দিনের সাজা ... রাতের মজা
আনুমানিক পঠন সময় : ৩০ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫০ টি দেশ ব্যাপী ৪১৪৫১ জন পড়েছেন।
জি০সি০ভট্টাচার্য্য,বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
----------------------------------------

যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার একমাত্র ছেলে গৌরবের বয়স ছিল মোটে ছয় কি সাত বছর। 
তবে ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান আর চকচকে, চটপটে আর চালাক চতুর ছিল। অনেকের বুদ্ধি থাকলে 
ও দেখি কুট বুদ্ধি কম থাকে। গৌরব সেই জাতীয় ছেলে নয় । তবে ছেলেটা মাঝে মাঝে অনেক 
অদ্ভূত কথা বলতো আর কোন কোন কাজ এমন করতো যার ব্যাখ্যা করা ও কঠিন।

তবে শৈশবেই ছেলেটা মাতৃহীন হয়ে আমাকে বেশ ঝামেলায় ফেলেছিল, সে সব কথা তো আমি 
আগেই বলেছি। কিন্তু ছেলেটাকে মানুষ করার দায়িত্ব ও শেষে নিজেই নিয়েছিলাম যদি ও অফিস 
আর ছেলে, তাও এতো ছোট একটা বাচ্ছাকে সামলানো মোটেই সহজ কাজ নয় একলা আমার মতন 
একজনের পক্ষে। গৌরব যখন জন্মায় তখন আমি সবে চাকরিতে ঢুকেছি এম০বি০এ০ করে। 
বছর তেইশ চব্বিশ  বয়স হবে আমার।

ছেলের দরকারে কাজের লোক ও একজন  রেখেছিলাম দিনভোরের জন্য। 

তা দেখি যে সে মাসে দশদিন আসেই না। মহা ঝামেলা তখন আর যখন আসে তখন ও ছেলেটাকে 
ঠিক মতন নাওয়ানো খাওয়ানোতে ও বেশ ফাঁকি দেয়। এমন কি ভালো দুধ, ছানা বা মিষ্টি যা 
ফ্রিজে এনে রাখা থাকে সে সব ও ছেলেটাকে খাওয়াবার বদলে নিজেই খেয়ে বসে থাকে। এক 
বছরের ছেলে তো আর কিছু বলে দিতে পারবে না তার বাপীকে। তাই নিশ্চন্ত ছিল সে।

তবে গৌরব সব্বার সব ব্যাপারেই যে বাদ সাধে সে আমি ঠিক দেখেছি।  সময়ের আগে খুব 
অল্প দিনেই প্রথমে ইসারায় কথা বলতে শুরু করে গৌরব। অপশ্য সে ভাষা এক আমিই বুঝতাম। 
আর তারপরেই কথা বলতে ও শিখে নিয়ে সব মাটি করে দিলো। আমাকে সব বলে দিতে লাগলো 
ছেলে আর আমি ও তাকে জবাব দিয়ে নিজের ছেলে নিজেই দেখব ঠিক করে একটা ডে চাইল্ড 
কেয়ার  হোমে কথা বলে নিলুম।  
   
গৌরবের মামা অবশ্য এসে ভার নিতে চেয়েছিলেন, আমি আর রাজি হই নি। কে জানে বাবা? 
সে’খানে ও হয়তো একই অবস্থা হবে আর গৌরবকে না খেয়েই থাকতে হবে, এই ভয়ে। 
কিছু বলতে ও তো পারবো না। 

ফলে ছেলের সব দায় দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিল। তাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, সাজানো, 
বেড়ানো, তার জামা কাপড় কাচা, ঘুম পাড়ানো, তার সাথে বসে তাকে পড়ানো, খেলা করা...
মন কি দরকারে ওষুধ পথ্য দেওয়া, সব।. . ..সব। কাজ কি একটা?

পাড়ার সহৃদয় জনগণ সেটা যে ঠিক মেনে নিতে চাইবেন না তা স্বাভাবিক।
তার ওপরে তখন আবার ছেলেকে কোলে নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় রোজই একটু গঙ্গার ঘাটে বেড়াতে 
ও যেতুম আমি। বেনারস যে অত সুবিধের জায়গা নয় সে হুঁশই ছিলো না। 

অফিস ফেরত ছেলেকে হোম থেকে বাড়ী নিয়ে এসে তার হাত মুখ ধুইয়ে জলখাবার খাইয়ে অন্য 
পোষাক পরিয়ে সাজিয়ে টাজিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। 

আর তখন কোন না কোন পরিচিত বা প্রতিবেশির সাথে দেখা হয়ে গেলেই হ’তো  চিত্তির।

আমার জন্য কষ্টে তাদের বুক যেন এক্কেবারে ফুটির মতন ফেটে যেতো। পুরোটা না ফাটলে ও 
আধাআধি হয়তো ফাটতো তাই নানান প্রশ্নের ঝড় বইতো । সেই সাথে আমার দুঃখ কষ্টে তারা 
যে কি করবে তাই ভেবে পেত না। উপদেশ অনুরোধে কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করতো 
আমার। সেই যে কখায় বলে না ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি. . .. . .সেই অবস্থা আমার হ’তো। 

রাগ করে অনেকে তো বলেই ফেলতো যে এই এক  তোমার ছেলে নিয়ে ব্রহ্মচারী হয়ে কি সারাটা 
জীবন কাটবে ভাই? পরে তুমি পস্তাবে। সময় থাকতে অপব্যবহার করো না তার। 

আমার মনে হ’তো যে অদ্ভূত ছেলে গৌরব হয়তো সেই বয়সেই সব বুঝতে ও পারতো তবে 
কোন কথা বলতো না। এই যা ।

সে’দিনটা ছিল বাংলা নববর্ষ। 

অবশ্য সবাই ইংরাজী নববর্ষকেই তখন থেকে নতুন বছরের আরম্ভ বলে মানতে শুরু করে দিয়ে 
বাংলাকে ভূলতে বসেছে।  

তা আমি ও সে’দিন গৌরবকে একটা হাল্কা ব্রাউন রঙের দামী বিদেশী কাপড়ে তৈরী চাইল্ড স্যুট 
পরিয়ে মুখে ফেয়ারনেস ক্রীম ও পাউডার টাউডার লাগিয়ে, ছেলের বড় বড় টানা টানা দু’চোখে 
কাজল টাজল পরিয়ে খুব করে সাজিয়ে নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম।

গৌরব তো এমনিতেই খুব ফর্সা ও অতি সুন্দর ছেলে, তাই তাকে সাজানোর কোন দরকারই হয় না । 
সাধারণ পোষাকেও ছেলেটাকে দারুণ সুন্দর দেখায়। তাও ছেলেকে আরো বেশী সুন্দর করবার আমার 
শখ আর চেষ্টা দেখে সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটু দুষ্টু হাসি হেসেছিল সেদিন।

বাড়ী থেকে বেরুতেই গৌরব বললো--‘আজ কোথায় যাবে, বাপী?’

‘যেখানে রোজ যাই. . .’

‘আজ না গেলে কি হয়, বাপী?’

‘কেন? যাবো না কি কারণে?’

‘মনে কর যদি বিশ্বেশ্বর আংকল বা অন্য কেউ সে’খানে থাকেন আর দেখা হয়ে যায়?’

‘তা যায় তো যাবে, তা’তে কি হয়েছে, গৌরব?. . .’

