৌনীবাবা। কথা ও বললেন না কারোর সাথে আর সকলের আনা ফল মূল
দক্ষিণার দিকে ও ফিরে চাইলেন না। শুধু হাত তুলে আশীর্বাদ দেওয়া ছাড়া তিনি আর কিচ্ছুটি
করলেন না, যদি ও দেখা গেল যে তখন তিনি ধ্যানস্থ নন।
তাই দেখে কাকু তো বেশ হতাশ হলো আর সবাই খুব বিরক্ত। সাধু মানুষ কোথায় একটু ভাগ্য টাগ্য বিচার
করে বা হাত টাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দেবেন তবে না। তা নয় শুধু দর্শন করে কি হবে?
সব শেষে কাকুর পরেই আমি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম। তিনি একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে
খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে কম্বলের আসনের নীচে থেকে কিছু বার করে আমার হাতে দিলেন।
আমি ফিরতেই কাকু বললো-‘দেখি, দেখি কি আশীর্বাদী দিলো সাধু? আর সবার ভাগ্যেই তো দেখি ঢুঁ ঢুঁ।
হুঁ হুঁ বাবা। কথায় আছে না যে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। যতই সাধু হও না কেন বাবা,পরীর দেশের
রাজকুমার অপরূপ সুন্দর এই ছেলের কাছে সবাই জব্দ। হয়তো বা মেয়েই ভেবেছে। নিশ্চয়ই মোহর
টোহর কিছু দিয়েছে একটা হাতে, ঘরে রাখলেই কোটিপতি। দেখি… তো’
আমি হাতের মুঠো খুললুম। আমার গোলাপী করতলের জিনিষটা দেখেই কাকু বলল-‘আরে….এ আবার কি? অ
্যাঁ? সাধু এই একটুকরো পুরনো পেন্সিল দিয়েছেন না কী আশীর্বাদী? আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ।
যত্ত সব পাগলের কান্ড। সাধু না ছাই । ফেলে দে দূর করে…’।
আমার কিন্তু জিনিষটা খুব খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলছি। বড়রা সবাই যেন কেমন ধারা হয়। তাই না?
সবসময় তারা খালি টাকার কথাই ভাবে। আর সব কিছুই যেন তাদের কাছে আজে বাজে আর অর্থহীন বলে মনে হয়।
আমি কিন্তু দেখে নিয়েছি যে পেন্সিলটা এইচ বি নয়। ড্রয়িং পেন্সিল। মনে হয় ৪বি বা ৬বি পেন্সিল।
ইঞ্চি চারেক লম্বা হবে প্রায়। বেশ মোটামতন নরম কালো শীষ ও আছে। আমার যে খুব শখ ছবি আঁকার,
মৌনীবাবা সে কথা ঠিক বুঝে নিয়ে দারুণ একটা পেন্সিল আমাকে দিয়েছেন। কাগজ থাকলে তক্ষুনি ছবি আঁকতে বসতুম আমি।
তা আর হয়ে উঠলো না। ফিরে এসে বাসে উঠলুম সবাই।
পথে দুপুরে একটা ঢাবায় সবাই খেয়ে নিলুম আমরা । দেড় ঘন্টা পরে আবার ছুটলো আমাদের বাস।
এপ্রেল মাস। সে’খানে তখনই বেশ গরম। আমার তো বাসের ধূলো আর ধোঁয়ায় আর ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল
সেই গরমে। বিকেল তিনটের পরে বাস এসে থামলো জলপ্রপাতের ধারে। তার নাম অবশ্য কেউ বলতে
পারলো না, তবে অনেকেই চান করতে নেমে পড়লো গরম কাটাতে। আমার বয়সী যারা ছিল তারা সবাই
তো বটেই বড়রাও অনেকেই বাদ গেলেন না।
সঙ্গে তোয়ালে নেই বলে দু’টো প্রায় বছর তেরো বা চৌদ্দোর বেশ ফর্সামতন ছেলে পরনের জামাপ্যান্ট
সমস্ত খুলে রেখে দিয়ে দিব্যি ঝর্ণায় নেমে পড়লো।
তাই দেখে আমি বললুম-‘কাকু, চান করবে?’
