খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে লুই,কুক্কুরী, বিরুবা, গুণ্ডরী, চাটিল্ল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিণ্ডা, বীণা, সরহ,শবর, আজদেব, ঢেন্ঢণ, দারিক, ভদ্র, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী,লাড়ীডোম্বী প্রভৃতি চব্বিশ জন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য বৌদ্ধ ধর্মের সাধন তত্ত্বের প্রকৃত গূঢ় তত্ত্বগুলিকে সাংকেতিক রূপকের আশ্রয়ে সঠিক রূপে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রাকৃত বাংলা ভাষাতে কতগুলি পদ রচনা করেছিলেন। পদ গুলিতে পদকর্তা দের নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর উল্লেখ থাকায় বোঝা যায় পদগুলিকে সুর সহযোগে গাওয়া হ’তো। যে প্রাচীন পুঁথি তে পদগুলি সঙ্কলিত হয়েছিল তার নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, তাই গান বা পদগুলিকে গবেষক রা ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাপদ’ নামে অভিহিত করেন। চর্যাপদ গুলি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার এক মূল্যবান নিদর্শন। বর্তমান কাল পর্যন্ত আবিস্কৃত বাংলা ভাষার সমস্ত নিদর্শনের মধ্যে চর্যাপদের বাংলা ভাষাই প্রাচীনতম। চর্যাপদ গুলিতে সন্ধ্যা ভাষার আবরণে দ্বৈত অর্থ সম্বলিত উচ্চ স্তরের ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্বের চর্চা করা হ’তো। চর্যাপদ গুলির বাহ্যিক রূপ সাদামাটা ও অনাড়ম্বর হলেও ভাবগত অর্থ ছিল কাব্য সুষমা সম্পন্ন ও বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের নানা দিগদর্শনে পরিপূর্ণ।
সহজিয়া বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা সিদ্ধাচার্য রা চর্যাপদের মধ্যে তাদের তন্ত্র সাধনার মন্ত্র গোপনে বেঁধে রাখতেন। যারা তান্ত্রিক সাধনা করেন, কেবল তারাই সেই মন্ত্র বুঝতে পারতেন। অন্যদের কাছে সেই গান ভিন্ন অর্থবহ মনে হ’তো। যোগ সাধনা বলে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করতে পারলে যে অজর অমর হওয়া যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধাচার্য বিরুবা একটি অদ্ভুত চর্যাপদ রচনা করেন, যার সাধারণ অর্থ ও ভাবগত অর্থ উভয়ই ভীষণ জটিল ও অর্থবহ।
বিরুবাপাদানাম্
রাগ – গবড়া
এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।।
সহজে থির করি বারুণী সান্ধঅ।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধঅ।।
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখইআ।
আইল গরাহক অপণে বহইয়া।।
চউশটি ঘড়িএ দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা ।।
এক সে ঘরলী সরুই নাল ।
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।
[শব্দার্থ : শুণ্ডিনি = মদ্য বিক্রেতা স্ত্রী লোক, সান্ধঅ = প্রবেশ করলো,চীঅন =চিক্কণ/সূক্ষ্ম, বাকলঅ = বল্কলের দ্বারা,বারুণী = মদ, বান্ধঅ = বানালো/তৈরী করলো, থির= স্থির, অজরামর = জরাহীন ও মৃত্যুহীন, হোই = হয়, দিঢ়কান্ধঅ = দৃঢ়স্কন্ধ, দশমি দুয়ারত = দশমী দ্বারে, দেখইয়া = দেখে, আইল = এলো, গরাহক = গ্রাহক/খরিদ্দার, অপণে = নিজে, বহইয়া = পথ বেয়ে, চউশটি = ৬৪ চৌষট্টি, ঘড়িএ = ঘড়ায়, দেল= দেখালো,পসারা = পসরা/বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যাদি,পইঠেল = প্রবেশ করলো, নিসারা = নিষ্ক্রমণ, ঘরলী = ছোট ঘড়া, সরুই= সরু, ভণন্তি = বলেন, চাল = চালো/ চালনা করো ]
প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-
একই মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদ চোলাই করলো। সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর ও দৃঢ়স্কন্ধ হয়। দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো। মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো। খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই। একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরেধীরে চালনা করো।
