• ২য় বর্ষ ১০ম সংখ্যা (২২)

    ২০১৩ , মার্চ



রম্য রচনা: দুর্মুখের বিজয়া দশমী
আনুমানিক পঠন সময় : ৯ মিনিট

লেখক : শ্রী সমর কুমার সরকার
দেশ : INDIA , শহর : Siliguri

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , আগষ্ট
প্রকাশিত ৪৮ টি লেখনী ৫৬ টি দেশ ব্যাপী ৬৭১৩১ জন পড়েছেন।
রম্য রচনা: দুর্মুখের বিজয়া দশমী
*************************

শারদীয় দুর্গা পূজার শেষ লগ্নে দেবীর পতিগৃহে যাত্রা শুরু হইয়াছে। দেবী অত্যন্ত বিষণ্ণ চিত্তে সজল নয়নে বিদায় লইতেছেন। ভক্তগণের উল্লাসের সীমা নাই। ভাবখানা যেন এই,পিতৃগৃহে বেশী দিন অবস্থিতি কন্যাদের পক্ষে কখনই সুখদায়ক হয় না,ফাঁক ফোঁকর দিয়া বেনো জলের প্রবেশ ঘটে। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে সসন্মানে পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছ,ইহা কি কম আনন্দের ? রাজপথ দিয়া একের পর এক শোভাযাত্রা চলিয়াছে.....ঢাকীরা প্রাণপনে বাজাইতেছে "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ....ঠাকুর যাবে বিসর্জন। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি র তেজ বেশী,কাঁসী বাদক ক্রমাগত তালে তালে ঠং...ঠং করিয়া তাল দিতেছে তাই তো...তাই তো....। ঢাকীদের উল্লাসের সীমা নাই। পূর্বে শোভাযাত্রায় ঢাক থাকিত সাকুল্যে দুই তিনটি,দীর্ঘ ক্ষণ বাজাইবার পরিশ্রমে হস্ত শিথিল হইলেই কর্মকর্তারা টের পাইয়া ঢাকীকে নিপীড়ণ করিতেন। এখন আর সে ভয় নাই। বিজ্ঞাপনের যুগে এক এক শোভাযাত্রায় বিজ্ঞাপন দাতা নির্ধারিত নুতন রঙীন ধুতি ও বুকে ছাপমারা গেঞ্জি পরিহিত ২০-২৫ জন ঢাকী মহা কোলাহলে নাচিতে নাচিতে বিক্রম প্রকাশ করিতেছে। ঢাকের গাত্রে সুশোভিত বস্ত্রের ঝালর। ঢাকের পিছন দিকে বন্যজীবন নিয়ন্ত্রণ আইন কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া শত শত বক ও সারস হত্যা করিয়া সংগ্রহ করা বকের পালকের ধ্বজা হনুমানের লাঙুলের ন্যায় আন্দোলিত হইতেছে। শোভাযাত্রা কিছু দূর যাইবার পরেই এক এক স্থানে দণ্ডায়মান হয় ঢাকী দিগের মহড়া জনসমক্ষে প্রদর্শন করিবার জন্য। কারণ,বিজ্ঞাপনের শর্তই যে এইরুপ। ঢাকীগণও মোবাইল মারফত পূর্বেই গৃহে এবং গ্রামবাসী দিগকে সংবাদ প্রেরণ করিয়াছে,অমুক চ্যানেলে আমাদের শোভাযাত্রা দেখাইবে,তোমরা আমাদের বিক্রম নিজ চক্ষে দর্শন করিয়া ধন্য হইয়ো। দুইদিকে সারিবদ্ধ ঢাকীগণ কোমর দুলাইয়া,লম্ফ প্রদান করিয়া আপন আপন শৈলী প্রদর্শন করিতেছে।
 
