• ২য় বর্ষ ১১তম সংখ্যা (২৩)

    ২০১৩ , এপ্রিল



চুনারের বাবাসাহেব
আনুমানিক পঠন সময় : ২০ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৪৮ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪৮৫ জন পড়েছেন।
         যে সময়ের কথা বলছি, তখন উত্তর প্রদেশ রাজ্যের 
মীর্জাপুর জেলার চুনার নামের জায়গাটি কিন্তু এতবড় টাউন হয়ে ওঠেনি 
আজকের মতন। একটি ছোট গ্রাম মাত্র ছিল।

১৯৭৫ সনে তো পাকা চুনার স্টেশন রোড তৈরী হয়। তারপরেও 
বহুদিন সেই পথ নির্জন পড়ে থাকত। ক্রমে তার দু’পাশে বসত বাড়ী, 
দোকান পাট এবং বাজার গজিয়ে  ওঠে। চুনার টাউন হয়ে যায়। কেল্লার
 কাছে গঙ্গার ধারে পুরণো টাউনে বাড়ী ঘর, দোকান পাট, বাজার, 
পুলিশ স্টেশন অবশ্য সব ছিল।  তবে স্টেশন থেকে কেল্লার দূরত্ব 
অনেকটা, প্রায় মাইল পাঁচেক। সন্ধ্যার সময় কোন যানবাহন ও তখন 
পাওয়া যেত না। মাঝা মাঝি জায়গাতে ছিল ছোট এক জনবসতি। 
টেকউর মালিয়ানে। 

কয়েকঘর মালিদের বসত ছিল বলে এমন নাম। এখন ও হয়তো আছে।

এই বসতির খানিক দূরেই ছিল এক পীর বাবার মাজার। পীর বাবার 
নাম অবশ্য কেউ বলত না তবে বাবাসাহেব নামে সেখানে তিনি ছিলেন 
বিখ্যাত।

একটা উঁচু মতন জায়গায় ছিল পাথরে তৈরী অতি সাধারণ এক কবর। 
তবে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলায় সেখানে স্থানীয় অনেক 
মুসলমানেরা গিয়ে ধূপ, মালা, মিষ্টি বা ক্ষীর সব চড়াত। অনেক 
হিন্দুরা ও যেত। অবারিত দ্বার ছিল বাবাসাহেবের।

অনেকেই দোয়া চাইত। 

শুনেছি যে অনেকের সে’খানে করা মানসিক ফলতো ও । তবে কারো 
অনিষ্ট করবার জন্য মানসিক করলে ফল ভালো হ’তো না। এমনকি 
শুধু নিজের ভালোর জন্যেই মানসিক করলে ও তাই। অপরের ভালোর 
জন্যে মানসিক করবার রেওয়াজ ছিল। বেশ অদ্ভূত নিয়ম। মানসিক 
আবার কেউ পরের জন্য করতে যায় না কী? তাই বহিরাগতদের ভীড় 
হতো না। তবে স্থানীয়দের ভীড় মন্দ হতো না।

আমি যখন চুনারে গিয়েছিলাম তখন বাদলের বয়স ছিল বছর বারোর 
মতন। তবে দারুণ সুন্দর দেখতে আর খুব মিষ্টি ব্যবহারের জন্য সবাই 
তাকে ভালোবাসতো। আমার দুধবরণ পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ 
সুন্দর ভাইপো চঞ্চল কাছে না থাকলে বাদলকে সঙ্গে না নিয়ে আমি 
কোথাও যেতাম না একলা। 

চুনারে তখন একমাত্র পাশকরা ডাক্তার ছিলেন ডঃ সুনীল রায়। ভূমিহার 
ব্রাম্হন। তিনি ও ছিলেন বাবাসাহেবের খুব ভক্ত। 

সেইদিনটা ও দৈবযোগে পড়ে গিয়েছিল বৃহস্পতিবার।

আমরা বাবাসাহেবের মাজারে দোয়া করতে যেতে চাই শুনে তিনি 
আনন্দের সাথে বললেন—‘বেশ তো যান না। দেখে আসুন। বাবাসাহেব 
খুব জাগ্রত। তাঁর দোয়াতেই তো এইখানে আমি টিঁকে আছি। মানসিক 
করেছিলাম আমার স্ত্রীর সন্তানের জন্য মনোকষ্ট দূর হোক। তখন তো 
ছেলে হয়েছে । একটিই তো ছেলে আমার। আজ দু’পয়সার মুখ যে 
দেখছি, নিজের বাড়ী করেছি… এ’সবই তো তাঁর কৃপায়। এখন অবশ্য 
কিছু বাইরের অসৎ লোক এসে চুনারে জুটে গেছে। আপনাকে তাই তো 
ডেকেছিলাম আজ। বার কয়েক ফোনে ধমক ও দিয়েছে আমাকে, টাকা 
আদায় করবার জন্য। আমি অবশ্য গ্রাহ্য করিনি। জানি তো যে 
বাবাসাহেব অন্যায় বরদাস্ত করেন না’।

‘তা আমার ছেলে সুশীল তো আজ যাবে বাবাসাহেবের মাজারে। ওর 
সাথে আপনারা ও  ঘুরে আসুন। তবে সন্ধ্যার পরে যেন আর দেরী না 
হয়। তখন ওইখানে  কারো থাকবার তো নিয়ম নেই। বাবাসাহেবের 
জুড়িগাড়ী করে সান্ধ্যভ্রমন ও তারপর নমাজে বিঘ্ন হয়’।

এই বলে নিজের ছেলেকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে তার হাতে ধূপ, 
গোলাপ জল, গোলাপ ফুলের মালা, মিষ্টি, প্রণামী সব কিছু দিয়ে 
আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। 

বাবাসাহেব যে রোজ সান্ধ্যভ্রমন করেন এবং কেউ তাই দেখেছে কি না 
আজ অবধি, তা আর আমাদের তখন জানা হ’ল না। 

