অপরিচিত
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ।
ছত্রিশগড় রাজ্যে নক্সালদের বড় ঠিকানা জেনে ও সেই রাজ্যের পহন্ডোর বলে এক
অখ্যাত জায়গায় না গেলে কাকুকে মুশ্কিলে পড়তে হ’তো না। গ্রাম দেহাত জায়গা
তায় আদিবাসী বহুল। সুবিধাজনক নয় মোটেই। তবে জল হাওয়া ভালো। জল যত
না তার চেয়ে হাওয়া আরো জোর ভালো কেননা খোলা জায়গা বলেই হোক বা যে
কারণেই হোক হাওয়া বেশ জোর।
একজন স্থানীয় ভদ্রলোক ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন কাকুকে সাদরে। নাম পরমেশ সিংহ।
তাঁর গরজ ছিল। তিনি সে’খানে ডাক্তারী প্র্যাকটিশ করতেন। গ্রামের ডাক্তার কিন্তু
একমেবাদ্বিতীয়ম অবস্থায় পসার মন্দ নয়।
যেখানে বেশীর ভাগ সবই তখন কাঁচা মানে ইঁটের পলেস্তারা বিহীন সাদা চুন করা
দেওয়াল আর খোলার বা টিনের চালের বাড়ির ছড়াছড়ি, সেখানে তাঁর একখানা
বেশ বড় সড় পাকা দোতলা পরিষ্কার পরিছন্ন রঙ চঙে সুন্দর বাড়ী ছিল রাস্তার
ধারে। সাথে বেশ প্রশস্থ কম্পাউন্ড বাউন্ডারী দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। বড় লোহার
গেট লাগানো বাড়ী আর তার পাশেই আর একখানা মাত্র পাকা বড় বাড়ী ছিল।
বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা ও বেশ বড় সড় একটা
বেলগাছ ও ছিল, আমি গাছগুলো গিয়েই দেখে নিয়েছিলাম।
আমার নাম যে চঞ্চল তা হয়তো আর বলতে হবে না নতুন করে। আমার বয়স
তেরো পুরো হয়ে গেছে তখন।
কাকুকে ডাকবার কারণ ছিল।
ডাক্তার ভদ্রলোকের এক আত্মীয়ের হঠাৎ মৃত্যু হয়ে তিনি চিন্তায় পড়েছিলেন বেশ।
তবে জায়গাটার মায়া কাটিয়ে বাড়ী বিক্রী করতে ও পারছিলেন না। শখ করে
বহু খরচ পত্র করে পুরনো বাড়ী কিনে প্রায় নতুন করে বানিয়ে ছিলেন সপরিবারে
আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে থাকবেন বলে।
জলের পাম্প, এ০সি০ এমন কি নিজস্ব একটা লিফ্ট ও ডিজেল জেনারেটার পর্যন্ত
আনিয়ে লাগিয়েছিলেন।
তা কাকু তাঁর সমস্যা শুনেই বলেছিল-‘আপনার আত্মীয়ের হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে
মৃত্যু হয়ে থাকলে সে তো পুলিশ দেখবে। আমি কি করবো গিয়ে, বলুন?
তা পুলিশ না কী পথ চলতে হঠাৎ কোন কারণে শ্বাস আটকে মৃত্যু হয়েছে তাঁর
শ্যালকের বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। নক্সালিরা হঠাৎ সাধারণ লোককে মারবে কেন
পুলিশ পেয়াদা ও সরকারী অফিসার ছেড়ে তা তিনি বুঝতে পারেন নি।
ভয় ভাবনায় ক্রমে নানা উপসর্গ জুটেছে এসে। মাঝে মাঝে রাতে তাঁর দম
আটকে আসে। হজম হয় না। সাথে গ্যাস আর অ্যাসিডিটি ও বেড়েছে। হার্টে
ও বেশ প্রবলেম হতে শুরু করেছে। তাঁর স্ত্রী ও ডাক্তার। গাইনী। তিনি ও বেশ
অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মাঝে মাঝে। সবটাই হয়তো মানসিক ব্যাপার।
কিন্তু বাধ্য হয়ে কাকুকে আসতে হয়েছে। আগাম পারিশ্রমিক পেয়েছে দশ হাজার
সাথে আসা যাওয়ার খরচ।
আমার কাকু তো আজকাল একলা কোথাও যেতেই চায় না তাই বাদল বা আমাকে
সঙ্গে নেয়। অবশ্য আমি সঙ্গে এসে থাকলে কাকুর সাহায্য যে কতো হয় তা কাকুই জানে।
মা তো বলে আমি নাকি কোন কম্মের নই। শুধু পরীর দেশের রাজকুমার ছেলে হয়ে
কি কাকুকে রহস্য অনুসন্ধানে সাহায্য করা যায় না কী? আমি একটা অপরূপ সুন্দর
ছেলে হ’তে পারি কিন্তু তা হয়ে কাকুর কি যে লাভ হয়েছে তাও বুঝি না। কাকুর
কাজে সাহায্য করতে হ’লে ঘটে বাদলের মতন বুদ্ধি থাকা চাই যে। সে আমার থাকলে
তো। তবে কাকু যে আমাকে একলা ছাড়তেই চায় না, তাই আমাকে যেতে হয় সঙ্গে।
রেল স্টশনের সে’খানে বালাই নেই তাই বাসে যেতে হয়েছিলো আমাদের।
অবশ্য অন্যদের মতন কাকু ও আমি গ্রাম্য লোকের মতন সাধারণ সাজ পোষাকে গিয়েছিলাম
নইলে যে এই সব দেশের লোক খুব সন্দেহ করে। নক্সাল প্রভাবিত এলাকায় ভাষাটা হিন্দী
কিন্তু লোকাল ডায়ালেক্ট, বোঝে কার বাবার সাধ্য? তাই কাকু ইসারাতেই কাজ সারছিল।
আমাকে সুরক্ষা উপকরণ ও পরাতে পারেনি । বাসে যে খুব ভীড়। দু’টো টিকিট তো
কাকু নিয়েছিল, কিন্তু বসাবার জায়গাই নেই। কোনমতে লাষ্ট সীটে আমাকে একটা জানলার
ধারে বসিয়ে দিয়ে কাকু কোনমতে আমার পাশে বসে এসেছে। শীতকাল। তাই আমি টুপি ও
পরে নিয়েছিলাম একটা।
বাস ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলে পহন্ডোর পৌঁছাল রাত আটটাতে। পেছনের সীটে দেখি ঝাঁকুনি ও
বেশী লাগে কিন্ত উপায় তো নেই। বাস থামতে তখন বাসের ছাদ থেকে একে একে জিনিষপত্র
নামাতেই রাত ন’টা বেজে যেতে, কাকু চিন্তায় পড়লো । অটো বা রিক্সা কিছুই নেই। বাস
ও লেট করেছে বেশ। কাকু ফোন করতে সিংহমশাই বললেন আপনারা একটু অপেক্ষা করুন
আমি লোক পাঠাচ্ছি।
তার পরে কোনমতে সেই বাড়ীতে ঢোকা গেল রাত দশটায়। সারা পথ অবশ্য হেঁটেই আসতে
হ’লো আমাদের। একখানা বেশ ভালো ঘর পাওয়া গেল দোতলায়। কাকু অবশ্য বলেছিল
আগেই যে অ্যাটাচড বাথ হওয়া চাই ঘর। কাকু আমাকে রোজ নিয়ে গিয়ে সে’বারের মতন
কুয়ো বা হ্যান্ডপাম্প তলায় চান করাতে নারাজ।
আগে বাথরুমে গিয়ে আমি হাত মুখ ধুয়ে এসেই কি মনে হ’তে ঘরের উত্তর দিকের একটা
জানলা খুলে দিলুম আর ঘরে বেশ হাওয়া বইতে লাগলো। খুব ঠান্ডা উত্তুরে জোর হাওয়া
তবে বেশ পরিষ্কার। । শীতকালে হাওয়া এই সবদিকে উত্তর দিক থেকেই আসে।
আর হাওয়াতে খুব অক্সিজেন আছে মনে হয়। তাইতে দেখি একদম সেই জানলার কাছেই
একটা বেশ বড় গাছ দাঁড়িয়ে ডালপালা নাড়ছে। ঠিক যেন আমার সাথে সে কথা বলতে
বা বন্ধুত্ব করতে চাইছে মনে হ’লো। কেন তা অবশ্য আমি জানি না।
তবে আমার অমন অনেক অদ্ভূত কথা প্রায়ই মনে হয়। কাকু তা জানে।
‘কাকু, এইটা কি গাছ বলো তো?’
‘রাতে কি গাছ চেনা যায়, চঞ্চল? কাল সকালে দেখলেই বোঝা যাবে। তুমি এখন জানলা
খুলে রেখো না যেন। ঠান্ডা লেগে যাবে । নতুন জল হাওয়া তো।’।
আমি ও তখন… ‘আচ্ছা ভাই, কাল সকালে তোমার সাথে কথা বলবো। আমরা বন্ধু।
হয়েছি তো, বাই’ .. বলে জানলা বন্ধ করে এসে একটা চেয়ারে বসতেই চা টা
এসে হাজির হ’লো। একটু পরেই খাবার জন্য ও ডাক এলো।
চা আমি অবশ্য খাই নি। কাকুর নিষেধ আছে। আমার দুধের বরণ ত্বক যাতে কালো
না হয়ে যায়, কাকুর সেই ভয়। মা তো কাকুকে আমার ওপরে রাগ হ’লেই বলে-
তোমার ছেলের রূপ ধুয়ে জল খাও গিয়ে।
ডাইনিং হল নীচে।
টেবিলে সিংহ পুত্র ও পুত্রি এবং সিংহিনির সাথে সিংহমশাই নিজে ও ছিলেন উপস্থিত।
পরিচয়াদি হচ্ছে আর কাকু আমার চোখের অসুবিধার জন্য রাতে ও কালো চশমার
অনিবার্যতা বুঝিয়ে চলেছে সবাইকে তখন আমার হঠাৎ করে মনে হ’লো যে এনারা
সিংহ যখন, তখন তো আর ঘাস ফুস খাবে না । মনে হয় মাংসই খায় ।
আমি কি খাবো এ’খানে?