রাজ পথের পাশেই আমার ফ্ল্যাট,দোতলার বেলকনি হইতে ক্রমাগত ঢাক এর গুর গুর শব্দে মনের মধ্যে কেমন কুরকুর করিতে লাগিল। এই তো সে দিনের কথা ….তখন সদ্য যুবক….এমনই শরতের মনোরম অপরাহ্নে,বেশ কয়েক পেগ বিলাতি ঔষধ সেবন করিয়া, রাঙা রাঙা ঢুলু ঢুলু চোখে  দলবল পরিবৃত হইয়া  ধুনুচি হস্তে কয়েক মাইল রাস্তা কতই না নৃত্য করিতে করিতে মায়ের শোকে অস্রু বিসর্জন করিয়াছি। কেন যে গৃহী হইলাম কে জানে ! আজ ইচ্ছা থাকিলেও উপায় নাই। যদি রাস্তায় ঐ রূপ উদ্দাম নৃত্য করি,তবে ছেলে বা মেয়ের বন্ধু বান্ধবীরা আঙুল দিয়া দেখাইবে,দেখ্ দেখ্ অমুকের বাপের কি ঢং ! সংসার বিষম নীরস বস্তু,উপরে সরস দেখাইলেও ভিতরে জলশূণ্য নারিকেলের ন্যায়। যে কারণে মূর্খ ব্যতীত জ্ঞান তাপস ব্যক্তিগণ কদাচিৎ গৃহী হন না। মনের এই দুঃসহ অবস্থা কে সংবরণে অপারগ হইয়া পোশাক পরিবর্তন শুরু করিলাম। কি জানি কি ভাবিয়া টাইট ফিটিং প্যান্ট,স্পোর্টস টি শার্ট, রিবকের জুতা পড়িয়া নীচে নামিলাম। গৃহিণী বায়না ধরিলেন,আমাকেও সঙ্গে লইয়া চলো,মহানন্দা নদীর তীরে মায়ের বিসর্জন দেখিয়া আসি। আমি আতান্তরে পড়িয়া তাহাকে বলিলাম,এতক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া কি দেখিলে ? এই কোলাহলের মধ্যে গৃহস্থ ঘরণীর বাহির না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
 
ক্ষুদ্র রাজপথ হইতে প্রধান রাজপথে আসিয়া আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। প্রতিটি শোভা যাত্রায় প্রতিমা র সঙ্গে নানা বয়সের শত শত মহিলা এবং শত শত নানা বয়সের পুরুষ উদ্দাম নৃত্য করিতে করিতে নদীর ঘাটের দিকে আগুয়ান। দেবী দুর্গা অসুর নিধনের পুর্বে মাধ্বী নামক সুরা পান করিয়া উন্মত্ত হইয়াছিলেন,নয় তো অসুর বধ সম্ভব ছিল না। চণ্ডী পাঠের সেই শিক্ষা বর্তমানে সমাজের সর্ব স্তরে প্রচলিত। উন্নত মানের সুরা পান ব্যতীত লেখকে লেখিতে পারেন না,গায়কে গাহিতে পারেন না,ইঞ্জিনীয়ার বাড়ীর নকশা ভুল করেন,চিকিৎসকে হাতের অপারেশন করিতে গিয়া পায়ের অপারেশন করিয়া বসেন। আর এ তো মাতৃদেহ বিসর্জনের গুরু দায়ীত্ব। আর সুরা পান না করিয়া উপায় ই বা কি ? মাগগী গণ্ডার বাজারে প্রতিদিন দুপুরে ৩০ গ্রাম ওজনের একখণ্ড মৎস্যের টুকরা আর সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন ২-৩ টুকরা হিমায়িত আরামবাগের চিকেন খাইয়া শরীরে যে পরিমাণ শক্তির সঞ্চার হয়,তাহাতে এক মাইল পথ হাঁটিলেই শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়,আর এ তো দীর্ঘ ৫-৬ মাইল রাস্তা উদ্দাম নৃত্যের কসরৎ। তা শোভাযাত্রা গুলি দেখিয়া পূর্বের অভিজ্ঞতায় মালুম হইল,পুরুষেরা প্রায় সকলেই অমৃত সুধা পান করিয়া প্রবল তেজে বলীয়ান। তাহাদের নিজেদের তেজে তাহারা নিজেই অস্থির। কাহারো জামার হয়তো একদিকের হাতা শুদ্ধ কিছুটা অংশ গায়ে লতপত করিতেছে,কাহারও জামা কোমরে বাঁধা,কেউ বা জামা ছিঁড়িয়া মাথায় পাগড়ী বাঁধিয়াছে। কাহারও জামা হয়তো কেহ পিছন হইতে টানিয়া সম্পুর্ণ ছিঁড়িয়া দিয়াছে,খালি গলা হইতে কিছুটা অংশ টাই এর মত ঝুলিতেছে । অস্ত্র না হইলে পুরুষ মানুষের বিক্রম প্রকাশিত হয় ? দেবী তথা অসুরের সমস্ত অস্ত্র এখন সব মদমত্ত যুবকদের হস্তে। কাহারো হস্তে দেবীর ত্রিশূল,কাহারও হস্তে খড়্গ,কাহারও হস্তে চক্র,এমন কি কেহ আবার অস্ত্রের অভাবে গেরিলা যুদ্ধের নিয়মে সরস্বতীর বীণা কেই প্রবল বিক্রমে অস্ত্রের ন্যায় দুলাইতেছে। একজনকে দেখিলাম গণেশের ক্রোড় হইতে কলা বৌ কে হরণ করিয়া,তাহার বস্ত্র নিজে প্যান্টের উপর পরিধান করিয়া,উলঙ্গ কদলী বৃক্ষকে স্কন্ধে লইয়া,মাথায় ঘোমটা দিয়া খেমটা নাচিতেছে। মুহুর্মূহু দুর্গা মাঈ কি..জয়...দুর্গা মাঈ কি..জয় ধ্বনি ও ধূনুচির ধোঁয়াতে বায়ুমণ্ডল আলোড়িত।
 