তবে দেখলাম সুশীল ছেলেটি ও বেশ সুন্দর, ফরসা, রোগামতন, 
বিনম্র ও শান্ত। মিষ্টি স্বভাবের চটপটে ছেলে। মা বাবার আদরের ছেলে 
তাও বেশ বোঝা গেল। একমাত্র ছেলে হলে তা তো হবেই। প্রায় 
বাদলেরই বয়সী মনে হ’লো কিংবা এক আধ বছরের ছোটই হবে 
হয়তো। 

সেই ছেলেটিই হ’লো আমাদের পথ প্রদর্শক।

আমি অতি সুন্দর রূপবান ছেলে বাদলের হাত ধরে সুশীলের সাথে হেঁটেই 
গিয়েছিলুম। খুব বেশী দূর তো নয় তাই । আমার সাথে ফুল মিষ্টি ও 
ছিল না আর সে’খানে কোন দোকান ও তো ছিল না যে কিনে নেব 
কিছু।  বাবার মাজারে কোন সেবাইত বা খিদমতগার ও ছিল না। যে 
যা নিয়ে গিয়েছিল সব সাজিয়ে রেখে নীচু হয়ে বসে দোয়া চেয়ে ফিরে যাচ্ছিল। 

আমি কিছু প্রণামী দিয়ে দোয়া চাইলুম-‘হে বাবাসাহেব, তুমি দেখো, 
যেন আমার বাদল লোকের কোন না কোন উপকার করে যেতে পারে 
সারাজীবন। আমার বা বাদলের নাম ডাক ও প্রসিদ্ধির দরকার নেই 
কোন। টাকা পয়সাও চাই না। অন্যের বিপদে সাহায্যে লাগতে পারলেই 
সার্থক হবে জীবন। তুমি তাই করো’।

বাদল যে কি চাইল তা কে জানে? হয়তো চেয়েছিল আমি যেন লেখক 
হই। কেননা বাদলের গল্প লিখতে লিখতেই আমার লেখকত্ব প্রাপ্তি হয়েছে। 
তা মানসিকের কথা তো আর জিজ্ঞাসা করতে নেই। তাই ঠিক জানি না। 

সেইখান থেকে দীদার ও দোয়া শেষে তিনজনে ফিরে চললুম। 

কথা বলতে বলতে মালিয়ানের গলিপথ পার হয়ে মসজিদ ছাড়িয়ে স্টেশন
 রোডে এসে যখন উঠলুম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে আসছে। 
বর্ষাকাল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা ও বাড়ছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে 
পারে যে কোন সময়। সঙ্গে একটা বর্ষাতি থাকলেও দু’জনের জন্য তো 
নেই। স্টেশন রোডে লাইট পোষ্ট বসে গেলে ও তখন পর্যন্ত লাইট লাগানো হয় নি। 

জনহীন পথ অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে সুশীল বলল—‘আংকল, একটা কথা বলি?’

‘বল ভাই’

‘এইখান থেকে স্টেশন রোডের ডানদিকে গেলে স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ড 
পড়বে। বাঁ দিকে আমাদের বাড়ী হয়ে কেল্লা ও গঙ্গার ঘাট সব শেষে। 
বালুয়া ঘাট। বাঁধানো ঘাট নয় তাও আবার বর্ষাকালে পিপের পুল ও 
নেই। সন্ধ্যাবেলায় খেয়া নৌকাও মিলবে না। এখন কোন ট্রেন ও নেই। 
আপনাদের তাই বাসেই যেতে হবে আংকল’। 

‘আপনাদের যদি অন্য দরকার আর কিছু এখন না থাকে তা’হলে ডান 
দিকে ঘুরে সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে যান। বাড়ীর এই সামান্য পথটুকু 
আমি একলাই চলে যেতে পারব বেশ। এখন তো আর রিক্সা ও নেই, 
অটো তো দূরের কথা। কষ্ট করে হেঁটেই যেতে হবে আপনাদের। আমি না 
হয় বাড়ী ফিরে গিয়ে পাপাকে বলে দেব যে আপনারা বাবা সাহেবের 
দীদার করে দোয়া নিয়ে ফিরে গেছেন। কেমন, আংকল?’

একলা ছোট ছেলেটাকে ছাড়তে আমার মন তো চাইছিল না কিন্তু সহজ 
সরল ছেলে হ’লে ও সুশীল তো আর ভেতো বাঙালীর ছেলে নয় 
বাদলের মতন। ভূমিহারী জিদ তো আছেই। 

বাধ্য হয়ে-‘আচ্ছা, তবে আমরা না হয় আসি এখন’ এই বলে আমি 
ডানদিকে ঘুরলুম বাদলের নরম মসৃন চকচকে ডানহাতটাকে শক্ত করে 
ধরে। 

সুশীল ও-‘জী আচ্ছা, নমস্তে আংকল। বাই বাই বাদল’ বলে বাঁ দিকে 
ঘুরে বাড়ীর পথ ধরলো।

আমরা সবে খানিকটা পথ গিয়েছি মাত্র, পিছনে হঠাৎ জাগলো মোটরের 
শব্দ। 

শুনেই থমকে দাঁড়াল বাদল আর পিছনে চেয়েই চেঁচিয়ে ঊঠল-‘ও কাকু, সর্বনাশ। 

ওরা সব কারা? ওরা মনে হয় কাউকে ধরে নিয়ে যেতে…’

সেইপথে মোটর চলত তখন কদাচিৎ। অটো ও খুব কম চলতো। দিনের 
বেলায় খানকয়েক রিক্সাই ছিল যানবাহন। তাই সন্দেহ আমার ও হয়েছিল
 কিন্তু আমি ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র পাশ দিয়ে সাঁ করে কালো রঙের 
একখানা মোটর গাড়ী ঠিক যেন উড়ে বেরিয়ে গেল ধূলোর ঝড় পিছনে 
তুলে দিয়ে।

