সন্মান
============================
জি০সি০ভট্টাচার্য্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
-----------------------------
সে’দিন বিকেলে কাকুর নামে একটা ডাকের চিঠি এসেছিল।
মুখবন্ধ করা খামের চিঠি।
লেটার বক্স খুলে চিঠিটা আমি দেখতে পেয়ে নিয়ে এসে কাকুর হাতে দিলুম।
খোলা চিঠি বা পত্র পত্রিকা হ’লে অবশ্য আমিই খুলি কিন্তু বন্ধ চিঠি হ’লে নয়।
তখন সময়টা ছিল মনে হয় নভেম্বর মাস।
আমাদের স্কুলে শীতের ছুটি পড়তে তখন ও বেশ দেরী।
কাকু যথারীতি সে’দিন ও আমাকে স্কুল থেকে বিকেল বেলা নিয়ে এসেছিল ছুটির পরে তিনটের সময়, স্কুটারে বসিয়ে। আমার একমাত্র বন্ধু বাদলকে ও বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। কাকুর কাজ খুব সময় ধরে হয় যে।
তবে বাদল সে’দিন কোথায় যেন যাবে ওর মায়ের সাথে তাই সন্ধ্যেবেলায় সে খেলতে আসতে পারবে না বলে দিয়েছিল। তাই কাকু আমাকে একেবারে চান টান করিয়ে ঘরের ড্রেসই পরিয়ে দিয়েছিলো। নইলে রোজ আমার হাত পা ধুইয়ে দিয়ে খেলার পোষাক পরায় আর আমাকে জলখাবার খাইয়ে দেয়। খেলার শেষে তখন নিয়ে গিয়ে চান টান করায়।
জলখাবার খেতে বসে চিঠিটা হাতে নিয়েই কাকু ভ্রু কুঁচকে বললো-‘হুঁ, দেখছি সাহিত্য সন্মান সংসদের চিঠি । তার মানে পাগলা অবিনাশের কান্ড। নাঃ… আমার কপালে বেশ ভোগান্তি আছে মনে হয়। কি যে গেরো এসে জোটে…..’।
আমি গরম আলুর পরোটা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলুম-‘পাগলা অবিনাশ কে কাকু?’
এখন বলে ফেলি যে আমার কাকু ছেলে হয়ে ও কিন্তু ভারী ভালো রান্না করে। আর মা তো…সে তুলনায় …যাঃ…। তবে আমি কিনা খুব অল্প করেই খাই। আমাকে একটু লোভ সামলাতেই হয়। কি আর করবো? নইলে ক্লাসের অনিমেষের মতন গোল কুমড়ো হয়ে যাবো তো সাত দিনেই। কাকু অবশ্য কখনো কিছু জোর করে খাওয়ায় না আমাকে। এই যা রক্ষে……মনে হয় আমার কাকুর ও কুমড়ো ছেলে পছন্দসই নয়। সে কথা যাক।
কাকু বললো- ‘আমার এক পুরণো বন্ধু। সেই প্রাইমারী স্কুলের সময়কার। মাথায় একটু বাতিক মতন ছিল বলে সবাই ওকে পাগলা বলত আর কি…’।
‘পাগলা দাশুর মতন, কাকু?’
‘মনে কর অনেকটা তাই, চঞ্চল। সবাই যা ভাবে বা করে তা অবিনাশ করতো না। ওর সব কাজই ছিল কেমনধারা বেয়াড়া গোছের বা উল্টো’।
‘তোমার বন্ধু কোথায় থাকে, কাকু?’
‘পুরুলিয়ায়। চিঠিটাও এসেছে সে’খান থেকে। আমিও তো পুরুলিয়ার ছেলে। সে’খানে তো আমাদের বাড়ী ঘর ও ছিলো। কিছুদিন পরে অবশ্য চলে আসে বাবা বদলী হয়ে। আর যায় নি। তবে বাড়িটা বিক্রী করে নি তাই পড়েছিল। তবে এতোদিনে হয়তো সবই বেহাত হয়ে গেছে…’।
জলখাবার খেয়ে নিয়ে তারপরে কাকু চিঠিটা খুলে পড়ে বললো-‘যা ভেবেছি, ঠিক তাই। ওরে বাবা …একমাস পরে যেতে বলেছে…তখন তো হবে ডিসেম্বর মাস। আর তখন যা ঠান্ডা না পুরুলিয়ায়… উঃ… অবিনাশটার আর বুদ্ধিশুদ্ধি হবার আশা নেই দেখছি…’
আমি যে চঞ্চল, তা আর বলতে হবে না হয়তো।
বাদল আমার নাম দিয়েছে ‘পরীর দেশের রাজকুমার’ আমি একটা খুব খুব সুন্দর ঝকঝকে চকচকে দুধের বরণ ছেলে বলে। যখনকার কথা বলছি, তখন আমার বয়স ছিল প্রায় বছর নয় কি দশ। এখন তো আমার বয়স তেরো পুরো হয়ে গেছে কবেই। আর আমি বেশ বড় ও হ’য়ে গেছি। অবশ্য কাকু তা মানেই না।
কাকু আমাকে আর বাদলকে নিয়েই গল্প লেখে। আর আমি যে খুব সুন্দর ছেলে তা ও বেশ করে লেখে, আর সে কথা হয়তো অনেকেরই ভালো লাগে না। লাগবার কথাই নয়। আর দ্বিতীয় দোষ যে কাকু সব সত্যি কথা লিখে ফেলে তাই কেউ আর কাকুর লেখাকে মোটেই ভালো ও বলে না। সন্মান দেওয়া তো রইলো গাছের মাথায়। তা ঠিকই করে। সাহিত্য কি তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী নাকি? যত বাজে কথা লিখবে আর মিথ্যে গাঁজার ধোঁওয়া ছাড়বে, সাহিত্য ততই উৎকৃষ্ট হবে। সে আর আমার কাকুর দ্বারা হয়েছে। সে কথা ও যাক। আমি ও আজকাল দেখছি যে সত্যি মানে বড় বাজে কথা লিখে ফেলি। কাকুর প্রভাব হয়তো ।
আমি বাদলের মতন মনে মনে হিসেব করে নিয়ে বললুম-‘তা ঠান্ডা তো কি হয়েছে, কাকু? যেতে যখন বলেছে, যাবে। সন্মান দিলে নেবে না কেন? আর ডিসেম্বরের শুরুতে খুব একটা ঠান্ডা ও পড়বে না…..’
এ’খানে বলে রাখি যে আমার কাকু হচ্ছে একটা ভীষণ শীতকাতুরে ছেলে।
আমার কথা শুনে চমকে উঠে কাকু বললো-‘হুঃ…বুঝেছি…বাদলের সঙ্গগুণ….তা পাগলা অবিনাশটাই তো এই জন্য দায়ী। এই সংস্থাটাকে সে সোসাইটি অ্যাক্টে রেজিষ্ট্রী ও করিয়েছে। অনেক মেম্বার ও বানিয়ে ফেলেছে। চাঁদা ও ঢের আদায় করছে। আর তাই দিয়ে সে যে সব সাহিত্যিকের কপালে না জোটে কোন সম্মান বা পুরষ্কার কেননা সন্মান পাবার জন্য তাদের নেই পয়সা ঢালার ক্ষমতা বা না আছে উঁচু সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক মহলে জানা শোনা, শুধু তাদেরই ধরে এনে সন্মান দেবে, ঠিক করেছে। আরে বাবা এই ঝামেলা করে লাভটা কি? খালি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। উঃ, কি কান্ড বলো তো, চঞ্চল?’
‘আবার সে ঠিক করেছে যে হয় কোন মন্ত্রী আর নয়তো অন্তত একজন সেন্ট্রাল সরকারের সেক্রেটারিকে ডেকে এনে তাঁকে করবে অতিথি ও বক্তা যাতে মিডিয়া আর পুলিশ প্রোটেকশান ও আসে সঙ্গে সুড়সুড় করে আর ফলে অখ্যাত লেখক গুলো একটু পরিচিতি ও সুরক্ষা পায়। আমার কি একটা তাজমহল নিয়ে লেখা ও কোন ওয়েব সাইটে না কি পড়েছে আর তাই আমাকে এই ঠান্ডায় ভুগিয়ে মারবে ঠিক করেছে। কি গেরো আমার বলো তো, চঞ্চল। তার ওপরে বিপদ হচ্ছে যে ওই ঠান্ডায় তখন আমি যাই কাকে সঙ্গে নিয়ে? তোমার ও বাদলের তো তখন মনে হয় পড়বে স্কুলের পরীক্ষা। আর বৌদি?. হুঁ................ তবেই হয়েছে…….’ ।
শুনেই আমি মনে মনে এত্তোবড়ো এক জিভ কেটে বললুম-‘এই রে….খেয়েছে….সে’টা তো আমিই লিখে কাকুর নামে…অ্যাই ছিঃ …. এখন উপায়? ভাগ্যে কাকুর মনেই নেই’।
ভালোমানুষ সেজে মুখে বললুম-‘তা তুমি কোন ট্রেনে যাবে, কাকু?’