ভাবিয়া ছিলাম,শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহণ কারী মহিলাদের বিষয়ে কোন কথা লিখিব না। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলাম,সত্য গোপন হেতু যে পাপ জন্মিবে,তাহার ফলে মৃত্যুর পরে যম দূতেরা তপ্ত শলাকা দ্বারা আমার জিহ্বা ছেদন করিবে। তাই বাধ্য হইয়াই লিখিতে হইল। আগে নৃত্যের অধিকার ছিল একমাত্র পুরুষ জাতির,মহিলারা শোভা যাত্রায় গেলে ট্রাকের উপরে দণ্ডায়মান অবস্থায় থাকিতেন, নচেৎ পদব্রজে নিতান্ত মহিলা সূচক ব্রীড়তার সহিত গমন করিতেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে রুচির পরিবর্তন ঘটিয়াছে। এখন মহিলারা প্রকাশ্যেই বাংলা ব্যাণ্ডের গানের সহিত নৃত্য করিয়া যথেষ্ট প্রশংসা প্রাপ্তা হন। তাই তাহাদের প্রকাশ্যে রাজপথে নৃত্যের আর কোন রূপ বিধি নিষেধ নাই। অধিকাংশ শোভাযাত্রায় ই ঢাকের সহিত ব্যাণ্ড পার্টি ও রহিয়াছে। তাহারা ক্যাসিয়ো সহযোগে  যে সকল চটুল সুর জগঝম্প লয়ে বাজাইতেছেন,তাহা শুনিয়া মৃত মানুষেও জাগিয়া উঠিবে। "নাচ মেরে বুলবুল...পয়সা মিলেগা...," "চোলি কা পিছে ক্যা হ্যায়...চোলি কা পিছে...," "বিড়ি জ্বালাই লে জিগর সে পিয়া......" ইত্যবৎ বিদায় সম্ভাষণ সূচক বাদ্যের সহিত নাচিবে না, তো প্রতিভার বিকাশ ঘটিবে কি রূপে ? তা সারা মুখে লাল সিঁদুর মাখা,ঘামে ভিজা শরীরে মহিলারা কি নৃত্যই না  করিতেছে। কেহ হিপ হপ তো কেহ কোমর দোলানো বিহু নাচ,কেহ বা কথাকলি,কুচিপুরী,বা মণিপুরীর ন্যায় শুধু শরীরের উপরিভাগ দোলাইতেছে, কেহ বা জীবনে একবার মাত্র "ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা " গানের সহিত নাচিয়া ছিল,এক্ষণে প্রতিভার গুণে সেই একই নাচ বিড়ি জ্বালাই লে গানের সহিত নাচিতেছে। প্রতিভার এইরূপ ক্রমবিকাশ দেবীর কৃপা ব্যতিরেকে অসম্ভব। আহা এমত অভূতপূর্ব দৃশ্য সকল পরিদর্শনে চিত্ত সাতিশয় পুলকিত ও আমোদিত হইল।
 