বাদল বলল-‘যাঃ, সব কিন্তু গন্ডগোল হয়ে গেল কাকু। ওরা হয়তো 
তৈরী ছিল। আমি বুঝতেই তো পারিনি। একলা পেয়েই ওরা সুশীলকে 
জোর করে মোটরে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। দু’জনে মিলে মুখে রুমাল 
চেপে ধরলে আর টেনে মোটরে তুলে নিলে একটা বাচ্ছা ছেলে কি 
করবে, বলো না কাকু? আমাদের সাথে একখানা সাইকেল ও নেই আর 
এ’খানে জনমানব ও নেই যে আমাদের সাহায্য করবে কেউ এসে। 
ডাক্তার আংকলের বাড়ী হেঁটে গিয়ে সব বলে কিছু ব্যবস্থা করতে তো 
অনেক দেরী হয়ে যাবে । এখন কি উপায় হবে কাকু?’
বলাবাহুল্য যে তখন মোবাইল ফোন জন্মায়নি।  

আমি বললুম-‘কি সর্বনাশ। হে বাবাসাহেব। এ আবার কি বিপদ হ’ল? 
তোমার মাজারে আমাদের নিয়ে যেতে গিয়ে এ কী মুস্কিল হ’ল 
ছেলেটার? এখন উপায় কর কিছু বাবা’।

বাদল বলল-‘কাকু, দৌড় লাগাও। আগে গিয়ে যদি কারো সাহায্য 
পাওয়া যায়, দেখা যাক তাই….’

‘মোটরের সঙ্গে দৌড়ে আমরা কি করতে পারি, বাদল?’

অতি বুদ্ধিমান ছেলে হয়ে ও বাদল কিন্তু ততক্ষনে আমার হাত ছাড়িয়ে 
বোকার মতন একলাই সামনে ছুট লাগিয়েছে। বাবাসাহেবের দোহাই দিয়ে 
আমাকে ও তাই ছুটতে হলো বাদলের পিছনে। ছেলেটাকে একলা যেতে 
দিই কি করে বিপদের মুখে?’

মোটরখানা ততক্ষনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। প্রায় দেখাই যায় না। 
নির্জন স্টেশন রোড নিঃঝুম। জনমানববিহীন। দু’পাশে অনুচ্চ পাহাড় 
আর জঙ্গলাকীর্ণ মাঠ। ঝোপ ঝাপ, খেজুর আর আতা গাছের সারি। 
একটা কুকুর ও নেই সেইপথে তখন।

বাদল আমাকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ডাকাতরা গুলী চালাতেই
 পারে। আমি আর ও জোরে ছুটলুম কিন্তু মোটরখানা তখন স্টেশনের 
কাছে গিয়ে ডানদিকে ঘুরছে। তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল মোড়ের মাথায়।
 

নির্ঘাৎ এ হ’ল মির্জাপুরী ডাকাতদের কান্ড। 

নইলে কেউ দিনের বেলায় এসে আচমকা এইভাবে পথ থেকে এতবড় 
একটা ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে সাহস পায় কখনো? 

আমি ততক্ষনে মোড় ঘুরেছি কিন্তু সামনে তখন না আছে মোটর খানার 
কোন চিহ্ন আর না আছে বাদল। কি করি? সোজা ছুটে চললে ও 
খানিক পরে তো আসবে লেভেল ক্রশিং। রেল গেট পার হয়ে জি০টি০ 
রোড। বাঁ দিকে গেলে বেনারস প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার আর ডান দিকে 
গেলে চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে মির্জাপুর। 

সেই মোড়ের ধূলোয় আনকোরা সদ্য তৈরী কোন গাড়ীর চাকার একটা 
দাগ দেখা গেল ডানদিকে গিয়েছে। বেশ গভীর দাগ । তার মানে কোন 
গাড়ী স্পীড না কমিয়েই ঘুরেছে সেইদিকে। 

কেন? ডাকাতদের গাড়ীখানা কি?

আমি ও ভাবতে ভাবতে সেইদিকে আবার ছুটতে শুরু করলুম।

সেদিন জি০টি০রোড ও একদম ফাঁকা। দু’ধারে ধূ ধূ রুক্ষ প্রান্তর। মাঝে
 মাঝে ইঁট ভাঁটার চিমনী দেখা যায় আর সামনে সরু কালো ঢেউ 
খেলানো পিচমোড়া রাজপথ। কোথাও লাইটের বালাই নেই। দৌড়তে 
দৌড়তে তখন আমি বেশ হাঁফিয়ে গিয়েছি।

তবু ও সমানে ছুটছি আর মনে মনে বাবাসাহেবের কাছে সুশীলকে রক্ষা 
করবার জন্য প্রার্থনা করছি, নইলে মুখ রক্ষা হয়না আমার।

ঘন্টায় কত মাইল স্পীডে দৌড় দিয়েছিলাম আমি সেদিন তা ভগবানই 
জানেন তবে বেগবান মোটরের কাছে যে তা কিছুই নয় তা ঠিক। তবে 
ক্রমে অনুভব করলাম যে আমার হাঁফ ধরা ভাবটা বেশ যেন বেশ কমে
 আসছে আপনিই আর আমি আরো জোরে ছুটছি। নির্ঘাৎ খোলা হাওয়ার 
গুনে এমনটি হচ্ছে তবে অন্ধকারে আর বিশেষ কিছুই দেখতে যে পাচ্ছি 
না তার কি করা যাবে।

অনেকক্ষন পরে হঠাৎ সামনে কেউ দৌড়ে আসছে মনে হতেই তখন মনে 
পড়ল পকেটে একটা ছোট টর্চ রেখেছিলাম বাড়ী থেকে বেরোবার সময়। 
তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চটা বার করলুম আমি। 

সেই সামান্য আলোয় যা দেখা গেল তা নিজেরই বিশ্বাস হ’ল না প্রথমে 
কিন্তু যা দেখেছি তা সত্যি। সামনে দৌড়ে আসছে বাদল, সুশীলকে টেনে 
নিয়ে।

