নিয়তি
আনুমানিক পঠন সময় : ১৫ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫২ টি দেশ ব্যাপী ৪৫৬৫৩ জন পড়েছেন।
নিয়তি

জি০সি০ভট্টাচার্য্য, বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ

যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি পড়তুম ক্লাশ এইটে। আর বয়স ও তাই ছিল কম। বছর তেরো বা চোদ্দো... আর কি।

তবে আমাদের যৌথ পরিবার ছিল এক্কেবারে গোঁড়া হিন্দু। একে হিন্দু তায় আবার ব্রাহ্মণ, যেন সোনায় সোহাগা । 
তবে আমার মাথায় তখন ও কিছুতেই ঢুকতো না যে জাত ধর্ম এইসব যখন ভগবান বা আল্লাহ পাক তৈরী করেননি 
তখন সেসব নিয়ে লড়াই কিসের আর ছোট বড়ই বা কিসের? সে অবশ্য আজ ও ঢোকে না। কিন্তু সম্ভব অসম্ভব  
অনেক কিছুই মেনে নিতে হতো বইকি। বিশ্বাস না করলেই বা কি?

তবে আমার মনে হতো একটা সোজা কথা যে হিন্দুর ঘরে জন্মেছে সে হিন্দু হবে আর যে মুসলমানের ঘরে জন্মেছে 
সে না হয় মুসলমান হবে। আর যে ব্রাহ্মণ হবে সে ও বংশের ধারায় আর যে চামার মানে শূদ্র সে ও তো তাই। 
জন্মনাঃ জাতি... তা এসব মানে জন্ম তো আর কারো নিজের হাতে নয়। ছোট বড় বা উঁচু নীচুর ভেদটা আসে কি করে? 

এখন ক্লাশে যে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো, স্কুলের বেস্ট বয় ও .....তার নাম ছিল ইকবাল। খুব দারুণ রকমের 
স্মার্ট সুন্দর আর মিষ্টি ছেলে একটা। সব্বাই তাকে ভালোবাসতো। কখন ও সে ক্লাশে ফার্ষ্ট হ’তো আর কখনো আমি। 
আমি ফার্স্ট হলে তখন  ইকবাল শুধু হাসতো আর বলতো –‘যাঃ...এবার আমার স্কুলের প্রাইজটা মাঠে মারা গেলো.... 
তোকেই দিতে হবে ক্ষতিপূরণ’। 
আমি মুখ নীচু করে বলতুম.... ‘তাই দেবো। অন্যায় করে ফেলেছি একটা যখন....কি আর করা?’

এখন এমন মুশ্কিল আমার যে তার নামটি ও বাড়িতে করবার যো ছিলো না ভূলে ও। বাড়িতে ডাকা তো 
রইলো গাছের মাথায়....অভিভাবকেরা তাকে বাড়ির চৌকাঠ পার হতে দিলে তো। উল্টে তার সঙ্গে খেলি 
শুনলেই আমাকে আগে চান করিয়ে তবে ঘরে ঢুকতে দিতো। কি জ্বালাতন বলো তো। আর তার টিফিনের 
থেকে ভাগ নিয়ে খেয়েছি সেটি জানলে তখন? নির্ঘাৎ ত্যাজ্যপুত্র ......হিঃ...হিঃ....হিঃ....তবে একটাই তো 
ছেলে আমি বংশের....তাই....একটু যা বাঁচোয়া...

সে কথা যাক। তার কথা না হয় আরেক দিন বলবো। 

আজ বলি নিয়তির কথা। সে ও বেশ সুন্দর মেয়ে ছিল। প্রায় আমারই বয়সী বা বছর খানেকের ছোটই ছিল। 
তবে সে হিন্দু হ’লে কি হয় ব্রাহ্মণ নয় বলে তার দৌড় ছিল আমাদের বৈঠকখানা অবধি। 
ছোট জাতের মেয়ে কি ব্রাহ্মণদের অন্দরে যেতে পায় নাকি? তবে প্রতি বছর বিজয়া আর দোলের দিন সে 
আমাদের ঠিক প্রণাম টণাম করতে আসতো। অন্য দিন ও। তবে সে যে আমার জন্য তা আমি জানতুমই না।

একদিন আমি বিকেলে ফিরছি স্কুল থেকে, পথে নিয়তির সাথে দেখা।

‘কি রে রাজকুমার, আজ যে বড় সকাল সকাল ফিরছিস?’

