রম্য রচনা : ফেসবুকে বয়স লুকানোর টিপস ও তজ্জনিত সমস্যা
আজকাল আর ফেসবুকের বিকল্প নেই। দাদ,হাজা,চুলকানি থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী ক্যান্সারের ঔষধ ও নিরাময়ের উপায় পর্যন্ত আজ বিনা মূল্যে,বিনা পরিশ্রমে ফেসবুকের পাতায় পাওয়া যায়। ফুল ও ফল গাছের পরিচর্যা,ছাগল,কুকুর ও বিড়াল পালনের উপায় ও ফেস বুকেই পাবেন। রূপচর্চার ও রান্না বান্নার নানা পদ্ধতি তো হর বখত পাওয়া যায়। জনৈক লেখক বন্ধু ফেসবুকে আমাদের বয়স লুকানোর কিছু মূল্যবান উপায় বা টিপস দিয়েছেন। তার লেখাটি হুবহু এইরূপ :--
বয়স লুকাতে চান ? আপনার জন্য কিছু টিপস্:
১. সপ্তাহে তিন দিন রাতে ভালো মানের মধু খান ও মুখে মেখে ধুয়ে ফেলুন।
২. অবশ্যই নিয়মমাফিক জল পান করুন।
৩. অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলুন।
৪. পছন্দের বা বিনোদনমূলক স্থানগুলো ভ্রমণ করুন।
৫. ছলনা করবেন না। ভালোবাসায় ছলনা আপনাকে অচিরেই বুড়িয়ে দেবে।
৬. প্রেমিকা বা প্রেমিকের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।
৭. নিজের চেয়ে বয়স বেশি,এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটান বেশি বেশি।
৮. ইতিবাচক চিন্তা করুন। নেতিবাচক চিন্তা চেহারায় বসয়ের ছাপ ফেলে।
৯. চোয়াল খানিক এলিয়ে থাকতে দিন। মুখের ভারিক্কি ভাব দূর হয়ে যাবে।
১০. শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস করুন।
১১. সুযোগ পেলে নাচুন।
১২. বেশি বেশি মন খুলে হাসুন।
১৩. মন থেকে ভালোবাসুন বই,গাছ,আকাশ।
১৪. সবসময় উদ্যমী ও প্রাণবন্ত থাকুন।
১৫. নিয়ম করে ঘুমান।
১৬. বৃক্ষজাত খাবার বেশি খান।
১৭. মুটিয়ে যাবেন না কখনই। মুটিয়ে যাওয়া মানেই নিজেকে বয়সী করে তোলা।
তা অনেক দিন ধরেই ভাবছি বয়স টা কি করে লুকানো যায় ? কারণ বর্তমানে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। আর ফেস বুকে আজ থেকে ১০ বছর আগে তোলা যে রঙীন ফটো দিয়েছিলাম,তা দেখতে দেখতে সকলের অরুচি ধরে গেছে। অনেকেই বলেন,দাদা এক ছবি দিয়ে আর কত দিন চালাবেন? অনেকে বলেন,কি কৃপণ আপনি,সখ করে নিজের ছবি ও তোলেন না ? কিন্তু ছবি বদলাতে গেলেই,নতুন ছবি তুলতে হবে,আর তাতে বয়সের ছাপ পড়বে। আর আমি যতই ভাল লিখি না কেন,চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লে, পাঠক কুল সে লেখা পড়লেও পাঠিকারা ক্রমশঃ দুরে সরে যাবেন। তখন কি দুঃখে আমার বুক ফেটে যাবে না ?
তারপরে আজকাল ফেসবুকের এক চল হয়েছে,সারাদিন কেবল লেখক লেখিকাদের ঘন ঘন প্রোফাইল পিকচার পাল্টানোর ট্যাগ পেয়ে বা নোটিফিকেশন দেখে লাইক মারা,বা মন্তব্য লেখার দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশেষ করে লেখিকাদের ক্ষেত্রে দেখেছি,যদি কোন লেখিকা সাকুল্যে কবিতা লেখেন মাত্র পাঁচটা,তো ছবি পোষ্ট করেন কম সে কম পঞ্চাশ টা। আরে বাবা ! সারা বছর শয়ে শয়ে লেখক লেখিকার ফটো তে আমি লাইক মেরে যাবো,মন্তব্য লিখে হাত ব্যথা করবো,আর আমার ফটো তে কেউ একটা ও লাইক মারবেনা,তা কি সহ্য হয় ? তাই প্রোফাইল পিকচার-এ একটু তরুণ তরুণ ভাব আনার জন্য বয়স কি করে কমানো যায় বা চেহারাটা দেখতে কম বয়সীদের মত হয়,সেই উপায় খুঁজছিলাম। কিন্তু আজ মেঘ না চাইতেই জল,উপরের টিপস গুলি পেয়ে গেলাম।
কিন্তু মন দিয়ে পড়ে,পরামর্শ গুলো মানতে গিয়ে দেখি নানা সমস্যা। লেখক/লেখিকা,পাঠক/পাঠিকা বা পরিচিত কেউ সমস্যাগুলোর সমাধান করে দিলে বা সমাধানের উপায় বলে দিলে বড়ই বাধিত হই।
১.লেখক বলেছেন -"সপ্তাহে তিন দিন রাতে ভালো মানের মধু খেতে ও চেহারায় মধু মেখে ধুয়ে ফেলতে।"