‘কেন? পুরুষোত্তম থাকতে ভাবনা কি? পুরুলিয়া টাটানগর হয়ে খড়্গপুর চলে যায়।’ অবশ্য পুরুলিয়ায় থামে দু’মিনিট……’
আমি পরীক্ষার কথা ভূলে তখনি ল্যাপটপ খুলে ইন্টারনেট চালু করে আই আর সি টি সির অ্যাকাউন্ট খুলে বসে পড়লুম। কাকু রাগ করে আমাকে কিছুটি বললো না। বেশ মজা তো…বেশী সুন্দর ছেলে হওয়ার অনেক লাভ ও আছে দেখছি।
কাকু আমাকে সে’দিন একটা বেশ সুন্দর সবুজ মতন মানে কচি কলাপাতা রঙের বিদেশী কাপড়ের দামী পোষাক পরিয়ে দিয়েছিল। যাদুকরদের মতন বেশ ঝলমলে আর ঢিলেঢালা, কিন্তু পাতলা হ’লে ও বেশ গরম। কাকুর এই এক শখ…..আমাকে যত পারে খালি সাজায় আর নতুন দামী দামী পোষাক পরায়, পয়সার শ্রাদ্ধ করে।
কাকু আমার মুখের দিকে চেয়ে চুপটি করে বসে কি যেন ভাবছিলো। বিড় বিড় করে বললো-‘সবুজ …………হুঁ, অবিনাশের পছন্দের রঙ….আবার সুন্দর বাচ্ছা ওর ভীষণ পছন্দ …….আমাদের যাওয়াটা কি ঠিক হবে?... কে জানে বাবা? পাগলাকে বিশ্বাস কি?’
আমি বললুম-‘কাকু, এসি থ্রি তে কিন্তু কোন বার্থ খালি নেই তো, সব ওয়েট লিষ্ট; তবে এ সি টু’তে আছে…. চারটে মাত্র। নেবে?’
‘হুঁ...’
‘তা ….এই হয়ে গেছে, কাকু, তবে সকাল সাড়ে দশটার গাড়ি মোগলসরাই থেকে। পুরুলিয়ায় সন্ধ্যাবেলায় নামতে হবে। দু’মিনিট স্টপেজ। আমি প্রিন্ট আউট একসঙ্গে নিয়ে নেব। এখন বলো তো তুমি ফিরবে কবে?’
‘কেন? একদিন পরেই.....’।
‘উঁহু, সেটি হবে না ….দিন পাঁচেক পরে হ’লে হতে পারে, কাকু’।
‘তাই সই…..তা তুমি ক’টা টিকিট কাটছো, শুনি’
আমি কথাটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বললুম-‘কেন কাকু? এখন তো লাগবে দেড়খানা টিকিট। আমার বারো বছর বয়স হয়ে গেলে তখন লাগবে দু’টো……’
কাকু আমার দুষ্টুমিটা ধরতে পারলো কি না কে জানে? মুখে বললো-‘সেরেছে…এই ঠান্ডায় একটা কচি ছেলে সঙ্গে নিয়ে………..উঃ…উঃ….’
তা যেখানে বাঘের ভয়, সে’খানেই সন্ধ্যে হয়…..বলে একটা কথা আছে না । আমার কাকু ঠান্ডার ভয়ে সাতশো টাকা খরচ করে ট্যাক্সি ভাড়া করে ঠিক দশটায় গিয়ে মোগলসরাই হাজির হয়ে কি করবে? টপ করে যে উঠে পড়বে তা দেখি যে গাড়িই তো নেই….সে আসছেই না আর….ট্রেন লেট…..তাও এক আধ ঘন্টা নয়, পুরো তিনঘন্টা………….. কাকু তো একনম্বর প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমে বসে বসে অস্থির। তায় সংলগ্ন দরজা খোলা বাথরুমটা যা নোংরা না…………সে’খানে বসা ও দায়।
অবশ্য লোকাল হিন্দুস্থানিদের ভ্রুক্ষেপ ও নেই। তারা দিব্যি করে সেইখানে বসে আবার খাওয়া দাওয়া ও সেরে নিয়ে এক ঘুম দিয়ে নিচ্ছে মাটিতেই খবরের কাগজ পেতে শুয়ে পড়ে। কাকু তো দেখেই নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে খালি….উঃ উঃ করছে।
আর আমি? ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি খালি কখন ট্রেন আসবে তাই জানবো বলে…. এনকোয়ারী থেকে ইলেক্ট্রনিক বোর্ড অবধি দেখছি বার বার। অবশ্য আমার টুপি, রোদ চশমা আর সিকিউরিটি বালাটা পরেই….নইলে কাকু আমাকে ছাড়লে তো?
তা শেষে পাঁচঘন্টা পরে বলে কিনা দু’নম্বরে গাড়ী আসবে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটাতে। বোঝ ঠ্যালা…. মেঘ বাদল নেই ….কুয়াশা নেই কিছুই নেই……এই সব কান্ডকে কাকুর ভাষায় বেশ বলা যায়….উঃ……উঃ…..
তা গাড়ী আসতেই আমরা উঠে পড়লুম। কাকু বললো-‘বাঁচলুম। এইবার কিছু খেয়ে নিয়ে ঢিপ করে শুয়ে পড়লেই হয়। দিন ভোর হাঁ করে তীর্থের কাকের মতন বসে বসে আমার কোমর ধরে গেছে যে ’।
আমি বললুম-‘কাকু, নামবে কি করে? পুরুলিয়া আসতে তো শেষ রাত’।
‘তেমন বুঝলে নামবো না। আমি জানি তুমি টিকিট খড়্গপুর অবধি কেটে রেখেছো দু’মিনিট স্টপেজ শুনেই’।
‘এই যাঃ….আমি মুখে কাকুকে কিছুটি না বললে ও কাকু যে কি করে আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে দেখেই আমার সব কায়দাগুলো ধরে ফেলে তা ভগবানই জানেন। আচ্ছা মুখ দেখে কি কারো মনের কথা জানা যায়? মনে হয় কাকু অন্তত জানতে পারে। আর কি করে জানতে যে পারে, সে কথা কাকুর কাছে জানতে চাইলে ও আমার হয় খুব মুশ্কিল। কাকু তখন ঠিক বলবে- ‘আগে তোমার একটা সুন্দর মতন ছেলে হোক। তখন নিজেই ঠিক বুঝতে পারবে, চঞ্চল’। আমার কি জ্বালা বলো তো।
আমি একটা ফেরৎ টিকিট ও নিয়ে রেখেছি। খড়্গপুর থেকে পুরুলিয়া। পরের দিনের। তবে রূপসী বাংলায় সব চেয়ার কার বলে আনন্দবিহার স্পেশালে নিয়েছি। কে জানে? কাকু হয়তো তাও জেনে বসে আছে, চোখে না দেখেই। … কাকুর অসাধ্য কর্ম নাহি ত্রিভুবনে………..তা এখন আমাকে মানতেই হবে।
তা কাকু খানিক পরে আমাকে খাইয়ে দাইয়ে দিয়ে হাত ধরে বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আপার বার্থে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে লোয়ার বার্থে শুয়ে পড়লো। অবশ্য আমার বেড রোল টোল সব পেতে, আমার গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো, কাকু। আসলে আমি জানি যে কাকু ট্রেনে মোটেই ঘুমোয় না। সর্তক নজর রাখে আমার ওপরে। আর আমি তো শুয়েই দিই টানা ঘুম। কাকু যে কি করে জেগে থাকে তাও ভগবান ছাড়া আর কেউ জানে না। আর সে কথা ও কাকুকে জিজ্ঞাসা করলেই…………..এই যাঃ…
অনেক রাতে গাড়িতে বেশ গোলমাল হ’তে আমার ঘুম ভেঙেছিল একবার। তাই দেখেই কাকু উঠে দাঁড়িয়ে বললো-‘চঞ্চল, এখন রাত সাড়ে তিনটে। চারটেয় আসছে টাটা নগর। বিহারিদের সব নামতে হবে তো। তাই চেঁচাচ্ছে। তুমি ঘুমোও। পুরুলিয়া পার হয়ে গিয়েছে রাত তিনটের সময়। এই শীতে ….উঃ….উঃ……। আমি নামবোই না। ঝাড়গ্রাম হয়ে খড়্গপুরে নামলেই হবে ছ’টার পরে’।
তাই করলুম আমরা।
তবে পরদিন বেলা সাড়ে দশটায় আবার ট্রেনে উঠতে হলো আমাদের।
তা দেখলুম খড়্গপুরে সবই অদ্ভূত ব্যাপার। এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম আর খুঁজেই পাই না আমি। শেষে দেখি তিন নম্বর শেষ হ’তে তখন সেটাই একনম্বর হয়ে গেল আর দু’নম্বরটা হয়ে গেল চার নম্বর। বেশ মজা তো। আমি শিমলায় এইরকমের ধাঁধা দেখেছিলাম মনে পড়লো।
তা কাকুর কপালের দুর্ভোগের কথা আমি দেখি প্রায়ই ফলে যায়। বেলা দু’টোয় আসবে পুরুলিয়া। কাকু তৈরী আর ট্রেন থামতেই নেমে ও পড়লো লাগেজ নিয়ে টুপ করে।
আমি ও নামতে যাচ্ছি, হঠাৎ হুড়মুড় করে উঠতে শুরু করে দিলো কুলির দল। সাত আট জন। আর তারা তুলতে শুরু করে দিলো জিনিষের পাহাড়। চার পাঁচটা বড় বড় অ্যাটাচী, গোটা দশেক বড় বড় ব্যাগ আরও যে কত কী যে তার ঠিক নেই। তুলছে তো তুলছেই। যেন এ সি টু টিয়ার কোচে নয় মালগাড়ী বোঝাই করছে। আর আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাই দেখছি। শেষে দরজা একদম আটকে গেল দেখে তখন আমি ছুটলুম অন্য দরজার দিকে পুরো কোচ পার হয়ে। তা গিয়ে দেখি যে সেটা আবার বন্ধ। আমি চেষ্টা করে ও খুলতে পারলুম না। বাধ্য হয়ে একজনকে বললুম-‘এই দরজাটা একটু খুলে দেবেন, আংকল? আমি তো হাত পাচ্ছি না…..’