‘অ্যাই মেয়ে, তুই আমাকে রাজকুমার বলবি না বলছি। আমি কি রাজার ছেলে নাকি?

’হিঃ....হিঃ.....হিঃ.........তুই একটা বুদ্ধু। খুব বেশী সুন্দর ছেলেদের লোকে রাজপুত্তুর বলে তা ও জানিস না?’

‘কোন ছাই সুন্দর আমি? ইকবালকে যদি তুই একবার দেখতিস, তখন আর ওই সব বাজে কথা বলতিস না আমাকে.....’

‘এমা, ইকবাল.....? ছিঃ..... সে তো মুসলমানের ছেলে হবে একটা। তাকে আবার কেউ সুন্দর বলে নাকি?’

‘তা বলবে কেন? সে কি আর মানুষ? তুই এখন যা তো....আমাকে রাগাবি না বলছি...তবে ও হচ্ছে 
একটা কি বলে....পরী ছেলে...তা শুনে রাখ....দেখলে তোর মুন্ডু ঘুরে’যাবে ...

‘তোর পরী থাক তোর কাছে....আমার দেখে আর কাজ নেই.....আর এখন যেতে আমার বড় বয়েই গেছে। 
তুই চল আজ আমাদের বাড়ী। মা ডেকেছে তোকে?’

‘তা মাসিমা ডাকলেন কেন হঠাৎ আমাকে?’

‘আমার সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে বলে....’

‘মারবো টেনে এক থাপ্পড় বেশী ফাজলামো করলে.....হ্যাঁ না তো ...মেয়ের না নিকুচি করেছে...’

‘তা মারবি তো মার আমাকে না হয় তুই। তবে বাড়ী এখুনি চল। বাবা জয়নগরের মোয়া নিয়ে এসেছে, তাই.....’

তা এখন তবে তো যেতেই হয় বইকি। বাধ্য হয়ে গেলুম ও। নিয়তি তো কারো বাধ্য নয়....নিয়তি কে ন বাধ্যতে? 
তবে আমি যে মোয়া আর নলেন গুড়ের সন্দেশ সেঁটেছি সে’খানে বসে, সেটি নিয়তিকে কখনোই আমাদের বাড়িতে 
বলতে না করে দিলুম বইকি। নইলে আর রক্ষা আছে? .

কোনমতে এইভাবেই চলছিল। 

তা ভাগ্য বলে একটা কথা আছে না। নিয়তির বাবা হঠাৎ করে পথে গাড়ির ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনায় মারা 
যেতেই সংসারটা ভেসে যাবার মতন অবস্থা হ’লো। আমি তখন সবে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করেছি। 
স্কুলে আমি তিন নম্বর বেশী পেয়ে ফার্ষ্ট আর ইকবাল সেকেন্ড হয়েছিল, প্রথম শ্রেণিতে। আমার জমানো 
টিফিনের পয়সা থেকে আবার একটা প্রাইজ গচ্ছা গেলো আর কি? তা দুষ্টু ছেলেটা তখন নিতেই চায় না মোটে। 
একটু বড় হয়েছে বলে লজ্জা পায় আর কি?  তা না নিলে আমি ঘা কতক দিয়ে দেবো না। করে কি? 
ওকে হারিয়ে দিয়ে প্রাইজ মানে উপহার দেওয়া। আর কি? অবশ্য অতো সুন্দর ছেলেটাকে মারতে ও মায়া লাগতো খুব আমার।

কিন্তু আমি তখন করি কি? 

ফন্দি করে খেলার সময় বাঁচিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট বাচ্ছাদের টিউশানী ধরলুম কয়েকটা। না 
আমাদের বাড়ির আর্থিক অবস্থা বেশ ভালোই ছিল....আর আমি বাড়িতে একটাই ছেলে। সে জন্য নয়। 
দু’টো ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে নিয়তির মা যে কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না দেখে.... 
আমাকে এই পথ ধরতে হলো। নিয়তির মা সামান্য কি সেলাই টেলাইয়ের কাজ করতেন কিন্তু সেই 
সামান্য আয়ে সংসার চলে না। আমি টাকাটা নিয়তিকে জোর করে গছাতাম শুধু মাসিমাকে ছাড়া 
আর কাউকে না বলবার শর্ত দিয়ে। তবে প্রথম প্রথম গোটা কয়েক টিউশানিতে কতই বা পেতাম আমি। 
বৃত্তি একটা পেয়েছিলাম বটে...মেরিট স্কলারশিপ.... তবে সে কথা বাড়ির সবাই তো জানতো ...
তাই আমি সে টাকাটা মাকে  এনে দিয়ে দিতাম।

