• ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা (২০)

    ২০১৩ , জানুয়ারী



রম্যরচনা : ন হি সুখং দুঃখৈর্বিনা লভ্যতে
আনুমানিক পঠন সময় : ৯ মিনিট

লেখক : শ্রী সমর কুমার সরকার
দেশ : INDIA , শহর : Siliguri

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , আগষ্ট
প্রকাশিত ৪৮ টি লেখনী ৫৬ টি দেশ ব্যাপী ৬৭১৩৮ জন পড়েছেন।
রম্যরচনা: ন হি সুখং দুঃখৈর্বিনা লভ্যতে
*****************************

মৃত্তিকা নির্মিত কলস বা কলসি হয় তো আপনারা অনেকেই 
দেখিয়াছেন,কিন্তু কলস বা কলসি কি রূপে কোথায় নির্মিত হয়,তাহা 
স্বচক্ষে না দেখিবার কারণে,বা অজ্ঞতার কারণে,হয় তো ঐ বিষয়ে 
বিশেষ কিছু জানেন না। একটি সাদামাটা কলস বা কলসি প্রস্তুত করিতে 
এক জন কুম্ভকারের যে কি রূপ পরিশ্রম হয়,এবং নির্মাণ কৌশলের কত 
গুলি স্তর অতিক্রম করিয়া,কত খানি ঘাতসহ হইবার পরে যে কলস বা 
কলসি শ্রীরূপ মণ্ডিত হয়,তাহা কুম্ভকার পল্লীতে গিয়া স্বচক্ষে দর্শন না 
করিলে বোধগম্য হওয়া দুষ্কর। আমাদের গল্প যে হেতু কলস নির্ভর,তাই 
কলসি কে লইয়া আলোচনা বাহুল্য মাত্র। প্রশ্ন করিতে পারেন,কলস ও 
কলসির মধ্যে পার্থক্য কি? স্থূল দৃষ্টি তে পার্থক্য পরিলক্ষিত না হইলেও
 উভয়ের মধ্যে বহুবিধ পার্থক্য বর্তমান। ব্যাকরণ মতে :
কলস=ক (জল)-লস্ অন্ কর্তৃ। পুং বা ক্লীব লিঙ্গ বাচক শব্দ। 
আর কলসি= ক(জল)-লস ই,ঈপ্। স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ। 
আকার ও ব্যবহার বিধি বিচারে কলস বৃহদাকার জলপাত্র,গ্রীবা কলসির 
তুলনায় ঈষৎ দীর্ঘ। গ্রাম্য রমণীরা ঐ কলস কাঁখে লইয়া নদী, পুকুর 
বা দূরবর্তী কোন কূপ বা নলকূপ হইতে পানীয় জল আনয়ন করেন। 
কলসি বা ঘড়া আকারে কলসের তুলনায় ক্ষুদ্র,গ্রীবা ঈষৎ হ্রস্ব। উহা 
তণ্ডুল ও গুড় রাখিবার মৃৎ পাত্র,খর্জুর বৃক্ষ হইতে রস আহরণের পাত্র, 
শ্মশানে জ্বলন্ত চিতাগ্নি তে জল সিঞ্চনের পাত্র প্রভৃতি রূপে বহুল ব্যবহৃত।
 
গ্রাম্য রমণীরা নদী বা পুকুরে স্নান করিতে গেলে অবশ্যই একটি কলসি 
সঙ্গে নেন। একাধিক গ্রাম্যবধূ কোমর প্রমাণ জলে শরীর ডুবাইয়া 
পরনিন্দা,পরচর্চার ফাঁকে ফাঁকে ঐ কলসি জলে পূর্ণ করিয়া তাহা 
আপনার মস্তকে ও সর্বাঙ্গে ঢালিয়া তিন চতুর্থাংশ স্নান সমাপন করেন। 
আর যাহা হউক,জলে ডুব দিয়া তো আর পরনিন্দা সম্ভব নয়! শেষে 
পরনিন্দা সঞ্জাত আনন্দে মন যখন পরিপূর্ণ হয়,তখন টপাটপ কয়েকটি 
ডুবে স্নান সমাপনান্তে ঐ কলসি জলে পূর্ণ করিয়া গৃহাভিমুখে অগ্রসর হন।

