নির্জীবের দায়িত্ববোধ
জি০ সি0 ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
সে দিন আমার পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ সুন্দর তেরো বছরের ভাইপো চঞ্চলকে সন্ধ্যাবেলায় বসে বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলাম আমি।
বিষয় ছিল নির্জীব ও সজীব পদার্থ।
সজীবের লক্ষণই হল শ্বসন, পোষণ, বৃদ্ধি বা বর্ধন, পুর্নজনন ইত্যাদি…নির্জীব জড় পদার্থের এইসব গুণ নেই। অনেক নির্জীব পদার্থ ও জড় নয়। যেমন গাড়ী আবার অনেক জড় পদার্থ ও সজীব যেমন গাছ। আবার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়ে দিয়েছেন যে নির্জীব পদার্থ ও সজীবের মতনই ব্যবহার করে বা রিঅ্যাক্ট করে। তবে তফাৎ কোথায়? তফাৎ বোধক্ষমতায়। গাছ নির্জীব নয় কিন্তু অন্য সব নির্জীব পদার্থের বোধ নেই। মানে তারা হলো নির্বোধ।
অপরূপ সুন্দর দুধবরণ ছেলেটা পদ্মপত্রের মতন টানা টানা চোখদুটো আরও বড় বড় করে আমার কথা শুনছিল।
আমি বললুম-‘দেখ চঞ্চল, আবার মানুষ এবং অন্য জীব জন্তু দুই সজীব হলে ও তাদের মধ্যে কিন্তু বৈশিষ্টের প্রভেদ আছে। অনেক গুণ তাদের কিন্তু আলাদা। মানুষ সুন্দর বা অসুন্দরের বিচার করে অন্য জীবেরা করেই না। অর্থাৎ তাদের কিন্তু সৌন্দর্যবোধ হীন বলা চলে। চন্ডীতে আছে যা দেবী সর্বভূতেষু লজ্জা রূপেণ সংস্থিতা…এখানে সর্বভূত কিন্তু সর্ব জীব নয় সব মানুষই। জীব জন্তুর কি লজ্জা করে? মোটেই না। লজ্জা ও হলো মানুষের একচেটিয়া অনুভূতি। কি চঞ্চল, আমি ঠিক বলছি তো?’
আজ যেমন আমার কার্তিক ঠাকুর দুধের বরণ ছেলে চঞ্চলকে বিকেলে তার স্কুল ড্রেস বদলে ঘরের পোষাক হিসেবে একটা দামী নরম বিদেশী গোলাপী কাপড়ের খুব সুন্দর ঝকঝকে ছোটদের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে ছিলাম। ড্রেসটা দাদার আমদানী। খুব সুন্দর পোষাক তবে কিনা একটু দোষ ও ছিল ড্রেসটার। সম্পূর্ণ পারদর্শী কাপড়ে তৈরী। তাই পরাতেই চঞ্চল এত্তবড় জিভ বার করে বলে দিয়ে ছিল-‘এ মা কাকু ছিঃ… এই তোমার দামী আর ভালো ড্রেস না কী? বাপী ও না …যাঃ, আমি কিন্তু পরবই না কাকু এই ড্রেস। আমি বুঝি বড় হইনি না? আমার বুঝি লজ্জা করে না’।
দেখা গেল যে বেশ আপত্তি ছেলের।
দেখে শুনে বাধ্য হয়ে খানিক পরে ছেলেটাকে একটা গোলাপী রঙেরই জাঙিয়া অন্তত এনে পরাতেই হয়েছিল আমাকে।
চঞ্চল বলল –‘কাকু, লজ্জা না করুক, দায়িত্ববোধ কিন্তু অন্য জীব যেমন কুকুরের ও তো আছে, তবে সে কি নির্বোধ?’
‘নাঃ, কুকুর তো সজীব প্রাণী তবে সে বোধ যদি নির্জীবের ও থাকে তাকে তখন তুমি কি বলবে?’
‘তুমি না কাকু সব দিলে গুলিয়ে। যার প্রাণ নেই তার তো মন ও নেই, বোধশক্তি কোথায় থাকবে তার?’