প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদটি এমনই অদ্ভুত যে, এর সাধারণ অর্থের ক্ষেত্রে যেমন কঠিন সব ইঙ্গিত রয়েছে, তেমনই সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির ভাবগত অর্থেও দুর্বোধ্য সব ইঙ্গিত রয়েছে। বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক ও সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।
“একই মদবিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদচোলাই করলো” - মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো, কারণ দুই ঘরে তার দুইটি পেশা একসঙ্গে চলছে। একটা ঘরে সে বকযন্ত্র বা চোলাই যন্ত্র দিয়ে উত্তম মদ প্রস্তুত করে এবং তা সাজিয়ে রাখে। সহজ আনন্দ লাভের আশায় যারা আসেন, তাদের মদের যোগান দিয়ে উচ্চ মার্গের তুঙ্গ আনন্দ দেওয়াই তার প্রধান পেশা। অপর ঘরে সে গ্রাহক কে দেহ মিলনে তৃপ্ত করে, এটি তার দ্বিতীয় পেশা।
সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন তত্ত্ব মতে মানব দেহে মেরুদণ্ডের নিম্ন দেশে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্য স্থলে কুন্দস্থানে রয়েছে মূলাধার চক্র। এই মূলাধার চক্র সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। বৌদ্ধ তান্ত্রিক শাস্ত্রে সুষুম্না হ’লো নৈরামণি বা নৈরাত্মা, বোধিচিত্ত, অবধূতী বা যোগীনির প্রতীক। সুষুম্না নাড়ীর বাম দিকে ইড়া ও ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নামক আরও দুইটি নাড়ী। ইড়া ও পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। মানব দেহে সঞ্চারমান প্রাণবায়ূ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্য দিয়ে সতত চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ইড়া ও পিঙ্গলাকে সংযত করার সাধনাই তন্ত্র সাধনা। ইড়া ও পিঙ্গলাকে সাধনার মাধ্যমে সুষুম্না তে মিশিয়ে দিতে পারলে সাধনা বলে সুষুম্না পরিণত হয় সহস্রায় বা মহাসুখ চক্রে, সেখানেই আছে মহা সহজানন্দ, অর্থাৎ সেখানেই শক্তি ও শিব রূপী জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনে নির্বাণ সুখ লাভ হয়। সুষুম্নাই হলো এ স্থলে শুণ্ডিনি। তার একটি ঘর হলো ইড়া ও অপর ঘরটি হল পিঙ্গলা। সাধনতত্ত্বের রসে আপ্লুত সাধক কে সুষুম্না প্রথমে ইড়া তে সাধনার সুরায় আসক্ত করে,তারপরে পিঙ্গলাতে মিলন সুখে তৃপ্ত করে। কাম প্রবৃত্তি থেকে যে যৌন শক্তির উদ্ভব হয় তাকে সাধকেরা কুম্ভক প্রক্রিয়ায় ইড়ার মাধ্যমে উর্ধ্ব পথে মস্তিস্কে পাঠায়। মস্তিস্কে সঞ্চিত যৌন শক্তি সাধনার প্রভাবে ওজঃ বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয়ে পিঙ্গলার পথে মূলাধার চক্রে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়ায় সমস্ত যৌন শক্তি ওজঃ শক্তিতেরূপান্তরিত হলে মোহ মুক্তি ঘটে এবং সহস্রায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের ফলে মহা সহজানন্দ লাভ হয়।
“সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর ও দৃঢ়স্কন্ধ হয়” – মদের চোলাই যত ভালো হয়, গ্রাহকেরা তত বেশী তৃপ্ত হয়, তাই মন স্থির করে মদ চোলাই করতে বলা হয়েছে, যেন মদ্য পানকারীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।
আসলে বৌদ্ধ সাধকদের বলা হয়েছে, তারা যেন একাগ্র চিত্তে কুম্ভক সমাধির মাধ্যমে মূলাধার চক্রে কুল কুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে সাধন পর্ব সমাধা করেন, যাতে তারা জরা হীন মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন।
“দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো” - মানব দেহে দশটি ছিদ্র বর্তমান, যাদের দশ দুয়ার বলা হয়। দুইটি চক্ষু ছিদ্র, দুইটি কর্ণ ছিদ্র,দুইটি নাসিকা ছিদ্র, একটি গ্রাস নালী ছিদ্র, একটি পায়ু ছিদ্র, একটি রেচন ছিদ্র ও একটি জনন ছিদ্র মিলিয়ে মোট দশটি ছিদ্র হ’লো দশ দুয়ার। দশমীর দুয়ার অর্থাৎ যৌনাঙ্গে আমন্ত্রণের সঙ্কেত পেয়ে গ্রাহক নিজেই শুণ্ডিনির কাছে এলো।
