কি মুশ্কিল!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ।
======================================================================================
কাল্লুজীর নাম তো এখন আপনারা অনেকেই জানেন। পরিচয় না দিলে ও চলবে।
তা সেই কাল্লুজীর ফোন পেয়ে আমাকে হঠাৎ যেতে হয়েছিল গৌহাটিতে।
সঙ্গে অবশ্য ছিল আমার পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ সুন্দর ভাইপো। অতি সুন্দর দুধবরণ ছেলে চঞ্চল। তখন রূপবান ছেলেটার বয়স ছিল প্রায় বছর এগারো কি বারো।
ছেলেটাকে বৌদিকে দিয়ে আসলে হ’তো। কিন্তু আমার একলা আসতে মনই চাইল না।
কাল্লুজির টেলিগ্রাম পেয়েই ছুটে চলে এসেছিলাম।
তাইতে এইমাত্র লেখাছিল-‘পন্ডিতজী, আমার বড় বিপদ, সাহায্য চাই। গৌহাটী চলে আয় কালকেই, আমাকে যদি বাঁচাতে চাস’।
কাল্লুজীর ভাষা বলে কথা। ঠিকই লেখা হয়েছে টেলিগ্রামে তা বুঝে নিতে হ’লো।
কিন্তু টেলিগ্রাম পড়ে নিজের টানা টানা চোখদুটোকে আর ও বড় বড় করে চঞ্চল জিজ্ঞাসা করেছিল-‘কাকু, কাল্লু আংকল কি সেখানে মৃতপ্রায় অবস্থায় আছে না কী?’
ছেলেটার সেই সুন্দর মুখের ভঙ্গি দেখে অতি কষ্টে হাসি চেপে বলেছিলাম-‘কি জানি ভাই, লেখেনি তো কিছুই। চলো, গেলেই জানা যাবে’।
তৎকালে যাওয়ার টিকিট কেটে নিয়ে অসম মেলে উঠে সোজা আজ এসে হোটেল অলংকারে হাজির হয়েছি আমি । হোটেলটা চেনা ছিল। ফ্যান্সি বাজারের কাছেই। তাই কাল্লুজিকে ঠিকানা দিয়ে এসেছি।
ঘোর বর্ষাকাল বলে চিন্তিত ছিলাম। নিজে একলা এলেই ঠিক হ’তো হয়তো। তার আমি কি করব? আমার অভ্যাস বেশ খারাপ হয়ে গেছে চঞ্চলকে নিয়ে থেকে। একলা আমার পক্ষে এখন থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার সুন্দরী বৌদি তো রাগ করে বলেই-‘করো ঠাকুরপো। তুমি ওই কার্তিক ঠাকুর ছেলে নিয়ে গিয়ে মনের সুখে যতো পারো সেবা করো আর ছেলেকে মানুষ করো। পরে হাড়ে হাড়ে বুঝবে কিন্তু ঠ্যালা। ওই ছেলে এক ঘন্টা কাছে না থাকলে, তখন তোমার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠবে কিন্তু। আর একটু বড় হলেই সে তো সব সময় তোমার কাছে আর বসে থাকবে না। তখন আমাকে দোষ দিতে পারবে না। তুমি তো জান না যে রূপের নেশা ও অতি সাংঘাতিক জিনিষ। তার ওপর চঞ্চল তোমার যা বাধ্য আর অতি আদরে একখানা যা ছেলে তৈরী হয়েছে না। কাকু বলতে অজ্ঞান। আমি বাবা নেই অমন ছেলেকে মানুষ করবার ঝন্ঝাটে’।
তা বৌদির কথা অতো শুনলে চলে না। দাদার বাইরে বাইরে চাকরী। ছেলেটাকে দেখবে কে? বেশী সুন্দর ছেলে হ’লে তার বিপদ ও কিছু কম হয়না। অপহরণ অনিবার্য।
তা আমরা বিকেলে নাগাদ গৌহাটিতে গিয়ে পোঁছে দেখি তখন ও বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, যদিও বেনারসে একটু ও বৃষ্টি নেই দেখে এসেছি। প্রথম রাতটা তো আমাদের অপেক্ষা করতেই হ’বে।
হোটেলে উঠে দেখি যে ঘরে মশারি টাঙানোর ব্যবস্থা ও নেই মশারী তো দূরের কথা। বাংলার বাইরে সর্বত্রই এই ঝামেলা হয়। মশারির মর্মই কেউ বোঝে না ছাতা। বললে বলে এখানে তো মশা নেই। মশারী কি হবে? ভারী মুশ্কিল।
মশার কথা গিয়ে বলতে একটা গুডনাইট পাওয়া গেল কিন্তু তাইতে মশা আটকালে তো।
একটু রাত হতেই বেশ মশার উৎপাত শুরু হ’লো। দেখতে দেখতে মশার কামড়ে চঞ্চলের দুধ সাদা হাত পায়ে লাল লাল দাগ হয়ে উঠল। কি করি? তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে ও শুয়ে যে পড়ব সে যো টি নেই। আর বৃষ্টি তখন বেশ জোরেই পড়ছে। কোথাও যাবার ও উপায় নেই।