আবার একটা কি অদ্ভূত কথা না? তখনো কোন খাবারই সার্ভ করেনি পাচক।
তারপরে একে একে নানা পদ আসতে লাগলো টেবিলে। আর অবাক কান্ড। পোলাও
ছাড়া সবই দেখি নন ভেজ পদ। শুধু পোলাও প্লেটে নিয়েছি আমি দেখে সিংহিনী
থুড়ি মিসেস আরাধনা সিংহ তাড়াতাড়ি চিকেন কারি ঢেলে দিলেন খানিকটা আর আমি হাত গোটালুম।
‘কি হ’লো? খাও…’
‘এ’টা কি চিকেন, আন্টি?’
‘হ্যাঁ, খাও তুমি। খুব ভালো করে তৈরী করেছে আনোয়ার, তোমরা আসছো বলে।
স্পেশাল ডিস…’
‘কি…কিন্তু আমি তো খাইনা, আন্টি’।
‘কি খাওনা, মাই বয়? তুমি কি চিকেন খাও না?’
‘নাঃ, কোন নন ভেজ খাবারই তো আমি খাইনা, আন্টি’।
‘ভেরী ফানি……হাউজ দ্যাট পসিবল? তোমার বয়সী একটা ইয়ং ছেলে কি না
স্রেফ ঘাসভূষা খায়? হাউ স্ট্রেন্জ? তোমার তো শরীর রোগা আর দুর্বল হয়ে যাবে।
গ্রোথ বন্ধ হয়ে যাবে। প্রোটিন অ্যানিমিয়া হয়ে যাবে। ড্রিংক ও মনে হয় তোমার
জন্য অচল … প্রোহিবিটেড…..তা এগ তো চলে? সে তো নন ভেজই ।
না সকালের ব্রেকফাস্টে তাও নেবে না? আমার বিবেক আর বিনিতাকে দেখো।
তোমার চেয়ে ছোটই তো হবে কিন্তু কতো হেল্দি। কি মিঃ রায়, আপনি ও কি তাই?’
‘কাকু ও মুখ নীচু করতেই সিংহিনী ডাকলেন-‘আনোয়ার, টু প্লেট ভেজিটেবলস
আর পালস বা কিছু আছে?’
‘ইয়েস, ম্যা’ম, আনছি’।
আমি মনে মনে কাকুর ভাষায় বললুম-‘কুমড়োপটাশ? দাই নেম ইজ হেল্দি? বাপরে।
কাকু তো এখন ও দেখি আমি যে এতো বড় ছেলে হয়ে গিয়েছি, তাও রাতে ঘুমোতে
যাবার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে তুলে নিয়ে পায়চারী করে গল্প শোনায় রোজ।
আমার ছোট্টবেলাকার অভ্যাস যে। সে যায় কোথায়? এখন আমি যদি ও’দের মতন
হোঁদল কুতকুত হয়ে যাই, তখন কাকু কি করবে? বেশ জব্দ হবে তখন, কাকু, কেননা
আমাকে তো তুলতেই পারবে না …হিঃ …হিঃ…হিঃ…’
সে যাক গিয়ে। খেতে বসে অকারণ হাসা চলবে না এ’খানে। এটা কি বাড়ী আমাদের?
কিন্তু বাসের ঝাঁকুনিতে তখন আমার বেশ ক্লান্ত লাগছিলো। ঘুম ও পাচ্ছিলো। খাওয়াটা
শেষ হ’লে বাঁচি। ওপরে উঠে গিয়েই আজ শুয়ে পড়তে হবে, জামা কাপড় ছেড়ে।
কাকু ও বেশ ক্লান্ত মনে হয়। আজ পায়চারী করবে কি না কে জানে? করতে হয়
করবে। আমি তো ঠিক ঘুমিয়ে পড়বো’।
‘সিংহ মশাই তখন বসে তাঁর শ্যালক রাত নটা নাগাদ বাস ধরে ফিরে যাবে বলে
বাড়ী থেকে বেরিয়ে কিভাবে পরদিন মৃতদেহে পরিণত হয়ে পথে পড়ে আছেন দেখে
হৈ চৈ হাসপাতাল পুলিশ শুরু হয় সেই বিবরণ শোনাচ্ছিলেন’।
‘আমার শুনতে ইচ্ছেই করছিলো না কেননা কোন তথ্যই নেই তাঁর বর্ণনাতে।
সব অনুমান। আমার গাছ বন্ধুর সাথে ভোরে উঠে না হয় তখন কথা বলবো।
কি গাছ আমার আগে তাই জানা দরকার। সব গাছের আবার আলাদা স্বভাব আর
পছন্দ হয় কি না। কোন কোন গাছ আবার বেশ রাগী ও হয়। যেমন শাল
গাছের রাগ বেশী। বট ও অশ্বথ্থ গাছ খুব জেদী হয়। বেল গাছ আবার
ভালো মানুষ কিন্তু বড্ড দুষ্টু। অনেক অকাজ করে ফেলতে পারে রাগ করে।
তখন তাকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। অবশ্য কথা বেশ শোনে’।
‘তবে এই সব কথা তো আর সবাই মানবে না। শুনলে পাগল বলবে’।
‘কাকু অবশ্য সব জানে কেননা আমিই বলি কাকুকে। তবে কাকু একটু ও
অবিশ্বাস করে না, তাই রক্ষা। কাকুর বুদ্ধি দারুণ যে’।
‘সবাইকে গুড নাইট করে কাকু আমার চকচকে দুধসাদা ডান হাতটা ধরে সিঁড়ি
দিয়ে উঠে এলো লিফ্টের দিকে ফিরে ও না তাকিয়ে। ডঃ সিংহ বেশ অবাক হয়ে
তাই দেখছিলেন তখন’।
‘আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের জামা প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে বললুম—
‘কাকু, আজ আমার ঘুম পাচ্ছে বেশ। গল্প ...’
মশারী নেই দেখে বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে গুডনাইট বার করছিলো, কাকু।
বাংলার বাইরে মশারির চল খুব কম।
বলল-‘ভালো লাগছে না। মেজাজ খিঁচড়ে দিয়েছেন মিসেস সিংহ বক বক করে।
ডাক্তার হয়ে কেউ এতো বকবক করে কি করে কে জানে? মুরগির ঠ্যাং না
চিবোলেই প্রোটিন অ্যানিমিয়া ….হুঁ….যত্তো সব…’
আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম। কাকু ও এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ে কম্বল
মুড়ি দিয়ে বললো-‘ব্যাপারটা যে কি হয়েছিল তাই তো বুঝতে পারছিনা, চঞ্চল।
তুমি বুঝলে কিছু?’
আমি কাকুকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললুম-‘তুমি ভেবো না, কাকু।
আমার মনে হয় মিসেস এসেই বাড়িতে গন্ডগোল শুরু হয়েছে। উনি হয়তো আগে
বাইরে কাজ নিয়ে থাকতেন। এখন ও নিজেদের গাড়ী টাড়ি কেনা হয়নি। নইলে
আমাদের জন্য পাঠাতেন। ওঁর ভাই ও হেঁটে বাস ধরতে যেতেন না। তবে মনে
হয় কোন গাড়ী করে উনি এখন যাতায়াত করেন রোজ। বাড়িটা ও আগে হয়তো
একটু অন্যরকম ছিলো মনে হয়। কেনবার পরে সারিয়ে আধুনিক করে দোতলা
করে ফেলা হয়েছে বাড়িটাকে হালে। তিনতলা ও হয়তো উঠছে বা উঠবে।
আর তখন থেকেই….ও’সব কথা আমি জেনে নেব ঠিক,কাকু। আগে বন্ধুর
সাথে কাল কথা তো বলি…’
কাকু আমাকে খানিক আদর করবার পরে বেশ ঘুম ঘুম গলায় বললো—
‘হুঁ, জানলার কাছে গাছটা তো বেশ বড়ো। না কেটে বাড়ির দোতলা তোলা
হয়েছে নইলে বাড়ির উঠোনে এতো বড় গাছ কেউ এই সব দেশে রাখে না।
দেওয়ের ভয়ে। বড় জোর নীম গাছ রাখতে পারে একটা, তাও দরজার বাইরে।
তেতো গাছ তো, তাই…তবে মৃতদেহ বাড়ির কাছেই মানে তিনশো মিটারের মধ্যে
পড়ে থাকা একটু সন্দেহজনক। অপরাধী কাছেই ছিলো মন হয়। নাঃ,
বাড়িটায় অনেক গোলমাল আছে দেখছি…’
কাকুর বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলুম একটু পরেই।
রাত তখন মনে হয় অনেক।
হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে যেতে জেগে উঠলুম।
আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।
কাছেই কোথাও খুট খাট টুং টাং করে যেন মৃদু শব্দ হচ্ছে।
এখন আমি উঠতে গেলেই তো কাকুর ঘুম ভাঙবে। আমার সাবধানী কাকু তো ইচ্ছে
করেই আমার চকচকে বাঁ হাতটাকে নিজের ঘাড়ের নীচে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এমনভাবে
আটকে রেখে শুয়েছে যে আমি একটু সরলেই…..
আমি খুব আস্তে করে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে দেখি কাকু জাগলো না। বাসজার্নির
ফল আর কি। তখন উঠে আমি নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে পড়লুম কম্বল সরিয়ে।
ঘরটা বেশ ঠান্ডা মনে হ’লো কেননা নভেম্বর মাস হ’লে কি হয়, বেশ খোলা
মেলা জায়গা তো আর তখন বেশ গভীর রাত।
আমি বাথরুম থেকে হয়ে এসে ঘরটা পরীক্ষা করলুম মানে দেওয়ালগুলো।
দেখি সব নতুন হলদে ডিসটেম্পার করা আছে। ছাদটা সাদা। কোন বৈশিষ্ট্য নেই।
মসৃণ দেওয়াল।
তখন আমি আর কি করি তাই ভাবছি, হঠাৎ কাকু বললো—‘কি হয়েছে, চঞ্চল?