গ্রাম্য কিশোরী ও রমণীদের সাঁতার শিখিবার এক বড় অবলম্বন এই 
কলসি। তাহারা শূণ্য কলসিকে উল্টাইয়া জলমধ্যে স্থাপন করিলে প্লবতার 
ধর্ম অনুসারে ঐ কলসি আর জলে নিমজ্জিত হইতে পারে না। তখন ঐ 
কলসির ভাসমান তলদেশের উপর আপন উদর বা বক্ষাঞ্চল স্থাপন 
করিয়া জল তলে ক্রমাগত হস্ত পদ সঞ্চালনের মাধ্যমে তুমুল জলাঘাতের 
শব্দ সহকারে সাঁতার শিক্ষা করেন।
 
গ্রাম্য রমণীরা কলসির অপপ্রয়োগ ও করেন। যে রমণীর মনে এই 
ভাবাবেগের উদ্রেক হয় যে, জীবনে বাঁচিয়া থাকিবার আর প্রয়োজন 
নাই, তিনি কলসির সহিত দুই হস্ত প্রমান একখণ্ড দড়ি যে কোন মতে 
সংগ্রহ করিয়া,চুপিসাড়ে জলাশয়ে অবতরণ করেন। তৎপর ঐ দড়ির এক
প্রান্ত কলসির গ্রীবায় এবং অপর প্রান্ত নিজ গ্রীবায় বন্ধনপূর্বক ডুব দিয়া 
কলসি টি জলপূর্ণ করিয়া আপনাকে গভীর জলের দিকে ঠেলিয়া দেন। 
ভারী জল পূর্ণ কলসি ঐ রমণীকে আর জলতলের উপরিভাগে উঠিয়া 
শ্বাস গ্রহণের সুযোগ দেয় না,ফলে ঐ রমণী কিছুক্ষণের মধ্যেই  ভব 
যন্ত্রণা হইতে মুক্তি লাভ করেন

এই কলস কি রূপে প্রস্তুত করা হয়,তাহা অবগত হউন। ভিজা এঁটেল 
মূত্তিকা দ্বারা এই কলস কে প্রথমে পৃথক পৃথক ভাবে একাদিক্রমে 
গ্রীবাদেশ,মধ্যদেশ ও তলদেশ এই তিনভাগে ছাঁচে ঢালিয়া প্রস্তুত করা 
হয়। তৎ পরে প্রতিটি খণ্ডকে কাষ্ঠ নির্মিত ছাঁচের উপরে রাখিয়া কাষ্ঠ 
নির্মিত হাতল যু্ক্ত মুদ্গরের সহায়তায় প্রহার করিয়া ঘাত সহ ও শক্ত 
করা হয়। শেষে তিনটি পৃথক খণ্ডকে জল ও কাদা মাটি লেপনের 
সাহায্যে যুক্ত করিয়া প্রখর রৌদ্রে শুষ্ক করা হয়। কয়েক দিন এই প্রকার 
রৌদ্রদগ্ধ করিবার পরে কলস গাত্রে পুনরায় পঙ্ক লেপন করিয়া উহাকে 
বিশেষ উপায়ে নির্মিত চুল্লি তে সারিবদ্ধরূপে সজ্জিত করিয়া রাশিকৃত 
জ্বালানি সহযোগে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। সর্ব শেষে এক মাত্র উত্তম রূপে দগ্ধ 
কলসগুলিই ব্যবহারের উপযোগী বলিয়া বিবেচিত হয়।