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করিলাম,আমার শরীর টা যেন ভিতরে ভিতরে ছন্দের দোলায় দুলিতেছে। শুষ্ক বীজ যেমন উপযুক্ত আলো ও জলের সংস্পর্শে আপনা আপনি ব্যাকুল হইয়া উঠে,আমারো বুঝি বা সেইরূপ অবস্থা। সুদীর্ঘ কাল এই শহরে বাস,বহু পূজার উদ্যোক্তাদের সহিত ব্যক্তিগত পরিচয় বর্তমান,বহু তরুণ তরুণী আমাকে চিনে। হঠাৎ এমনই এক অতি পরিচিত ক্লাবের শোভা যাত্রার পার্শ্বে উপস্থিত হইলাম। এতক্ষণ অনেক পরিচিত শোভা যাত্রা হইতেই পরিচিত ব্যক্তিরা হাত নাড়িয়া শুভেচ্ছা জানাইয়াছেন,আমি ও তাহাদের প্রত্যাভিবাদন জ্ঞাপন করিয়াছি। কিন্তু এক্ষেত্রে তাহা সম্ভব হইল না। অতি পরিচিত দুই যুবক আনন্দের আতিশয্যে আমাকে হঠাৎ প্রবল আকর্ষণে তাহাদের চৌকোণা দড়ির ঘেরাওয়ের মধ্যে টানিয়া লইলেন। আপনারা দেখিয়াছেন,সকল পূজার শোভাযাত্রাতেই একদল নিবেদিত প্রাণ গাট্টা গোট্টা যুবক বা মধ্যবয়স্ক মানুষ হাতে হাতে দড়ি ধরিয়া লক্ষণের গণ্ডীর মত এক আয়তাকৃতি চৌখুপির সৃষ্টি করেন। শোভাযাত্রার সর্বাগ্রভাগে থাকে পথ প্রদর্শকের দল ও ঢাকীর দল, তৎপরে চৌখুপির মধ্যে নৃত্যরত পুরুষ ও মহিলা নৃত্য শিল্পীর দল,তৎপরে ব্যাণ্ড পার্টির বাদক দল ও সর্বশেষে দুইটি বা তিনটি আলোকমালা সজ্জিত ট্রাকে প্রতিমা সকল। কাজেই চৌখুপির সন্মুখভাগ ও পশ্চাদ্ভাগ সুরক্ষিত,কিন্তু বাম ও দক্ষিণ পার্শ্বে চলমান জনস্রোতের হাত হইতে এই নৃত্যশিল্পীদের রক্ষা করিবার প্রয়াসে ঐ সকল নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিগণ জনতার দিকে পৃষ্ঠদেশ রাখিয়া গণ্ডীর সুরক্ষা প্রদান করেন। বন্ধন দেখিলেই মানুষের বন্ধন অতিক্রম করিবার ইচ্ছা জাগে,তাই প্রায়ই যুবক ও যুবতী দের কেহ কেহ বন্ধন অতিক্রম করিয়া উন্মুক্ত দর্শকের সামনে উপস্থিত হইয়া তাহার নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে বাহবা কুড়াইবার চেষ্টা করেন। তখন ঐ কঠোর সুরক্ষা দল তাহাদের ঠেলা মারিয়া আবার দড়ির চৌখুপির মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেয়। এতক্ষণ আমি ছিলাম চলমান জনতার প্রতিনিধি,কিন্তু চৌখুপির মধ্যে প্রবেশ মাত্র আমি হইলাম তাহাদের একান্ত আপন জন - এইরূপ কিছু চিন্তা করিয়া দুই যুবক আমার দুই পার্শ্বে আসিয়া বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে আমাকে উৎসাহিত করিল। তথাপি দীর্ঘ দিনের অনভ্যাস ও কন্যার পিতার অভিভাবক সুলভ গাম্ভীর্য হেতু তাহা প্রত্যাখ্যান করিলাম। কি ! এতবড় দুর্বুদ্ধি ! আমাদের দলের আপন জন হইয়াও তুমি নাচিবে না ? দুই সুদর্শনা মহিলা নৃত্যশিল্পী এবারে আমার সঙ্কল্প ভঙ্গের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হইলেন। এই নারীগণের শক্তি মহান। ইহারা নৃ্ত্য পটুতায় বিশ্বামিত্র মুনির তপোভঙ্গ করিয়াছেন,আমি তো কোন ছার ! ব্যাণ্ডে তখন বাজিতেছে ,"পড়শি কো চুলহা সে তাপ লেহি লো.....বিড়ি জালাই লে .. জিগর সে পিয়া.... জিগর মে বড়ি তাপ হ্যায়....", দুই নৃত্যশিল্পী মদালসা ভঙ্গী তে এমন ভাবে শরীর কাঁপাইলেন,স্থান কাল পাত্র ভুল হইল,পড়শির চুলহার সমস্ত তাপ আমার শরীর কে উত্তপ্ত করিল। জিগরে বিষম কম্পনের সৃষ্টি হইল,আমি প্রথমে দক্ষিণ পার্শ্বের স্কন্ধ ঝুঁকাইয়া তিনবার দক্ষিণ বাহু ঝাঁকাইলাম, তৎপর অনুরূপ ভাবে বাম বাহু ঝুঁকাইলাম,সঙ্গে সঙ্গে পদ-দ্বয়ের অগ্র পশ্চাত সঞ্চালনে আমার দীর্ঘ দিনের অধীত বিদ্যা সহসা ফিরিয়া আসিল। সাইকেল বা সাঁতার যেমন কেহ একবার শিখিলে জীবনে ভোলেন না,তেমনি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যাহার নাচিবার অভিজ্ঞতা আছে, সুযোগ পাইলেই সেই কুশলতা সময় মত জাগিয়া ওঠে। নিমেষেই আমি সকলের সাথে মিশিয়া গেলাম।