আমি সাহায্য করতে পারি তোমাকে কিছু?’
ওরে বাবা, তবে তো কাকু আমি উঠতে ঠিক জেগেই গিয়েছে।
কি করে কাকু যে সমস্তটি ঠিক টের পায়, কে জানে? আমি না থাকলেই
কাকুর ঘুম ও নেই হয়ে যায়। মা তো তাই বলে যে এই ছেলে নিয়ে তুমি পরে
বেশ জব্দ হবে কিন্তু ঠাকুরপো। তা কাকু তো সে সব কথা শোনেই না।
‘হুঁ’
কাকু উঠে আসতে আমি আমার হাত দু’টো উঁচু করলুম কোন কথা না বলে।
কাকু হেসে ফেলল। তবে নিঃশব্দে। এগিয়ে এসে নীচু হয়ে আমাকে দু’বছরের
ছোট্ট কচি একটা বাচ্ছা ছেলের মতন করে নিজের কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে
এসে দেওয়াল ধরে ঘরের মধ্যে ঘুরতে লাগলো খুব ধীরে ধীরে,
ঠিক একটু আগে যেমন করে আমি একলা ঘুরছিলুম।
কাকু আমার কাজ সবই দেখেছে তার মানে।
তা দেখুক গিয়ে, কাকু। তবে অনুসন্ধানের তো ফল শূণ্য এই বারে ও।
কাকু, ফিরে আসছে খাটের দিকে আমাকে নিয়ে হঠাৎ জানলার দিকে কাচের
জিনিষের শব্দের মতন টুং করে একটা শব্দ হতেই কাকু থেমে গেল। আমি
জানলাওলা দেওয়ালটা আঙুল দিয়ে দেখাতে কাকু আবার সেই দিকে এগিয়ে গেলো।
আমি বাঁ হাতে দেওয়ালটা পরীক্ষা করে নিয়ে কাকুর খালি হাতটা ধরলুম আর
টেনে নিয়ে দেওয়ালের একজায়গায় রাখতেই কাকু বেশ চমকে উঠলো।
কাকু নিজের হাতটা টেনে নিয়ে একটু শুঁকলো। তার পরে আমাকে নিয়ে বিছানার
কাছে ফিরে এসে আমাকে নীচে নামিয়ে দিলো। অন্য হাতে একটা শাল তুলে নিয়ে
আমার গুটিয়ে ওপরে উঠে যাওয়া গেন্জিটাকে ঠিক করে টেনে নীচে নামিয়ে
দিয়ে তার ওপরে গায়ে জড়িয়ে দিলো আগে যাতে আমার ঠান্ডা না লাগে।
তারপরে নিজের বিশেষ ব্যাগ খুলে একটা সেলোটেপ রোল বার করে এগিয়ে গিয়ে
সেইখানের দেওয়ালের গায়ে টেপ ভালো করে আটকে দিলো।
তারপরে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হাত ধুইয়ে দিলো লিক্যুইড সোপ দিয়ে,
নিজে ও হাত ধুয়ে ফিরে এসে বিছানায় ঢুকে পড়লো, কাকু। বাথরুমটা দেখলুম
বেশ বড় আর ভালো। গিজার, হেয়ার ড্রায়ার, সব রকম প্রসাধনের জিনিষ সাজানো আছে।
আমি কাকুর কানে কানে জিজ্ঞাসা করলুম—‘কাকু, অতো উঁচুতে ওটা কি বলো তো?’
‘কোন হিয়ারিং সিস্টেম বা এগজস্ট পাইপ থাকতে পারে, চঞ্চল। ক্যামেরার
লেন্স নয় বলেই মনে হয়। কেননা গরম হাওয়ার মতন কিছু বেরুচ্ছিল সাথে
কেমিক্যালের মনে হয় অ্যামোনিয়ার কোন যৌগিকের তীব্র গন্ধ’।
‘এই ঘরটা আমাদের জন্য ঠিক নিরাপদ নয় বলেই মনে হয়। বাড়িটা ও তাই।
এই ঘরের নীচে কোথাও অন্য একটা ঘর আছে আর সে’খান থেকেই শব্দগুলো
আসছিলো এই ঘরে। এ’দিকে তো রাত দু’টো বাজে। এখন কে রসায়ন নিয়ে
কাজ করছে কে জানে? তুমি এখন শাল খুলে রেখে দিয়ে আমার কম্বলের
ভেতরে চলে এসো, ঘরে বেশ ঠান্ডা আছে। কাল ভেবে দেখতে হবে ব্যাপারটা’।
আমি তাই করলুম, তবে আর ভালো ঘুম হ’লো না। কাকু ও শুয়ে রইলো চুপ করে।
একবার বললো-‘মনে হয় এই বাড়িতে লোকজন থাকলে কারো অসুবিধা হয়।
সে কে বা তারা কারা তা কে জানে?’।
ভোর পাঁচটা বেজে যেতে কাকু উঠে গিয়ে গিজার চালিয়ে জল গরম করে নিয়ে
ভোরের সব কাজ সেরে নিতে লেগে গেলো।
কাকু আগে ব্যাগ থেকে রুম হীটার বার করে চালিয়ে দিলো। ঘর গরম হ’তে
কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের পরে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেলো, কাকু ।
আমার স্নান, প্রসাধনের পরে ব্যাগ থেকে পরিষ্কার থার্মোওয়্যার বার করে আমাকে পরিয়ে
দিয়ে তার ওপরে শার্ট প্যান্ট, সোয়েটার, টুপি, মোজা সব পরিয়ে একদম ফিটফাট করে
আমাকে তৈরী করে দিয়ে নিজে ও তৈরী হয়ে নিতে গেলো। অবশ্য তখন ও বাইরে অন্ধকার রয়েছে।
আলো একটু ফুটতে তখন আমি ঘরের জানলাটা একটু ফাঁক করে দেখে নিয়ে
বললুম—‘ও ভাই, তুমি তো বন্ধু দেখি, বেলগাছ। কাল কথা বলতেই পারিনি
তোমার সাথে, এতো ঘুম পেয়ে গেছিলো। রাগ কর নি তো ভাই? আমাক
এই জায়গার ব্যাপারটা বুঝতে একটুখানি সাহায্য করবে, ভাই?’
আর তখনই আমার একটা অদ্ভূত অনুভূতি হ’লো। মাথাটা একটু ঝিম ঝিম
করে উঠেই ঘুরে গেল। মনে হ’লো কে যেন বলছে ----
‘বিস্ফোরক অনেকটা করে লাগে, তাই কেমিক্যালই ভালো। এ’র পরে যদি পুলিশ
শালাদের জন্য বায়োলজিক্যাল ওয়েপন মানে ভাইরাস বোমা তৈরী করতে পারা যায়, তখন দেখা যাবে,
কে বেশী ……..’
আমার অদ্ভূত ভাবনার স্মৃতির প্রোজেকশন তখনি মিলিয়ে গেল আর আমি
হঠাৎ এক অজানা আশংকায় ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।
আমার কেমন যেন মনে হ’তে লাগলো, যে কোন কেমিক্যাল বা গ্যাস ও তার
সাথে হয়তো কোন সাংঘাতিক ভাইরাস আসল ঘটনার জন্য দায়ী ..
হয়তো আজই আবার কিছু ঘটবে….।।
আজ মনে হয় অনেক দুর্ভোগ আছে আমাদের কপালে। সিংহদের খবর নিতে হবে।
মনে হয় ওনারা ও ঘুমিয়ে আছেন এখন অবধি।’
কাকু তৈরী হয়ে আসতে সব বললুম আমি।
শুনেই কাকু বাদলের মতন ভুরু কুঁচকে বললো –‘হুম, গন্ডগোলং গড়গড়ায়তে...।।
তবে আমাদের ধারে কাছেই আছে উৎসটা। সেইটাকে খুঁজে পেলেই কাজ হবে…….
কিন্তু সেটা বিপজ্জনক খুব……হালে উগ্রবাদিরা বারুদের বদলে কেমিক্যাল বোমা
মেরে অনেক পুলিশকে যমের বাড়ী পাঠিয়েছে, তা জানি। সামনে ইলেকশান আসছে,
ব্যাটাদের কোন জব্বর প্ল্যান থাকলে আশ্চর্যের কিছু নেই। এসেই ভূল করেছি দেখছি……………. ’।
কাকুর সাংঘাতিক সংস্কৃত শুনে আমি তো হিঃ…. হিঃ …..করে হেসে দিলাম।
কাকুর মুখ ভার।
সে’দিন সকালেই জানা গেল যে একজন ব্যবসায়ী কাল রাত দশটা নাগাদ বাস
থেকে নেমে বাড়ী যাচ্ছিলেন। তা নিজের বাড়ির বদলে পথেই যমের বাড়ী চলে গিয়েছেন।
হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছে বেশ তাই নিয়ে।
আমরা ও গিয়ে জায়গাটা একবার দেখে এলুম। হত্যা বলে বোঝাই অসম্ভব।
কাকু বলল-‘আজ বিকেলে রায়পুর যাবো ভাবছি। সন্ধ্যের বাসে ফিরলেও রাত
এগারোটা হয়ে যাবে। অনেকটা দূর যে। তবে দাদাকে আগেই জানিয়ে দিয়ে দেখি।
দাদা পুলিশ সুপারকে বলে দিলে হয়তো সাহায্য পেতে পারি। পথে মনে হয় রাত
পাহারা বসাতেই হবে। আর রাতে আমাদের হেঁটেই ফিরতে হবে। ডাঃ সিংহ হয়তো
লোক পাঠাতে চাইবেন বাস স্ট্যান্ডে। তবে সেটি আটকাতে হবে.....হুঁ , দেখি কি হয়....’