কাকু হেসে বললো-‘ওই ওদের মতন করে? অন্য পথ তো নেই। নেমে পড় তুমি ও ঝর্ণায় চান করতে হ’লে’।
লজ্জা পেয়ে আমি জিভ বার করে বললুম-‘এ্যাই ছিঃ কাকু….এত্তো বড়ো ছেলে হয়ে সব্বার সামনে?…যাঃ…’
হাসতে হাসতে কাকু বলল-‘তবে আর কি করা, চঞ্চল? কিন্তু দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে যে ওই ছেলে দু’টোর
কেউই তোমার চেয়ে বয়সে ছোট নয় মোটেই। তা চলো আমরা হাত মুখ ধুয়ে নিই চোখেমুখে জল দিয়ে
আর জলপ্রপাতের ছবি ও তুলে নিই মোবাইলে। এ’যাত্রায় এই লাভ’
বাস আবার রওনা হ’ল একঘন্টা পরে।
কিন্তু ভাগ্য মন্দ।
রাজপুরের মাইল চারেক আগে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
হঠাৎ করে বন্দুকের গুলী চলার মতন একটা জোর শব্দ হ’ল বাইরে আর বাসটা ঝপাং করে একদিকে
নীচু হয়ে এঁকে বেঁকে ছুটে গিয়ে দমাস করে একটা গাছের গায়ে ধাক্কা মারলো। অনেকের মাথায় গায়ে
বেশ চোট ও লাগলো। আমি কিন্তু বেঁচে গেলাম দৈবযোগে বা কাকুযোগে ও বলা যায়।
দিনভোর গরমে আর বাসের ঝাঁকুনিতে আমি একদম ক্লান্ত হয়ে পড়েছি দেখে কাকু তখন আমাকে
নিজের কোলের ওপরে আড় করে শুইয়ে রেখেছিল আর আমার বুকে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসেছিল।
হয়তো কাকুর ও শরীর অস্থির করছিল গরমে।
কি হয়েছে? না বাসের টায়ার পাংচার আর সঙ্গে বাড়তি কোন টায়ার ও নেই জানা গেল। আশেপাশে
গ্যারাজ তো নেইই, জনবসতি ও নেই কোন।
ফলে আমাদের বাস যাত্রার সে’খানেই ইতি হয়ে গেল।
অন্য যাত্রিদের দেখি তা’তে ও কিছু আসে যায় না। সব নেমে পড়ে যে যার বোঁচকা বুঁচকি হাতে আর
মাথায় তুলে নিয়ে সড়ক ছেড়ে পাকদন্ডি বা পায়ে চলা পথ ধরলো। বোঝা গেল যে তারা নিজেদের গ্রামে চললো যে যার।
এখন মুশ্কিল এই হ’ল যে আমরা কি করি? পথ ও চিনি না। শুনে সেই ছেলে দু’টোর অভিভাবক সঙ্গে
এসে একটা পথ দেখিয়ে দিয়ে বললেন-‘এই পথে চলে যান। সর্টকাটে পৌঁছে যাবেন মাইল আড়াই গেলেই।
তবে সন্ধ্যে করবেন না, বিপদ হতে পারে’।
এইবার আসল অভিযান শুরু হ’ল আমাদের।
জনমানব বিহীন রুক্ষ নিস্তব্ধ পথ। লালচে মতন ধূলোয় ভর্তি। দূরে দূরে কয়েকটা গাছ আছে বটে কিন্তু
ধারে কাছে সব ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ আর তার মাঝে উঁচু নীচু এবড়ো খেবড়ো সরু পায়ে চলা পথ।
সে পথে খানিকটা হাঁটলেই জুতোর তলায় কাঁকর ফুটে বেশ ব্যথা করে দারুণ। আর আমরা হাঁটছি তো
হাঁটছিই। সে পথ ও আর ফুরোয় না। পায়ের ব্যথায় শেষে আর চলতে ও আমি তখন পারি না ।
কাকুকে বলতে ও আমার লজ্জা করছে।
তা কাকুই হঠাৎ বললো-‘পা ব্যথা করছে চঞ্চল? তা আমাকে বলবে তো’।
কাকু তৎক্ষণাৎ নীচু হয়ে আমাকে বাপীর মতন করে জড়িয়ে ধরে টেনে নিজের কোলে তুলে নিলো।
আমি কিচ্ছুটি বললুম না কাকুকে।
এ’খানে আর কে দেখছে যে এত বড় ছেলে হয়ে আমি কাকুর কোলে উঠে যাচ্ছি।
অন্য লোকজন কেউ থাকলে আর দেখলে তো আমার লজ্জা করবে?