হঠাৎ সঙ্গে আনা ওডোমস ক্রিমের নতুন টিউবের কথা মনে পড়লো আমার।
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করে দিয়ে ছেলেটার নরম, মসৃন, চকচকে দুধ সাদা হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে ওডোমস বার করতে বসলুম। বেশ করে চঞ্চলের হাতে, পায়ে,গায়ে এখন ওডোমস লাগাতেই হবে বসে। কি আর করা? ।
বললুম-‘এখনই এদিকে যা বৃষ্টি। বাবারে বাবা। বেশ ঠান্ডামতন ও লাগছে। আমার ভয় করছে যে অসম রাজ্য বলে কথা। বন্যার রাজ্য ও বলা চলে। বৃষ্টিতে বন্যা হয়ে ট্রেন না বন্ধ হয়ে যায় লাইন ডুবে গিয়ে’।
‘চঞ্চল আমার কান্ড দেখে বললো-‘ও কাকু, ওডোমস তো পরে লাগাবে তুমি। আমি তো ঠিক জানি যে তুমি জ্বালা করছে শুনে এখনি তার আগে নির্ঘাৎ করে আমার হাতে পায়ের লাল লাল মশার কামড়ের দাগে হোমিওপ্যাথি ওষুধ লাগাতে বসবে। তা তুমি একটু দাঁড়া ও তো, কাকু। আমি আমার নতুন জামা টামা সব খুলি আগে, কাকু। নইলে……হিঃ হিঃ হিঃ…’।
মুক্তোর মতন দাঁত ঝকমক করে উঠল চঞ্চলের ভুবন মোহন হাসির সাথে। সত্যিই এই ছেলেটার হাসিতে মাণিক আর কান্নায় মুক্তো ঝরে যে’।
আমি হেসে আমার রূপেন্দ্র ছেলের পরিচর্যা করতে বসলুম। নিজের ও হাতে পায়ে লাগালুম ওডোমস বেশ করে।
পরে শোবার আগে চঞ্চলকে নিয়ে আমার পায়চারী করবার সময় কিন্তু ছেলেটা দুই নরম মৃণাল বাহু দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো-‘কাকু, আমাকে তুমি বলোনি তো যে কাল্লু আংকল বেনারস ছেড়ে এখানে এসেছেন কবে আর কেনই বা?’
‘এখানে আসে নি তো?’
‘তবে?’
‘এসেছে অরুণাচলে। চাকরী করতে’।
‘সে কি রকম, কাকু’?
‘বলছি শোন। এই প্রদেশটার আগে নাম ছিল নেফা বা নর্থ ইষ্ট ফ্রন্টিয়ার এরিয়া। পাহাড়ী দুর্গম রাজ্য। সীমান্ত প্রদেশ বলে সামরিক মহত্ব অসীম। অতি বিষম বন জঙ্গলে ভরা পার্বত্য অঞ্চল। নানান জাতের পাহাড়ী সব আদিবাসিদের বাস। জনসংখ্যা ও খুব কম’।
‘কাল্লুরামের বাড়ীর অবস্থা তো ভালো নয়। গরীবের ছেলে। সরকারী স্কলারশিপের জোরে বি০এ০, বি০এড০ করে আমার সাথে। তারপরে শুরু হয় চাকরী খোঁজার পালা। অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে শেষে এই কাজটা পেয়ে যেন বর্তে যায়। আমি অবশ্য বারণ করেছিলাম যেতে। কাল্লুরাম শোনে নি। ওর বাড়ির সবাই ও চায় যে কাল্লু সরকারী কাজে জয়েন করুক। তাই সে চলে আসে’।
‘টি০জি০ টিচারের গ্রেড। পরে পি০জি০ করে প্রোমোশান ও পেতে পারে। ওখানে সবই মিলিটারী স্কুল। মাইনে ছাড়াও সুবিধে অনেক। সরকারী চাকরী। ফ্রি কোয়ার্টার। ওষুধ পত্র ও খাওয়া দাওয়া ও পায়। তবে মিলিটারীর সংরক্ষিত এলাকা বলে সমাজ সংস্কৃতি বিহীন। বৃষ্টি বাদল তো লেগেই থাকে । বর্ষাকালে তো কথাই নেই’। ‘
‘রেশনের ভালো ব্যবস্থা থাকলেও মিলিটারী ট্রাকের ওপরে নির্ভর। রাস্তায় ধ্বস নামলেই পথ বন্ধ হয়ে যায়। অতবড় মিলিটারী স্কুল হলে কি হয়, হস্টেলের স্টোর কিন্তু তেমন বড়ো নয় বলেই শুনেছি। বড়জোর দিন দশেকের মতন রসদের যোগান থাকে। কারণ আছে বই কি। এক তো সাপ্লাই সীমিত তায় স্টাফদের জন্যও রান্না হয় একই মেসে। সুতরাং অসুবিধে অন্য সময় বিশেষ না হ’লেও বর্ষাকালে হয়ই’।