বৌদ্ধ ধর্মমতে জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য যিনি স্বয়ং নির্বাণ লাভ থেকে বিরত থেকে অপরকে নির্বাণ লাভে সহায়তা করেন, তাকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বুদ্ধত্ব লাভেরজন্য বোধিসত্ত্বগণকে জন্ম জন্মান্তরে দশ পারমী পূর্ণ করতে হয়। এই দশ পারমী হলো - দান,শীল, নৈষ্কম্য,ক্ষান্তি, বীর্য, সত্য, অধিস্থান, মৈত্রী, উপেক্ষা ও প্রজ্ঞা। সাধকেরা বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে গিয়ে জানতে পারলেন এই দশ পারমীর কথা, এবং এই দশ পারমী লাভের উপায় সুষুম্না তে নিহিত আছে জানতে পেরে সাধকেরা নিজেই সুষুম্নার শরণাপন্ন হ’লেন।
“মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো” - নর নারীর যৌন জীবন কে সুখী, তৃপ্তিকর ও সন্তোষজনক করার জন্য নারীদের কণ্ঠ সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ, নৃত্যকলা, কেশ শয্যা, হস্ত শিল্প, রন্ধন প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার গুণে দক্ষ হতে হয়। এদের বলা হয় চৌষট্টি কলা। এই চৌষট্টি কলার কয়েক টি তে পারদর্শিনী হলেই নারী রা পুরুষ দের হৃদয়ে গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করতে পারেন। শুণ্ডিনি কে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়, তাই শুণ্ডিনি গ্রাহকের মন বুঝে এই চৌষট্টি কলার কোন না কোন একটির সাহায্যে তার মন জয় করে।
আসলে এখানে বলা হয়েছে, নারীদের চৌষট্টি প্রকার কাম কলার সবগুলি থেকে মুক্ত হতে না পারলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ অসম্ভব। সুষুম্নার সহায়তায় কুলকুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে দীর্ঘ সাধনায় এক একটি করে কাম কলার মোহ হতে মুক্ত হতে হয়। সুষুম্না রূপী নৈরাত্মা সাধকদের এক এক করে চৌষট্টি প্রকার কাম কলা হতে মুক্ত করে।
“খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই” - শুণ্ডিনির সান্নিধ্য পেয়ে গ্রাহকেরা এতই মত্ত যে আর বাইরে আসার নাম নেই।
আসলে বলা হয়েছে উপযুক্ত সাধন পথের সন্ধান পেয়ে সাধকেরা একবার যদি নৈরাত্মার সাহচর্যে সহজানন্দের সন্ধান পান, তবে আর গৃহী জীবনে ফিরে আসেন না।
“একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরে ধীরে চালনা করো ” – মিলনের পথ সংকীর্ণ, তাই অহেতুক তাড়াহুড়ো অনুচিৎ।
সুষুম্না নাড়ী মানব দেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। সুষুম্নার সূত্রাকার পথ অতিসূক্ষ্ম। এই সূক্ষ্ম পথেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে । তাই বিরুবা উপদেশ দিচ্ছেন অতি ধীরে ধীরে সাধনার পথে এগিয়ে চলো।
এই ভাবে আমরা যদি ক্রমাগতঃ ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের সমস্ত চর্যাপদগুলিকে বৌদ্ধশাস্ত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে, সব গুলিতেই সাধন তত্ত্বের কোন না কোন গূঢ় রহস্য দক্ষতার সঙ্গে মানব জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির আবরণে সুন্দর কাব্যিক রূপে বর্ণিত ।
বৌদ্ধ সহজপন্থী সাধকেরা মনে করতেন ললনা ও রসনার মিলনে সংবৃত বোধি চিত্ত উৎপন্ন হয় ও তা নির্মাণ কায়ে অবস্থান করে। নির্মাণ কায়ে অবস্থান কালে সংবৃত বোধি চিত্ত নিচের দিকে ধাবিত হতে চায়। কিন্তু যোগ সাধনা বলে একে উর্ধ্বগামী করতে পারলে তা রূপান্তরিত হয় পারমার্থিক বোধি চিত্তে। এই পারমার্থিক বোধি চিত্তকেই চর্যাপদে নৈরামণি বলা হয়। চর্যাপদের আদি কবি শবরপাদ একটি চর্যাপদ রচনা করেন, যা তে এই নৈরামণির উল্লেখ আছে। আাপাতদৃষ্টিতে একে নর নারীর প্রেম ও মিলন চিত্র মনে হলেও, এর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান সাধন পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
শবরপাদানাম্
রাগ - বল্লাড্ডি