‘উনি আমার এই দামী পোষাক আর সাজ গোজ দেখলে না বাপী. . ...খুব আপসেট হয়ে পড়বেন  
হিঃ. . .. . .. . .. . ..হিঃ. . .. . .. . .হিঃ. . .. . .. . .. . ..আর তুমি যে নতুন ঝকঝকে 
ঘড়িটা আমার হাতে আজ পরিয়েছো না বাপী, সেটার দাম ও তো এক হাজার টাকার কম নয়। 
দেখলেই উনি ঠিক ভাববেন যে এই অপয়া হতচ্ছাড়া এক ছেলের জন্য মাইনের সব টাকাটাই  
জলে দাও তুমি, বাপী. . .. . .. . .. . .. . ...’

গৌরবের মুখে বড়দের মতন কথা শুনে আমি তো অবাক। কারো কাছে সে এই ধরনের কথা বার্তা 
যে শুনেছে, তা নির্ঘাৎ সত্যিকথা। নইলে বলবে কি করে? তবে তখন কার দিনে হাজার টাকার 
অনেক দাম ছিলো। তিন চার’শোতে ভালো এইচ০এম০টির ঘড়ি পাওয়া যেতো।
আমি বললুম—‘তুমি ঘড়িটার দাম জানলে কি করে, গৌরব?’

‘মা বলেছে যে. . ..বলেই ছেলে মুখে হাত চাপা দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো।’

বোঝো ঠ্যালা এখন। এই আর এক মুস্কিল আমার হয়েছে এই সুন্দর ছেলেটাকে নিয়ে। 
কি যে আমি করি? যে মানুষ আঠারো বছর বয়সে মা হয়ে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে পথ দুর্ঘটনায় 
স্বর্গে চলে গিয়েছে, তার আর অস্তিত্ব কোথায়? কে বোঝায় সে কথা এই অবোধ বাচ্ছা ছেলেকে?
 
মানুষ মারা গেলেই তার আত্মা তখন হয়  মুক্ত। তখন তার আর কোন লৌকিক বা সাংসারিক পিছুটান 
কি থাকে? তবে হ্যাঁ, শুনেছি যে বেশ কম বয়সে আর প্রথমে ছেলে হ’লে, তার ওপরে তার মায়ের না 
কি খুব টান হয় অনেক সময়। গৌরবের মতন একখানা রূপবান ছেলে হ’লে তো কথাই নেই।

গৌরবের মা ও তো এই ছেলে নিয়ে যে কখন কি করবে তা ভেবেই পেতো না। সবসময় খুব করে 
সাজিয়ে গুজিয়ে ঠিক একটা পরী বানিয়ে রাখতো নিজের কচি ছেলেটাকে। আমার ও সেই দেখে দেখে 
অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আর কি। ছেলেকে খুব করে খানিক না সাজালে ভালো লাগে না। 
তার আর এখন কি হয়?
 
তবে গৌরব বলে—‘মা তো দিব্যি আছে। তুমি বাপী তো বোঝই না কিছু. . .’

সে যাক। ছোট বাচ্ছার কথায় কান দিতে নেই। আমি তখন বললুম—‘তা গৌরব, আমি যদি 
আমার টাকা আমার ছেলের জন্য নষ্ট করি, তা’তে কার কি?’

‘আছেই ঠিক কোন স্বার্থ। তুমি শিগ্গীরকরে তা জানতেও পারবে, বাপী। আর তখন তুমি বাপী যা 
মুশ্কিলে পড়বে না. . ..হিঃ. . ...হিঃ. . .. . .হিঃ. . ..’     
  
ছেলের ঠাট্টায় রাগ করে বললুম--‘ছাই আছে. . .. . .. . ..’

বলে আমি জোর পায়ে হাঁটা দিলুম গঙ্গার ঘাটের দিকে ছেলের চকচকে নরম ডান হাতটা শক্ত করে ধরে। 
ঘড়িটা গৌরবকে বাঁ হাতে পরিয়েছিলাম তো, তাই।

কিন্তু ঘাটের সিঁড়ি নামবার আগেই আমি দারুণ চমকে উঠলুম—‘ও   ওরে বাবা, এ কী? সত্যিই তো। 
সামনেই দেখি যে ঘাটের ওপরে বিরাজমান রয়েছেন এক জবরদস্ত প্রতিবেশী বিশ্বেশ্বর মুখার্জী এবং মনে 
হয় সপরিবারে। অন্য কয়েকজন আত্মীয় স্বজন ও আছেন মনে হয়. . .. . .এই লক্ষণ তো ভালো নয়। 
কোন প্ল্যান আছে মনে হয়. . ...’ ।

‘সর্বনাশ হয়েছে. . .ও গৌরব. . .’

‘আমি তো তখনই বলেছিলাম, বাপী। তুমি তো খুব জেদী ছেলে. . .তাই শুনতেই চাও না. . .’

‘এখন. . .উপায়?’

‘উনি আমাদের দেখে ফেলবার আগেই তুমি ছুট্টে পালাও, বাপী. . .’

‘পালিয়ে যাবটা কোথায়? উনি তো বাড়িতেও ধাওয়া . . .. . .. . .. . .. . .. . ..’

ঘড়ি দেখে গৌরব বলল--‘বাড়ী যাবে কেন, বাপী? কে০সি০এম০ পিক্চার হাউসে যাবে। 
মিকি মাউস চলছে। অবশ্য সময় কম। রিক্সা না করলে. . .’ 

অতঃপর তাই। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি নীতি মেনে ছেলেকে নিয়ে আমি একখানা রিক্সায় উঠে পড়লুম। 

বাড়ী ফিরতে রাত দশটা। ভাগ্যে রাত ন’টায় হল থেকে বেরিয়ে গোধূলিয়ার  দি রেষ্টুরেন্টে ঢুকে 
পড়েছিলুম, নইলে বাড়ী ফিরে আবার কিচেনে ঢুকতে হ’তো আমাকে।

তা বাড়িতে এসে দেখি যে গেটের লেটার বক্সে একখানা চিঠি পড়ে আছে।

ঘরে এনে খাম খুলে চিঠি পড়ে আমার তো চক্ষুস্থির। 

প্রেষক বিশ্বেশ্বর বাবু।
 
আজ আমাকে নববর্যের সারপ্রাইজ ও উপহার দেবেন বলে তিনি না কী গঙ্গার দশাশ্বমেধ ঘাটে 
সন্ধাবেলায় সপরিবারে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তা আমি তো গেলামই না দেখে বাড়ী এসে 
ও দরজা বন্ধ দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। তবে কিছু আসে যায় নি তা’তে তাঁদের। 
কাল সকাল আটটাতে চলে আসবেন আবার. . ..’

‘কি ভয়ানক। সর্বনাশ হয়েছে. . .. . .. . .. . .. . .ও গৌরব. . .. . .. . ..’

‘কি হয়েছে, বাপী?’

‘তিনি আবার কাল সকালে. . .’

‘সে কালকে তো? তুমি এখন চলো তো। আগে জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও। তারপর ঘুম. . 
সকালে উঠে তাড়াতাড়ি একটু চা টা রেডী করে রাখলেই হবে। ওঠো না বাপী. . .’

‘কিন্তু উদ্দেশ্যটা কি?’

‘বোঝনা কেন? তোমার টাকার অপচয়  মানে বাজে খরচ রোধ করা। আর কি হবে, বাপী?’

‘তার মানে, গৌরব?’

‘সে আমি কি  . . .. . .. . .নাঃ, থাক বাপী. . ..’

‘কি না?’

‘থাক না এখন. . .’

আমার ঘোরতর সন্দেহ শুরু হ’লো। গৌরব যা বলছে তার অর্থ পরিষ্কার। ছেলেটা বাপের আদরে 
আছে মা হারা হয়ে ও, তা কারো মনে হয় ঠিক সহ্য হচ্ছে না। সুতরাং. . .. . ..কিন্তু যুক্তিটা কী?’

