তেঁনাদের কথা
আনুমানিক পঠন সময় : ২০ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫০ টি দেশ ব্যাপী ৪৩১১৩ জন পড়েছেন।
তেঁনাদের কথা

=======================================================
জি০সি০ভট্টাচার্য, বারাণসী, উত্তর প্রদেশ।

=====================================================

তেঁনাদের অস্তিত্বে আজ আমরা অনেকে বিশ্বাস করি বা নাই করি, তেঁনাদের গল্প পড়তে পেলে কিন্তু কেউ একটু ও ছাড়ি না। তাই গাঁজাখুরি বলে অনেকেই নাক সিঁটকোলে কি হবে, ভূতের গল্পের বাজার আছে আর আজকের মার্কেট ওরিয়েন্টেড থুড়ি ডমিনেটিং ইকনমির যুগে তাই এই সব গল্পের বইয়ের ব্যবসায় মার খাবার কোন প্রশ্নই নেই। 

সে কথা যাক গিয়ে।

আমার সমস্যা এখন হয়েছে অন্য।

আর সেটা তৈরী করেছে আমার পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ সুন্দর ছেলে চঞ্চল। তাও করেছে ইদানীং। 

রোজ রাতে ঘুমোবার আগে তার তো চাইই একখানা করে গল্প। 

বছর তেরো বয়স হয়ে যাবার পরে কোথায় একটু গল্প শোনার সেই ইচ্ছেটা, পড়াশোনা আর খেলাধূলোর চাপে পড়ে কমবে, তা তো দেখি হ’বার নয় । উল্টে দারুণ সুন্দর ছেলের আব্দার আর ও বেড়েছে। তেরো বছর বয়স পুরো হয়ে যাবার পর এখন দেখি যে ছেলেটা বেশ সাহসী ও হয়ে উঠেছে। তাই শুনে খুব ভয় করে, সময় অসময়ে এমন সব গল্প চাই তার। অর্থাৎ সহজ সরল ভূত হ’লে ও ছেলের হবে না, খুব দুষ্টু ভূতের গল্প চাই। বোঝো ঠ্যালা। ‘আমি কই কম্ম কাবার’…..পাই কোথা?

সেই মতন গোটা বারো ভূত নিয়ে মানে ভূতের গল্প নিয়ে ‘এক ডজন তেঁনারা’ নাম 

দিয়ে একটা বইয়ের পান্ডুলিপি অনেক কষ্টে তৈরী করে ফেলে ছিলুম আমি গল্পগুলো এক এক করে চঞ্চলকে শোনাবার পরে। আর একজন  দূরদর্শী প্রকাশক মশাই ও দিব্যি তৈরী হয়ে গিয়ে ছিলেন সেই বই খানা ছাপতে। 

তা আমার ভূতভাগ্য তেমন ভালো নয়। হঠাৎ কি যে হ’লো, দিন কয়েক হয়েছে তিনি একদম নির্বাক। ভূতের খপ্পরেই পড়লেন না কি তাই বা কে জানে বাবা? 

তা আপনারা যদি কেউ সে দায়িত্বটুকু নিতে চান তবে জানাবেন অবশ্য করে কিন্তু। তেঁনাদের দয়ায় বাজারে বই যে পড়তে পাবে না সে গ্যারান্টি আমি দিতে পারি তেঁনাদের হয়ে। ‘হট কচুরিজ…’ বলা যায় স্বচ্ছন্দে।

বইটার নাম ‘তেঁনাদের কথা’ ও রাখলে চলে, কেননা প্রথম গল্পের নামই তাই। গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকমের। তা বলছি শুনুন---

আজকাল বেনারসে কিছুদিন হ’লো বিকেল বেলায় রোজ হঠাৎ করে বেশ খানিক বৃষ্টি ঝড় হওয়া শুরু হয়েছে আর রূপকুমার দুধবরণ ছেলে চঞ্চল, তাই নাম দিয়েছে বিকেল বৃষ্টির দেশ। ছেলেটার ভূগোল পড়বার ফল আর কি। বিকেলে রোজ বৃষ্টি হয় এমন  দেশের কথা চঞ্চলের আট ক্লাশের ভূগোল বইতে আছে। 

তা সে’দিন ও সেই ব্যাপার।

আমি সবে চঞ্চলকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি স্কুটারে বসিয়ে। ব্যস,….ঝড় শুরু হ’তেই মেঘে চারদিক অন্ধকার আর লাইট ও গেল নিভে। বাধ্য হয়ে ব্যাটারী চালিত ইনভার্টারের লাইট জ্বেলে চঞ্চলকে আগে বাথরুমে নিয়ে গেলুম। ছেলের হাত পা মুখ সাবান দিয়ে বেশ করে ধুইয়ে দিয়ে তার সারাদিনে নোংরা হয়ে যাওয়া স্কুল ড্রেসগুলো সব খুলে নিয়ে ওয়াশিং মেশিনে পরে কাচবো বলে ফেলে দিলুম আমি। তারপর চঞ্চলের নরম মসৃন চকচকে দুধসাদা হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসে ঘরে পরবার হাল্কা সুতির কাচা পোষাক পরাতে বসলুম। সুন্দর ছেলেটাকে তারপরে জলখাবার খেতে বসিয়ে দিলুম। বৃষ্টি ও বেশ শুরু হ’লো তখন। কি আর করি? 