তিনি রাগ করে মুখ খিঁচিয়ে বললেন-‘এখন কি হবে আর দরজা খুলে, শুনি। চুপ করে বসে থাকো গিয়ে। ট্রেন যে ছেড়ে দিয়েছে দেখতে পাচ্ছো না? যত্ত সব…হুঁ…’
‘আমার তো শুনেই কান্না পেয়ে গেলো। আমার সঙ্গে টিকিট ও নেই। আর কাকুও নেই। চেন যে টানবো সেও আমি হাত পেলে তো। আর এই সব বিহারিদের মধ্যে অন্য কেউ যে হেল্প করবে আমাকে, সে আশা না করাই ভালো। তবুও ভয়ে ভয়ে অন্য একজনকে জিজ্ঞাসা করলুম-‘আংকল, এই ট্রেনের পরের স্টপেজ কোথায়? ......’
তিনি বিরক্তমুখে বললেন-‘এই গাড়িতে উঠেছো, কিছুই জানোনা? ……..গোমো… দু’ঘন্টা পরে…..’
‘সর্বনাশ….সে তো তবে অনেক দূর। আমি জানি যে পুরুলিয়ার পরে বোকারো ও চন্দ্রপুরা বড় জংশন। প্রায় সব গাড়ীই দাঁড়ায়। গোমো তো বোকারো থেকে ও ৩৫ কিলোমিটার। পুরুলিয়া থেকে বোকারো থার্মাল প্রায় ৬০ কিলোমিটার…চন্দ্রপুরা আসবে মধ্যপথে, বোকারোর ও ১৯ কিলোমিটার পরে। সব শুদ্ধু ৯৫ কিলোমিটার পথ…. ওরে বাবা….এখন আমি করি কি? যাই…… নিজের সেই ১১ নম্বর সাইড বার্থটায় গিয়ে চুপটি মেরে বসে থেকে দেখি কি হয়? গতিক যে সুবিধের নয় বিশেষ সে তো বেশ বোঝাই যাচ্ছে।
ট্রেন তখন উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। দারুণ দুলছে কোচখানা….কি একটা বড় স্টেশন পেরিয়ে গেল এক মুহুর্তে। কি অনারা না কি যেন নাম। ঠিকমতন পড়তে ও পারলুম না ছাই। হঠাৎ ব্রেকের শব্দ জাগলো। গাড়ী দুরন্ত স্পীড কম করছে যেন। কেন? একশো কিলোমিটার পথ কি পার হয়ে গেল নাকি এইটুকু সময়ের মধ্যেই? ওঃ… ওরে বাবা এ কী? এ যে দেখি চারদিকে জল। দেখতে দেখতে মাঠ ভর্তি জল বেড়ে উঠল এমন যে রেলপথ ও ডুবে গেল। চাকার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আর শোনা গেলো না। গাড়ী ৮৮ কিলোমিটার স্পীড ভূলে সাইকেলের চাইতে ও ধীরে চলছে তখন।
রেল লাইনের ধার দিয়ে দেখি যে তিন চারটে গরু পাশাপাশি চলেছে খপৎ খপৎ করে সেই হাঁটু জল ভেঙে। তারা ও ট্রেন ছাড়িয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শুনলুম সবাই বলছে বাঁকুড়া মেদিনীপুরে নাকি হঠাৎ খুব ঝড়জল হয়ে এই অবস্থা হয়েছে।
এতক্ষনে কি একটা স্টেশন আবার এলো। তবে ট্রেন থামলো না। ওঃ হরি…এ তো সবে সাওঁতালডিহ। গাড়ী তখন জল পেরিয়ে স্পীড বাড়াচ্ছে আবার। দশ…বিশ… ত্রিশ… চল্লিশ…. পঞ্চাশ… ষাট… সত্তর… আশী….বাড়ছেই গতি। সেই সাথে আবার ভয়ানক দুলছে এসি কোচ ও। এতো জোরে টানছে ইঞ্জিনখানা…..
আমি চুপটি করে বসেই আছি। কাকু এখন একলা কোথায় কি করছে তা কে জানে?
ও রে বাবা….আবার ব্রেক কষছে ট্রেন প্রাণপনে…আজ হ’লো কি? ওঃ….আবার জল যে। জল বাড়ছে….চালক মনে হয় ব্রেক লিভার টেনে ধরেই আছে। তা সে আর করবেটাই বা কি? আশী বা নব্বই পার হয়ে যাওয়া দুরন্ত স্পীডকে আবার আটে নামাতে হবে যে…….লাইন ডুবছে আবার। চারদিকে শুধু জল আর জল। আর কিছুটি নেই………..
হঠাৎ ছুটে এলেন সেই এসি কোচের টি টি আই….
‘কার নাম চঞ্চল কুমার? বার্থ ১১….ওঃ তুমি…?’
‘হ্যাঁ, কি হয়েছে, আংকল?’
‘তুমি কি পুরুলিয়া জংশনে নামতে পারোনি?’
‘নাঃ আংকল…যা ভীড় উঠলো না….আর অন্য দরজাটাও বন্ধ ছিলো, আংকল..’
‘কি যে সব কান্ড করে এরা? এখন আমাদের এই ট্রেন থামাতেই হবে। সাঁওতালডিহ তো পার হয়ে গেলো। থামতে হবে সামনের স্টেশন ভোজুডিহ’তে… আগে তোমাকে নামাতে হবে। তবে যেতে পারা যাবে। পুরুলিয়ার আর এম অফিসের ফোনে অর্ডারের পর অর্ডার আসছে সমানে…. ট্রেন থামাও….এখুনি যেখানে হয় থামাও ….. এখনই না থামলে…..হুঁ….. আমাদের রেড সিগন্যাল দিলো বলে। তখন চিত্তির……….কি কান্ড রে বাবা….. অবশ্য এতক্ষণে আমাদের কখন চন্দ্রপুরা ও ছাড়িয়ে চলে যাবার কথা। তা ট্রেন যা চলছে…………. ঠিক যেন গরুর গাড়ী…..’
আমি এইবার রাগ করে বললুম-‘সে’খানে এখন নেমে আমি কি করবো, আংকল? চিনি না জানি না তায় একলা…..ছোট্ট জায়গা…আমি নামবো না’।
‘আরেঃ …না…না। তোমার কোন ভয় নেই, ভাই। তোমার কাকু টাটানগর ধানবাদে অনারা ও আদ্রা হয়ে আসছে। আদ্রায় ট্রেন আধঘন্টা কি চল্লিশ মিনিট দাঁড়ায়। তাই সেইটুকু সময় তোমাকে বসে থাকতে হবে আর পি এফের থানায়। তোমাকে নামিয়ে গার্ডসাহেব পুরুলিয়ায় তা জানিয়ে দিয়ে তবে ট্রেন ছাড়বে। এখন চারটে বাজছে…. আসছে ভোজুডিহ…. চলো আমি তোমাকে নামিয়ে ইনচার্জ অফিসারকে সব বলে দিয়ে যাচ্ছি…. ওরে বাবা রে….দু’ঘন্টায় তো গোমো পৌঁছে যাবার কথা এই সুপারফাস্ট ট্রেনের আর সে কি না পৌঁছাচ্ছে সবে ভোজুডিহ………যাঃ চ্চলে……. এমন জব্দ আমরা সারা জীবনে ও হই নি কখনো সত্যি বলছি। এই অসম্ভব কান্ড যে হয় কি করে তাই তো বুঝছি না..’
