• ৩য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা (৩১)

    ২০১৩ , ডিসেম্বর



"ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া ( ভাই ফোঁটা)-র উৎস সন্ধানে"
আনুমানিক পঠন সময় : ১১ মিনিট

লেখক : শ্রী সমর কুমার সরকার
দেশ : INDIA , শহর : Siliguri

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , আগষ্ট
প্রকাশিত ৪৮ টি লেখনী ৫৬ টি দেশ ব্যাপী ৬৪৪৯০ জন পড়েছেন।
ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া ( ভাই ফোঁটা)-র উৎস সন্ধানে
************************************

ভাইফোঁটা হিন্দুদের একটি বিশেষ উৎসব।এই উৎসবের শাস্ত্রসন্মত নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে অর্থাৎ দীপাবলী উৎসবের 
দুই দিন পরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। মহারাষ্ট্র,গোয়া ও কর্ণাটকে ভাই ফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। 
এইসব অঞ্চলে ভাইবিজ একটি বর্ণময় অনুষ্ঠান এবং সেখানে এই উপলক্ষ্যে নানা পারিবারিক সন্মেলনের ও আয়োজন করা হয়। এই অঞ্চলগুলিতে যে সব 
মেয়েদের ভাই নেই,তাদেরও চন্দ্র দেবতাকে ভাই কল্পনা করেই ভাইবিজ পালন করতে হয়। নেপাল,সিকিম ও দার্জিলিং এর পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব 
ভাইটিকা নামে পরিচিত। সেখানে বিজয়া দশমীর পরে ভাইটিকাই সব চেয়ে বড় ও বর্ণময় উৎসব। 

বাংলাদেশ,পশ্চিমবঙ্গ,আসাম ও ত্রিপুরার হিন্দু-বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাইফোঁটা এক বিশেষ রীতিতে পালিত হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিনে 
হিন্দু বাঙালী বোনেরা উপবাস পালন করেন। ঘরে ঘরে বোনেরা ভাইদের জন্য নানা রকম নাড়ু,মোয়া, বরফি,মোহনভোগ, ক্ষীর ও মিষ্টান্ন তৈরী করেন। 
এ ছাড়া দোকান থেকে কিনে আনা নানা স্বাদের নানা পদের মিষ্টি তো আছেই। ঐ দিন বোনেরা সকাল সকাল স্নান সেরে ভাইদের কপালে ফোঁটা 
দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সুন্দর আসন পেতে ভাইদের বসতে দেওয়া হয়। সন্মুখে একটি বরণ ডালায় থাকে ধান,দুর্বা,চন্দন বাটা,শিশিরের জল,ঘি,জ্বলন্ত 
প্রদীপ ও হাত পাখা। বাড়ির অন্যান্য মহিলারা ঘন ঘন শাঁখ বাজান ও হুলু ধ্বনি দেন। বোনেরা প্রথমে ভাইদের পাখা দিয়ে বাতাস করেন,তারপরে 
জ্বলন্ত প্রদীপ ভাইয়ের মুখের সামনে কয়েক বার ঘুরিয়ে ভাইকে বরণ করেন এবং মাথায় ধান দুর্বা ছড়িয়ে আশীর্বাদ বা মঙ্গল কামনা করেন। এরপরে 
ক্রমান্বয়ে ভাইদের কপালে বাম হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে প্রথমে শিশির জলের ফোঁটা,তারপরে ঘি-এর ফোঁটা এবং শেষে চন্দনের ফোঁটা দেন। ফোঁটা 
দেওয়ার সময় বোনেরা ভাইদের দীর্ঘায়ু কামনা করে একটি ছড়া কেটে বলেন - 

"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিলাম আমার ভাইকে ফোঁটা।"

