দেবর্ষি নারদের মুখ ভার,হৃদয়ে কণা মাত্র সুখানুভূতি নাই।সৃষ্টির আদি
লগ্ন হইতে দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, কিন্নর, মুনি, ঋষি, মায় নর
কুল, সকলেই কলহ কালে ঘোর বিবাদের উদ্ভব হইলে, দেবর্ষি কে স্মরণ
করিতেন। দেবর্ষি উৎফুল্ল চিত্তে স্বয়ং উপযাচক হইয়া বাদী ও বিবাদী
উভয় পক্ষের নিকট গমন করিয়া এরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ মন্ত্রণা দান
করিতেন যে, কলহ ভয়াল রূপ ধারণ করিত, এবং অবশেষে দেবর্ষি
যোগ্যতর পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহাকে বিবাদে জয়ী হইতে সাহায্য
করিতেন। এই উপায়ে তিনি বিশেষ আত্মসুখ লাভ করিতেন এবং নিজের
ও মহাত্মাদিগের মহিমা প্রচার করিতেন। কিন্তু বর্তমান কালে দেবতা
দানব বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ নাই বলিলেই চলে।
মনুষ্যলোকের মনুষ্যেরা এখন স্বয়ং কলহ নিপুণ, নিজেরাই কলহ করেন,
নিষ্পত্তি না হইলে আদালতের দ্বারস্থ হন। অতএব দেবর্ষির মহিমা এখন
লুপ্ত প্রায়। হৃত গৌরব উদ্ধার হেতু নারদ মনস্থ করিলেন স্বর্গলোকের
তিন দিকপাল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যে কোন একজনকে যদি
কলহে প্ররোচিত করা যায়, তবে তাহার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের পথ
প্রশস্ত হয়। ব্রহ্মা একে অতি বৃদ্ধ, তায় পরম জ্ঞানী, তাহাকে কলহে
প্ররোচিত করা দুষ্কর। বিষ্ণু দেবতা গণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা চতুর, এবং
তিনি দেবর্ষির উপাস্য দেবতা, সুতরাং এই পরিকল্পনা রূপায়ণ ও
অসম্ভব। কৈলাসপতি মহেশ্বর একে ভোলে ভালা নেশাখোর, তায় পু্ত্র ,
কন্যা ও ভার্যা সহ এক পরিবারের প্রধান। দেবর্ষি জানেন, যিনি
নেশাখোর, স্বভাব ক্ষ্যাপা এবং সংসার প্রতিপালনে নিমগ্ন, তাহাকে
সহজেই কলহে লিপ্ত করানো সম্ভব। কিন্তু কলহতেও ক্ষেত্রের প্রয়োজনহয়।
সুচতুর দেবর্ষি জানেন কলহের যত উৎস বিদ্যমান, তন্মধ্যে স্ত্রী জাতিই
সর্বোৎকৃষ্ট। শরৎকাল আগত প্রায় , দেবী দুর্গা সপরিবারে মর্ত্যভূমে
পিত্রালয় গমনের আয়োজনে ব্যস্ত। যদি বুদ্ধি বলে শিব ও পার্বতীর মধ্যে
বিবাদের সূচনা সম্ভব হয়, তবে উপায় লাভ সম্ভব। অতএব, দেবর্ষি
উপায় উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হইলেন।
দেবর্ষি মর্ত্যলোকের এক শপিং মল হইতে এক অত্যাধুনিক শক্তিশালী
ল্যাপটপ উত্তোলন করিয়া মহেশ্বর সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, "প্রভু,