পরে আমি একটু উঁচু ক্লাশের ছেলেদের পড়ানো শুরু করতে তখন একটু বেশী টাকা পেতে খুব আনন্দ হয়েছিল।

আমার এই কীর্তি কেউ না জানতো না তবে ইকবাল কি করে যে ঠিক সব জেনে ফেলেছিল ব্যাপারটা জানি না। 
একদিন আমাকে দিল খুব কষে বকুনি....বলে...  ‘সামনে তোর হায়ার সেকেন্ডারী....আর তুই টিউশানী করে 
বেড়াচ্ছিস শুনলাম। কেন রে? তোদের কি পয়সার অভাব হয়েছে?’

‘আরে চুপ চুপ....কেউ শুনে বাড়িতে বলে দিলেই আমার কম্ম কাবার। তুই জানিস না? টিউশানী করলে 
সেই ক্লাশের সব বিষয়ের পড়া দিব্যি মুখস্থ হয়ে যায়.... তা জানিস?’

‘তুই আমাকে বোকা বানাচ্ছিস?’

ব্যস...অভিমানে ছেলেটা কেঁদেই ফেললো ঝর ঝর করে পথেই দাঁড়িয়ে.........এই বড় বড় টানা টানা 
দুটো চোখ দিয়ে জল ঝরছে দেখেই বললুম-‘সর্বনাশ হয়েছে......এখন কেউ দেখলেই আমি গেছি। 
বেশী সুন্দর ছেলে বা মেয়েদের কাঁদতে দেখলেই সকলের দরদ একেবারে লাফিয়ে ওঠে। তাই তাড়াতাড়ি 
ছেলেটার দুধবরণ একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে ঢুকে পড়তে হলো  একটা কফি হাউসের মধ্যে....তখন 
বলতে ও হলো সেই রূপবান ছেলেকে সব কথা.....উঃ...যার একটা অমন বন্ধু থাকে না....তাকে অনেক 
কিছুই করতে হয়। আমার নিয়তি...........

তা সব কথা শুনে কিশোর ছেলেটা জলভরা বড় বড় চোখ দু’টো একটু মুছে নিয়ে বললো-
‘হুঁ, তা একদম ঠিক কাজ করেছিস তুই....তবে আমি কিছু দিলে হয়তো ওরা নেবে না তাই না রে? 
আমি যে মুসলমানের ছেলে আর যতই নীচু জাত হোক ওরা তো হিন্দু....’

‘নিকুচি কিয়া হ্যায় তোর ছাতার জাতের। অত বড় দুর্ঘটনা হ’লো, সংসারটা ভেসে গেলো তখন 
কটা হিন্দু এসে দাঁড়িয়েছে? দেখেছে? তুই পারলে আমাকে দিয়ে দিস তবে আমি অবশ্য বলবো নিয়তিকে....লুকিয়ে দেবো না.’

‘তখন যদি না নেয়?’

‘না নেয় তো না নেবে। নেবার লোক হাজার...দাতা এক রাম....তা জানিস?’

‘তুই যদি এই সব করতে গিয়ে শেষে পরীক্ষায় ফেল করিস ভাই, তখন তো ধরা পড়ে যাবি?’

‘সেটা সম্ভব নয়।‘

‘কেন?’

‘আগেই বলেছি না তোকে। এখনই আমি স্কুল ফাইন্যালের ছাত্রদের পড়াচ্ছি...সব বইয়ের পড়া আমার 
মুখস্থ হয়ে গেছে। সামনের মাস থেকে একটা হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেকেও পড়াবো। অফার এসে গেছে।
ফলে কোর্সের ও  সব পড়া মুখস্থ হয়ে যাবে আপনিই....দেখবি তোকে হারিয়ে দেবো ঠিক...হিঃ...হিঃ....হিঃ..’