এরপরে বোনেরা ভাই বয়সে বড় হলে তাকে প্রণাম করেন ও ভাই বয়সে ছোট হলে দিদিকে প্রণাম করেন। এইসময় ভাই ও বোনেরা পরস্পর উপহার 
বিনিময় ও করে থাকেন। এরপরে ভাই দের সামনে পানীয় জল ও নানা পদের ঘরে প্রস্তুত ও দোকান থেকে কিনে আনা মিষ্টি থালায় সাজিয়ে খেতে 
দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়,ঐ দিনই মধ্যাহ্নে বোনেরা পুনরায় ভাইদের মাছ মাংস ও নানা ব্যঞ্জন সহকারে মধ্যাহ্ন ভোজে অপ্যায়িত করেন। যে সব 
মেয়েদের আপন ভাই নেই,তারা জ্যেঠতুতো,খুড়তুতো,পিসতুতো,মাসতুতো,ও মামাতো ভাই, এমন কি সম্পর্কিত ভাইদের ও ভাইফোঁটা দিয়ে থাকেন।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হিন্দু বাঙালীদের একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান বা লোকোৎসব হলেও,এই উৎসব পালনের পিছনে নানা কিংবদন্তী আছে।কারও কারও মতে,শ্রী 
কৃষ্ণ ভয়ঙ্কর দৈত্য নরকাসুর কে হত্যা করে ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত শরীরে বোন সুভদ্রার গৃহে আসেন। সুভদ্রা তখন বিজয়ী শ্রীকৃষ্ণের কপালে বিজয় তিলক 
হিসাবে একটি ফোঁটা দেন এবং শ্রীকৃষ্ণকে শীতল পানীয় ও নানাবিধ মিষ্টান্ন দিয়ে অপ্যায়িত করেন। সেই থেকেই ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। 
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত কল্যাণী র বিরহী নামক স্থানে এই ঘটনার অনুসরণে বোনেদের ফোঁটা সবার আগে পান শ্রী কৃষ্ণ,তারপরে ফোঁটা 
পড়ে ভাইদের কপালে। স্থানীয় মদনগোপাল মন্দিরের চৌকাঠে শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশে ফোঁটা দেওয়ার পরেই এই অঞ্চলের মেয়েরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন।

অপর সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটি হলো,যম ও তার বোন যমুনা (বা যমী ) সূর্য্যদেব ও ঊষার যমজ সন্তান। কোন এক কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া 
তিথিতে যমুনা দেবী ভাই যমের মঙ্গল কামনায় গভীর ধ্যান মগ্ন হয়ে পূজা করেন এবং তার কপালে ফোঁটা দিয়ে দেন। সেই পূজার ফল স্বরূপ যমদেব 
অমরত্ব লাভ করেন। তাই এই তিথি কে যমদ্বিতীয়া ও বলা হয়। যমদেব মৃত্যুর দেবতা,তাই কোন ভাইকে যেন যমরাজ অকালে না নিয়ে যেতে পারেন,
সেই জন্য যমের দুয়ারে কাল্পনিক কাঁটা স্থাপন করে বাঙালী বোনেরা যমের আসার পথ রুদ্ধ করেন ও ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমুনার মতই 
ভাইয়ের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করেন।