‘তাই সেই মতন সব ব্যবস্থা করা হ’লো। আমরা সব জানাতে রায়পুর থেকে
পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা ঠিক করা হ’লো। তবে আমাদের সব কাজ সেরে পহন্ডোর
এসে বাস থেকে নামতে রাত এগারোটা বেজে গেলো। কাকু আমাকে সুরক্ষা উপকরণ
পরিয়ে কাকুর আগে আগে মানে পঞ্চাশ গজ আগে একলা হেঁটে ফিরতে বললো
যে কেন, তা কে জানে? হয়তো একলাটি ফিরছে কাকু, তাই বোঝাতে .....’
‘প্রায় অর্দ্ধেক পথ চলে এসেছি হঠাৎ এক জন স্থানীয় লোক কোথা থেকে
এসে কাকুকে কেমন চাপা অদ্ভূত স্বরে বলল-‘বাবুজী, একঠে বিড়ী হো তো দেঁই......’
বলেই সে কাকুর নাকের ঠিক সামনে ফস করে একটা সিগারেট লাইটার জ্বেলে ধরলো......।
সঙ্গে সঙ্গে কাকু ও জোরে ফুঁ দিয়ে সেটা ঝপ করে নিভিয়ে দিয়ে তেমনি স্বরে
বললো-‘জী নেহী হ্যায়......’
বলেই লাফ মেরে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলো লোকটাকে কিন্তু কাকুর কথা শোনা
মাত্র লোকটা অন্ধকারে সাৎঁ করে একদম দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো আর আমি ছুটে গেলুম কাকুর কাছে।
‘কি হয়েছে? ও কাকু...।‘
‘কিছুই হয় নি তবে ব্যাটা একটুর জন্য ফস্কে গেলো। সে যাক গিয়ে। তবে
ওকে এখন পদ্ধতিটা বদলাতেই হবে। লোকটা অতি ধূর্ত তাই সে মরা মানুষ
সেজে এসেছিলো দুই নাকে তুলোর ছিপি গুঁজে......আমাকে ভয় দেখাবে বলে আর
নিজের সুরক্ষা ও হবে .....’
‘কাকু, এই কি তবে হত্যাকারী, কিন্তু. কি ভাবে.....?’
‘কোন কিন্তু নেই চঞ্চল। লাইটারের পেট্রোলে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে রেখেছিলো .........
ভাগ্যিস আমি দম বন্ধ করে রেখে ছিলাম......। চলো চঞ্চল, এখন তো বাড়ী যাই।
আজ আমাদের রাতের খাবার ঘরেই এনে রেখে দিতে বলা আছে। শোবার আগে ঘরটার
সিক্যুরিটি পরীক্ষা করতে হবে আবার। গন্ডগোল তো রয়েছেই কোথা ও একটা।
আমি ধরতেই তো পারছি না এখন অবধি’।
তা সিংহ সদনে ফিরে এসে আমরা খেয়ে দেয়ে ঘরটা পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে
শুয়ে পড়লুম।। সেই রাতে ও কাকুর পায়চারি করা বাদ….. হিঃ…হিঃ….হিঃ….
পরদিন সকালে ও কাকু আগে আমাকে গরম জলে চান টান করিয়ে এনে আগের
দিনের মতন সব গরম জামা কাপড় পরিয়ে তৈরী করে দিয়ে আমার চোখে নাইট
ভিজন ও হাতে সুরক্ষা উপকরণটা ও পরিয়ে দিলো, তারপরে নিজে বাথরুমে চলে
গেল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে।
আমি ভাবলুম কালকের আক্রমণটা যখন বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে হয়েছিল তখন
সেই থট প্রোজেকশানটা তো মিথ্যে নয়। কিন্তু সেটা করলে কে? আর কি ভাবে?
আমার গাছবন্ধু কি?
তবে সুরক্ষার কাজটা করে কাকু একদম ঠিক করেছিলো সে’দিন। কেননা কাকু
যখন ঘরে ঢুকলো চান সেরে তখন আমি নেই হয়ে গিয়েছি। কাকু ও জব্দ হয়ে গিয়েছে।
আসলে হয়েছিলো যা সে এক নাটক।
আমি শালটা তুলে ভাঁজ করছি হঠাৎ খুট খুট করে কড়া নাড়লো কেউ যেন
দরজার। আমি তো আর বাদল নই। তাই হাঁদার মতন শালটা হাতে নিয়েই খুলে
দিলুম দরজা বাড়ির কেউ জলখাবারের জন্য ডাকতে এসেছে ভেবে। দেখি ছোট
মাস্ক পরা একটা লোক হাতে একটা স্প্রেগান নিয়ে নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে আছে
বাইরে । তার সামনে নীচু চাকা লাগানো হ্যান্ডেলওলা একটা স্ট্রেচার লম্বালম্বি ভাবে
রাখা আছে নীচে, ঠিক দরজার সামনে।
আমি তখন-‘আপনি কে? কি চাই’? বলতেই সে ঘরে কি একটা সাদা মতন
কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে স্প্রেগান চালিয়ে দিলো। একটা মিষ্টি গন্ধের
গ্যাসে আমার সামনেটা সাদা হয়ে গেল। আমি শাল দিয়ে মুখ ঢাকতে চেষ্টা
করলে কি হয় ততক্ষনে মাথাঘুরে ধপ করে গিয়ে পড়লুম গদি লাগানো সেই
স্ট্রেচারের ওপরে। ব্যস। লোকটা সেটা ঠেলে নিয়ে চলে গেল লিফ্টের দিকে।
আমি জীবনে প্রথমবার অপহৃত হয়ে গেলুম নিঁখুতভাবে আমার হাতে অত্যাধুনিক
শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক সুরক্ষা উপকরণ থাকা সত্বে ও।
তবে জিনিষটার অনেক গুণ। আমি তা জানতুম না ।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার জ্ঞান ফিরে এলো আচমকা। লিফ্ট তখন ও নীচে
নামছে। মনে হয় তিন চার তলা নেমে তবে থামলো। আমার মনে হ’লো যে
দোতলা বাড়িতে লিফ্ট চার তলা নামে কোন মন্ত্রে?
এ বেশ রহস্যজনক লিফ্ট। পরীক্ষা করে দেখতে হবে তো।
স্ট্রেচার ঠেলে লোকটা লিফ্ট থেকে বেরিয়ে এসে সোজা এগিয়ে গেলো আর একটা
ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঠেলে দিলো আমাকে স্ট্রেচার সমেত আর দরজা বন্ধ করে দিলো।
ব্যস। তার কাজ শেষ।
আমি আস্তে করে মুখ তুলে দেখি যে ছোট একটা ঘরে মিটমিট করে একটা বাল্ব
জ্বলছে। মেঝেতে ম্যাট পাতা আর সে’খানে দু’টো ছোট ছেলে মেয়ে জড়াজড়ি
করে বসে আছে আমার দিকে চেয়ে। দেখেই চিনলুম বিনয় আর বিনিতা। ঘরে
কোন আসবাব ও নেই। একটা চেয়ার টেবিল ও নেই যে তার ওপরে উঠে দেখব
কিছু করে পালানো যায় কি না বা সেটা তুলে কারও মাথায় বাড়ি দিয়ে পালাবার
কোন পথ করা যায় কি না। খুব চালাক লোক তো।
ঘরটা বেশ কনকনে ঠান্ডা তবে আমি অনেকগুলো গরম পোষাক পরে আছি বলে
তেমন কিছু কষ্ট না হ’লে ও ওই ছেলে মেয়ে দু’টোকে মনে হয় বিছানা থেকেই
তুলে এনেছে কোন কায়দা করে। কেননা ছেলেটার পরনে আছে একটা নেটের
স্যান্ডো সাদা গেন্জী আর জাঙিয়া। আর মেয়েটার পরনে আছে পাতলা সাদা ফিতে
লাগানো মেয়েদের টেপ আর প্যান্টি। রাতে এই পরেই হয়তো ওরা শুয়ে ঘুমিয়েছিলো।
ভাগ্যিস আমাকে ভোরে উঠে কাকু গরম পোষাকগুলো সব পরিয়ে দিয়েছিলো। নইলে….
‘তুমি চঞ্চল না…..তোমাকে ও এনেছে। আমাদের বাড়িটা ওরা দখল করতে
চায় মনে হয়...। তাই…’ বিনয় বললো।
আমি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললুম --চুপ।
আমি হাতের শালখানা বিনিতাকে গায়ে জড়াতে দিয়ে নিজের সোয়েটার ও শার্ট প্যান্ট
খুলে ফেলে বিনয়কে পরতে দিলুম। আমাকে আজ ও কাকু দামী অন্তর্বাস পরিয়ে তার
ওপরে থার্মোওয়্যার পরিয়ে দিয়ে ছিলো। তাই যথেষ্ট আমার জন্য।
তা আমি তো রোগা ছেলে তাই দেখি বিনয়ের গায়েই হয় না আমার পোষাক ।
কোন মতে টেনে টুনে তাই পরে নিয়ে তখন ও ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বিনয়
বলল –‘থ্যাংক ইয়ু, চঞ্চল। আমরা ঠান্ডায় আজ মরে….’
আমি বললুম—‘নো মেনশন। চুপ করো । ঘরটা মাটির নীচে। তাই ঠান্ডা বেশী।
তোমাদের লিফ্টে কিছু কারসাজি করা আছে। রিমোট দিয়ে চলে মনে হয়।
মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের লিফ্ট এ’টা। একের নীচে ও এই বেসমেন্ট জিরোয় নেমে
আসে অনায়াসে। কার পার্কিংয়ের উদ্দেশ্যে। তবে এ’খানে সে সব তো কিছুই নেই,
আছে এই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটা। এখন আলোটা ও নেভানো যাবে না। সুইচ বাইরে।
ইন্টিরিয়র ওয়্যারিং। আমাদের তো দেখি কিছুই করবার নেই। তোমাদের খিদে…’
বলতে বলতে আমি থেমে গেলুম। বাইরে কেউ আসছে ধীর পায়ে।
হয়তো খাবার নিয়ে।
সাবধানে দরজা খুলে এক ভীমকায় লোক খালি হাতে ঘরে ঢুকতেই বিনিতা বললো-
‘আংকল, আমাদের কিছু খেতে দেবে? আমাদের খুব খি….’