‘এই তো কান্ড বেশ। প্রাণ কি জিনিষ তা কি বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পেরেছে আজ ও। বড় জোর বলবে চেতনা বা চৈতন্যশক্তি তাহলে সেই শক্তি তো নির্জীবের ও থাকতে পারে। এই জগৎটাই তো চেতনাময়। ইলেক্ট্রন প্রোটনের গতি ও স্থিতি এই চেতনাশক্তি নির্জীবের মধ্যে ও জাগিয়ে তোলে। সুতরাং আমার এই সজীব সুন্দর ও সুকুমার ছেলে চঞ্চলের সাথে তার ছোট্টবেলাকার খেলনা রেলগাড়ীর তফাৎ কোথায়?
আর ও দেখ না, ছোটবেলায় কুমার চঞ্চলকে একদম কিছু না পরিয়ে রাখলে ও সে তো তখন আপত্তি করত না। তবে….? বোধ তো ক্রমবিকাশশীল।’
‘এই যাঃ কাকু, তুমি যেন কি? খালি দুষ্টুমি। তুমি নির্জীবের দায়িত্ববোধ আগে ব্যাখ্যা কর দেখি। এ তো হতেই পারে না।‘
‘কি হয় আর কি না হয় তা কিন্তু বলা খুব কঠিন, চঞ্চল। জীব শব্দটাই গোলমেলে বড়। জীব যদি জীবন সূচক হয় তবে মাত্র কোষবিভাজন থেকে জীব তৈরী হতে পারে কি? সে হতে পারে একটা টিউমার, একটা ছেলে বা মেয়ে তায় আবার দারুণ সুন্দর বা অসুন্দর তৈরী হয় কি করে? আর জীব যদি হয় আত্মবোধ শক্তি যাকে আত্মা ও বলা হয়, তবে তা নির্জীবে ও থাকতেই পারে। তার তো সর্বত্র অধিষ্ঠান সম্ভব। ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ হয় তাইতেই। সজীবের গুণ এ’গুলি তবে মাঝেমধ্যে নির্জীবের মধ্যে ও তার স্ফুরণ ঘটে যায়। …’
‘যথা…?’
‘অ্যাই সেরেছে,….উদাহরণের বদলে একটা গল্প শোনাব তোমাকে না হয় আজ চঞ্চল। আগে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট পাঠটি পড়ে ফেল তুমি, আর আমি এখন যাই রাতের জন্য আমাদের খাবার তৈরী করে ফেলি গিয়ে ততক্ষন। দিব্যি করে খেয়ে দেয়ে নিয়ে পাঠের বাইরের বিজ্ঞান আলোচনা করা যাবে তখন দু’জনে মিলে না হয়’।
অগত্যা তাই সই …তা সে ছেলের তর সইলে তো। খালি আমাকে তাড়া দেয়-- ‘ও কাকু, তোমার হয়েছে? আমি সব পড়ে ফেলেছি কিন্তু। তুমি এসে বল দেখি আমার এই সুন্দর পোষাকটা সজীব না নির্জীব?
আমি গিয়ে বললুম- ‘এই পোষাকের মধ্যে যে দারুণ সুন্দর মতন একটা ছেলে রয়েছে সে তো সজীব । আমি তাকে ধরে পোষাক থেকে টেনে বার করে নিই এইবার যদি তখন পোষাক নির্জীব ও জড় পদার্থ মাত্র। পড়ে থাকবে মাটিতে। এই দ্যাখ। ঠিক হয়েছে তো। থাকুক গিয়ে পড়ে’।
‘আর সজীব যখন তখন ছেলেটাকে কোলে নিয়ে একটু খাইয়েই দিই আমি এইবার। পোষাক কি খেতে পারবে? মোটেই না। বছর দুই তিন পরে এই ত্রয়োদশোত্তীর্ণ ছোট ছেলেটা আরও বড় হয়ে যাবে কিন্তু ও পোষাক তো আর বড় হবে না, তাই গায়ে ছোট হয়ে যাবে। এমন কি চঞ্চলের ছেলে ও হবে পরে, পোষাকের কি আর ছেলে বা মেয়ে হবে কখনো? মোটেই না। তাই সাধারণ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের মূল সূত্র গুলো ঠিক। তবে ভিন্ন পরিস্থিতির কথা আলাদা’।
তার মানে, কাকু?’