যম ও যমীর(যমুনার)কারণেই যে হিন্দু তথা বাঙালীদের সমাজ ব্যবস্থায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটার প্রচলন হয়েছে,এ বিষয়ে সন্দেহর অবকাশ নেই,কিন্তু 
প্রচলিত কিংবদন্তী বা গল্পটির সঙ্গে হিন্দুদের সর্ব প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ বেদে বর্ণিত যম ও যমীর গল্পের বিন্দু মাত্র মিল নেই। ঋগ্বেদ-সংহিতার সপ্তম অষ্টকে 
অবস্থিত ষষ্ঠ অধ্যায়ের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তে চৌদ্দ (১৪) টি শ্লোকের সাহায্যে যম ও যমীর উভয়ের মধ্যে একটি বিশেষ মুহুর্তের কথোপকথন বর্ণিত 
হয়েছে। যম ও যমী সূর্য্যদেবের ঔরসে ঊষা দেবীর গর্ভে যমজ ভ্রাতা ও ভগিনী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। পৌরাণিক যুগ বা আর্য জাতির ভারতবর্ষে 
আগমনের পরবর্তী কালে আর্যদের সমাজ ব্যবস্থায় অবাধ যৌনাচারে কোন বাধা ছিল না। নারীর উপর পুরুষের অধিকার যেমন ছিল অবাধ,তেমনি নারীরাও 
নিজের পছন্দ মত পুরুষের সঙ্গে অবাধে যৌনাচারে মিলিত হতে পারতেন। সম্পর্ক সেখানে কোন মতেই বাধা হয়ে উঠত না। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া 
তিথিতে যম ও যমী সমুদ্র মধ্যবর্তী এক নির্জন দ্বীপে প্রমোদ ভ্রমণে সময় অতিবাহিত করছিলেন। ঐ নির্জন দ্বীপে আর দ্বিতীয় কোন পুরুষ বা নারী ছিল না। 
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে সহসা যমীর শরীরে কামভাবের উদ্রেক হয়। কাম পীড়িত যমী তখন উপস্থিত এমাত্র পুরুষ যমকে শারীরিক মিলনের আহ্বান জানান। 
কিন্তু ব্যবহারিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ যম দেব এই প্রস্তাবে অসন্মত হন। তখন তাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বর্তমান 
হিন্দু সমাজে প্রচলিত ভাইফোঁটার আদিম ইতিহাস।

ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ার উৎস মূলে যেতে হলে পাঠকদের প্রথমে ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের দশম সূক্তটির সম্বন্ধে সম্যক ধারণার প্রয়োজন। তাই ঋগ্বেদ সংহিতার 
দশম মণ্ডলের দশম সূক্তের ১৪ টি আদি সংস্কৃত শ্লোক এবং প্রতিটি শ্লোকের নীচে দক্ষ প্রশাসক শ্রী রমেশ চন্দ্র দত্ত কৃত বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো। 

ঋগ্বেদ-সংহিতা
সপ্তমোহষ্টকঃ,ষষ্ঠোহধ্যায়ঃ
দশমং মণ্ডলং,দশমং সূক্তং

যমী বৈবস্বতী : ও চিৎসখায়ং সখ্যা ববৃত্যাং তিরঃ পুরূ চিদর্ণবং জগন্বান্।
পিতুর্নপাতমা দধীত বেধা অধি ক্ষমি প্রতরং দীধ্যানঃ।।১।।

যমীর উক্তি : [ বিস্তীর্ণ সমুদ্র মধ্যবর্ত্তী এই দ্বীপে আসিয়া এই নির্জন প্রদেশে তোমার সহবাসের জন্য আমি অভিলাষিণী,কারণ মাতার গর্ভাবস্থায় তুমি ছিলে 
আমার সহচর। বিধাতা মনে মনে চিন্তা করিয়া রাখিয়াছেন,যে তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দর নপ্তা (নাতি) জন্মিবে। ]১ 

যমো বৈবস্বতঃ : ন তে সখা সখ্যং বষ্ট্যেতৎসলক্ষ্মা যদ্বিষুরূপা ভবাতি।
মহস্পুত্রাসো অসুরস্য বীরা দিবো ধর্তার উর্বিয়া পরি খ্যন্।।২।

যমের উত্তর : [ তোমার গর্ভসহচর তোমার সহিত এই প্রকারের সম্পর্ক কামনা করে না। যে হেতু তুমি সহোদরা ভগিনী,তাই তুমি আমার নিকট অগম্যা। 
আর এইস্থান নির্জন নহে,যে হেতু সেই মহান অসুরের স্বর্গ ধারণকারী বীর পুত্রগণ(দেবতা বা দেবতাদের চরেরা) পৃথিবীর সর্ব ভাগ দেখিতেছেন। ]২

যমী বৈবস্বতী : উশংতি যা তে অমৃতাস এতদেকস্য চিত্ত্যজসং মর্তাস্য।
নি তে মনো মনসি ধায্যস্মে জন্যুঃ পতিস্তন্ব মা বিবিশ্যাঃ।।৩।।