‘তা দিস তুই আমাকে হারিয়ে। তুই অনেক বড় মাপের মানুষ। তোর কাছে আমার মতন  
একটা বাজে সাধারণ ছেলের হারতে লজ্জা নেই রে। তোকে আমার রহীম বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে ...’

‘অ্যাই খবর্দার বলছি। মারবো এক চড় তোকে তাহ’লে...একমাত্র আল্লাহ পাক হলেন রহীম...
তিনিই করীম...তুই মুসলমান হয়ে আমাকে রহীম বলতে চাস? ছিঃ....’

‘কি করবো বল? আমি যে তোর মধ্যে তাঁর ছায়া দেখতে পাচ্ছি...’

‘গোঁড়া হিন্দুদের মতন কথা বলবি না বলছি। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়....তাঁর ছায়া বা মূর্তি 
কিছুই হয় না। তবে তিনি যাকে দিয়ে তাঁর যা খিদমত করাতে চান সেটা তার সৌভাগ্য রে ভাই.’

‘হুঁ মনে হচ্ছে তুইই একজন খাঁটি মুসলমান, আমি নয়। তবে তুই নিয়তিকে একটু দেখিস। 
শুনছি মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন।‘

‘কেন? কি হয়েছে রে নিয়তির?’

‘তা ঠিক জানি না।...... হয়তো তোর কাছে টাকা নিতে হচ্ছে বলে সম্মানে বাধছে ? হয়তো 
সে তোকে মুহব্বত করে বলে? হয়তো তোকে চায় শাদী করতে যাতে সে গ্রহীতা হয়ে না থাকে? 
আর সেটা হয়তো সম্ভব হবার নয় তোদের হিন্দু সমাজে.....

ইকবাল ছেলেটা যে শুধু অপরূপ সুন্দর তাই নয়, বেশ বুদ্ধিমান ও তা আমি জানতাম। 
নইলে ফার্স্ট হয় কি করে ? তবে সে’দিন মনে হ’লো ছেলেটা শুধু জিনিয়াস ও নয় সুপার জিনিয়াস। 
তখনি হঠাৎ আমার আর ও মনে এক দারুণ সন্দেহ শুরু হলো .....আচ্ছা তা হলে আমি ওকে অনায়াসে 
হারাই বা টপকে যাই কি করে পরীক্ষায়? অ্যাঁ.? ও নিজেই হেরে যায় না তো আমার জন্য? 
ও ছেলে না পারে কি? হয়তো সব প্রশ্ন করে না সল্ভ পরীক্ষায়.? 

কে জানে বাবা? ও যে কি করে পরীক্ষা হলে বসে তা কে জানে । নিজে ইচ্ছে করে হারে আর 
আমাকে এসে রহীম বানায়? 

আমার একটা গান মনে পড়লো হঠাৎ করে.........কে জানে মা কালী কেমন?’

তবে ইকবাল যা বলে তা অবশ্য ফলে। সে বার আমার কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে নিয়তি কেঁদে 
ফেলল ঝর ঝর করে। যত জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে, তত কাঁদে। শেষে বলে আমাকে তুই একটা যে 
কোন রকমের কাজ যোগাড় করে দিতে পারবি’?

‘কেন? আমার কাছ থেকে সামান্য কটা টাকা নিতে তোর সন্মানে ঘা লাগছে বুঝি?’

‘না রে...ও তুই বুঝবি না।‘ 

‘হুম....বুঝেছি’.....

‘ছাই বুঝেছিস’..........বলে নিয়তি দৌড়ে চলে গেল। তবে পরে একদিন মাসিমা 
ও যখন বললেন একই কথা, তখন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলুম আমি। 

‘বাবা....তুমি একটু দেখো...আমার মেয়েটার মাথাটা যেন  দিন কে দিন কেমন খারাপ মতনই হয়ে যাচ্ছে। 
রোজ রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদে....দিনে হঠাৎ করে কখনো রাস্তায় বেরিয়ে চলে যায় ...কাকে যেন... আসছি......বলে। 
আমার গতিক বড় সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না বাবা। ও কার সাথে যেন কথা ও বলে বিড় বিড় করে। 
আমার খুব ভয় করে আজকাল। বিশেষ করে রাতে......’

‘বেশ তো । আপনি হরিশ ডাক্তারকে দেখান আজই। যা লাগবে, ব্যবস্থা হয়ে যাবে মাসিমা। 
কোন চিন্তা নেই আপনার। সে ভালো হয়ে উঠলেই আমার ভালো লাগবে....’