এই অমূল্য যন্ত্রে মর্ত্যের যাবতীয় লোকদিগের জীব লীলা প্রত্যক্ষ
করুন, স্বয়ং ফেসবুক বা মুখ পুস্তিকাতে অংশ গ্রহণ করতঃ ভক্তদিগের
সম্বন্ধে সম্যক অবগত হউন। অতঃপর দেবর্ষি মহেশ্বরকে ফেসবুকে
ভোলানাথ মহেশ্বর নামকরণে একটি প্রোফাইল খুলিয়া দিলেন , এবং
ফেসবুকে কি কি কার্যক্রম কি কি উপায়ে সম্পন্ন হয়, তাহা বিশদ রূপে
বুঝাইয়া দিলেন। মহেশ্বর আমার বা আপনাদের মত চাকুরী বা ব্যবসায়
নিযুক্ত নহেন, কাজেই অখণ্ড অবসর, তাই নুতনকে জানিবার প্রয়াসে
সমগ্র বিশ্বের ১০-১২ কোটি প্রোফাইল হাতড়াইয়া আনন্দিত চিত্তে
কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। অভিজ্ঞতা শুধু মানুষকেই নয়, ঈশ্বরকে
ও সমৃদ্ধ করে। মহেশ্বর লক্ষ্য করিলেন , ফেসবুকে জনপ্রিয় এবং সর্বজন
পরিচিত হইবার সহজতম পন্থা হইল, কারণে হউক আর অকারণে
হউক, নিজের এবং পরিবারের সকলের রঙ্গীন আলেখ্য ( ফটো )
নিয়মিত প্রকাশ করিয়া নিজেকে জাহির করা। ক্ষেপা মহেশ্বর তৎক্ষণাৎ
নন্দি নামক অনুচরকে প্রেরণ করিয়া নারদকে আনয়ন করিলেন এবং
সন্মান প্রদর্শন পূর্বক আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। দেবর্ষির খুশীর
অন্ত নাই, তিনি আনন্দিত, কারণ, দেবের দেব মহাদেব ও মনুষ্য সৃষ্ট
ফেসবুকের প্ররোচনায়, যশের কাঙাল হইয়া স্বেচ্ছায় তাহার জালে ধরা
দিয়াছেন। অতএব গৃহবিবাদের লগ্ন আসন্ন। মহেশ্বর দেবর্ষি কে সতর্ক
করিয়া কহিলেন, "আমি ভিন্ন আর সকলের আলোক চিএ গ্রহণের সময়
খেয়াল রাখিবে, যেন তাহারা বুঝিতে না পারেন যে তাহাদের আলোক
চিত্র গৃহীত হইয়াছে। আরও খেয়াল রাখিবে, আলোক চিত্র গ্রহণের সময়
যেন কাহার ও হস্তে অস্ত্র-শস্ত্র, লীলাকমল, শঙ্খ, চক্র, রত্নসিন্দুক
,বীণা প্রভৃতি দেবচিহ্ন্ বর্তমান না থাকে এবং সঙ্গে যেন কোন বাহন
না থাকে। যথা আজ্ঞা বলিয়া দেবর্ষি স্বয়ং জাপান হইতে মহা মূল্যবান
ক্যামেরা ও গুপ্ত ক্যামেরা আনয়ন করিয়া আপন কার্যে প্রবৃত্ত হইলেন।
প্রথমে মহেশ্বর ফেসবুকের ওয়ালে আপন চিত্র প্রকাশ করিলেন। মস্তকে
সর্প, চন্দ্র বা গঙ্গার চিহ্নমাত্র নাই, গলায় সর্পের কুণ্ডলী নাই, পরণে
ব্যাঘ্রচর্ম ও মস্তকে জটা থাকিলেও ললাটের ত্রিনয়ন লুক্কায়িত থাকায় এবং
সাথে ত্রিশূল ও ডমরু না থাকায় কাহারও সাধ্য নাই তাহাকে কৈলাসপতি
শিব বলিয়া শনাক্ত করেন। বরঞ্চ জটাধারী ,ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত অনিন্দ্য
সুন্দর যোগী মুর্তি দেখিয়া দেশ বিদেশের পুরুষ স্ত্রী নির্বিশেষে কয়েক শত
ভক্ত মহেশ্বরের ওয়ালে মন্তব্য করিলেন। অনেকে তাহার শিষ্য শিষ্যা