আমাকে জড়িয়ে ধরে চঞ্চল আদুরে গলায় বললো--‘ও কাকুউ, তুমি তো আর এখন আমাকে ছাড়বেই না, তা ঠিক জানি আমি। তবে তুমি যদি টি০ভি০র নিউজ চ্যানেলটা একটু চালিয়ে দিতে, কাকু আমার হয়ে, তবে হয়তো আবহাওয়ার অবস্থাটা কি এখন, সেটা জানা যেতো’।
বললুম-‘তা দিচ্ছি না হয় …’।
‘নিউজে জানা গেল-‘সারা অরুণাচল, মেঘালয় আর অসম রাজ্য জুড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। তাই পথ মেরামতের কাজ বন্ধআছে, তবে কাল যদি বৃষ্টি একটু থামে তবে সে আশা আছে। তখন অবধি খান চারেক ট্রেন না কী ক্যানসেল করা হয়েছে । সব নদীর জলস্তরই বাড়ছে…’।
‘এই রে, সেরেছে। যা ভয় করছিলাম আমি, তাই হবে না কী রে বাবা? আচ্ছা, আমিও পালাবো তবে যে ভাবে আর যতো তাড়াতাড়ি পারি তা কিন্তু নির্ঘাৎ করে কথা। আমি এই দারুণ সুন্দর ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বিপদে পড়তে চাই না’।
খাওয়া দাওয়ার পাট সারাই ছিলো। তাই খানিক পরে টি০ভি০ বন্ধ করে দিয়ে চঞ্চলের দুধ সাদা নরম গায়ে একটা দামী পশ্মীনা শাল জড়িয়ে দিলুম আগে। তারপরে চঞ্চলকে অভ্যাস মতন দু’হাতে ধরে বুকে তুলে নিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম আমি।
আর তখন রূপকুমার চঞ্চলের আদরে আদরে চট করে ঘুম ও এসে গেল দিব্যি আমার।
পরদিন দুপুরে বৃষ্টি একটু ধরলো আর সন্ধ্যে নাগাদ এসে হাজির হ’লো কাল্লুজী তবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায়। অনাহারে, অনিদ্রায় হতজ্ঞান অবস্থা তার। সঙ্গে একটা পয়সা ও নেই। মিলিটারী ট্রাকে এসেছে দীর্ঘ পথ পার হয়ে প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে।
আমি অন্য একটা ঘর বুক করে কাল্লুজিকে ব্যাগ ব্যাগেজ সমেত থাকবার ব্যবস্থা করে দিলুম। চান টান সেরে দাড়ি টাড়ি কেটে একটু ভদ্র হয়ে কাল্লুজী চা টা খেয়ে সুস্থির হ’তে খানিক পরে ডিনারের অর্ডার দিলুম আমি। বলাবাহুল্য সবই আমার এ্যকাউন্টে। বৃষ্টিতে ব্যান্ক ট্যান্ক সব বন্ধ থাকায়, কাল্লুজী চলে এসেছে খালি হাতেই।
আমি বললুম--‘এইবারে বলো তো দেখি কাল্লুজী যে তোমার ব্যাপারটা হয়েছে কী?’
‘আরে, হবে আবার কি রে পন্ডিতজী? যা হবার নয়, তাই হয়েছে। কি যে মুশ্কিল কি বলি? তা শোন বলি …’।
‘ওই যাঃ, আবার যে নামলো বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে….সাথে তেমনি ঠান্ডা হাওয়া। তোর এই রাজকুমার বাবুয়াকে এতো পাতলা সৌখিন ড্রেস পরিয়ে রেখেছিস কেন রে পন্ডিতজী? ঠান্ডা লাগবে তো ছেলেটার’।
‘চলো আমার ঘরেই বসবে চলো। গরম শাল আছে, তোমার লাগবে, কাল্লুজী?’
‘নাঃ, এই বাবুয়াকে জড়িয়ে দে গায়ে। আর…শোন বলি তবে---‘
‘এইবারে বর্ষা পড়লে ও বেশী ঝামেলা প্রথমে হয়নি। মুশ্কিল শুরু হ’লো টানা তিন দিন সমানে বৃষ্টি হ’য়ে হাইওয়ে ধ্বসে যেতেই। ট্রাক আসা বন্ধ হ’লো। তার দিন সাতেক পরেই মেস বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। স্টাফরাই বা খায় কি আর স্কুল হোস্টেলের অতো গুলো ছেলেই বা যায় কোথায়? বাড়ী ও যে যেতে পারবে চলে কেননা সে পথ ও নেই’।
‘প্রিন্সিপ্যাল সব টিচার ও ওয়ার্ডেনদের মিটিং ডাকলেন। স্থানীয় লোকের সাহায্য নেওয়া ঠিক হ’লো কিন্তু তেমন সাহায্য মিললো না মিলিটারী এলাকা বলে। দূরে দূরে ছোট গ্রাম যা আছে সেখানেও একই অবস্থা’।
‘শেষে সবার সাথে আমার ও হরিমটরের পাকা ব্যবস্থা হয়ে গেল আরো দিন চারেক পরেই রে পন্ডিতজী’।