ছোট বড়,পুরুষ মহিলা ভেদ নাই,যে যেমন পারে নাচিতেছে। আমার মত পরিচিত রাশভারী ব্যক্তি কে পাইয়া যেন অনেকের বিশেষ সুবিধাই হইল,বেশ কিছু পরিচিত মহিলা আমাকে ঘিরিয়াই নাচিতে লাগিল। যদি বাড়ীতে মাত্রাতিরিক্ত নাচের কারণে কোন কিশোরী অভিভাবকের বকুনি খায়,তো সহজেই বলিতে পারিবে,সমর জ্যেঠুর সঙ্গেই তো নাচিয়াছি,আর কাহারো সহিত তো নাচি নাই। যদি কোন ঈর্ষা পরায়ণ দুর্বল চিত্তের স্বামী তাহার স্ত্রীর বিড়ি জ্বালাই লে নাচের মৃদু সমালোচনা করিয়া শোক প্রকাশ করেন,তবে  দোষ স্খালনের হেতু স্বরূপ সহজেই বলিতে পারিবে,দেখো তো সরকার বাবু এমন রাশভারী লোক,তিনি  কি নাচটাই না নাচিলেন,আর তুমি ....ছি ! ৪০-৪৫ মিনিট পরেই টের পাইলাম হাঁপ ধরিতেছে,দীর্ঘ দিনের অনভ্যাস,তায় কোন রূপ সঞ্জীবনী সুধা পান করি নাই। কাজেই শরীরে ক্লান্তির উদ্রেক হইল। প্রশ্ন করিতে পারেন,এই যে এত মহিলা নাচিতেছেন,তাহাদের তো সুরার প্রয়োজন হয় না। সত্যের খাতিরে বলিতে ই হয়,পাড়ায় হাজার হাজার মহিলা বাস করেন,সকলেই তো বিসর্জন নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন না। আজকাল কো এডুকেশন স্কুল ও কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা হস্টেলে ও জন্মদিন পালন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক ভাবেই মদ্যপান করিয়া থাকে। অভিভাবকেরা স্ট্যাটাস রক্ষার তাগিদে জানিয়াও না জানার ভান করিয়া থাকেন। সন্ধ্যায় যে কোন পানশালায় গেলে দেখিবেন সেখানে মহিলারা কোন অংশেই কম নয়। তা ছাড়া পতিগণ নিজ গৃহে সুরাপান করিলে প্রায়শঃই স্ত্রী কে সাধাসাধি করেন,কলেজে সুরা পানে পোক্ত স্ত্রী কোনদিন খাই নাই ভাব দেখাইয়া দিব্যি স্বামী কে সঙ্গ দেন। আমাকে আর ঘাঁটাইয়ো না,আমি অনেকের মুখেই গন্ধ পাইয়াছি। আমি কোন মতে সকল কে এড়াইয়া চৌখুপির বাহিরে আসিয়া জনতার সহিত মিশিয়া গেলাম। এতক্ষণ ভীড়ে খেয়াল করি নাই,এবারে সহসা দৃষ্টিগোচর হইল,একাধিক কেবল টিভির ক্যামেরা রাজপথের দুই পার্শ্ব হইতে সমস্ত শোভা যাত্রা গুলির চিত্র গ্রহণ করিয়া সরাসরি গৃহে গৃহে সম্প্রচার করিতেছে। ক্লান্ত দেহে নিরঞ্জন ঘাটে কয়েকটি মাত্র প্রতিমার নিরঞ্জন দেখিয়াই গৃহে প্রত্যাগমন করিলাম। গৃহিণী দ্বার উন্মোচন করিয়া বলিলেন,ভালই তো বিজয়া দশমী করিলে। প্রত্যুত্তরে কহিলাম,হ্যা শুধুমাত্র কয়েকটি প্রতিমার নিরঞ্জন দেখিয়াই ফিরিয়া আসিয়াছি। গৃহিণী কহিলেন,হ্যা কেবল চ্যানেলে আমি বিড়ি জালাইলে নাচ ও হৃদয় পুড়াইলে মহিলা সবই প্রত্যক্ষ করিয়াছি। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে স্নান ঘরে প্রবেশ করিলাম। স্নান হইতে ফিরিয়া দেখিলাম,টেবিলে আমার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। গৃহিণীর এই এক গুণ, প্রচণ্ড ক্রোধের সৃষ্টি হইলে কয়েক দিন বাক্য বিনিময় বন্ধ রাখেন,অথচ সময় মত চা,জলখাবার,ভোজন ইত্যাদি টেবিলে ঢাকা দিয়া রাখেন। নীরব প্রতিবাদের ও এক বিরাট শক্তি আছে। সুপ্ত আগ্নেয় গিরি কে জাগায় কোন মূর্খ ? আমি দায়সারা ভাবে খাদ্য গ্রহণ করিয়া সোফায়  শয়ন করিলাম (ইহাই চিরাচরিত রীতি )।