ততক্ষনে বাদল কাছে এসে গেছে। 

হাঁফাতে হাঁফাতে ছেলেটা বলল-‘কাকু, তুমি এসে গিয়েছ। যাক, বাঁচা 
গেল। আমি আর দৌড়তেই পারছি না। সুশীল ও না। ওই দেখ, ভাগ্যে 
একটা অটো আসছে । হয়তো  আশেপাশের কোন গ্রামে যাত্রী ছাড়তে 
এসেছিল, কিন্তু এখন খালিই ফিরছে। তা তুমি একটু জিজ্ঞাসা করে দেখ 
না কাকু, যদি যেতে রাজী হয়। সুশীলকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমাদের 
বাস স্ট্যান্ডে যদি ছেড়ে দেয় তো বাঁচি…’

আমি হাত তুলতে অটোটা থামল। 
মালিয়ানে চল ডঃ রায়ের বাড়ী বলেই সুশীলকে দু’হাতে তুলে নিয়ে 
অটোতে বসিয়ে দিলুম। ছেলেটা ভয় আর ক্লান্তিতে এক পা ও চলতে 
পারবার অবস্থায় ছিল না। বাদলকে ও বসিয়ে নিজে শেষে উঠে পড়লুম 
অটোতে। অটো স্টার্ট নিল।

সুশীল একটু ধাতস্থ হ’তে জিজ্ঞাসা করলুম—‘সুশীল, কি ভাবে কি হয়েছিল ব্যাপারখানা বলো দেখি’।

সুশীল বলল-‘আংকল, আমি তো বাড়ী যাচ্ছিলুম। কয়েক পা যেতেই 
হঠাৎ একটা কালো রঙের মোটর এসে আমার পাশে খ্যাঁচ করে থেমে 
গেল। পেছনের দরজা খুলে কালো চশমাপরা একজন লোক নেমে এসে 
আমাকে জিজ্ঞাসা করল-‘আরে এ বাচ্চে, স্টেশন আর কত দূর?’

বললুম-‘আড়াই কিলোমিটার, আংকল। সোজা চলে যান’।

‘তাই না কী? তবে তুমি ও চল না আমাদের সাথে। একটু দেখিয়ে 
দেবে। আমরা চিনতে না পারলে মুস্কিলে পড়ব। হয়তো স্টেশন ছাড়িয়েই 
চলে যাব। আবার ফিরতে হবে লোককে জিজ্ঞাসা করে করে। আর 
লোকই বা কোথায়? তুমি তো চেন সব মনে হয়। তুমি কার ছেলে?’

‘পাপার নাম করে বললুম –‘আমি তো বাড়ী যাচ্ছি আর আপনাকে 
চিনি ও না। সঙ্গে যাব কেন আপনার?’।

‘শুনে সে বলল-‘তবে তো যেতেই হবে তোমাকে’। 

বলেই সে একহাতে আমার মুখ চেপে ধরল ঘাড়ের পিছন দিয়ে হাত 
ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে আর নীচু হয়ে অন্য হাত আমার হাঁটুর নীচে ঢুকিয়ে 
আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল একটানে।  সেইভাবেই  সে নীচু হয়ে 
মোটরে ঢুকে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলো গাড়ীর। গাড়িটা ও সঙ্গে সঙ্গে 
ছেড়ে দিল। আমি --হেল্প …হেল্প… করে চিৎকার করলে ও কে শুনছে’?
 

‘মোট তিনজন ছিল ওরা গাড়ীতে। 

একজন ড্রাইভার সামনে আর অন্য দু’জন ছিল পিছনের সীটে আমার 
দু’পাশে। হয়তো দ্বিতীয় লোকটাই সর্দার হবে। আমি চিৎ হয়ে দু’জনের 
পায়ের ওপর পড়েছিলাম। আমার চিৎকারে আর ছটফট করতে করতে 
হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকের দরজা খুলে ফেলবার চেষ্টা দেখে সে রাগ করে 
বলল-‘আবে ছোটে, শালার ছেলের মুখে রুমাল ঢুকিয়ে বেঁধে ফেল 
আগে। তারপর হাতদুটো ও বাঁধ। দড়ি বার করে। সঙ্গে আছে?’

‘না, বস’।

ভীষন রেগে গেল সর্দার। বলল-‘আরে বুরবক, তা থাকবে কেন সঙ্গে? 
বারো বছরের এতবড় একটা ছেলেকে অপহরণ করা সোজা কাজ? তুই 
এখন রুমাল দিয়েই শালার মুখটা বাঁধ আগে। তারপর শালার ছেলের 
শার্টটাকে খুলে হাত দুটো বাঁধ তাই দিয়ে। শেষে প্যান্টটা ও খুলে নিয়ে 
তাই দিয়ে পা দুটোও শক্ত করে বেঁধে সীটের নীচে ফেলে রেখে শালার 
ছেলের বুকে পা চাপিয়ে দিয়ে বসে থাক। পুলিশ বা কেউ কিছু যেন 
দেখে বা শুনে না ফেলে আওয়াজ’। 

‘ততক্ষনে লোকটা আমার মুখ বেঁধে দিয়েছে, আংকল। তাই চিৎকার ও 
বন্ধ হয়ে গেছে আমার। তবে খুব হাত পা ছুঁড়ছিলাম আমি। তখন 
লোকটা আমার হাত ধরে জোর করে বেঁকিয়ে দিয়ে একে একে সার্টের 
হাতা খুলছে টেনে। আর আমি ব্যথায় গোঁ গোঁ করছি। গাড়ী ততক্ষনে 
জি০টি০ রোডে এসে গিয়েছে কেননা ড্রাইভার বলল-‘বস, ডানদিকে 
যাব না বাঁয়ে? বলো’।

সর্দার বলল-‘আবে কিষনওয়া, দু’নম্বরমে চল জল্দী। শালে পুলিশকো 
খবর কিয়ে হোঙ্গে। বনারস জানে কা টাইম নহী হ্যায়। মির্জাপুরকে 
বরকচ্ছা গাঁও কি ওর ভাগ জল্দী সে’।
   
