কি বলিলে? তুমি কবিতা রচনা করিয়া কবি হইবে ? তা হও না কেন, কে বারণ করিতেছে ?
আজকাল তো জনগণের প্রসাদে সব কিছুই হওয়া সম্ভব। যে চতুর ব্যক্তি দেশ ও দশের সেবা
তো দুরের কথা, নিজের উন্নতি ও আয়ের পথ প্রশস্ত করা ছাড়া সমগ্র জীবনে ভিন্ন কোনরূপ
চিন্তা করেন নাই, দেখো, সে ব্যক্তিও কেমন ভোজমন্ত্র বলে রাতারাতি মহান দেশ সেবকে
পরিণত হইতেছেন। ঈশ্বরের তপস্যা না করিয়া, কোন রূপ যোগবল লাভ না করিয়াই ভোগী
গণ যোগী পুরুষ হইতেছেন। বেদ অধ্যয়ন করেন নাই, শুধুমাত্র রেশম নির্মিত গৈরিক বস্ত্র ধারণ
করিয়া, বেদানন্দ উপাধি ধারণ করতঃ সকল ব্যক্তিকে মুক্তি-মার্গ প্রদর্শণ করিতেছেন। তা তুমি
লেখক হইলে আর কে আপত্তি করিবে ? সঙ্গীতজ্ঞ হইতে চাহিলে গলা ছাড়িয়া চিৎকার করিতে
হইতো, বাদ্যকর হইলে বাদ্যযন্ত্র বাজাইবার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ দুলাইয়া নৃত্য করিতে হইতো, কিন্তু
লেখক হইবার কোন পরিশ্রম নাই, কেবল ভাবা আর লেখা,আর তৎক্ষণাৎ মুদ্রণ বা বৈদ্যুতিন
মাধ্যমে প্রকাশ করা।
বেশ,লিখিতে বসিয়া প্রথমে মনে করিলে, ছন্দ মিলাইয়া কবিতা লিখিবে। এ কি কাণ্ড!
ছন্দ আসে না কেন ? আর কি বিষয়ে লিখিবে, তাহাই তো বোধগম্য হইতেছে না! মনে করিলে,
প্রেমের কবিতাই লিখি, তবে আর ছন্দের অভাব হইবে না। অনেক ভাবিয়া এক পংক্তি লিখিলে,
"ও গো প্রিয়া,তুমি কত সুন্দর ", ব্যস দ্বিতীয় পংক্তিতেই ধাক্কা,আর তো মিল খুজিয়া
পাইতেছো না। সুন্দর শব্দের সহিত কোন শব্দের মিল ? তখন বর্ণমালার 'অ' হইতে 'হ' পর্যন্ত
হাতড়াইয়া শব্দ খুঁজিতে লাগিলে,"অন্দর.. আন্দর..ইন্দর.. উন্দর.. কন্দর..খন্দর..ক্রমশঃ
বন্দর... বান্দর.. হন্দর.. এই সব শব্দ মনে আসিতে লাগিলো, দেখিলে কোন শব্দই ব্যবহার
করা যায় না। বিরক্ত হইয়া ভাবিলে, দুর ছাই! নিত্য প্রেম করিয়া কত আনন্দ পাই, তবে আর
প্রেমের কবিতা লেখার দরকার কি,তদপেক্ষা নারী দেহের সৌন্দর্য লইয়া কিছু লিখিলে পাঠক গণ
উল্লসিত হইয়া আমাকে বাহবা দিবেন । অনেক ভাবিয়া, বেশ কয়েক জনের লেখা পড়িয়া,
দিব্য চক্ষে নারীদেহ ধ্যান করিয়া, মহা উৎসাহে লিখিলে " তোমার দেহে পাহাড় আছে,
আছে উপত্যকা...'', এক পংক্তি লিখিয়াই তুমি মহা খুশী, আহা কি লিখিলাম ! কায়দা করিয়া
কবিতার নাম দিলে কেহ ভাবিবে নারী দেহের বর্ণনা, তো কেহ ভাবিবে প্রকৃতি মাতার বন্দনা।
কিন্তু এ বারেও ধাক্কা, নারী দেহের উপত্যকা বর্ণনা করিতে গিয়া স্বয়ং খাদে পড়িয়া গিয়াছো,