ধান ভানিতে শিবের গীতি হইলো,এ ক্ষণে মূল গল্পে ফিরিয়া যাই। প্রাচীন 
বঙ্গে সংস্কৃতই ছিল সাহিত্য চর্চার মূল ভাষা। এই অমৃত মধুর ভাষার 
প্রয়োগে অত্যন্ত অশিষ্ট বিষয়কেও ছন্দ ও অলঙ্কার নৈপুণ্যে শিষ্ট রূপে 
পরিবেশন সম্ভব হইতো। বহুল প্রচলিত ভাষা হওয়ার কারণে স্ত্রী পুরুষ 
নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকেই তখন সংস্কৃত বুঝিতেন। ঐ সময় কালে,
 নদী বিধৌত উত্তরবঙ্গ স্থিত শিলগাড়া নামক এক জনপদে প্রতাপাদিত্য 
নামক এক মেধাবী যুবক বাস করিতেন। যুবকের প্রধান দোষ এই 
যে,অন্যান্য যুবকেরা যথায় যুবকোচিত ধর্মে স্বীয় উপার্জন দ্বারা অন্ন 
সংস্থানের চিন্তা করিতেন,তথায় অলস ও স্বপ্ন বিলাসী প্রতাপাদিত্য কাব্য 
রচনায় কালাতিপাত করিয়া সকলের বিরাগ ভাজন হইতেন। উত্তর বঙ্গের 
মুক্ত উদার প্রকৃতি তাহাকে মুগ্ধ করিতো। জনপদের সীমানা 
ছাড়াইয়া,সবুজ বনভূমি ও তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরের বক্ষস্থল ভেদ 
করিয়া,আঁকাবাঁকা পথে ফুলেশ্বরী নাম্নী যে স্বচ্ছসলিলা নদীটি কুলু কুলু 
রবে বহিয়া যাইতো,তাহা তাহাকে আকর্ষণ করিতো। নদী তীরস্থ 
ছায়াবৃক্ষতলে বসিয়া প্রতাপাদিত্য পরিচিত অপরিচিত নাম না জানা শত
 শত বিহগের কল কাকলি শ্রবণে মুগ্ধ হইতেন। গো-পালক রাখাল 
বালকদিগের বংশীধ্বনি তাহার মন কে আকুল করিতো। প্রকৃতি প্রেমিক 
হইলে মনে কবিত্বের সঞ্চার স্বাভাবিক। প্রতাপাদিত্য যাহাই দেখিতেন,সেই 
বিষয় লইয়াই সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে কবিতা রচনা করিতেন। অপরাহ্ন 
কালে ফুলেশ্বরী নদীতে যে সকল তরুণী যুবতীরা কলস কাঁখে পানীয় 
জল সংগ্রহের নিমিত্ত আসিতেন তন্মধ্যে বিভাবতী নাম্নী এক 
সুদর্শনা,সুকেশী যুবতীর প্রতি প্রতাপাদিত্য আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। বিভাবতী 
কে প্রণয় নিবেদনের উদ্দেশ্যে প্রতাপাদিত্য নিয়মিত অপরাহ্নে নদী 
তীরবর্তী ছায়াবৃক্ষতলে বসিয়া নদী র শোভা নিরীক্ষণ করিতেন এবং 
পশু পক্ষী,কীট পতঙ্গ,বৃক্ষ,লতা মেঘ,নদী যে কোন বিষয় কে উপলক্ষ 
করিয়া চতুরতার সহিত শ্লোক সৃষ্টি করিয়া আবৃত্তির ছলে তাহার 
মনোগত বাসনা ব্যক্ত করিতেন। বিভাবতী যদিও বুঝিতেন,ঐ সকল 
শ্লোকের মূল উদ্দেশ্যই প্রেম নিবেদন,তবুও কটাক্ষপাত না করিয়া আপন 
সহচরীদিগের সহিত নীরবে কলস পূর্ণ করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেন। 


এই রূপে দিন,মাস,বর্ষ পূ্ণ হইল,এক বর্ষ শেষে অপর বর্ষের আগমন 
ঘটিল,তথাপি বিভাবতীর কোন রূপ সাড়া না পাইয়া বিরক্তি তে 
প্রতাপাদিত্যের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল। ইতিমধ্যেই তাহার এই নিয়মিত অপরাহ্নে
 নদী তীরে বসা সমাজপতি অভিভাবক কুলের দৃষ্টি আকর্ষণ 
করিয়াছিল,এবং তাহাদের মধ্যে গোপনে এই বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা ও 
হইয়াছিল। উপরন্তু দিনের পর দিন শ্লোক রচনা করিতে করিতে 
প্রতাপাদিত্যের শব্দ ভাণ্ডারেও টান পড়িয়াছে,তাই মাঝে মাঝেই মুগ্ধ 
দৃষ্টিতে কলস কাঁখে বিভাবতীর অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করা ভিন্ন তাহার 
আর কিছুই করিবার থাকিত না,কারণ ক্লান্ত মস্তিস্ক আর পূর্বের ন্যায় 
সহজেই শ্লোক সৃষ্টিতে সক্ষম হইতো না। দিনের পর দিন রৌদ্র, 
বৃষ্টি,শীত উপেক্ষা করিয়া ঘন্টার পর ঘন্টা নীরবে প্রতীক্ষা সত্ত্বেও 
বিভাবতীর চিত্ত জয়ে সমর্থ না হইয়া প্রতাপাদিত্যের হৃদয়ে বর্ষার এক 
অপরাহ্নে প্রচণ্ড ক্রোধের উদয় হইলো। তিনি স্থির করিলেন,ঐ দিন 
অপরাহ্নে যে উপায়েই হউক,তিনি সরাসরি বিভাবতীর সন্মুখে উপস্থিত 
হইয়া তাহাকে প্রেম নিবেদন করিবেন,এবং ফলাফল যাহাই হউক,এই 
প্রচেষ্টাই তাহার শেষ প্রচেষ্টা।