তবে আমার কাজ নেই কিছুই তো তখন আর। করি কী?
কি মনে হ’তে প্যান্টের পকেট থেকে সেই পুরণো পেন্সিলটাই বার করলুম আমি ডান হাত দিয়ে।
বাঁ হাত দিয়ে কাকুর গলা জড়িয়ে ধরে রেখে ছিলুম আমি। তাই ডান হাত দিয়ে ছবি আঁকব ঠিক করলুম আমি।
তা কাগজই তো নেই, ছবি আঁকবোটা কিসের ওপরে?
তাই তখন নিজের দুধসাদা বাঁ হাতটাকেই কাগজ বানিয়ে নিয়ে হাতের তালু খুলে আঙুলের প্রতি পর্বে
একটা করে কালো ভ্রমর আঁকা শুরু করলুম। মোট পনেরোটা বড় বড় হুলওয়ালা ভোমরা এঁকে ফেললুম
আমি আগে। যা মনে এলো তাই আঁকলুম আর কি।
হারপরে হাতের গোলাপী তালুতে দু’টো বেঁজী ও এঁকে ফেললুম বড় বড় দাঁতওয়ালা।
কাকু দু’হাত এক করে অতক্ষণ ধরে একমনে আমি কি করছি, তাই দেখবে বলে পথের একটা বাঁকের
মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার বাঁ হাতটাকে ধরে টেনে নিয়ে দেখেই হেসে ফেলল।
বলল-‘এই না হলে আর বাচ্ছার কান্ড?’
কাকু বলুক গিয়ে। বলতেই পারে। কাকুর কাছে তো মনে হয় আমার ১৬ কি ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে ও সেই বাচ্ছাই থাকব।
আমি বাঁ হাতের মণিবন্ধের ওপরের দিকে মৌমাছি ও ততক্ষনে এঁকে ফেলেছি গোটা দশেক।
কিন্তু অবাক কান্ড এই যে সেই পেন্সিলের দাগ দেখি হাত থেকে সহজে উঠছেও না। আঁকতে গিয়ে
একটুখানি ভূল হ’লে মিটিয়ে ঠিক করা ভীষণ মুশ্কিল। ভিজে ন্যাতা না হ’লে হবেই না সে’কাজ।
তাই খুব সাবধানে আঁকছিলুম আমি।
কাকু আবার চলতে শুরু করলো কিন্তু সেই বাঁকের মুখে দু’টো গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ জোর হৈ হৈ শব্দ
শুনে থমকে দাঁড়ালো আবার আর আমাকে আস্তে করে নীচে নামিয়ে দিলো।
আমাদের এ’দিকে কোন গাছ ও নেই। খোলা মাঠ। কোথাও গা ঢাকা দেওয়া অসম্ভব।
আর আমরা তো একদম নিরস্ত্র।
দেখতে দেখতে পাঁচ ছ’জন বিকট দর্শন কালো মতন লোক আধুনিক আগ্নেয় অস্ত্র হাতে নিয়ে বাঁক
ঘুরলো আর আমাদের দেখতে পেয়েই হৈ হৈ করে দৌড়ে এসে ঘিরে ধরলো।
অগ্রগামী লোকটাই হয়তো সেই ডাকাত বা উগ্রবাদী দলের সর্দার। সে বিকট চিৎকার করে কাকুর বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে ধরলো।
‘হাত তোল…..’।
আমরা বাধ্য হয়ে দু’হাত তুলে দাঁড়ালুম।
লোকটা আরো এগিয়ে এসে কাকুর গালে ঠাস করে এক চড় মারলো।
তারপরে কাকুকে সার্চ করে পকেট থেকে পার্স, কলম, পরিচয় পত্র এমন কি চশমা, হাতের আংটি, ঘড়ি,
রুমাল সব কিছুই কেড়ে নিল। কাকুর সব জামা কাপড় ও পকেট সার্চ করে সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই দেখে ঠেলে দিলো একদিকে,কাকুকে।
কাকুর পরে আমার পালা।
চারটে বন্দুক আমাদের দিকে তাক করে রইলো আর সর্দার এগিয়ে এসে আমার বুকের কাছে জামাটা
মুঠো করে টেনে ধরে আমাকে হিড় হিড় করে কাছে টেনে নিতেই দু’টো বোতাম পট পট করে ছিঁড়ে গেলো
আমার দামী জামাটার।
সে পকেট থেকে আমার পার্সটা ও বার করে নিলো। তারপর তার নজর গেল জামার খোলা বুকের ভেতর