কাল্লুজী সোফায় বসেছিল, আমরা বিছানায়। অতি সুকুমার পরীর দেশের রাজকুমার ছেলে চঞ্চলকে কাছে টেনে এনে দু’জনেই এক সাথে গরম শাল জড়ালুম এইবারে। জানলা দিয়ে তখন জোর ভিজে ঠান্ডা হাওয়া আসছে।
কাল্লুজী বললো- ‘তা আমার ভাগ্য রে ভাই, পন্ডিতজী। স্কুলের দারোয়ান থাপা সেদিন সকালেই ডেকে বললো- ‘স্যার, আমার এক বন্ধুর বাড়ী যদি আপনি যেতে রাজী হয়ে যান তা’হলে হয়তো কিছু উপায় হতে পারে। কিন্তু……’
‘কিন্তু আবার কী? আমি এখনি যেতে রাজী। বৃষ্টিটা একটু যখন ধরেছে, তখন এইবেলা না হয় চলো…’
‘কিন্তু আমার বন্ধুর যে ভারী মুশ্কিল হয়, স্যার। সবসময় কেমন বিপদ এসে যেন ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে ওর…’
‘সে আবার কী কথা? আমি বললুম-‘বিপদ কি ব্যাঙ না কী যে লাফা লাফি করবে? ও সবই মনে হয় লোকেদের অন্ধবিশ্বাস আর কী? লেখাপড়া শিখে আমি ওই সব কুসংস্কারে যদি বিশ্বাস করি তা’হলে আর কি তফাৎ রইলো আমার অশিক্ষিতদের সাথে? তুমি চলো…’
‘আপনি বলছেন যখন তখন চলুন কিন্তু পরে কিছু হ’লে আমাকে যেন দোষ দেবেন না’।
‘আরে না রে বাবা, তোমার সে ভয় নেই। চলো, না খেয়ে মরবার চেয়ে না হয় খেয়েই মরবো’।
‘পাহাড়ী পাকদন্ডি বেয়ে পথ। উঁচু নীচু ঢালু পথে চলছি তো চলছিই। আগে আগে চলেছে থাপা, পিছনে আমি। পথ যেন শেষ আর হয় না’।
‘হঠাৎ দারোয়ান থাপা পেল্লায় এক লাফ মেরে তিন হাত পিছিয়ে এসে পড়লো আমার ঘাড়ে। আর তখনি দু’জনেই পপাত ধরণীতলে। গড় গড় করে গড়াতে গড়াতে গিয়ে নেহাৎ একটা পাথরে আটকে গেলাম নইলে দু’জনকেই অতল খাদে সমাহিত হতে হতো, তা ঠিক’।
‘এটা কি হলো কান্ড তোমার শুনি? অ্যাঁ….থপ ক’রে এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে কেন বিপদের মতন। নাম থাপা বলেই না কী রে বাবা?’
‘দেখলেন, দেখলেন তো কি সব কান্ড শুরু হচ্ছে, স্যার?’
‘হচ্ছে তোমার গুষ্টির মাথা আর মুন্ডু। খামোকা হনুমানের মতন পেল্লায় লাফ মেরে আমার ঘাড়ে এসে পড়লে কেন শুনি’?
‘কি করবো স্যার? আর একটু হলেই এক পাহাড়ী সাপের ল্যাজে পা দিয়েছিলাম আর কি। আর তা হ’লেই আর দেখতে হ’তো না স্যার। ভীষণ হিংস্র সাপ যে’। …
‘কি আর করা? খানিক পরে আবার গুটি গুটি পায়ে ঢালু পথে নামা শুরু হ’লো আমাদের। আধ মাইলটাক হয়তো গিয়েছি। পাহাড়ী পথে দূরত্ব বোঝা কঠিন। হঠাৎ
‘ও রে বাপরে…’ বলে থাপা পথের মাঝেই ঝপ করে বসে পড়লো আর আমার কপালে ধাঁই করে এসে লাগলো একটা কাঠফল। অনেকটা আখরোটের মন দেখতে। ওই অঞ্চলে অনেক মেলে জঙ্গলে। আমি কাঠফল বলি। বাজারে ও বিক্রি হয় অন্য সময়’।
‘বেজায় ব্যথা পেয়ে উঃ করে উঠলুম আমি’।
‘সামনে তাকিয়ে দেখি দূরে পথের বাঁকে গাছের ডালে বসে বাঁদর বা বেবুন জাতীয় একটা প্রাণী আমাদের মুখ ভেঙাচ্ছে। রাগ করে গোটা কয়ক নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারতে তবে সে পালিয়ে রেহাই দিল।
‘উঃ, কি সব গেরো রে বাবা’।
এই বলে কাল্লুজী আমার মিনারেল ওয়াটারের বোতল তুলে নিয়ে ছিপি খুলে জল ঢাললো গলায়। তারপরে সেটা নামিয়ে রাখতে গেল আর তার হাত ফসকে গিয়ে বোতলটা ধপাস করে মেঝেতে পড়েই গড়িয়ে গেল দরজার দিকে। বেগে জল ছড়িয়ে গেল। লাফিয়ে গিয়ে কাল্লুজী বোতলটাকে কব্জা করে আনলেও জলটা কে পারলো না আটকাতে’।
‘এই, এই হ’লো শুরু….’
‘কি শুরু হ’লো, কাল্লুজী?’