কিছুতেই উঠিবার পথ পাইতেছো না। এখন যদি লেখো নারীর দুইটি হাত, দুইটি পা, দুইটি চোখ.... আছে,
তবে লোকে ভাবিবে, "ব্যাটা,গরুর রচনা নকল করিয়া নারীর রচনা লিখিয়াছে"।তখন আঙুর
"আঙুর ফল টক"-এর মত বলিলে, সাহিত্যের শতকরা ষাট (৬০%)ভাগ-ই তো কেবল
নারীকে লইয়া লেখা, তবে আর ওই পথে ভীড় বাড়াই কেন ? বরঞ্চ প্রকৃতির বর্ণনা দিয়া কবিতা
লিখিলে প্রকৃতি-প্রেমিক কবি নামে যথোচিত সুনাম হইবে।
এবারে তুমি অনেক সতর্ক, প্রকৃতিকে লইয়া কবিতা লিখিতে হইলে তো প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবলোকন
প্রয়োজন। তুমি কম্পিউটার খুলিয়া যতটা সম্ভব পাহাড়-পর্বত,নদী-নালা,খাল- বিল,পশু-পক্ষী,ঝরণা,
গাছপালা,মায় আগাছা,পরগাছা প্রভৃতির ছবি প্রাণ ভরিয়া দেখিয়া লইলে,তৎপর এক পেয়ালা
চা পান করিয়া, খোশ মেজাজে লিখিতে শুরু করিলে। অতি দ্রুত এক পংক্তি লিখিয়াও ফেলিলে,-
"এই দেখিলাম, সুন্দর এক নদী"...। ব্যস,আবার ধাক্কা, কি মিল দিই ? আদি..কাঁদি..গাদি..নাদি..মাদী..যদি
এইসব শব্দ মনে আসিতে লাগিলো, যাহা ব্যবহার করিলে কবিতা হয় না। কেননা,অনেক মাথা খাটাইয়া
ঐ সব শব্দ ব্যবহার করিয়া দেখিলে, কবিতা টি এইরূপ দাঁড়ায়, -
"এই দেখিলাম,সুন্দর এক নদী -
তাহার তীরেতে মাদী ছাগলের নাদি,
কলার গাছেতে ঝুলিছে কলার কাঁদি,
ভালো লাগিতো,খাইতে পেতাম যদি।"
এইরূপ কবিতা তো আর প্রকাশ করা যায় না ? তখন তুমি বুদ্ধি করিয়া ঐ প্রথম পঙক্তি তে
নদী কাটিয়া 'গাছ' লিখিলে, কারণ নদীর চেয়ে গাছ অনেক কাছের জিনিস। এবারেও ফের ধাক্কা,
গাছের সঙ্গে মিল খুঁজিতে গিয়া পাইলে --কাছ..পাছ..বাছ..মাছ প্রভৃতি শব্দ। আবার মাথা খাটাইয়া
কবিতা তৈরী হইলো-
"এই দেখিলাম,সুন্দর এক গাছ ,
তাহার তলায় নদীতে ভাসিছে মাছ।
মাছ গুলিকে জালেতে ধরিয়া বাছ,
পাছে নয় বাবা আন রে আমার কাছ।
এই কবিতা ও মনঃপুত হইল না বলিয়া বাতিল হইলো।
এইবারে ভাবিলে,সামাজিক সমস্যা লইয়া গরম গরম কবিতা লিখিয়া বাজার মাৎ করিলে কেমন হয় ?
অনেক ভাবিয়া এক ধাক্কায় দুই পংক্তি লিখিলে,-
"আঁধার রাতেতে,শহরের পথে,শুয়ে আছে কত ভিখারী,
নাইকো বিছানা,নাইকো বালিশ,নাইকো উপরে মশারি।"
এবারে পড়িলে সঙ্কটে,কবিতা শুরু করা যেমন সহজ,শেষ করা তত কঠিন। সামাজিক সমস্যার
কবিতা লিখিলে,সমস্যার কারণ সহ সমাধান ও লিখিতে হয়। কিন্তু,তুমি অনেক চিন্তা করিয়াও
উপযুক্ত কথা খুঁজিয়া পাইলে না। এখন,কবিতা লিখিবে বলিয়া এত সাধ্য সাধনার পরে যদি কিছছুই না
লিখিতে পারো,তবে মুখ রক্ষা হয় কি প্রকারে ?