বললুম—‘চঞ্চল, আজ আর বাদলের সাথে ছাদে গিয়ে যে তুমি ব্যাডমিন্টন খেলবে, সে আশা নেই। গতিক সুবিধের নয়। তাই তাড়াতাড়ি করে তোমার কালকের হোম টাস্কগুলোই সব সেরে নাও দেখি’। 

তাই চঞ্চল খেয়ে উঠে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসলো। 

তখন ঝমঝমিয়ে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকাল গিয়ে ও সে এইবারে কেন কে জানে দিব্যি আটকে গিয়েছে যেন আর নিজের প্রকৃতি বদলে সমানে টিঁকে ও আছে এই আশ্বিন মাস অবধি। দিন কয়েক পরেই পূজো এসে যাবে। তখন ও বৃ্ষ্টি হবে হয়তো। তবু ও গরম কিন্তু একদম কমে নি। সে বেশ আছে।

আমি সিলিং পাখাটা জোরে চালিয়ে দিয়ে সোফায় বসে একটা গল্প লেখায় মন দেব ভাবছি, হঠাৎ করে লাইট একদম ডিম হয়ে গেল। পাখা ও বন্ধ হয়ে গেল। নির্ঘাৎ পুরো চার্জ হয়নি ব্যাটারী আর নয়তো খারাপ হয়েছে কিছু।  

আমি ও কাগজ কলম ফেলে রেখে ঝপ করে লম্বা সোফাটাতে শুয়ে পড়লুম দূর হোক ছাই…বলে। তাই কি সহজ কাজ? গরম লাগতে শুরু হ’লো বেশ। 

চঞ্চল নিজের আকর্ণ বিস্তৃত চোখ জোড়াকে আর ও বড় বড় করে বললো—‘ও কাকুউ, এ কি হয়ে গেলো আবার? তুমি দেখোই না। এই আলোতে তো পড়াই যাচ্ছে না কিচ্ছু, কাকু। কি হবে বলো না?’।

আমি রাগ করে বললুম-‘ছাই হবে। ভূতে ধরেছে আলোকে আজ। বাইরে ঘোর বৃষ্টি কিন্তু জানলা খুললেই ঘরে সে সোঁ করে ঢুকে পড়ে ঘর ভাসিয়ে দেবে। তাই ভয়ে সব বন্ধ রাখতে হয়েছে দরজা জানলা আর গুমোট গরমে ঘরে আমাদের প্রাণ যাচ্ছে। পাখা ও অচল। তায় আলোর এই অবস্থায় কিচ্ছু আর করা যাবে না এখন, কারেন্ট না এলে’।

‘আমার ও খুব গরম তো লাগছেই কাকু, কি আর করা? আমি না হয় কাকু, আমার এই ড্রেসটা খুলে ফেলি আগে আর তারপরে তুমি একটা ভূতের গল্পই বলো কাকু। আমি তাই শুনি না হয় ততক্ষন’।

‘তাই ভালো, তবে তেঁনাদের দয়া না হ’লে সে গল্প কি আর জমবে, চঞ্চল? খুব ভালো হয় যদি একটা সত্যি ভূতের গল্প বলতে পারা যেত। তা এই বেনারসেই আগে অনেক ভূত ছিল, প্রায়ই লোকদেরই ভূতে ধরতো মানে ঘাড়ে ভর করতেন তেঁনারা। আর তখন তারা পাগলের মতন সব কাজ করত। তখন রোজা ডেকে এনে ঝাড়ফুঁক করে তবে রেহাই মিলতো’। 

‘তুমি নিজে দেখেছো কখনো তেঁনাদের, কাকু?’

‘নাঃ, তেঁনাদের তো দয়া না হ’লে চোখে দেখা ও ঠিক যায় না, ভাই….আর সে’সব অনেকদিনের কথা তো…’। 

‘তবে, কাকু?’

‘পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি’… চঞ্চল আরো বড় বড় সরল চোখে তাকাল।

‘তেঁনারা ঘাড়ে চাপলে মানুষের পাগলের মতন ব্যবহারে আর অসম্ভব সব অজানা ভাষায় বলা কথাবার্তায় তা বোঝা যেত’। 

‘তা চঞ্চল, তুমি এখন আমার কাছে চলে এসো, সোনা। আমি না হয় তোমার গায়ে হাতে পায়ে বেশ করে এই ঠান্ডা ক্রীমটা লাগিয়ে দিয়ে হাতপাখা দিয়ে তোমাকে হাওয়া করছি। দেখবে, গরম আর একটু ও লাগবেই না’।

‘সত্যি, কাকু?’ 

আমার কথা শুনেই চেয়ার থেকে উঠে এসে নিজের পরনের সব পোষাকগুলো একে একে খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল চঞ্চল। 

‘হ্যাঁ, আসলে ঘামাচির পাউডার যেমন হয় না, এও তেমনি ধারা জিনিষ। তবে এই ক্রীমটা দামী বিদেশী জিনিষ হ’লে ও এতে বেশ খানিকটা হেয়ার রিমুভার আর ক্লোরিনেটেড ব্লিচিং এজেন্ট ও দেওয়া আছে বলে বেশী ব্যবহার করা চলে না। সেন্টেড হ’লে ও ক্লোরিনের গন্ধ অনেকের একদম সহ্যই হয় না যেমন কি না সর্ষে লংকা ও হলুদ পোড়ার গন্ধ বা ধোঁওয়া তেঁনাদের পছন্দ হয় না। এই অন্য শিশির স্প্রে’টার সেন্টের গন্ধটা ও ঠিক হলুদপোড়ার মতন লাগে কিন্তু…আমার’। 