আমার গলার সোনার চেনটার দিকে। আর যায় কোথায়? ভীষণ লোভে তার চোখ দু’টো বাঘের মতন
জ্বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে একটানে সে সেটা ও টেনে ছিঁড়ে নিলো। আমি ব্যথায় উঃ করে উঠলুম।
কে শুনছে? উল্টে সে বলল-‘শালেকে কপড়ে উতারকর তো দেখ, আউর ভি কুছ কীমতি মাল হ্যায় ক্যা’।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ডাকাত এগিয়ে এলো।
একজন আমার হাত ধরে রইলো আর অন্যজন শার্টের বাকী বোতাম গুলো খুলতে শুরু করলো।
আমি মানা করলে ও শুনতে তাদের বড় বয়েই গিয়েছে।
তারপরে একে একে জোর করে আমার হাত বেঁকিয়ে ধরে শার্টটাকে খুলে মাটিতে ফেলে দিয়েই তারা
আমার প্যান্টের হুক আর জীপার নিয়ে টানাটানি শুরু করলো।
আমি তখন অসহায় লজ্জায় ……..‘এই না না ….প্লীজ, আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা আংকল’ ….
এই বলে অনেক কাকুতি মিনতি করলুম। কাকুও অনেক করে বললো। কিন্তু কে শোনে সে সব কথা।
বন্দুক যার দুনিয়া তার নীতি তখন তাদের।
আমার দামী প্যান্টটা খুলে ফেলে দিয়ে ডাকাত দু’জন তারপরে আমার গেন্জিটা ও টেনে তুলতেই
আমার কোমরের সোনার দামী মেখলাটা দেখে ফেলে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো। সে’টায় এক
জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী একটা দামী সবুজ পাথর বসানো ছিল। সবসময় আমাকে সেই পাথরটা
পরে থাকতে হবে বলে মা এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই কারণে আর ও তখন আমার ঝর্ণায় নামা হয় নি ।
কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে।
একটানে সর্দার সেই মেখলাটাও টেনে ছিঁড়ে নিতে গেল। কিন্তু চেনটা মোটা বলে সেটা ছিঁড়লো না।
আমি এ’বার ব্যথায় খুব জোরে আর্তনাদ করে উঠলুম।
তখন সে বলল-‘শালার গেন্জী খোল তবে বার করা যাবে। বহৎু কীমতী মাল বে’।
কিন্তু গেন্জী খুলেও ওপর দিকে টেনে মেখলাটা খুলতে পারল না। আমার হাতে আটকে গেল
দেখে সর্দার দু’হাতে সেটাকে ধরে নীচে টেনে নামাতে শুরু করল।
কিন্তু তখন আমার অন্তঃবাসের ইল্যাস্টিকে জড়িয়ে আবার মেখলাটা শক্ত হয়ে আটকে গেল।
বার বার অসফল হয়ে ভীষণ রেগে গিয়ে সর্দার তখন পুরো গায়ের জোর দিয়ে টানতে টানতে
সবশুদ্ধ খুলে নিলো। আর তাই না দেখে ডাকাতগুলো সব্বাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলো
একজন তখনি এগিয়ে এসে আমার দুটো হাতই মুচড়ে টেনে ধরে একসাথে পিছমোড়া করে শক্ত
করে বেঁধে দিলো।
মুখে বলল--‘শালে বদমাস লৌন্ডে, তু কুছ দের রুক যা। ফির তুঝে পতা লগেগা কি হমলোগ ক্যা চীজ হ্যায়’।
সর্দার তখন মেখলাটা ছাড়াতে ব্যস্ত। আমার দিকে তার নজর নেই নইলে হয়তো সেও অট্টহাসি
হাসতে শুরু করতো। তখন আমি কাঁদতে লাগলুম। কেউ তা’তে ও তারা কান দিলো না।
একজন ডাকাত এসে সর্দারের কানে কি যেন বলতেই সে মুখ তুলে বলল-‘কি? এই সেই জাসুসের ছেলে?
