• ৯ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা (১০৬)

    ২০২০ , মার্চ



ওরা আজও ফিরে আসে
আনুমানিক পঠন সময় : ১১ মিনিট

লেখিকা : সায়ন্তী সাহা
দেশ : India , শহর : সিঙ্গুর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , ডিসেম্বর
প্রকাশিত ২৫ টি লেখনী ২৭ টি দেশ ব্যাপী ১৪৬৬৪ জন পড়েছেন।
রাত এগারোটা....চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে...মারাত্মক গুমোট পরিবেশ... কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে,মেঘের চাদর গায়ে দিয়ে চাঁদও বুঝি লুকোচুরি খেলছে আজ...প্ল্যাটফর্মে শেডের মধ্যে ম্যারমেরে টিউবলাইটগুলো এই নিকষ কালো অন্ধকারেও আলো ছড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে।এরকম নিশ্চল নিস্তরঙ্গ পরিবেশে হঠাৎ করেই যেন অন্ধকারের কালো পর্দা সরিয়ে উদয় হল বছর ছাব্বিশের এক ছেলে।

লিলুয়া স্টেশনের ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই ছুটতে ছুটতে তারকেশ্বরগামী শেষ ট্রেনটা ধরল জয়।চলন্ত ট্রেন ধরা বরাবরই তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ,বহুদিন ধরে অভ্যাসও নেই ওর এভাবে ছুটে ট্রেন ধরার,কিন্তু আজকের ঘটনাটা একেবারে অন্য,আজ যে করেই হোক ওকে বাড়ি ফিরতেই হবে।সন্ধ্যাবেলায় খবর এসেছে ওর ঠাকুমা নাকি মৃত্যুশয্যায় শায়িত,যখন তখন খারাপ কিছু ঘটতে পারে,শেষবারের মতো তিনি তার একমাত্র নাতির মুখটা একবার দেখতে চেয়েছেন।খবরটা তাকে ফোনে জানিয়েছে হরেনকাকা,ওদের পৈতৃক বাড়ির একমাত্র কাজেরলোক।খবরটা শুনেই আর দেরী করেনি জয়,অফিস থেকে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল,কিন্তু রাস্তায় গাড়িটা হঠাৎ করে বিগড়ে যাওয়ায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই ট্রেনে করে যেতে হচ্ছে তাকে।

ট্রেনের জেনারেল কামরাটা একেবারে ফাঁকা,একটা সিটের ওপর বসে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে রীতিমত হাঁফাতে লাগল জয়....জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে ওর....মাথাটা বেশ খানিকক্ষণ নীচে নামিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করল ও।খানিকক্ষণ পর বুঝতে পারল শরীরটা এবার আগের তুলনায় বেশ ভালোই লাগছে ওর,মাথাটা তুলে ভালো করে উঠে বসে পুরো কামরাটাকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হতাশ হল ও..লিলুয়া থেকে উঠেছে ও,মাঝে বেলুড় স্টেশন চলে গেছে বটে কিন্তু কোনো সহযাত্রীই ইতিমধ্যে ট্রেনে ওঠেনি,পুরো কামরা একেবারে ফাঁকা।গা টা একটু ছমছম করে উঠল ওর,স্কুল লাইফের পর ও ট্রেনজার্নিটাকে পারতপক্ষে একটু এড়িয়েই যায়,একা একা ক্লাস টুয়েলভের পর তো কোনোদিন আর ট্রেনেই ওঠেনি,আসলে একা ট্রেনে উঠলেই ও কেমন একটা ভেবলে যায়...এক অজানা ভয় এসে গ্রাস করে ওকে...কিন্তু স্কুললাইফে তো এমনটা কই হতোনা।ও আর রাজীব বরাবরই ট্রেনে চাপতে ভালোবাসত...ট্রেনের গেটে প্রতিদিনই ইচ্ছা করে ঝুলতে ঝুলতে যেত দুজনে...তারপর...তারপর....