গৌরবের ডাকে তখন বাধ্য হয়ে উঠে বাইরের পোষাক খুলে রেখে তাকে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলুম আমি।

বিছানায় শুয়ে পড়বার পরে গৌরব আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো—‘আচ্ছা বাপী, হঠাৎ করে
কাজ থেকে ছুটি নিতে হ’লে কোন ছুটি নিতে হয়?’

আচমকা গৌরবের এই প্রশ্নে চমকে উঠে বললুম---‘কেন? সি০এল০ মানে. . .’
‘মানে আমি জানি, বাপী। তুমি দু’ দিনের ছুটির যোগাড় করে রেখো তো। আর. . .. ‘

‘কি আর?’

‘নাঃ এখন থাক। সে কাল সকালে শুনো। মনে হয় দু’দিনে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে. . ...
এখন একটু শান্ত হয়ে তুমি ঘুম করো তো।‘

‘ওরে বাপরে. . ...আমার মাথা গরম হয়ে গেছে, গৌরব। কান ভোঁ  ভোঁ করছে. . .ঘুম আসবেই না। 
অতো করে দেখা মিকি মাঊস ও মাথায় উঠে গেছে. . ..’।

‘ঠিক আসবে ঘুম, বাপী । তুমি না একটা বড্ড ছটফটে ছেলে, বাপী। একটুতেই এতো অস্থির 
হও কেন বলো তো ? এখন আগে তোমার চোখ বন্ধ করো তো। একদম পুরো বন্ধ। একটু ও 
তাকাতে পারবে না তুমি আমার দিকে পিটপিট করে।  তারপরে প্রভু যীশুর ভেড়াগুলো সব 
গুনতে শুরু করো তো। এক. . ..দুই. . .তিন. . .করে যেমন আমি ও গুনছি. . .. . .গোন. . ..’

ঠিক যেমন করে গৌরবকে আমি ঘুম পাড়াতুম আরো আগে ছোট্টবেলায়. . ..তাই দেখি সব দিব্যি 
মুখস্থ করে বসে আছে এই তীক্ষ্নধী ছেলেটা। 

এখন লোকের কথা হচ্ছে এই যে বড় হয়ে এই গৌরব না কী আমাকে মোটেই দেখবে না. . ..
সে তখন তার বৌয়ের হুকুমে চলবে। 

সেই কথা বিশ্বশ্বরবাবুর ও. . .. ছিঃ. . .. . ...

আমি জানি সে সব করে ইডিয়ট ছেলেরা . . .অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বা হাইলি ইন্টেলিজেন্ট ছেলে ও 
মেয়েদের দুনিয়া হয় একেবারে অন্যজাতের .....তাদের ব্যবহার ও কাজ হয় অসাধারণ   তার বিচার 
বা অনুমান ও সাধারণে কি করে করবে? তাদের কথা বা ব্যবহার কিছু বুঝতেই তো পারবে না। ... 

কিন্তু তখন গৌরবের কথা মেনে সেই মতন কাজ করে সত্যিই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি আমি ছেলের 
সাথে তারপরে, তা কে জানে? বলেছি না গৌরব একটা বেশ মজার ছেলে।

পরদিন সকালে বিশ্বেশ্বর বাবু এলে যুক্তিটা জানা গেলো। গৌরব হয়তো ঠিকই জানতো. . .তার একটা 
সোর্স আছে যে ....যদি ও আমি তা মানতে চাই না .....কিন্তু কথাটা কিছুতেই বলতে চায় নি ছেলে, হয়তো লজ্জায়. . .

তাঁরা না কী আমার বাউন্ডুলে জীবনের কষ্টে অতি কাতর হয়ে পড়েছেন। তাই আমার জন্য. . ..

আর কিই বা আমার বয়স? আমার সামনে এখন  সারাটা জীবন তো পড়ে আছে। আর আমাকে 
চাকরী ও করতে হবে। কে তখন সময় অসময়ে দেখে আমাকে? কেই বা ভাত জল দেয়, ঘরে কেউ 
না থাকলে? সুতরাং. . .. . .. . .. . .. . .. . .

আর আমার ছেলে? 

হুঁ. . ...সে ছেলে তো আর দশ বছরেই দিব্যি করে বড় হয়ে হোস্টেলে চলে যাবে টেকনিক্যাল বা 
মেডিক্যাল লাইনে পড়তে. . ..তারপরে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়েই চাকরী হয়ে যায় আজকাল. . . ভাবী 
পুত্রবধূ ও জুটে যাবে আমার অনায়াসে .....তবে তারা চাকরী দেখবে না আমাকে?

সুতরাং একটি সুযোগ্য পাত্রী দেখবেন তাঁরা ঠিক করেছেন আমার জন্য. . .কয়েকটি দেখেও ফেলেছেন 
ইতিমধ্যে . . .তবে কি না কোনটিই মনে ধরেনি ঠিক।
 
আর যখন  কিনা তাঁদের নিজেদেরই একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে. . .সর্ব সুলক্ষণা. . .সর্ব গুণবতী. . 
অসীম রূপবতী. . .তখন চিন্তাই বা কিসের? কাল তার ঠিকুজী কোষ্টি ও না হয় নিয়ে আসবেন। 
অবশ্য যদি আমি দরকার আছে বলি তবেই. . .কেননা আজকাল তো কেউ ওই সব আর তেমন 
মানে টানে না. . ..সুতরা আমি রাজী হ’লেই কথা পাকা. . ... আর রাজী আমি হবই না বা কেন? 
মেয়ে কি ফ্যালনা তাঁদের? তাই সেই উপলক্ষ্যে একটু মিষ্টিমুখ তাঁরা আমাকে না করিয়ে যাবেন না।     

শুনে আমি প্রমাদ গুনলুম মনে মনে। ওরে  বাবা. . ...এ তো দেখি সেই যাকে বলে নিজেই বাজায় 
আর নিজেই গায়. . .. . .. . .অবস্থা. . .. . .এ কি ক্যাঁচাকল রে বাবা? 

আরো সর্বনাশ হয়েছে যে এই ভদ্রমহিলা যে হস্তিনী জাতীয় হবেন তা নির্ঘাৎ সত্যি. . .ওজন একশো 
পঞ্চাশ বা ষাটের নীচে কিছুতেই নয়. . .আশী ও হ’তে পারে. . ..তাঁর মেয়েটি ও তো সেই 
জাতীয়ই হবেন. . .. . . তবে তখন তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বিরাট এক মিষ্টির প্যাকেট খুলছেন. . ..
আমাকে নিজের হাতে খাওয়াবেন বলে।

আমি অসহায় হয়ে চারদিকে দেখছি। যদি পালিয়ে বাঁচতে পারি । কেননা ওই মিষ্টি খাওয়া 
মানেই তো রাজী হওয়া. . .যা তাঁরা তো একরকম ধরেই নিয়েছেন. . .. . ..

ওরে বাপরে. . .ফটোতে মেকআপ খুব চড়া । তাও মেয়েটি যে বেশ কালো আর তেমনি ট্যারা তা বোঝাই যায়। 

ইন্দ্রাণী মানে গৌরবের মা এই ছিরির মেয়েকে দেখলে. . .. ওরে বাবা. . .রে. . ..হেসেই বাঁচতো না, সে তা ঠিক কথা .....

সত্যিই সে ইন্দ্রাণী ছিল নইলে গৌরবের মতন অতো সুন্দর একটা ছেলে হয় কখনো? 
কিন্তু এখন আমার উপায়? হে মা দুর্গা. . ..হে মা রক্ষেকালী. . ..আমাকে আজ বাঁচাও . . .. . 
গৌরবটা ও তো দেখি এখন  আমার ধারেকাছে নেই যে কোন সাহায্য. . .... . .’