তা ডাক্তার দেখলো বটে কিন্তু রোগ ধরা পড়লো না। পাগলামির লক্ষণ বলে ধরে নিলো অনেকে। 

আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলুম। 

সব কথা ইকবালকে বলতে সে বেশ গম্ভীর মুখে বললো-‘না রে চঞ্চল, ব্যাপারটা খুব সুবিধের বলে 
মনে হচ্ছে না আমার। তুই শুনলে হাসবি তাই বলতে লজ্জা করছে। তবে এটা ঠিক যে একটা অপার্থিব 
জগৎ ও আছে এই পার্থিব জগতের সমান্তরাল। তুই বিশ্বাস কর। অনেকে বুঝতে পারে। যারা পারে না 
তারা বলে পাগলামি। আমার বেশ ভয় করে কি জানি কি হয় এই ভেবে।

তা ঘটনাটা ঘটলো ঠিক সাতদিন পরে। 

সেই পথ দুর্ঘটনা। 

সে দিন বিকেল থেকেই জোর বৃষ্টি পড়ছিলো। একটা ছাতি মাথায় দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল নিয়তি 
দোকান  থেকে জিনিষপত্র কিনে নিয়ে ফেরবার পথে। দূরাগত মোটরটা দেখতে পায় নি হয়তো। 
চালক ব্রেক কষেছিল ঠিকই তবে জলকাদায় স্কিড করলো চাকা। হাসপাতালে মুভ করবার পথেই সব শেষ। 
শুনলাম, ওর বাবার ও এই রকমই দুর্ঘটনা ঘটেছিল না কি?

আমি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লুম যেন। কি হবে আর টিউশানী করে? সব ফাঁকি। 
সবকিছুই মিছে বলে মনে হতে লাগলো আমার। কেন এমন হলো তা জানি না।। 

খবরটা ইকবাল ও পেয়েছিল। পথেই একদিন দেখা করল আমার সাথে।

‘কি রে চঞ্চল? কেমন আছিস?’

‘ভালো নয় রে ভাই’। 

‘সে তো দেখেই বুঝেছি তবে তুই এখন আরো সাবধানে থাকবি একটু’।

‘কেন রে?’

‘হয়তো তোর ও বিপদ হতে পারে’।

‘কিসের বিপদ হবে আমার? কেনই বা হবে?’

‘কেন তা জানি না । ও কথা বাদ দে। তুই টিউশানী করছিস কিনা এখন তাই বল?’

‘নাঃ....আর কি হবে করে? কার জন্যে?’

‘আরেঃ...তুই কি বলছিস? এখন তো মাসিমা আর ও একলা আর অসহায় হয়ে পড়বেন। 
ছোট একটা ছেলে নিয়ে....’

‘তা আমি.........আমি আর কি করবো?’

‘যা করতিস। তবে আমি না হয় এসে টাকাটা মাসিমার হাতে দিয়ে যাবো। 
তোকে এখন আর আসতে হবে না কিছুদিন এই রাস্তায়।’........

‘তা কেন?’

‘মনে হয় তোর পক্ষে সেটাই ভালো হবে। আজ যাই। ও মাসের দু’তারিখে আসবো। 
আর না পারলে মানে ভালো না লাগলে তোকে আর টিউশানী ও করতে যেতে হবে না। 
আমিই সব ম্যানেজ করে নেবো..’


‘সে হবে না রে ভাই। তুই হিন্দু গোঁড়ামি তো জানিস। কি যে সন্কীর্ণমনা.....তুই যতই বল... 
না খেয়ে মরলে ও মুসলমানের দেওয়া টাকা ছোঁবে না জাতধর্ম চলে যাবার ভয়ে। 
এই সব ধর্ম যত শীঘ্র শেষ হয়.....’

‘থাক ভাই............তবে তুই কিছু যদি ভয় পাস বা সন্দেহ করিস তো সোজা আমাদের 
বাড়িতে তৎক্ষণাৎ চলে আসবি কিন্তু.....কথা দে তুই।

‘আমি কি ভীতুর ডিম না কি? তবে তুই হঠাৎ এই সব কথা বলছিস যে?’

‘আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে......থাক গে।.ও কিছু না....’

