বাদল ও বল
==================
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ সুন্দর ভাইপো চঞ্চলের বয়স ছিল বছর পাঁচ কি ছয় প্রায়। কিন্তু আই০ কিউ০ টেস্ট নিয়ে দেখেছি যে তখনই দুধবরণ ছেলেটার টেস্ট স্কোর উঠেছিল জিনিয়াস স্তরের।
মনোবিদরা জানেন এবং বলতে ও পারবেন যে আমি যে পরীক্ষাটা নিয়েছিলাম সেটা নেহাৎ যা তা নয় কেননা সেই স্ট্যান্ড্যার্ডাইজড পরীক্ষাটার নাম ছিল আলেকজান্ডারস্ পাশ এলোঙ টেস্ট। নন ভার্বাল বুদ্ধি পরীক্ষা বলে ছোটদের জন্য উপযুক্ত। পরে অবশ্য ভার্বাল টেস্টে ও সে স্কুলে সবার ওপরে ছিল তবে শুধু বাদল ছেলেটাকে ছাড়া।
তাই চঞ্চল বলতো- ‘বাদলটা না কাকু, সুপার জিনিয়াস ছেলে একটা। আমাকে তো খালি হারিয়েই দেয় সব তা’তেই...মহা দুষ্টু ছেলে ...’।
তবে ভগবান বড় চালাক ভদ্রলোক।
যাকে যে গুণ যতটুকু পরিমাণে দয়া করে দেন তাকে তার চতুর্গুণ অহংকার দিয়ে সব মাটি করে ছাড়েন। রূপ থাকলে রূপের, বুদ্ধি থাকলে বুদ্ধির অহংকারে মাটিতে আর দেখি তার পা পড়ে না। আর সব গড়বড় হো যাতা হ্যায় তাইতেই। ফলে সেই গুণ তার জীবনে কোন কাজেই লাগে না, উল্টে সবাই তাকে অশ্রদ্ধা করে।
বলতে নেই….. তবে ভগবানের দয়ায় চঞ্চল ছেলেটার মনে একটু ও অহংকার ছিল না, তাই সে বাদলকে হিংসে ও করতো না। স্কুলে একমাত্র বন্ধুই ছিল তার বাদল। আর সেও ছিলো রূপেতে ও চঞ্চলের সমকক্ষ। গুনের.তো.কথাই.নেই।.আমার তো দেখলেই ওদের খুব করে আদর করতে ইচ্ছে করতো।
সে কথা যাক। এখন যা বলছিলাম, তাই বলি আগে।
ছেলে দু’টো তখন পড়তো ওয়ান ক্লাশে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। জায়গাটার নাম ছিল কামাখ্যা বা স্থানীয় হিন্দী ভাষায় কমচ্ছা।
তবে ওরা ডঃ এনী বেসেন্টের স্থাপিত বিখ্যাত সেন্ট্রাল হিন্দু বয়েজ স্কুলে পড়তো না। পড়তো একটা অন্য স্কুলে।
বাদল নার্সারিতে অবশ্য ওই স্কুলেতেই কিছুদিন পড়েছিলো। তবে সেটা প্রাইমারী সেক্সান। একটু দূরে বিনায়কার কাছে কোল্হুয়া বলে একটা জায়গায়। কিন্তু হিন্দু স্কুলের ঠিক সামনেই ছিল ওদের নতুন স্কুল। বেশ দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বলে বাদল অবশ্য পড়তো না আগে সে’খানে। আমি চঞ্চলকে প্রথমে ভর্তি করে দেবার পরেই বাদলকেও জোর করে এনে ওই স্কুলেতে ভর্তি করে দিয়েছিলাম নিজের খরচে। নইলে যে চঞ্চলকে একলা ছাড়তে হয় স্কুলে। সে সাহস আমার ছিলো না বেনারসের মতন জায়গায়।
সেই স্কুলের নিজস্ব কোন খেলার মাঠ ও ছিলো না, তাই সবাই খেলতো সামনের সি০এইচ০ বি০ এসের০ বিশাল খেলবার মাঠে। তখন সেই মাঠ ঘেরা ও ছিল না এখনকার মতন দেড় মানুষ সমান উঁচু কংক্রিটের মজবুত পাঁচিল দিয়ে।
ছিল যা তা সামান্য একটা হাত তিনেক উঁচু কাঁটা তারের বেড়া। সে আর কে মানে? তাই আশে পাশের পাড়ার অনেক মুসলমান ছেলেরাও এসে ক্রিকেট খেলতো সেই মাঠে। চার পাঁচটা পিচ গড়ে উঠেছিল। আর মাঠের সামনেই রাস্তার ধারে বসে গিয়েছিল দু তিনটে ব্যাট বল আর তার মেরামতির জন্য অস্থায়ী দোকান। সাইকেল মেরামতের দোকান তো ছিলই আর বেশ চলতো ও সেই সব দোকান। তখনকার বল ছিল রঙীন নরম রবারে তৈরী। খুব বিক্রী হ’তো সেই বল ।
আমি অবশ্য চঞ্চল বাদলকে কখনো ভূলে ও সেই মাঠে কোনদিন পাঠাই নি খেলতে। স্কুল ছুটি হ’লেই গিয়ে স্কুটারে বসিয়ে দু’জনকেই সোজা নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে আসতুম আমি। সে’খানেই ওদের হাত মুখ ধুইয়ে, চঞ্চলের পরে বাদলের ও নোংরা স্কুল ড্রেস সমস্ত চেঞ্জ করে তারপরে জলখাবার খাইয়ে ছাদে ব্যাডমিন্টন বা যা ইচ্ছে খেলতে পাঠিয়ে দিতুম আমি । সেই ছাদ ও গোটাটা লোহার বীম আর শক্ত জাল দিয়ে ঘেরা ছিল। দাদা যে পুলিশ অফিসার। তাই তার একমাত্র রূপবান ছেলের জন্য এই সুরক্ষা ব্যবস্থার খুব দরকার ছিল।
কিন্তু বহিরাগতদের উৎপাতের ফলে অনেক সময় সেই স্কুলের ছেলেরাই মাঠে খেলবার জায়গা ও পেতো না। কি আর করা? জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা ছিল। হিন্দীতে বলতো…. জিসকি লাঠি উসকি ভৈঁস….মালিক আবার কি?