‘এ’তে স্প্রে সিস্টেম আছে তবে সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। যেন চোখে মুখে না লাগে। অবশ্য স্প্রে মেয়েদের বেশী পছন্দ হয়। সহজে গায়ের সব জায়গায় লাগানো যায় বলে। আর চান করে ফেললেই হয়ে যায় তোয়ালে দিয়ে রগড়ে গা মুছতে ও হয় না। তবে এ’তে কুলিং এফেক্ট খুব কম, তাই আমাদের দরকার নেই। সবই দাদার আমদানী। কাস্টমস থেকে যোগাড়….’। 

‘একটু লাগাতেই দেখবে তুমি যে তোমার হাত, পা বা গায়ের খোলা থাকা অংশের সব 
সান বার্ন মিলিয়ে গেছে। আর এখন তুমি একটু তো বড় হয়েছ। তাই বলে তোমার শরীরে যেখানে যে সমস্ত হাল্কা রূপোলী নরম চকচকে রোম হয়েছে, সে সব ও দেখবে একদম উঠে গেছে। 

সে একঘন্টা পরে এই নরম ভিজে তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর রগড়ে মুছে ফেললেই হয়ে যাবে। কিন্তু এর কুলিং এফেক্ট আরো আধ ঘন্টা মতন বেশ থাকবে। তা এখন তুমি এসো। শোনো….একবার হয়েছে কি না…’ 

সেই মৃদু আলোতে চঞ্চলের অনিন্দ্যসুন্দর মুখটুকু বাদ দিয়ে দুধসাদা সারা শরীরে আমি ক্রীম লাগিয়ে হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে হাওয়া করতে করতে বাঁ হাতে কিশোর ছেলেটার নরম মসৃন ঠান্ডা মতন শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বেশ খানিক আদর করতে করতে সবে মাত্র গল্পটি শুরু করেছি আর অমনি কি না ঝিঁ ঝিঁ করে মৃদু্স্বরে কলিংবেল বেজে উঠলো হঠাৎ করে সদর দরজায় ঠিক তখনি। 

‘আঃ কাকু, কি সুন্দর মিষ্টি ঠান্ডা লাগছে…’ আরামে এই কথা বলতে বলতেই বেল বাজছে শুনে পরম সুন্দর রাজীবলোচন সুকুমার ছেলে চঞ্চল ছটফটিয়ে লাফিয়ে উঠলো আমার বুকের ওপর থেকে।

‘ইসসসসস্, এ মা গো। কি সর্বনাশ…ও কাকু, এই জল ঝড় মাথায় করে কে এলো আবার এই অসময়ে? ভূত না কী, কাকু? এখন উপায়, কাকু? ও কাকু, কি হবে? আমি না হয় বাথরুমেই চলে যাই, কাকু আর  তুমিই উঠে দেখো একটু, প্লীজ…’ 

এই না বলেই ঝকঝকে দুধবরণ ছেলে চঞ্চল এগিয়ে গিয়ে একহাতে ক্রীমের টিউব, স্প্রেয়ারযুক্ত লোশন আর ভিজে তোয়ালে আর অন্য হাতে নিজের ছেড়ে রাখা পাজামা, পাঞ্জাবী আর অন্তর্বাস গুলো ও এক এক করে তুলে নিয়ে মরাল শুভ্র দু’হাতে নিজের বুকে চেপে ধরে দে ছুট। বাথরুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল চঞ্চল। আর  সে করবেই বা কী? ঘন্টাখানেক পরে গা হাত পা মুছতে হবে তাকে ভিজে তোয়ালে দিয়ে। 

এ’দিকে ঝিঁ ঝিঁ ডেকেই চলেছে সমানে। জ্বালাতন আর বলে কাকে? গল্প তো গেলেন চুলোয়, অত সুন্দর ছেলেটাকে ভালো করে মনের সুখে আজ একটু আদর ও করতে পেলুম  না আমি।

আমি গিয়ে দরজা খুলে তো অবাক। বাইরে একজন বেশ রোগা ও বৃদ্ধমতন লোক সন্ধ্যার আবছায়ায় দাঁড়িয়ে। গলার স্বর খুব ক্ষীণ। তিনি আমার…অল্পপরিচিত…তাই  প্রথমে আমি তো চিনতেই পারিনি আগন্তুককে।

‘কে?’

‘আমি….আমি হরিচরণ বাবু..অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ তো নেই, হয়তো চিনতেই 
পারছেন না। রিটায়ার্ড মানুষ। অনেকদিন পরে আজ মেয়ে জামাইয়ের বাসা থেকে বাড়ী ফিরছিলুম, আমাকে তো যেতে ও হবে সেই নারদঘাটে। হঠাৎ বড্ড চেপে জল এলো, তাই ভাবলুম…….তা ভয় নেই আমি ভূত টুত কিছু নই…’

‘কি যে বলেন? ভূত হতে যাবেন আপনি কোন দুঃখে? প্রায় দশ বছর পরে দেখা তাই মনে করতে পারি নি। তা ভেতরে আসুন…’

‘নিন, এই তোয়ালে দিয়ে গা হাত মাথা মুছে ফেলুন একটু। বেশ ভিজেছেন দেখছি। সর্দি জ্বর হওয়া কিছু বিচিত্র নয় এই বয়সে…আলোটা ও আজ আবার….’

‘আলো বা তোয়ালে কিছুরই আমার দরকার নেই। আপনি বসুন…’

‘তবে আমি একটু চা আনছি..করে…’

‘কিচ্ছু লাগবে না আমার। আপনি বসুন তো। আমি আগে খুব চা খেতুম। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। সেই রাণীপুরের ঘটনার পর থেকে…’

‘আপনি ভালো আছেন তো?’