যেমন চলছিল তেমনই সব আবার চলতে লাগলো।

মাস কয়েক কেটে গেছে।

শীতকাল।

জানুয়ারির দু’তারিখ। টিউশানী সেরে  ছাতি মাথায় ফিরছি। নিয়তিদের বাড়ী হয়ে বাড়ী যাবো। 
বড় রাস্তা পার হয়ে আসছি। কে যেন জোর এক ধাক্কা মারলো আচমকা। লাফ দিয়ে ছিটকে পড়া 
সামলে গলির মুখে এসে পড়লুম। তৎক্ষণাৎ একটা কালো মোটর সাঁ করে বেরিয়ে গেল। 
মোটর চাপা পড়া থেকে আমি বেঁচে গেলাম বটে কিন্তু হাওয়ার ঝটকায় ঝপাৎ করে ছাতাটা উল্টে গেলো। 
সে আর কিছুতেই সোজা করতে পারি নে। শীতের বৃষ্টিতে ভিজছি। 

হঠাৎ কেউ যেন ছাতাটা এক ঝটকা মেরে আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে ফট করে সোজা করে 
আমার মাথায় ধরে খুব মৃদু স্বরে বললো- ‘হয়েছে, এবার দাও টাকাটা। তোমাকে আর জলকাদা ভেঙে যেতে হবে না...’

‘তুমি.....মানে আপনি কে? আমি তো ঠিক.............’

‘এরই মধ্যেই আর চিনতে পারছিস না। কি রে তুই? যাক................আমি নিয়তি.’

আমি আঁৎকে উঠে বললুম ‘যাঃ....তুই না মারা গেছিস?’

‘তা মরে গেছি বলে কি আর আসতে নেই?না আসলে তুই ও এতক্ষণে অক্কা পেতিস ওই গুন্ডা 
মস্তানদের গাড়ী চাপা পড়ে। ওরা সৎ গরীব ধার্মিক মানুষদের শত্রু....ও সব তুই বুঝবি না ...
যেতে দে ...তবে  বাবা আমার উপকার করেছে খুব। শেষের দিকে তো প্রায়ই আমাকে ডাকতে 
আসতো.....কথা বলতো......তা এখন আর আমার মনে কোন কষ্ট নেই। কেননা আমার তো 
আর এখন কোন জাত নেই, ধর্ম ও নেই...ঘর সংসার ও করতে হবে না বিয়ে করে.....
তাই তোর টাকা নিতে ও লজ্জা নেই। এমনকি তোর বন্ধুর টাকা ও আমি নিতে পারি এখন স্বচ্ছন্দে। 
আর কে কি বলবে আমাকে বল? বাড়িটা সারাতে হবে তো। ঘরে যে জল পড়ে বৃষ্টি হলেই। 
ভাইটাকেও মানুষ করতে হবে.’

‘তুই এখন এই সব কি করে করবি?’

‘আরে আমি কি আর করবো? করবি তুই আর তোর বন্ধু’।

‘আর তুই কি করবি?’

‘যা করছি...’

‘মানে?’

‘হিঁ..........হিঁ.........হিঁ........তোর ঘাড়ে চেপে থাকবো। আর কোথায় যাবো বল?’

‘সর্বনাশ ....আমার যে বিয়ের ঠিক করছে বাড়ী থেকে। জানিস তো আমাদের বংশে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়.......’

‘হওয়াচ্ছি....আমি তোর বিয়ে.....কালই না তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছি শ্যাওড়া গাছের ডালে 
তো আমার নাম নেই..তোর  ভাগ্যে আর বিয়ে করা নেই রে...... হিঁ........ হিঁ........ হিঁ...’

‘এই নে...তবে তুই রাখ টাকাটা.....আমি তবে যাই। তোর কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে 
এখন বোঁ বোঁ করে ঠিক চরকির মতন....’

‘নাঃ....তুই যেমন দিস তেমনই গিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে আয়। নইলে আমি দিলে মা ভয় পেতে পারে রে..’

আমি টাকাটা দিয়েই ফিরলুম। সোজা ইকবালের বাড়ী চলে গেলুম। নিজের ঘরে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে 
আমাকে বসিয়ে সব শুনে ছেলেটা বললো-‘হুঁ, ইলুউশান.....তবে কাল যদি তোর বা তোর ভাবী 
বৌয়ের সত্যিই কিছু হয় তখন আর এটা ইলুউশান থাকবে না আর তোকে ও এখানে আর রাখা যাবে না...’