‘তার মানে চৈতনোন্মেষ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের বলেছিলেন –তোমাদের চৈতন্য হোক। যার মধ্যে চেতনা জাগবে সে নির্জীব হ’লে হবে সজীব আর সজীব হলে হবে শিব। শব, শক্তি যোগে শিব হয়। বিজ্ঞানের স্থুল নিয়ম তখন বদলে যায়। তুমি আগে খেয়ে নাও, একটা সত্যি ঘটনা গল্পরূপে শোনাব।
ছোটবেলায় চঞ্চলকে কোলে তুলে নিয়ে পায়চারী করবার সময় যেমন গল্প শোনাতাম, আজ ও তাই করতে হ’ল।
খাইয়ে দাইয়ে হাত মুখ ধুইয়ে নিয়ে এসে রূপকুমার ছেলেটাকে মনের সুখে বেশ খানিক আদর করবার পরে আমি বললুম-‘সে অনেক দিন আগেকার কথা। তখন ট্রেন চলত বাষ্প ইঞ্জিনে। কয়লার গাড়ী থাকত ইঞ্জিনের সঙ্গে। জল ও । বেলচায় করে কয়লা দিতে হ’ত ইঞ্জিনে বলে ফায়ারম্যান থাকত ইঞ্জিনে। যত জোর আগুন হত, বাষ্প ও তৈরী হত তত বেশী। গাড়ী ছুটত তত জোরে’।
‘তখন সারনাথ দুর্গ এক্সপ্রেস ছাড়ত বেনারস থেকেই, ছাপরায় যেত না। রাজেশ নামে এক ড্রাইভার ছিল সেই গাড়ীর। এক্সপার্ট ড্রাইভার। কখন ও তার গাড়ীতে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। সে খুব সতর্ক চালক ছিল। আর নিজের হাতে প্রতিদিন ইঞ্জিনের কলকব্জা থেকে ব্রেক, স্পীড লিভার, স্টার্টার সব পরীক্ষা করে নিত। তারপরেই সে গাড়ী ছাড়ত’।
‘তার আর ও একটা বদ অভ্যাস ছিল। ট্রেন ছাড়বার আগে সবকিছু পরীক্ষা ও নিজের হাতে ঠিকঠাক করা হয়ে গেলে তখন সে হাতজোড় করে ইঞ্জিনটাকে বলত-‘ভাই, এইবার তো রওনা দিতে হবে। ডিউটি ইজ ডিউটি। এখন তোমারই ওপরে সব ভরসা। দেখো, যেন কোন রকম গন্ডগোল না হয়। সব তোমার দায়িত্বে থাকব আমরা আর হাজার খানেক যাত্রী। সকলকে রক্ষা করবার ভার কিন্তু তোমাকে দিলাম আমি। যেন বিপদ না হয় কারো, তুমি দেখো’।
অন্য খালাসী, পয়েন্টসম্যান, ফায়ারম্যানরা এই নিয়ে খুব হাসাহাসি, ঠাট্টা তামাসা করত তার সঙ্গে কিন্তু রাজেশ গ্রাহ্য ও করত না সেইসব কিছু । বলত –‘ট্রেন ছাড়লে ইঞ্জিন মালিক আর থামলে স্টেশন মাষ্টার’।
একদিন কিন্তু একটি ঘটনা ঘটেই যায় তার গাড়ীতে অত সাবধানতা সত্বে ও । কিন্তু রেলওয়ে বোর্ড তাকে তার ফলে পাঞ্জাব মেলের ড্রাইভার করে দেয়, শাস্তি না দিয়ে। তখন তো মাত্র আসাম, মাদ্রাজ, বম্বে ও পাঞ্জাব মেল এই মাত্র চারখানা মেল ট্রেন চলত যা রাজধানীর সমকক্ষ ছিল।
চঞ্চল বলল- ‘ও কাকু, চল শুয়ে পড়ি গিয়ে আমরা না হয় এইবার। তারপরে শুনব তোমার গল্প। নইলে কষ্ট হবে তোমার। আমি তো আর সত্যিই বাচ্ছা নই। তুমি বললে কি হবে, বলো তো কাকু’।