আমাকে উপুড় করে পিছমোড়া করে হাত দুটো বাঁধতে ব্যস্ত অপহরনকারী 
তখন। 

গাড়ীর ঝাঁকুনি আর আমার লাফালাফিতে সে কাজ তাড়াতাড়ি হচ্ছিল 
না, আংকল’।
পূর্ণ বেগে ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে সে অনেক কসরত করে আমার পা দুটো 
ও বাঁধতে শুরু করল। 

ড্রাইভার বলল-‘বস, কোন একটা গাড়ী পিছনে আসছে কিন্তু, 
হেডলাইট বন্ধ করে। ছেলেটাকে জল্দী সীটের নীচে ফেলে দিন। কেউ 
দেখে নিলে মুস্কিল হবে’।

‘আমি সে শালার ভেজা উড়িয়ে দেব গুলী করে তার আগেই। তুই শালা 
স্পীড বাড়া যেন ওভার টেক না করতে পারে। সাইড দিবি না’।

‘বস, টপ স্পীডে যাচ্ছি। হান্ড্রেডের ও বেশী। এই গাড়ীর আর স্পীড 
বাড়বে না। পিছনের গাড়ীটা হয়তো ফোর্ড বা জীপ। আমরা পারব না 
ওদের সাথে। লাইট নেই কেন যে তাই ঠিক বুঝছি না।

‘শালা কুত্তার বাচ্চা ছেলেটাকে নীচে ফেলে দিয়ে পিছনের উইন্ড স্কীনটা 
ঠেলে তোল তিন ইঞ্চি। আমি দেখছি…’

এই বলে সে পকেট থেকে পিস্তল বার করতে লাগল। আমি তখনি জোর
 ঠেলায় নীচে গড়িয়ে পড়লাম । পাশ ফিরে পড়লাম বলে বেশী না হলে
 ও দিব্যি জোর লাগলো আমার খালি গায়ে। পরক্ষনেই দড়াম করে এক 
গুলির শব্দ শুনতে পেলাম আমি…আবার…আবার ও…

চড়র বড়র করে গাড়ীর ছাদে তখনি কেমন একটা শব্দ শুরু হতেই 
ড্রাইভার বলে উঠল-‘মার দিয়া শালা, পানী ভি আভি বরষনা থা। 
রাস্তে মে বালু পড়া হ্যায়, শালা ভিগ কর স্পীড খা জায়েগী বালু। 
জিধর দেখো ইঁটা আউর বালু …সব শালে মকান বনওয়ানে মে মস্ত 
….কুত্তে …হারামী…’

‘আবে শালে কো গোলী লগী নহী রে। বহুত তেজ হাওয়া অউর বারিষ …অন্ধেরা ভি…’

‘আরে বস, গাড়ী তো বগল মে আ গয়ী…হোশিয়ার…’

‘সাইড প্যানেল নামা ডানদিকের…ভেজা উড়িয়ে দিই হারামিকে বাচ্চের..’

দড়াম…গুড়ুম…খট…খট…খট

‘যাঃ, গোলী খতম। ছোটে, গোলী ভর পিস্তলমে…জলদী  সে…’

ছোটে পিস্তলের চেম্বার খুলে গুলী ভরছে হঠাৎ দমাস আর ঝনঝনঝনাৎ 
করে দারুন শব্দ হ’ল একটা আর সেই সাথে এসে আমার গায়ে লাগলো 
ভিজে হাওয়ার জোর ঝাপটা ।

‘আরে আরে হামরা পিস্তল তো ছটক গিয়া রে হাওয়া কে ঝপট্টে 
সে…রোখ গাড়ী আভি…’ ছোটে চেঁচিয়ে উঠল।

তখনই আবার দমাস করে জোর শব্দের সাথে ড্রাইভার –‘আরে বাপ্পা 
রে, মর গয়লী রে…’ বলে আর্তনাদ করে উঠল এবং গাড়ীর স্পীড 
কমতে শুরু করল।

একেবারে থেমে গেল গাড়ী একসময়। ড্রাইভার হয় অচেতন নয়তো তখন 
পরপারে।

দরজা খুলে আমাকে মাড়িয়ে দু’দিক দিয়ে নীচে নামল সর্দার আর ছোটে।

আলোর ঝলকানি দেখে আমার মনে হ’ল ছোটে টর্চ জ্বেলে পিস্তল খুঁজছে 
আর সর্দার জোর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই আগন্তুক গাড়ীটা কোথায় তাই দেখতে ।

হঠাৎ ছোটের এক আর্ত চীৎকার ও ধপাস করে জোর শব্দ শুনে বুঝলুম
 তার ও পতন এবং মূর্ছা হ’ল হয়তো’।

‘তখনি ভয়ংকর জোর বোমা বিস্ফোরনের মতন শব্দে আমার কানে 
তালা লেগে গেল যেন। আবার…আবার…তেমনধারা  ভয়ংকর শব্দ’।

‘খন্ডযুদ্ধ যে লেগে গেছে বাইরে তা বেশ বুঝলেও আমার তো কিছু 
করবার ক্ষমতাই ছিল না তখন, আংকল। আমি পড়ে পড়ে শুনলুম, 
বাইরে সর্দার চীৎকার করছে-‘শালে কী গাড়ী, ই হমে চক্কর মারতী 
হ্যায়…রুক যা… আভি চকনাচুর করকে.রাখ দুঙ্গা.’

আবার বোমা ফাটলো একটা…

শেষ বিস্ফোরনের পরক্ষনেই সর্দারের দীর্ণ আর্ত চীৎকার ধ্বনিত হ’লো..

ব্যস। সব চুপচাপ। বৃষ্টি ও থেমে গিয়েছে তখন।

প্রায় পাঁচ মিনিট পরে কেউ গাড়ীর হাতলে আস্তে করে চাপ দিল। 
বাঁ দিকের দরজা খুলে গেল আর মৃদু আলো জ্বলল ভিতরে। কেউ 
ডাকল—‘সুশীল, তুম কাঁহা হো’? 