এমন কি কোনাকুনি মাঠ পার করবার জন্য পায়ে চলা এক পথ ও তৈরী হয়ে গিয়েছিলো লোকের যাতাযাতের সুবিধার খাতিরে আর সবাই সেই পথেই চলতো ।
পথ শর্টকাট করে ।
স্কুলের ঘাস…. লন সব সাফ হ’য়ে বারোটা বাজতো আর স্কুল বোর্ড হ’তো নাজেহাল।
শেষে তিন চার ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নিয়ে ও আর আটকাতে পারে না তারা।
রাতারাতি পাঁচিল ভেঙে রাস্তা তৈরী হ’য়ে যায়। গোটা জায়গাটাই তো অনেক আগে ছিল ডঃ এনী বেসেন্টের যা তিনি দান করে দেন কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়কে। তার অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিকিউরিটি গার্ডের চৌকি বসিয়ে কংক্রিট পাঁচিলের ব্যবস্থা করা হয় মাঠকে সুরক্ষিত করতে।
তা সে সব তো অনেক পরের কথা।
যে সময়ের কথা বলছি তখন মাঠ ছিল পাবলিকের দখলে। রাস্তা থেকেই তাদের খেলার হুল্লোড় দেখা ও শোনা যেতো। সে কি হৈ চৈ। বাপ রে।
সেদিন আমি ছেলেদের নিয়ে ফিরছি, মাঠে ও খুব হৈ হল্লা চলছে। হঠাৎ চঞ্চল ও খেলা দেখতে দেখতে হাত তুলে বলে উঠলো----‘নো বঅঅঅঅল…’
একটু পরেই মাঠে ও সেই ধ্বনি উঠলো। আমি তো অবাক। আজকালকার ছেলে মেয়েরা কতো ভালো রকম বোঝে খেলা, নিজেরা না খেললেও। আমি তো ছাই কিছুই বুঝি না….।
বললুম—‘সত্যি সত্যি কি নো বল হয়েছে?’
বাদল নিজের সুন্দর ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো—‘আমার তো তা মনে হয় না, কাকু। আপীল খারিজ হ’লো বলে। ওটা হবে … ‘নো দি বল…’
হিঃ….হিঃ….হিঃ…… ।
উঃ….ওইটুকু ছেলের কথার কি মারপ্যাঁচ? এক্কেবারে উল্টে দিলো সব কিছু বাদল। আর কি কান্ড দেখো না ….তখনি রেফারির বাঁশী ও বেজে উঠলো। দু’হাত মাটির সমান্তরালে নাড়ছে সে অর্থাৎ….আপীল খারিজ….ওরে বাবা। বোঝ ঠ্যালা, কি ছেলে বাদল?
চঞ্চল দেখে শুনে এক্কেবারে চুপ।
বাড়িতে এসে যথা রীতি আগে আমি চঞ্চলকে সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলুম।
ছেলের হাত মুখ ধুইয়ে স্কুল ড্রেস খুলে নিয়ে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে দিয়ে অন্য কাচা পোষাক পরিয়ে চুল টুল আঁচড়ে হাল্কা প্রসাধন করে দিয়ে ঘরে এনে বাদলকে নিয়ে যাবো, তা দেখি ছেলে বাঁ হাতের তর্জনী চেপে ধরে চুপটি করে বসে আছে। মুখে কথাটি নেই।
‘এসো বাদল…’
‘আজ থাক না কাকু। জল লাগলেই তো আরো বেশী জ্বালা করবে …’
‘তার মানে? কোথায় জ্বালা করবে? কেনই বা করবে…?’
চঞ্চল বললো--‘বুঝলে না, কাকু? বাদল আঙুল কেটে বসে আছে হয়তো। তাই বলছে…’
‘সে কী? দেখি তো….হঠাৎ কি করে….?’
চঞ্চল হাত উল্টে বললো-‘ওই খেলার সরঞ্জামের পুরণো আলমারিটার কাঁচ একটু ভাঙা আছে না, কাকু। আজ বাদল অসাবধানে হয়তো খুলতে গিয়েছিলো এসেই’
‘তাই, বাদল?’