আর কিচ্ছু মনে করতে চায়না জয়...ব্যাগ থেকে হেডফোনটা বের করে কানে গুজল ও...মনটাকে এবার একটু ডাইভার্ট করতে হবে...অতীতের চিন্তা মাথায় আনলে চলবেনা এখন,নাহলে অযথা ভয় এসে থাবা বসাবে ওর স্বত্বাতে আর তারপরই ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করবে ওর সমগ্র চেতনাশক্তি।মোবাইলের প্লে লিস্টে নিজের পছন্দের গানটা চালু করে চোখ দুটো বুজে ফেলে জয়,আয়েশ করে মাথাটা নামিয়ে সুখরাজ্যে হারিয়ে যায় ও।

সারাদিনের ক্লান্তিতে একপ্রকার ঘুমিয়েই পড়েছিল ও..বাইরের জগতের প্রতি অার কোনো খেয়াল ছিলনা ওর....খেয়াল হল ফোনটা যখন চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।ব্যাগ হাতড়ে জয় দেখল ওর কাছে চার্জার বা পাওয়ার ব্যাঙ্ক কোনোটাই নেই।তাহলে এবার কি হবে?চিন্তায় পরে গেল জয়,এবার সে কি করে যোগাযোগ করবে বাড়ির সাথে?নিজের বোকামীতেই মাথাটা আরও বেশি গরম হয়ে যায় ওর।ফোনটাকে পকেটে ভরে বোতল থেকে একটু জল খায় ও,তারপর চোখটাকে আবার বন্ধ করে ফেলে,এবার আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর ফেলে আসা শৈশব ওর নিজের ছেলেবেলা.....

তারকেশ্বর স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে জয়ের পৈতৃক বাড়ি,বাবা জয়ন্ত রায় ওখানকার মান্যিগণ্যি মানুষ,পারিবারিক ব্যবসা ছিল বাবা-দাদুর,সেই পয়সার জোরেই বেশ সচ্ছল অবস্থা ছিল ওদের।জয়ের বাবা ছিলেন নামকরা প্রমোটার,বেশ ভালো অঙ্কেরই কাঁচা পয়সা উপার্জন করতেন তিনি প্রতিমাসে আর তার জোড়েই এলাহী ছোটোবেলা উপহার পেয়েছিল জয়,যেখানে কোনো অভাবের অস্তিত্ব ছিলনা,ছিলনা কোনোকিছু থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়,যখন বাবার কাছে সে যা চেয়েছে তখন তাই পেয়েছে ও,বাবার কাছ থেকে কোনোদিন কোনোব্যাপারে ওকে না শুনতে হয়নি।এটাই একসময়ে অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল ওর...কোনোকিছুতেই তাই না শব্দটা তার সহ্য হতনা আর।

জয়ের মা ওর জন্মের সময়ই মারা গিয়েছে,তাই ছোটো থেকেই ঠাকুমার কাছে মানুষ জয়।না পাওয়ার মধ্যে একমাত্র মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকেই বঞ্চিত ও,এরজন্য একেকবার ওর প্রচন্ড রাগও হত,তখন ও হিংসা করত তাদের প্রত্যেককে যাদের মা আছে।ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনাতে বেশ ভালোই ছিল জয়,ক্লাসে বরাবরই দ্বিতীয় হত,আর প্রথম হত রাজীব....

রাজীবের মুখটা মনে পরতেই শিউরে উঠল জয়,না এসব মনে করবে না ও....কিছুতেই মনে করবে না আর এসব।ভ্যাবশা গরমে দমবন্ধ হয়ে আসে ওর,সিট থেকে উঠে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়,,বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে একমনে,ট্রেনের কামরা থেকে যতটুকু আলো বাইরে পরছে তাতেই আলোকিত হচ্ছে পাশের রেললাইন আর বাইরের সামান্য অংশ, তারপর বাকি অংশটা গাঢ় অন্ধকারে যেমন ডুবে ছিল তেমনই ডুবে আছে।

