বিভাবরী বাগানে রোদে বসে আছে আরামকেদারায় আর বাগানের ফুলগুলোর রঙের খেলা দেখছে তার দুটি চোখ, ঠিক সেই সময় তার পাঁচ বছরের নাতনি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো , এই তো আমার আম্মি ধরে ফেলেছি , এবার তুমি লুকাও , বছর পঞ্চাশের বিভাবরী দেবী তার পাঁচ বছরের নাতনির সাথে খেলা করছিলেন | বার্ধক্যজনিত কারণে হাফ ধরাতে বাগানে এসে একটু জিরোচ্ছিলো কিন্তু নাতনির জন্য বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই , বসলেই খোঁজ পরে যায় ঠাম্মি তুমি কোথায় ..
***
তিন্নির মা বাবা দুজনেই পেশায় ডাক্তার | তিন্নির জন্মের পর থেকেই সমস্ত দায়িত্ব তার ঠাম্মায় নিজের হাতে তুলে নেয় , বাইরের লোকের থেকে নিজের লোক অনেক বেশি ভরসার এইটা বিভাবরীর বৌমা নীলিমা জানতো তাই সে শাশুড়ির হাতে তার ছোট্ট মেয়ে তিন্নিকে নিশ্চিন্তে রেখে দিয়ে নিজের হসপিটালের কাজে ফিরলো |
ছোট্ট তিন্নি যখন থেকে তার মুখের বুলি ফোটে নি , যখন সে মায়ের গন্ধ ছাড়া আর কিছু চিনতো না সেই সময় থেকেই তার আম্মাই তার মা হয়ে উঠেছিল , বিভাবরী দেবীর স্বামী চলে যাওয়ার একাকিত্ব নিঃসঙ্গতা তিন্নি পূরণ করেছিল | নতুন করে বাঁচার আলো দেখিয়েছিলো ছোট্ট তিন্নি |
***
আজ তিন্নি প্রথম স্কুল এ যাবে , বিভাবরী দেবী সকাল থেকে ব্যস্ত আর সাথে চিন্তায় আছে কি করবে স্কুল এ গিয়ে তিন্নি !! কাঁদবে না তো !! নিজের চিন্তার কারণ বৌমা কে বলাতেই বৌমা বলে উঠলো মা তুমি থাকবে স্কুল এর বাইরে তাহলে তিন্নি কিছু করবে না , এইটা শুনে বিভাবরী দেবী নিশ্চিন্ত হলো , পাশ থেকে ছেলে পল্লব বলে উঠলো , মা তুমি আনার সময় ও স্কুল এর বাইরে বসেছিলে মনে আছে ? বাবা তোমায় কত বকেছিলো বসে থাকার জন্য , তাও তুমি শোনোনি সেই গিয়েছিলে আমার সাথে , আর এইটা তো তোমার নাতনি তুমি তো যাবেই , শুনে বিভাবরী দেবী হালকা হেসে বললেন আমার তিন্নির সাথে আমি তো যাবোই স্কুল এ পড়তে ,সেই শুনে তিন্নি তো আল্লাদে আটখানা !! কি মজা আম্মা যাবে আমার সাথে |
**
আম্মার যত্নে ধীরে ধীরে ছোট্ট তিন্নি বড়ো হতে লাগলো | বিভাবরী দেবী তার চিন্তাধারায় তিন্নি কে বড়ো করে তুললেন | যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন পূরণ হয় নি তা তিন্নিকে দেখাতে শুরু করেন |
তিন্নি তার আম্মার কাছে রোজ গল্প শুনে ঘুমায় | এইটাই তার রোজকার অভ্যাস | এইভাবেই দিন যায় |
***
হ্যালো তিন্নি কেমন আছিস রে কান্না ভেজা গলায় বিভাবরী দেবী বললেন , ফোনের ওপারে তিন্নি শুধুই কাঁদছে একটু ও ভালো নেই আম্মি , তোমাকে ছাড়া আমি কেমন করে ভালো থাকি বলো ? বেশ কিছুক্ষন নিস্তব্ধ দুদিকেই , তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে বিভাবরী দেবী বললেন , কি করবি বল , আমি যে নিরুপায় ছিলাম ! আমার তো তোর ওপর কোনো অধিকার নেই !! শুনেই তিন্নি রেগে গেলো বললো শোনো আম্মি আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি , তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি আজ আমি ডাক্তারি পাশ করেছি | তুই ডাক্তার হয়ে গেলি তিন্নি !! চশমার কাচটা ঝাপসা হয়ে গেলো বিভাবরী দেবীর !! দেখতে দেখতে কত্ত গুলো বছর পার হয়ে বুঝতে পারলাম রে তিন্নি !! আজ কত বছর তোরা দেশের বাইরে ...আর আমি এখানে তোর দাদুর বাড়িতে | কিন্তু তিন্নি আমার স্বপ্ন তো পূরণ হয় নি এখনো ...কি কথা হয়েছিল মনে আছে তোর ? তিন্নি ওপার থেকে বলে উঠলো জানি আম্মি আমি যাচ্ছি দেশে ..তোমার কাছে মানুষের সেবা করতে .তুমি তো তাই শিখিয়েছো আমাকে | আমি যাচ্ছি আম্মি ...শুনেই বিভাবরী দেবী লাফিয়ে উঠলেন , তুই আসছিস তিন্নি !! তাড়াতাড়ি চলে আয় ..কখন আবার আমার ডাক এসে যায় | অমন বলবে না আম্মি তুমি আমার জন্য বাঁচবে আর আমি তোমার জন্য | আমি আসছি আম্মি |
রচনাকাল : ১৫/৩/২০২০
© কিশলয় এবং ঝিমলি ব্যানার্জি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।