উঞ্চা উঞ্চা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী।
তোহেরী ণিঅ ঘরণী ণামে সহজসুন্দরী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী।।
তিঅ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী।
সবরো ভুঅঙ্গ ণইরামণি দারী পেহ্ম রাতি পোহাইলী।।
হিআ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই।
সুণ ণইরামণি কন্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই।
গুরুবাক ধনুআ বিন্ধ ণিঅ মণে বাণেঁ।
একে সরসন্ধাণেঁ বিন্ধহ বিন্ধহ পরম নিবাণেঁ।।
উমত সবরো গরুআ রোসে।
গিরিবর সিহর সন্ধি পইসন্তে সবরো লোড়িব কইসেঁ।।
[ শব্দার্থ : উঞ্চা উঞ্চা= উঁচু উঁচু,পাবত=পর্বত,তঁহি=তথায়,বসই=বাস করে, সবরী=শবরী,বালী=বালিকা,মোরঙ্গি পীচ্ছ = ময়ূর পুচ্ছ,পরহিণ = পরিধান করেছে, গীবত = গ্রীবায়/গলায়, গুঞ্জরী = গুঞ্জা/কুঁচ ফল, মালী = মালিকা, উমত = উন্মত্ত, সবরো = শবর, মা কর =করিস না, গুলী =গোলমাল, গুহারী = গুহা বাসী, তোহেরী= তোর, ণিঅ = নিজ, ণামে=নামে,ণাণা=নানা/বিভিন্ন, তরুবর =গাছ, মৌলিল=মুকুলিত হলো, গঅণত=গগনে/ আকাশে, লাগেলি=লাগলো/ ঠেকলো, ডালী=শাখা, একেলী=একা, হিণ্ডই=ঘুরে বেড়ায়, তিঅ=তিন, ধাউ=ধাতু,মহাসুহে=মহাসুখে,সেজি= শয্যা, ছাইলী=পাতলো/রচনা করলো, ভুঅঙ্গ=ভুজঙ্গ/নাগর, দারী = রমণী, পেহ্ম রাতি = প্রেমময় রাত্রি, হিআ=হিয়া/হৃদয়, তাঁবোলা= তাম্বুল / পান, কাপুর = কর্পূর, সুণ=শূণ্য, ণইরামণি = নৈরাত্মা, গুরুবাক=গুরুবাক্য, ধনুআ=ধনুক, বিন্ধ=বিদ্ধ করো, নিবাণেঁ= নির্বাণ কে, সিহর = শিখর, পইসন্তে = প্রবেশ করে, লোড়িব=লড়াই করিব ]
প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-
উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা। শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ ও গলায় গুঞ্জার মালা। উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল ক’রো না। তোমার নিজ ঘরণী হ’লো সহজসুন্দরী। বিভিন্ন গাছপালা মুকুলিত হ’লো, তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী শবরী এ বনে ঘুরে বেড়ায়। তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো। শবর ভুজঙ্গ নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো। হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো। শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো। গুরু বাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো। এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে। গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে ?
বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির আলোকে বিচার করে চর্যাপদটির বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্রকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক ও সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।
“উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা” -এই মানব দেহ যেন সুমেরু পর্বত,মস্তিস্ক হলো পর্বতের শিখর। সেই শিখরে বাস করে সহজানন্দ পানে প্রমত্ত শবরের সহজ সুন্দরী গৃহিণী নৈরামণি বা নৈরাত্মা দেবী। মস্তকে অবস্থিত পারমার্থিক বোধি চিত্তই হলো এই নৈরামণি। প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব বৃত্তি থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়,তাকে ঊর্ধ্ব দিকে মহা বিদ্যুত আধার মস্তিস্কে প্রেরণ করতে পারলে, সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌন শক্তি “ওজঃ” বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয় । মানব দেহের সমস্ত পাশব যৌন শক্তি ওজঃশক্তি তে পরিণত হয়ে গেলে মানুষ নির্বাণ লাভ করে ও মহাপুরষের পর্যায়ে উপনীত হয়।
“শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ ও গলায় গুঞ্জার মালা” - শবরী র একই অঙ্গে বিলাস বৈভব ও কৃচ্ছসাধন এই দুইটি প্রতীক নিত্য বর্তমান। বিলাসের ভাববিকল্প রূপ বর্ণময় ময়ূর পুচ্ছ ও কৃচ্ছসাধনের গুহ্য মন্ত্ররূপ হলো গুঞ্জার মালা।
“উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল ক’রো না। তোমার নিজ ঘরণীহ’লো সহজসুন্দরী” - বিষয় আনন্দে মত্ত শবর রূপী চিত্তকে সতর্ক করা হচ্ছে, যেন সে শবরীরূপী পারমার্থিক চিত্ত নৈরাত্মা কে চিনতে ভুল না করে। একমাত্র তার সঙ্গেই শবরের মিলন হওয়া উচিত।
“বিভিন্ন গাছপালা মুকুলিত হ’লো, তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী শবরী এ বনে ঘুরে বেড়ায়” - মানব দেহ রূপী সুমেরু পর্বতে অযত্নে কাম, ক্রোধ,মোহ, লালসা প্রভৃতি অবিদ্যা রূপ তরু মুকুলিত হয়েছে।তাদের শাখা প্রশাখায় মনের আকাশ অন্ধকার। তাদের ভেদ করে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করতে পারছে না। সেই অন্ধকার কাননে নৈরাত্মা একাকিনী ঘুরে বেড়ায়। তাকে চেনার একমাত্র উপায়, তিনি বজ্রের অগ্নির মত আলোকময়, জ্ঞান মুদ্রারূপী কুণ্ডল শোভিত হয়ে ঘুরে বেড়ান।
“তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো” - তিন ধাতুর খাট বলতে এখানে কায়, মন ও বাক বুঝানো হয়েছে। কায়, মন ও বাক সংযম হলো সাধনার প্রথম ধাপ। জীবাত্মা রূপী শবরের সঙ্গে পরমাত্মা রূপী শবরীর মিলনের জন্য উপযুক্ত শয্যা চাই। তাই শবর কায়, মন ও বাক্য সংযমের খাট বা বেদীর উপর শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্ম রূপী মহাসুখের শয্যা বিছালেন।
“শবর ভুজঙ্গ নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো” - শবর ও শবরী প্রেমের রাত্রি কাটালো, অর্থাৎ অবশেষে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হলো।
“হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো,শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো”- জীবাত্মা রুপী শবর পরমাত্মা রূপী শবরীর সঙ্গে সম্ভোগ চক্রে মিলিত হলেন, ফলে ব্রহ্মজ্ঞানানন্দতুল্য নির্বাণ সুখ ভোগ করলেন। এর পরে শবর হৃদয় রূপ তাম্বুলে মহাসুখ রূপী কর্পুর খেলেন,অর্থাৎ চিত্ত কে অচিত্ততায় লীন করলেন।
“গুরুবাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো। এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে”_- শবরপাদ জানাচ্ছেন গুরুর বাক্য রূপ ধনুকে সাধকের মন রূপী শর যোজনা করে নিক্ষেপ করায় একবার শর সন্ধানেই নির্বাণ কে বিদ্ধ করা গেছে, অর্থাৎ গুরু প্রদর্শিত পথে মন প্রাণ দিয়ে সাধনা করায় এক বারেই নির্বাণ সুখ লাভ হয়েছে।
“গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে ?” - নির্বাণ লাভের পর সহজানন্দ পানে প্রমত্ত জীবাত্মা মস্তকে অবস্থিত মহাসুখ চক্রে এমন ভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে যে তার আর বিষয় বিষে দুষ্ট ক্লেদাক্ত জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।
কৃচ্ছ সাধনের দ্বারা নির্বাণ লাভ সম্ভব, তবে কৃচ্ছসাধনের জন্য যে শিক্ষা বা জ্ঞান প্রয়োজন,তার জন্য গুরু সঙ্গ আবশ্যক এবং গুরুকে জিজ্ঞাসা করেই মুক্তির উপায় জানতে হবে। লুইপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের প্রচার কল্পে পটমঞ্জরী রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:
লুই পাদানাম্
রাগ–পটমঞ্জরী
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুছ্ছিঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।।
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনু পাখ ভিড়ি লাহু রে পাস।।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পাণ্ডি বইঠা।।
[ শব্দার্থ:কাআ=দেহ/শরীর, তরুবর=বড় গাছ, পঞ্চবি=পাঁচটি, ডাল=শাখা, চীএ=চিত্তে,পইঠো=প্রবেশ করে, কাল= মৃত্যু রূপী দেবতা, দিঢ়=দৃঢ়/শক্ত, মহাসুহ=মহাসুখ, ভণই=বলেন,পুচ্ছিঅ=জিজ্ঞাসা করে, জাণ=জানো,সঅল= সর্বকাল, সমাহিঅ= একাগ্র ভাবে ধ্যান মগ্ন, কাহিকরিঅই= কি করিবে, নিচিত = নিশ্চিত/অবশ্যই, মরিঅই = মরিবে,এড়ি = এড়ানো/বর্জন করা, এউ=এই, ছান্দক= ছন্দের, বান্ধ = বন্ধন, করণক = ইন্দ্রিয়ের,পাটের আস = পারিপাট্যের আশা, সুনু পাখ = শূন্যপাখা, ভিড়ি=ভর করে, লাহু রে = লও রে,পাস = পাশে, আমহে = আমি, ঝাণে = ধ্যানে, দিঠা = দেখেছি, ধমণ চমণ = শ্বাস-প্রশ্বাস,বেণি –দুই রকম, পাণ্ডি = পিড়া, বইঠা = বসেছি।]