‘নাঃ, ও কিছু নয়। ওই অন্ধবিশ্বাস রে ভাই সব। তা শোন রে পন্ডিতজী’।
‘কপালে হাত বোলাতে বোলাতে আরও মাইল খানেক চড়াই উৎরাই ভেঙে শেষে মীর বক্স সাহেবের কুঠিয়াতে গিয়ে হাজির হওয়া গেল। থাপা কিন্তু দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েই খালাস। পিছন ফিরলো সে। সেই বাড়ির ধারে কাছে ও সে গেল না ভেতরে যাওয়া তো দূর অস্ত…’
‘আমি নিজেই গিয়ে দরজায় খট খট করলুম। দরজা খুললেন এসে লম্বা সাদা দাড়ীওয়ালা মীর বক্স সাহেব নিজেই। তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে আসবার উদ্দেশ্যও বললুম’।
‘তা তিনি লোক ভালোই। ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। আদর সৎকার হলো। তাঁর ঘরে চাল ডাল আলু সবই ছিলো। তাড়াতাড়ি খিচুড়ী আর আলুর তরকারী বানিয়ে এনে আমাকে খেতে দিলেন অভুক্ত আছি শুনে’।
‘তা যেই না ক্ষিধের চোটে হাম হাম করে খেতে গেছি অমনি মুখ গেল পুড়ে এমন গরম সে খিচুড়ি আর তরকারীতে যেমন মারাত্মক ঝাল তেমনই নুনে পোড়া’।
‘ধন্যি মীর বক্স সাহেবের রান্না রে ভাই। তিনি অবশ্য নির্দ্বিধায় সপাসপ সেই রান্না করা খাবার সব গপা গপ শব্দ করে মেরে দিলেন । তা কি আর করা? কোনমতে প্রাণ বাঁচাতে তাই আমাকে ও গিলতে হ’লো রে পন্ডিতজী’।
বেজায় রাগ করে বললুম—‘এমন চাকরির না কাঁথায় আগুন’।
‘বিকেলে অতিথিকে তিনি বিস্কুটের সাথে গরম চা ও করে এনে দিলেন। তা সে চা না শর্বত তা ঠাহর হ’লো না। কোনমতে তাই গলায় ঢেলে হোস্টেলে ফেরার পথ ধরলুম রে ভাই। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার আগেই পাহাড়ী পথ তো পার হতে হবে। বৃষ্টি বাদলের দিন বলে অন্ধকার ও হবে তাড়াতাড়িই। বিদায় নিয়ে রওনা দিলুম আমি’।
‘খানিকদূর গিয়ে একজন পাহাড়ী লোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। লোকটা আমাকে চেনে কেননা সে কিছুদিন আমাদের স্কুলে সাফাইয়ের কাজ করে ছিল অস্থায়ীভাবে’।
সে জানতে চাইল-‘স্যার আপনি এই বৃষ্টি বাদলে এইদিকে কোথায় গিয়েছিলেন আজ?’
আমি বললুম-‘মীর বক্স সাহেবের বাড়িতে…’।
শুনেই সে… ‘ওরে বাপরে …সর্বনাশ’… বলেই লাফিয়ে উঠে এমনভাবে ছুটে পালালো যেন স্বয়ং শয়তান তাকে তাড়া করেছেন। কিছুই না বুঝে হাঁ করে থাকতে হ’লো আমাকে’।।
কোনমতে ফেরবার চেষ্টা করতে হবে তাই ভাবনা চিন্তা বেশী না করে পা বাড়াতে হ’লো আর তখনই জোর বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টিতে পাহাড়ী পথে চলা কঠিন হয় কেননা জলের স্রোত নামে নীচের দিকে ঢাল বেয়ে। একটুতেই পা পিছলে যায় আর তা হলেই গভীর খাদে সমাধি লাভ হবেই’।
‘কোনমতে ভিজতে ভিজতে ফিরে তো এলুম কিন্তু ঘটনাটা ঠিক চাউর হয়ে গেল আর তার ফলে স্কুলে ছা্ত্র থেকে কর্মচারী আর মাষ্টার থেকে প্রিন্সিপ্যাল অবধি সবাই যেন কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে শুরু করলো আমাকে দেখামাত্রই। এ আবার কি কান্ড রে বাবা?’
‘পরদিন অবশ্য ট্রাক এসে গিয়েছিল রাস্তা ঠিক হতেই তাই আর আমাকে যেতে ও হয় নি কোথাও অন্যত্র খানা খেতে। কিন্তু গন্ডগোল কাটেনি’।
‘একদিন সিমনী নামের একটা ছেলে ক্লাশে পড়া না বলতে পারায় আমি রাগ করে তার কান মুলে দিতে যেতেই সে আর্তনাদ করে উঠলো— ‘ও রে বাপরে…না স্যার আমাকে আপনি ছোঁবেন না যেন, স্যার। অন্য যা হয় শাস্তি দিন স্যার আমাকে…’।
শুনে বেজায় রাগ হয়ে গেল আমার। মুখটাকে তেঁতুলের চাটনির মতন করে জিজ্ঞাসা করলুম--‘কেন? আমি ছুঁলে কি তোমার জাত যাবে না কী?’