তা ভোজুডিহ এসে গেলো। ট্রেন ও থামলো।
গার্ড ড্রাইভার টি টি আই সবাই নেমে এলেন আমাকে নিয়ে। সে কি খাতির আমার তখন। চেন টেনে গাড়ী থামিয়ে নামতে গেলে এই মজাটি যে হতোই না তা ঠিক। কিন্তু এটা কি শুধুই কাকুর কমপ্লেনের ফল? মনে হয় এই ঘটনার পিছনে আর ও কোন বড় শক্তি আছে…..নইলে অনারা থেকে সাঁওতালডিহ হয়ে ভোজুডিহ মাত্র পনেরো কি বিশ মিনিটের পথ এই ট্রেনের। বড়জোর আধঘন্টাই হোক….আড়াইটেয় ট্রেন অনারা পার হয়েছিল। এই টুকু আসতে চারটে বাজে কখনও? দেখি কাকুর আদ্রা থেকে আসতে কতক্ষণ লাগে? তাহ’লেই সব বোঝা যাবে।
আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফোন করলেন গার্ডসাহেব আমার সামনেই……….. ‘হ্যাঁ স্যার…নামিয়ে দিয়েছি. স্যার। আপনি ওর কাকুকে এখন জানাতে পারেন, স্যার। ….ঠিক আছে স্যার। …..ট্রেন তো দাঁড়িয়েই আছে, স্যার।….. আপনি স্যার কনফার্ম করে নিয়ে ভোজুডিহ কেবিন কন্ট্রোলকে বলুন আমাদের এইবার গ্রীন সিগন্যাল দিতে………… না স্যার…ও ভয় পায়নি স্যার। একদম ঠিক আছে……..’
প্রায় মিনিট পাঁচেক কাটলো। সিগন্যাল লাল হয়েই আছে….সব্বাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে সেই রক্ত চক্ষুর দিকে…..আকাশে হয়তো মেঘ ছিলো। তাই অন্ধকার ও বেশ ঘনিয়ে আসছে তখনই। যাত্রীরা নেমে একটু গোলমাল শুরু করতেই গার্ড, ড্রাইভার আর লাঠি হাতে সেই পুলিশের দল খেঁকিয়ে উঠলো—‘গোলমাল নয় …একদম…. দেখছেন না সিগন্যাল আপ…..এটা স্টপেজ নয়……যে কোন মুহুর্তে ট্রেন ছেড়ে দেবে…যে যার জায়গায় ফিরে যান’
সত্যিই তার একটু পরে দেখি যে দূরের লাল সিগন্যালটা বদলে সবুজ হয়ে গেলো। আর সবাই হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠে গেলেন। তৎক্ষণাৎ গাড়ী জোরে হুইশেল দিয়ে ছেড়ে দিলো। সাঁ করে বেরিয়ে গেলো ট্রেন………স্টেশন ফাঁকা…..
সাড়ে চারটে।
কাকুর আসতে নাকি সাড়ে পাঁচটা হয়ে যাবে। এইবার হয়তো আদ্রা ছাড়ছে কাকুর ট্রেন। তা আসুক তো আগে কাকু। তারপরে কোথায় যাবে আর কি করবে তা ঠিক করবে।
ভোজুডিহ ছোট্ট স্টেশন…দু’টি মাত্র প্ল্যাটফর্ম তবে আধুনিক ভাবে টাইল্সে বাঁধানো… .
আর বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে ও। আমার মন্দ লাগলো না। তা আমাকে বাইরে একটু বসতেই কি দেয়? ঘরে বসিয়ে রেখে দিলো। যদি আমি কোথাও চলে বা হারিয়ে যাই। কি ভীতু পুলিশ রে বাবা?
তা পুলিশগুলো বেশ ভালো লোক। খালি জানতে চাইছে তখন আমার ক্ষিধে পেয়েছে কি না? কি খাবো? চা তো ঠিক নয় । তবে ? দুধ বিস্কুট? …এ্যাই, রামচরণ….লে আও জল্দী সে….হুকুম হয়ে গেল। আমার তখন খাবার ইচ্ছেই করছিলো না কিছু। তাঁরা তা শুনলে তো। আর সবাই তখন ভোজুডিহতে নন স্টপ সুপারফাস্ট থ্রু ট্রেনের রেড সিগন্যাল পেয়ে বাধ্য হয়ে দাঁড়ানো নিয়ে খুব কথায় ব্যস্ত।
তা আমি কি আর করি? অনিচ্ছাসত্বে ও দুধ বিস্কুট খেয়ে বসেই আছি। পাঁচটা বাজলো। কই কাকু তো আসছেই না ছাই। পুলিশগুলো অবশ্য আমাকে সমানে বলে যাচ্ছে-‘বেটা, ডরো মৎ, ধানবাদ কা সিগন্যাল হো গিয়া….’
কাকু কি পুরুলিয়ায় আমার বাপী যে পুলিশ অফিসার তা বলেছে? মনে হয় না । তবে বেশী কিছু হ’লে ঠিক বলবে….।
পাঁচটা দশ।
দূরে জাগলো জোর হুইশেলের শব্দ।
আসছে …..টাটানগর ধানবাদ এক্সপ্রেস…আমি বেরিয়ে এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালুম…
বেগে এসে সশব্দে থামলো এক নম্বরে ট্রেন। দেখি যে কাকু লাগেজ নিয়ে নেমে এলো ইনভ্যালিডদের কামরা থেকে। ইঞ্জিনের পরেই যেটা লাগানো থাকে। বুঝলুম ট্রেন ছাড়বার ঠিক আগে কাকুকে তুলে দিয়েছে। আমি ‘কাকুউ’… বলে দৌড়ে গিয়ে কাকুকে জড়িয়ে ধরলুম।
তবে আমার প্রথম প্রশ্নই হ’লো-‘কাকু, তোমার ট্রেন কখন ছেড়েছিলো?’
‘তিনটেয়….সাড়ে তিনটেয় অনারা…চারটেতে আদ্রা…..চল্লিশ মিনিট পরে ছেড়ে সোজা সাঁওতালডিহ….চারটে পঞ্চান্ন…..আর সোয়া পাঁচটায় এইখানে……কেন?’
‘না এমনিই, কাকু……………দু’ঘন্টা পনেরো মিনিট থেকে পঞ্চান্ন মিনিট বা স্টপেজ টাইম আর আদ্রা অবধি উল্টোপথে যাওয়া এই সব নিয়ে একঘন্টা পঁচিশ মিনিট বাদ দিলে তোমার আসতে সময় লেগেছে মাত্র পঞ্চাশ মিনিট। তাও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছে তোমার ট্রেন সাঁওতালডিহতে…. আর অনারা হয়ে নন স্টপ সোজা এই অবধি আসতে দু’ঘন্টা লেগেছে আমার গাড়ির বেলায়……পথে খুব জল ছিল তো তাই…’
কাকু শুনে যেন আকাশ থেকে ধপাৎ করে একেবারে মাটিতে এসে পড়লো। বিস্মিত হয়ে বললো--‘জল? কিসের জল? কোথায় জল, চঞ্চল? পথে তো কোথাও জল ছিল না। নইলে আদ্রা থেকে প্রায় একঘন্টার জায়গায় মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিটে ট্রেন চলে আসতে পারে? অবশ্য দারুণ স্পীডে এসেছে আমার ট্রেন কিন্তু তুমি যে কি বলছো চঞ্চল, আমি তো তাই বুঝছি না.’
‘থাক, ও সব কথা পরে হবে, কাকু। এখন তুমি ওই পুলিশ গুলোকে সামলাও আর কি করবে তা ঠিক করো’।
‘তা কাকু পুলিশদের ধন্যবাদ দিতে যেতেই আবার চা এসে হাজির। জানা গেলো ছ’টায় চোপন প্যাসেঞ্জার আসবে। তবে সে গাড়ী পুরুলিয়া যাবে না। আদ্রায় বদলাতে হবে ট্রেন। কাকু ভায়া আদ্রা পুরুলিয়ার দু’টো টিকিট কেটে নিলো আঠারোর বদলে সাড়ে তেরো টাকা দিয়ে। দু’নম্বরে গাড়ী আসতে পুলিশেরাই লাগেজ বয়ে এনে আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে নমস্কার করে ও কাকুর ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে নেমে গেলো।
আর সব ছোট ছোট স্টেশনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ট্রেন আটটায় এসে আদ্রায় থামতে আমরা ও নেমে পড়লুম। তবে পথে কোথাও যে লাইন ডুবে নেই জলে তা আমি অন্ধকারে ও বেশ বুঝতে পারলুম গাড়ির চাকার জোর শব্দে। একবার ও সেই শব্দ কমলো না অথচ যাবার সময়ে দিনের আলোয় আমি নিজের চোখে দেখেছি যে…………. ওঃ কি কান্ড? সে.যাক গিয়ে…… তবে নেমে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো যে পুরুলিয়ার ট্রেন ন’টা পঁয়তিরিশে আসবে। আর রঘুনাথপুর না গেলে আদ্রায় কোন থাকবার হোটেল ও নেই। সাত আট কিলোমিটার পথ অন্ধকারে যাওয়া ঠিক নয় আর ঠান্ডা ও বাড়ছে বেশ।
‘ও কাকু, এখানের এই চারধার খোলা ওয়েটিংরুমে এই ঠান্ডায় রাত ভোর তো থাকাই যাবে না আর রাত সাড়ে দশটার পরে পুরুলিয়ায় পোঁছেই বা তুমি কি করবে? তোমার মহামায়া লজ কি তখন খোলা থাকবে, কাকু?’