শুনে বুঝলুম বাদলের কন্ঠস্বর। কিন্তু আমি মাত্র একটু গোঁ গোঁ করে 
উঠলুম। বাদল তাইতেই কি বুঝলো কে জানে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে 
আমার অবস্থান বুঝে নিয়ে সাবধানে আমার শরীর বাঁচিয়ে অনেক 
কসরৎ করে ভেতরে ঢুকল বাদল। আন্দাজে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আমার 
হাতের বাঁধন খুলতে লেগে গেল সে। অনেক কষ্টে খুলে ফেলল সার্টের 
বাঁধন। তারপর আমার পায়ের বাঁধন ও খুলল বাদল’।
 
‘সব শেষে মুখের রুমাল অপসারিত করে সীটে টেনে তুলে বসালো 
আমাকে। আমার অসাড় হাত ও পায়ে ম্যাসেজ করে দিল খানিকক্ষন। 
হাত পায়ের একটু সাড় ফিরতে দশ পনেরো মিনিট সময় নষ্ট হ’লো। 
তা কি আর করা’? 

‘তারপরে বাদল আমাকে ধরে গাড়ী থেকে বাইরে বার করে এনে 
পোষাক পরতে ও সাহায্য করলো। বাইরে বৃষ্টি ও থেমে গিয়েছে 
ততক্ষনে। সবশেষে আমাকে একটু ফ্রী হ্যান্ড ব্যায়াম করে শরীর ঠিক 
করে নিতে বললো। তারপরে তো সোজা পেছন দিকে দৌড় শুরু হ’লো 
আমাদের, আংকল। তবে বাদল যে কি করে আমাকে উদ্ধার করলো 
সে’খানে ঠিক সময়ে এসে, তা ঠিক বলতে পারবো না কিন্তু’।

ততক্ষনে মালিয়ানে এসে গিয়েছে।

বাড়ীর গেটে ডঃ রায় দাঁড়িয়ে ছিলেন চিন্তিতমুখে। অটো গিয়ে থামলো। 
সুশীলকে নামতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন –‘কি রে? কোথায় 
গিয়েছিলিস? এতো দেরী হলো যে ফিরে আসতে?’

বাদল হয়ত কিছু বারণ করে দিয়েছিল আগেই। সুশীল বলল-‘কিছু না 
পাপা। একটু দেরী হয়ে গেল তাই অটো করে আসতে হ’লো। তুমি ঘরে 
চলো, সব বলছি। তবে আগে অটোওয়ালাকে এনাদের বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে 
যেতে বলে দাও না পাপা…. বৃষ্টি তো পড়া শুরু হয়েছে এখানে ও এখন 
গুঁড়ো গুঁড়ো। দেরী হয়ে গেলে তো বাস ও আর মিলবে না…’


ডঃ রায় অটোওয়ালাকে বললেন-‘এনাদের বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়ে 
বেনারসের বাসে তুলে দিও। তোমার টোটাল কত হ’লো বলো’।

‘জী, একশো…’

‘এই নাও। জল্দী যাও এবারে। আচ্ছা স্যার, নমস্তে। বাই বাদল…’।

অটোওয়ালা আমাদের বাসে তুলে দিয়ে গেল। 

পেছনের সীট। 

তাই সই। 

ক্লান্ত বাদল আমার কোলে মাথা রেখে হঠাৎ করে আড় হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বললো-‘কাকু, আমাকে বাড়ীতে গিয়ে ভালো 
করে চান করিয়ে দিও কিন্তু। যা ধূলো খেয়েছি না। খোলা গাড়িতে…’।

রাত ন’টা বাজলো আমাদের বেনারস পৌঁছতে। 

একটা হোটেল থেকে আমাদের জন্য রাতের খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে 
অন্য অটোতে উঠলুম আমরা। এই ধকলের পরে আর বাড়ী গিয়ে রান্না 
করবার ক্ষমতা নেই আমার। কিন্তু রাতে কিছু তো খেতে হবেই। তাই 
এই ব্যবস্থা….

বাড়ী পৌঁছে খানিক বিশ্রামের পরে রূপকুমার ছেলে বাদলকে আগে নিয়ে 
গিয়ে ভালো করে স্নান ও প্রসাধন করিয়ে এনে ঘরের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে 
নিজে ও স্নান করতে গেলুম। বাদল কার্টুন দেখতে বসল। 

রাতের খাওয়ার শেষে চঞ্চলের বদলে বাদলকেই নিয়ে পায়চারী করবার 
সময় জিজ্ঞাসা করলুম—‘বাদল, এইবারে তুমি বলো তো শুনি, যে 
কান্ডটা কি হয়েছিল। সুশীলকে ঊদ্ধার করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। 
পুলিশেও করতে পারতো না এতো কম সময়ের মধ্যে। তুমি করলে কি করে?’

সুন্দর ভ্রুভঙ্গি করে বাদল বলল—‘এ্যাই ধ্যাৎ কাকু, আমি কি কিছু 
করেছি না কী? সব তো তিনিই করলেন। আমি তো মাত্র সঙ্গে ছিলাম, এই যা’।

‘কে তিনি, বাদল’?

‘তা তো জানি না, কাকু। তবে ঘটনাটা তোমাকে বলছি শোনো’। 

দবাদল দুই নরম হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শুরু করল---

‘কাকু, আমি তো দম বন্ধ করে প্রাণপনে দৌড় দিয়েছিলাম। দৌড়ে 
কোন মোটরকে ধরতে পারা অসম্ভব জেনেও। তুমি তাই পিছিয়ে 
পড়েছিলে, কাকু। মোড় ঘুরলুম আমি স্টেশন পার হয়ে। জনমানবহীন 
পথ। হঠাৎ দেখি পাশ দিয়ে একখানা এক্কা গাড়ী যাচ্ছে ধীর গতিতে। 
আমাকে ছুটতে দেখে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। দেখি সেই গাড়ীতে চালকের 
আসনে বসে আছেন লম্বা সাদা দাড়ীওয়ালা একজন মুসলমান আর 
গাড়ীতে একটার বদলে দু’টো কুচকুচে কালো তাগড়া ঘোড়া জোতা আছে’। 