হইবার মনোবাসনা ব্যক্ত করিলেন। কতিপয় পুরুষ আসক্ত মহিলা এমনকি
ইনবক্স ম্যাসেজে তাহাকে পতি রূপে কামনা করিয়া দীর্ঘ প্রেমপত্র প্রেরণ
করিলেন। মহেশ্বর অভিভূত, সামান্য এক আলোকচিত্র প্রকাশ করিয়া মাত্র
একদিনে এত ভক্তের সাড়া পাওয়া কি কম কথা? পুরাকালে শিব
মাহাত্ম প্রচার কল্পে তাহাকে কতই না হীন পন্থা অবলম্বন করিতে
হইয়াছে। দৈব বলে বনের সমস্ত পশুপক্ষী কে লুক্কায়িত রাখিয়া ব্যাধ কে
ক্ষুধার্ত থাকিতে বাধ্য করিয়াছেন। নিশাকালে হিংস্র জন্তুর আক্রমণের
ভয়ে ব্যাধ সন্মুখেই মায়াবলে সৃষ্ট বিল্ববৃক্ষ দেখিয়া তাহাতে আরোহণ
করিলে, নিজে বিল্ববৃক্ষের তলদেশে সারা রাত্রি ঠায় বসিয়া থাকিয়াছেন।
শেষ রাত্রে ক্ষুধায় কাতর ব্যাধ রোদন শুরু করিলে, তাহার কয়েক
ফোঁটা অশ্রুজল গড়াইয়া শিথিল বৃন্তযুক্ত বিল্বপত্রের উপর পতিত হইয়াছে
এবং কাকতালীয় ভাবে সেই বিল্বপত্র তাহার মস্তকে পতিত হইয়াছে। তখন
তিনি স্বয়ং ব্যাধকে দর্শন ও বরদানে প্রীত করিয়া আপন পূজার মাহাত্ম
প্রচার করিয়াছেন। আর এক্ষণে এই অপূর্ব যন্ত্রের কল্যাণে বিনা পরিশ্রমে
একদিনেই এত ভক্তের সাড়া পাইলেন। এমন ধারা সচল থাকিলে অতি
অল্পকাল মধ্যেই তিনি বহুবন্দিত হইবেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
অতঃপর মহেশ্বর গণেশের আলোক চিত্র প্রকাশ করিলেন। নারদ সতর্কতা
অবলম্বন করায় গণেশের মাথায় মুকুট , হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম
না থাকা সত্ত্বেও গজমুণ্ড ও লম্বোদর হেতু সকলেই গণপতি কে শনাক্ত
করিলেন।দেশে বিদেশে বসবাসকারী যাবতীয় গুজরাতি, সিন্ধী ও
মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীগণ "গণপতি বাপ্পা মরিয়া" মন্তব্যে মহেশ্বরের ওয়াল
পরিপূর্ণ করিলেন। কতিপয় ব্যবসায়ী গণপতির মস্তকে স্বর্ণ মুকুট ও গাত্রে
রত্নালঙ্কারাদি অদর্শনে এমন মন্তব্য ও করিলেন যে আগামী কয়েক মাসের
মধ্যে কয়েক কোটি টাকার মোটা দাঁও মারিতে পারিলে অবশ্যই গণপতির
নামে স্বর্ণ মুকুট, রত্নালঙ্কার ও কয়েক কুইন্টাল লাড্ডু চড়াইবেন। আপন
পুত্রের প্রতি মনুষ্য সমাজের এইরূপ প্রীতি সন্দর্শনে মহেশ্বর আবেগাপ্লুত
হইলেন। কার্তিকেয়র আলোক চিত্র প্রকাশ মাত্র চতুর্দিকে সাজো সাজো
রবের উদ্ভব হইল। কার্তিকেয়র এমন সুন্দর গ্রীক ভাস্কর্যের মত দিব্য
সুন্দর রূপ দর্শনে তাবৎ রমণী কুল প্রেম শরাবদ্ধ হইলেন। বিশ্বের বিভিন্ন
প্রান্ত হইতে কয়েক কোটি সুন্দরী যুবতী ইংরাজী, ফ্রেঞ্চ, জার্মানী,