বাদল মাথা নাড়লো।
‘কাকু…. তুমি ডেটল দেবে না তো লাগিয়ে?’
‘নাঃ…ব্যান্ড এড লাগাবো। আর উপায় কি? এখন তুমি এসো’…।
‘হুঁ….সময়টা মোটেই ভালো যাচ্ছে না দেখছি। কাল তোমার ক্ষিধে ছিলো না একটু ও আর আজ আবার……নাঃ…চলো, আজই ওই কাচটাকে বদলাবো আর কোন ভালো জ্যোতিষীর পরামর্শ নিতে ও এখনি যাবো’।
‘থাক না। কি দরকার অতো সবের, কাকু? এ সব তো হয়ই। অনর্থক পয়সা নষ্ট…….’
‘আছে বইকি দরকার। অগ্রাহ্য করা তো ঠিক নয়…;
বাদলের আঙুলে ব্যান্ড এড লাগিয়ে দিয়ে, সাবধানে ছেলের হাত পা মুখ ধুইয়ে ঘরের ড্রেস পরিয়ে তৈরী করে এনে জলখাবার খাইয়ে দিলুম দু’জনকেই আর তারপরেই কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে এসে চঞ্চলকে দাদার বাড়িতে এনে বৌদির কাছে রেখে বাদলকে নিয়ে এক পরিচিত জ্যোতিষের বাড়ী গেলুম।
তিনি দেখে শুনে বললেন-‘কন্যা লগ্নের ছেলে তো আপনার, বুধ প্রবল আছে জাতকের কিন্তু হ’লে কি হবে? বিরুদ্ধ রাহুর প্রভাবে…. হুঁ, সময়টা একটু গন্ডগোলেরই চলছে। দেখুন, আপনি না হয় ছেলেকে একটা পান্না মানে সবুজ পাথর পাঁচ রতির ধারণ করিয়ে রাখুন। নাঃ, আংটিতে নয়, লকেট করাবেন। বাচ্ছা ছেলে তো। হারিয়ে ফেলতে পারে। কমচ্ছায় আমার একজন পরিচিত দোকানদার আছে…ছোট দোকান …তবে আসল গ্রহরত্ন রাখে। আমি ফোন করে দিচ্ছি, চলে যান। কিছু রিবেট ও দিয়ে দেবে…আমি না হয় শোধন করে দেবো। সামনের বুধবারে পরিয়ে দেবেন আপনার অতি সুন্দর এই ছেলেকে..’
আমরা তখন তাই গেলুম।
আমার ঘড়িতে তখন সোয়া চারটে বাজে। তাই গ্রহরত্নের সেই দোকানে বেশী ভীড় ছিলো না। একজন মাত্র খদ্দের ছিলো। আমাদের বসিয়ে তাঁকে হীরে দেখাতে লাগলেন দোকানদার। দু’টো ঠান্ডা পানীয় আনিয়ে আমাদের দিলেন তিনি ।
বাদল চুপি চুপি আমাকে বললো—‘কাকু, কোট প্যান্ট পরা এই ভদ্রলোককে মুসলমান বলে মনে হয় না তোমার? দাড়ী নেই অবশ্য কিন্তু ওনার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখলেই বুঝবে তুমি, কাকু। তা মুসলমানেরা কি হিন্দু জ্যোতিষ দেখায়? না গ্রহ রত্ন মানে? উঁহু….মনে তো হয় না…..’
আমি কিছু বলবার আগেই তিনি নগদ সাত চল্লিশ হাজার টাকা গুনে দিয়ে দু’টি রত্ন নিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। সেই সময় সাত চল্লিশ হাজার টাকার অনেক দাম ছিল। আজকের মতন ডিভাল্যুয়েশন হয়নি তো টাকার। তাই মনে হয় ভদ্রলোক বেশ পয়সাওয়ালা।
হাজার টাকার নোটগুলো ভালো করে দেখে নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিয়ে দোকানদার আমাকে ডাকলেন—‘এইবার আপনারা আসুন স্যার, বসুন। পান্না দেখবেন তো। জ্যোতিষাচার্য ফোনে বলে দিয়েছেন একটু আগেই আমাকে’।
‘তা আমার কাছে অবশ্য অর্ডিনারী ও স্পেশাল কোয়ালিটির দু’রকমের পাথরই আছে। তা আপনাকে স্পেশাল কোয়ালিটিরই দেখাই । কি বলেন? আপনার এতো সুন্দর স্পেশাল কোয়ালিটির এই ছেলের জন্য …হাঃ…..হাঃ….হাঃ……..’
‘দাম অবশ্য একটু বেশী পড়বে। চার হাজার টাকা রতি…মানে পাঁচ রতি পড়বে …বিশ হাজার। যদি সোনার লকেট করাতে চান…কেন না পান্না তো সোনাতেই পরে লোকে, তা হ’লে সব মিলিয়ে পঁচিশ পড়বে’।
এ০সী০ চলছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে কাউন্টারের সামনে রাখা গদী মোড়া একটা চেয়ারে বসলুম। বাদল বন্ধ কাঁচের দরজার কাছেই পর্দার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে তখন ও, তাই আমি বললুম-‘তবে তাই দেখান’।
আর বলেই বাদলকে ডাকলুম-‘ও বাদল, এসো…..’