‘আমাকে তিনি ইসারায় গাড়ীতে উঠতে বললেন। আমি লাফিয়ে ওঠা 
মাত্র তিনি নক্ষত্রবেগে গাড়ী চালিয়ে দিলেন কোন কথা না বলে। রেল 
গেটে এসে যেতে তখন স্পীড একটু কমালেন। রাস্তার দিকে ক্ষণকাল 
চেয়ে কি যেন দেখলেন এবং ডানদিকে গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে আবার 
পূর্ণবেগে চালিয়ে দিলেন। আমি অত উঁচু থেকে কিছুই দেখতে পেলুম না,
 কাকু। কাঠের সমতল পাটাতন ফেলা উঁচুমতন বহুপুরণো এক্কাগাড়ী। 
পাটাতনের চারকোনে চারটে লোহার রড লাগিয়ে তার ওপরে একটা 
কাপড়ের আচ্ছাদন মাত্র লাগানো ছিল’।

আমি বিড়বিড় করে বললুম—‘জুড়ি গাড়ী…’

বাদল আমার স্বগতোক্তি ঠিক শুনতে পেয়ে গিয়ে নিজের সুন্দর ভ্রু 
কুঁচকে প্রশ্ন করলো—‘তার মানে, কাকু?’

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অপরূপ সুন্দর ছেলেটাকে আদর করতে 
শুরু করলুম হঠাৎ। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে আমি থামতে নিঃশ্বাস ফেলে 
বাদল বলল-‘হয়েছে, কাকু। আমি সব বুঝেছি। তোমাকে আর বলে 
ব্যাখ্যা করতেই হবে না কিছু’।

একেই বলে হয়তো সাপের হাঁচি, বেদেয় চেনে।

পরীর দেশের রাজকুমার ছেলে চঞ্চল হ’লে তাকে এখন একঘন্টা ধরে 
ব্যাখ্যা করতে হতো জুড়িগাড়ীর মানে। দু’টো ছেলের মধ্যে এই এক 
দারুণ প্রভেদ। 

তবু বললুম-‘কি বুঝেছ, বাদল? বলো তো।’
‘কাকু, এক্কায় একটাই ঘোড়া থাকে। জোড়া ঘোড়া থাকলে তাকেই তখন 
জুড়িগাড়ী বলা হয়। আর ওই গাড়ী চলতো আজ থেকে বহুদিন আগে। 
অর্থাৎ আমি যাকে দেখেছি তিনি এইকালের কোন মানুষ নন। তাই আমি 
ভাগ্যবান বলে তুমি আমাকে আজ এতো আদর করছো, এই তো… তা শোনো’---

ছোট বাচ্ছা হ’লে কি হয়, বাদল যে সুপার জিনিয়াস ছেলে। তাই তার 
ব্যাখ্যা বা অনুমানে ভূল হয় না কখনো। মুখে কিছু না বললে ও অনেক
 কিছুই সঠিক বুঝে নেয় সে অনায়াসে।

‘গাড়ী ছুটছে না উড়ছে তা আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না কিন্তু, 
কাকু। রাস্তা ও খুব একটা সমতল নয় । কেমন যেন ঢেউ খেলানো। 
ফলে লোহার রড ধরে ও দাঁড়িয়ে থাকা ক্রমে আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে 
ঊঠল যেন। দু’কানের পাশ দিয়ে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কি করব 
ভাবছি, হঠাৎ দূরে জাগল একটা কালো বিন্দু ধূলোর অন্তরালে। যত 
সময় যায় সেটা বড় হয়ে চলেছে আর ধূলো ও ছুটে আসছে ঝড়ের 
বেগে। ধূলোয় চান করে যাচ্ছি কিন্তু কিচ্ছুটি আমার করবার নেই’।
‘হঠাৎ দুম করে জোর একটা শব্দ হতেই গাড়ীর একটা লোহার রড 
হেলে পড়ল। বুঝলুম গুলী চালাতে শুরু করেছে অপহরণকারী দল। 
যেখানে গাড়িটার কাঠে রডটা আটকানো ছিল সেখানের কাঠ ভেঙে গিয়ে 
রডটা বেরিয়ে এসেছে। খোলা গাড়িতে এই মুস্কিল কিন্তু গাড়ীটা এইবার 
সাপের মতন এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগলো আর পর পর আরো কয়েকটা 
গুলীর আওয়াজ হ’লে ও গাড়ীর আর কোন ক্ষতি হ’লো না। ভারী 
লোহার রডটা নীচে পড়ে যাচ্ছে দেখে আমি সেটা ধরে একটান দিলুম। 
রডটা পুরো খুলে আমার হাতে চলে এলো আর তাইতে আটকানো 
আচ্ছাদনটা পত পত করে উড়তে লাগলো, পতাকার মতন’।

‘ক্রমে আমাদের গাড়ী সেই গাড়ীখানাকে ধরে ফেলল। সে অতি অদ্ভূত 
ব্যাপার,কাকু। ঘোড়ার গাড়ী যে মোটর গাড়ীর চেয়েও জোরে ছুটে যেতে 
পারে তা কিন্তু এই প্রথম দেখলুম আমি। তারপর  দুটো গাড়ীই 
পাশাপাশি ছুটলো বেশ কিছুক্ষণ আর কালো গাড়ী থেকে আবার দু’ 
তিনবার গুলী ও চললো তবে তা হাওয়ার বেগে কোথায় যে উড়ে গেল 
তা কে জানে? একটা গুলির ছানাও আমাকে ছুঁতে পারলো না’।

‘তারপরে আমাদের গাড়ীখানাই কিন্তু রেসে জিতে গিয়ে এগিয়ে গেল সাঁ 
করে। আমি লোহার ভারী রডটা হাতে তুলে নিলুম ও অকারণে শক্তকরে 
উঁচু করে তুলে ধরে না থেকে কি মনে হ’তে বাঁ দিকে হরাইজেন্টালী 
ধরে রইলুম। তখন গাড়ীর স্পীড হঠাৎ একঝটকায় কমে গেল আর সঙ্গে 
সঙ্গে বেশ বিচ্ছিরী কান্ড হ’ল একটা। আমার রডটাতে দমাস করে এসে 
ধাক্কা মারলো ওদের গাড়ীর উইন্ডস্ক্রীন…’

‘ঝন ঝন ঝনাৎ ….বিষম শব্দে কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে 
পড়ল। তা’তে আর আমি কি করব বলো না, কাকু?’