‘আগে বেশ কষ্টে ছিলাম রাণীপুর থেকে ফিরে। কোনমতে চাকরী করে চালিয়েছি। তবে এখন আর কোন কষ্ট আমার নেই’। 

‘তা সেই সব কথা আমি তো ঠিক জানি না, তাই ঘটনাটা বললে হয়তো বুঝতে পারতুম…’।

‘বেশ, আগে তবে তাই বলছি, শুনুন। সময়টা ও দিব্যি কেটে যাবে। কিন্তু আগে আপনি মেঝেতে পড়ে থাকা ওই সাদামতন একফোঁটা বস্তুটা, কোন কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন দেখি। গন্ধটা বড় বিশ্রী। আমার একদম সহ্য হয় না’।

চমকে উঠে দেখি সত্যিই পায়ের কাছে সেই সুগন্ধিত ক্রীম একফোঁটা পড়ে রয়েছে। হয়তো চঞ্চলকে মাখাবার সময় পড়েছে। আমি টের ও পাইনি, দেখতে ও না। ইনি এই বয়সে আর ঘরে ঢুকেই তা দেখতে পেলেন কি করে এই আবছা আলোতে? যাই হোক, ক্রীমটুকু মুছে ফেললুম তোয়ালে দিয়ে। তখন তিনি স্বাভাবিক হয়ে বসে বলতে শুরু করলেন।

‘যখনকার কথা বলছি সেই সময়ে আমি ছিলাম এক বেকার যুবক। রেলের চাকরিটাও আমার তখন জোটে নি’। 

‘তাই যেখানে পাচ্ছি সে’খানেই বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত ঠুকছি আর ডাকলে গিয়ে সাক্ষাৎকার ও দিচ্ছি। ফলাফল যদি ও শূন্য। শেষে জানা গেল যে রাণীপুর বলে একটা স্টেট আছে, আর সেখানে কাজ ও মেলে। তবে সেই সময়ে কেউ রাণীপুরে কাজ নিয়ে যেতেই চাইতো না। আধা মাঠ আধা জঙ্গলে ভরা জায়গাটাকে লোকে কেন কে জানে ভালো বলে মনে করতো না’।

‘তা আমি তখন যুবক আর চাকরির জন্য মরীয়া। কমার্স নিয়ে পড়েছি তাই  রাণীপুর স্টেটের হিসেব পরীক্ষকের জন্য একজন লোক চাই এই খবর শুনেই জয় মা বলে দরখাস্ত ঠুকে দিলুম। এক ভদ্রলোক আমাকে ঠিকানা দিলে ও তিনি সে’খানে যেতে বার বার করে নিষেধ করলেন। বলা বাহুল্য যে তখন ও জমীদারী বা তাদের স্টেটের প্রথা লুপ্ত হয়ে যায়নি। দিন পনেরো পরেই সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক আসতে, যাবার জন্য ভরা বর্ষাকালেই আমি তৈরী হচ্ছি দেখে বাড়ী থেকেই শুধু নয়, বন্ধুবান্ধব ও সবাই বারণ করতে শুরু করলো। জায়গাটার না কী বদনাম আছে খুব। গ্রাম্য এলাকা। সাপখোপের উপদ্রব তো আছেই, বর্ষায় বন্যা হতে ও দেরী হয় না তাই নিরাপদ নয়’।

‘সে সব কথায় কান দিলুম না আমি। একটা সুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে। প্যাসেঞ্জার ট্রেন। পোঁছবার কথা সন্ধ্যে ছ’টায়। তখন ট্রেন ঠিক সময়েই চলতো তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম কিন্তু ট্রেন গয়া পার হয়ে ঝাড়া তিনঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে মাটি করলো সব। আগে না কী কোথায় লাইন ডুবে গিয়েছে। সারা রাস্তাই বৃষ্টি হয়ে চলেছে তাই সেটা আর অসম্ভব বলে মনে হ’লো না’।
 
‘তা যদি ও বা একসময় ট্রেন ছাড়লো, গোরুর গাড়ির মতন স্পীডে ডুবন্ত লাইন পার হয়ে চলতে চলতে রাণীপুর স্টেশনে যখন পোঁছাল, তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়েই চলেছে আর হু হু করে ভিজে হাওয়ার ঝড় বইছে। রীতিমতন সাইক্লোনিক ওয়েদার আর কি?’ 

‘স্টেশন বলতে আছে নীচু কাঁকড় বিছানো এক কাঁচা ভিজে প্ল্যাটফর্মে দু’চারটে লোহার বেঞ্চি, একটা টিউবকল, দু’তিনটে গাছ আর গ্যাসের নিভন্ত বাতি আর জনমানব বিহীন ছোট্ট একটা পাকা স্টেশন ঘর। ব্যস। কোথাও একটু বসবার মতন জায়গা ও নেই সেই বৃষ্টিতে। ট্রেন চলে যেতেই স্টেশন জনমানব বিহীন। যাত্রী অন্য কেউ নামে নি আর ট্রেন পাশ করিয়েই স্টেশনের লোকজন সব সরে পড়েছে’।  