‘আ....   আমি কোথায় যাবো? তোদের সবাইকে ছেড়ে? আর কেনই বা? সে আমি পারবো না কিছুতেই....’

‘খুব পারবি । যেখানে হয় যাবি। কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়ী। মোট কথা হচ্ছে এই যে তোর আর 
এইখানে থাকা চলবে না মনে হয়। তবে তোর ‘সে’ ভাগ্য ভালোই বলতে হবে.’

‘সে ভাগ্য আবার কি?’

‘ওই ইয়ে ভাগ্য...’

‘ইয়ে.........সেটা কি বস্তু রে বাবা?’

‘মানে ভালোবাসা মানে প্রেম ভাগ্য আর কি....জবর্দস্ত যাকে বলে’...বলে ইকবাল উঠে দাঁড়ালো।

‘চল আমি তোকে এখন বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। নইলে সবাই খুব চিন্তা করবে। তবে তোর বাড়ির 
খুব কাছে আমি যাবো না। আর প্যান্ট শার্ট পরে গেলে কেউ বুঝতে ও পারবে না যে আমি মুসলমানদের ছেলে। 
আর তোর এখন একলা যাওয়া ঠিক না এতো রাতে’...

‘তার দরকার নেই রে ইকবাল...তোকে তো ফিরতে হবে একলা.....’

আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল-‘দরকার আছে। চল তো....’

তারপর থেকে ইকবাল আমাকে একরকম পাহারাই দিতে লাগলো। কিন্তু দিলে হবে কি? টিউশানী 
সেরে আমার ফিরতে রাত তো হতোই। আর লোডশেডিং ও হতো প্রায়ই। 

একদিন টিউশানী সেরে ঘোর অন্ধকারের মধ্যে গুলাব বাগের বড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরছি। পথ জনমানবহীন। 
রাত নটা পার হয়ে গেছে ঘড়িতে । হঠাৎ আমার পায়ের নীচে থেকে যেন মাটি সরে গেল আর আমি 
হুড়মুড় করে কোথাও নীচে পড়ে গেলুম। 

পথের মাঝখানে কেউ বা কারা হয়তো বা কর্পোরেশানের লোকজনই  বিরাট এক গর্ত খুঁড়ে রেখে দিয়েছিল 
আর কোন ব্যারিকেটিং ও নেই। এই ঝামেলা এখানে লেগেই থাকে প্রায়ই। সঙ্গে টর্চ রাখা উচিৎ ছিল আমার। 
খুব ভূল হয়ে গেছে।

কিন্তু তখন আর সেই সব ভেবে কি হবে? তবে নীচে মাটিটা নরম ভিজে মতন বলে হাত পা ভাঙলো না আমার। 
মাথায় জোর চোট লাগল বইকি। হাত পা ভাঙলেই দফা গয়া হয়ে যেত....  এই যা রক্ষা পেয়েছি। 
কিন্তু কোনমতে উঠে দাঁড়ালে ও ওপরে উঠে আসতে পারলুম না সেই মানুষ প্রমাণ গর্ত থেকে। 
আমি হেল্প....হেল্প বলে চেঁচাতে বাধ্য হলুম। কিন্তু কে শুনবে? মিনিট পাঁচেক ধরে  অনেক চেষ্টা করে 
ও উঠতে পারলুম না। কিনারার মাটি এত নরম যে হাত দিয়ে ধরলেই ভেঙে পড়ছে ঝুর ঝুর করে ।

আমি অসহায় হয়ে পড়লুম। প্রায় একঘন্টা কাটলো। 

আমি নিজের চেষ্টায় ও উঠতে পারলুম না আর কেউ সাহায্য করতে ও এলো না। 

সেই ঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কি করবো ভাবছি। হঠাৎ মাথার ওপরে থেকে তারাভরা আকাশ হলো 
বিলুপ্ত আর পরক্ষণেই ভিজে মতন ঠান্ডা হাতের মতন কিছু একটা আমার ডানহাতটা চেপে ধরে এক 
বিষম টান দিলো। আমি ও ভান পা তুলে গর্তের গায়ে ভর দিতে চেষ্টা করলুম। কিন্তু তার দরকার 
ছিল না কেননা ঝুলতে ঝুলতে পরক্ষণেই আমি একেবারে রাস্তার ওপরে এসে পড়লুম ধপ করে ।

তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সচমকে দেখি সেখানে কেউ নেই। কাকে ধন্যবাদ দেব?