বুঝুন ঠ্যালা,এখন মধু বলে বাজারে যা পাওয়া যায়,তা স্রেফ গুড়ের জল। খাঁটি মধু না হয় সুন্দর বন থেকে এক হাঁড়ি আনিয়েই নেব। কিন্তু চেহারায় রাতের বেলায় মধু মাখলেই গিন্নী দেখে ফেলবেন এবং কারণ জিজ্ঞাসা করবেন। তখন বিষয় টি আর গোপন থাকবে না। গিন্নী মনে করবেন,এই বয়স কমানোর চেষ্টা নিশ্চয় অপর কোন রমণীর কারণে,কেন না,তিনি আমাকে মুখে মধু মাখতে বলেন নি,আর এতদিন তার কথা চিন্তা করে,মধু কেন,ময়দা ও মাখি নি। আর রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে মুখে মধু মাখলে হয়ত অনেক সময় ধোওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না। ফলে বিছানা,বালিশের দফা রফা হবে। তা ছাড়া মধুর গন্ধে মধুলোভী পিঁপড়ের দল এসে হাজির হবে। তখন সারা রাত্রি মুখে পিঁপড়ের কামড় খেতে হবে !! পাশে গিন্নী থাকলে আমার কারণে তাকেও পিঁপড়ের কামড় খেতে হবে। তখন গিন্নী কি আমায় ছেড়ে দেবেন ? আপনারাই বলুন,এর বিকল্প উপায় কি ?
২.লেখক বলেছেন -"ছলনা করবেন না। ভালোবাসায় ছলনা আপনাকে অচিরেই বুড়িয়ে দেবে।"
আপনারাই বলুন,ছলনা ছাড়া প্রেম হয় ? যাদের কপাল ভাল,তাদের দুই একজনের ভাগ্যে সুন্দরী বা অতি সুন্দরী প্রেমিকা বা স্ত্রী জুটে যায়। আর বাকি রা কি করবে ? যে মেয়ের চোখ গোল গোল,তাকে আদর করে বলতে হবে,তোমার পটল চেরা চোখ আমাকে মুগ্ধ করেছে? গরুর মত চোখ যে মেয়ের,তাকে আদর করে বলতে হবে মৃগনয়নী ? খ্যাঁদা মেয়ের নাক টিপে বলতে হবে,আহা,তুমি যে উন্নত নাসা শুক পক্ষী গো ? হাতীর মত থপথপ করে চলে যে রমণী,তাকে আদর করে বলতে হবে প্যার কে বুলবুল? আর সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে যার দাঁত ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না,তাকে ও আদর করে বলতে হবে নুর ই চশমে অর্থাৎ চোখের আলো ? ছলনা না করে কি ভাবে ভালবাসা প্রকাশ করবো? তবে কি ছলনা না করে এইভাবে সত্যি কথা বলে প্রেম করবো--"দ্যাখো,তোমাকে দেখতে তো শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর মত,চোখগুলো গোল গোল গরুর মত,তাও আমার ভাগ্যে এর চেয়ে ভাল জোটে নি বলে,বাধ্য হয়ে তোমাকে স্বর্গের পরী বলি,নূর ই চশমে বলে আদর করি।"?
৩.লেখক বলেছেন -"প্রেমিকা বা প্রেমিকের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।"
প্রেমিকার সঙ্গে বেশী সময় কাটাতে কে না চায় ? কিন্তু তাতে দুই ভাবে ক্ষতি। এক,আপনি যদি পেশাদার ব্যক্তি হন,তবে যতক্ষণ প্রেমে সময় কাটালেন,ততক্ষণ পেশার ক্ষতি অর্থাৎ আয়ের ক্ষতি। দুই যতক্ষণ প্রেম করবেন,ততক্ষণ উপহার দেওয়া,বা গাড়ীতে চড়ে ভ্রমণ করা,বা দামী হোটেল রেঁস্তোরাতে অপ্যায়ন বাবদ আর্থিক গুণাগার সহ্য করতে হবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে,বা পার্কে প্রেমিকা কে পাঁচ টাকার ঘুগনী বা আলুকাবলী খাইয়ে,ঘুগনি বা আলুকাবলি কেমন ঝাল পরীক্ষা করার ছলে প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু দেওয়ার দিন শেষ। আর রিক্সা বা সাইকেলের রডে বসে আজকের দিনে কেউ আপনার সাথে প্রেম করতে যাবে,এমন ভাবা মুর্খামি। ঝাঁ চকচকে গাড়ী,নিদেন পক্ষে দামী বাইক না দেখলে আজ আর প্রেমিকাদের মন টলে না। গাড়ী,রেষ্টুরেন্ট এত হ্যাপা সামলে যদি বা নিরালা এক কোণে একটু বসলেন,তাও কি উপায় আছে ? পাঁচ থেকে পঁচাশি সবার হাতেই আজকাল দামী মোবাইল,আই পডের ছড়াছড়ি। আর আদেখলা গুলো বিনা কারণেই কেবল ফটো তুলে চলে। এইরকম কারো ফ্রেমে বন্দী প্রেমিকা সহ আমার প্রেমের ছবি যদি কোন ভাবে বাড়ীর কারো হাতে পড়ে বা ফেসবুকে কোন উজবুক যদি ঐ ফটোই ব্যবহার করে প্রেমের রগরগে কবিতা লেখে,আর ফেসবুক ফ্রেণ্ড হবার কারণে,আমার ছেলে মেয়ে বা গিন্নীর চোখে পড়ে যায় ঐ ছবি,তবে আমার কি দশা হবে ?