বাদল আমার কাছে এসে নিজের টানা টানা চোখ দু’টো আর ও বড় বড় করে ধীরে ধীরে আমাকে বললো—‘ও কাকু, তাড়াতাড়ি করে তুমি আমাকে এখন পাঁচটা টাকা দাও তো।‘
‘কি করবে, বাদল?’
‘একটা ক্রিকেট বল যে কিনতেই হবে আমাকে এখুনি, কাকু …’
সে আবার কি রে বাবা? বাদল তো ছাই ক্রিকেট খেলেও না দেখি তেমন। বল কেনবার শখ জাগলো কেন হঠাৎ করে, এই ছেলের?
‘কাকু….দাও না…দেরী হয়ে যাচ্ছে…’
বোঝ ঠ্যালা। আবার দেরী ও হয়ে যাচ্ছে ছেলের। এতো তাড়াই বা কিসের রে বাপু? নাঃ…এ তো দেখছি যে বেশ রহস্যময় ছেলে হয়ে উঠছে বাদল এই বয়সেই। তা বেশী বু্দ্ধিমানদের তো পাগলই মনে করে সাধারণ লোকে। কেননা তারা কত দ্রুত কি বুঝে ও ভেবে নিয়ে কখন যে কি করে বসে, সাধারণে তো বুঝেই উঠতে পারে না।
তবে আমি বাদলের কোন কাজে কোনদিনই বাধা দিই না। কেননা দেখেছি, পরে সেইজন্যে অনেক ঠকতে হয়। বিনা বাক্যব্যয়ে তাই তখনি পকেট থেকে একটা সবুজ রঙের পাঁচটাকার নোট বার করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাদলের বদলে তখন পান্নার রূপ গুণ দেখতে বসলুম আমি ।
অনেক বেছে একটা ঝকঝকে সবুজ পাথর পছন্দ করে সেটা ওজন করতে বললুম।
ও হরি, সে আবার কয়েক সেন্ট বেশী হয় ওজনে। দোকানদার মিঃ খান্না বললেন-‘আপনি না হয় এই অন্যটা নিয়ে নিন। পুরো পাঁচ রতি আছে’।
আমি বললুম- ‘নাঃ ওটার রঙ হচ্ছে একদম ম্যাড়মেড়ে। আমার ছেলের জন্য মানানসই নয়। আপনি ওইখানাই দিন। যা দাম হয়…’
তিনি লকেটের জন্য সোনার হিসেব করতে বসলেন। শেষে বললেন-‘আপনি স্যার, আমাকে এখন দশ হাজার দিয়ে যান। অ্যাডভান্স মেমো দিচ্ছি। আপনি তো পরিচিতই হয়ে গেছেন। বাকিটা কালকে নেবো লকেট ডেলিভারী দেবার সময়ে’।
আমি তাই দিলুম। পাঁচশো টাকার কুড়ি খানা নোট হাতে নিয়ে গুনে দেখে তিনি সেই দেরাজেই ঢুকিয়ে রাখলেন আবার।
তখনই একটি কুড়ি পঁচিশ বছরের ফরসা মতন ছেলে দোকানের ভেতর দিকের একটা দরজা ঠেলে এসে ঢুকলো। দোকানদার তাকে বললেন-‘বিজয়, ক্যাশ আছে। এন্ট্রি করে ফেলো আগে। বেশীক্ষণ রাখা ঠিক নয় দেরাজে’….।
সে দেরাজ থেকে সব নোটগুলো বার করে নিয়ে টেবিলের অন্যপ্রান্তে গিয়ে একটা ঢাকা দেওয়া আলো জ্বেলে নিয়ে বসে এক এক করে সমস্ত নোটগুলো চেক করতে লাগলো খাতায় এন্ট্রি করবার আগে।
‘পাপা, এই হাজার টাকার নোটগুলো কি ইনি দিয়েছেন তোমাকে?’
‘নাঃ…মিঃ প্রসাদ দিয়ে গেলেন খানিক আগে। ক্যাশ মেমোর কাউন্টার ফয়েলে দেখে নাও। তা জিজ্ঞাসা করছো কেন?’
‘তুমি নোটগুলো ঠিক মতন দেখে নাও নি, পাপা?’
‘নিয়েছি তো’।
‘নাঃ…মনে হয় তুমি শুধু উঁচু করে তুলে ধরে ওয়াটার মার্ক আর টেস্ট লাইন দেখেছো হয়তো। আলো জ্বেলে ফ্লুরোসেন্স টেস্ট করোনি সবুজ কালির…’
‘তা ….তা বটে। কিন্তু তা’তে কি হয়েছে…?’
‘মনে হয় সব জাল নোট দিয়ে গেছে।আমি পাশেই স্টেট ব্যাংকে দৌড়ে গিয়ে ভেরিফাই করিয়ে আসছি, পাপা।…এখনো বন্ধ হয়নি…’
‘কি সর্বনাশ …আমার সাত চল্লিশ হাজার টাকার হীরে…..হে ভগবান। …’
তখনি বাদল এসে দোকানে ঢুকলো।
দোকানদার বললেন-‘বেটা, তুমি তো বাইরে গিয়েছিলে। যিনি তোমাদের আগে আমার দোকানে এসেছিলেন, তিনি কোনদিকে গিয়েছেন, তা দেখেছো কি?’