‘হুম….বেশ ভালো এক ফ্যাসাদ হয়েছে দেখছি। আদ্রা পাহাড়ী জায়গা। রাতে এখনই খুব ঠান্ডা পড়বে। তবে চলো দেখি রিক্সা নিয়েই যাই…...’
‘ওভারব্রিজ পার হয়ে নেমে কাকু রিক্সা খুঁজছে, দেখি হঠাৎ কে একজন সাদা চাদর মুড়ি দেওয়া লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে মনে হ’লো খুব চাপা স্বরে বললো-‘ওই যে….ওই দোকানে যাও……………..’
আর বলেই সে হন হন করে এগিয়ে চলে গেল যেন খুবই সে ব্যস্ত।
আমার কৌতুহল বাড়লো। এগিয়ে গিয়ে দেখি যে সেটা একটা খাবার হোটেল। আমি থাকবার হোটেল কোথাও পাবো কি না তাই জানতে চাইতে দোকানদার মাথা নেড়ে বললেন-‘না ভাই। আর তার দরকারই বা কি? তোমরা এ’খানে এসে বসে খেয়ে দেয়ে নাও আগে তারপরে রিক্সা ধরে সম্রাট কম্যুনিটি হলে চলে যাও। রিক্সায় বিশ টাকা ভাড়া নেবে। এখন তো বিয়ে থা কিছু নেই …. হল ফাঁকাই পড়ে আছে। ভাড়া হয়তো শতখানেক বেশী চাইবে, তা রিক্সা করে রঘুনাথপুর যেতে ও তো সেই টাকাটা লাগবে আর পথ ও ভালো নয় আর অন্ধকার। বিশেষকরে রাতে না যাওয়াই ভালো। মোটরগাড়ী থাকলে সে কথা অবশ্য আলাদা…’
আমি কাকুকে ডাকলুম-‘ও কাকু, এদিকে চলে এসো….’
কাকু এসে বললো-‘নাঃ….রাজী হয় না কেউ এতো রাতে অতদূরে যেতে…’
‘তার দরকার ও নেই, কাকু । তুমি এখন এ’খানে বসে খাবে না প্যাক করিয়ে নেব খাবার, তাই বলো …’
‘তা প্যাক করিয়ে নিলেই হয়তো ভালো হয়। সারাদিনে হাতমুখ ও তো ধোওয়া হয় নি আমাদের… .’
‘আংকল, দু’টো খাবার প্যাক করে দিন। নিয়ে যাবো। পঞ্চাশ টাকা তো?’
‘হ্যাঁ….’
‘এই নিন…..’
খানিকক্ষণ বসে থেকে খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে আমি বললুম-‘এইবার চলো, কাকু.’
‘কোথায় যাবো, ও চঞ্চল?’
‘রাতের আশ্রয়ে……আর কোথায়? হিঃ….হিঃ….হিঃ…..এখনই যা শীত বাড়ছে না কাকু, তুমি এসো.’
একজন রিক্সাওয়ালাকে দেখতে পেয়েই আমি ডাক দিলুম-‘ও আংকল, যাবে?’
‘কোথায়?’
‘সম্রাট হলে.’
‘যাবো, তবে তিরিশ টাকা লাগবে…’
‘হুঁ….সব্বাই দেখি সুযোগ সন্ধানী…………….আচ্ছা চলো………….জিনিষ তোল আগে.’
কাকু চুপ।
ভাদু পূজোর এক বড়ো প্রসেশন চলেছে রাস্তা দিয়ে। ভীড়কে পাশ কাটিয়ে সোজা চলছে রিক্সা। অনেকক্ষন পরে ডানদিকে ঘুরলো। অনেকটা পথ চলে আবার ডানদিকে….আবার বাঁদিকে…..সারা পথই অন্ধকার। তবে টাউনের মধ্যে আছি বলে জীব জন্তুর ভয় নেই। এই যা রক্ষে। তবে রঘুনাথপুর বা কাশীপুর যেতে হলে সে ভয় ও বেশ থাকতো মনে হয়…..।
অবশেষে পৌঁছানো গেল।
রিক্সাওলার ডাকে কেয়ার টেকার এসে গেট খুললো। ঘর চাই শুনে বললো-’ঘর? তা আছে। পাবেন। তবে তিনতলায়… আর তিনশো টাকা ভাড়া….একখানা আই ডির কপি ও চাই কিন্তু……’।
কাকু বললো-‘ও ঠিক আছে। তবে জিনিষগুলো একটু তুলে দিতে হবে, ভাই। কেননা সিঁড়ি ও তো দেখছি অন্ধকার। আমি টর্চ ধরছি…’
গিয়ে দেখি খুব বড় জানলাওলা ঘর। দু’টো টিউব লাইট জ্বলছে। তবে আলাদা বাথরুম কিন্তু অন্য ঘরে আর কেউ নেই বলে তা আমাদেরই হয়ে গেল। লম্বা বারান্দা ও বসবার লাউন্জ ও আছে।
হাত মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে দেয়ে নিয়ে কাকু বললো-‘দোকানদার তোমাকে এই হলের সন্ধান দিয়েছে তা তো বুঝলুম কিন্তু তুমি হঠাৎ গেলেই বা কেন ওই দোকানটায়?’
আমি সব বললুম।
শুনে কাকু বললো-‘নাঃ, রহস্যটা ঠিক ধরতেই পারছিনা তো। বাধা গুলো যেমন আসছে তেমনই সাথে যেন কেউ অদ্ভূতভাবে আমাদের সাহায্য করছে বলে মনে হচ্ছে। প্রথমে, অত জল………..এলো কোথা হতে? আর আধঘন্টায় সে জল যায়ই বা কোথায়? মানলুম না হয়…যে তুমি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই জলের স্বপ্ন দেখেছো চঞ্চল…. কিন্তু তোমার গাড়ীর স্পীড যে কোন কারণে খুবই কমে গিয়েছিল তা ঠিক নইলে আমাকে গোমো ছুটতে হ’তো। আর ফেরা ও যেত না তখনই…..সেই কারণটা কি? আর ওই লোকটাই বা কে? পুলিশ, চেকার ও গার্ড অতো খাতিরই বা করলো কেন? আর শুধু খাতির? এক্কেবারে ভোজুডিহকে রেড সিগন্যালের অর্ডার দিয়ে দিলো? আমি তো আমাদের পুরো পরিচয় ও দিই নি। নাঃ থাক, এখন দেখছি চট করে কম্বল সম্বল না করলেই নয়…বড্ড ঠান্ডা বাড়ছে ….’।
‘তা ও চঞ্চল,…..শোন…. এই ঠান্ডায় আর তোমাকে এখন জামা প্যান্ট ছেড়ে শু’তে হবে না। চলে এসো কম্বলের আশ্রয়ে সোজা…. ‘
‘সকাল ন’টায় ট্রেন ধরে কালই যেতে হবে আবার পুরুলিয়ায়। কেননা আয়োজন তো কালকেই। তবে আদ্রা স্টেশনের কেক আর আলুর ঝালবড়া বিখ্যাত। কাল কিনে নিয়ে গাড়িতে ওঠা যাবে…’।
জামা প্যান্ট সব পরে শু’লে আমার ঘুমই আসে না, কাকু তা বেশ জানে। তবে শীতের ভয়ে কাকু যে এখন আমাকে বাইরের পোষাক খুলতে বারণ করছে তা আমি বুঝি। বিদেশ বিভুঁই জায়গা…. তায় পাহাড়ী….শেষ রাতে এ’খানে খুবই ঠান্ডা পড়ে….জামা সোয়েটার সব পরা না থাকলে আমার ঠান্ডা তো লাগতেই পারে।
তা শীতকালে বাইরে কোথাও গেলে কাকুর সাথে ওয়াটার ও রুম হীটার দু’ই থাকে, মনে পড়তেই আমি বাথরুম থেকে ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে এসে রুম হীটারটা বার করে প্লাগ লাগিয়ে দিয়ে সেটা অন করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম।
পনেরো মিনিটেই ঘর বেশ একটু গরম হ’তে তখন আমার দামী পোষাক গুলো সব একে একে ছেড়ে রেখে কাকুর খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। কাঠ লাগালো ফোল্ডিং সিঙ্গল খাট… তবে ঘরে দু’খানা খাট ছিলো। থাক গিয়ে।
বললুম-‘রুম হীটারটা চলুক, কাকু….তা হ’লে আর শীতের ভয় থাকবে না বেশী’।
কাকু বললো-‘নাঃ….দেখছি লাগেজ বাড়বে এই ভয়ে ডাবল স্লিপিং ব্যাগটা না এনে আমি খুব ভূল করে ফেলেছি’।
এখন দু’হাতে কাকুকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তি হয়ে একটু ঘুম দিয়ে তো নিই। সারাদিন যা ঝামেলা গেলো না…আজ। সত্যি বাবা….এই সব কান্ডকে উঃ….উঃ…ছাড়া আর কি যে বলা যায়, তাই তো জানি না আমি?