রাশিয়ান, পর্তুগীজ, ল্যাটিন, জাপানী, চৈনিক প্রভৃতি বিদেশীয় ভাষায়
এবং তামিল, তেলেগু, কন্নর, মালয়ালম, আসামী, বাঙলা , হিন্দী
প্রভৃতি ভারতীয় ভাষায় কার্তিক কে প্রেম নিবেদন করিয়া মন্তব্য
লিখিলেন এবং সঙ্গে আপনাদিগের আলোকচিত্র প্রেরণ করিলেন। মহেশ্বর
স্বগতোক্তি করিলেন: আমার বীর পুত্র কার্তিকেয় দেবতাগণের সেনাপতি,
অথচ কোন দেবকন্যা কার্তিকেয় কে প্রণয় নিবেদন করে নাই , তাই
সে চিরকুমার রহিয়া গিয়াছে, অথচ মর্ত্যে তাহার কি রূপ জন প্রিয়তা।
এই জনপ্রিয়তা অবলম্বনে গণেশের ন্যায় সর্বত্র কার্তিকের পূজার প্রচলন
করিতে হইবে। সর্বশেষে মহেশ্বর একযোগে দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর
আলোক চিত্র প্রকাশ করিলেন। দেবর্ষি নারদ গুপ্ত ক্যামেরায় দেবী দুর্গার
যে আলোকচিত্র গ্রহণ করিয়া ছিলেন, তাহাতে বাহন সিংহের ছবি তো
ছিলই না, উপরন্তু দুর্গার ত্রি-নয়ন লুক্কায়িত ছিল এবং দেবীর দশটি
বাহুর বদলে মাত্র দুইটি বাহু ছিল। কারণ শুধুমাত্র অসুর বিনাশের
প্রাক্কালেই দেবীর দশটি বাহুর উদ্ভব হয় এবং তিনি দশ ভুজে দশ প্রহরণ
ধারণ করতঃ অসুরদের বিনাশ করেন। লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর আলোক
চিত্রেও কোন বাহনের ছবি বা বীণা বা ঝাঁপি প্রভৃতি পরিচিত বস্তু ছিল
না। দুর্গা ও লক্ষ্মীর তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ সদৃশ ভুবনমোহিনী রূপ ও
সরস্বতীর সৌধ ধবল শ্বেতপ্রস্তরের ন্যায় অপরূপ রূপ লাবণ্য দর্শনে বিশ্ব
ব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি হইল। বিশ্বব্যাপী ফেসবুকের প্রায় সাত কোটি
পুরুষ সদস্যের মধ্যে ন্যূনপক্ষে প্রায় পাঁচ কোটি সদস্য মন্তব্যে মন্তব্যে
মহেশ্বরের ওয়াল পরিপূর্ণ করিলেন। ফেসবুকে অকস্মাৎ এই জন জোয়ারের
প্রভাব দর্শনে ফেসবুকের শেয়ার দর তিন চারি গুন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল।
মন্তব্য পড়িয়া মহেশ্বরের চক্ষু ক্রোধে অগ্নি বর্ণ ধারণ করিল। দুর্বৃত্ত
মনুষ্যগণ দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে সুন্দরী রমণী ভ্রমে তাহাদের মনের
যাবতীয় লালসা উজার করিয়া মন্তব্য লিখিয়াছেন। এশিয়া, ইউরোপ,
আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা প্রভৃতি সমস্ত মহাদেশের
পুরুষ দিগের একই রকম আচরণে শঙ্কর মহাক্রোধে কাঁপিতে লাগিলেন।
সরোষে নন্দী ভৃঙ্গি ও ভূতগণকে ডাকাইয়া আদেশ দিলেন, "সকলে
প্রস্তুত হও,পৃথিবী পাপে পরিপূর্ণ হইয়াছে, এক্ষণি সমস্ত পাপের বিনাশ