হঠাৎ জয়ের মনে হল অন্ধকারে কেউ যেন পাশেরলাইন ধরে ওর চোখের সামনে দিয়েই দ্রুত ছুটে গেল,অবাক হয়ে যায় জয়,মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকায় ও,খেয়াল করে পাশের লাইনে ট্রেনের ছায়া পরছে,দরজায় দাঁড়ানো ওর নিজেরও ছায়া পরছে কিন্তু সাথে...সাথে আরও দুটো অতিরিক্ত ছায়াও পরছে,যে দুটো ওকে ঘিরে রেখেছে;ফাঁকা ট্রেনে তার পিছনে এই বাকি ছায়া দুটো কোথা থেকে এল তা বুঝতে পারেনা জয়,আতঙ্কে শিউরে উঠে পিছনে তাকায় ও,নাহ্ কেউ কোথাও নেই,ভয়ে ভয়ে আবার সামনের দিকে তাকায় ও....যা দেখে তাতে মনে হয় হৃৎপিন্ডটা ওর এবার বাইরে বেরিয়ে আসবে,একজন ট্রেনের সাথেই সমগতিতে পাশের লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে.....হঠাৎ করেই নিজের মুখটা জয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিল সেই ব্যক্তি,কি ভয়ঙ্কর দেখতে মুখটা,মাথার একদিকটা থেতলে গিয়ে ঘিলু বেরিয়ে এসেছে,কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে,একটা চোখের কোন দিয়ে আর নাক দিয়ে রক্ত গরাচ্ছে.....এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষ হতেই পারেনা....আর্তনাদ করে ওঠে জয়,পা দুটো ঠক্-ঠক্ করে কাঁপছে ওর,ট্রেনেতেই বসে পরে ও,লোকটার কোনো ভাবান্তর হয়নি,সে এখনো তেমন করেই মরা মাছের মতো একদৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে জয়ের দিকে,নিজের গতিবেগেরও তিনি কোনোরকম পরিবর্তন করেননি,হঠাৎ করেই জয় পাশ ফিরে দেখল শেওড়াফুলি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম শুরু হয়েছে আর লোকটাও কেমন যেন চোখের আড়ালে চলে গেল।এবার মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে ট্রেনের গেটটা বন্ধ করে নিজের সিটে এসে বসল জয়।বুকটা ওর আরো বেশি ধকধক করছে কারণ লোকটাকে ও চিনে ফেলেছে.....

ক্লাস টেন অবধি রাজীব আর জয়ের বলতে গেলে গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল,সেটা যদিও রাজীবের মনে হত,রাজীবের বাবা ছিলনা,অতিকষ্টে মা তাকে মানুষ করেছেন,প্রধানত স্কলারশিপের টাকাতেই চলত তার লেখাপড়া,প্রতিবার স্কুলে প্রথম হয়ে নিজের স্কুলের মাইনেটাকে সবার আগে ফ্রি করত রাজীব,এমন মেধা দেখে স্যাররাও বিনা বেতনে পড়াত ওকে।যেদিন মাধ্যমিকে স্কুলে প্রথম আর রাজ্যে পঞ্চম হল সেদিন মায়ের হাসিমুখটা দেখার মতো ছিল....স্যার ম্যাম পাড়া প্রতিবেশীরা শুভেচ্ছাবার্তায় ভরিয়ে দিয়েছিল ওকে।সারা গ্রাম সেদিন রাজীবের সাফল্যে খুশি ছিল,একমাত্র জয় ছাড়া।
জয়ের মতো এমন বড়োলোকের ছেলে রাজীবের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল প্রধানত দুটো কারণে,এক রাজীবের সব নোটস পাবার আশায় আর দুই হল রাজীবের মায়ের ভালোবাসা,মিনতিদেবী জয়কেও নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন,মনে মনে জয় রাজীবকে তার মা্যের কাছে ছোটো করতে চাীত,যাতে মিনতিদেবী জয়কে বেশি বালোবাসেন আর রাজীবকে ঘেন্না করেন তারজন্য যা দরকার হয় সেটাই করত ও....কিন্তু এত করেও কিছু হলনা...সেই রাজীব আবার প্রথম হল....কি না করেছে ও রাজীবকে হারানোর জন্য...ওর নোটসের খাতা ইতিহাস পরীক্ষার আগেরদিন পুড়িয়ে দিয়েছে...রাজীবের তৈরী করা সব নোটস লাইন বাই লাইন মুখস্থ করেছে...রাজীবকে বিরক্ত করে অঙ্ক পরীক্ষার দিন ওর খাতা আধঘন্টা আটকে রাখিয়েছে স্যারকে দিয়ে তার সত্বেও ৩০ নাম্বার বেশি পেল রাজীব....ইতিহাসে আর অঙ্কেতে ১০০করে....রেজাল্ট শুনেই মাথা গরম হয়ে যায় ওর।হাতের কাছে যা কিছু ছিল সব একে একে ছুঁড়ে ফেলে ভাঙতে থাকে ও,শেষপর্যন্ত ঠাকুমা এসে থামায় ওকে.....তারপর তারপর...