‘চঞ্চলের নরম মসৃন দুধবরণ শরীরটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে মশারীর মধ্যে আশ্রয় নিলুম আমি।
আমাকে বেশ খানিকক্ষন আদর করবার পরে চঞ্চল বলল-‘এইবার বল, কাকু…’
‘সে দিন যথা রীতি ট্রেন ছেড়েছিল রাজেশ। এলাহাবাদ হয়ে পথ। নৈনী ফিরে এসে মানিকপুরের পথে ট্রেন ছুটতে শুরু করলে রাজেশ ইঞ্জিনে কয়লা দিয়ে ভাল করে প্রেসার তুলতে বলল। ৮৪ কি০মী০ নন স্টপ রানিং তখন।
সেখান থেকে ৭৮ কি০মী০ সাতনা। তারপরে ৯৮ কি০মী০ কাটনী যেখানকার সিমেন্ট বিখ্যাত। মধ্যে মৈহর দেবীর মন্দিরের জন্য প্রসিদ্ধ স্টেশন মৈহর। দুর্গ এক্সপ্রেস থামতো না সেখানে তখন। সোওয়া এগারোটায় বেনারস থেকে ছেড়ে মানিকপুরে ট্রেন থামল পৌনে পাঁচটার সময়। ২২৮ কি০মী০ পথ পার হয়ে এসে। ৬টায় এসে গেল সাতনা’।
‘ট্রেন রাইট টাইম রান করছিল’।
‘দুর্গ এক্সপ্রেস নন লেট ট্রেন ছিল তখনকার দিনে। সরকারী খাজনা থেকে টাকা পয়সা ও তখন প্রায়ই যেত ওই ট্রেনে। সাতনা ক্রস করে ফুল স্টীম তুলে স্পীড লিভারটা ঠেলে তুলে দিলে অনেকটা ওপরের দিকে রাজেশ। একঘন্টা পঁচিশ মিনিটের রান। মৈহরে একটু স্লো হবে গাড়ী, যে যাত্রীদের দরকার তারা ঠিক উঠে পড়বে’।
‘পূর্ণ বেগে ছুটতে শুরু করলো লৌহ দানব। ঝম ঝম ঝমা ঝম। দারুণ শব্দঝন্ঝনা ছড়িয়ে পড়ল…ত্রিশ…চল্লিশ …পঞ্চাশ…ষাট কি০মী০ প্রতি ঘন্টা স্পীড উঠে গেল ট্রেনের দেখতে দেখতে। আর ও বাড়ছে বেগ। স্পীড লিভারটা তো নামানো হয় নি আর তাই কিছুক্ষনের মধ্যেই সত্তর ছাড়িয়ে আশীর কোঠায় এসে গেল কাঁটা।
‘মৈহর আসছে সাহাব। স্পীড কন্ট্রোল করুন আমি রিং নিচ্ছি। খালাশী রামদেও বলল’।
‘এখুনি করছি কন্ট্রোল, তুমি রেডী হও…’
‘এই বলেই সে স্পীড লিভারটাকে নীচে ঠেলে দিতে গেল রাজেশ। কিন্তু দেখা গেল লিভার জ্যাম। কোন যান্ত্রিক গন্ডগোল হবে নির্ঘাৎ। একটু ও নামছে না আর লিভার। আঁৎকে উঠল ড্রাইভার সাহেব। এ্যাকসিলেশন কম করতে লেগে গেল সে। নাঃ, কোন যন্ত্রই কাজ করছে না। বাধ্য হয়ে তখন ব্রেকে চাপ দিল রাজেশ। সঙ্গে সঙ্গে তার গলা দিয়ে আর্তনাদ ঠেলে বেরিয়ে এলো একটা। সাধারণ বা এমার্জেন্সী কোন ব্রেকই যে কাজ করছে না ইঞ্জিনের। এমনকি প্রেসার রিলিজ বোতাম ও চুপচাপ। তার মানে ট্রেন স্পীড কমাতে এক্কেবারেই রাজী নয়’।
আমি থামলুম।
কপালের ওপর থেকে নিজের সুকুঞ্চিত ঘন কেশদাম বাঁ হাতের তালু দিয়ে ওপরের দিকে তুলে দিয়ে চঞ্চল বলল-‘তখন বলো না কাকু? কি হল?
