হুগলী জেলার অখ্যাত গ্রাম,নাম টি পাইকপাড়া,
সেথায় বসত করেন ঘটক ‘আনন্দরাম ধারা’।
চাল চলনে সপ্রতিভ,মধুর মুখের বুলি,
বংশপরম্পরায় তাহার পেশা টি ঘটকালি।
পাত্র পাত্রী যেমন টি চান,ভাবনা কিছুই নাই,
জুটিয়ে দেবেন আনন্দরাম,যেমন টি ঠিক চাই।
কানা,খোঁড়া,অন্ধ,টেরা,বেঁটে,বোবা,নুলা,
ঢ্যাঙা,কুঁজো,নেকা,টেকো,তোতলা,কানে কালা।
উট-কপালী,চিরুণ-দাঁতি,শ্লীপদ,খড়ম-পেয়ে,
ভাগ্যহত যাদের আছে এমন ছেলে মেয়ে,
পাইক পাড়ায় গিয়ে খাতায় লেখান শুধু নাম,
হবে বিয়ে যোগ্যতাসই,পুরবে মনস্কাম।
আনন্দরাম ভালই জানেন আপন কর্মধারা,
খুঁতের সাথে খুঁত মিলিয়ে দুইটি হৃদয় জোড়া।
তাহার ঘটকগিরির নিয়ম,আর কোথা না পাবে,
পাত্র-পাত্রীর দেখা শুধুই বিয়ের সময় হবে।
উভয় পক্ষের বাড়ি তিনি যাবেন নিয়ম মত,
কথার প্যাঁচে জবাব দেবেন,প্রশ্ন করুন যত।
পাত্র-পাত্রী বুঝতে হবে আপন অনুমানে,
পাঁচ হাজার ও ঘটক বিদায় দিতে হবে গুনে।
এই ভাবেতে শত শত বিয়ে দিয়ে তিনি,
ঘটক কুলে পরিচিত ‘ঘটক চূড়ামণি’।
সব পেশাতেই আছে ঝুঁকি,বিপদ সম্ভাবনা,
সময় সময় জোটে তার ও লাঞ্ছনা,গঞ্জনা।
বলাগড়ের গৃহস্থ এক ধনী চাষীর বাড়ি,
আনন্দরাম করতে গেলেন বিয়ের ঘটকগিরি।
মেয়ের বাবা ধনী চাষী প্রশ্ন করে -“মশায়,
পাত্রটিকে দেখতে কেমন? কেমন বিষয় আশয়?”
জলযোগের ফাঁকে ফাঁকে আনন্দরাম বলে-
“এক হাতে সব কার্য সারে,এমন কাজের ছেলে।
ঘর-বাড়ি কি বলবো মশাই,আলোয় আলোকময়,
ছেলে স্বয়ং ‘আঁধার মাণিক’,সর্ব জনে কয়।
এক কাপড়ের উপরেতে আর এক কাপড় পরে,
আপন কার্য করে ছেলে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে।
বর্ষাকালে ঘরের পাশে মাছেতে খলবল,
মন্দ নয় কো ছেলে,তাহার ভাগ্য যে সম্বল।”
বোকা চাষী ভাবে বসে,“আমার ভাগ্যফলে,
পেয়ে গেলাম উপযুক্ত,এমন ভাল ছেলে।
এক হাতে সব কার্য সারে,কাজের ছেলে বটে,
আলোয় আলোকময় বাড়ি,আহ্লাদে প্রাণ ফাটে।
ঘরে ঘরে আলো জ্বলে,এত সুন্দর বাড়ি!
কাপড় কেনে গাদা গাদা,এত টাকা-কড়ি।
কাজ করতে যায় যে ছেলে,ঘোড়ার গাড়ি চড়ে।
বাড়ির পাশের পুকুরেতে মাছ খলবল করে।
‘মন্দ নয় কো ছেলে’,মানে চরিত্র টি ভাল,
আমার মেয়ের মুখে এবার ফুটবে খুশীর আলো।
‘ভাগ্য সম্বল’ মানে হ’লো,ছেলে ভাগ্যবান,
মনের আশা পূর্ণ হ’লো,ও গো ভগবান।”
কুন্তিঘাটের বিলের ধারে জীর্ণ কুটির সারি,
আনন্দরাম গেলেন সেথা পাত্র পক্ষের বাড়ি।
ছেলের বাবা বলেন,“মশাই,মেয়ের কি কি গুণ?
কাজকর্ম জানে ভাল? রান্না তে নিপুণ?