‘খাওয়াচ্ছি। চল, চেম্বারে ঠুঁসে দিই তোদের, আর খিদে পাবে না জীবনে। শালার
বদমায়েস টিকটিকি চিঠি পড়ে ও ভয়ে না পালিয়ে পুলিশে ফোন করছিল। বাধ্য
হয়ে সিস্টেম জ্যাম করে আটকাতে হয়েছে। এইবার চল শয়তানের বাচ্চা ….’
আমার মনে পড়লো যে একদিন কাকু গল্পে বলেছিলো জার্মান কনসানট্রেশান ক্যাম্প ও
গ্যাস চেম্বারের কথা, যেখানে ইহুদিদের ঢুকিয়ে দিয়ে দলে দলে মেরে ফেলা হ’তো।
এও সেই না কী?
লোকটা আমার দিকে কটমটিয়ে চেয়ে বললো---‘আগে তোর পালা। তুই চল ।
শালা টিকটিকির এই সুন্দর মতন ছেলেটা আগে না মরলে ওই হারামির বাচ্চা
পালাবে না। ইচ্ছে করছে এ’টাকে শালার সরুমতন ঘাড়টা ভেঙ্গে এ’খানেই মেরে
ফেলি......... শালা টিকটিকি কি ধূর্ত রে বাবা……অনায়াসে আমাদের নিঁখুত পদ্ধতিটা
মাটি করে দিলো কাল রাতে......। এখন পুলিশ এসে...।।
এই বলেই সে আমার ঘাড় তার বিশাল ডান হাতের থাবায় সজোরে চেপে ধরে
আমাকে একটা নেংটি ইঁদুরের মতন করে এক টানে শূণ্যে তুলে নিলো। বিনয়
বিনিতা ভয়ে চিল চিৎকার করে উঠলো।
আর তখনি হ’লো এক বিভ্রাট। সে এতো জোরে আমার ঘাড় চেপে ধরেছিলো যে
আর এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার ঘাড় ভেঙ্গে যেতো ঠিক। কিন্তু আমার সুরক্ষা
যন্ত্র যে এক ন্যানো সেকেন্ডে ও সক্রিয় হতে সক্ষম আর তার বৈদ্যুতিক শক্তি আমার
ওপর প্রযুক্ত পেশী শক্তির বর্গের মানে স্কোয়ারের সমানুপাতে বেড়ে যায়, তা সে
জানতো না ।আমি ও সে’কথা জানতুম না।
সঙ্গে সঙ্গে সে আঁ …আঁ…..আঁ….. করে এক বিকট চিৎকার দিয়ে তিন হাত দূরে
ছিটকে পড়ে নিশ্চল হ’য়ে গেলো। মনে হ’লো একদম স্পট ডেড….
আমার হাতের চকচকে স্টিলের বালা তখন সবুজ অক্ষর দিয়ে লিখে জানাচ্ছে যে প্রথম
অ্যাটাকেই থার্ড ডিগ্রী শক দিতে বাধ্য হ’তে হয়েছে তাকে, নইলে সাবজেক্ট মানে
আমার মৃত্যু হ’তো দুই দশমিক এক এক শূণ্য শূণ্য চার তিন ছয় আট নয় সেকেন্ডের
মধ্যে……হাই পাওয়ার ভোল্টেজের জন্য স্পেশাল রিজার্ভ ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও মাইক্রো
ইনডাকশান কয়েল প্রয়োগ করা হয়েছে যার পোটেন্শিয়াল ভ্যালু ৩.৪৮২৭১৬০৫২ ….
যা সর্বোচ্চ ক্ষমতার থেকে ৪৪.৯৮৭৬৫৪৩২১ পয়েন্ট কম আর সেই শক্তি প্রয়োগ
করা হ’লে টার্গেট পুড়ে কয়লায় পরিবর্তিত হয় সাড়ে তিন সেকেন্ডের মধ্যে .
রিজার্ভ পাওয়ার খরচ হয়েছে ০.১২৭৬৫৮৯৪৩ শতাংশ….
‘তুমি ওই ভয়ংকর গুন্ডাটাকে পটকে দিলে, ভাই? শাবাস চঞ্চল….’ বিনয় বললো।
‘ওই হ’লো। এখন চলো তো, বেরিয়ে দেখি…..লিফ্টটা কোথায়…আমার
কাকু যে চিন্তা করবে খুব’।
বেশী সুন্দর ছেলে থাকা মনে হয় বাবা মা বা কাকাদের জন্য বেশ একটা ঝামেলার
ব্যাপার হয়ে যায়। সে খুব বাজে জিনিষ।
অবশ্য কাকু বলে যে মা বাবাদের কাছে না কী একটা কালো হতকুচ্ছিত আর স্রেফ
প্যাঁচার মতন ছেলে হ’লে ও তাকে দারুণ সুন্দর বলে তাদের মনে হয়।
মা লক্ষীর জন্য তাই প্যাঁচা নিজের ছেলে মানে বাচ্ছাকে এনে দিয়ে ছিলো বাহন করতে,
সে দুনিয়ার সবথেকে বেশী সুন্দর বলে। কি আর করে বেচারা? মা লক্ষী সবচেয়ে যে
বেশী সুন্দর হবে তাকেই নিজের বাহন করবেন বলেছেন। তবে সে গোটা দুনিয়া ঘুরে
কোথাও নিজের বাচ্ছার চেয়ে কাউকে বেশী সুন্দর দেখতেই পেলো না তো কি করবে?’
তা খুব পা টিপে টিপে দরজা একটু খুলে তিনজনে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে তো এলাম
কিন্তু সরু টানা করিডোরে বেরিয়ে মুশ্কিল হ’লো। এখন আমরা যাই কোনদিকে?
বিনিতা মেয়েটা ভাইয়ের চেয়ে দেখি বেশ সাহসী। সে বললো—‘ভাই, তোর তো
একটুতেই ভয় করে। তুই চঞ্চলের সাথে বাঁ দিকে যা আর আমি ডান দিকে গিয়ে
দেখি। তবে সাবধান. কেউ যেন দেখতে না পায়’।
বিনয় তো তাই চায় । সে এগিয়ে এসে আমার দুধ সাদা ডান হাতটা ধরতে গেলো
শক্ত করে আর আমি লাফিয়ে উঠে… না…না…..করে সরে গেলুম।
‘না….না….বিনয়…তোমাকে আমার হাত ধরতে হবে না। তুমি এমনি আমার সঙ্গে এসো…’
‘কেন? আমার যে ভয় করছে…’
‘কোন ভয় নেই। চলো…’
আমি মনে মনে বললুম –‘আর একটু হ’লেই হয়েছিলো আর কি । এখন আমার
এক কাকু ছাড়া আর কেউ পারবে না আমার হাত ধরতে। বাপী ও না। ধরলেই
থার্ড ডিগ্রী……হিঃ…হিঃ….হিঃ……’
তা কোথায় লিফ্ট। খানিক এগিয়ে দেখি একটা দরজা পথ বন্ধ করে দিয়ে দিব্যি
দাঁড়িয়ে আছে। আমি সে’টাকে একটু ঠেলে দেখতে গেলুম আর সেটা ঝনাৎ করে
খুলে গেল। কি ব্যাপার দেখবো বলে ঢোকা মাত্র কে এসে আমাকে লোহার মতন
হাত দিয়ে চেপে ধরলো। চেয়ে দেখি একটা আমার বয়সী ছেলে তবে তার গায়ে
আসুরিক শক্তি।
পরক্ষণেই কোন চিৎকার নেই কিছু নেই অথচ সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো আর তার
নাক কান মুখ দিয়ে নীলচে মতন ধোঁওয়া বেরিয়ে আসতে লাগলো গলগল করে।
তাই না দেখে ভয় পেয়ে বিনয় চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি বললুম –‘ভয় নেই বিনয়। ওটা মনে হয় হিউমেনয়েড শ্রেণীর একটা রোবট।
এখানকার পাহারাদার। মনে হয় হাই পাওয়ার এনার্জী ওর সেন্ট্রাল সার্কেট ও চিপস
পুড়িয়ে দিয়েছে……।আরেঃ, এই ঘরটা তো একখানা গবেষণাগার বলে মনে হয়। কে
রিসার্চ করে এই আধুনিক ল্যাবে বসে? কি নিয়েই বা করে?’
বিনয় বললো—‘ওই দেখ চঞ্চল, একটা প্যাট্রি ডিশ ও রয়েছে। তবে তো কোন ফাংগাস
গ্রো করে কলোনী বানায় কি না তা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে অথবা……’।
‘হুঁ, তা হ’তেই পারে কিন্তু…..আচ্ছা এই ঘরের তাকে সার দিয়ে রাখা নানা বোতলে
নানা ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে যা সাংঘাতিক বিষাক্ত হ’তে পারে। আমরা কিছুই তো
জানি না সুতরাং এই জায়গায় থাকা ঠিক না আমাদের পক্ষে। বিনয়, চলে এসো..
লিফ্টটা মনে হয় অন্যদিকে…..’