‘কি আর হবে চঞ্চল? যা কখনো হয়নি তাই হলো। ড্রাইভার, খালাসী, ফায়ারম্যান সবাই নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমনকি গার্ড বা স্টেশন মাষ্টার সাহেব ও কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তখন তো আর সেলফোন ছিল না। কথাবার্তা চলতো ওয়াকি টকির মাধ্যমে আর খবর যেতো টেলিগ্রাফের দ্বারা। তারবাবুরা থাকতেন স্টেশনে সেইজন্য’।
‘যেই ড্রাইভার ঘটনাটি জানালো গার্ডসাহেবকে তিনি জানালেন মৈহরের স্টেশন মাষ্টারকে আর তিনি তার করে জানালেন কাটনী অবধি যত ছোট স্টেশন ছিল সবাইকে। ট্রেনকে সমানে লাইন ক্লিয়ার দিয়ে যাবার জন্য। এমনিতে ও ওই ট্রেনের অন্য কোথাও থামবার কথা নয়। তবে এখন কাটনী জংশনকে ও তৈরী হ’তে বলা হ’লো প্ল্যাটফর্ম একের বদলে দুই নম্বর দিয়ে ট্রেনকে থ্রু পাশ করাবার জন্য’।
‘প্রায় শতাধিক কিলোমীটার স্পীডে এসে গেল মৈহর স্টেশন। ভীমবেগে একনম্বরে ইন করল সারনাথ দুর্গ এক্সপ্রেস ট্রেন। দারুণ শব্দ ঝন্ঝনার সৃষ্টি হলো। থরথর করে কাঁপতে লাগল প্ল্যাটফর্ম সমেত গোটা স্টেশন বিল্ডিং। ধূলোয় ভরে গেল স্টেশন। ঝম ঝম ঝমাঝম করে পাঁচ সেকেন্ডে যেন উড়ে বেরিয়ে গেল ট্রেন। রামদেব রিংটা ছুঁড়ে দিল এ’প্রান্তে ঢুকেই। প্ল্যাটফর্মের অপর প্রান্ত থেকে বিহারীলাল ও সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে দিল তার রিংটাকে। সেটা যখন ইন্জিনের কাছে গেল ততক্ষনে ইন্জিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। অদ্ভূত ক্ষিপ্রতায় ক্যাচ করল রামদেব রিংটাকে টাল সামলে নিয়ে। দুই কানের পাশ দিয়ে তার তখন ঝড় বইছে যেন’।
‘প্রায় সাত আটজন যাত্রী অপেক্ষা করছিল মৈহর স্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য। তারা এগিয়েও গিয়েছিল কোন কোচের হ্যান্ডেল ধরে নেবার জন্য।
‘বাপরে বাপ …’ বলে ছিটকে সরে এলো তারা হাওয়ার ঝাপটায় নাহ’লে চাকার নীচে যেতে হতো তাদের হাওয়ার ঘুর্ণির টানে। কয়েকজন গড়িয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন ততক্ষনে সিগন্যাল কেবিন পেরিয়ে যাচ্ছে আর সবুজ পতাকা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে অবাকচোখে তাকিয়ে দেখছে কেবিনম্যান’।
‘কেবিন থেকে তারা শুনছে ট্রেনের জোর ঝমাঝম শব্দ। ট্রেন তো বহুদূরে চলে গেছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। পূর্ণশক্তিতে ছুটছে ইঞ্জিনখানা তখন গোটা ট্রেনকে নিয়ে’।
আমি আবার একটু থামলুম।
পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ রূপবান দুধবরণ ছেলে চঞ্চল ততক্ষনে আমার বুকের ওপর দুটি নরম করতল রেখে শুয়ে নিজের টানাটানা চোখদুটোকে আরও বড় বড় করে গল্প শুনতে ব্যস্ত। আমাকে থামতে দিতে সে মোটেই রাজী নয়।
রাগ করে চঞ্চল বলল-‘আঃ কাকু, এখন থাক না তোমার জয়পুরী লেপ। আমার শীত করছে না এখন একটু ও। পরে গায়ে দিলেই হবে। তুমি বলো তো দেখি আগে যে তারপরে কি হলো। তোমার গল্পগুলোয় সবসময় এমন একটা করে ক্লাইম্যাক্স থাকে না যে তখন শ্রোতার দম আটকে আসে আর তুমি এমন দুষ্টু ছেলে একটা যে ঠিক সেই সময় বুঝে নিয়ে থেমে যাও’।
আমি বললুম-‘আরে বাবা, নভেম্বর মাস এসে গেছে। ঠান্ডা লেগে গেলে তখন ঠ্যালা কে সামলাবে শুনি? খালি গায়ে বেশীক্ষন থাকা ঠিক নয়। বেশী সুন্দর ছেলে হ’লে কি তার ঠান্ডা ও লাগবে না এমন কোন কথা আছে না কী? আগে গায়ে চাপা দাও লেপ’।
‘আচ্ছা বাবা, দিয়েছি লেপ চাপা গায়ে। এবার বলো-…’
‘বলব কি? গাড়ী ঝড়ের বেগে ছুটছে রাগী দানবের মতন ফোঁসফোঁস শব্দে। একটার পর একটা ছোট স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে আড়াই থেকে তিন মিনিট পর পর। প্রচন্ড দুলছে ট্রেন সেই সময়। শব্দ ও বেশী করে হচ্ছে। আধঘন্টার আগেই দূরে জাগলো কাটনী জংশন স্টেশনের সিগন্যালের রক্তচক্ষু। প্রমাদ গুনলো ড্রাইভার। সর্বনাশ’।
‘সিগন্যাল নেই। থামতে হবে যে’।
‘কিন্তু কি ভাবে তা সম্ভব ভেবে পেল না সে। শীতকালে ও তার কপালে ঘাম দেখা দিল। এসে গেছে সিগন্যাল পয়েন্ট। এইবার আবার জোরে স্পীড লিভারে ঠেলা দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে নীচু হল লিভার। ব্রেকে চাপ দিয়েছে ততক্ষনে ড্রাইভার জয় মা দুর্গা বলে। ঝপ করে সিগন্যাল ডাউন হ’ল তখনি আর কাটনী জংশনের সিগন্যালের রক্তচক্ষু সবুজ দ্যুতি ছড়ালো সঙ্গে সঙ্গে। বাধ্য হয়ে থ্রু ট্রেন পাশিং দিচ্ছে কাটনী জংশন স্টেশন ও’।
‘কিন্তু ততক্ষনে ট্রেনের চাকায় ব্রেকের ঘর্ষনের সুর বাজছে অর্থাৎ যথানিয়মে থামছে এসে ট্রেন । কেবিনে দ্রুতহাতে লিভারে টান দিল সিগন্যালম্যান আহমেদ আবার। একনম্বরে ইন করাবার অর্ডার আসছে যে তার কাছে স্টেশন থেকে ওয়াকী টকিতে’।
‘যথাস্থানে গিয়ে থামলো দ্রুতগামী ট্রেন। ছুটে এলো স্টেশন মাষ্টার থেকে ইঞ্জিন পরীক্ষকের দল। শুরু হলো পরীক্ষা’।
‘পনোরো মিনিট পরে তারা রায় দিল-‘আরে ড্রাইভার সাহেব, ইঞ্জিন তো আপনার দেখভালে বেষ্ট পারফর্মিং স্ট্যাট্যাসে রয়েছে দেখছি। বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই কোথাও। নিশ্চিন্তে ড্রাইভ করে যান আপনি। কোন সাময়িক জ্যামিং হয়েছিল হয়তো। এখন পুরো ফিটনেসের সার্টিফিকেট দিতে আমার আপত্তি নেই। এই নিন। ছাড়বার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ট্রেনের। প্রেসার রিলিজিং ভাল্ব বন্ধ করতে পারেন আপনি এবার। ও০কে০। বাই’।