‘আমার সুটকেশে বর্ষাতি ছিল। তাই বার করে গায়ে চড়িয়ে নিতে হ’লো আগে। 
তারপরে বার করে নিলুম টর্চ। সেই আলোতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে সোজা চলে যাওয়া এক চওড়া কাঁচা রাস্তায় উঠলুম। এখন কোনদিকে যে যেতে হবে তাই বা কে জানে? সোজাই চলতে শুরু করলুম। পথ ভর্তি দারুণ জলকাদা। হাঁটাই দায়। যিনি চিঠি দিয়ে ডেকেছেন তাঁর নাম রুদ্রনাথ। স্টেটের ম্যানেজার। পথ নির্দেশ ছিল চার মাইল উত্তরে।   কোনদিকে উত্তর আর কোনদিকে যে দক্ষিণ, তা কে জানে?’।

‘আধ ঘন্টা চলবার পরে একজায়গায় দেখি টেমি জ্বেলে এক চায়ের দোকান খোলা আছে অত রাতে ও । আশ্চর্য তো। তা সে’খানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম—‘সদর স্টেট অফিস কতদূরে?’

কে একজন ভেতর থেকে কেমন অদ্ভূত গলায় বললো-‘সোঝা ছলে ঝান…থিন মাহিল…’ । তাকে দেখা কিন্তু গেল না।

আবার জানতে চাইলুম--‘চা আছে? পাওয়া যাবে?’

‘আছে, ঠান্ঢা হয়ে আসছে। ছলবে?’

‘তাই দিন। কত?’

‘থিন ঠাখা …’

সামনে এক গ্লাশ চা এসে তখনি হাজির।
‘ফয়সাঠা ও’খানেই রেখে ঝান…’ 

‘খেয়ে দেখি যে সে চা একদম ভালো নয়। একে ঠান্ডা তায় বিস্বাদ…তাই এক গেলাস গলায় ঢাললুম ঝড়জলের রাতে। দাম দিয়ে পথে নেমে কি মনে হ’তে পিছনে তাকালুম একবার।  কিন্তু দোকান বা দোকানঘরের চিহ্নও দেখলুম না। আবার টর্চ জ্বেলে ফিরে গিয়ে  সেই দোকান খোঁজার জন্য মনে কোন উৎসাহ পেলুম না। দূর হোক ছাই দোকান, বলে এগিয়েই চললুম আমি। মাথাটা কেন যে বেশ ভার হয়ে উঠতে শুরু করলো, কে জানে। মনে হ’লো সেই বাজে চা খেয়ে উল্টো ফল হয়েছে। চা তো নয় ওদের ভাষায় ছা’

‘জলকাদা মাড়িয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই। পথ আর ফুরোয় না। খানিক পরে মনে হ’লো যে চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। কারণ কি খুঁজতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। পায়ের নীচে জলকাদা আর নয় শুধুই জল আর সে জল ক্রমেই পা ডুবিয়ে উঠে আসছে হাঁটু অবধি। নীচে নরম পাঁকের মতন রয়েছে। পা আটকে যায়। নির্ঘাৎ এ’দিকে কোন নদী আছে আর এই জল তারই প্লাবনের’। 

‘বৃষ্টি ও হয়েই চলেছে। তাই একটু পরেই জল হাঁটুর ওপরে উঠে এলো। আমাকে  দাঁড়াতে হ’লো। রাস্তা জলের নীচে। দেখা যায় না । যাব কোনদিকে? সামনে জল বাড়ছে। যাওয়া অসম্ভব। কমবে কোনদিকে গেলে, তা কে জানে? আচ্ছা স্রোতের ধারা কোনদিক থেকে আসছে? মনে হয় পিছন থেকে অর্থাৎ বাঁচতে হ’লে পিছনপানেই যেতে হবে’। 

‘অগত্যা তাই সই’।

‘স্রোতধারা ঠেলে যাওয়া ও কোন সহজ কাজ নয় দেখা গেল। পা ব্যথা হয়ে যায় জল ঠেলে হাঁটতে। সুটকেশ মাথায় তুলে জলে ভিজে আলো স্তিমিত হয়ে আসা টর্চ হাতে নিয়ে গান্ধীজীর মতন ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’… বলে এগিয়ে চললুম’।

গল্পটা বেশ জমেছে দেখে সোজা হয়ে বসলুম আমি। পায়ের নীচে কিছু একটা ঠেকলো। নীচু হয়ে তুলে দেখি বাবলগাম একটা। নিশ্চয়ই চঞ্চলের অন্তর্বাসের পকেট থেকে পড়ে গেছে, সেটা তুলে নিয়ে যাবার সময় তাড়াতাড়িতে। 

বাবলগামটা নিয়ে কি করি? প্যাকেট খুলে মুখে ফেলে দেব না কী ভাবছি। 

শুনি তিনি বিড়বিড় করে বলছেন-‘একজোড়া ঘাসের চটি দেখছি পড়ে আছে টেবিলের নীচে। সাইজ দেখে মনে হয় যার চটি তার বয়স খুব বেশী নয়। এগারো বারো বছর হবে। চটিটায় কালো দাগ কোথা নেই আর বেশী দেবে ও যায়নি’। 

‘অর্থাৎ যার চটি সে কালো নয় মোটেই কেননা কালো যারা হয় তারা বড় অপরিচ্ছন্ন হয় বেশীরভাগ। আর সে বেশ রোগা। বাবলগাম মেয়েরা কম খায় এই বয়সে। অর্থাৎ চটির মালিক হচ্ছে একজন ছেলে। অথচ তাকে ক্রীম মাখানো হয় তার মানে যে সে শুধু ফর্সাই নয় খুব রূপবান আর আদরের ছেলে’।

‘কি বলছেন? ও হরিবাবু…’

‘অ্যাঁ, না, ও কিছু না’।

‘আমার মনে হ’লো এই লোকটি ডিটেক্টিভ বা তার উল্টো কিছু হতে পারেন। কি উদ্দেশ্যে যে এসেছেন তা কে জানে। অনেকদিন আগের পরিচয়। মনে ও নেই ঠিক। এখন হঠাৎ এসে পড়াটা বিশেষ সহজ ব্যাপার মোটেই নয়। 

মুখে বললুম-‘তারপর?’