আমরা বেরিয়ে এসে ফিরে চললুম।
খানিক দূর গিয়ে দেখি বিনিতা আসছে। তার মানে ও লিফ্টটা খুঁজে পেয়েছে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম দেখেই। বিনয় এগিয়ে গেল…. দিদি……বলে ডাক দিয়ে
আমার চুপ করে থাকবার সর্তকবাণী ভূলে গিয়ে।
ফল হ’লো বিপরীত।
তখনি পাশের একটা দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে এসে তাকে খপ করে ধরে
ফেললো। আমি পায়ে পায়ে পিছিয়ে চলেছি তখন।
‘ছাড়….আমাকে ছেড়ে দাও…’
‘ছাড়বো বইকি তোকে…….একটু পরেই ছেড়ে দেব, তবে আমার তৈরী প্রথম
ভাইরাস কাল্চারটা তোর ওপর দিয়ে একটু পরীক্ষা করে নিই আগে……’
‘আরে এই মেয়েটা ও তো বেশ কাজে লাগবে আমার। ভালো স্বাস্থ্য। তাই সহজে
মারা যাবে না। ভাইরাস ক্যারিয়ার হিসেবে মনে হয় খুব সুন্দর কাজ দেবে মেয়েটা।
মেয়েরা খুব ভালো ক্যারিয়ার হয়। শরীরে ভাইরাস ইন্জেক্ট করে দিলেই জ্যান্ত অস্ত্র
বা লিভিং ওয়েপন তৈরী। । তারপরে সুবিধা মতন যদি হাত পা কেটে বা অন্য
কোনভাবে খানিক রক্তপাত শুরু হয় মেয়েটার শরীর থেকে………’।
‘বেশ বেশ। চলে আয়। দু’মিনিটের ব্যাপার তো। পালাবার চেষ্টা করলেই
মরবি। তখন আমার দোষ নেই কিন্তু।’।
‘আর শোন ছেলে, আমি ভাইরাসের অ্যান্টি ডোট ও বানিয়ে রেখেছি । তাই
তুই মরবি না। ভয় নেই। তবে তোর শরীরের সব রিঅ্যাকশানগুলো রেকর্ড না
করে সেটা দেওয়া তো যাবে না। বেশী দেরী হয়ে গেলে অবশ্য তুই না ও বাঁচতে
পারিস। সে আর কি করবো আমি? চল…’
বলেই সে দু’হাতে দু’জনকে জাপটে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ভিতরে আর
দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছিলাম বলে সে আমাকে দেখতে পেলো না।
কিন্তু এখন আমি করি কি? ভাবলুম--বাদল হ’লে কি করতো? ওদের বাঁচাতো না
ছুটে গিয়ে কাকুকে ডেকে আনতো? ততক্ষনে তো ওরা ভাইরাস বোমা হয়ে যাবে আর
তখন তো বলছিল যে ওদের লোকটা ছেড়ে দেবে নিজেই…
আচ্ছা এখন আমার এই সুরক্ষা উপকরণটাকে একটু বোকা বানালে কি হয়? সে বেশ মজা
হবে। আমি আমার বাঁ হাতটাকে যদি ওই দরজাটার গায়ে নিঃশব্দে গিয়ে জোর দিয়ে চেপে
ধরি তাহ’লে ও বুঝবে কি করে যে দরজাটা আমাকে চেপে ধরেছে কি না। অবশ্য চাপ
বেশী হয়ে গেলেই কম্ম কাবার। দাউ দাউ করে সবশুদ্ধু জ্বলে উঠলেই আমি ধরা পড়ে
যাবো। সুতরাং এই পরীক্ষা মানে এক্সপেরিমেন্টটা,,…খুব সাবধানে করতে হবে…
যা ভাবা সেই কাজ। দরজার রং পাল্টে যেতে দু’ তিন সেকেন্ড লাগলো আর তারপরে
একটু ধাক্কা দিতেই ঝুরিভাজার মতন সেটা কালো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো।
আমি নিঃশব্দে ঢুকে পড়লুম।
ভিতরে সার সার কাঁচে ঘেরা কেবিন।
একটার মধ্যে থেকে মানুষের স্বর শোনা গেল। কেউ মনে হয় কথা বলছে। মনে হয়
সেই লোকটাই বললো—‘নে, আমার ইঞ্জেকশান রেডী। তুই তোর জামা প্যান্ট গুলো
খুলে এই ট্রেতে রেখে দে আগে। তোর শরীরের সব পেশির আক্ষেপ, খিঁচুনী, শরীরের
অস্থিরতা, সব রেকর্ড হবে কি করে নইলে? রক্তস্রাব ও হ’তেই পারে’……
‘হয়েছে’?
‘নে তবে এইবারে ওই টেবিলে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়। আমি লোকাল অ্যানেসথেশিয়া
দিয়ে ইঞ্জেকশান দেব, তুই জ্বালা যন্ত্রণা কিছু টেরই পাবি না। এ্যাই মেয়ে, যা তোর
ভাইকে সাহায্য কর। অন্য চেষ্টা করলেই মরবি। আমার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। স্রেফ
গুলী করে দেব ….নে ….ওয়ান ….টু… ইয়া… গুড গার্ল, ভাইয়ের হাতে রেকর্ডারের
তারটা বেঁধে দিয়ে সরে আয়। অডিও ভিডিও সব রেকর্ডিং হবে’।
সুঁইইইইইইই……করে একটা শব্দ হয়েই থেমে গেলো।
শোনা গেল-‘হুঁ, একটা পিস্তল হাতে নিয়ে ইঞ্জেকশান দেওয়া বেশ শক্ত। তাই স্প্রেটা
করতে হ’লো। তা এখন তুই ঘুমো, মেয়ে । তোর ভাইকে ইঞ্জেকশানটা দিয়ে নিই
আগে। তারপরে তোকে ও তৈরী করে তোর ভাইয়ের মতন অন্য টেবিলে শুইয়ে দেব’।
সময় আগত। আর দেরী করা তো যায় না।
আমি নিঃশব্দে ঢুকে পড়লুম কাচের দরজা ঠেলে।
লোকটা আমার দিকে পিছন ফিরে ছিল।
ডান হাতের পিস্তলটা সে সেই বিনয়ের জামা কাপড়ের ট্রেটায় রেখে এগিয়ে গেলো। আমি
পিস্তলটা তুলে নিয়ে চুপচাপ নিজের পকেটে ভরে ফেললুম টুপ করে।
ছোট হওয়ার মজা ও আছে দেখি বেশ। সে টেরই পেলো না।
তবে ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জটা সে বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে দেখি কি
একটা তুলোর মতন জিনিষ তুলে বিনয়ের কোমরে ঘষতে লাগলো। শেষে সেটা ফেলে
দিয়ে ডান হাত এগিয়ে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি দুই আঙুল দিয়ে তার সেই হাতটা
আস্তে করে চেপে ধরলুম। খুব হিসেব করে। নইলেই হয়েছে। আমার দ্বিতীয়
এক্সপেরিমেন্টটা ও তো ঠিকমতন হ’তে হবে না হ’লে…….।
লোকটা তাইতেই আঁ আঁ….করে উঠলো।
তবে ইঞ্জেকশান সমেত হাতটা তার ঘুরে গেলো তারই বাঁ হাতের দিকে। লোকটার
হাত অবশ হয়ে গেছে নির্ঘাৎ তখন।
ইঞ্জেকশানটা অনেক কষ্টে তার বাঁ হাতে দেওয়া হয়ে যেতে দ্রুত বিনয়ের হাত থেকে
রেকর্ডিং ডিভাইসের তারটা খুলে লোকটার হাতে আটকে দিয়ে অ্যান্টি ডোট খুঁজতে শুরু করলুম আমি।
কই? কোথাও তো রাখা নেই। তার মানে সব ধাপ্পা। বিনয়কে বাঁচাতে তার বড় বয়েই গিয়েছে।
লোকটা আচ্ছন্নের মতন পড়ে আছে তখন। হয়তো বৈদ্যুতিক শক যা লেগেছে
তাইতেই এই অবস্থা। বিনিতা ও কাছেই পড়ে আছে । বিনয় ও তেমনিভাবে
টেবিলে পড়ে আছে। সে কি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে?
কে জানে? সে যাই হোক তবে আমার মনে হয় লোকটাই সজাগ হবে সবার আগে।
অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই ইঞ্জেকশান দেবার প্রতিক্রিয়া তখন কেমন হবে কে জানে?
তার আগেই সরে পড়তে হবে আমাদের।
আগে বিনয়ের সিন্থেটিক কাপড়ের পোষাকগুলো যেগুলো সব আমারই পোষাক,
তুলে এনে বাইরে ফেলে রেখে বিনিতাকে টেনে আনতে হ’লো। শেষে বিনয়কেও
এনে কাচের দরজাটা বাইরে থেকে শক্ত করে বন্ধ করতে হ’লো। বিনয় আর
বিনিতাকে আনবার সময় আমি বিনয়ের সূতোর গেঞ্জী জাঙিয়া দুটো নিজের
দু’হাতে জড়িয়ে নিয়েছিলাম নইলেই হয়েছিলো আর কি।
বিনয়কে শেষে আমি একটা আঙুল দিয়ে সামান্য ছুঁয়ে দিতেই সে লাফিয়ে উঠলো আঁক করে।
আমি বললুম—‘বিনয়, ওঠো। কুইক। তোমার কিছু হয় নি। আগে পোষাক
পরো তারপরে বোনকে কাঁধে তুলে নিয়ে আসতে পারো কি না দেখো। এসো
আমার সঙ্গে। এখুনি এ’খানে ধুন্ধুমার কান্ড শুরু হয়ে যাবে, এ’খানে কি
হয়েছে তা সবাই জানতে পারলেই। চলো, উঠে দাঁড়াও…..’
বিনয়কে নিয়ে লিফ্টের খোঁজে ছোটা ছাড়া গতি নেই তখন আর আমার।
বিনিতাকে বইতে সাহায্য ও করা অসম্ভব আমার পক্ষে।
লিফ্টে উঠে যখন আমি কাকুর কাছে পৌঁছেছি ততক্ষনে বাড়ী তোলপাড় আর কি।
কাকুর ফোন অকেজো। বাড়ির ফোন ও তাই।
পুলিশে লোক পাঠানো হয়েছে কিন্তু কেউই আসে নি। বড় অফিসার কেউ না এসে
পড়লে লোকাল পুলিশ ভয়ে আসবে ও না।।
আমাকে লিফ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই কি করে জানি কাকু কি সব বুঝে
নিলো আর দেখা মাত্র ছুটে এসে আমাকে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘরে
চলে গেলো সবাইকে অবাক করে দিয়ে।
তখন আমার যা লজ্জা করছিলো না, সে আর কি বলবো? কাকু যেন কী?
