কোন এক দেশে এক বদরাগী মানুষ ছিলেন। তার মেজাজ এতই কড়া ও চড়া যে,
কোন কিছুই তার কোপ থেকে রক্ষা পায় না। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও তিনি গ্রাম্য
অপরিশীল ভাষায় যে সকল মধুর বাক্য বর্ষণ করেন,তা দেখে ও শুনে বড় বড়
মানুষের ও বুক কেঁপে ওঠে। তবে সেই বদরাগী মানুষের একটা চমৎকার গুণ ছিল,
তিনি কথায় কথায় ভাল ছড়া কাটতে পারেন,ও ভাল মন্দ সকল কিছুই ছড়ার
মাধ্যমে বলতে পারেন । তা,সেই বদরাগী মানুষ এক দিন যখন সুখের স্বপ্ন দেখতে
দেখতে নিদ্রা যাচ্ছিলেন,তখন সামান্য অস্বস্তি তে তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি
সবিষ্ময়ে লক্ষ্য করলেন,ছোট ছোট কিছু সুতোর টুকরো তার মাথার চুলে ছড়িয়ে আছে।
একে তো প্রচণ্ড বদরাগী মানুষ,তায় সুতোর ইতিহাস তার জানা,অর্থাৎ অন্যান্য অনেকের
মতই,তিনিও সুতোর দুর্দশার জন্য দায়ী,তাই স্বভাব মতই তিনি সুতোকে উদ্দেশ্য করে
গ্রাম্য অপরিশীল ভাষায় কবিতার ছন্দে বললেন :
"হালার হুতা,মারুম জুতা,কর যে মসকরা !
ছিলা আগে পাছার তলায়,এখন মাথায় চড়া ?
ভালা ছিলা,কাপাস ছিলা,পাড়তে গেলা ফাল -
জোলার পোলায় চরকা দিয়া করলো কিতা হাল ?
লাল সবুজ হুতা বুইন্যা,বেটা পুঙির পুত,
লুঙি বুইন্যা ছাড়ল তোমায়,শুঁকলা গু আর মুত ।
হালার হুতা,ভাবছো বুঝি পাইলা তুমি ছাড়া,
ছিলা কাপাস,হইছো হুতা,কপাল তোমার পোড়া ।
লুঙি যখন পুরান হইলো,কাইট্যা করলাম জামা !
আমি পরছি,পরছে পোলায়,পরছে পোলার মামা !
হালার জামা যাইবা কুথা ? ছিঁড়্যা হইছো ল্যেতা,
পুঁটলি বাইন্ধ্যা করছি বালিশ,এহন দেহাও কেতা ?
মাথার চুলে সুড়সুড়ি দাও,শরম তোমার নাই ?
এক্ষুনি তাই আগুন জ্বাইল্যা করুম তোমায় ছাই।
হালার হুতা,চুপ আছিলা,দিছি তোমায় ছাড়,
জোট বাইন্ধ্যা চড়ছো মাথায়,পাইবা না আর পার ।
আজ যদি ছাড়ি তোমায়,কাইল হইবা দড়ি,
গলাতে ফাঁস হইতে পারো,সেই ডরেতে মরি !!
গল্পটা এবার সবিস্তারে বলি,কারণ প্রকৃত বিষয় না জানলে,ব্যাপারটা খেলো মনে হবে।
ঐ বদরাগী মানুষটি ছিলেন পরম সুবিধাবাদী ও চরম স্বার্থপর এক রাজনৈতিক নেতা।
সুতো তৈরীর ইতিহাস তার জানা আছে। তিনি লাল ও সবুজ রঙের সুতোয় বোনা
এক রঙিন লুঙি কিনেছিলেন পরার জন্য। বেশ কিছুদিন পরার পরে লুঙিটা একটু
পুরানো হলে,তিনি লুঙি কেটে গায়ের জামা বানালেন। নিজে তো যথেচ্ছ ব্যবহার
করলেন-ই,তার ছেলে,যিনি কি না বাবার রাজনৈতিক দলে ইতিমধ্যেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন,
তিনি ও সুযোগ পেলেই একই জামা ব্যবহার করতে লাগলেন (পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই,
বাবার জামা গায়ে চাপিয়ে ছেলে রাজনীতি তে প্রতিষ্ঠিত হয়, এতে দোষের কিছু নেই)।
এরপরে বাড়িতে আশ্রিত ছেলের মামা,অর্থাৎ বদরাগী মানুষটির শ্যালক ও ঐ জামা
ব্যবহার করতে লাগলেন ( জামাই বাবু যার দাপুটে নেতা,তিনি ক্ষমতার ছিটে ফোঁটাও
ভোগ করবেন না,তা কি কখনো হয়? )।এ বব এ
এর পরেও জামার মুক্তি নেই,জামা ছিঁড়ে যখন টুকরো টুকরো ন্যাতা হয়ে গেল,তখন