হঠাৎ দেখি যে পাশের ঘরের দরজাটা এক সেকেন্ডের জন্য একটু যেন ফাঁক হ’লো আর দু’টো 
ছোট্ট ধবধবে ফর্সা আঙুল বেরিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল ভেতরে। 

ভি দেখালো আমাকে দুষ্টু ছেলেটা .... তার মানে ভিক্টরি। তার মানে. . .আমার চিন্তা নেই. . ..
তার মানে গৌরব আছে ওই ঘরে।

আর তখনি প্যাকেটটি খুলে মিষ্টি তুলতে গেলেন সেই ভদ্রমহিলা।

সঙ্গে সঙ্গে ফরররররর্. . .. . .. . .. . .. . .. . .. . .শব্দে প্রায় ডজন খানেক এই বড়ো বড়ো 
আরশোলা বেরিয়েই জেট প্লেনের মতন উড়ে গিয়ে ওই দু’জনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। 

আঁ. . .আঁ. . .আঁ. . .. . .. . .সে কী বিকট শব্দ রে বাবা. . .আর মিষ্টির প্যাকেট ও বেগে 
উর্দ্ধগামী হয়েছে তখন তাঁর হাতের জোর ধাক্কায়. . .. . .। 

কেননা চেয়ার টেবিল উল্টে ফেলে ভদ্রমহিলা স্বামীসহ পপাত ধরণীতলে হয়েছেন আতঙ্কে। আর 
বিশ্বেশ্বরবাবু বিষম জোরে চিঁ. . .চিঁ রবে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তবে হস্তিনী চাপা পড়া যে মোটেই 
আনন্দদায়ক ব্যপার নয় তা বিলক্ষন বোঝা গেল। আমি তখন উভয় সংকটে। কি যে করি? 

ভদ্রমহিলাকে টেনে তুলতে চাইলে তো তিন চারজন মজুর অন্ততপক্ষে ডেকে আনতে হবে। একলা আমার 
দ্বারা সে তো হ’বার নয়। বরং দেখি বিশ্বেশ্বর বাবুকেই যদি টেনে হিঁচড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা অবস্থায় ও 
বার করে আনতে পারি. . ...
   
তা অনেক কষ্টে আমি টেনে হিঁচড়ে উদ্ধার করলুম তাঁকে। 

ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে বললেন—‘আগে ওই পাপগুলোকে বিদেয় করো । আমাকে তুলতে হবে না।  আমি 
নিজেই উঠবো তবে চেয়ার টেবিলগুলো কিন্তু তুলতে হবে . . .ওরে বাবা রে, আমার কোমর গেছে রে. . ..
প্যাকেটটা কাল রাতে ফ্রিজে তুলে রাথতে বলেছিলাম, তা আমার কথা কেউ শুনলে তো। 
এখন আমার কি হবে রে?’

কোনমতে উঠে একটু চোখে মুখে জল দিয়ে ও জল টল খেয়ে একটু সামলে নিয়ে দ্রুত তাঁরা 
বিদেয় হতেই ঘড়ির দিকে চেয়ে আমি একেবারে আঁৎকে উঠলুম। 

ওরে বাবা. . ..রান্না খাওয়া সব দেখি ডকে উঠলো আজ আমাদের। এখন আজ সি০এল০ না 
নিলেই নয়। কাল যদি ওঁরা আবার আসেন, আর তাই তো আসবেন বলেই গেলেন, তবে দু’টো 
সি০এল০ হবেই নষ্ট। 

গৌরব দু’টোর কথাই অবশ্য বলেছিলো কাল। কিন্তু এখন আমি অফিসে ছুটির দরখাস্তটা পাঠাবো 
কি করে? দরখাস্ত লিখে মানে টাইপ করিয়ে সেটাকে ফ্যাক্স করতে হবে মনে হয়. . .কি জ্বালা?. . .
দাও দশ দশ বিশ টাকা আরো গচ্চা. . .. . .’
  
তাই দিতে হ’লো। কি করবো? 

সব সেরে এসে বসতে গৌরব কাছে এসে বললো-‘জানো বাপী, ওনারা হয়তো আজ বিকেলে 
ও চলে আসতে পারেন’।

‘সে কী? বললেন যে কাল আসবেন । তা আবার বিকেলেই কেন?’

‘বাপী, ওনাদের মনে একটুখানি সন্দেহ হয়েছে বলে.’

‘কী সন্দেহ, গৌরব?’

‘বাপী, আমাদের বাড়ী থেকে ফিরে যেতে যেতে খানিকদূরে চলে যাবার পরে পথে আংকল 
বলছিলেন যে –‘আমাদের বাড়িটা কি একটা ডাস্টবিন? অ্যাঁ. . .. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরে 
একটা পোকা মাকড় ও নেই আর অতো আরশোলা এসে একসাথে ঢুকলো কি করে মিষ্টির বন্ধ 
প্যাকেটের মধ্যে? .....আমি না হয় আজ বিকেলেই একবার যাবো আবার. . .আর মেয়েটাকেও 
সঙ্গে করে নিয়ে যাবো. . ...সাক্ষাৎ পরিচয়টা হয়ে যাবে ওদের আজই. . ..।’

আন্টি শুনে রাগ করে বললেন যে –‘তোমার যা খুশী হয়, করোগে। আমি কিছু ভালো বুঝছি 
না, আর ও’সব  জানি ও না বাপু। কি করে যে কি হ’লো. . ..অলুক্ষুণে মা টা মরলো 
আর হতভাগা ছেলেটাকে বাপের ঘাড়ে বসিয়ে রেখে গেলো যে কি জন্যে তা ও বুঝি না। 
দু’টোই একসাথে যমের বাড়ী গেলেই তো ঝামেলা চুকে যেতো’। 

‘অতো ভালো চাকরী করা ছেলেটার একটা ভবিষ্যত তৈরী হ’তো আর আমাদের মেয়েটার ও 
একটা গতি হ’তো।  যত্তো সব. . .হুঁ. . .অমন বদমায়েস মা ছেলের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয়. . ..’  

গৌরবের মুখে এই সব গোপন বার্তালাপের কমেন্টারী মানে ধারা বিবরণ শুনে আমি চুপ। 

শেষে বললুম-‘তবে তো আমাদের পালাতে হয় গৌরব, তার আগেই। নইলেই সেই কঁহি পর 
নজর আর কঁহি পর নিশানা. . ..এসে ঠিক ঘাড়ে পড়বে. . .ওরে বাবারে. . ...তা যাই কোথায় বলো তো?’

‘চুণারে যাবে বাপী? বেড়ানো ও হবে, আর ফোর্ট দেখা ও হবে। তবে . . .. . .. . .. . ...’

‘তবে আবার কি গৌরব?’

‘না. . .মানে . . .আমাদের সন্ধ্যের আগে আগেই ফিরতে হ’বে বাপী। তা ফিরতে না পারলে 
কিন্তু মুশ্কিল হ’তে পারে, বাপী। তখন হয়তো আবার এক উল্টো ঊৎপত্তি হবে. . .. জায়গাটা 
তো ঠিক সুবিধের নয় ....তুমিই তো ধলেছিলে আর বছরে. . ...অবশ্য পাঁচটায় সরকারী আইন 
অনুসারে তো  ফোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা  কেননা একটা মিউজিয়াম তো থাকতেই পারে তাই। 
তা তোমার এই হতভাগা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে  ....তুমি যাবে তো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, বাপী. . ..’