‘তা নয় স্যার। আপনি ছুঁলে আমার ভীষণ বিপদ হবে, স্যার। আপনি যে মীর বক্স সাহেবের বাড়ীতে গিয়েছেন, স্যার। হয়তো খানা ও খেয়েছেন, স্যার’।
‘হ্যাঁ, তা খেয়েছি। আর তা’তে হয়েছেটা কী? না খেয়ে থাকবার চেয়ে…’
‘না খেয়ে মরে গেলেও আমরা কেউ কখনো ওনার বাড়িতে যাই না, স্যার। ভীষণ বিপদ হয়, স্যার। সব সময় বিপদ সাথে ঘুরে বেড়ায় স্যার, ষাঁড়ের মতন তাড়া করে গুঁতোবে বলে’।
‘দুত্তোর, ষাঁড়ের না নিকুচি করেছে। যত সব কুসংস্কার তোমাদের….’ বলে ফিরে গেলুম আমি সেই ছেলেটাকে কোন শাস্তি না দিয়েই।
‘আমি রাগ করে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়লুম ধপাস করে আর তখনি ঘটলো আর এক অঘটন। চেয়ারটা কাঠের পাটাতনের ওপরে ঠিকমতন হয়তো বসানো হয় নি হয়তো। বাচ্ছা ছেলেদের দিয়েই এই সব কাজ ও করানো হয়। যাদের ডিউটি তারা শুধু তদারক করে। কুড়ের বাদশা বলে কথা আছে না একটা’।
‘আমি গিয়ে ঝপ করে বসতেই সেটা একদিকে কাৎ হয়ে গেল আর পরক্ষণেই ধাঁ করে উল্টে গেলো দড়াম শব্দ করে। ছাত্ররা সবাই চীৎকার করে উঠলো কিন্তু কেউ আমাকে ধরে তুলতে তো এলোই না। উল্টে মুহূর্তে ক্লাশ খালি হয়ে গেল’।
‘আমার যখন হুঁশ ফিরলো তখন দেখি যে আমি মিলিটারী হাসপাতালের বেডে চিৎ হয়ে পড়ে আছি কাতলা মাছটার মতন সর্দারজীর বনে গিয়ে। পাগড়ির বদলে মাথায় ইয়া বড়ো এক সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। তিন দিনের মতন আমার ছুটি হয়ে গেল’।
‘এই ঘটনার পরে কিন্তু পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হয়ে উঠলো স্কুলে। আমার ক্লাশে আর কোন ছাত্রই পড়তে আসতে চায় না। ক্লাশ একদম ফাঁকা। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ধমক ধামকে ও কাজ হয় না’।
‘তখন একটা রফা হলো যে আমি ক্লাশে নিজের চেয়ারে বসেই পড়াবো। ছাত্রদের কাছে আর যাবো না। ছাত্রদের শাস্তি দিতে হলে ‘স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চ’ বা ‘নীল ডাউন’ বললেই হবে’।
‘তা সেই মতন কাজ চললো। তবে সে’ভাবে ইংরিজী পড়ানো না হয় গেল, অংকের বেলায় কি হয়? বোর্ডে অংক কষে দিতুম আমি, ছাত্রেরা লিখে নিত দেখে। একদিন রুন বলে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে উঠে বললো-‘স্যার, আমি তো ১০ নম্বরের অংকটা ঠিক এমনি ভাবেই করে ছিলাম কিন্তু আপনি সেটা ভূল বলে কেটে দিয়েছিলেন কেন, স্যার?’
বললুম--‘কই? কোন অংক নিয়ে এসো তো দেখি’। তা ছেলেটা ও ছাড়বে না। সে খাতা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল আমাকে দেখাতে’।
‘কিন্তু বিধি বাম। একটা স্টুলে কি করে পা আটকে গেল ছেলেটার তাড়াতাড়িতে। দড়াম করে সে পড়ল গড়িয়ে। জোর চোট লাগলো। হৈ চৈ শুরু হয়ে মুহূর্তে ক্লাশ ফাঁকা হয়ে গেল। আমাকেই বাধ্য হয়ে পিওন ডেকে এনে ধরাধরি করে ষোল বছরের ছেলেটাকে তুলে ফার্স্ট এড রুমে নিয়ে যেতে হ’লো’।
‘ক্লাশের বারোটা বেজে গেল। আর এমনিধারা কান্ড হতে থাকলে পড়াশুনোই বা চলে কি করে? আমার যে কি দোষ তাও তো বুঝলুম না। আমি তো আর কিছু করিনি রে বাবা’।
‘তবে ভেতরে ভেতরে আমাকে স্কুল থেকে সরাবার জন্যে যে সবাই লেগে পড়েছে তা ও জানতুম না। এমনিতেই এস০টি০ বলে অনেকেই আমাকে পছন্দ করতো না। স্টাফরুমে আমি যে চেয়ারটায় বসতুম সেটাতে কেউ ভুলে ও বসতো না’।
‘হঠাৎ আমার নামে সেদিন একটা চিঠি এলো রেজিষ্ট্রী। বড়বাবুর কাছে। আমাকে অফিসে ডাকা হ’লো। আমি তখনি গেলুম’।