‘হ্যাঁ আংকল, তিনি তো বয়েজ স্কুলের মাঠ দিয়ে শর্টকাট করে চলে গেলেন বিনায়কার দিকে…’
‘আচ্ছা স্যার, আপনি এই অ্যাডভান্স মেমো নিয়ে যান। কাল এইসময়ে এসে লকেট নিয়ে যাবেন’।
আমি বেরুচ্ছি। দেখি বিজয় দৌড়ে আসছে। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। বেশ হাঁফাচ্ছে ও। কৌতুহল হ’তে জিজ্ঞাসা করলুম-‘কি হয়েছে, বিজয় ভাই?’
‘সব জালি নোট দিয়ে গেছে। তবে আর ও সর্বনাশা কান্ড হয়েছে, স্যার’।
‘কি হ’লো আবার?’
বিনায়কার পথে এখনি একজন খুন হয়েছেন। তাঁর পোষাক আশাক ও দেখতে না কি ওই জোচ্চোর প্রসাদের মতন, বলছে সবাই। অবশ্য তা ঠিক না ও হ’তে পারে। আমি তো দেখি নি নিজে। কাজেই…..যাই পাপাকে বলি। না হয় পাপাকে একবার গিয়ে দেখে আসতে বলবো…’
আমি আর তখন সে’খানে না দাঁড়িয়ে চট করে দোকান থেকে বেরিয়েই একটা রিক্সা ডেকে বাদলকে নিয়ে উঠে বসলুম। খুন খারাপির জায়গায় আর না থাকাই ভালো। আর কিছু না হোক শেষে বেনারসী পুলিশের পাল্লায় পড়তে কতক্ষণ।
সোজা বাড়িতে এসে তখন বাদলের কাছে জানতে চাইলুম-‘বাদল, তখন হঠাৎ করে তুমি যে কি বল কিনতে চাইলে, তার কি হ’লো?’
‘কিনেছি তো, কাকু। এই তো দেখো না…।’
এই বলে বাদল হাফ প্যন্টের পকেট থেকে একটা ছোট হলদে মতন রঙের রবারের বল বার করে আমার হাতে দিলো। সাধারণ বল। যেমন হয় আর কি। সে’টা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে শেষে বাদলের হাতেই ফিরিয়ে দিয়ে বললুম—‘কেন কিনলে হঠাৎ? কালকে ছাদে গিয়ে চঞ্চলের সাথে খেলবে বল নিয়ে তুমি, বাদল?’
‘খেলব না তো, কাকু…’
‘তবে? কি করবে?’
‘আলমারিতে তুলে রেখে দেব, কাকু। মোটে তো সাতটা বল ছিলো ওই দোকানে। একটা লাল, তিনটে সবুজ আর বাকি তিনটে হলদে।’। বলেই দারুণ মিষ্টি করে হেসে দিলো ছেলেটা ঠিক চঞ্চলের মতন আর শুনে আমি তো হতভম্ব।
বাদল বলে কি? বল আবার কেউ বাক্স আলমারিতে তুলে রাখে না কী? বাদলটা মনে হয় নেহাৎই পাগল ছেলে একটা। সে যাক গিয়ে। বাচ্ছার কান্ড তো। এখন গিয়ে চঞ্চলকে বাড়িতে নিয়ে আসি আগে।
দিনকাল ভালো নয়। বেশী রাত করা ও ঠিক নয়।
**********************************************
পরের দিন সকালে খবরের কাগজ খুলে প্রথম পাতাতেই দেখি বিনায়কাতে একজন পথচারিকে কে বা কারা ছোরা মেরে খুন করেছে বিকেল পাঁচটাতে, সেই খবর বেরিয়েছে।
দিনের বেলা প্রকাশ্য রাজপথে নরহত্যা। মৃতের সনাক্তিকরণ হয় নি এখনো।
তবে জানা গেছে যে তিনি বয়েজ স্কুলের মাঠ হেঁটে পার হয়ে যখন যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ পিছনে ফিরে প্রায় দৌড়ে চলে আসেন কমচ্ছা মেন রোডে আবার এবং একটা ব্যাট বলের অস্থায়ী দোকানের সামনে এসে আচমকা হুমড়ি খেয়ে দোকানদারের ঘাড়ে গিয়ে পড়েন একজন সাইকেল চালকের ধাক্কায়। একটু অসাবধান ছিলেন তিনি মনে হয়।
তবে সামলে উঠে তিনি সেই দোকানদারের কাছে মাফ চেয়ে নিয়ে সেই সাইকেল চালকের সাথে খানিক ঝগড়া করেন যা তা বলে…বেনারসের নিয়ম অনুয়ায়ী ... মানে রাস্তায় চোখে দেখে চলে না… অন্ধা….বদমায়েস…এইসব বলে আর কি? তারপরে আবার বয়েজ স্কুলের ফটক পেরিয়ে চলে যান তিনি। তারপরে বিনায়কার কাছে নির্জন পথে কে বা কারা তাঁকে ছোরা মারে ও তাঁর পকেটের সব টাকা পয়সা হাতঘড়ি হাত ব্যগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়, তা জানা যায়নি।