এক বাড়ী লোকের সামনে এতোবড়ো ছেলেকে কেউ এইভাবে ….. ছিঃ….
অবশ্য তখন বিনয়কে ও তার মা কোলে তুলে নিয়েছেন বিনিতাকে জড়িয়ে ধরে…
তা তারা তো ছোট ….
তবে কাকুর তখন উদ্দেশ্য অন্য, আমাকে শুধু আদর করাই নয়। আমার হাতের
চকচকে বালাটার দরকার ছিল কাকুর। সকলের সামনে সেটা তো আর খুলে
নিতে পারে না আমার হাত থেকে, তাই ছেলেটাকে শুদ্ধু নিয়ে এসেছে………..।
বালাটা খুলে নিলো আমার হাত থেকে কাকু ঘরে ঢুকেই এবং উল্টো করে ধরে কি
একটা সুইচ টিপে বললো—‘হ্যালো, দাদা….এমার্জেন্সী স্যাটেলাইট ফোনে বলছি ...
অন্য সব সিস্টেম জ্যামিংয়ের কবলে…..অবিলম্বে আসতে হবে পহন্ডোরে .
চঞ্চল বলতে পারবে কোথায় যেতে হবে। সময় নেই হাতে। পুলিশ কর্ডন না
করলে হামলা শুরু হবে যে কোন সময়। মনে হয় ডঃ সিংহের পাশের বাড়িখানাই
ওদের ঘাঁটি……এই বাড়ির মাটির নীচে ও গুপ্ত স্থান থাকা সম্ভব। তুমি রায়পুর
পুলিশ সুপারকে বলো……… বেশী অসুবিধা দেখলে আমাদের সরে পড়তে হ’তে পারে…….ওভার….’
তখনি ডঃ মিসেস সিংহ এসে বললেন—‘আমি বিনয়ের কাছে সব শুনেছি। আপনার
ছেলে আমাদের সন্তানদের প্রাণ বাঁচিয়েছে কয়েকবার, একলা হাতে লড়াই করে।
ভেরী ব্রেভ বয়। তবে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা ও নেই আর সময় ও নেই’।
‘কিন্তু আমার কাজের জায়গার গাড়ী এসে গেছে। আমি ছেলে মেয়ে ও স্বামীকে
নিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনারা ও এখানে থাকলে খুব বিপদে পড়বেন একটু পরেই।
আপনারা ও আমাদের সঙ্গে চলুন। ইনোভা গাড়ী। জায়গা আছে। একজন রাইফেলধারী
গার্ড ও আছে। কিছু খাবার আর জল সঙ্গে নিয়ে নিচ্ছি আমি। আজ তো এখনো
কারোরই জলখাবার খাওয়া ও হয় নি। কিন্তু সে সব হবে গাড়িতেই। আপনারা
পাঁচ মিনিটে নেমে আসুন জিনিষপত্র মানে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে….’
আমরা ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লুম।
গাড়িতেই জলখাবার খাওয়া হ’লো।
তবে বিপদ পিছন ছাড়লো না।
কাকু এক সময় গম্ভীর গলায় বললো—‘ড্রাইভার সাহেব, কেউ আমাদের পিছনে আসছে।
দলে তারা বেশ ভারী। আমি আমার বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল পাচ্ছি। মনে হয়
আমাদের আজ যুদ্ধে নামতেই হবে। তুমি জল্দী এখন রায়পুরের পথে চলো দেখি।
যদি ফোর্সের সাহায্য মেলে তবেই রক্ষা নইলে আজ আমাদের কপালে বাঁচা নেই।
নানান নতুন বিদেশী অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে শত্রু এখন মরীয়া…..আর আমাদের
সামান্য একটা গ্যাস মাস্ক ও সঙ্গে নেই….মনে হয় স্থানীয় আদিবাসিরা ও এদের
সাহায্য করছে যথাসাধ্য……’
শুনেই ড্রাইভার পথ বদলালো।
একঘন্টা পরে রায়পুর থেকে ছুটে আসা তিনখানা পুলিশ জীপের দেখা মিললো এক নালার ধারে।
কাকু হাত তুলতে তারা থামলো। আমরা ও থামলুম।
কাকু পুলিশ সাহেবকে বললো—‘আর এগিয়ে কোন লাভ নেই, স্যার। স্ট্রাটেজী তৈরির সময়
মিলবে না। মহিলা ও বাচ্ছাদের এখন কোনো গাছে উঠে পড়তে হবে। ডঃ সিংহকে ও।
তারপরে আমরা পজিশন নেবো নানান জায়গায়….ঝোপ ঝাপ, টিলার পিছনে, গ্রেনেডিয়ার
ও রাইফেল ম্যান সমেত। কুইক…..আর ও ফোর্সের জন্য রায়পুরকে লোকেশন বলে জানান
এখনি….পরে হয়তো আর সময়ই থাকবে না….সব গাড়ী ক্যামোফ্লেজিং করে লুকিয়ে রাখবার
ব্যবস্থা করুন। সময় নেই……কুইক…’
আমাকেও একটা বড় গাছে তুলে দিয়ে কাকুরা অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি কি আর করি বসে
থাকা ছাড়া? তায় সে’গাছে আবার দারুণ পিঁপড়ে ভর্তি…খালি কট কট করে কামড়ায়….
কি যে মুশ্কিল সে আর ব’লার নয়।
আধ ঘন্টা ও গেলো না । হৈ ….হৈ….করে প্রায় আড়াইশো নক্সালবাদী ডাকাত গাড়ী ছুটিয়ে
এসে আমাদের জায়গাটা ভরিয়ে ফেললো। একজন আমাদের গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেয়ে
গেলো আর তাই দেখেই এলোপাথাড়ী গুলী চালানো শুরু করলো চারদিকে, লাইট এম জি দিয়ে।
শুরু হয়ে গেলো অ্যাকশান মানে সম্মুখ সমর। গুলী গোলা মানে গ্রেনেড ও
চলতে শুরু হ’লো। সে এক খন্ড যুদ্ধের দৃশ্য।
খানিক পরে কি করে একখানা লুকনো পুলিশ জীপ খুঁজে পেয়ে তাইতে আগুন ধরিয়ে দিলো
তারা। ধূ ধূ করে জ্বলে উঠলো গাড়ী। গাঢ় কালো ধোঁয়ার মেঘে সবদিক ঢেকে গিয়ে
অন্ধকার হয়ে এলো। সেই ধোঁয়ায় দমবন্ধ হবার অবস্থা। একটু কাশবার ও জো নেই।
কাশলেই গেলুম। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে হবে। খানিক পরেই জীপের তেলের ট্যাংক
বোমার মতন শব্দ করে ফাটতেই চার দিকে তরল আগুনের ফোয়ারা ছুটলো আর
আশেপাশের অনেকগুলো গাছ পালা ও ঘাসে আগুন ধরে গেলো।
সে এক বিশাল অগ্নিকান্ড।
অবশ্য সেই আগুন বহুদূর থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলো রায়পুরের
হেলিকপ্টার পুলিশ আর সেনাবাহিনী।
আর ও কয়েক দল নক্সালদের ও আগমন হ’লো। সন্ধ্যে হ’য়ে এলো কিন্তু যুদ্ধ থামলো না।
ইতিমধ্যে একখানা অন্য পুলিশজীপ আবার আগুনে পুড়লো।
অন্ধকার হয়ে যেতে আর ও ফোর্স এসে পড়ায় যুদ্ধে পুলিশদের জয় হ’লো ও সব গুলি
গোলা চলা বন্ধ হ’তে কাকু এসে আমাকে গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে তৃতীয়
জীপখানায় উঠে রায়পুরের পথে ছুটলো।
ডঃ সিংহের পরিবার নিজেদের কাজের জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা হ’লেন।
চারদিকে ঘোর অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।
নির্জন বুনো ঝোপ ঝাপ আর উঁচু নীচু খানা খন্দে ভরা দুর্গম পথ।
হেডলাইট জ্বেলে ধীরগতিতে চলছে আমাদের গাড়ী। আর আমাদের পেটে ইঁদুরে ডন দিচ্ছে।
হঠাৎ পথের মাঝে একজন মানুষকে দেখে ব্রেক কষতে বাধ্য হ’লো চালক। সম্পূর্ণ
অপরিচিত এক মানুষ। এই এলাকার লোক নয় বলেই মনে হ’লো আমার।
বিশালকায় গোরিলার মতন দেখতে সেই আকৃতি। সে তার দুই দীর্ঘ বাহু মেলে
এগিয়ে এলো। এ আবার কি রে বাবা?
পুলিশ হাঁকলো--‘হল্ট……’
চিৎকার করলো রাইফেলম্যান- ‘কে? কি চাই? থামো…’?
সে গ্রাহ্য ও করলো না।
গুড়ুম…..আবার শব্দ হ’লো….. গুড়ুম….দু দু’টো গুলী যেন ধোঁওয়া ভেদ
করে চলে গেল। এ আবার কি কান্ড রে বাবা?
এইবার দ্বিতীয়জন বন্দুক তুললো। কাকু বললো—‘খুব সাবধান……’
সে গুলী করতেই বিশাল একটা কালো হাত এসে তার গলা মুখ চেপে ধরে একটানে
তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে বিশ হাত দূরের একখানা বড় পাথরের দিকে ছুঁড়ে দিলো।
বিকট শব্দ…..আর ভয়ংকর আর্তনাদ শোনা গেল….