কি প্রমাণ? তবে ছেলেটা তো দেখছি খুবই সুন্দর, তাই আমাদের কাজে লাগবেই। এইবারে চল সবাই।
শালেকো সাথ নিয়ে চল। আর দেরী নয়…’।
বলেই সে আমার মেখলাটা নিজের পকেটে পুরে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আমার সব জামা
প্যান্ট তুলে নিয়ে কাকুর মুখে ছুঁড়ে মেরে হিংস্র গলায় বলল-‘মাত্র এই পোষাক গুলো তুই এখন রাখতে পারিস, শালে।
তবে কৌনো কীমতেই এই দারুণ সুন্দর ছেলেটাকে তুই আজ ফেরৎ পাবি না’।
‘নেহাৎ যদি ওয়াপস নিতেই চাস তবে মাত্র বিশ লাখ নিয়ে কাল একলা এ’খানে চলে আসবি এইসময়ে।
পুলিশ শালে লোগদের জানাবি না। আর তার বেশী দেরী করলে তোর ছেলে যে টিঁকে মানে বেঁচে থাকবে
সে আশা ও তুই একদম ভুলে ও করিস না। এখন যা তুই। তোকে যে ছেড়ে দিলাম, এই না কতো? হাফেজ
সর্দারের হাতে পড়ে বেঁচে ফেরা হচ্ছে অসম্ভব কথা। তা জানিস বে,শালে? তোর ভাগ্যের জোর আছে,
শালে তা আমাকে মানতেই হবে’। …
‘যাঃ, …নিয়ে আয় গিয়ে টাকা…’
কাকুর অনুরোধ উপরোধ, আমার কান্না আর সব প্রতিরোধ উপেক্ষা করে ঘাড় ধরে আমাকে হিড়
হিড় করে টেনে নিয়ে চললো সর্দার।
আর ঠিক তখনি সে বিকট চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো হঠাৎ কোলাব্যাঙের মতন।।
দেখা গেল যে হঠাৎ কোথা থেকে গোটা দশ পনেরো কালো ভোমরা এসে তাকে ছেঁকে ধরেছে তখন।
অন্য সবাই ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া হুক্কা হুয়া গোছের চিৎকার করে ছুটে আসতেই তাদের ওপরে
ও তৎক্ষণাৎ এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো গোটা কয়েক কালচে মতন ভীমরুল বা মৌমাছি।
দেখতে দেখতে বড় বিচ্ছিরি কান্ড শুরু হয়ে গেল তখন সে’খানে।
বন্দুক পিস্তল ছোরা ছুরী কিছু দিয়েই যে তাদের মারা যায় না।
ডাকাতদের চিৎকার আর্তনাদে বদলে গেল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
ডাকাতরা ছুটে পালাবার চেষ্টা করতে গেল এইবার বেগতিক বুঝে আর ঠিক তখনই বড় বড় তীক্ষ্ন
দাঁতওলা দু’টো সাংঘাতিক বেঁজি ও এসে জুটলো কোথা থেকে কে জানে।
তাদের কামড়ে দেখতে দেখতে সব ক’টা ডাকাত মাটিতে পড়ে যন্ত্রনায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো
আর তার পরেই অজ্ঞান হয়ে গেল একে একে।
কাকু তখন এগিয়ে এসে সর্দারের পকেট থেকে আমাদের কেড়ে নেওয়া সব জিনিষগুলো একে একে
আগে উদ্ধার করলো। তারপর কাকু আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আমার বাঁ হাতের তালু ও হাতটা
বেশ ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলো। আমি ও দেখলুম। তখন কিন্তু আমার দুধবরণ নরম বাঁ হাতটা
একদম পরিষ্কার ঝকঝক করছে। কোথাও কোন ছবি বা কালো পেন্সিলের একটা দাগ বা তার আভাষ