দ্বিতীয় পাতায় অন্য একটা অদ্ভূত খবর ও ছিল। কালই গভীর রাতে কে বা কারা কমচ্ছা নিবাসী এক মিঃ বীরেন্দ্র পান্ডে ও জনৈক বাবুলালকে হত্যা করেছে তাদের বাড়িতে ঢুকে। মিঃ পান্ডে এল০আই০সি০ অফিসে কাজ করতেন আর বাবুলাল ছিল খবরের কাগজের হকার। সে রোজ বিকেলে হিন্দু বয়েজ স্কুলের সামনে অস্থায়ী দোকান ও করতো বল ব্যাট ও সেই সবের মেরামতির। বলা বাহুল্য যে কোন হত্যাকারীই ধরা পড়ে নি। পুলিশ জোর তদন্ত করছে।
সে’দিন আমি আর ভয়ে চঞ্চল ও বাদল কাউকেই স্কুলে পাঠালুম না। কমচ্ছা অতি সাংঘাতিক জায়গা বলে মনে হ’তেই আমি ঠান্ডা। আমার হাত পা ও সব ঠান্ডা। দিন দুপুরে জোচ্চোর আর খুনে ঘোরে যেখানে, সেই জায়গায় স্কুল….সর্বনাশের মাথায় পা…অমন স্কুল আমার মাথায় থাকুন। নাঃ….ছেলে দু’টোকে মনে হয় সেন্ট জন্সেই ভর্তি করতে হবে দেখছি। যা সব কান্ড হচ্ছে, আজ আমাকে একলাই গিয়ে বিকেলে লকেটখানা নিয়ে আসতে হবে।
তাই করলুম কিন্তু তারপর থেকে প্রায় রোজই খবরের কাগজ খুললেই দেখি নরহত্যার খবর। একে একে ছয়… নাঃ সবশুদ্ধু সাতটি খুন হবার পরে দিল্লী সি০আই০ডি০ পুলিশের টনক নড়লো।
সে’দিন সকালেই এলো দাদার ফোন—‘কি রে সিদ্ধার্থ, তোদের বেনারসের কমচ্ছা, সিদ্ধগিরিবাগ মানে গুরুবাগ আর ভেলুপুরায় কি খুনের মহড়া দিচ্ছে কেউ না কী? কোন আক্কেলে ছেলেটাকে ওই জায়গার অখদ্যে এক বাজে স্কুলে ভর্তি করেছিস তুই, তাই শুনি?’
বললুম—‘পরীর দেশের রাজকুমার ছেলে চঞ্চলের স্কুলে যাওয়া এখন বন্ধ আছে, দাদা’।
‘আর মাষ্টার বন্ডের?’
‘এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না দাদা তবে বাদল তোমার সাথে এখনি দু’টো মাত্র কথা না কী বলতে চায়। সময় আছে? বলতে পারবে?’
‘অবশ্যই। তুই ফোন দে বাদলকে….’
‘হ্যালো…বড়কাকু….’
‘বলছি.’
‘আজ এখন সকাল আটটা বাজছে তো। সব বারেই তুমি আমাদের যেতে হ’বে বলো তো। হয় দিল্লী নয়তো অন্য কোথাও। তা তুমি আজ বেনারসে আসতে পারবে সন্ধ্যার আগে?’
‘কেন? কেন? হঠাৎ এই ভয়ানক জোর তলব কিসের জন্য, মাষ্টার বন্ড?……’
‘আজ আমাদের পালা পড়তে পারে বলে মনে হয়, তাই…’
‘তার মানে, তার অর্থ, মাষ্টার বন্ড?’
‘আমার দুটি কথা বলবার ছিল। সে বলা কিন্তু শেষ, বড়কাকু। ফোনে আর কিছু বলা যাবেই না। তাই এখন তুমি কাকুর সাথে কথা বলো দেখি…..হিঃ….হিঃ….হিঃ….’
আমি আবার ফোন হাতে নিতেই দাদা পুলিশী রাগে ফেটে পড়লো--‘অ্যাই সিদ্ধার্থ, এটা কি হ’লো?’
‘আমি তো তা ঠিক জানি না, দাদা। বাদল আমাকে কিছুটি বলে নি এখন অবধি। তবে তুমি এলেই মনে হয় ভালো। বাদল হয়তো তোমার সাথে ক্রিকেট খেলতে চায়’।
‘হুম…রাতের বেলা….ক্রিকেট খেলা? চালাকী পেয়েছে সব। দেখাচ্ছি মজা। দেব ফাটকে পুরে…’
‘না না না অমন কাজ ও করবে না ভূলে ও, দাদা। শুনলে না, বাদল কি বললো?’
‘হুম….গোল্লায় যা তোরা। রাখছি…’
‘বেশ…তাই যাবো। আমি গোল্লায় যেত খুব খুব রাজি….তবে কিন্তু তোমাকেই এক হাঁড়ি গোল্লা মানে রসগোল্লা ও নিয়ে আসতে হবে আজ, দাদা। কাঁচাগোল্লা হ’লে ও বেশ চলে যাবে, অবশ্য যদি দিল্লীতে পাওয়া যায়। কেননা আমরা বাড়ী থেকে আজ আর ভূলে ও বের হচ্ছি না। তবে দিল্লী কা লাড্ডু চলবে না, দাদা।.’