‘টর্চটা নিভে গেল হঠাৎ আমার জলে ভিজেই হয়তো। সব অন্ধকার। জল বাড়া শুরু হ’লো সেখানেও বৃষ্টির সাথে। কাজেই আবার জল ভেঙ্গে চলা শুরু হ’লো আমার। জল বাড়তে বাড়তে কোমর ছাড়াতেই আমার সলিল সমাধি প্রায় পাকা হয়ে এলো’।

‘তখন দূরে অনেক গাছপালাদের ঝড়ে মাথা নাড়তে দেখে মনে হ’লো, ওইদিকেই যাই। একটা কোন গাছে উঠে যেতে পারলে প্রাণ বাঁচতে পারে। আমার সব অনুমান ও ইনডাকশন পাওয়ার চূলোয় গেল। মৃত্যুভয়ে একবার ও আমার মনে হ’লো না যে গাছগুলো সেই নদীর বা জলাশয়ের ধারে ও তো হতেই পারে যার প্লাবনে মাঠঘাট ও পথের এই অবস্থা হয়েছে’।

‘তা সেই দিকে যাওয়াই আমার কাল হ’লো। জল বুক ছাড়াতেই ভেসে গেলাম আমি। সুটকেশ, টর্চ সব যে কোথায় গেল কে জানে। সাঁতার জানি না তাই অসহায় অবস্থায় হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভেসে যেতে হ’লো আমাকে’।

আবার চমক লাগল আমার। ভদ্রলোক অতি সাংঘাতিক কথা বলছেন। উনি যদি জলে ডুবে মারা গিয়ে থাকেন তবে কি ভাবে এখন বেঁচে আছেন। না কী ইনি একজন ভূ…’

‘তখনি শুনলাম তিনি আবার বিড় বিড় করছেন—‘কিন্তু ছেলে যদি হয় তবে সে আমি আসছি বুঝে সরে পড়লো কেন এইঘর থেকে। মেয়ে হ’লে নয় লজ্জা পেয়েছে মনে 
হ’তে পারতো। তাও এই বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ের লজ্জার কিছু নেই। চটি পরেনি নিজের প্রিয় বাবলগাম ও নেয় নি, এত দ্রুত চলে গেছে। তবে কি ছেলেটির সাথে কিছু অনৈতিক কাজ করা হচ্ছিল? হয়তো তাই। সে যাই হোক, কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তি কেমন, তা তো বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে সে কি জব্দ….’

‘কি সব বলছেন, শুনতে পাচ্ছিনা। ও হরিবাবু…?’

‘না না ও কিছু না। তারপরে শুনুন। আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম। তার মধ্যেই মনে হ’লো যে কে বা কারা আমাকে জল থেকে টেনে তুলছে একসময়। আমার সেবা শুষ্রুষা করছে, বেঁচে আছি কি না পরীক্ষা করে দেখছে বার বার। আমি কিছু বলতে পারছি না। এমন আমার অর্দ্ধচেতন অবস্থা……’

‘শেষে তারা আমাকে জীবিত মনে করে তুলে এনে একটা শুকনো জায়গায় শুইয়ে দিলো। ভিজে পোষাকে আমার তখন কেমন শীত শীত করছিল, তা মনে আছে আর মনে হ’লো নরম কার্পেট জাতীয় কিছুর ওপরে শুয়ে আছি আমি। মনে হ’লো সে’খানে কোন জোর আলো  জ্লছে তবে মশাল নয়। একদিকে একখানা ধাতু মোড়া সিংহাসন ও পাতা আছে। 

সেই আসনে কোন মহিলা আসীন বলে মনে হ’লো আমার যখন তিনি কোন অন্যজনকে বললেন-‘যাও, এখনি খোঁজ করে দেখ যে এই মানুষটা কে? কোথা থেকে এবং কেনই বা এসেছে এ’খানে? ও কি চায়?’

‘আর ততক্ষন একে কারাগৃহে বন্দী করে রাখা হোক……..’।

‘তখনি কয়কজন মিলে আমাকে তুলে এনে অন্য একটা অন্ধকার ঘরের শক্ত মেঝেতে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সশব্দে। জলে ভেসে কোথায় যে এসে পড়েছি তা ভগবানই জানেন। তবে আমার যে পালাবার কোন উপায় নেই এই বন্ধ কারাগার থেকে, তা ঠিক। সে ক্ষমতা ও নেই। আচ্ছন্নের মতন পড়েই ছিলাম’। 

‘হঠাৎ মনে হ’লো কোথায় যেন মৃদু গুন গুন করে শব্দ উঠছে। এই ঘরে না বাইরে কোথাও থেকে আসছে শব্দটা? নাঃ বাইরে হ‘লে কি এই বন্ধ ঘরে শোনা যেত কিছু? সুতরাং ঘরে এবং হ্যাঁ, ঠিক আমার মাথার কাছেই তো’। 

