• ৯ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা (১০৫)

    ২০২০ , ফেব্রুয়ারী



চিকু
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখিকা : সায়ন্তী সাহা
দেশ : India , শহর : সিঙ্গুর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , ডিসেম্বর
প্রকাশিত ২৫ টি লেখনী ২৭ টি দেশ ব্যাপী ১৪৮৩৮ জন পড়েছেন।
পাড়ার মোড়ে ওই যে বেদীটা রয়েছে সেখানেই থাকে ও। টানাটানা চোখ, চিকনের মতো লোম আর গোলুমোলু দেখতে তাকে। এমন মায়াবী চোখ যে প্রত্যেকেই আদর করতে বাধ্য। সোনালীও অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। রোজ যাওয়া-আসার পথে ওকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তারপর পরম যত্নে ব্যাগ থেকে গোটা কয়েক বিস্কুট বের করে ধরে তার মুখের সামনে। খাওয়া-দাওয়ার শেষেও চলে একপ্রস্থ আদর-যত্ন। তারপর চলে যায় নিজের গন্তব্যে। সে কিন্তু সেখানেই ক্ষান্ত হয় না। সোনালীর পিছন পিছন এগিয়ে চলে বেশখানিকটা রাস্তা। রাতেও ঘটে একই কাণ্ড। স্টেশন থেকে পাহারা দিয়ে সোনালীকে সে দিয়ে যায় সোনালীর বাড়ীর সামনের গলি পর্যন্ত।কিন্তু সোনালীর বাড়ী ওবধি সে কখনোই যায়না।

দুজনের মধ্যে খুব ভাব। সোনালীকে দূর থেকে দেখেই লেজ নেড়ে স্বাগত জানায় সে। তারপর নানারকম অঙ্গিভঙ্গি করে সে আনন্দ দিতে চায় তাকে। চুপিচুপি সোনালী সেদিন তার হাতে একটা রাখী বেঁধে এসেছে। আসলে প্রতিদিনই এ পাড়ার বখাটে ছেলেগুলোর থেকে একপ্রকারের রক্ষা করেই বাড়ী পর্যন্ত সোনালীকে দিয়ে আসে চিকু-সোনালীর দেওয়া আদরের নাম। তাই মনে মনে ভাইয়ের মতো ভালোবাসে ওকে সোনালী। ছেলেগুলো যখন তাকে নানাভাবে টোন কাটে, উত্যক্ত করে তখন রাগে গড় গড় করে চিকু। এমন ভয়াবহভাবে তাদের দিকে এগিয়ে যায় যে প্রতিবারই পালাতে পথ পায়না জানোয়ারগুলো। তাই চিকুর দীর্ঘজীবন কামনা করে সেদিন বাড়ীর সামনের অন্ধকার গলিতে চিকুর হাতে রাখীটা বেঁধেছিল সে। চিকুও জিভ দিয়ে হাতটা চেটে দিয়েছিল ওর।

তারপর কয়েকদিন জ্বর ভোগ করে দুর্বল শরীর নিয়ে রাস্তায় বেরোল সোনালী। বেদীটার সামনে গিয়ে দেখে সেই বখাটে ছেলেগুলো গোল হয়ে চিকুকে ধরে রেখেছে।চিকুও সমানে চিৎকার করে চলেছে। কাছে গিয়ে দেখে ওদের মধ্যে একজন চিকুকে সমানে এলোপাথারি লাথি মেরে চলেছে।চিকুর দুধের মতো সাদা মুখটা কেটে গেছে। চিকনের মতো লোমগুলো রক্তে লাল হয়ে গেছে। সোনালী দৌড়ে যায় ওদের মাঝখানে।
-"এই কি করছ তোমরা? অবলা প্রাণীটাকে এমন করে মারছ কেন?" প্রায় একপ্রকার কাঁদতে কাঁদতেই কথাগুলো বলে সোনালী।

-"দেখছিস না ওকে একটু আদর করছি? তোকেও একটু আদর করব নাকি রে?" হাসতে হাসতে বলে ওঠে প্রহারকারী সেই জানোয়ার।