সাধন না করিলে সৃষ্টি রসাতলে যাইবে। ফেসবুকে যত লম্পট পুরুষগণের
নাম পাইবে, সব লিপিবদ্ধ করো, তৎপর একে একে সকলের প্রাণ
সংহার করিবে। আমার ত্রিশূল আনয়ন করো, আমি ত্রিশূল নিক্ষেপ
করিয়া ফেসবুকের সংযোগ রক্ষাকারী যাবতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ কে এই
মুহূর্তে ধ্বংস করিব। আর তোমরা সকলে জননীকে সংবাদ জানাইয়া
আইস, এ বৎসরে মর্ত্যভূমে পুত্র কন্যা সহ পিত্রালয়ে ভ্রমণ ও পাপিষ্ঠদের
পূজা গ্রহণ আমি নিষিদ্ধ ঘোষণা করিলাম। সকলে মিলিত ভাবে গালবাদ্য
ও ডমরু বাজাও, আমি ধ্বংসলীলার প্রস্তুতি স্বরূপ তাণ্ডব নৃত্য শুরু
করি।" অনুচরগণ দেবী দুর্গা কে সংবাদ প্রেরণ করিবার পর মহা
সমারোহে ববম...বোম....ববম.....বোম শব্দে গালবাদ্য শুরু
করিল ও মহা সমারোহে ডমরু বাজাইতে লাগিল। মহেশ্বর নাচের মুদ্রা
শুরু করিবা মাত্র পদকম্পনে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল কাঁপিতে শুরু করিল।
প্রবল কম্পনে ও মহা শোরগোলে অন্যান্য দেবতা গণ তথায় উপস্থিত
হইলেন। দেবর্ষি নারদ এতক্ষণ অন্তরালে থাকিয়া মজা অনুভব
করিতেছিলেন, এক্ষণে সন্মুখে উপস্থিত হইলেন। ইতিমধ্যে পিত্রালয়ে গমন
নিষিদ্ধ শুনিয়া মহা ক্রোধে দেবী দুর্গা পুত্র কন্যা সহ তথায় উপস্থিত
হইলেন। দেবতা গণ করযোড়ে মহেশ্বর কে কহিলেন,"হে প্রভু সংযত
হউন, তাণ্ডব সংবরণ করুন। ক্ষুদ্রমতি নরগণের অন্যায়ের হেতু
আমাদের স্বার্থের হানি ঘটান কেন ? আপনি লক্ষ লক্ষ মনুষ্যের প্রাণ
সংহার করিলে, আমাদের পূজা কে করিবে ? দেবী দুর্গা মহাক্রোধে
ঘূর্ণিত লোচনে কহিলেন, "নাথ, আপনার অনেক অত্যাচার সহ্য
করিয়াছি, আপনি দিবা নিশি গাঁজা, ভাঙ সেবন ও কারণ্ বারি পান
করিয়া ভূত প্রেতাদি সহ কালাতিপাত করিয়া থাকেন,আমি নীরবে সকল
লাঞ্ছনা সহ্য করি। সম্বৎসরে একবার মাত্র পুত্র কন্যা সহ পিত্রালয়ে গমন
করি ও ভক্তগণ কর্তৃক পূজা প্রাপ্ত হই। ভক্তগণ সারা বৎসর আমার
অপেক্ষায় দিন গণনা করে, আমার পূজাকে উপলক্ষ্য করিয়া মৃতশিল্পী,
কুম্ভকার, মালাকার, গন্ধবণিক, মণ্ডপ শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী,
আলোক শিল্পী, চর্মকার, তন্তুবায়, বস্ত্র ব্যবসায়ী, ক্ষৌরকার,
খলিফা, ঢাকী,পুরোহিত তথা ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তিধারীদের প্রচুর অর্থাগম হয়।
আমার পূজা বন্ধ হইলে তাহারা সকলে প্রাণে মরিবে। দুঃখের কথা কি
বলিব নাথ, আমার পূজাকে উপলক্ষ্য করিয়া বাঙালী কিশোরী, যুবতী
ও বিবাহিতা রমণীরা পঞ্চমী হইতে দশমী পর্যন্ত এই ছয় দিনে, দিনে