বর্ষার ধারা স্নাত অপরাহ্নে নব ধারা জলে পুষ্ট,স্ফীত ফুলেশ্বরী নব 
উদ্যমে কল কল খল খল শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে। কাজল কালো মেঘের 
ছায়ায় বৃষ্টি স্নাত কদম্ব রাশির শোভা দর্শনে মন মুগ্ধ,এমন সময়ে 
প্রতাপাদিত্য লক্ষ্য করিলেন,দূরে প্রান্তর মধ্যস্থ পথ বাহিয়া সহচরী 
পরিবেষ্টিত বিভাবতী কলস কাঁখে এক অপুর্ব ছন্দে পদ চালনা করিয়া 
নদী অভিমুখে আসিতেছেন। একেই অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য তাহার মনে 
মুগ্ধতার সৃষ্টি করিয়াছিল,তদুপরি কলস কাঁখে লীলায়িত ছন্দের রমণী 
রূপ,মুগ্ধ প্রতাপাদিত্যের ঘুমন্ত কবিত্ব শক্তিকে জাগাইয়া তুলিল। তিনি চিন্তা
 করিলেন,কত পীড়ন,কত তাপ সহ্য করিয়া টিঁকিয়া থাকে বলিয়াই 
কলস এত ভাগ্যবান। কষ্ট বা দুঃখ বিনা সুখ লাভ সম্ভব নহে। তিনি 
মনে মনে চতুর কৌশলতার সহিত একটি শ্লোক সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। 
কলস জলে পূর্ণ করিয়া,বিভাবতী যখন কলস কাঁখে গমনোদ্যত,তখন 
প্রতাপাদিত্য এক কদম্ব বৃক্ষের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইয়া উদাত্ত কন্ঠে 
বলিলেন:

ন জানাসি কলস ত্বং
ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র।
যত্নে কৃতে যদি ন সিদ্ধতি
মম দোষঃ কোহত্র ?

[হে কলস,তুমি জানো না,ভাগ্যই সর্বত্র কাম্য ফল প্রদান করে। যত্ন 
করিলেও যদি কার্য সিদ্ধি না হয়,তাহা হইলে আমার আর দোষ কি ?]
 
শ্লাঘ্যং নীরস কাষ্ঠ তাড়ন শতং
শ্লাঘ্যঃ প্রচণ্ড আতপঃ
শ্লাঘ্যং পঙ্ক বিলেপনং পুনরিহ
শ্লাঘ্যোহ অতি দাহানলঃ।

[তোমাকে প্রস্তুত করিবার সময়ে কুম্ভকার যে তোমাকে শুষ্ক কাষ্ঠ দণ্ড 
দ্বারা শত শত বার প্রহার করিয়াছে,তাহার ফল তোমার কাছে আজ 
প্রশংসনীয়। তৎ পরে কুম্ভকার তোমাকে যে প্রখর রৌদ্রে দগ্ধ ও শুষ্ক 
করিয়াছে, তাহার ফল ও তোমার কাছে আজ প্রশংসা যোগ্য  মনে 
হইতেছে। সর্বশেষে কুম্ভকার পুনরায় তোমার উপরে পঙ্ক লেপন করিয়া 
যে রূপে প্রচণ্ড অগ্নিতে তোমায় দগ্ধ করিয়াছ ,তাহা ও আজ তোমার 
নিকটে পরম গর্বের বিষয়।]

যৎ কান্তা কুচকুম্ভ
পেলব বাহুলতিকা- 
কটিদেশ হিল্লোল লীলাসুখং
লব্ধং কুম্ভবর ত্বয়া।

[যে হেতু তুমি যুবতী রমণীর কটিদেশে আরোহণ করিয়া,তাহার কোমল
 কুম্ভসদৃস স্তন যুগলের স্পন্দন ও বাহুলতিকা বেষ্টনের স্পর্শ সুখ অনুভব 
করিতেছ, সেই হেতু তোমার সমস্ত ক্লেশ আজ সার্থক।]