হঠাৎই রাগে গর্জন করে ওঠে চিকু। কিন্তু সারা শরীরে আঘাত নিয়ে সে বেশিকিছু করতে পারে না। অন্য একজনের পদাঘাতে আবার ভূপতিত হয় সে।

-"ছেড়ে দাও ওকে। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলছি। একজন অবলা প্রাণীর ওপর অত্যাচার করার জন্য আমি কিন্তু তোমাদের নামে থানায় অভিযোগ করব" এবার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে সোনালী।

-"কি করবি শালী? আরেকবার বল? থানায় যাবি? প্রমাণ করতে পারবি আমাদের অপরাধ? কে সাক্ষী দেবে তোর হয়ে? তোর এই পাতানো ভাই?" -বলে সজোরে এক লাথি মারে চিকুর তকপেটে। কিছুটা কাঁচা রক্ত মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে চিকুর।


সোনালী কাতরকন্ঠে অনুরোধ করে সেখানে উপস্থিত সকল প্রত্যক্ষদর্শীকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত পাড়ার কুখ্যাত গুন্ডাদের সাথে মুখ লাগাতে চায় না কেউ।

-"তা শালীর দেখছি পাড়ার কুকুরদের ওপর খুব দরদ। তা আমাদেরকেও একটু দরদ দেখাও সুন্দরী! মাইরি বলছি তোমায় রাজরানী করে রাখব"-হাসতে হাসতে বলে জানোয়ারগুলোর মধ্যে একজন।

সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে সোনালী। তারপর একটা গাছের পিছন থেকে লুকিয়ে মোবাইলে রেকর্ড করতে থাকে সমস্ত ঘটনা। মিনিট তিনেক পর আবার সামনে আসে সে। তারপর গর্জে উঠে বলে -"এই জানোয়ার! তোদের সব কুকর্ম আমি রেকর্ড করেছি আমার ফোনে। চিকুকে ছাড়বি না আমি থানায় যাবো বল।" তারপর ওদের সামনে প্লে করল রেকর্ড করা ভিডিওটা।

মনে হল গুন্ডাগুলো ভয় পেয়েছে। তারা যে যার বাইকে চেপে চলে গেল সেইস্থান থেকে। সোনালী দৌড়ে গেল চিকুর কাছে। ব্যাগ থেকে বোতলটা বার করে জল খাওয়াতে চেষ্টা করল ওকে। মনে মনে ভাবল একটা অটো করে চিকুকে নিয়ে যাবে পশু চিকিৎসাকেন্দ্রে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। সোনালীর হাতে দু ঢোঁক জল খেয়েই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করল চিকু। কান্নায় ভেঙে পরল সোনালী।

কিছুক্ষণ পর চোখের জলটা মুছে উঠে দাঁড়াল সে। কর্তব্য স্থির সে করেই ফেলেছে। চিকুর অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি দিতেই হবে। ফোনটা হাতে চেপে ধরে থানায় উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে।

-"দেখুন মিস সোনালী ব্যাপারটা আমি দেখছি। দোষীরা যোগ্য শাস্তি পাবে। আপনি একটা রিপোর্ট লিখিয়ে দিন আর এফিডেন্সটা জমা দিয়ে যান।তারপর বাকিটা আমি দেখছি।" থানার ও.সির কথায় আশ্বস্ত হয় সোনালী। যাক চিকুটা এবার ন্যায়বিচার তো পাবে।

পরেরদিন রাতে সোনালী স্টেশনে নেমে দেখে লোডশেডিং। সারা পাড়া ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার। চিকুও তো আর নেই যে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। এত অন্ধকারে ও যাবে কি করে। ফোনটারও চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ভগবানকে ডেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে।

বেদীর সামনে আসতেই ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে সোনালীর। ওই বখাটে ছেলেগুলো না! কিন্তু হিসাব অনু্যায়ী ওদের তো এখন লক-আপে থাকার কথা। আশেপাশেও কেউ নেই।কাকে এবার ডাকবে সোনালী?