প্রাকৃত বাংলা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :
মানুষের দেহ বৃক্ষের পাঁচ টি ডাল। চঞ্চল চিত্তে কালপ্রবেশ করে। মনকে দৃঢ় করে মহাসুখ পাও। লুই বলে -গুরু কে জিজ্ঞাসা করে সব জেনে নাও। সুখে বা দুঃখেতে মরণ যখন নিশ্চিত,তখন সব সময়ে তপস্যা করে কি হবে ? এই ছন্দের বন্ধন এবং ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য ছেড়ে শূণ্য পাখায় ভর করে তার কাছে যাও। লুই বলে আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি।
কিন্তু লুইপাদের এই চর্যাগীতি র ভাবগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মনকে নিয়ন্ত্রণ, ইন্দ্রিয় দমন এবং গুরু বাক্য অনুসারে চিত্তের সাধন দ্বারা যে নির্বাণ লাভ সম্ভব, সেই তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
“মানুষের দেহ বৃক্ষের পাঁচ টি ডাল “- মানুষের শরীর কে যদি একটা জীবন্ত গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় দেহ বৃক্ষের পাঁচটি শাখা স্বরূপ, যা মানুষের জীবন কে নিয়ন্ত্রণ করে।
“চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে” - ইন্দ্রিয় গুলি মানুষ কে ভোগময় জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে। মানুষ যত ভোগ করে তত ভোগের স্পৃহা বাড়ে। ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত মানুষ ভোগের ব্যাঘাত ঘটলেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তখন মন অশান্ত হওয়ার ফলে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে, অনিয়মিত ও বিশৃঙ্খল জীবন যাপনের দরুণ শরীরে কাল রূপী ব্যাধির আবির্ভাব ঘটে।
“মনকে দৃঢ় করে মহাসুখ পাও” - মনকে যত দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মন তত শান্ত হয়। অশান্ত মন কখনই ঈশ্বর সাধনার উপযোগী হয় না। এ জন্য যোগী গণ ঈশ্বর সাধনার অঙ্গ হিসাবে নানা যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম প্রভৃতির সহায়তায় চিত্ত সংযম করেন। কৃচ্ছ সাধনে মন যত সফল হয়,ভবিষ্যতে ঠিক সেই অনুপাতে সুখ বৃদ্ধি ঘটে।
“গুরু কে জিজ্ঞাসা করে সব জেনে নাও” - নির্বাণ লাভের জন্য যে প্রজ্ঞা ও উচ্চভাব মার্গে বিচরণের উপযুক্ত মানসিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তা একমাত্র ধর্ম সাধকেরাই অর্জন করতে পারেন। সে জন্য সাধন পথে অগ্রসর হতে গেলে সতত গুরু সঙ্গ প্রয়োজন । গুরুদেব জ্ঞানাঞ্জন শলাকার ছোঁয়ায় শিষ্যের জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন ঘটালে তবেই শিষ্য সাধনার উপযুক্ত হন। গুরুর কাছ থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিলে সাধন পথের বাধা বিঘ্ন গুলিকে সহজেই অতিক্রম করা যায়।
“সুখে বা দুঃখেতে মরণ যখন নিশ্চিত, তখন সব সময়ে তপস্যা করে কি হবে ?” - মানুষ মরণশীল। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর হাত থেকে কারও রক্ষা নেই। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে সর্ব প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাণ লাভ করতে পারলে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে এবং পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু বোধিলাভ ছাড়া নির্বাণ সম্ভব নয়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও পরম জ্ঞানকেই বোধি বলা হয়। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তপস্যার মাধ্যমে বোধি লাভ ও বোধি লাভে প্রাপ্ত জ্ঞানের সহায়তায় নির্বাণলাভের প্রয়োজনেই তপস্যা ।