বেজায় রাগ করে আমি বললুম--‘চুপ করো একদম. . ...ওই সব বাজে কথা বললে মারবো 
গালে এক থাপ্পড়. . .. . .. . ..যতো সব আদিখ্যেতার কথা ওই দুষ্টু, পাজী, বজ্জাত লোকদের, 
শুনলে গা জ্বলে যায় আমার। আমার নিজের ছেলেটা কেউ নয়। যে আমার সব কিছুরই আইনগত 
উত্তরাধিকারী, সে হ’লো হতভাগা. . ..সে কি না যমের বাড়ী গেলেই পারতো. . ...  আর 
ওনাদের হস্তিনী মেয়ে এসে আমাকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করতো, আর আমি খালি তখন চিঁ . . .চিঁ . . .
করে ইঁদুরের মতন জোরে জোরে চ্যাঁচাতুম যেমন মেয়ের বাপ নিজেই চ্যাঁচাচ্ছিলেন তখন ....হুঁ. . ...
আমাকে হস্তিনী চাপা দিয়ে মারবার মতলব খালি। বার করছি ওঁদের বজ্জাতি. . .. . .. . .. . .. . ...’

আমার কথা শুনে রাগ না করে গৌরব হিঃ. . ..হিঃ. . ..হিঃ. . ...করে হেসে ঘর থেকে ছুটে 
পালালো। হাসলে ছেলেটাকে আরো সুন্দর দেখায় .....অবিকল ওর মায়ের মতন দেখায় তখন. . .. . .

আমি ও গিয়ে তখন কিচেনে ঢুকে পড়ে, কষ্ট করে যা পারি খাবার তৈরী করতে লেগে গেলুম। 
কি আর করা? পেটে কিছু দিতে হবে তো । 

ভাবলুম--বেশ, আজ না হয় আমি চুণারেই চলে যাবো. . ...যা থাকে কপালে. . ...তবে এই সব 
কথা গৌরব জানলো যে কি করে তা জিগ্যেস করাই হ’লো না আমার। 
তবে ছেলেটা এখন ও মিথ্যে বলতেই শেখে নি । এই  যা রক্ষে. . .

ঘরে বসে থেকে ছুটিটা মিছে নষ্ট না করে সে’দিন খেয়ে উঠে তৈরী হয়ে বাসে করে চুণারে পৌঁছে 
রিক্সা নিয়ে যখন আমরা ফোর্টে হাজির হ’লুম তখন চারটে ও বেজে গেছে। বাসেই তিন ঘন্টা লেগে 
গেলো যে। তা কি করা যাবে? টিকিট নিয়ে এক ঘন্টায় যা পারি ঘুরে দেখলুম। 

নভেম্বর মাস বলে তখনই বেশ অন্ধকার হয়ে আসছে। 

ফেরার পথে জানা গেল যে কাছেই গঙ্গার ওপারে বালুয়া ঘাটে পিপের পোল তৈরী হয়ে গেছে। আমরা 
ওপারে গিয়ে যদি বাসে উঠি তো বেনারসের জন্য পনেরো মাইল পথ কম হবে। ভাবলুম তবে তাই 
যাই না কেন? পোল অবশ্য হেঁটে পার হ’তে হবে। 

তা দেখি গঙ্গার পোল আর ঘাটের পথ ভালো নয়, একদম  কাঁচা, বিষম উঁচু নীচু আর পোল ও বেশ 
নড়বড়ে। কোন যান বাহন চলবার অনুমতি দেওয়া হয় নি তখন ও।

ছোট্ট ছেলে গৌরব অতো পথ হাঁটতে পারবে না বুঝে নিয়ে ছিলাম। সে’দিন তার পরনের পোষাক ও 
ছিল হাঁটবার পক্ষে অনুপযুক্ত। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর ছোট্ট ধুতি পরা ছেলেটাকে তাই তখন  কোলে 
তুলে নিয়ে বীর বিক্রমে পথে নামলুম আমি। বাপ ছেলের একই পোষাক ছিলো সে’দিন। 
হাঁটবার জন্য নয়, বেড়াবার পোষাক। 

তা গঙ্গা পার হয়ে ঢালু পাড়ের বালি ভেঙে উঠে বাস দাঁড়াবার জায়গায় গিয়ে দেখি ও হরি. . ..কোথায় বাস? 
বাস স্ট্যান্ডই তো নেই। জনমানবহীন খোলা জায়গা।  একটা ও বাস নেই সে’খানে। 

আবছামতন অন্ধকারে একটা পুরণো দিনের একঘোড়ার এক্কাগাড়ী মাত্র দাঁড়িয়ে আছে। পথে কোথাও আলোর 
বালাই নেই। লোকজন ও নেই কেউ। বেশ গা ছমছম করা পরিবেশ। অবশ্য গৌরব বেশ সাহসী ছেলে 
এই যা রক্ষা কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে অগত্যা সেই এক্কাওয়ালাকেই বলতে হ’লো। 

এক্কা চালক সঙ্গে সঙ্গে বললো—‘বুঝেছি, বুঝেছি. . ...আর আপনাকে বলতে হবে না কিছু, বাবু। আপনারা 
কোথায় যাবেন সে আমি বুঝে গেছি। আরো অনেককেই আজ পৌঁছে দিয়েছি তো। সে যে এক বিরাট কান্ড 
হচ্ছে। ভাড়া ও লাগবে না আপনাদের, বাবু। বুক করাই আছে । আসুন, উঠে পড়ুন. . .. 

আমরা কোনমতে লাফিয়ে উঠলুম সেই বিরাট উঁচু এক্কায় আর গাড়ী বেশ জোরে চলতে শুরু করলো। 
আমি মনে মনে হিসেব করলুম যে রকম ছুটছে ঘোড়া তাই করে ঘন্টায় যদি এই গাড়ী চৌদ্দো পনেরো 
মাইল ও ছোটে তবে ৩৫ মাইল পথ পার হ’তে, নাঃ আড়াই ঘন্টাতো লাগবেই। তিন ঘন্টা ও হতে পারে। 
তাই এখন নিশ্চিন্ত. . ...

কিন্তু এক দেড় ঘন্টা ও কাটলো কি না হঠাৎ শুনি দূরে কোথাও খুব বাজনা বাজছে। বিয়ে বাড়ী 
আছে কাছেই কোথাও মনে হ’লো । থাকতেই পারে, হিন্দুস্থানী মানে হিন্দী ও ভোজপুরী ভাষা 
ভাষিদের জোর লগন চলছে যে।  ক্রমেই বাজনা জোর হচ্ছে। হঠাৎ মোড় ঘুরতেই দেখি সামনেই 
এক আলো ঝলমলে খুব সাজানো বিয়ে বাড়ী। মাইকে হিন্দী গান ও বাজছে।

সেই বাড়ির কাছে এসেই হঠাৎ করে আমাদের এক্কা থেমে গেলো আর চালক বললো—‘এসে গেছি। 
নামুন। নামুন। তড়াক করে লাফিয়ে নেমে পড়ুন, বাবু । আমার একদম সময় নেই কেননা আমি 
আবার ফিরে যাবো অন্য লোকদের আনতে। রাত ভোর আমাকে আজ ডিউটি করতে হবে। 
পুরো পাঁচশো’তে বুকিং।  

‘কি. . ..কিন্তু এটা কোন জায়গা? বেনারস তো নয় মনে হচ্ছে’।

‘বেনারস হ’তে যাবে কোন দুঃখে? এ হচ্ছে-শীতলাধাম. . ..বিখ্যাত জায়গা. . ...সোজা চলে যান। 
সব ব্যবস্থা আছে. . ..খুব ভালো খাওয়াবে, বাবু. . ..বড়লোকের বাড়ী. . .’ ।

এই বলেই সে গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে যে পথে এসেছিলো সেই পথেই ছুটলো। আমি তো স্রেফ হতভম্ব। 

‘ও গৌরব, এটা আবার কি কান্ড হ’লো?’