ভয় পেয়ে আমি যত জোরে পারি হেঁটে তৎক্ষণাৎ সে স্থান ত্যাগ করলুম।

ইকবালকে পরদিন সব বললুম। শুনে সে বললো গতিক সুবিধের নয় রে চঞ্চল। খুব সাবধানে থাকবি। 
মনে হয় সত্যিই তোর পক্ষে আর নিরাপদ নয় এই স্থান।

আর সাবধান। হঠাৎ করে কিছু হয়ে গেলে কি সাবধান হওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে সেদিন বিকেলেই 
টিউশানিতে চলে গেলুম তবে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল হঠাৎ করে বৃষ্টি আসায়। পরিচিত পথ। 
কিন্তু আলো সব তখনি নিভে গেল আর দূরে শোনা গেল পালাও পালাও রব।। পাগল হয়ে গেছে একটা কুকুর। 

সব লোক দৌড়চ্ছে। আমি কি করবো বুঝে উঠবার আগেই পথ জনহীন আর বেশ কাছেই বিশ্রী 
ডাক শোনা গেল কুকুরের। মোড় ঘুরতেই দেখি বিরাট এক কুকুর তেড়ে আসছে। আমি পিছন ফিরে 
দে দৌড়। কুকুর ও দৌড়ে এল। আমি যত দূরে যাই সেও যায়। অন্ধকার পথে দৌড়নো সহজ নয়। 

হঠাৎ হোঁচট খেয়ে দেওয়াল ধরে কোনমতে সামলে নিয়ে দেখি সামনেই পড়ে আছে  একটা পাথর। 
সেটাই তুলে নিতে না নিতেই দেখি কুকুর এসে হাজির । ছুঁড়ে দিলুম পাথরটা। বিকট চিৎকার....কেঁইইইইইইইইই......

আমি আবার দৌড় দিলুম। সে আর তেড়ে এলো না। অতো ছোট একটা পাথরে মরে যাবার কথা 
নয় কুকুরটার। কিন্তু পরদিন শুনলুম তাই হয়েছে। একটা পুরণো বাড়ির কার্ণিস তার ওপরে ভেঙে পড়ায়.....
তা কার্ণিসটা কি আমার সেই পাথর লেগে ভেঙেছিল। অদ্ভূত কান্ড....

অবশ্য ইকবাল শুনে ভয় পেয়ে বলল আর  নয়। তোকে যেতে হবেই এইখান থেকে। । আমি ব্যবস্থা করছি। 
তবে দেখা যাক তোর আশীর্বাদের দিনটা তো কেটে যাক আগে ভালোয় ভালোয়।

তা সেই আশীর্বাদের দিনেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার হবু বৌকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। 
সব তোড়জোড় করা মাটি হয়ে গেল বলে আমাদের বাড়ির সবাই খুব মুষড়ে পড়লো। 

আর তার কয়েকদিন পরেই ইকবাল আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই পুরুলিয়া থেকে রাতারাতি একেবারে 
চম্পট দিলো একেবারে  সোজা বেনারসে ওর মামার বাড়িতে।  আমার হবু বৌ আর সুস্থ হয়ে বাড়ী 
ফিরে আসতে পারবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ শোনামাত্রই।  

০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২৩/১০/২০১৮
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 2  Canada : 50  China : 27  Germany : 3  India : 212  Iran, Islamic R : 1  Ireland : 1  Japan : 2  Mongolia : 1  Romania : 13  
Russian Federat : 8  Saudi Arabia : 6  Sweden : 7  Ukraine : 38  United Kingdom : 7  United States : 390  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 2  Canada : 50  China : 27  Germany : 3  
India : 212  Iran, Islamic R : 1  Ireland : 1  Japan : 2  
Mongolia : 1  Romania : 13  Russian Federat : 8  Saudi Arabia : 6  
Sweden : 7  Ukraine : 38  United Kingdom : 7  United States : 390  


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নিয়তি by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৮০১৩৪৮
fingerprintLogin account_circleSignup