কাকু পরদিন ঠিক ভোরে উঠে তৈরী হতে শুরু করলো। কাকু আগে জল গরম করে সকাল সকাল আমাকে চান টান সব করিয়ে জলখাবার খাইয়ে দিয়ে, নিজে তৈরী হয়ে নিলো আর জিনিষপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলো। রিক্সাওলাকে আসতে রাতেই বলে দিয়েছিল, কাকু।
তাই টিকিট কেটে নিয়ে গিয়ে দিব্যি ন’টার ট্রেনটা কাকু পেয়ে গেলো।
একঘন্টায় পুরুলিয়া।
আমরা স্টেশনের বাইরে আসতেই দেখি এক ছোকরা রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। সে জানতে চাইল-‘বাবু কি চিতকায়….মানে জে কে কলেজ যাবেন? আমাকে বলা আছে। তা আসুন……….’
‘তোমার ভাড়া?....’
‘সে আপনার দিতে লাগবে না। আগাম দেওয়া আছে।.’
‘আমরা না হয় মহামায়া বা নতুন তৈরী ওই মহেন্দ্র লজেই উঠি। স্টেশনের কাছেই তো ছিল। চিতকা তো অনেকটা দূরে’।
‘আবার সেই যাতাযাতের ঝামেলা থাকবে? আর একটা গোটা বাড়ীই ভাড়া করা আছে তো। রুম ও সব অ্যাটাচড বাথ….সে তুলনায় অতিথি তো মোটেই পাঁচজন। আবার অন্যত্র থেকে কি হবে? জলখাবার ও খাবার ব্যবস্থা ও করা আছে। দেখে নিয়ে….তখন যা বলবেন…করা হবে’।
মহামায়া লজ ছাড়িয়ে রিক্সা চলছে তো চলছেই। একটা সাতবাঁধ না কি নামের বড় জলাশয় পার হয়ে আর ও অনেকটা গিয়ে পড়লো কলেজ। কলেজ ছাড়িয়ে খানিক দূরে আমাদের আস্তানা।
তা সে ঠিকই বলেছিল। আপ্যায়নের এমন নিঁখুত ব্যবস্থা আর কোথাও দেখিনি আমি। তবে শুধু কাকুর বন্ধুরই যা দেখা নেই…হয়তো কাজে ব্যস্ত খুব……।
বাথরুমে গীজার অবধি দেখি লাগানো আছে। তখন কি আর আমরা জানি যে এই সুন্দর বাড়িটাই সংস্থার হেড অফিস। পাশের যে বাড়িটার বিরাট লনে স্টেজ তৈরী হচ্ছে সেইটাই বরং ভাড়া নেওয়া।
তা আমরা যাওয়া মাত্র তিনজন ভলেন্টিয়ার এসে নাম জিজ্ঞেস করে রুম কার্ড ও চাবী দিলো আর জিনিষ নিয়ে পৌঁছে ও দিলো ঘরে। মিনারেল ওয়াটার দিয়ে গেলো দু’বোতল। দশ মিনিটে আমাদের জন্য চা জলখাবার ও হাজির। কি যে সুন্দর ব্যবস্থা? যেন আমরা কোন ভিআইপি।
প্রোগ্রাম কার্ড একটা নীল ফোল্ডারে ভরে ঘরের টেবিলের ওপরে রাখা ছিলো। সাথে একটা রাইটিং প্যাড আর ঝকঝকে কলম ও ছিল। প্রোগ্রামে দেখি….দুপুর দু’টোয় মধ্যাহ্নভোজন থুড়ি লাঞ্চ ……… সাড়ে চারটেয় হাই টি….রাত সাতটা থেকে ফাংশান…. ন’টায় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আর দশটায় ডিনার…..
জানা গেলো যে বিকেলের দিকে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইলে একখানা ইন্ডিকা গাড়ী তৈরী আছে। সে’টায় অবশ্য পেতলের ঝকঝকে বোর্ড লাগানো আছে---সভাপতি….। আমি সে আগেই দেখে নিয়েছি। মনে হয় গাড়িটা কাকুর বন্ধুর।
তাই বিকেলে এক চক্কর ঘুরে নিলুম আমরা।
তারপরে প্যান্ডেলে।
সামনের সারিতেই সোফায় বসানো হ’লো আমাদের। প্রায় আধঘন্টা দেরী করে মন্ত্রী মহোদয় এলেন….সিকিউরিটি এলো….মিডিয়া এলো… ভিডিও ক্যামেরা চালু হ’লো জোর আর্ক লাইট জ্বেলে।
খুব ঘটা করে উদ্বোধন হ’লো মালা জড়ানো বড় মঞ্চ প্রদীপ জ্বালিয়ে।।
সংঙ্গীতে বাজনায় আলোয় ফেস্টুনে মঞ্চ সরগরম। অতিথি সন্মান হ’লো। উদ্বোধনী ও কয়েকটা সঙ্গীত ও বাজনা, একটা নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও সব শেষে পাঁচজন সাহিত্যিককে শাল, শ্রীফল মানে একটা গোল নারকোল, সন্মানপত্র, পুষ্পগুচ্ছ, স্মৃতিফলক, সন্মান প্রমাণপত্র আর পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে সন্মানিত করলেন মন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং।
খুব ফটো উঠলো ও ভিডিও করা হ’লো। লোকাল টিভি চ্যানেলের রেকর্ডিং ও টেলিকাস্টিং… সব মিলিয়ে সে দারুণ ব্যাপার হ’লো একখানা।
মঞ্চের শেষ আসনে যিনি বসেছিলেন, আমার একবার যেন মনে হ’লো যে তিনিই হয়তো কাকুর বন্ধু হবেন…..তা আমার তো সবই অনুমান।
তেমনি আর ও মনে হ’লো যে …কাকু যে শালটা পেলো সেটা অন্যদের থেকে বেশ একটু আলাদা গোছের ……মানে হয়তো সে’টা কাশ্মীরী… মানে আকাশী রঙের পশ্মীনা আর কাকুর হাতে সেলোফেনে ঢাকা লাল ভেলভেটে মোড়া স্মৃতিফলকের ওপরে যে বড় গোল টিপটা লাগানো ছিল, সেটা ও অন্যদের মতন ঝকঝকে সাদা নয়, এক্কেবারে হলদে। এখন সাদা কি স্টীল…. আর হলদে কি পেতল? তাই তো মনে হয় হওয়া উচিৎ…। তা কে জানে বাবা? আর তা যদি না হয়? তো?……….কি হতে পারে? সাদা…সাদা যদি রুপো হয় …তবে হলদে? হলদে কি সোনা?
আর ও ভাবলুম –‘আচ্ছা, আমরা ও যদি লোকদের ডেকে এনে…..এমনি করে প্রাইজ দিই? তখন……’?
তা আমার তো অমন কত কিই মনে হয়। সে কথা যাক। কাকুর বন্ধু আংকলকে পেলে ঠিক জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু মন্ত্রীমশাই ভাষণ দিয়েই চলে গেলেন আর সিকিউরিটি ও। ফাংশন চলছিল। হঠাৎ দেখি সেই চাদর মুড়ি দেওয়া অদ্ভূত লোকটা। দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে।
‘কি বলছো, আংকল?’
ইসারায় সে তক্ষুণি আমাকে স্থান ত্যাগ করতে বলেই সরে পড়তে আমি ভয়ে ভয়ে কাকুকে ডাকলুম।
‘কাকু.?’
‘কি?’
‘আমাদের রুমে এখন একটু যাবে?’
‘কেন? ওঃ বুঝেছি…তা চলো। আমার হাতের এই আপদগুলোকে ও রেখে আসি আমি। এসো…’
আমরা নিজেদের ঘরে এলুম। কাকু দরজা খুলে আলো জ্বেলে দিয়ে বললো-‘যাও চঞ্চল, বাথরুমে যাবে তো?’
‘আমি বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরুমে গিয়েই বলে উঠলুম-‘কাকু দেখো, নেই তো’।
‘কি নেই, চঞ্চল?’
‘বাথরুম পরিষ্কার করবার অ্যাসিডের বড় শিশিটা। কি যে নাম?’
‘হয়তো জমাদার এসে নিয়ে গেছে, চঞ্চল…’
‘তাই বুঝি? কিন্তু নিলো কখন? সকালে তো আসেই নি জমাদার । আর তারপরে তো ঘর তালাবন্ধ ছিলো, কাকু?’
‘আরে বাবা, অন্য চাবী থাকেই ওদের জন্য রিসেপসানে। নইলে ঘর পরিষ্কারই তো করা হবে না । তুমি নিজের কাজ সেরে চলে এসো’….।
আমি তাই করলুম। আর তখনি হঠাৎ নীচে গুড়ুম….গুড়ুম দুম…দমাস …. করে দারুণ সব শব্দ শুরু হ’লো। কিসের শব্দ রে বাবা? বাজী পুড়ছে না কি? কই প্রোগ্রামে তো সে’কথা লেখা ছিলো না। তবে?