“এই ছন্দের বন্ধন এবং ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য ছেড়ে শূণ্য পাখায় ভর করে তার কাছে যাও “ – মুক্ত পক্ষ পাখীর মত শূন্য মার্গ অবলম্বন করলে অর্থাৎ জাঁকজমক বা ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য সমূহের অকারণ ভার পরিত্যাগ করলে মন মুক্ত হয়, এবং মুক্ত মন মুক্তির সহায়ক হয়। মুক্তি লাভ করলে আত্মা বুদ্ধে বিলীন হয়।
“লুই বলে আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি ” - লুইপাদ নিজেই ছিলেন একজন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। বৌদ্ধ ধর্মের সাধন তত্ত্ব তার জানা ছিল। শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বা কুম্ভক সমাধি দ্বারা দেহের প্রকৃতি দোষ খণ্ডন করে, নির্বিকল্প সমাধিতে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখ সঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়, এই কথাই পরিশেষে তিনি উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বজ্রযানী ও সহজযানী পন্থী সিদ্ধাচার্য গণ সন্ধ্যা ভাষায় অতি সহজ কথায় চর্যাপদগুলি রচনা করলেও বাস্তবে তা ছিল দ্বৈত অর্থবহ, দুরূহ এবং সাধন তত্ত্বের গভীর ভাবব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ।।
মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের উর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, তাকে সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধন যোগে অবধূতিকা মার্গের পথে ‘মহাসুখকমল ’-এ স্থিত করে যদি সাধক মহাসুখ লাভ করেন, তবে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। কুক্কুরীপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের ভাবকল্পে গবড়া রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:
কুক্কুরীপাদানাম্
রাগ–গবড়া
দুলি দুহি পীঢ়া ধরণ ন জাই ।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই ॥
আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী।।
সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগই।
কানেট চোরে নিল কা গই মাগই।।
দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই।।
অইসনী চর্য্যা কুক্কুরীপা এঁ গাইল।
কোড়ি মাঝেঁ একু হি অহি সমাইল।।
[ শব্দার্থ:দুলি = কাছিম, দুহি =দোহন করে,পীঢ়া = পাত্র/ ভাঁড়, ধরণ = ধারণ করা, রুখের = গাছের, তেন্তলি = তেঁতুল, কুম্ভীর= কুমীর, আঙ্গণ = প্রাঙ্গন/আঙ্গিনা, সুন = শোনো, ভো=ওহে, বিআতি = বাদ্যকরী, কানেট = কানের অলঙ্কার, অধরাতী = মধ্য রাত্রি, সসুরা =শ্বশুর, বহুড়ী = বধূ, মাগই = চাইবে, কাউ = কাক, ডর = ভয়, কামরু = কামরূপ, অইসনী = এইরকম, কোড়ি = কোটি, একু = একজন, সমাইল = বুঝতে পারলো।]
প্রাকৃত বাংলা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :
মাদী কাছিমের দুধ দোহন করে ভাঁড়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়। ওগো বাদ্যকরী শোনো, ঘরে আর অঙ্গনে প্রভেদ নেই, ঘরের মধ্যেই অঙ্গন। অর্ধ রাত্রিতে চোরে কানের অলঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেল। শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল আর বধূ জেগে রইল। চোরে যখন কানের অলঙ্কার নিয়েই গেল, তখন কার কাছে গিয়ে আর চাইবে ? দিনের বেলায় বধূ কাক দেখে ভয় পায়, অথচ রাত্রি হলেই সে কামরূপ যায়। কুক্কুরীপাদ এমন চর্যাপদ গাইলেন, যা এক কোটি মানুষের মধ্যে হয় তো একজন ই বুঝতেপারবেন।
সাধারণ ভাবে কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় –“এক পরপুরুষে আসক্ত বধূ, দিনের বেলায় এমন ভাব দেখায় যে কাকের ডাকেও ভয় পায়, অথচ রাত হলেই সে কামরূপ যায় অর্থাৎ কামস্পৃহা চরিতার্থ করে। বধূটি মধ্য রাত্রে শ্বশুরের নিদ্রার সুযোগে ঘরের বাইরে এসে পরপুরুষের সঙ্গে সম্ভোগ ক্রিয়া করছে। তার দুর্বলতার সুযোগে চোরের মত স্বভাবের পুরুষ তার যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে তার কানের অলঙ্কার ও হরণ করেছে। বধূ এখন কার কাছে কানের অলঙ্কার চাইবে ?