‘তৎক্ষণাৎ আবার বেড়ে গেল স্পীড আমাদের গাড়ীর হঠাৎ আর 
খানিকটা এগিয়ে গিয়েই আবার ঠিক যেন একেবারে ব্রেক কষে দাঁড়ালো 
ক্ষণেকের জন্য। দারুণ সংঘর্ষের সাথে অন্য গাড়ীখানার মধ্যে আবার 
জাগলো আর্তধ্বনি এবং তারপরেই সেই কালো গাড়িখানার স্পীড কমতে 
শুরু করলো। শেষে খানিকক্ষন পরে দেখি যে একদম থেমে গেলো 
গাড়িটা। বৃষ্টি তখন আর পড়ছিলো না সে’খানে’।
 
‘দমাস দমাস করে শব্দ করে দরজা বন্ধ হলো দু’টো। অর্থাৎ দু’দিকের 
দরজা খুলে কম সে কম দু’জন লোক নামলো। বাঁ দিকে আমাদের 
গাড়ীটা খানিক যেন সরে এলো হঠাৎ। সেই দিকে দেখি ক্ষীণ টর্চের 
আলো। কেউ কিছু নীচু হয়ে খুঁজছে মনে হ’লো। সুযোগ বুঝে অন্ধকারেই 
লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে আলোর উৎসের লক্ষ্যে আমি বেগে ছুঁড়ে দিলুম 
হাতের ভারী লৌহদন্ড। তৎক্ষণাৎ জাগল দারণ আর্তনাদ। অর্থাৎ আমার 
লক্ষ্য ভূল হয় নি’।

‘আমাদের গাড়ীখানা যেন হাওয়ায় ভর করে বেগে এক চক্কর ঘুরে 
সামনে এসে দাঁড়াতে একজন কেউ কিছু একটা জোরে ছুঁড়ে মারলো 
আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গাড়ী ও বেশ ভেল্কিবাজী দেখালো 
যেন। ধাঁ করে কালো গাড়ীটার আড়ালে সরে গেল আর দারুন বোমা 
ফাটার মতন শব্দ হ’লো একটা ঠিক আগের জায়গাটাতে’। 

আমি বললুম-‘স্বয়ং পার্থসারথী না কী রে বাবা?’

বাদল শুনেই হিঃ…হিঃ… করে হেসে ফেলল মুক্তোর মতন দাঁত বার করে।

তারপরে বলল—‘কাকু, পরপর ক’টা যে গ্রেনেড ফাটলো সেখানে তা 
আমি গুনিনি কাকু, তবে মনে আছে যে শেষেরটা আমাকে লক্ষ্য করে 
এসে পড়েছিল কালো গাড়ীটার ছাদে। ঠিক তার পিছনে আমি আছি 
তখন মনে করে’। 

‘সেখানে কিন্তু ওদেরই কিছু জিনিষপত্র বাঁধা ছিল ফোম ও রবার ক্লথ 
বা তেমনিধারা কিছু দিয়ে বৃষ্টির জলের হাত থেকে সুরক্ষিত করে 
রাখবার জন্য। জোর হাওয়াতে প্ল্যাস্টিক ছিঁড়ে যায় বলে মনে হয় রবার
 ক্লথ প্রয়োগ করা হয়েছিল হয়তো। আমি ঠিক দেখতে পাইনি তাই 
অনুমানে বলছি, কাকু  কেননা ফল তো উল্টোই হ’লো’। 

‘শেষ বোমাটা দেখি হঠাৎ বাউন্স ব্যাক করে গিয়ে ক্ষেপনকারীর সামনে 
ঠিকরে পড়ে ভীষণ জোরে বিস্ফোরিত হ’লো আর তার দীর্ণ আর্ত 
চীৎকার ধ্বনিত হ’লো পরক্ষণেই’। 

‘তার পরে সব চুপচাপ । আমি লাফিয়ে নেমে পড়লুম গাড়ি থেকে। 
গাড়িটা গড়গড় করে সামনে চলে গেল আর আমি এগিয়ে গিয়ে কালো 
গাড়িখানার দরজা খুললুম, সাবধানে। তারপরে যা যা হয়েছিল, সেসব 
তো সুশীল বলেই দিয়েছে, কাকু।   আমি অবশ্য ওর পাপাকে সবকথা 
পরে জানাতে বলেছিলাম, নইলে আমাদের ফিরতে আরো তো দেরী হয়ে 
যেত। তাই না কাকু?’

‘সত্যিই তো তাই’। 

‘তা এইবারে চলো বাদল, চুনারের হজরত বাবাসাহেবকে সেলাম জানিয়ে 
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়া যাক দু’জনে। রাত তো অনেক হয়ে গেছে’। 

এই বলে সুকুমার ছেলে বাদলকে নিয়ে টিউব লাইট নিভিয়ে নীল নাইট 
ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে মশারির ভেতরে ঢুকে শুয়ে পড়লুম টপ করে। 
================================================

০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ১৭/৩/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 5  China : 53  France : 3  Germany : 2  Hungary : 1  India : 216  Ireland : 2  Israel : 31  Netherlands : 12  
Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 1  Sweden : 7  Ukraine : 33  United Kingdom : 2  United States : 563  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 5  China : 53  France : 3  
Germany : 2  Hungary : 1  India : 216  Ireland : 2  
Israel : 31  Netherlands : 12  Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 1  
Sweden : 7  Ukraine : 33  United Kingdom : 2  United States : 563  
  • ২য় বর্ষ ১১তম সংখ্যা (২৩)

    ২০১৩ , এপ্রিল


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
চুনারের বাবাসাহেব by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০১৫৯৬৬৪
fingerprintLogin account_circleSignup