নহি সুখং ভাগ্যৈর্বিনা লভ্যতে
ব্যর্থ সর্ব বিদ্যা চ পৌরুষম্
তথাপি তস্য তদেব মধুরং
যস্য মনো যত্র সংলগ্নম্।

[ভাগ্য ব্যতীত সমস্ত বিদ্যা ও পৌরুষ ব্যর্থ,ভাগ্য ব্যতীত সুখলাভ ও 
অসম্ভব। তথাপি  যাহার মন যাহাতে অনুরক্ত,তাহার  নিকট সেই টিই
 সর্বাপেক্ষা সুন্দর।]

বিভাবতী যে প্রতাপাদিত্যের প্রতি এত দিন নজর দেন নাই বা তাহার 
সহিত এত দিন বাক্যালাপ পর্যন্ত করেন নাই,তাহার কারণ এই নয় যে 
বিভাবতী প্রতাপাদিত্য কে পছন্দ করেন নাই। শুধু মাত্র এক বার চোখের
 দেখা দেখিবার জন্য ও মনের কথা প্রকাশ করিবার জন্য যে পুরুষ 
শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা,প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা তাহার জন্য নদী তীরে 
ব্যাকুল নয়নে অপেক্ষা করিতে পারেন, তাহাকে আর যাহা হউক, 
প্রেমিক নহে- এই অপবাদ অন্ততঃ দেওয়া যায় না। প্রতাপাদিত্য কোনরূপ
 উপার্জন করেন না,এইরূপ পুরুষের সহিত কেহ তাহার কন্যার বিবাহ 
দিবে এই রূপ চিন্তা ও বাতুলতা মাত্র,তাই এই প্রেম নিস্ফল হইবে 
ভাবিয়াই বিভাবতী সাড়া দেন নাই। বিভাবতী শুধু সুন্দরীই নন, তিনি
 শিক্ষিতা,এবং গৃহে অবসর সময়ে সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করেন। প্রতাপাদিত্যের শ্লোক শ্রবণে বিভাবতী উপলব্ধি করিলেন যে,  প্রতাপাদিত্য
 সত্যই সাহিত্য রসিক,এবং তাহার মনের সর্বত্র তাহারই আসন পাতা।
 তাই পুলকিত অথচ সংযত স্বরে বিভাবতী কিঞ্চিত অগ্রসর হইয়া 
প্রতাপাদিত্যকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন :

অসারে খলু সংসারে
সার অর্থং সত্যং ইতি
অর্থস্য পুরুষো দাসঃ
দাসস্ত্বর্থো ন কস্যচিৎ।

[অসার সংসারে অর্থই যে সারবস্তু,ইহা অতি সত্য। অর্থ কখনই কাহার 
ও দাস নয় কিন্তু মানুষ অর্থের দাস।]

মাতা নিন্দতি 
ন অভিনন্দতি পিতা
ভ্রাতা চ ন সম্ভাষতে।
ভৃত্যঃ কুপ্যতি 
নানুগচ্ছতি সুতঃ
কান্তা চ ন আলিঙ্গতে।

[অর্থ না থাকিলে মাতা নিন্দা করেন পিতা অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন 
না,ভ্রাতা ও সম্ভাষণ করে না। ভৃত্য অকারণে ক্রোধ প্রকাশ করে,পুত্র 
অবাধ্য হয় এমন কি পত্নী প্রেমালিঙ্গন করে না।]

অর্থ প্রার্থনা শঙ্কয়া
ন কুরুতেহপ্য আলাপ মাত্রং সুহৃত
তস্মাদ অর্থম উপার্জয় শৃণু সখে
অর্থেন সর্বে বশাঃ।

[অর্থহীন ব্যক্তি অর্থ প্রার্থনা করিবে,এই শঙ্কায় বন্ধু বান্ধবেরা তাহার 
সহিত আলাপ পর্যন্ত করে না,অতএব সখা শোনো,অর্থ উপার্জনে যত্নবান 
হও,অর্থের দ্বারা সকলেই বশীভূত হয়।]