‘ও কাকু? ও কিসের শব্দ? বাজীর?’
‘মনে হয় না’।
‘তবে?’
‘মনে হয় বন্দুকের গুলী আর গ্রেনেডের শব্দ। আমি ব্যাপারটা কিছু ভালো বুঝছি না, চঞ্চল। আমাদের সব কিছু ওই গা আলমারিটায় ঢুকিয়ে কম্বিনেশন লকটা আটকে দিই না হয়। হয়তো মঞ্চে বা এই বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। এই স্মৃতিফলকগুলো হয়তো খুব দামী…পেতলের নয়। কে জানে?... .’
কাকু তাই করলো।
হঠাৎ নিচে থেকে আবার বহুলোকের আর্তনাদ…দারুণ চিৎকার শোনা গেলো।
‘ও আবার কি, কাকু?’
‘মনে হয় বহুলোক পালিয়ে যাচ্ছে বিষম যন্ত্রনায় দারুণ চিৎকার করতে করতে। এ কী রহস্য আমি একবার গিয়ে দেখে আসি। তুমি ঘরেই থাকো। আমি এসে ডাকলে তবে দরজা খুলবে। তোমার সিকিউরিটি গার্ড বালাটা হাতে পরে নাও, চঞ্চল’
কাকু বেরিয়ে গেলো আর আমি সুট বুট টাই সান গ্লাশ সব পরে বসে রইলুম ঘরে।
কাকু ফিরলো প্রায় আধঘন্টা পরে।
‘কি হয়েছিলো, ও কাকু?’
‘সত্যিই ডাকাত এসেছিল, চঞ্চল।.’
‘সর্বনাশ….তা ‘কি ডাকাতী করলো, কাকু?’
‘একটা মাত্র ছেলে…’
‘ছেলে?’
‘হুঁ, তুমি উঠে এলে সে তোমার জায়গায় গিয়ে বসেছিল। তাই মনে হয় ভূল করে…’
‘তার মানে, কাকু?’
‘মানে আর কি? চঞ্চল অপহরণ পন্ড….তবে ভলেন্টিয়ার ছেলেগুলো বাহাদূর বটে। তারা তখন জনা বারো মিলে কাচের গ্লাশে করে মিনারেল ওয়াটার পরিবেশন করছিলো অতিথিদের। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ও চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকাতদের কাছে চলে যায় বন্দুকের মুখে ও তারা মাথা ঠিক রেখে। তারপর তারা একসাথে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সেই জল একে একে ডাকাত গুলোর মুখে ছুঁড়ে দেয় আর তারা ওই রকম বিকট চিৎকার করে অন্ধের মতন যে যেদিকে পেরেছে দে দৌড়..’
‘শুধু জল?’
‘হুঁ…’
‘তুমি কি সেই জায়গাটা একটু পরীক্ষা করেছো, কাকু? জল তো কিছুটা মাটিতে ও পড়েছেই…’
‘হয়তো….তবে তা এখন শুকনো মাটিতে পড়ে গেছে শুকিয়ে… অবশ্য আমি শুঁকে খুব ঝাঁঝালো মতন একটা গন্ধ পেয়েছি মাটিতে।’
‘কাকু……ওটা তবে জল নয়….’
‘তবে কি, চঞ্চল?’
‘অ্যাসিড………….ট্রে তে নির্ঘাৎ দু’রকম জল সাজিয়ে নিয়ে গেছিল.….’
‘হুম। পদে পদে বিপদ দেখছি এ’খানে। তবে এই ভাবে ওরা তৈরী ছিল, তা হয় কি করে, চঞ্চল?’
‘কেউ যদি আগেই সব জানিয়ে দেয় তো হবে না কেন, কাকু?’
‘সে কে, চঞ্চল?’
‘তা তো আমি জানি না, কাকু। যে আমাকে তখন হঠাৎ এসে সরিয়ে দিলো, হয়তো সেই। আমার কিন্তু তখন বাথরুম পায়নি, কাকু’।
আমি কাকুকে সব বললুম। কাকু শুনে বললো-‘হুম, দ্বিতীয়বার হ’লো এই নিয়ে। লোকটা কে রে বাবা? থাক…আমি ডিনারে যাবো না আর তোমাকে নিয়ে রাতে। ঘরেই ডিনার আনাবো। এখন কাল মানে মানে সকাল হলেই পালাতে পারলে বাঁচি। যদি ও ফেরবার টিকিট কাল নেই। তা ধানবাদেই চলে যাবো না হয়….ওরে বাপ রে…..যত্তো সব মানুষমারা কান্ড….কিন্তু ওই ছেলেটা……’।
‘ও নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, কাকু………..ডাকাত গুলো সব অন্ধ হয়েই গেছে হয়তো …..তাই.’
তা রাত দশটায় খাবার জন্য আমাদের ডাক এলো। কাকু যাবে না বলে দিতে তারা বলল-‘ঠিক আছে, ঘরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনাদের জন্য খাবার’।
আমরা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বার আগে বারান্দায় একটু পায়চারী করছিলাম। দেখি এককোনে সাত আটটা বড় বড় মুখ বন্ধ জলের জেরিকেন রাখা আছে। মনে হয় বাথরুমের জল কম হ’লে বা বন্ধ হয়ে গেলে এটা বৈকল্পিক ব্যবস্থা।
তবে দেখেই কাকু বললো-‘হুম, আবার জল, চঞ্চল। এও যে ছাই কোন জল মানে এই জলের যে কি গুণ আবার, তা ভগবান জানেন’।
আমি বললুম-‘আমাদের তো কাল টিকিট নেই, কাকু। পরশু। ধানবাদ গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। সে’খান থেকে গঙ্গা সতলজ ছাড়ে সাড়ে নটায়। তেঁতুলমারি আর গোমো হয়ে বেনারস যায়। এখন চলো শুয়ে পড়ি গিয়ে, কাকু’।
‘তাই চলো। তবে আমাদের রাতে একটু সতর্ক থাকতে হবে। তোমার কোট প্যান্ট টাই খোলো কিন্তু আর সব জামা টামা গায়েই থাক। হঠাৎ পালাবার দরকার পড়লে তখন আর জামা পরবার সময় ও জুটবে না’।
আমি তাই করলুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। কেমন অস্বস্তিতে ঘুমের চটকাটা হঠাৎ ভেঙে গেল।
খুট…..খুট….খুট……..
‘কে?’
‘আমি …অবিনাশ…’
‘এতোক্ষণে তোর আসবার সময় হ’লো রে হতভাগা গাড়োল? এই রাত দুপুরে?’
‘হুঁ….আর সময় পাবো না তো, তাই। তোর কোন ভয় নেই…দরজা খোল…আঃ আলো জ্বালাস না।.’
‘কেন রে?’
‘আমার কষ্ট হয়। মানে….ওরা আমাকে মে….মানে মেরেছে খুব’
‘ওরা কারা?’
ওরা সব উগ্র সন্ত্রাসবাদী। থাক, ছেলেটাকে আর এখন জাগাস না। শোন… আমাকে এই সংস্থা না খুলে চাঁদার সব টাকাগুলো ওদের ফান্ডে দিয়ে দিতে বলেছিলো। খাবার, পোষাক, গুলী গোলা, বন্দুক, গ্রেনেড এই সব কিনতে ওদের কাজে লাগবে। সরকার ওদের সব কিছু নাকি ব্যান আর সীজ করে দিয়েছে তাই জনগণকেই এখন ওদের সাহায্য করতে হবে। এমনকি নিজের বাড়িতে আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে আশ্রয় ও দিতে হবে ওদের পুলিশের কম্বিং অপারেশনের সময়। আমি রাজী হই নি। ফল যা হবার তাই হয়েছে..’
‘তার মানে?’
‘মানে পরে শুনবি। আমার সময় কম। শোন…..আমার অবর্তমানে তোকেই কিন্তু সভাপতি হয়ে আমার সংস্থাটাকে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। এটা কিন্তু তোর দায়িত্ব। আর আমার জেদ….জানিস তো….আমি অবশ্যই সাহায্য করবো তোকে। তোর কোন অসুবিধে হবে না। শুধু সই টই গুলো করে দিবি আর টাকা তোলা …জমা দেওয়া…..আমার এই বাড়ি গাড়ী ব্যাংকের টাকা সব তোর নামেই থাকবে। কমিটির মিটিংয়ে সব ডিসিসান নেওয়া হয়ে গিয়েছে, এই মাসেই। আমার তিনজন বিশেষ ভলেন্টিয়ার আছে। তারা তোদের দেখবে আর বাঁচাবে। কাল সকালেই উপ সভাপতি উকিলবাবুকে নিয়ে আসবেন। তিনি যা বলবেন সব করবি মানে সই টই আর কি? কাল সব কাজ হয়ে গেলে পরশু তুই ধানবাদের ট্রেন ধরতে পারবি। এ’খানে রেজিষ্ট্রি অফিস কাছেই আছে তবে তোকে যেতে হব েনা, রেজিষ্ট্রার নিজেই আসবেন। তোকে ইনভ্যালিড শো করে….কাল তোকে কোথাও যেতে হবে না’….