‘হঠাৎ কটাং কট করে কি যেন আমার বাঁ হাতে কামড়াল। মশা কি? ঠিক তাই। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে চাপড় দিলুম আমি। তখনি ডান হাতে ও মশা কামড় দিল। আবার চাপড় । কিন্তু ক্রমেই মশাদের সংখ্যা যেন বাড়ছে আর তাদের গুঞ্জন ও জোর হয়ে উঠছে’।

‘আমি ও তখন যেন মরীয়া হয়ে দু’হাতে সমানে চড় চাপড় চালিয়ে যাচ্ছি মশা মারতে কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়ে উঠলো না। আমার হাত পা মাথা সব দেখতে দেখতে অবশ অসাড় হয়ে গেল আর আমি মড়ার মতন পড়ে সেই প্রচন্ড মশার কামড় খেতে রইলাম। ক্রমে আমার হাত পা মাথা সব ঝিন ঝিন করতে লাগলো। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা ও বুকে যেন হাজার ছুঁচ ফুটতে লাগলো আর আমার মনে হ’লো যে আমি তলিয়ে যাচ্ছি পাতালে, সে’খান থেকে আরো অতলে…কোথায় কে জানে। সে মাত্র অনুভূতির বিষয়, মুখে বলে আপনাকে এখন বোঝানো কঠিন’।

‘তারপর…?’

‘হঠাৎ একটি স্বর শোনা গেল’। 

‘মহারাণী, এইমাত্র গূঢ়পুরুষ সমাচার এনেছে যে এই মানুষটি আমাদের পাশের স্টেটের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে এসেছে তাদের ডাক পেয়ে, এর কাগজ পত্র যা সুটকেসে ছিল তাই দেখে জানা গেছে যে লোকটি যোগ্য এবং অভাবগ্রস্থ…. সুতরাং… যদি অনুমতি করেন তবে আমরা একে নিয়ে গিয়ে রাণীপুরে…’

‘আঁ…এঁ এঁ …অঁকঃ  করে কেমন এক বিশ্রী শব্দ হ’লো তীক্ষ্ন বিকৃত নারীকন্ঠে  ঠিক আমার মাথার কাছে এবং সমস্ত মশার কামড় বন্ধ হয়ে গেল একসাথে…’

‘আমার চোখের পাতা টুকু খোলবার মতন শক্তি ও তখন শরীরে অবশিষ্ট নেই। শুয়ে শুয়েই মনে হ’লো বাইরে কে কি আরো বললো কিছু এবং আমাকে দরজা খুলে কারা টেনে বার করে আনলো’। 

‘খানিক পরে তারা আমাকে তুলে নিয়ে কোন উঁচু জায়গায় উঠলো এবং আমাকে পাঁজা কোলা করে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো। আমি শোঁ শোঁ করে নীচে পড়তে শুরু করলুম। দু’কানের পাশ দিয়ে সোঁ সোঁ করে ঝড়ের মতন হাওয়া বইতে লাগলো। অনেকক্ষন পরে দমাস করে কোথায় গিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালাম’।।

‘পরদিন যখন আমার হঁশ ফিরলো তখন সকাল হয়ে গেছে আর আমি জল কাদা মেখে ভিজে পোষাকে বর্ষাতি জড়িয়ে রাণীপুর স্টেশনের একটা লোহার বেঞ্চিতে পড়ে আছি। সারা শরীর ও ঘাড় আর মাথা ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে টাটিয়ে উঠেছে’। 

‘আর সেই সাথে আমার সারা গায়ে লাল লাল দাগড়া দাগড়া দাগ হয়ে ফুটে আছে। 
এ’সব কিসের দাগ? কালকের সেই মশার কামড়ের না কী’? 

‘পাশে পড়ে আছে আমার সুটকেস আর টর্চ। সেই অবস্থায় আবার রাণীপুরের স্টেটের অফিসের খোঁজে যাবার শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই তখন আমার আর ছিলো না’। 

‘আমি যে গাড়ী আগে ধরতে সক্ষম হ’লাম, তাইতে টিকিট কেটে নিয়ে উঠে পালিয়ে এলাম’।

থেমে গেলেন তিনি। 

‘এই ঘটনার পর কি আর কারো শরীর ঠিক থাকতে পারে? বলুন আপনিই। তা বিশ্বাস হ’লো তো আমার কথা, স্যার?’

‘নাঃ’

‘না, মানে?’

‘না মানে না। আর কি? যত সব উদ্ভট, গাঁজাখুরী গল্প আপনার….’ আমি বললুম।

রাগে যেন লাফিয়ে উঠলেন হরিবাবু। বললেন--‘কি, আমি গাঁজাখোর? যত বড় মুখ নয় তত বড়ো কথা? বটে, বটে । বেশ, এইবার তবে দেখুন, প্রমান ও দেখিয়ে ছাড়ব আপনাকে আমি আজ । এখনই হয়েছে সে সময় উপস্থিত। হাড়ে হাড়ে বুঝবেন  কি সত্যি আর কি মিথ্যে…..’

বলেই তিনি উঠে গিয়ে হঠাৎ আমার সোফার চারপাশে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলেন আর আমার যেন দম বন্ধ হয়ে এলো, হাওয়ার অভাবে। মনে হ’লো কে যেন পাম্প করে আমার চারদিক থেকে সব বাতাস টেনে নিচ্ছে। আমার দম আটকে এলো আর মাথা ঘুরতে লাগলো । হাত পা এলিয়ে পড়ল আর তখনি যেন আমার সারা শরীরে কট কট করে খুব মশা  কামড়াতে শুরু করলো। যেন হাজার হাজার ছুঁচ ফুটছে আর শরীরের সব শিরা উপশিরা ঝনঝন করছে। শরীরের সব রক্ত কে যেন শুষে নিচ্ছে নিঃশেষ করে’। 

‘এমন পরিস্থিতিতে আমি সারা জীবনে কখনো পড়িনি। আমি নির্জীব ও শক্তিহীন হয়ে পড়লাম কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। আমার হাত পা নাড়বার ও আর যেন কোন ক্ষমতাই নেই। আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি যেন জলের ভিতর। সে এক ডুবে যাওয়ার মতন অতি বিচিত্র মৃত্যু অনুভূতি……..’