যমীর উক্তি : [ যদিও কেবল মনুষ্যের পক্ষে এই প্রকার সংসর্গ অনুচিত। তথাপি দেবতারা এইরূপ সংসর্গ ইচ্ছাপূর্বক করিয়া থাকেন। অতএব আমার যেই 
রূপ ইচ্ছা হইতেছে তুমি ও তদ্রূপ ইচ্ছার বশবর্ত্তী হইয়া পুত্রের জন্মদাতা পতির ন্যায় আমার শরীরে প্রবেশ করো।]৩ 

যমো বৈবস্বতঃ : ন যৎপুরা চকৃমা কদ্ধ নূনমৃতা বদংতো অনৃতং রপেম ।
গন্ধর্বো অপস্বপ্যা চ যোষা সা নো নাভিঃ পরমং জামি তম্নৌ।।৪।।

যমের উত্তর : [ এইরূপ কার্য পূর্বে কখন আমরা করি নাই। আমরা সত্যবাদী,কখন মিথ্যা কহি নাই। গন্ধর্ব (বিবশ্বান বা সূর্য্যদেব) আমাদের পিতা,আর 
আপ্যা যোষা (সূর্য্যপত্নী ঊষা) আমাদের উভয়ের মাতা;সুতরাং আমাদের অতি নিকট সম্পর্ক। ]৪

যমী বৈবস্বতী : গর্ভে নু নৌ জনিতা দংপতি কর্দেবস্ত্বষ্টা সবিতা বিশ্বরূপঃ।
নকিরস্য প্র মিনংতি ব্রতানি বেদ নাবস্য পৃথিবী উত দ্যৌঃ।।৫।।

কো অস্য বেদ প্রথমস্যাহ্নঃ ক ঈং দদর্শ ক ইহ প্র বোচৎ।
বৃহন্মিত্রস্য বরুণস্য ধাম কদু ব্রব আহনো বীচ্যা নৃন্।।৬।।

যমস্য মা যম্যং কাম আগন্তসমানে যোনৌ সহশেয্যায়।
জায়েব পত্যে তন্বং রিরিচ্যাং বি চিদ্বৃহেব রথ্যেব চক্রা।।৭।।

যমীর উক্তি : [ নির্মাণকর্ত্তা ও প্রসবিতা ও বিশ্বরূপ দেব ত্বষ্টা আমাদিগকে গর্ভাবস্থাতেই বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষবৎ করিয়াছেন। তাহার অভিপ্রায় অন্যথা করিতে 
কাহারো সাধ্য নাই। আমাদিগের এই সম্পর্ক পৃথিবী ও আকাশ উভয়েই জানেন। ]৫

[ এই প্রথম দিন কে জানে ? কে বা দেখিয়াছে ? কেই বা প্রকাশ করিয়াছে ? মিত্র ও বরুণের আবাসভুত এই বিশ্বজগৎ অতি প্রকাণ্ড। অতএব হে আহন 
( যম ),তুমি নরদিগকে ইহার কি বলো ? ]৬

[ তুমি যম,আমি যমী,তুমি আমার প্রতি অভিলাষযুক্ত হও,এসো এক স্থানে উভয়ে শয়ন করি। পত্নী যেমন পতির নিকট দেহ মেলিয়া ধরে,সেইরূপ আমি 
তোমার নিকট নিজ দেহ উদ্ঘাটন করিয়া দিই।রথ ধারণকারী চক্রদ্বয়ের ন্যায় এসো আমরা এক কার্যে প্রবৃত্ত হই।]৭

যমো বৈবস্বতঃ : ন তিষ্ঠং তি ন নি মিষংত্যেতে দেবানাং স্পশ ইহ যে চরংতি।
অন্যেন মদাহনো যাহি তূয়ং তেন বি বৃহ রথ্যেব চক্রা।।৮।।

রাত্রীভিরস্ম অহভির্দশস্যেৎসূর্যস্য চক্ষুর্মুহুরুন্মিমীয়াৎ।
দিবা পৃথিব্যা মিথুনা সবংধু যমীর্যমস্য বিভৃয়াদজামি।।৯।।