‘আর তুই?’
‘আমাকে আগে ও’দের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। হিসেব বাকী আছে…রে…আমি এখন যাই। অবশ্য কাল সব বেহাত হয়ে গেলে ওরা হয়তো একবার আবার আসবে। তা আসুক। তুই যেন ভয় পাস না। আর তোর ছেলেটা তো খুব স্মার্ট আর সুন্দর। বেশ সাহসী ও। অন্য ছেলেদের মতন একটুতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে না। …আমাদের ভবিষৎ কালের সভাপতি….তখন এটা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন হয়ে যাবে। সে যাক….এখন আমি গিয়ে সেই অপহৃত ছেলেটার খোঁজ করে নিয়ে আসছি। মনে রাখবি জলই জীবন আর তার নানা রূপ। আচ্ছা …বাই’.
‘আরেঃ………….তুই এখন থাকিস কোথায় নিজের বাড়ী ছেড়ে?’
‘সা…ত…বাঁ…ধ….’ ক্ষীণ স্বর শোনা গেল বাইরে থেকে।
আমি চমকে উঠলুম কথাটা শুনে। সব রহস্য যেন জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল হঠাৎ আমার চোখের সামনে আর আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবে খুব ভয় ভয় করতে লাগলো আমার তখন। শুনলুম কাকু দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসে শুয়ে পড়তে পড়তে নিজের মনেই বিড় বিড় করে বলছে-‘ব্যাটা পাগলা….বলে কি না থাকে সাতবাঁধে… উঃ….উঃ…...’
তা পরের দিন আমরা কোথাও গেলুম না। অবিনাশ আংকলের কথা মতন সব কাজ হয়ে গেলো। তিনজন ভলেন্টিয়ার বাড়ীর মধ্যে ছিলো। অন্যেরা বাইরে। প্যান্ডেল ও ক্যাটারিংয়ের লোকজনদের সামলাচ্ছিল। সন্ধ্যেবেলায় তারা সব বিল নিয়ে এসে কাকুকে বললো-‘চেক রেডী স্যার। আপনার নাম ও সই ব্যাংকে চলে গেছে। আপনি এখন চেকগুলোতে সই করে দিতে পারেন। পেমেন্ট হয়ে যাবে। আর কাল আপনারা অন্য মানে সভাপতির নিজস্ব কারে নয় রেন্টাল কারে ধানবাদ যাবেন। তার জন্য ও চেক তৈরী………….’ কাকু সব সই করে দিলো। বেশ কয়েক হাজার টাকার বিল ছিল।
আমাদের রাতের খাবার ও ঘরে এসে গেল। কাকু আর আমি খেয়ে নিয়ে বারান্দায় গেলুম একটু পায়চারী করতে আর গিয়েই আমি লাফিয়ে উঠে বললুম-‘কাকু, দেখো… নেই…’
‘কি নেই, চঞ্চল?’
‘সেই জলের জেরিকেন গুলো? কোথায় গেলো?’
‘আরেঃ…..সে তো থাকবেই না। অতিথিরা তো সব চলে গেছেন আজ। আর তাই ক্যাটারার ও জল ফেলে দিয়ে জেরিকেনগুলো নিয়ে গেছে। এতে তুমি আশ্চর্য হচ্ছো কেন, চঞ্চল?’
আমি চুপ………..তবে ও’গুলো হয়তো জলই ছিলো।
আমরা ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম।
একটুক্ষণ পরেই আমি ঘুমিয়ে ও পড়লুম।
রাত তখন অনেক হবে।
হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো। কেন, তা বুঝলুম না। কেউ কি ঠেলে দিলো আমাকে?
সঙ্গে সঙ্গে দুড়ুম করে একটা শব্দ হতেই কাকুর ঘুম ও ভেঙে গেলো।
‘উঃ………..ও কিসের শব্দ রে বাবা?’
‘মনে হয় বোমার…….কাকু’।
‘তার মানে?’
‘আমরা আক্রান্ত হয়েছি, কাকু। আজ ওরা মরিয়া হয়ে এসেছে। আমাদের ছাড়বে না।.’
সর্বনাশ…….তাহ’লে এখন উপায়, চঞ্চল? আমরা নিজেদের ঘরেই এখন বন্দী?’
‘আমাকে কিছু আর বলতে হ’লো না। ভীষণ দুম দাম দমাস গুড়ুম ধাঁই……..শুরু হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে হো…হো….চিৎকার….গোটা বাড়ী ঘিরে ফেললো। আমাদের ভলেন্টিয়াররা তখন কোথায় আর কি করছে তা কে জানে?
অনেক লোক মিলে দুম দাম দমাস করে দারুণ শব্দে তখন আমাদের বাড়ীর সদর দরজা ভাঙছে……
হঠাৎ কোথায় খুব মৃদু ঘর ঘর শব্দ করে পাম্পের মতন কি যেন চলতে শুরু করলো…আর অতি ক্ষীণ ঝর ঝর শব্দ করে জল পড়া ও শুরু হয়ে গেলো দূরে কোথাও।
মনে হয় বাইরে জল পড়ছে ছাদের ট্যাংক ভরে গিয়ে। কিন্তু এতো রাতে জলের পাম্প চালাবে কে? আর কেনই বা?
আমি জানলায় গিয়ে দাঁড়ালুম বাইরে কত গুলো ডাকাত এসেছে আর জল কোথায় পড়ছে তাই দেখবো বলে। তা আমি কি সহজে যেতেই পারি ছাই? কিসে যেন পা আটকে গেলো আমার আর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লুম।
বাদলের মতন তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে এসে আমাকে কাকু ধরে ফেললো তাই পড়ে গিয়ে আমার নাক মুখ আর কিছু ভাঙলো না। তবে কাকু আমাকে নিয়ে মাটিতেই বসে পড়লো ধপ করে আর তখনি গুড়ুম….
শার্শি ভেদ করে একটা লাল মতন আলোর ঝলক অন্ধকার ঘরে ঢুকে ফটাস করে সামনের দেওয়ালে লাগলো আর ঝড়াং করে খানিকটা দেওয়ালের প্ল্যাস্টার খসে পড়লো।
‘ওরে বাবা। এখন আমি কি করি? ওদের বন্দুক একেবারে তৈরী যে ।অন্ধকারেও ছায়া দেখে গুলী করছে। ও চঞ্চল……’
‘কাকু, ওদের বন্দুকে মনে হয় অত্যাধুনিক ইন্ফ্রা রেড টেকনোলজী লাগানো আছে। তাই…..’
দূরের ঝর ঝর শব্দটা তখন যেন খুব কাছে এসে গেছে। দরজাটা তখন ও আস্তো আছে দেখে কেউ যেন একটা বোমা ছুঁড়ল।
দুড়ুম…..ধাঁই…………জোর আলোর ঝলক জাগলো বাইরে।
হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো দরজা আর বাইরে সেই সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন….প্রলয় বহ্নির মতন…………..দেখতে দেখতে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো চারদিকে।
তখনি এক বিকট আর্তনাদ শোনা গেল---‘এ….এ কী? আরে ভাগ….ভাগ…………এ তো পানী নয় রে…… এ শালা জরুর পেট্রোল আছে……আমরা ভাবলুম বারিষ হচ্ছে…… তা একটু হোক গিয়ে। ধ্যানই না দিয়ে ভিজে মরেছি…..তবে এই শালার পেট্রোলের গন্ধ নেই কেন রে? কি মিশিয়েছে শালে লোগ এতে তা কে জানে? ন্যাপথা না এল্কোহল. না কী? আরেঃ যাঃ…..গেল সব আজ…..আমাদের দূরে লুকিয়ে রাখা আটটা গাড়িই যে ও’দিকে জ্বলে উঠেছে রে….আমরা এখন পালিয়েই বা যাবো কি করে? আরে ভাগ… ভাগ…..জল্দী সে ভাগ…গিয়ে সাতবাঁধ মে ঝাঁপা……..’
আমি মনে মনে বললুম-‘তাই যাও এখন ডাকাত আংকল তোমরা। আর কি করবে বলো? তবে সাবধান …সেই জলে তোমরা অবিনাশ আংকলকে মেরে ডুবিয়ে রেখেছো। এখন তোমরা ও যাও। আংকলের সঙ্গে থাকো গিয়ে। আংকলের মতন তোমরা ও আর কোনদিনই উঠবে না ওই জল থেকে, তা ঠিক। আমি এখন ঠিক জানি যে জলের ওই জেরিকেন গুলোতেই ছিল পেট্রোল তবে কিছু মেশানো ছিল যাতে গন্ধটা না বোঝা যায় পেট্রোলের। এই আর কি।
‘
০৯৪৫২০০৩২৯০
‘
‘
‘
‘
রচনাকাল : ৯/১/২০১৫
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।