‘হাঃ…হাঃ…হাঃ…এইবার বুঝতে পারবেন আপনি, যে আমার কি অবস্থা হয়েছিল সেই রাতে। আমি সব সত্যি বলছি না মিথ্যে। কেউ আর এখন পারবে না আমার হাত থেকে বাঁচাতে আপনাকে’। 

‘এই জন্যই আজ আমি এই ঝড় জল মাথায় করে এসেছিলাআ আ …আঃ…আঃ….আঃ ….আঁক………………………’

কথাটা পুরো হবার আগেই হঠাৎ করে থেমে গেল । তারপর শুধু এক অমানুষিক তীক্ষ্ন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আর কিছু মনে রইলো না আমার তারপরে।…….

যখন আমার চেতনা ফিরলো একটু, তখন দেখি যে আমি সোফায় এলিয়ে পড়ে আছি অপরূপ সুন্দর পরীর দেশের রাজকুমার চঞ্চলের নরম কোলে মাথা রেখে। সে আমাকে দুধ সাদা হাতে স্মেলিং সল্ট শোঁকাচ্ছে। ছেলেটার পরনে আছে সূতির সাদা পাজামা আর আদ্দির পাঞ্জাবী।

‘আমার কি হয়েছিল চঞ্চল?’

‘মনে হয় তুমি একটু ভয় পেয়েছিলে, কাকু…’

‘সেই ভয়ংকর বুড়ো লোকটা আপনা থেকেই চলে গেছে, চঞ্চল?’

‘নাঃ কাকু, দুষ্টুরা অতো সহজে কি যায় কাকু? তাদের তাড়া করতে হয়। তবে যায়.’

‘তা কে তাড়ালো….’

‘আমি, কাকু….’

‘তুমি? একটা এইটুকু কচি বাচ্চা ছেলে? ওই ভয়ংকর বুড়োকে তাড়িয়েছো? তা কি করে?’

‘আমি বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে সমানে নজর রেখেছিলাম, কাকু। তোমার কথামতন নির্দিষ্ট সময় হয়ে যেতেই ভিজে তোয়ালে দিয়ে আমার সারা গা হাত পা মুছে নিয়ে তারপরে জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আগে নিজের শুধুমাত্র এই পাতলা পোষাকটাই চট করে পরে নিলুম আমি। ও কিন্তু আমার চটিটার দিকে আর বাথরুমের দরজার দিকে বার বার করে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কিছু বলছিল’। 

‘কথাগুলো আমি শুনতে পাইনি তা ঠিক, কাকু তবে তোমার মেঝে মুছে ফেলা দেখে বুঝে নিয়েছিলাম যে ও যে কোন কারণেই হোক ক্লোরিনের গন্ধ বা ক্লোরিনেটেড লিকুইড কিচ্ছু সহ্য করতে পারে না। ক্লোরিন জীবাণুনাশক বলেই হবে বোধ হয়। তাই তখন আমি হাতে সেই স্প্রে লোশনটা নিয়ে তৈরী হলুম, কাকু।  আর যেই না ও তোমাকে আক্রমণ করতে উঠলো, আমি ও বাদলের মতন ছুটে এসে পুরো লোশনটা ওর গায়ের ওপরে স্প্রে করতে শুরু করে দিলুম’। 

‘ওঃ কাকু, তখন ওর চিৎকার আর লাফানো যদি একটু তুমি দেখতে কাকু। তার পরক্ষনেই তো ও একদম ছুটে চলে গেল বাইরে, একটানে সদর দরজাটা হাট করে খুলে ফেলে। হিঃ….হিঃ…..হিঃ ….হিঃ….,কাকু।

‘এখন তোমার শরীর কেমন লাগছে, কাকু?’

‘একটু যেন ভালো মনে হচ্ছে, চঞ্চল সোনা’।

‘তুমি আগে ঠিক হয়ে ওঠো, কাকু। তারপরে না হয় তোমার এই কচি বাচ্চা ছেলেটাকে একটু আদর করে দিও,কাকুমণি। হিঃ……..হিঃ…………..হিঃ………’।

=======================================================

০৯৪৫২০০৩২৯০
-------------------------------------------------------
 
     

 


রচনাকাল : ১৬/৮/২০১৩
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 13  Canada : 4  China : 34  Europe : 12  France : 2  Germany : 5  Hungary : 3  Iceland : 13  India : 240  Ireland : 1  
Israel : 31  Netherlands : 12  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 5  Sweden : 7  Ukraine : 35  United Kingdom : 2  United States : 581  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 13  Canada : 4  China : 34  Europe : 12  
France : 2  Germany : 5  Hungary : 3  Iceland : 13  
India : 240  Ireland : 1  Israel : 31  Netherlands : 12  
Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 5  Sweden : 7  Ukraine : 35  
United Kingdom : 2  United States : 581  


© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
তেঁনাদের কথা by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০০২২
fingerprintLogin account_circleSignup