পরক্ষনেই দ্বিতীয়জন ও গেলো প্রথমজনের পথে।
জীপে চারজন সশস্ত্র পুলিশ ছিলো।
একে একে সবাই শেষ হ’তে সেই হাতখানা এসে কাকুকে
ডিঙিয়ে আমার গলা মুখ চেপে ধরলো।
আমার দম আটকে এলো সেই ভয়ংকর হাতের চাপে।
তাই দেখেই কাকু সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বার করে দুড়ুম করে সোজা তার বুকে গুলী করলো।
তবে কিছুই হ’লো না ক্ষতি সেই ভয়ংকরের, গুলিতে। উল্টে গুলী বেরিয়ে ছিটকে
কোথায় যে চলে গেল তা কে জানে? তবে সে আমাকে তুলতে পারলো না।
সেইভাবেই দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো।
আমার মনে হ’লো যে ভয়ানক বৈদ্যুতিক শক্তিতে এতোক্ষনে তার পুড়ে কয়লা
হয়ে যাবার কথা, তাইতে সে দাঁড়িয়ে কাঁপছে মাত্র। কি অদ্ভূত এই জীব?
এ কে? এ কে? এ কি কোন মানুষ? কোন জীব? না কোন অমানুষ? আবছা
আলো আঁধারিতে তাকে ঠিক মতন দেখা ও যাচ্ছিল না।
আমি মুখ একটু নীচু করে সেই শক্ত থাবার ফাঁক দিয়ে দেখি যে দ্রুত বদলাচ্ছে
সবুজ অংক মালা আমার হাতের বালার গায়ে।
তখনি আমার মনে হ’লো যে এই ছোট বালার রিজার্ভ পাওয়ার তো অফুরন্ত বা
অসীম নয়। এখুনি শেষ হয়ে যাবে আর তখনি সে আমাকে ও আছড়ে মারবে
পাথরে আর তারপরে কাকুকে ও।
এ কী কোন রোবট না অপদেবতা? রোবট হ’লে শুনেছি যে গুলী করলে
ঠিকরে যায় । তার গায়ে লাগেই না। কিন্তু এই হাতখানা মনে হয় কোন
রোবটের নয়। রোবটের হাতের যান্ত্রিক চাপের সাথে আজ সকালেই আমার
পরিচয় হয়েছে। তার যন্ত্রের শরীরে আমার সুরক্ষার শক্তি কাজ করতে দেখেছি।
কিন্তু এ যেন ধোঁয়া শক্ত হয়ে আমার গলা মুখে চেপে বসেছে। এ যে কি দিয়ে
তৈরী তা কে জানে? তবে এমন কিছু দিয়ে যার ওপরে বৈদ্যুতিক শক্তি কাজ করে না।
শুনেছি যে এইখানকার আদিবাসিরা অনেক অপদেবতা বা অশুভ শক্তির পূজো
করে। জীব জন্তু বলি দেয়। অনেকে বলে নর বলি ও হয়। মানে অনেক ছোট
ছেলে মেয়ে ও প্রায়ই নিখোঁজ হয়ে যায় এই সব অঞ্চলে। সেই অশুভ শক্তিকেই
কি কেউ আজ জাগিয়ে এইখানে পাঠিয়েছে আমাদের শেষ করতে? লড়াইয়ে আজ
অনেক নক্সালপন্থী মরেছে বলে….প্রতিশোধ নিতে?
কে জানে?
পিঁ……..পিঁ…..পিঁ…
আমার বালার প্রথম সিগন্যাল বাজলো।
অর্থাৎ প্রায় পাওয়ার শেষ। মাত্র দশ সেকেন্ড আছে আর রিজার্ভ পাওয়ার অবশিষ্ট।
পিঁইইইইইইইই…
আর মাত্র তিন সেকেন্ড সময় বাকি আছে…
খটাং……মনে হ’লো দূর করে ছূঁড়ে ফেললো হাত থেকে পিস্তলটাকে, কাকু।
তারপরে আমার মনে হ’লো….. মানে ঠিক যেন জমাট বাঁধা ধোঁওয়ার মধ্যে
দিয়ে আমি দেখলুম যে কাকু তৎক্ষণাৎ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট
গোলমতন কি একটা জিনিষ বার করলো এক সেকেন্ডের মধ্যে…..আর দ্বিতীয়
সেকেন্ডে চেপে ধরল কাকু সেই জিনিষটা সেই থামের মতন মোটা কালো হাতটার ওপরে।
পিঁইইইইইইইই….ককককককক….
নিভে গেলো বালার সবুজ অংকের সারি আর সঙ্গে সঙ্গে এক বিষম অমানুষিক
ভয়ংকর আর্তনাদের সাথে লাফিয়ে উঠে ছিটকে গেলো সেই ঘন ধোঁয়ায় তৈরী
সেই ভারীমতন হাতটা আমার গলা মুখ থেকে…
আমি জীপের মধ্যে ছিটকে পড়ে গেলুম একটা প্রবল ধাক্কায় আর কাকু উল্টে
গড়িয়ে গিয়ে ধপাস করে পড়লো একেবারে জীপের বাইরে। বিষম ভয়ে তখন
আমার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে এসেছে। গলা মুখ শুকনো। দম আটকে আসছে।
ঠিক মতন নিঃশ্বাস নিতে ও পারছি না। আমার গলা বুকে সেই প্রবল চাপ
যেন তখন ও আটকে আছে।
প্রলয় ঝন্ঝাবাতে জীপটা শুদ্ধু যেন টলমল করে উঠলো। মনে হ’লো বুঝি
বা উল্টে যাচ্ছে গোটা জীপটাই। আর রক্ষা নেই আমাদের।
কিন্তু নাঃ…..ভাগ্য সহায়। যেন ৮.৫ রিখ্টার স্কেল পয়েন্টের এক ভূমিকম্পের
তীব্র ঝটকায় টালমাটাল খেয়ে জীপ স্থির হ’লো আর তখনি বাইরে থেকে কাকুর
গলা শোনা গেল—‘চঞ্চল, ভয় নেই। তুমি ঠিক আছো তো? চোট লাগে নি তো
তোমার? একটু দাঁড়া ও……আমি পিস্তলটা খুঁজে নিয়েই আসছি’।
কাকু এসে জীপে উঠে আমার হাত থেকে চকচকে স্টিলের বালাটা খুলে নিয়ে
পকেটে ভরতে ভরতে শুকনো গলায় অষ্পষ্ট ভাবে বললো—‘কি বিপদ,
বলো দেখি। যত্তো সব ঝামেলা এসে জোটে আমারই পোড়া কপালে আর কী।
এখন এইটাকে আবার রিচার্জ করাতে হবে আর সে ও এই দেশে ছাই কিছু হ’বে ও না।
আর সে সব তো যা হ’বে পরে। আগে এখন এই অখাদ্য লড়ঝড়ে মার্কা পুলিশ জীপ
চালাতে হবে আমাকে পাক্কা ত্রিশ মাইল। কি গেরো বলতো আমার বরাতে?
আপদ কী গাছে ফলে? এদিকে ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে………. ধ্যুৎ…..’
‘চঞ্চল, তুমি বসো, আমি স্টার্ট দিই….’
আমি বললুম--‘কিন্তু কাকুউ…..হাই পাওয়ার এনার্জী যেখানে ফেল করলো সে’খানে
তুমি ওটাকে কি দিয়ে জব্দ করলে, বলো তো?’
‘ও কিছু না চঞ্চল’…..তাচ্ছিল্যভরে কাকু বললো…. ‘অতি সামান্য জিনিষ ...
একটা একমুখী রুদ্রাক্ষ…..হয়তো মন্ত্রপূত….ঠিক জানিনা আমি……হিমালয়ের এক সাধু
দয়া করে একদিন আমাকে দিয়েছিল আমি বিপদজনক সব কাজ করি দেশের
অপরাধিদের ধরে শাস্তি দেওয়াবার জন্য, তাই শুনে……..’।
বলেছিলেন—‘তুমি এইটা সব সময় সঙ্গে রেখো। আমি কোন জিনিষ তো অগ্রাহ্য করে
ফেলে দিই না, তাই সঙ্গে ছিলো মানে আমার পকেটেই পড়ে ছিলো’।
‘তবে.ওই দুষমন পাজী বদমায়েস নচ্ছার ব্যাটা পর পর চারটে পুলিশকে ধরে আছড়ে
মারলো আর আমাকে সামনে পেয়ে ও অকারণে ছেড়ে দিয়ে তোমাকে ধরতে গেল কেন,
সেই খানেই আসল রহস্যটা লুকিয়ে ছিল। কিন্তু সেই টুকুই বুঝতে তো আমার এতোটা
সময় লাগলো যে কি বলি তোমাকে, চঞ্চল? ফলে আর এক সেকেন্ড ও দেরী হ’লেই
আজ আমাদের সব শেষ হয়ে যেতো’।
‘এক্কেবারে ঠিক যেন লাষ্ট মোমেন্ট সাজেশান পেয়ে প্রাণে বেঁচেছি আজ….. উঃ ....
আমি যে একটা ভয়ংকর হাঁদা গাধা, তো তার কি হবে, বলো না?’
‘সে এখন যাক গিয়ে’।
‘ওই রায়পুরের আলো দেখা দিয়েছে। আগে আমাদের পেটে কিছু দিতে হবে। নইলে
শরীর আর বইছে না’।
‘তারপর আবার পুলিশ পাঠাতে হবে তো এ’খানে মৃতদেহগুলো সব উদ্ধার করে নিয়ে যেতে’।
‘তারপরে ও দাদার বকুনি আছে না?…..এই সামান্য পথ আসতে তুই এতো দেরী
করলি কোন আক্কেলে, শুনি? সঙ্গে আবার ছেলেটাকে নিয়ে এসে অ্যাডভেঞ্চার করা হচ্ছে।
দেব এক থাপ্পড়…………….’
‘হুঁ………কি যে আমি করি? আপদ কি কম?’
‘আপাতত সে সব থাক, আগে এখন পেটপূজো’।
‘পেটে খেলে পিঠে ও সব সইবে রে, ভাই। এখন অদূরে ওই যে হোটেল অনামিকা
আসছে দেখা যাচ্ছে, সামনে তার নীল নিয়ন সাইন বার বার জ্বলছে আর নিভছে,
ওই খানেই থেমে পড়ি? কি বলো, চঞ্চল? এসো, দেখি কি জোটে বরাতে আমাদের। ’
----------------------------------
09452003290
রচনাকাল : ১৭/৪/২০১৪
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।