অতএব সুহৃদ মিত্রবর্গ,বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করিয়ো। বড় সাধ ছিল,তোমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করিয়া আমার গৃহে আনয়ন করতঃ সুমিষ্ট বাক্য,উত্তম কড়াপাকের সন্দেশ,ঘৃতপক্ক ফুলকো লুচি, কাশ্মিরী আলুর দম ও সুশীতল হিমায়িত পানীয়ের দ্বারা তোমাদের সন্তুষ্টি বিধান করি।  কিন্তু কপালের দোষে আমি সকল সুযোগ হারাইলাম। দুঃখিত হইয়ো না,আবার নিশ্চয় সামনের বৎসর তোমাদের নিমন্ত্রণের সুযোগ পাইব।

**************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি 
**************************


রচনাকাল : ৩/১১/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 35  Canada : 24  China : 84  France : 2  Germany : 8  Hungary : 1  Iceland : 12  India : 402  Ireland : 12  Israel : 21  
Japan : 1  Mongolia : 1  Netherlands : 31  New Zealand : 12  Norway : 13  Romania : 1  Russian Federat : 16  Russian Federation : 16  Saudi Arabia : 7  Sweden : 1  
Ukraine : 41  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 3  United States : 856  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 35  Canada : 24  China : 84  France : 2  
Germany : 8  Hungary : 1  Iceland : 12  India : 402  
Ireland : 12  Israel : 21  Japan : 1  Mongolia : 1  
Netherlands : 31  New Zealand : 12  Norway : 13  Romania : 1  
Russian Federat : 16  Russian Federation : 16  Saudi Arabia : 7  Sweden : 1  
Ukraine : 41  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 3  United States : 856  
  • ২য় বর্ষ ১০ম সংখ্যা (২২)

    ২০১৩ , মার্চ


© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
রম্য রচনা: দুর্মুখের বিজয়া দশমী by SAMAR KUMAR SARKAR is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৩৮৮২৬
fingerprintLogin account_circleSignup