কমপক্ষে তিন বার হিসাবে অন্ততঃ অষ্টাদশ বার কেশ বিন্যাস, নানা
মহার্ঘ্য প্রসাধনী সহযোগে রূপচর্চা , ফ্রক, জিনসের প্যান্ট ও শর্ট টপ,
মিনি-মিডি স্কার্ট , শাড়ী বা সালোয়ার কামিজে সুসজ্জিতা হইয়া লক্ষ
লক্ষ পূজামণ্ডপ আলোকিত করিয়া বসিয়া থাকেন। তাহাদের সৌন্দর্য সুধা
পানের উদ্দেশ্যে সদ্য গোঁফের রেখা গজানো কিশোর হইতে ঘাটের মড়া
শকুন গলার বৃদ্ধ পর্যন্ত তাবৎ পুরুষ কুল সুসজ্জিত হইয়া তাহাদের পার্শ্বে
ঘুরঘুর করিয়া বেড়ায়। আমার পূজা বন্ধ হইলে তাহাদের সকলের মনে
দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্জ্বলিত হইবে। অতএব নাথ,আপনি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার
করিয়া আমাকে পিত্রালয়ে যাইবার অনুমতি প্রদান করুন,আমি যাইবার
আয়োজন সমাপ্ত করি। আর যদি অনুরোধ রক্ষা না করেন,তবে আর
একবার দেহত্যাগ করিয়া জ্বালা জুড়াই।"
মহাতেজা রমণীর ঘূর্ণিত লোচন কে উপেক্ষা করিবেন ,এমন দৃঢ়চেতা
পুরুষ শুধু মনুষ্য কুলেই নয়, দেব কুলেও দুর্লভ। মহেশ্বর আমতা
আমতা করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া দেবর্ষি নারদ
করজোড়ে কহিলেন, প্রভু আমার নিকট ফেসবুকের বৃত্তান্ত সকল শ্রবণ
করুন,অচিরাৎ আপনার ভ্রান্ত ধারণা দূরীভুত হইবে। ফেসবুকের এই যে
রমরমা, তাহার প্রধান আকর্ষণ ই নারী। যদি ফেসবুকে নারীর
প্রবেশাধিকার বন্ধ করা হয়, তবে দেখিবেন সাত কোটি পুরুষ সদস্য
হইতে কয়েক মাসে সদস্য সংখ্যা মাত্র কয়েক লক্ষে পরিণত হইবে। কোটি
কোটি পুরুষ ও নারীর বিনোদন স্থল এই ফেসবুক। অধিকাংশের ই
উদ্যেশ্য দিনভর বিপরীত লিঙের মনুষ্যের সঙ্গে নানা মাধ্যমে চটুল
বাক্যালাপ দ্বারা মনের অবদমিত ক্ষুধার নিবারণ করা। এখানে সুন্দরী
মহিলাদের কদর সবচেয়ে বেশী। তাহাদের বন্ধু সংখ্যা কাহারও তিন
হাজার, কাহারও চার হাজার, কাহারও বা পাঁচ হাজার ছুঁই ছুঁই।
তাহাদের অধিকাংশের ই একমাত্র কাজ কয়েক দিন পর পর নিজের নানা
ভঙ্গীর আলোক চিত্র দ্বারা প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তনের মাধ্যমে আপন
সৌন্দর্য জাহির করা তথা একদল ভেড়া মার্কা মুর্খ স্তাবক দল সৃষ্টি
করা। ঐ সুন্দরী রমণী যদি একটি বিড়াল ছানার ছবি ও পোষ্ট করেন,
তবে তৎক্ষনাৎ শত শত মুগ্ধ স্তাবক মন্তব্য লেখেন, এমন সুন্দর
বিড়াল ছানা তাহারা ভূ-ভারতে দেখেন নাই। একদল পুরুষ সদস্যের
একমাত্র কাজ, সারাদিন মহিলা সদস্যাদের স্তাবকতা করা , ম্যাসেজ ও
চ্যাটিং এর মাধ্যমে মহিলাদের উত্যক্ত করা ও প্রেম নিবেদন করা। মা
