প্রাচীন বঙ্গভাষী হিন্দু সমাজের সমাজ জীবন ছিল মন্থর ও কর্মবিমুখ।
কন্যাদায়গ্রস্ত গৃহস্থগণের জীবনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল যে কোন উপায়ে কন্যা কে
পাত্রস্থ করা। তাই পাত্র জীবিকা বিহীন হইলেও পাত্রীর অভাব হইত না। ফলে
কর্মহীন,উপার্জনহীন জামাতায় সমাজ পরিপূর্ণ ছিল। এই সব জামাতাগণের
অধিকাংশই শ্বশুরালয়ের দাক্ষিণ্যে সংসার প্রতিপালন করিতেন। হতদরিদ্র কোন
কোন জামাতা জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষ্যে একবার শ্বশুরালয়ে আসিবার সুযোগ
পাইলে সহজে আর গৃহে প্রত্যাগমনের নাম করিতেন না। পুত্রবৎ জামাতা আপন
ইচ্ছায় শ্বশুরালয় পরিত্যাগ না করিলে,তাহাকে তো আর বলা যায় না
-'অনেকদিন হইল,এবার আপনার গৃহে যাও', তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভদ্রতা
বজায় রাখিয়া জামাতা বিতাড়নের নানা কৌশল অবলম্বন করিতে হইত।
দেবভাষা সংস্কৃতে চারি পংক্তির একটি শ্লোকের মাধ্যমে এইরূপ একটি কাহিনী
অতি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হইয়াছে। সংস্কৃত ভাষার বিলুপ্তির ফলে শ্লোক টি
বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত হইলেও, শ্লোকের একটি ক্ষুদ্র অংশ মনুষ্যগণ না
জানিয়া বুঝিয়াই বলিয়া থাকেন। কোন ব্যক্তিকে তাহার অনুচিত কৃতকর্মের
কারণে উত্তমমধ্যম প্রহার কালে অনেকেই আপন জ্ঞান প্রকাশের সহজ কামনায়
"প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ" বাক্যাংশটি বারংবার বলিয়া থাকেন।আপনাদের জ্ঞাতার্থে
শ্লোকটি নিবেদন করিতেছি,কেননা,ক্ষুদ্র শ্লোক টিই গল্পটির উৎস। সংস্কৃত শ্লোক
টি এইরূপ -
"হবির্বিনা হরির্যাতি
বিনা পীঠেন মাধবঃ।
কদন্নৈঃ পুণ্ডরীকাক্ষঃ
প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ।।
[সরল বাংলা অর্থে দাঁড়ায়- 'ঘৃতের অভাবে হরি গেলেন,পীড়া অর্থাৎ
কাষ্ঠাসনের অভাবে গেলেন মাধব,কদর্য অন্ন দেখিয়া পুণ্ডরীকাক্ষ গেলেন,ধনঞ্জয়
গেলেন প্রহারের ফলে।]
এক্ষণে গল্পটি বিবৃত করি।
প্রাচীন বঙ্গ সমাজে এক গৃহস্থ তাহার চারি কন্যাকে নিতান্ত নিরূপায় হইয়া চারি
দরিদ্র পরিবারে পাত্রস্থ করিয়া ছিলেন। ঐ গৃহস্থ ছিলেন পরম বিষ্ণু ভক্ত। তাই
নামের সহিত বিষ্ণুর নামের সাদৃশ্য আছে,কেবল মাত্র সেইরূপ পাত্রদের হস্তেই
কন্যা সম্প্রদান করিয়াছিলেন। জামাতাদিগের মধ্যে জ্যেষ্ঠ জামাতার নাম
হরি,মধ্যম জামাতার নাম মাধব,তৃতীয় জামাতার নাম পুণ্ডরীকাক্ষ,এবং কনিষ্ঠ
জামাতার নাম ছিল ধনঞ্জয়। জামাতাদিগের সকলেই ছিলেন হতদরিদ্র এবং
পরমুখাপেক্ষী। জামাই ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে একবার সপরিবারে শ্বশুরালয়ে প্রবেশের
সুবর্ণ সুযোগ লাভ করিলে তাহাদের কেহই আর সহজে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনে
সচেষ্ট হইতেন না। ঐ গৃহস্থের আর্থিক অবস্থা অনুকূল থাকায় হাস্যমুখেই
জামাতাদিগের আবদার রক্ষা করিতেন। কিন্তু এক বৎসরে ফসল ভাল না হওয়ায়
গৃহস্থ যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হইলেন। তথাপি কন্যা ও জামাতাগণ নিরাশ
হইবে চিন্তা করিয়া জামাইষষ্ঠীতে সকল জামাতাকেই সপরিবারে নিমন্ত্রণ
করিলেন। মহা সমারোহে জামাই ষষ্ঠী পালিত হইল। কিন্তু একে একে দিন গত
হয়,সপ্তাহ গত হয়,মাস গত হয়,জামাতারা কেহই আপন গৃহে প্রত্যাগমনের
উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। আসলে প্রতিদিন নানাবিধ ব্যঞ্জন সহকারে সপরিবারে
নিশ্চিত আহারের সংস্থান ত্যাগ করিয়া কেহই আর সহজে অনিশ্চিত জীবনে
ফিরিতে চাহে না। সকল জামাতাই ভাবেন - অন্যেরা অগ্রে যাউক,আমি না
হয় কিয়দ কাল পরে যাইব। ফসল না হইবার কারণে গৃহস্থ পূর্বেই দুর্দশাগ্রস্ত
ছিলেন,এক্ষণে জামাতাদিগের কল্যাণে ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হওয়ায় পুত্রদের শরণাপন্ন
হইলেন। পিতা ও পুত্রগণ সকলে গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির
করিলেন,জামাতাদিগের কার কোন বিষয়ে দুর্বলতা আছে,তাহা অনুসন্ধান করিয়া