দাদা বললে—‘হুম…যত্তো সব বাজে ঠাট্টা…’
তারপরে?
তারপরে আর কি?
দাদাকে এয়ার ইন্ডিয়ার শরণ নিতেই হ’লো আর তার আগেই সি০আই০ডি০ পুলিশের দল এসে গোপনে আমাদের গোটা বাড়িটা ঘিরে বসে রইলো দিল্লী থেকে হুকুম পেয়ে। চঞ্চল বাদলের শেষ দিন বলে কথা। করে কি?
তখন শুধুই অপেক্ষা।
আমি ছেলে দু’টোকে নিয়ে সন্ধ্যার পরে চুপি চুপি বাগানে গিয়ে লুকিয়ে পড়লুম আগ্নয়াস্ত্র হাতে। বাড়ির মধ্যে থাকা কিছু নয়। নিশ্চয়ই পাঁচিল ডিঙিয়ে কেউ ঢুকবে
বাড়িতে। তাই চঞ্চলকে নিয়ে বাদল উঠে পড়ল একটা গাছে আর আমি একটা বড় ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিলুম। দারুণ মশা আর পোকার উৎপাত। কিন্ত করি কি?
দাদা বুদ্ধিমান তাই বেনারসে এসেছে কি না বা কোথায় আছে কিছুটি ফোনে জানায়নি সাবধানতার খাতিরে।
রাত বারোটার পরে ধুপ করে হ’লো এক শব্দ বাগানে। পরক্ষণেই আবার ধপাস।
বুঝলুম কোন দুই মহাপ্রভুর অনধিকার প্রবেশ ঘটলো বাগানে। তারপরে সব চুপচাপ । আমি বাগানের মাঝামাঝি গাছে বেঁধে রাখা দড়িটা টানটান করে দিয়ে উঠতেই বাজলো পুলিশের বাঁশী আর হুড়মুড়িয়ে কারা দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাড়ী থেকে আর অন্ধকারেই টেনে দৌড় দিতে গিয়ে সেই দড়িতে আটকে পপাত ধরণীতলে হ’লো।
হল্ট…..পুলিশের চিৎকার শুনেই দুড়ুম করে গুলী চালিয়ে দিলো একজন। পালটা গুলী ছুটে এলো পুলিশের রাইফেলের। আমি ও গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চালালুম এক গুলী পলায়নরত এক ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে। তখনি সে’খানে জাগলো এক বিকট আর্তনাদ।
তবু ও বেশ কয়েক রাউন্ড গোলাগুলি বিনিময় হয়ে যাবার পরে ধরা পড়লো দুই অনধিকার প্রবেশকারী আহত অবস্থায়। তাদের একজন সেই খুন হয়ে যাওয়া মিঃ প্রসাদ যদি ও সে মোটেই খুন হয়ে যায় নি, দিব্যি দেখি সে বহাল তবিয়তেই আছে আর সে মিঃ প্রসাদ ও নয় কোনকালেই। এমন কি হিন্দুই নয় সে। বাদলের অনুমান এক্কেবারে ঠিক। দ্বিতীয়জন তার কুকর্মের এক সঙ্গী বলে মনে হ’লো।...।
প্রথমজন হচ্ছে স্বনামকুখ্যাত মোহম্মদ জাফর খান। নামকরা আতংকবাদী। টেররিষ্ট। মিঃ প্রসাদ সেজে সে যাকে হত্যা করেছিল সে ছিল তার চির প্রতিদ্বন্দী নাটে গুন্ডা। সে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা এবং এসেছিল খানের পিছনে পিছনে। তাই তার মৃতদেহ সহজে শনাক্ত করা যায় নি। গ্রহরত্নের দোকানে জোচ্চুরী করে খান সহজেই মিঃ প্রসাদ নামে খ্যাত হয়ে গিয়েছিলো।
সে নাটেকে আচমকা ছুরী মেরে আর তাকে ঝটপট প্রসাদের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে নিজে নাটের পোষাকে সরে পড়ে ছিল নির্জন গলিপথে। কাশীর বিখ্যাত গলিপথ। কে ধরবে?
পরদিন বাড়িতে বসে সকালে আমাদের আলোচনা হচ্ছিল দাদার সাথে।
‘তবে আগে ভাগে সব খবরাখবর নিয়ে সাত চল্লিশ হাজারের হিরেগুলোর লোভে পড়ে মাঠ পেরিয়ে খান যখন সরে পড়ছিলো, সেই সময় তাকে তাড়া না করলে হয়তো মরতে হ’তো না নাটেকে’। আমি বললুম।
বাদল যোগ করলো—‘বড়কাকু, মনে হয় সে’দিন বিকেলে দূর থেকে নাটেকে আসতে দেখেই মহা ধুরন্ধর খান তার ফন্দি বুঝে নিয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে এসে আগে হীরের গতি করতে সচেষ্ট হয় কেননা লড়াইয়ে হার জিৎ তো থাকেই। রিস্ক নেওয়াটা কোন কাজের কথাই নয়। আগে হীরের ব্যবস্থা করে তারপরে নিশ্চিন্ত হয়ে নাটের ব্যবস্থা করতে ফিরে যায় সে’।
‘কি সেই ব্যবস্থা বলো তো, মাষ্টার বন্ড?’