আ যা তা গচ্ছানুত্তরা যুগানি যত্র জাময়ঃ কৃণবন্নজামি।
উপ বর্বৃহি বৃষভায় বাহুমন্যমিচ্ছস্য সুভগে পতিং মৎ।।১০।।

যমের উত্তর : [ এই যে সব দেবতাদিগের গুপ্তচর,ইহাদের সর্বত্র গতিবিধি,ইহারা চক্ষুঃ নিমীলন করেন না। হে ব্যথাদায়িনী যমী,যাও, শীঘ্র অন্যের নিকট 
গমন করো; রথ ধারণকারী চক্রদ্বয়ের ন্যায় তাহার সহিত এক কার্য করো। ]৮

[ কি দিবসে,কি রাত্রিতে,যজ্ঞের ভাগ যেন যম কে দান করা হয়,সূর্য্যের তেজঃ যেন পুনঃ পুনঃ আবির্ভুত হয়। দ্যুলোক ও ভূলোক স্ত্রী ও পুরুষবৎ যমের আত্মীয়। 
তাই যমী ভ্রাতা যম ভিন্ন অন্য পুরুষকে আশ্রয় করুক। ]৯

[ভবিষ্যতে এমন যুগ হইবে,যখন ভ্রাতা ভগ্নীতে সহবাস করিবে। হে সুন্দরী,আমা ভিন্ন অন্য পুরুষকে পতিত্বে বরণ করো। তিনি যখন রেতঃ সেক করিতে থাকিবেন,
তখন তাহাকে বাহু দ্বারা আলিঙ্গন করিবে। ]১০

যমী বৈবস্বতী : কিং ভ্রাতাসদ্যদনাথং ভবাতি কিমু স্বসা যন্নির্ঋৃতির্নিগচ্ছাৎ।
কামমূতা বহ্বে তদ্রপামি তন্বা মে তন্বং সং পিপৃগ্ধি।।১১।।

যমীর উক্তি : [ সে কিসের ভ্রাতা,যদি সে থাকা সত্বেও ভগিনী অনাথা হয় ? সে কিসের ভগিনী,যদি সেই ভগিনী থাকা সত্বেও ভ্রাতার দুঃখ দূর না হয় ? 
আমি কাম অভিলাষে মূর্ছিতা হইয়া এত করিয়া বলিতেছি, তোমার শরীরে আমার শরীরে মিলাইয়া দাও। ]১১

যমো বৈবস্বতঃ : ন বা উ তে তন্বা তন্বং সং পপৃচ্যাং পাপমাহুর্যঃ স্বসারং নিগচ্ছাৎ। 
অন্যেন মৎপ্রমুদঃকল্পয়স্ব ন তে ভ্রাতা সুভগে বষ্ট্যেতৎ।।১২।।

যমের উত্তর : [ তোমার শরীরের সহিত আমার শরীর মিলাইতে ইচ্ছা নাই। যে ব্যক্তি ভগিনীতে উপগত হয়,তাহাকে পাপী বলা যায়। তাই আমি ভিন্ন অন্য পুরুষের 
সহিত আমোদ আহ্লাদের চেষ্টা দেখো। হে সুন্দরী তোমার ভ্রাতার ঐ রূপঅভিলাষ নাই।]১২ 

যমী বৈবস্বতী : বতো বতাসি যম নৈব তে মনো হৃদয়ং চাবিদাম।
অন্যা কিল ত্বাং কক্ষ্যেব যুক্তং পরি স্বজাতে লিবুজেভ বৃক্ষং।।১৩।।

যমীর উক্তি : [ হায় যম ! তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ দেখিতেছি ! এ তোমার কি প্রকার মন,কি প্রকার অন্তঃকরণ,আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যে রূপে রজ্জু 
ঘোটককে বেষ্টন করে,কিংবা যে রূপে লতা বৃক্ষ কে আলিঙ্গন করে তদ্রূপ অন্য নারীগণ ও তোমাকে অনায়াসেই আলিঙ্গন করে। অথচ তুমি কেবল আমাতেই দেখি বিমুখ !]১৩