কৌশলে বিতাড়নের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
গৃহস্থের বাটী তে জামাতা অপ্যায়নের বিশেষ এক রীতি ছিল। জামাতারা সুবৃহৎ
সুদৃশ্য কাষ্ঠাসনে বসিয়া আহার করিতেন। বৃহৎ কাংস্য নির্মিত থালায় পর্বতের
চূড়ার মত সজ্জিত সুগন্ধী অন্নের শীর্ষদেশে একটি ক্ষুদ্র বাটিকা খাঁটি গব্যঘৃতে পূর্ণ
থাকিত। থালা বেষ্টন করিয়া তিন চারিটি বৃহৎ কাংস্য বাটি তে নানাবিধ ব্যঞ্জন
থাকিত,আর বৃহৎ কাংস্য নির্মিত গ্লাসে থাকিত পানীয় জল। একদিন জামাতারা
আহারে বসিয়া লক্ষ্য করিলেন, অন্নের চূড়ায় ঘৃতের বাটি অনুপস্থিত। জ্যেষ্ঠ
জামাতা হরির ঘৃতের প্রতি অত্যধিক দুর্বলতা ছিল,তাই অন্য জামাতাগণ আহারে
প্রবৃত্ত হইলেও হরির আঁতে ঘা লাগিল। ক্রুদ্ধ হরি ঘোষণা করিলেন, জামাতা
হইয়া ঘৃতবিহীন অন্ন ভক্ষণ করা তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। সেই দণ্ডেই হরি
পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন।
কিছুদিন পরে জামাতা গণ লক্ষ্য করিলেন,আহার্য দেওয়া হইয়াছে,কিন্তু বসিবার
সুবৃহৎ কাষ্ঠাসন অনুপস্থিত। মধ্যম জামাতা মাধবের কাষ্ঠাসনের প্রতি দুর্বলতা
ছিল,তাই পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়া আহারে প্রবৃত্ত হইলেও,অপমানিত
মাধব রূঢ় স্বরে বলিলেন,জামাতা হইয়া ভৃত্যের ন্যায় মাটিতে বসিয়া আহার
করা তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। সেই দণ্ডেই মাধব পরিবার সহ শ্বশুরালয়
পরিত্যাগ করিলেন।
পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়াই আহার করিতে লাগিলেন, তাহাদের
ঘৃতেরও প্রয়োজন নাই। কয়েক দিবস পরে পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় লক্ষ্য করিলেন,
তাহাদের যে অন্ন দেওয়া হইয়াছে,তাহা কীটদ্রষ্ট বদগন্ধ যুক্ত চাউলে তৈরী।
ধনঞ্জয় আহারে প্রবৃত্ত হইলেও পুণ্ডরীকাক্ষ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া বলিলেন,যে
শ্বশুরালয়ে জামাতাকে কীটদ্রষ্ট বদ গন্ধযুক্ত চাউলের অন্ন পরিবেশন করা হয়,
সে গৃহে আহার করা তাহার পক্ষে অপমান জনক। সেই দণ্ডেই পুণ্ডরীকাক্ষ
পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন।
ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়া সাধারণ থালায় কদর্য অন্নই শুধুমাত্র এক প্রকার ব্যঞ্জন
সহযোগে আহার করিতে লাগিলেন। নানা কৌশলেও তাহাকে বিতাড়ন করিতে না
পারিয়া একদিন শেষ চেষ্টা দেখিবার আশায় ধনঞ্জয় কে পানীয় জল ও কোনরূপ
ব্যঞ্জন ছাড়াই শুধুমাত্র কদর্য অন্ন দেওয়া হইল। একে কদর্য অন্ন, তদুপরি
ব্যঞ্জনহীন । ধনঞ্জয় অন্ন দ্বারা গোলাকার কয়েকটি মণ্ড প্রস্তুত করিয়া আহারে
প্রবৃত্ত হইলেন। শুষ্ক অন্নের মণ্ড কণ্ঠদেশে আবদ্ধ হওয়ায় এবং পানীয় জল না
থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হইয়া ধনঞ্জয় গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিলেন।শ্যালকেরা
অন্তরালেই ছিলেন। তাহারা দ্রুতবেগে আসিয়া কণ্ঠদেশ মুক্ত করিবার আছিলায়
বেশ কয়েকবার ধনঞ্জয়ের ঘাড় ও গলদেশে একাধিক কিল ও চড়
মারিলেন,তৎপরে গণ্ডদেশে সজোরে চপেটাঘাত করিয়া গ্রাম্য ভাষায় বলিলেন,
"অনেক নাক কাটা, কান কাটা দেখিয়াছি,তোমার মত চোখের চামড়া ছাড়ানো
লোক দেখি নাই।তুমি কোন আক্কেলে শুকনো মোটা ভাতের পিণ্ডি গিলিতে গেলে ?"
অতঃপর মাথায় মুখে জল দিয়া ও জল পান করাইয়া ধনঞ্জয় কে বিপন্মুক্ত করা
হইল। কিন্তু শ্যালকেরা কিল,চড় মারিয়াছে,সেই অভিমানে ধনঞ্জয় অবশেষে
পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন।
সুখের কথা,পরবর্তী কালে আমন্ত্রণ জানাইলেও জামাতারা কেহই আর শ্বশুরালয়ে
জামাই ষষ্ঠী তে আসিতেন না। পুঁথিগত বিদ্যা অপেক্ষা হাতে কলমে প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতা লাভের মূল্য তো আর কম নয়!!
****************************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
****************************************
রচনাকাল : ২৬/৬/২০১৩
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।