এই ঘটনার পরবর্তী কালে প্রতাপাদিত্য আর নদী তীরে সময় ব্যয় না 
করিয়া অর্থ উপার্জনে ব্রতী হইয়াছিলেন। তাহার সহিত তাহার প্রণয়ী  
বিভাবতীর বিবাহ হইয়াছিল,বা হয় নাই,সেই বিষয়ে বিশদ জানিবার 
উপায় নাই। উত্তরবঙ্গের সেই অখ্যাত জনপদ শিলগাড়া আজ বিরাট এক 
উন্নত মানের শহর। ফুলেশ্বরী কালের করাল গ্রাসে আজ এক মৃতপ্রায় 
নালার মতো। সেই বনভূমি ও তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট 
নাই। শুধুমাত্র কিছু লেখকই এইরূপ ঘটনা তাহাদের কল্পনা জগতে বিচরণ 
কালে দেখিয়া থাকেন ও লেখিয়া থাকেন। কাজেই,আজকালের পরিবর্তিত 
পরিস্থিতিতে আর কেহ চরিত্র গুলিকে খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিবেন না।

তবে,পাঠকগণ নিশ্চয় প্রশ্ন করিবেন,এই ঘটনা আজকের দিনে জানিয়া 
আমাদের কি লাভ ? লাভ যেমন নাই,ক্ষতি ও তো তেমন কিছু নাই। 
যে সংস্কৃত ভাষা এত সবল,সুন্দর,এবং অলঙ্করণ ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ,তাহা 
কে আমরা ত্যাগ করিয়াছি,তাই তো অতি আধুনিকতার নামে বাধ্য 
হইয়া আমাদের কু-সাহিত্য হজম করিতে হইতেছে। তাহা ছাড়া,একজন 
লেখক কে লেখার উপযোগী হওয়ার জন্য যেমন অনেক কিছু জানিতে ও 
বুঝিতে হয়,তেমনি উপযুক্ত পরিবেশে সেই সঞ্চিত জ্ঞান কে প্রয়োগ ও 
করিতে হয়। গ্রামে ভ্রমণ কালে, প্রতাপাদিত্য কি রূপে কুম্ভকারগণ কলস 
প্রস্তুত করেন, তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। ঐ জ্ঞান তাহার মনের মধ্যে
 সঞ্চিত ছিল। বিভাবতী র সহিত কথা বলিবার জন্য তাই তিনি সহজেই 
কলস কে অবলম্বন করিয়া, রস সঞ্চার সহকারে আপন বক্তব্য জানাইতে 
পারিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের রসবোধে প্রীত হইয়া বিভাবতী ও তাহাকে 
সুন্দর রূপে বাস্তব জ্ঞান প্রদান করিয়াছেন যে,অর্থোপার্জন ব্যতীত 
পুরুষের সম্পুর্ণতা লাভ হয় না। তাই আমার নিবেদন আপনারা 
প্রতিনিয়ত আপনাদের চতুর্দিকে যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করিতেছেন,তাহার 
সম্বন্ধে যাহা কিছু অবগত হইবেন তাহা কে সুযোগ ও সুবিধা মত 
উপযুক্ত ভাষা সহকারে আপনার লেখায় প্রকাশ করিতে সচেষ্ট 
হইবেন,তবেই তাহা আধুনিক সাহিত্য হিসাবে বিবেচিত হইবে।।

*****************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
*****************************
রচনাকাল : ১১/১২/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bahrain : 8  Bangladesh : 33  Canada : 25  China : 86  France : 3  Germany : 39  Hungary : 5  Iceland : 1  India : 395  Ireland : 34  
Israel : 21  Japan : 2  Kuwait : 12  Netherlands : 31  Norway : 13  Romania : 1  Russian Federat : 12  Russian Federation : 16  Saudi Arabia : 5  Spain : 1  
Sweden : 12  Ukraine : 67  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 14  United States : 813  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bahrain : 8  Bangladesh : 33  Canada : 25  China : 86  
France : 3  Germany : 39  Hungary : 5  Iceland : 1  
India : 395  Ireland : 34  Israel : 21  Japan : 2  
Kuwait : 12  Netherlands : 31  Norway : 13  Romania : 1  
Russian Federat : 12  Russian Federation : 16  Saudi Arabia : 5  Spain : 1  
Sweden : 12  Ukraine : 67  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 14  
United States : 813  
  • ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা (২০)

    ২০১৩ , জানুয়ারী


© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
রম্যরচনা : ন হি সুখং দুঃখৈর্বিনা লভ্যতে by SAMAR KUMAR SARKAR is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০০৮৬
fingerprintLogin account_circleSignup