‘মনে  হয়  বিয়ে বাড়ীর ভোজন লাভের ব্যবস্থা হ’লো, বাপী। কিন্তু সব যে চুপচাপ হয়ে 
গেছে হঠাৎ। কি হ’লো? সবাই চুপচাপ. . .. . .  বিয়ে বাড়ির বাজনা ও তো আর শোনা 
যাচ্ছে না, বাপী । এগিয়ে গিয়ে দেখবে, বাপী?’

‘তাই চলো। আবার কোন দুর্ভোগ জুটলো এসে কপালে কে জানে?’

তা যাচ্ছি তো যাচ্ছিই । বিয়ে বাড়ী আর কাছে আসে না। ঠিক যেন সেই আগের মতন বিশ হাত 
দূরেই রয়েছে বাড়িটা আমরা অনেকটা পথ হেঁটে যাবার পরে এখন ও ।  এ আবার কি? 
কান্ড দেখে আমার কেমন গা ছমছম করে উঠলো হঠাৎ। 

গৌরব তখন বলল-‘আমার মনে হয় কোন কারণে এ’খানের জিও ম্যাগনেটিক পাওয়ার খুব বেশী 
হয়ে গেছে, বাপী। সাবধান, এইবার আমরা কিছু দেখে বা না দেখেই ভয় পেতে পারি হয়তো। 
আরে দেখ. . . দেখ বাপী. . ..ওরা কারা যেন আসছে এই পথ দিয়েই আর কিছু একটা কাঁধে তুলে 
বয়ে নিয়ে আসছে. . ..ওরা সব কারা, বাপী?.’

গৌরবের জিও ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা ভূ চুম্বকীয় শক্তির কথা তখন জানবার বা বোঝবার কথাই না। 
ভূত শব্দের উৎপত্তির মূলে ও এই শক্তি যা তীব্র হয়ে উঠলে আমাদের মস্তিষ্কে ভয়ের অনুভূতি জাগে। 
আমার তখন ভয় করছে বেশ কিন্তু নিঃশব্দে এগিয়ে আসা লোকগুলো  তখন  সামনে এসে পড়েছে। 
আর তারা দেখি বয়ে এনেছে নতুন বাঁশ কেটে তৈরী করা একটা মড়া বইবার চালি। তবে মড়া নেই ....সেটা একদম খালি।

তখনি হঠাৎ কে যেন অদ্ভূত ঘষামতন অনুনাসিক স্বরে বলে ঊঠলো--‘আরে, পথ দুর্ঘটনায় চোট 
খাওয়া মড়াটা আই০ সি০ ইয়ুতে চিকিৎসার পরে আজ জ্যান্ত হয়ে উঠে বসে আমাদের পথে বসিয়েছে .....
শালার ডাক্তারগুলোর হাতে কুড়ি কুষ্টি হোক. . .. . ..আর তাই তো আমাদের এই বিয়ে বাড়ির বরই 
আসেনি। সব আয়োজন পন্ড। কিন্তু দেখ একটা উপায় ও হয়েছে মনে হয়’।  

‘কি? কি হয়েছে?’

‘ঐ দেখ না, একটা জ্যান্ত মানুষকেই মনে হয় কাদের খাঁ এনে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে. . ..চল চল .....
এখন  এইটাকেই চালিতে বেঁধে নিয়ে যাই বিয়ে বাড়িতে, নইলে  বিয়েই তো বন্ধ হতে বসেছে. . ...
ধর ব্যাটা মানুষকে ....শালা, কি আর করে নেবে আমাদের?’

‘তারপরে পুরোহিত এই ব্যাটা মানুষকে আমরা ধরে এনেছি  দেখে বেশী গাঁই গুঁই করলে তখন না হয় 
দেখা যাবে। তখন এইটাকে কিলিয়ে ভূত বানিয়ে ফেললেই হ’লো। তখন তো  আর আমাদের সমাজের 
নিয়মে আটকাবে না বিয়েতে. . ..’
‘ এ. . ..এ. . ..এ. . . .খিঁক . . .খিঁক. . . খিঁ. . .ক .....খিঁই ক. . .. . .. . .. . .. . .. . .. . .’

বিকট  এক হাসির সাথে পরমুহূর্তেই দেখি যে কোন অদৃশ্য হাতের বিষম এক ধাক্কায় আমি সেই 
মড়ার চালিতে উল্টে পড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে  আছি। আমাকে বেঁধে ও ফেলেছে তারা আর সেই 
চালি তুলে নিয়ে লোকগুলো ছুটছে বেগে. . ...

‘আরে. . ..আরে. . ..কর কি? থামো. . .থামো. . ..আমার ছেলে. . ...আমার গৌরব যে একলা রইলো. . ..’

কে শোনে কার কথা? 

তারা ছুটে চলেছে সমানে। এ আবার কি গেরো জুটলো এসে আমার কপালে? এখন কী আমাকে 
পেত্নী বিয়ে করতে হবে না কী?  তবে এটাই কি বরের তাঞ্জাম যাতে আমি  চড়ে যাচ্ছি? 
ওরে বাবা. . ..মড়া বইবার চালি এদের বর আনতে লাগে? এখন গায়ে গোবর না দিলেই বাঁচি যে । 
শুনেছি ভূতের বিয়েতে গায়ে হলুদের বদলে. . ...
খানিক পরে আমার তাঞ্জাম মাটিতে নামলো আর আমাকে ধরে কে যেন টানতে লাগলো। আমি উঠে 
বসতেই সত্যি সত্যি পচা গোবর জলের ছড়া এসে আমার গায়ে পড়লো ছলাৎ ছলাৎ করে . . .।

উরে বাবারে সে কি পচা গন্ধ রে বাবা. . ..দারুণ কুটকুট ও করছে যে .....আর আমার ফর্সা 
জামাকাপড়ের যে ছাব্বিশটা বেজে গেলো .....।

দূরে জোর শেয়াল আর প্যাঁচার ডাক শুরু হয়ে গেলো তখনই। উলুধ্বনির বদলে না কি তাই বা কে জানে. . .. . .?

একটু পরেই দেখি আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছি যেখানে সেটাকে কলাতলা না বলে শ্যাওড়াতলা বলাই ঠিক। 
আশ শ্যাওড়া না কি যেন গাছের ডাল এনে চারপাশে পচা গোবরের তালে পুঁতে এই  অদ্ভূত 
ছাদনাতলা তৈরী হয়েছে   তার কি বিকট গন্ধ রে বাবা. . .টেঁকা দায়. . ...মাথার ওপরে 
আচ্ছাদন মনে হয় খুব সুক্ষ্ম ধরণের. . .ওরে বাবা এ কী? এ মাকড়সার জাল না কী রে বাবা?
আর ও’দিক থেকে কারা যেন যে দুটো মালা বয়ে আনছে ওই বা কিসের মালা? সাদা সাদা 
ও’গুলো কি ফুল? বেশ বড়ো বড়ো ফুল তো. . .. 

মালা জোড়া আরো কাছে আনতেই আমি আঁৎকে উঠলুম. . .সর্বনাশ . . .এ’ তো দেখি ফুল নয়.
 . . খুলি. . . মড়ার মাথার খুলি. . .তবে মনে হয় ছ’মাস কি এক বছরের ছোট বাচ্ছাদের 
 মাথার খুলি এনে গেঁথে তৈরী করা হয়েছে এই মালা। মালা বদলের সময় লাগবে হয়তো. . ... 

অদূরে কারা যেন দেখি একটা চিতা সাজাচ্ছে না? হ্যাঁ. . ..ওই তো একটা মড়া ও এনে তুলছে ....
এই চিতাকেই তবে প্রদক্ষিণ করতে হবে আমাকে?  যে বিয়ের যে মন্ত্র . . .মানে ....ধরণ  
আর কি. . ..সবাই খুব ব্যস্ত . . .বিয়ের যোগাড়যন্ত্র ও ব্যবস্থা করতে. . ..