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য গণ মানব শরীরের ষটচক্র স্থিত অখিল পদ্ম কে “মহাসুখ কমল" রূপে ও কুন্দস্থানে সুষুম্না নাড়ীর মুখদেশে মূলাধার চক্র কে “বজ্রমণিরূপ আসন” রূপে কল্পনা করেন। তাদের মতে গভীর রাত্রে ইন্দ্রিয়াদির সুষুপ্ত অবস্থায় কুম্ভক সমাধি দ্বারা দেহের প্রকৃতি দোষ খণ্ডন করে, নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করে অর্থাৎ মহাসুখ কমল কে বজ্রমণিরূপ আসনে স্থাপন করে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।
এই তত্ত্বজ্ঞানের আলোকে এবং পদকর্তার ইঙ্গিত অনুসরণ করে চর্যাপদের প্রতিটিছত্র কে বিশ্লেষণ করলে চর্যাপদটির এই রপ ভাবগত অর্থ পরিস্ফুট হয়ঃ
“ মাদী কাছিমকে দোহন করে দুধ ভাঁড়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না ” - ‘মহাসুখ কমল’ কে জাগ্রত করে বজ্রমণি রূপ আসনে ধরে রাখা যাচ্ছে না অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী কে বশীভূত করে মনের দ্বৈত ভাব দূর করে জ্ঞানের আধার মন কে নির্বাণের পথে চালিত করা যাচ্ছে না, ফলে স্বাভাবিক নির্মল আনন্দ লাভ সহজ হচ্ছে না।
“গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়” - মানব দেহকে যদি গাছ বলে কল্পনা করা হয়, তবে তেঁতুল রূপী অম্ল ফল হলো তার অন্তরের অবদমিত বিকৃত বাসনা। তেঁতুল কে কুম্ভীরে খায় অর্থে ইঙ্গিত করা হয়েছে কুম্ভক সমাধি র সাহায্যে মনের বিকৃত বাসনা কে নিবৃত্ত করা যায়।
“ঘরে আর অঙ্গনে প্রভেদ নেই, ঘরের মধ্যেই অঙ্গন” - দেহ যদি মনের ঘর হয়, তবে তার অঙ্গনে অর্থাৎ মনের মধ্যেই মহাসুখরূপ অঙ্গনে নির্বাণ লাভ সম্ভব হয় যদি দেহ ও মন এক হয়ে যায়।
“অর্ধ রাত্রিতে চোরে কানের অলঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেল” - অর্ধ রাত্রিতে ইন্দ্রিয় গুলি সুষুপ্ত অবস্থায় থাকে, সেই সময় প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের অভিষেকের সময়। কানেট বা কানের অলঙ্কার হলো এক জাগতিক বস্তু র প্রতীক যার প্রতি মানুষের মোহ জন্মে। চুরি করা অর্থে ভাবের ঘরে চুরি করা। মধ্য রাত্রে ইন্দ্রিয় গুলি যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তখন কুম্ভক সমাধির সহায়তায় মন প্রজ্ঞার দ্বারা ভাবের ঘরে চুরি করে মনের প্রকৃতি দোষ অর্থাৎ পার্থিব বস্তুর প্রতি মোহ কে হরণ করে।
“শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল আর বধূ জেগে রইল” - এই ইঙ্গিতের দ্বারা বোঝানো হয়েছে শ্বাসবায়ু যখন ঘুমিয়ে পড়ে অর্থাৎ স্থির থাকে তখন পরিশুদ্ধ প্রকৃতি রূপিণী আত্মা জেগে থাকে।
“দিনের বেলায় বধূ কাক দেখে ভয় পায়, অথচ রাত্রি হলেই সে কামরূপ যায়” - কাক প্রকৃতির আবর্জনা খেয়ে জীবন ধারণ করে , তাই কাক বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতির প্রতীক। কামরূপ অর্থে বোঝায় মহাসুখ সঙ্গম বা নির্বাণ লাভের মহা আনন্দ। দিনের বেলা যখন সকল ইন্দ্রিয় সজাগ অবস্থায় থাকে তখন পরিশুদ্ধ আত্মা বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতি দেখে ভয় পায়, অথচ গভীর রাত্রে ইন্দ্রিয়গুলি যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তখন পরিশুদ্ধ আত্মা নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করে চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।
"কুক্কুরীপাদ এমন চর্যাপদ গাইলেন, যা এক কোটি মানুষের মধ্যে হয় তো একজন ই বুঝতে পারবেন” - অবশেষে কুক্কুরীপাদ সংশয় প্রকাশ করেছেন, তিনি যে চর্যাপদ গাইলেন, তা এক কোটি মানুষের মধ্যে একজন ও বুঝতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে।
আজ বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, তখন রাশি রাশি পুস্তকপড়েও যখন চর্যা পদের ভাবগত অর্থ উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছি, সেই নিরিখে খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্ম লগ্নে রচিত এই চর্যাপদ প্রসঙ্গে করা উক্তি টি মোটেই অতিশয়োক্তি নয়।
************************************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
************************************************
রচনাকাল : ১৭/৪/২০১৩
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।