৪.লেখক বলেছেন- " নিজের চেয়ে বয়স বেশি,এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটান বেশি বেশি।"
আরে একি গেরো ? এক মুখে দুই রকম কথা বললে হবে ? এই বললেন প্রেমিকা বা প্রেমিকের সঙ্গে বেশি সময় কাটান,আবার বলছেন নিজের চেয়ে বয়স বেশি,এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটান বেশি বেশি। তার মানে আমার যা বয়স,তার চেয়ে পাঁচ বা দশ বৎসর বেশী বয়সের পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে বেশী বেশী সময় কাটাতে হবে ? বেশী বয়সের পুরুষ হলেই,কথায় কথায় জ্ঞান দিয়ে মেজাজ টাই মাটি করে দেবেন। আর বেশী বয়সের মহিলা,যদি মাসি,পিসি,দিদি বা বৌদি সমগোত্রীয়া না হন,তা হলে আমাকে তরুণ পেয়ে,আকৃষ্ট করার মানসে নানা সাজগোজ,নানা ছলাকলা শুরু করবেন। আরে রাম রাম,আমার মাথা তা হলে ঘুলিয়ে যাবে,আর কবিতার বদলে এবড়ো খেবড়ো লেখা বেরোতে থাকবে। পুরানো মদ,পুরানো ঘি বেশী মূল্যবান সন্দেহ নেই,কিন্তু বয়স্ক প্রেমিকার হ্যাপা সামলানো আমার কর্ম নয়।
৫.লেখক বলেছেন-"চোয়াল খানিক এলিয়ে থাকতে দিন। মুখের ভারিক্কি ভাব দূর হয়ে যাবে।"
আরে,ইচ্ছা করলেই কি চোয়াল এলানো যায় ? চোয়াল ইচ্ছা করে এলাতে গেলে মুখ হাঁ হয়ে থাকে। সারাদিন কি মুখ হাঁ করে অফিসে কাজ করবো ? তবে তো লোকে হাঁ-মুখো বলবে। তবে যদি কোন বক্সার কে ডেকে এনে চোয়ালে দুটো আপার কাট মারানো যায়,তবে অবশ্য সারা জীবনের জন্য চোয়াল একেবারে পাকাপাকিই এলিয়ে যাবে। তবে তখন আর থ্যাবড়া মুখ নিয়ে ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার পাল্টিয়ে লাভ নেই,যে দুই একজন বন্ধু বান্ধবী আছেন,তারাও ছবি দেখে আমায় ছেড়ে চলে যাবে।
৬.লেখক বলেছেন-" শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস করুন।"
আরে আমি কি কাকতাড়ুয়া, যে সারাদিন বেগুন ক্ষেতে সোজা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় দোল খাবো ! নাকি হোটেলের বয়,না বারের পেগ সার্ভার,যে শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে থাকবো? শিরদাঁড়া ভাজ করে কি কি উপায় আছে,তাই আপনারা বলুন।
৭.লেখক বলেছেন - "সুযোগ পেলে নাচুন।"
আহা রে দাদা,কি বিধান টাই দিলেন মাইরি!! সারাদিন অফিসের কাজ,বাড়ীর কাজ,দোকান বাজার এ সব করে নাচার সময় কই ? আবার নাচতে গেলে মোটা টাকা খরচ করে নাইট ক্লাবে সঙ্গিনী সহ এক রাত্রিতে কম করে হাজার দশেক টাকা খরচ। বাড়িতে ছেলে মেয়ের চোখ বাঁচিয়ে যদি গিন্নী কে কখনও বলেন "ও গো এসো একটু নাচি", গিন্নী কি রাজী হবেন ? তবে এক কাজ করা যেতে পারে,কুং ফু র পোষাক পরে সকালে খোলা মাঠে নাচের কায়দায় লাফালে,কেউ পাগল ভাববে না,মনে করবে আপনি কসরৎ শিখছেন।
৮.লেখক বলেছেন --"নিয়ম করে ঘুমান ।"
আরে ভাই,নিয়ম করে যদি ঘুমাতেই যাবো,তবে সারারাত জেগে ফেসবুক করবে কে ?
সুধী পাঠক পাঠিকা বৃন্দ,আপনারাই ভরসা,যদি সম্ভব হয়,সমস্যাগুলোর সমাধান আমায় অবশ্যই জানাবেন।
রচনাকাল : ৩০/১২/২০১৩
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।