ছেঁড়া ন্যাকড়া গুলোকে পুঁটলি বেঁধে ঐ বদরাগী নেতা মাথার বালিশ হিসাবে ব্যবহার
করতে লাগলেন। কিন্তু বহু ব্যবহারে ন্যাকড়া টুকরো টুকরো হয়ে আবার সুতোর
টুকরোয় পরিণত হলো এবং পুঁটলির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে এক রাতে বদরাগীর মাথার
চুলে গিয়ে ঢুকলো। ক্ষমতাভোগী রাজনৈতিক নেতাদের একটা বিরাট দোষ এই যে,তারা
সারা জীবন জনগণের মাথায় পাহাড়ের মত চেপে বসে থাকেন,অথচ,তাদের মাথায়
যাতে কুটো টি ও না পড়ে,সেই ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকেন ও মাথায় টুপি পড়েন।
বদরাগী মানুষ টি টুপি খুলেই ঘুমিয়ে ছিলেন,তাই মাথার চুলে সুতার টুকরা ঢোকা
মাত্রই তার অস্বস্তি হতে লাগলো। তিনি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে,আয়নায় নিজের
মুখ দেখেই চমকে উঠলেন। যিনি সারা জীবন অন্যের মাথায় চড়ে বড় হয়েছেন,
তার মাথায় চড়ার সাহস সুতোর টুকরোর হয় কি করে ? তার সঙ্গে রসিকতার
সাহস সুতোর হয় কি করে ? তাই তিনি ছন্দময় অথচ কদর্য ভাষায় সুতোর উৎপত্তি
ও অবস্থান উল্লেখ করে উপরোক্ত মন্তব্যটি করে সুতোর টুকরো গুলিকে পুড়িয়ে দেওয়ার
ভয় দেখালেন। তবে,অস্বীকার করার উপায় নেই,তিনি সুতোর টুকরোকে মাথায় চড়তে
দেখে যথেষ্ট ভয় ও পেয়েছিলেন। জোটবদ্ধ রাশি রাশি সুতোর টুকরো কে পাকিয়ে
যদি দড়ি তৈরী করা যায়,তবে তা দিয়ে অত্যাচারীর গলায় যে ফাঁস ও পরানো যায়,
তা তিনি জানতেন।
পাঠকেরা হয় তো বিরক্ত হয়ে ভাবছেন,এই গল্পের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি ?
সম্পর্ক আছে বলেই তো গল্প টা বলা। আমরা সাধারণ মানুষেরা হলাম ঐ কার্পাস
তুলার ফল। ভিতরটাও সাদা,ব্যবহারেও সাদা। কিন্তু আমাদের থেকে নিপুণ হাতে
সুতা তৈরী করে,চতুর রাজনৈতিক লোকেরা লাল,নীল,সবুজ প্রভৃতি নানা রঙে রঞ্জিত
করে আপন কার্যে ব্যবহার করেন। একবার সুতো হলে আর জীবনে মুক্তি নেই। ঐ
বদরাগী মানুষের মত রাজনৈতিক লোকেরা আমাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ পান।
নিজে তো সদলবলে ব্যবহার করেনই,তার আশ্রিত চ্যালা চামুণ্ডারাও যথেচ্ছ ব্যবহার করেন।
শত ব্যবহারে জীর্ণ হলে, পুঁটলি বেঁধে বালিশ বানিয়ে,তাতে মাথা দিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখেন।
কিন্তু ভুলেও যদি কোন সুতোর টুকরো বালিশের পুঁটলি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে,
তবে তার শাস্তি হলো চিরতরে বিনাশ।সুতোর কি তবে মুক্তি নেই ? একটাই উত্তর -আছে ।
সুতোর টুকরো যদি জোট বেঁধে দড়ি হতে পারে, তবেই তার মুক্তি সম্ভব,কারণ সব
অত্যাচারীই দড়িকে ভয় পায়।
এবারে বলতে পারেন, এই গল্পের তাৎপর্য কি ? দীর্ঘ দিন আমি বলেছি,আপনারা শুনেছেন,
এবারে আপনারা সবাই কিছু বলুন,আমি শুনি। আপনাদেরও তো বলার হক আছে।
চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন,ঐ রকম বদরাগী রাজনৈতিক স্বার্থপর
মানুষেরা সব দেশে,সর্বত্র আপনার আশে পাশেই আছেন।
রচনাকাল : ৩০/৯/২০১২
© কিশলয় এবং শ্রী সমর কুমার সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।