যমো বৈবস্বতঃ : অন্যামূ ষু ত্বং যম্যন্য উ ত্বাং পরি স্বজাতে লিবুজেব বৃক্ষং।
তস্য বা ত্বং মন ইচ্ছা স বা বাধা কৃণুষ্ব সংবিদং সুভদ্রাং।।১৪।।

যমের উত্তর : [ হে যমী, তুমিও অন্য পুরুষকেই উত্তম রূপে আলিঙ্গন করো। যে রূপ লতা বৃক্ষ কে বেষ্টন করে সেইরূপ অন্য পুরুষই তোমাকে আলিঙ্গন করুক। 
তুমি তাহার মন হরণ করো,সে ও তোমার মন হরণ করুক।তুমি তাহারই সহিত সহবাসের ব্যবস্থা স্থির করো, তাহাতেই তোমার মঙ্গল হইবে।]১৪ 

যমীর আবেদনে যমের সাড়া না দেওয়ার কারণ কি ? যম মৃত্যুর দেবতা, অভিজ্ঞতা বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একই পিতা মাতার সন্তানদের মধ্যে পরস্পর 
যৌন মিলনের ফলে যে বংশধারার সৃষ্টি হচ্ছে, তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশঃ দুর্বল হওয়ার ফলে, শিশু মৃত্যু, অপুষ্ট শিশু, বিকলাঙ্গ শিশুর পরিমাণ ক্রমশঃ 
বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগ,ব্যাধি, মহামারিতে অকাল মৃত্যুর হার ক্রমশঃ ঊর্দ্ধগামী। সময় থাকতে সাবধান না হলে ভবিষ্যতে ফল মরাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। 
দেবতাদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেই যে হেতু মানব সমাজে অনুশাসনের সৃষ্টি হয়, তাই দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্য কর্তব্য। যম ভগিনী যমী 
কে একই পিতা মাতার সন্তান, বা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন জ্ঞাতিবর্গের সমগোত্রীয় নর নারীর মধ্যে অবাধ যৌনাচারের কুফল ব্যাখ্যা করলেন, এবং এই প্রথা 
দূরীকরণে যমীর সহায়তা চাইলেন। যমের আবেদনে সাড়া দিয়ে যমী যমের কপালে টিকা দিয়ে, নানা খাদ্য দ্রব্য খাইয়ে তাকে সন্তুষ্ট করলেন, এবং ঘোষণা করলেন, 
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া র এইদিনে ভ্রাতা ও ভগিনীর মধ্যে যে পবিত্র সম্পর্কের সৃষ্টি হলো, তা চির অম্লান হোক। যে করেই হোক, এই পবিত্র সম্পর্কের প্রচার 
ও প্রসার দেব,দানব ও মানবের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে তবেই জগতের কল্যাণ।

আর্যরা বেদের স্রষ্টা। আদিম মানব গোষ্ঠীর তুলনায় আর্যরা বিদ্যা ,বুদ্ধি ও চিন্তাধারায় অনেক উন্নত ছিলেন। মানব মনের ক্রমোন্নত অবস্থায় তারা সমাজের কোন টি 
ভাল এবং কোন টি মন্দ তার বিচার ও ভেদাভেদ করতে শিখেছিলেন। সমাজের উন্নতি সাধনের জন্য তারা কিছু সামাজিক বিধিনিষেধের অনুশাসন তৈরীর 
প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু অনুশাসন তৈরী করলেই তো চলবে না, অনুশাসন বলবৎ করার জন্য মানুষের সন্মুখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাই বেদ 
রচনাকালে আর্যরা অদৃশ্য মহা শক্তিধর কাল্পনিক দেব দেবীদের চরিত্র সৃষ্টি করে তাদের জীবনচর্যা ও চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমে সামাজিক অনুশাসন গুলি তুলে 
ধরার চেষ্টা করলেন, যাতে তা মানুষের কাছে বিশ্বাস যোগ্য ও গ্রহণীয় হয়। যম ও যমীর আখ্যান ও ঠিক ঐ প্রকারেরই এক শুভ প্রচেষ্টা। 