চেহারা টা কেমন ধারা,সেটা ও বলুন আগে,
আমার সেবা করতে হবে,বলছি আগে ভাগে।”
আনন্দরাম বলেন,“মশাই,হবেন যে ঘুমহারা,
কাজের বেলায় মেয়ে সদাই এক পায়েতে খাড়া।
দৃষ্টি দিলে মেয়ের দিকে,মাথা যাবে ঘুরে,
কপালে জল ঢাললে মেয়ের গায়ে তে না পড়ে।
দাঁতের সারির উপর তাহার আলো করে খেলা,
ধ্যান করে সে নিয়মিত,সকাল সন্ধ্যা বেলা।”
গেঁয়ো মজুর ছেলের বাবা,হলেন আত্মহারা,
“কাজের বেলায় মেয়ে আহা,এক পায়েতে খাড়া!
এমন কাজের মেয়ে পেলে,গিন্নী হবেন খুশী,
আমার দিকে নজর দিতে পারবে তখন বেশী।
কপালে জল ঢাললে মেয়ের বাইরে গিয়ে পড়ে,
চামড়া যে তার তেলতেলে,তা বুঝেছি এ বারে।
দাঁতের সারির উপর আলো কেন করে খেলা?
ঝকঝকে তার দাঁতের পাটি,বোঝে না কোন শালা?
মেয়ে আবার দুই বেলাতে,ধ্যান ও দেখি করে,
দেবতাদের দয়ায় অভাব থাকবে না আর ঘরে।
এমন ভাল মেয়ে পেয়ে,আমি বেজায় খুশী,
ঘটক মশাই যা চাবে তার দেবো অনেক বেশী।”
শর্ত ছিল,ঘটক বিদায় আগে,পরে বিয়ে,
দুই পক্ষই দিল বেশী,বড়ই খুশী হয়ে।
বিয়ের সময় দুই পক্ষের চক্ষু ছানাবড়া,
যা শুনেছে,যা ভেবেছে,ফারাক আগা-গোড়া।
বাম হাত টি নুলো ছেলের,ডান হাত টি ভাল,
অন্ধকারে যায় না দেখা,ছেলে এমন কালো।
মেয়ের ভাল এক খানি পা,অপর পা টি ছোট,
কপাল যেন ঢেউ-খেলানো,উঁচু ভুরু দু’টো।
দাঁতের পাটি এমন উঁচু,বন্ধ না হয় মুখ,
উভয় পক্ষের অবস্থাতে,উভয় পক্ষের দুঃখ।
এই দুনিয়ায় কোন কিছুই নয় কো অসম্ভব,
বিয়ে হলো লগ্ন মত,হলো ও উৎসব।
বিয়ের পরে উভয় পক্ষ,এলো ঘটক বাড়ি,
বললো,“মশায়,বেশ ঠকালেন,করে জুয়াচুরি।”
মেয়ের বাবা বলে -“মশায়,বলেছিলেন ভাল,
কে জানতো ‘আঁধার মাণিক’ তেল কুচকুচ কালো?
বিলের ধারে খড়ের বাড়ি,ফুটো ঘরের চালা,
নুলো জামাই ঘোড়ার গাড়ি চালায় সারা বেলা।
তালি মারা জামা কাপড়,ভাগ্যে জুটলে খায়,
আহা মরি!ঘটক মশায়,প্রণাম তোমার পা-য়।”
ছেলের বাবা বলে -“মশাই,মেয়ের ফিটের ব্যামো,
তার সেবাতেই কাটছে যে দিন,গেছে রাতের ঘুম ও।
উট-কপালী বৌমা আমার,দাঁত দু'পাটি উচা,
এক পায়েতে লাফিয়ে চলে,দিলেন বুকে খোঁচা।”
আনন্দরাম বলেন -“মশাই,শুনুন দু'জনেতে,
মিথ্যা কথা বলিনি তো,আমি কোন মতে।
বুদ্ধিমানের কাছে গিয়ে,করেন যদি বিচার,
প্রমাণ হবে,কোন কথাই মিথ্যা না কো আমার।
মেয়ের বাড়ি গিয়ে যদি বলি,‘ছেলে নুলো’,
আর কিছু কি শুনবে তারা?কানে দেবে তুলো।
ছেলের বাড়ি গিয়ে যদি বলি,‘মেয়ে খোঁড়া’,
করবে তাড়া লাঠি নিয়ে,ভাঙবে দাঁতের গোড়া।
দুইটি হৃদয় মিলিয়ে দেওয়া,সেটাই আমার গুণ,
কি বা ক্ষতি,পানের থেকে খসলে পড়ে চূণ?
প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়ের মনে বড়ই দুঃখ,
তাদের সুখী করতে পেরে,আমি যে পাই সুখ।”
*******************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
********************************
রচনাকাল : ২৯/১১/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।