‘১৬৭ কিমী দূর অনূপপুর। তিনঘন্টার পথ। ট্রেন ছেড়ে দিল বিশ মিনিট সময় হয়ে যেতেই। ছুটে চলল বেনারস দুর্গ সারনাথ এক্সপ্রেস আবার তবে নির্ধারিত গতি সীমার বেশী স্পীড দিতে আর সাহস পেল না ড্রাইভার সাহেব। যথা নিয়মে দুর্গে ও পোঁছে গেল ট্রেন’।
‘তবে পরদিন একটা দারুণ খবর পড়ে চমকে গেল রাজেশ। পরবর্তী ট্রেন ছিল গোরখপুর দুর্গ এক্সপ্রেস। মৈহর স্টেশন থেকে প্রায় জনা আটেক সশস্ত্র ডাকাত কম্বল মুড়ি দিয়ে উঠে পড়ে সেই ট্রেনে। কাটনী পার হতেই তাদের তান্ডব শুরু হয়। প্রায় দশজন আহত হয়। তিনলক্ষ টাকা নগদ ও জিনিষ মিলিয়ে লুঠ করে নেয় তারা । অনুপপুরের আগেই ট্রেন থামিয়ে নেমে ফায়ারিং করতে করতে অন্ধকারে চম্পট দেয়’।
‘সারনাথ দুর্গ এক্সপ্রেস ট্রেনে সরকারের কিছু গোপনীয় দস্তাবেজ ও টাকা পয়সা যাচ্ছিল সেদিন। মৈহরে কম্বল মুড়ি দিয়ে লোকগুলো সন্ধেবেলা থেকেই কিন্তু অপেক্ষায় ছিল যে তা কিন্তু ঠিক বলে জানা গেছে। কেন? তারা কি সরকারেরর দশ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নেবার তালে ছিল? তাদের কয়েক সেকেন্ডের জন্য রাজেশ ও দেখেছিল বটে।
তারা ট্রেনে উঠতে গিয়ে অসফল হয়ে প্ল্যাটফর্মে যে গড়াগড়ি খেয়েছিল তাও সে দেখেছিল ঠিক। তাদের হাত থেকে তাকে ও ট্রেনকে বাঁচাবার জন্যই কি ইঞ্জিন খানা স্পীড কমাতে রাজী না হয়ে একশো মাইল স্পীডে পেরিয়ে এসেছিল মৈহর স্টেশন? না কী, এটা শুধুই একটা কাকতালীয় ঘটনা। এটাকে কি ট্রেনের ইন্জিনের দায়িত্বপালন বলা চলে? হয়তো তাই। কেননা এমনধারা কান্ড রাজেশের জীবনে আর কখনো ঘটেনি’।
‘তারপরে,কাকু?’
‘তার পনেরো দিন পরে পুলিশের তৎপরতায় একজন ট্রেন ডাকাত রায়পুরে ধরা পড়ে যায়। তখন পুলিশের গুঁতো খেয়ে সে স্বীকার করে যে সত্যিই তাদের লক্ষ্য ছিল সারনাথ বেনারস দুর্গ এক্সপ্রেস ট্রেন… গোরখপুর দুর্গ ট্রেন তাদের দুধের আশা ঘোলে মেটালে ও দুর্ভাগ্য তার… তাই শেষরক্ষা ও হলো না’।
‘তা সে ঘটনা যাই হোক না কেন কিন্তু এই খবর এসে যাওয়ার পরে রাজেশকে রেল বোর্ড থেকে নগদ দশ হাজার টাকা পুরষ্কার ও বেষ্ট ড্রাইভারের প্রমাণপত্র দেওয়া হয় ও পরে তাকে পাঞ্জাব মেল ট্রেনের ড্রাইভার করে দেওয়া হয়’।
----------------------------------------------------------------------------
ডঃ জি০ সি০ ভট্টাচার্য,বারাণসী,উত্তর প্রদেশ,০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২৬/২/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।