‘বড়বাবু বললেন-‘ভেতরে আসুন স্যার। কাউন্টারে তো হবে না। রিসিভ করতে হ’বে রেজিস্টারে সই করে’।
‘আমি তখন ভেতরেই গেলুম অফিসঘরে।
‘স্যার, এই রেজিস্টারে এইখানে সই করুন আপনি। এই আপনার চিঠি’।
‘আমি নীচু হয়ে সই করছি। বড় বড় করে লিখলুম কাল্লুরাম রাম। সই করে ঝট সে মাথা তুলে বললুম-‘কই, দিন আমার চিঠি’।
‘তা সে সময় যে তিনি এগিয়ে এসেছেন আমি ঠিকমতন সই করছি কি না তাই দেখতে না কি করতে, তার আর আমি কি জানি। সই করে মাথা তুলতেই খটাং করে তাঁর থুতনিতে আমার মাথাটা ঠুকে গেল জোরসে’।
‘আমার মুখ দিয়ে ধন্যবাদ বেরিয়ে আসবার আগেই বড়বাবু ‘বাপরে…’ বলে চোখ উল্টে চেয়ার সমেত ডিগবাজী খেয়ে এক্কেবারে পপাত ধরণীতলে হলেন। আমি শূন্যে উড়ন্ত খামখানাকে খপ করে ক্যাচ ধরে নিয়ে মাথার পেছনে আলুর মতন ঢিবি হয়ে ফুলে ওঠা জায়গাটায় হাত বোলাতে লাগলুম’।
‘দারুণ হৈ চৈ পড়ে গেল অফিসে। লোকজন সব ছুটে এসে বড়বাবুকে তুলে নিয়ে হসপাতালে গেল। এমনিধারা কান্ডের পরে কি আর স্কুলে পড়া হয়? যা হয় তা হ’লো ছুটি। তাই হয়ে গেল’।
‘আর আমি মাথায় জল টল দিয়ে ব্যথা একটু কমলে খাম খুলে দেখি আমার এই স্কুল থেকে ট্রান্সফারের চিঠি এসেছে। আমাকে আরও কুড়ি মাইল ভেতরে এক অখ্যাত অখাদ্য বাজে জায়গার স্কুলে বদলি করে দেওয়া হয়েছে প্রিন্সিপ্যালের বিশেষ অনুরোধে। সেখানে মেসের ব্যবস্থা ও নেই না কী’।
‘আমি তখন রাগকরে দিন সাতেকের জন্য ছুটির একটা দরখাস্ত ঠুকে দিলুম। ছুটি মন্জুর ও হলো কিন্তু ফিরবো যে তারও তো উপায় নেই। সেই ট্রাক ভরসা। বৃষ্টি ও শুরু হ’লো আবার। চারদিন বসে কাটলো’।
‘বৃষ্টি একটু কমতে যদি বা ট্রাক এলো তো আবার বৃষ্টি। ফিরি কি করে? কোনমতে রওয়ানা যদি বা হলুম ট্রাকে আমার জিনিষপত্র তুলে নিয়ে, তা মাইলখানেক গিয়েই বিপত্তি। টায়ার পাংচার। একঘন্টা লাগলো স্পেয়ার চাকা চেন্জ করতে’।
‘পাহাড়ী পথে আবার রওনা হওয়া গেলো। তা ঘোরানো পাহাড়ী পথে তো বার বার গিয়ার পাল্টাতে হয়ই। ঠিকমতন নিয়মিত গিয়ার চেকিং ও করতে হয়। পাহাড়ী কুড়ের ডিম গুলো সেসব তো করেই না ঊল্টে মদ না খেয়ে গাড়ী চালায় না। ফল যা হ’বার তাই হলো’।
‘একটা বাঁকের মুখে এসে গিয়ার বক্সটাই জ্যাম হয়ে আটকে গেল। কোনমতে ব্রেক কষে গাড়ী থামানো গেল বলে উল্টে খাদে গিয়ে পড়তে হ’লো না এই রক্ষা কিন্তু গাড়ী আর চলবে কি করে?’
‘সেখানে জনমানব নেই। বৃষ্টি ও পড়ছে। আলো থাকতে থাকতে ড্রাইভার গিয়ার বক্সটাকে খুলে ফেললো আর বৃষ্টির মধ্যেই ক্লিনার রওনা হলো চার মাইল দূরের গ্রামের উদ্দেশ্যে। নতুন গিয়ার বক্স আর মেকানিক নিয়ে আসতে’।
‘আর আমি আর ড্রাইভার দু’জনে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলুম। জংলী জানোয়ারের ভয়ে। বৃষ্টিতে রাতে পাহাড়ীপথে অন্ধকারে কে আসছে? সারা রাত ঠায় বসে কাটলো। পরদিন ভোরে মেকানিক নিয়ে এলো ক্লিনার সাহেব। নতুন গিয়ার বক্স সেট করা হ’লো দু’ঘন্টায়, তারপরে গাড়ী সচল হলো’।
‘বৃষ্টির মধ্যে পথে অন্য একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ট্রাকের বনেট তুবড়ে গেল খানিক পরেই। কিন্ত এতো কান্ড করে ও যে গৌহাটিতে এসে পৌঁছেছে সেই ট্রাক আজ বিকেলে পথে কোথাও না উল্টে গিয়ে এই আমার বাপের ভাগ্য রে পন্ডিতজী।। আর আমি যাই ওই চাকরী করতে? মরতে হয় কাশীতেই গিয়ে বরং না খেয়ে মরব আমি। উঃ কি গেরো রে বাবা’।
‘আমি বললুম –‘কাল্লুজী, ভূলে যেও না যে কাশীতে এখনও মা অন্নপূর্ণার বাড়িতে রোজ অন্নসত্র চলে। না খেয়ে কেউ মরে না সেখানে, কাল্লুজী। তবে….’