এ’দিকে আমার সামনে দেখি একটা ফাঁসির মঞ্চ মতন ও তৈরী করেছে। দুটো. . .সামনা সামনি. . ..
দুটো ফাঁস ও ঝোলানো হয়েছে . . .তবে এইতে ঝুলিয়েই কনের বর প্রদক্ষিণ হবে না কি? 
না বরের কনে প্রদক্ষিণ হবে? না কি দুটোই হবে পরের পর? বর বড় না কনে বড় সেই 
পরীক্ষার জন্য নয় তো এই মঞ্চ? তবেই তো আমি গেছি রে বাবা  পেত্নী তো গলায় ফাঁসি 
পরে সড় সড় করে উঁচুতে উঠে যাবে।  আমাকে যদি তাই করতে হয়. . ..তখন উপায়?
 
কনেকে আনা হোক। কনে কোথায়? 

কে যেন এই কথা বলতেই আমার হাতে একজন চট করে সেই জয়মালা না বরমালা বলে 
বিকট মুন্ডমালাটা ধরিয়ে দিলো এনে ....ওরে বাবা সে কী ভারী মালা রে বাবা. . . প্রায় 
তিন  চার হাত লম্বা .....আমি তো তুলতেই কাহিল ....কনের গলায় পরাতে হ’লেই হয়েছে। 

অন্য দু’জন তখন ফাঁসির দড়ি টেনে দেখে নিয়ে রেডী হয়েছে. . ..প্রথমে মুন্ডমালা বদল. . ..
তারপর প্রদক্ষিণ. . .তারপরে বর কনে উঁচু হবে কে বড় দেখাতে. . .বলা বাহুল্য গলায় 
দড়ির ফাঁস পরিয়ে টেনে তোলা হবে আমাকে তখন. . ..

হঠাৎ হৈ হৈ. . ...কনে আসছে. . ..কনে আসছে. . .

অদূরে দেখা গেলো কারা যেন কি বয়ে আনছে. . .কনেকে পিঁড়েতে তুলে নিয়ে আসছে না কী? 
ওরে বাবা. . ..পিঁড়ে তো নয়. . ..এ কী জিনিষ? 

এ তো জ্বলন্ত চিতার কাঠের আসন. . ..সেই কাঠগুলোর আগা  জ্বলছে দাউ দাউ করে. . .. 
চটপট করে শব্দ হয়ে হু হু করে ধোঁওয়া উঠছে আর তার ওপরে বসে আছে এক বিকট দর্শন 
কালো পেত্নী ....মূলোর মতন মস্ত দাঁত বার করে ....চারজনে সেই কাঠের আসন সুদ্ধু তাকে বয়ে আনছে. . ..

বুঝলুম এই জ্বলন্ত কাঠ দিয়েই তবে চিতাটা  জ্বালানো হবে. . .পরে. . ..

শুরু হ’লো হাড়ের খটাখট বাজনা. . .বিয়ের বাদ্যি. . ..

কনের হাতে ও মুন্ডমালা তুলে দেওয়া হ’লো. . ..

‘পরাও মালা. . ..’ কে যেন বললো।

দু’টো শুকনো সরু কালো হাত লম্বা হয়ে আমার গলার দিকে এগিয়ে এলো মুন্ডমালা সমেত. . ..আর 
তখন সত্যি বলছি, আমি বেজায় ভয় পেয়ে  চোখ  দু’টোই বদ্ধ করে ফেললুম মুহুর্তের জন্য. . .

তখনি হঠাৎ শুনি শপাৎ করে একটা শব্দ হ’লো আর হাঁউ মাঁউ খাঁউ বলে সে এক বিকট চিৎকার 
শুরু হয়ে গেলো।. . .

চোখ খুলে দেখি শূণ্যে মালা সমেত দু’টো কাটা হাত ঝুলছে আর  কনে হাউ মাউ করে চিৎকার করছে। 
তার দু’টো হাতই নেই। 

আবার শপাৎ. . ..সঙ্গে সঙ্গে আবার বিকট আওয়াজ. . ..কনের ধড় আর মুন্ডু আলাদা হয়ে ঝুলছে. . .
দেখে আমি চমৎকৃত. . .এ সব  আবার কি কান্ড শুরু হ’লো রে বাবা?

হৈ হৈ করে কয়েকজন একদিকে তেড়ে যেতেই শপাৎ শপাৎ করে শব্দের ঝড়  শুরু হয়ে জায়গাটা 
নরক গুলজার করে তুললো কেননা তার সাথে বিকট আর্তনাদের সরগম চালু হয়ে গেলো  তখনই. . ..

‘এই,. . .. . .. . ... তুই কে? তুই  কি চাস? আর ওই গাছের ডাল পেলি কোথায়? 
এই তল্লাটেই তো নেই ওই সর্বনেশে গাছ. . ..’ 

‘আমাকে বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ছো, আবার কথা বলছো? এখুনি বন্ধ করো এইসব কান্ড 
নইলেই ....শপাৎ. . .. . .. . .. . .. . .. . .. . .. . .’

‘আঁই রে বাপ আমার. . ...করছি. . .করছি. . .রে বন্ধ । সে এখন তুই যা বলবি তাই 
করবো। আর মারিসনে. . .ও রে বাবা . . .হাড় মাস. . .হাত পা সব যে আমাদের 
আলাদা হয়ে গেলো  রে বাবা. . ..জোড়া লাগাতে কতো যে আকন্দপাতার রস খেয়ে 
মরতে হবে তার ঠিক নেই. . ..এ তো ছেলে নয় বিচ্ছু একটা. . .’

‘আমরা বাড়ী যাবো কি করে? তাই বলো, শুনি?’ 

দেখি যে একটা ছোট ছেলে একটা বড়  বড় সবুজ পাতাওয়ালা গাছের ডাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে 
সেটাকে বেগে ঘোরাচ্ছিল। সেই জানতে চাইলো।  

‘আমরা মাথায় করে পৌঁছে. . .’

‘ইঃ. . ..আব্দার আর কি?  তোমাদের সব্বার মাথা ভর্তি ইয়া বড় বড় উকুন আছে। 
সে আমি জানি না বুঝি? আমাকে ভারী একটা বোকা ছেলে পেয়েছো না? নাঃ, গাড়ী করে 
যাবো আমরা. . .’ ‘আচ্ছা, আচ্ছা ....তাই যাবে বাপ আমার. . ..কাদেরকেই ডাকছি. . .
যেখানে বলবে পৌঁছে দিয়ে আসবে. . ..’

‘তখনই  তাই দিলেই পারতো. . ..তা না করে এইখানে এনে তুলতে কে বলেছিলো তাকে শুনি? 
বড় বেশী সাহস না? একটা মানুষকে একলা পেয়ে তাকে তোমরা ভেবেছিলে কিলিয়ে. . ..’

‘না. . .. না ....ভাবি নি ....ভাবি নি. . ..কখনো ভাববো ও না. . ..আর কিছু চাই?’’

‘হ্যাঁ, চাইই তো. . .’
‘
হুকুম করা হোক’

‘আমাদের পাড়ার বিশ্বেশ্বর আংকল আমার বাপীকে রোজ বড় ত্যক্ত করে মারছে তার ট্যারা, 
কালো, খেঁদি, হাতী মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে বলে।  তার জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে নইলে. . .. . ...’

‘সেও হয়ে যাবে. . ..কালই হয়ে যাবে . . .আমাদের অনেকেই তো এখন মানুষ সেজে 
আই এ এস ....পি সি এস. . .. অফিসার হয়ে বসে আছে আর ভূতের শাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছে. . .   
একজনকে পাঠিয়ে দিলেই হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে বর্তে যাবে তারা’।

‘ঠিক আছে. . ..তা গাড়ী কই?’