এবারে তোমার মাথায় সত্যকারের বুদ্ধির উদয় হইল। তুমি ঠিক করিলে,অভিধান দেখিয়া কঠিন কঠিন শব্দ
বাছিয়া,শুধুমাত্র যে কোন প্রকারে দুইটি পঙক্তির অন্ত্যমিল রক্ষা করিয়া ই নতুন ধারার কবিতা সৃষ্টি করিবে।
সেই কবিতা অর্থহীন হইলেও ক্ষতি নাই। কারণ কবির দায় কবিতা রচনা করা,আর পাঠকের দায়
কবিতার মর্ম উদ্ধার করা। এবারে অভিধান ঘাঁটিয়া মন মত শব্দ চয়ন করিয়া,তাহার সহিত কল্পনার
মিশ্রণ ঘটাইয়া যাহা সৃষ্টি করিলে,তাহাকে কবিতা বলিবে না,এমন স্পর্ধা কাহার আছে ? তুমি লিখিলে :
"কুজ্ঝটিকার অন্তরালে গড্ডালিকার ধাক্কা,
কর্কোটকের দংশনেতে,মেঢক গেল অক্কা।
উষ্ণোপগম,খাচ্ছি যে কম,পকেট সদাই ফক্কা,
ঘোর নিনাদে,নির্বিবাদে বাজাও জয়ঢক্কা।"
আহা ! কি আনন্দ আকাশে,বাতাসে....,তুমি কবিতা লেখার মহান কৌশল আবিস্কার করিয়াছ,
তাই তুমি আনন্দে আত্মহারা। কিন্তুতুমি কি একবারও ভাবিলে,কেন তোমার মনোপটে ছন্দের
অবতারণা হয় না ? গভীর ভাবে চিন্তা করিলে তুমি বুঝিতে পারিতে যে, তোমার শিক্ষা থাকিলেও
সংস্কার নাই। ব্রাহ্মণ হইলেই চলে না,উপনয়নের মাধ্যমে তৃতীয় নয়ন লাভ করিয়া,সংস্কার শিক্ষা করিয়া,
তবে সে প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয়। তুমি শিক্ষা গ্রহণ করিয়া শিক্ষিত হইয়াছো সন্দেহ নাই, কিন্তু তুমি শিক্ষাকে
অন্তর হইতে গ্রহণ করো নাই। ইংরাজী মাধ্যম বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ কালে, নাম মাত্র রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র প্রভৃতি দিকপাল লেখকদের লেখা পাঠ করিয়াছো, পরীক্ষায়
পাশ করিবার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই । বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়া থাকিলে,
গৃহ শিক্ষক গণ প্রশ্নোত্তরের নামে যে টুকু নোট দিয়াছে, তাহার বাহিরে কিছু শেখো নাই ।
বাংলা সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডারে যে বিপুল রত্নরাজি রহিয়াছে, কখনও ভুলিয়াও তাহার প্রতি
দৃষ্টিপাত করো নাই । রত্নের পরিবর্তে সহজলভ্য রঙ্গীন কাঁচের পাথর পাইয়া সন্তুষ্ট থাকিয়াছো।
যে জ্ঞান সরোবর তুমি নির্মাণ করিয়াছো, তাহা কংক্রিট নির্মিত কৃত্তিম সাজসজ্জায় সজ্জিত জলাধার মাত্র,
ভূ-গর্ভে সঞ্চিত বিপুল জলরাশির সঙ্গে তাহার কোন যোগ সূত্র নাই। তাইতো তোমার এত সীমাবদ্ধতা,
তাই তো অন্তরে তোমার দৈন্যতার গ্লানি । দীন ব্যক্তির পক্ষে কুটীর নির্মাণ সম্ভব হইলেও রাজপ্রাসাদ
নির্মাণ সম্ভব নহে।।
*************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
রচনাকাল : ১/৯/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।