-"কিরে মাগী? ভাবলি আমাদের লক-আপে ভরবি? ওরে আমাদের কথায় থানা ওঠে বসে। কুকুরটাকে পাগল প্রমাণ করতে আর দশটা কুকুরে কামড়ানো পেশেন্ট জোগাড় করতে না আমাদের দু মিনিটও টাইম লাগেনি! রাস্তার কুকুরের প্রতি তোর খুব মায়া না। চল তোকেও আজ ওর কাছে পাঠিয়ে দিই। কি বলিস ঝন্টু?"-বলেই ওরা সবাই মিলে গোল করে ঘিরে ফেলল সোনালীকে।

-"কি নামে ডাকতিস যেনো ওই কুত্তাটাকে? কি যেনো নাম? কি যেনো? কি যেনো? হ্যাঁ মনে পরেছে চিকু! ডাক তাকে দেখি কেমন করে সে বাঁচায় তোকে?"-বলেই সোনালীর ব্যাগটা কেড়ে নিল ঝন্টু।

-"শালা তোকে দুটো কথা কি বলতাম তেড়ে কামড়াতে আসত হারামীটা। তাই কাল ইচ্ছে করেই সবাই মিলে মেরে দিয়েছি ওকে। এবার তোকে রক্ষা করার আর কেউ নেই! হাঃ-হাঃ-হাঃ!!"-বলেই সোনালীর ওড়নাটা টেনে নেয় বিল্টু।

-"বস! সাবধানে থেকো কুত্তাটার আত্মাটা কিন্তু তোমায় দেখছে।" বলেই হাসতে থাকে ঝন্টু।

-"দেখেও কিছু করতে পারবে না আমার"-বলেই সোনালীকে জড়িয়ে ধরতে যায় বিল্টু।

-"চিকু!!! আমায় বাঁচা রে"-অস্ফুটে বলে ওঠে সোনালী। ঠিক সেই মূহুর্তেই অন্ধকারে চিৎকার করে ওঠে বিল্টু।

-"শালা পায়েতে কি কামড়ালো রে?? মরে গেলাম আমি...." কথা শেষ হয়না মাটিতে শুয়ে পরে বিল্টু। এদিকে ঝন্টুদের ও আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে সোনালী।

কোনোমতে অন্ধকার হাতড়ে নিজের ওড়নাটা আর ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির দিকে ছুট লাগায় সে।

পরেরদিন প্রত্যেকটা খবরের চ্যনেলেরই একটাই খাসখবর::"রাতের অন্ধকারে অস্বাভাবিক মৃত্যু ছয়জন দুষ্কৃতীর। পাড়ার একনম্বরের বখাটে ছেলে ছিল এরা। নানারকম অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত থাকা সত্বেও রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকায় এদের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিতে পারেনি পুলিশ। প্রত্যেকেরই সারা গায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু একরাতেই মৃতদেহের শরীরে এতটা পচন কিভাবে সম্ভব সেটাই ভাবাচ্ছে পুলিশকে। এদিকে ময়না তদন্তে উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মৃতদের শরীরে নাকি পাওয়া গেছে রেবিস ভাইরাস। কিন্তু কস্মিনকালেও তাদের কুকুরে কামড়ায়নি। সমস্তদিকটাই খতিয়ে দেখছে পুলিশ।"
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 31  Europe : 1  France : 10  Germany : 6  India : 229  Ireland : 20  Russian Federat : 16  Saudi Arabia : 3  Sweden : 21  
Ukraine : 16  United States : 348  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 31  Europe : 1  France : 10  
Germany : 6  India : 229  Ireland : 20  Russian Federat : 16  
Saudi Arabia : 3  Sweden : 21  Ukraine : 16  United States : 348  
  • ৯ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা (১০৫)

    ২০২০ , ফেব্রুয়ারী


© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
চিকু by Sayanti Saha is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.
fingerprintLogin account_circleSignup