‘এই যে। এসে গেছে। উঠে পড়া হোক’।

পরক্ষনেই দেখি আমি সেই এক্কাগাড়িতে বসে আছি। পাশে ছেলে গৌরব। তবে তখন  তার হাত 
সেই অদ্ভূত আকৃতির অচেনা গাছের ডালটা ও  রয়েছে। চালক বার বার মুখ ফিরিয়ে সেই ডালটার দিকে  দেখছে।

একবার সে বেশ রাগত সুরে জিজ্ঞাসা করল—‘তোমরা কোথায় নামবে, বেনারসে?’

লালমতন আরো রাগী মুখ করে গৌরব বলল—‘ফের বজ্জাতি হচ্ছে এখন ও। তুমি জানো না 
কোথায় থাকি আমরা?’ তোমাকে তখন বলে দেওয়া হয়নি না ভূলে গিয়েছো? তা  বেশ, 
তবে মনে পড়িয়ে  দিই আমি. . .. . .’।
শপাৎ. . ..

বিকট আর্তনাদের সাথে চালক বলে উঠলো--‘জানি ....জানি. . ..বাপ আমার . . .আমার 
একটা হাত খসে গেলো. . .যে. . ..আর মেরো না ’।

গৌরব আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বললো—‘ভাগ্যিস তখন সময় মতন মা এসে এই ডালটা 
আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো তাই রক্ষে, নইলেই আজ হয়েছিলো আমাদের দফা সারা ....রাত 
হয়ে যাবার পরে এই ভয়জনক মির্জাপুর জেলায় চুণারে  বা আশে পাশে বেড়াবার মজা টের  পাইয়ে ছাড়তো এরা।

ছোট্ট ছেলে গৌরবের কথা শুনে আমি বললুম-‘তা তোমার মা  কি করে দিলো তোমাকে 
এই ডালটা এনে, গৌরব? নিজে এসে দিয়েছিলো?’

‘না তো, বাপী’।

‘তবে?’

‘তোমাকে যখন ওরা জোর করে নিয়ে চলে গেলো না বাপী, আমার তখন খুব খুব করে 
কান্না পাচ্ছিল। মনে হয় ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই ওদের পিছনে আমি দৌড় দৌড়ে যাচ্ছিলুম। 
কি আর করবো আমি তখন একলা? হঠাৎ খুব জোর একটা হাওয়া উঠলো। ঠিক যেন 
ঝড়ের মতন। আশে পাশের সব গাছের ডাল পালা গুলো খুব নড়ছিল আর মড় মড় করে শব্দ করছিল’।

‘তারপরে, গৌরব?’

‘হঠা দেখি মড়াৎ করে একটা শব্দ হয়ে এই ডালটা ঠিক আমার সামনে না জানি কোথা 
থেকে ছিটকে এসে পড়লো। আর আমার তখুনি কেমন যেন মনে হ’লো নিই ডালটাকে 
আমার হাতে তুলে। আমি আর কিছু করতে যদি না ও পারি, ওই লোকগুলোর কেউ 
সামনে পড়লে এই দিয়ে তাকে একটা জোর বাড়ি তো অন্তত মারতেই পারবো। খালি হাতে 
থেকে তো তাও মারতে পারবো না আমি, তাই না বাপী?’

‘হুঁ. . .’, তারপরে গৌরব?’

‘তার কতক্ষণ পরে আমি দৌড়ে গিয়ে ওই বাড়িটায় ঢুকলুম, তা জানি না বাপী। অন্ধকারে 
ঘড়ি দেখতেই তো পাই নি আমি। তবে গেটে তিন চারজন কালো কালো লোক দাঁড়িয়ে কথা 
বলছিলো। আমাকে দেখা মাত্র তারা হাঁই মাঁই করে চেঁচিয়ে উঠে,  দুদ্দাড়িয়ে দু’হাত তুলে 
ঘুঁষি বাগিয়ে তেড়ে এলো। তখন আমি কি করি? কিছুই ঠিক করতে না পেরে  কি মনে 
হতে সামনের লোকটার গায়ে জোরে এক বাড়ি মারলুম. . .হাতের ডালটা দিয়ে. . ..ধাঁই করে। 
আবার. . ..আবার. . ..’।

তারা বিশ্রী চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। তবে কারো হাতের আঙুল কারো বা কান 
ছিটকে পড়ে সেখানে মাটিতে গড়া গড়ি খেতে রইলো। আর তাই না দেখে বাপী, আমার 
ভয় করবার বদলে বেশ মজা লাগলো আর আমি দৌড়ে গিয়ে যাকে পেলুম তাকেই পিটতে 
শুরু করলুম। সে তো তুমি নিজেই সব  দেখেছো বাপী. . .. হিঃ. . .হিঃ. . ..হিঃ. . ...’।
 
‘আমাদের সেই এক্কা গাড়ির চালক হঠাৎ করে বলে উঠলো—‘এসে গেছি, বাবু। 
নেমে পড়ুন. . .আমাকে তো আবার এখনি. . ..’।

‘সে কী? এরই মধ্যে? . . .’

‘হ্যাঁ, নইলে ঘোড়ার বদলে আপনার ছেলের চাবুক তো আমার পিঠেই পড়বে, বাবু’।
আর তা হ’লেই তো আমি দু’ফাঁক. . .ওরে বাবা রে. . ..’।

আমরা কসরৎ করে লাফিয়ে নামতেই গাড়িটা বোঁ করে লাট্টুর মতন এক পাক ঘুরেই সাঁৎ 
করে যেন উড়ে বেরিয়ে গেল।

আমি গৌরবের হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা ল্যাম্পপোষ্টের নীচে দাঁড়িয় বললুম—
‘হুম। এতো জঙ্গম বাড়ী রোড দেখছি. . .’।

‘তার মানে বাড়ী তো এসেই গেছে । তাই না বাপী?’

‘হ্যাঁ. . .কিন্তু তোমার হাতে ওই আম গাছের ডালটা এলো কোথ্থেকে, গৌরব? 
এটা তো সেই ডালটা নয়. . ..’।

‘তা আমি কি জানি, বাপী? আমি তো ডালটাকে একটু ও ছাড়ি নি। মাত্র নামবার 
সময় এটাকে গাড়ির সীটের ওপর একটুক্ষণ রেখে লাফিয়ে নীচে নেমেছিলাম। তবে আমার 
হাতের এই ডালটা এমন বদলে গেলো কি করে, বাপী?

‘হুম. . ...’. . .. . ...    

শুনে তো আমি চুপ একেবারে।

জোর পায়ে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলুম আমি হন হন করে, গৌরবের নরম, মসৃণ, 
চকচকে বাঁ হাতটাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে। 

ছেলে ডানহাতে যে তার সেই অমূল্য রতন  ডালটাকে ধরে রেখে ছিলো। কিছুতেই সে সেই 
বাজে গাছের ডালটাকে ও ফেলে দিতে রাজী নয়। তার আর কি করা যেতে পারে?’

০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২৪/৫/২০১৪
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 4  Cambodia : 1  Canada : 8  China : 24  Germany : 5  Hungary : 7  Iceland : 1  India : 252  Japan : 1  
Russian Federat : 8  Saudi Arabia : 5  Sweden : 7  Ukraine : 21  United Kingdom : 3  United States : 539  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 4  Cambodia : 1  Canada : 8  
China : 24  Germany : 5  Hungary : 7  Iceland : 1  
India : 252  Japan : 1  Russian Federat : 8  Saudi Arabia : 5  
Sweden : 7  Ukraine : 21  United Kingdom : 3  United States : 539  


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
দিনের সাজা ... রাতের মজা by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৬৯০২
fingerprintLogin account_circleSignup