জননী দুর্গা ও লক্ষ্মী সরস্বতী র আলোক চিত্রে এই শ্রেণীর রুচিহীন ঘৃণ্য
সদস্যরাই মন্তব্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। আর বিলাসিনী মহিলারাই
কার্তিকের আলোক চিত্রে মন্তব্য লিখিয়াছিলেন। ফেসবুকে শত শত কবি ও
সাহিত্যিকের ভীড়, শতাধিক কবিতার গ্রুপ, সর্বত্রই গাঁয়ে মানে না
আপনি মোড়ল দশা প্রাপ্ত ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ। কবিতার নামে সব দুর্বোধ্য
লেখার ছড়াছড়ি। লেখক নিজেই জানেন না, কি লিখিয়াছেন। অভিধান
হইতে কঠিন কঠিন শব্দ চয়ন করিয়া মৃত অক্ষরের মত সাজাইয়া সব
কবিতা রচনা করেন। তাহাতেই তাহাদের আঁতলামির সীমা নাই। আপনি
ও প্রভু ভুল করিয়াছেন। দেবীরা ঐশ্বর্যশালীনি,স্বর্ণালঙ্কারাভরণ
সুসজ্জিতা,মস্তকে স্বর্ণ মুকুট,হস্তে লীলাকমল ধারিনী ও বাহনে উপবিষ্টা না
হইলে কেহ দেবী বলিয়া জ্ঞান করে না, তাই ঐ বিপত্তি ঘটিয়া ছিল।
আপনি সমস্ত অবগত হইলেন,এক্ষণে মা জননী কে পিতৃ আলয়ে গমনের
অনুমতি প্রদান করুন। আর মা জননীরা যখন মর্ত্যভূমে পূজা গ্রহণ
করিবেন, তখন আপনি কৈলাসে বসিয়াই এই ল্যাপটপের সাহায্যে কোথায়
কত সমারোহ, কোথায় কেমন মণ্ডপ ও আলোক সজ্জা,সমস্ত দেখিয়া
বিশেষ পুলকিত হইবেন। অতঃপর পরমেশ্বর মা দুর্গাকে পিত্রালয়ে গমনের
অনুমতি দিলেন ও হাস্যমুখে নারদকে কহিলেন, "বৎস, মা জননীর
আগমনী গ্রচার যেমন আবশ্যক, তেমনি , ফেসবুকের এই সব নোংরা
মানুষ গুলিকেও সতর্ক করা উচিত, নারী রা দেবী না হইলেও দেবীরই
অংশ, কারণ দেবী না হইলে মা হওয়া যায় না। তুমি কোন ফেসবুকের
লেখক কে দিয়া এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করাইয়া অবিলম্বে ফেসবুকে প্রচারের
ব্যবস্থা করো।" নারদ কহিলেন, "প্রভু, হিমালয়ের পাদদেশে শিলিগুড়ি
নামক ভূখণ্ডে,এক ধর্মভীরু নিষ্কর্মা ব্যক্তি বাস করেন। তিনি ছোট খাটো
কবিতাও লিখিয়া থাকেন।আপনি স্বপ্নে তাহাকে আপনার জানা ঘটনা টুকু
দিব্যশক্তি বলে প্রত্যক্ষ করাইয়া আদেশ করিবেন,যেন অবশ্যই 'দেবীর
আগমনী সংবাদ ' নামে রম্যরচনা লিখিয়া ফেসবুকে প্রচার করেন।
আমিও আপনার পরে পরেই তাহাকে স্বপনে দেখা দিয়া আপনার জানা
অংশের পূর্ববর্তী অংশ,এবং আমার মহিমা প্রচারের আদেশ দিব, তবেই
আমাদিগের কার্য সিদ্ধি হইবে।
"কার্যাঞ্চাগে নারদ তথা শিবানুমত্যানুসারে লিখিতং ইতি।
***************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
***************************
রচনাকাল : ৩/১১/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।