ব্যাপারটা আমার কাছে তখন পর্যন্ত অবাস্তবিক, অবিশ্বাস্য আর হাস্যকর বলে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আমার কথাটা শেষ আর হ’লো না।
দরজায় কেউ নক করলো। বললুম—‘কাম ইন, খোলা আছে দরজা…’
পর্দা ঠেলে দু’জন ভেতরে এলো। রুম সার্ভিস। আমাদের ডিনার নিয়ে এসেছে অর্ডার মতন। সামনের জনের হাতে একটা বিশাল ট্রে অন্য ট্রে দিয়ে ঢাকা। পিছনের জনের হাতে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর আইসক্রীমের ট্রে। ঝকঝকে টাইল্স বসানো মেঝেতে পা রেখে তারা ধীরেই সেন্টারে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো’।
তারা তো আর জানে না যে কাল্লুজী মেঝেতে আধ লিটারের মতন পরিষ্কার মিনারেল ওয়াটার ঢেলে রেখেছে। যেই না তারা জলের ওপরে পা দিয়েছে আর যায় কোথায়। সড়াৎ করে পা স্লিপ করলো প্রথম জনের আর সে উল্টে গিয়ে দমাস করে পড়লো দ্বিতীয় জনের ঘাড়ে। দু’খানা ট্রেই শূন্যে উড়ে গেল আর পরক্ষণেই দমা দম করে এসে আছড়ে পড়লো রুম সার্ভিস বয়দের মাথায়।
ভাত, ডাল, তরকারী, চাটনী, আইসক্রীম সব মেখে তারা তখন-‘ বাবারে মা রে গেলুম রে মলুম রে’… বলে কাৎরাতে লাগলো।
‘আরে ই ক্যা ভয়ল রে…’ বলে কাল্লুজী উঠে ছুটলেন তাদের তুলতে আর অমনি গড়িয়ে আসা আইস ক্রীমের বলে পা দিয়ে তিনি ও পা ঊল্টে ডিগবাজী খেয়ে ছিটকে পড়ে… ‘আরে বাপ্পা রে, মাই রে, মর গইলি রে…’ বলে এমন আর্তনাদ শুরু করে দিলেন যে আরো চার জন রুম অ্যাটেন্ড্যান্ট ছেলে ছুটে এলো। সে কী হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড রে বাবা। সে সব আর কহতব্য নয়।
অনেককষ্টে সব মিটতে তখন ঝগড়া লেগে গেলো এই নিয়ে যে আমাদের ডিনার তো সবাই মেখে টেখে নিয়ে খতম করলো, তা এখন দ্বিতীয় বার ডিনারের পয়সা কে দেবে?
কাল্লুজী বলে-‘দোষ তো তোমাদর । ফেলেছ সব তোমরাই। তাই দাম ও তোমরা দেবে’।
তারা বলে-‘আমাদের দোষ নেই কোন। মেঝেতে অতো জল কি আমরা ঢেলেছি না কী?’
সে কচকচি আর মেটে না। বহু কষ্টে ফয়সলা হ’লো –ফিফ্টি ফিফ্টি লোকসান দু’জনেরই আর সেই টাকাটা ও আমারই গেল গাঁটগচ্চা।
তা পরীর দেশের রাজার ছেলে চঞ্চলতো এই সব কান্ড না দেখে শুনে হেসেই কুটি পাটি হ’তে লেগেছে। আমারই মাথায় বাজ পড়েছে। অবিশ্বাস মাথায় উঠে গিয়েছেন আমার সাঁৎ করে, আর চক্ষু ও চড়ক গাছে।
তাই ডিনার সেরে কাল্লুজী যেই না গুড নাইট করে চলে গেছেন অমনি আমি ও দরজা বন্ধ করে দাদার শরণ নিলুম ফোনে তখুনি।
সব শুনে টুনে নিয়ে দাদা বললো –‘কালকের জন্য টিকিট তো মিলবে না ট্রেনের, তবে পরশুর জন্য ব্যবস্থা হয়ে যাবে’।
আমি বললুম –‘রক্ষে করো মা। আবার চব্বিশ ঘন্টা এইখানে বসে থাকা। কাল্লুজীর সাথে। নৈব নৈব চ। কভি নেহী’।
বাধ্য হয়ে শেষে বললুম-‘দাদা, তুমি প্লেনের টিকিট পাঠাও কালকের সকালের । দিল্লী হয়ে বেনারস যাবার জন্য । আমার আর চঞ্চলের জন্য চাই। আর কাল্লুজীর জন্যে ট্রেনের টিকিট পাঠাও পরশুর। এমনিতে ও আমি আর যেতে রাজী নই কাল্লুজীর সাথে এক ট্রেনেতে। বুঝলে? গিয়ে সব বলবো তোমাকে’।।
দাদা শুনে কি বুঝলো কে জানে শুধু বললো –‘তা বেশ, আমি ফ্যান্সি বাজার এলাকার থানার ও০সি০কে বলে দিচ্ছি ফোনে । কাল সকালে টিকিট পেয়ে যাবি। তবে ফ্লাইট মনে হয় এগারোটায়। দশটার আগেই বেরিয়ে পড়বি এয়ার পোর্টে যাবার জন্য হোটেলে একদিনের একস্ট্রা পেমেন্ট করে দিয়ে’।
‘মনে হয় আড়াই ঘন্টায় দিল্লী এসে যাবি তোরা। বিকেল ৬টার ফ্লাইটে সাতটা কি সাড়ে সাতটার মধ্যেই তোরা বেনারসে পৌঁছে যাবি। লাগেজ কালেকশান হলে এসেই ফোন করে দিবি। বেনারসের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেব আগেই’।
‘ছেলেটাকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরে আয় তো দেখি। কি যে সব কান্ড করিস তোরা তাও তো আমি বুঝি না’।
‘কিন্তু খবর্দার বলছি। তোর বৌদিকে কিছুটি বলবি না এখন, নইলে তোর কপালে কিন্তু দুঃখ আছে। ফোনটা চঞ্চলকে দে। ওকেও বারণ করে দিই আগেই। । যা গাধা ছেলে হয়েছে না একটা। ঠিক তোর গুণ পেয়েছে আর কি?’।
‘ও রে বাবা, বোঝ এখন ঠ্যালা। ছেলে হ’লো গিয়ে দাদার আর সে কি না গুণ পেলো এই অভাগা আমার। তা পাক গিয়ে। আমার কোন ক্ষতি নেই। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি নীতি এখন আমার’।
==========================================================================
০৯৪৫২০০৩২৯০
।
রচনাকাল : ১০/৪/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।