‘বিশেষ কিছুই না, বড়কাকু। হীরেগুলোকে সে একটা রবারের বলের মধ্যে পুরে দিয়ে সাইকেলের পাংচার মেরামতির লোশন দিয়ে ফুটোটাকে ভালো করে বন্ধ করে সেটাকে বাবুলালের ঘাড়ে গিয়ে পড়বার সময়ে তার বলের ডালায় চালান করে দিয়েছিল অতি দ্রুত হাতে’।
‘ছেলেদের ক্রিকেট খেলা জোর কদমে চলছিল। মাঠ পার হয়ে আসবার সময় হঠাৎ কোন একটা ছিটকে আসা বল হাতানো কঠিন হয় নি তাই। আর এক সাইকেল মিস্ত্রির দোকান ও ছিল কাছেই। আমার মনে হয় পাংচার মেরামতের লোশনের টিউবটা হাতিয়ে নেওয়া হয় সেই দোকান থেকে। তবে অভিনব কায়দাটা দেখে ফেলার দোষে মিঃ পান্ডে মানে সেই নির্দোষ সাইকেল চালককে সেই রাতেই পরলোকের পথ ধরতে হয়, নাটের পরেই। কিন্তু মুশ্কিল হ’লো এই যে দোকানের সাতটা বলই হয়ে যায় সে’দিন বিক্রী সাতজনের কাছে’।
‘ফিরে এসে আবার স্কুল গেট দিয়ে বেরিয়ে মিঃ প্রসাদের ওই দোকানদারের ঘাড়ে গিয়ে পড়া আর আবার আগের পথেই ফিরে যাওয়া অব্দি সব কিছু আমি দেখে নিয়েই দৌড়েছিলুম একটা বল কিনতে। আর আমি খুঁজে নিয়েছিলুম সেই বলটাকেই যে বলটা নতুন তো মোটেই নয়, বেশ পুরণো মতন, ঘষে যাওয়া আর উল্টে বেশ একটু খুঁতো মতন দেখতে ও.। বাকি বলগুলোর কোনটাই পুরনো ছিল না’।
‘তাই সেই বলের খদ্দের সহজে মেলে নি’।
‘সেটা আমার ভাগ্যে পড়ে ছিল কিন্তু মনে তো হয় যে বাবুলালকে মরবার আগে বলে যেতে হয়েছিল যে কোন কোন সাত জন তার সাতটা বল কিনেছে। সে তাদের নাম না জানলে ও তাদের চেহারা ও শরীরের বিবরণ সব বলে দিতে বাধ্য হয়েছিল বই কি হত্যাকারিকে, অত্যাচারের ঠ্যালায়’।
‘তখন খান নিজে ও তার লোকেরা গিয়ে একে একে সবাইকে খুঁজে বার করে হত্যা করে বলেটার সন্ধানে.। বলটা তারা খুঁজে বার করে চুরি করে নিয়ে চলে যায় বটে কিন্তু ছ’টা বলই মিছে…মানে খালি বেরোয় আর তাদের সব চেষ্টাই পন্ডশ্রম হয় মাত্র। তাই শেষ বলটাই যে আসল হবে তা তারা জানতো। আর তাই মোটর গাড়ী নিয়ে প্রধান সাকরেদের সাথে গভীর রাতে দু’জনে তৈরী হয়েই এসেছিলো। ওই গাড়িতেই পালাতো তারা’।
‘কিন্তু বাদল, হীরেদের নড়াচড়া তো বুঝতেই পারিনি আমি বলের ভেতরে..’
‘কি করে পারবে, কাকু? একটু পাংচার লোশন আগে থেকে ফুটো দিয়ে বলের মধ্যে
ঢুকিয়ে তারপরে হীরে ঢুকিয়ে দিলেই তো হয়ে গেল। তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এতসব কান্ড করতে হ’লে কতোটা উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হয় আর চটপটে হতে হয় বলো না, কাকু’।
‘অতঃ কিম্?’
‘কিছুই না, কাকু। বলটাকে ছুরী দিয়ে কাটলেই এখন পরিণাম বোঝা যাবে। এই নাও সেই বল তবে কাল সকালে খান্না আংকলকে ডেকে এনে তার সামনেই বলটা আমাদের কাটা উচিৎ বলে মনে হয়। তাই না বড়কাকু?’
‘হুম…’
শেষে তাই করা হ’লো আর সাত চল্লিশ হাজার টাকার শোক ভূলে মিঃ খান্না বাদলকে উপহার দিলেন ঠিক চঞ্চলের মতনই ঝাঁ চকচকে ঝকঝকে দেখতে একটা সোনার বল তৈরী করিয়ে এনে।
সুন্দর ছেলেটা দেখি ক্রিকেট খেলে ম্যান অফ দি ম্যাচ বা সিরিজ কিছু না হয়েই পেয়ে গেলো গোল্ডেন বল। ভারী মজা তো দেখি বাদলের……….
--------------------------------.
০৯৪৫২০০৩২৯০
রচনাকাল : ২২/৮/২০১৪
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।