হিন্দুদের ধর্মীয় আচার আচরণ,সামাজিক সংস্কার সবই বেদ কেন্দ্রিক। বেদের প্রদর্শিত পথে চলতে গিয়ে যুগ বদলের সাথে সাথে প্রয়োজনে সংযোজন, বিয়োজন বা 
সংশোধনের কারণে নতুন নতুন পুরাণ বা কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নানা লোকাচার, ব্রতকথা ও প্রথার। ভাইফোঁটার সময় বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে 
"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা" বলে যে ছড়াটি উচ্চারণ করেন, তা আপাতদৃষ্টিতে যমরূপী মৃত্যুর দেবতা যাতে ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর 
কারণ না হয়, তার জন্য যমের দুয়ারে কাঁটা ছড়িয়ে তার আসার পথ রুদ্ধ করার প্রয়াস মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পুর্ণ ভিন্ন। যম ও যমীর 
কাহিনীতে বর্ণিত উপাখ্যানের মত ভ্রাতা ও ভগিনীর পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে যাতে কোন প্রকারেই কোন অন্ধকার চোরাগলি দিয়ে সুপ্ত কোন যৌন আকাঙ্ক্ষার 
বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, সেই সুপ্ত কামনা বাসনার পথে কাঁটা বিছিয়ে সম্পর্ক কে চির পবিত্র, চির সুন্দর রাখার চেষ্টাতেই হিন্দু সমাজে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া নামক এই সামাজিক
লোক উৎসবের সৃষ্টি। ভারতীয় আর্য সভ্যতার কল্যাণকর লোক সংস্কৃতির বলিষ্ঠ ধারক ও বাহক বাঙালী জাতি যুগ যুগ ধরে তাই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালনের মাধ্যমে ভাই 
ও বোনের পবিত্র মধুর সম্পর্ক কে নিষ্কলুষ রাখার পবিত্র ব্রত পালন করে চলেছে।

********************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
********************************
০৫.১১.২০১৩.
রচনাকাল : ৫/১১/২০১৩
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bahrain : 12  Bangladesh : 150  Canada : 467  China : 89  Europe : 10  Finland : 31  France : 12  Germany : 36  Hong Kong : 1  
Hungary : 91  Iceland : 69  India : 2491  Ireland : 48  Israel : 12  Italy : 1  Japan : 24  Kuwait : 14  Luxembourg : 1  Malaysia : 15  
Nepal : 2  Netherlands : 1  Norway : 1  Philippines : 2  Poland : 3  Portugal : 1  Romania : 12  Russian Federat : 11  Russian Federation : 12  Saudi Arabia : 16  
Singapore : 12  Ukraine : 28  United Arab Emi : 1  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 37  United States : 2379  Virgin Islands, British : 31  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bahrain : 12  Bangladesh : 150  Canada : 467  
China : 89  Europe : 10  Finland : 31  France : 12  
Germany : 36  Hong Kong : 1  Hungary : 91  Iceland : 69  
India : 2491  Ireland : 48  Israel : 12  Italy : 1  
Japan : 24  Kuwait : 14  Luxembourg : 1  Malaysia : 15  
Nepal : 2  Netherlands : 1  Norway : 1  Philippines : 2  
Poland : 3  Portugal : 1  Romania : 12  Russian Federat : 11  
Russian Federation : 12  Saudi Arabia : 16  Singapore : 12  Ukraine : 28  
United Arab Emi : 1  United Arab Emirates : 12  United Kingdom : 37  United States : 2379  
Virgin Islands, British : 31  
  • ৩য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা (৩১)

    ২০১৩ , ডিসেম্বর


© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
"ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া ( ভাই ফোঁটা)-র উৎস সন্ধানে" by SAMAR KUMAR SARKAR is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৬২৫২৬
fingerprintLogin account_circleSignup