মাত্র ও নেই কোন। এ কী আশ্চর্য কান্ড? কি করেই বা এমন ব্যাপার হ’লো ভগবান জানেন।
কাকু কিন্তু একে একে আমার দু’টো হাতই পরীক্ষা করলো। তারপরে আমার হাতে মালিশ করে রক্ত
সঞ্চালন ঠিক করতে শুরু করলো। আমার হাতে তখন বেশ ব্যথা করছিলো শক্ত বাঁধনের জন্য।
সেই ব্যথা একটু কমতে তখন কাকু প্রথমে এক এক করে সব পোষাকগুলো আবার আমাকে পরিয়ে
দিতেই আমি আগে ছুটে গিয়ে দূরে ছিটকে পড়ে থাকা সেই পুরোনো পেন্সিলটা কুড়িয়ে এনে প্যান্টের
পকেটে রেখে দিলুম।
তারপরে বললুম-‘কাকু, এইবারে চলো এ’খান থেকে তুমি তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যার অন্ধকার হয়ে
আসছে কিন্তু। অন্ধকারে এদের মতনই কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার ও বেরোনো বিচিত্র নয় এই সব জায়গায়’।
কাকু আবার নীচু হয়ে আমাকে দু’হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে নিয়ে জোরে পা চালিয়ে দিলো।
বেশ কিছুটা যাবার পরে অনেক দূরে টাউনের আলোক মালা দেখা গেল।
তখন একটু নিশ্চিন্ত হয়ে কাকু আমাকে খুব খানিক আদর করে নিয়ে বললো—‘চঞ্চল সোনা, তোমার ধরা
ডাকাতগুলো ওই খানেই এখন যেমন পড়ে আছে, তাই থাক। ফিরে গিয়ে থানায় খবর দিলেই পুলিশে এসে
তাদের অতিথি শালায় সহজেই ওদের সবকটাকে নিয়ে যেতে পারবে বলে আমার মনে হয়। কেননা
অন্তত দু’ তিন তো ওরা আর সহজে উঠে দাঁড়াতে ও পারবে বলে মনে হচ্ছে না’।
‘আর লোকাল পুলিশ কষ্ট করে রাতে এ’খানে আসতে গা না করলে তখন না হয় লজে গিয়ে দাদাকেই
ফোন করতে হবে। হাফেজ সর্দারের মাথার ওপরে মনে হয় গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে আর তার জন্য
পুরষ্কার ও বড় কম আছে বলে মনে হয় না আমার। অনেক ডাকাতী আর খুন করেছে তো। আজ অবধি
কেউ টিকি ও ছুঁতে পারেনি, গ্রেফতার করা তো দূরের কথা। ওর নামটা আগে পুলিশকে আমি জানাবই না।
দাদাকে বলবো আর দাদা যে পুলিশের গ্রেডের ডবল প্রমোশান পেয়ে যাবে তা কিন্তু নির্ঘাৎ করে কথা।
ঠেকায় কে? তারই ছেলের কীর্তি বলে কথা যে’।
‘তবে ও যাই বলে থাক না কেন একটু আগে, আমার চঞ্চল কুমার এই অসম লড়াইয়ে ও কালকের পরে
ও টিঁকে ঠিক থাকবে কিন্তু ওই পাজী হাফেজ সর্দারটা এখন নিজেই টিঁকলে হয়। অনেক অনেক কামড়
খেয়েছে তো। এই সব কীট পতঙ্গ বিশেষ করে কালো ভোমরার যা ভয়ানক বিষ হয় না…..’।
‘বেশী কামড়ালে এক্কেবারে জীবন মরণ সমস্যা হয়ে পড়ে। অন্য ডাকাতগুলোর কেউ কেউ অন্ধ বা
বিকলাঙ্গ ও হয়ে যেতে পারে। মোটকথা ডাকাতী করা ওদের ইহ জীবনের মতন শেষ। দেখা যাক, মায়ের কি ইচ্ছা’।
রচনাকাল : ২০/৭/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।