বাইরে আবার মুশলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে,গুমোট ভাবটা আর নেই...হঠাৎ করেই ক্যাঁচ করে আওয়াজ করে নসিবপুর আর সিঙ্গুরের মাঝে ট্রেনটা থেমে গেল।কামরার আলোগুলো নিভুনিভু হয়ে আসছে।"ঝড় বাদলার দিনে ট্রেনের তার-ফার আবার ছিঁড়ে গেল নাকি?"মনে মনেই ভাবতে লাগল জয়,আর তারপরই ট্রেনের লাইটগুলো দপ্-দপ্ করতে লাগল......ট্রেনের মেঝেতে একটা ঘষটে ঘষটে কিছু এগিয়ে আসার শব্দ শোনা গেল...কান খাড়া করে শুনতে লাগল জয়...হ্যাঁ ঠিকই শুনছে ও শেষ দরজা থেকেই আওয়াজটা হচ্ছে...তড়িঘড়ি সেদিকে ছুটে গেল জয়...কই কিছু নেই তো...তাহলে?কাঁপা কাঁপা হাতে দুদিকের দরজাটাই সজোরে বন্ধ করে দিল ও তারপর ছুটে এসে পুরো কামরারই সবকটা দরজা টেনে বন্ধ করে দিল....তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে সিটে এসে বসল,
" যাক্ বাবা!!আর কিছু হবার সম্ভবনা নেই..."মনেমনে ভেবে নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সময় দেখাচ্ছে রাত বারোটা বেজে পনেরো.....হঠাৎ করেই সামনের দরজায় ঠক্-ঠক্ করে কে যেন ধাক্কা দিল.....শিউরে উঠল জয়...কে হতে পারে....আওয়াজটা হয়েই চলেছে...জয়ের পিছনদিক থেকে রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মেয়েলী কন্ঠে কে যেন বলে উঠল,
"কি হল শুনতে পাচ্ছেন না কে একজন দরজাতে ধাক্কা দিচ্ছে...হা করে বসে না থেকে গিয়ে দরজাটা খুলুন...আশ্চর্য!!"

চমকে ওঠে জয়...ইনি আবার কোত্থেকে এলেন..কখনই বা এলেন.....মেয়েটি যেন জয়ের মনের কথা পড়তে পারছে..সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে,
"আমি কখন এলাম সেটা না হয় পরে ভাববেন...দরজাটা খুলে আগে দেখুন কে এসেছে...দরজাটা বন্ধ করেছেন তো আপনিই তাহলে এবার আপনারই খোলা উচিত নয় কি?"ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় জয়,দরজাটা সামান্য ফাঁক করে খুলে দেখে অন্ধকারে লাইনে একজন দাঁড়িয়ে আছে,জয়কে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে,
"আশ্চর্য লোক তো আপনি মশাই!কামরার সব দরজা বন্ধ করে কি করছেন বলুন তো?কখন থেকে নীচে দাঁড়িয়ে ভিজছি....আচ্ছা কোনো কুকর্ম করছেন না তো...সরুন দেখি...ভেতরে কে আছে দেখি..."লোকটি নীচ থেকে ওপরে উঠে আসে,সহযাত্রী পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জয়,যাইহোক আর কোনো ভয় নেই...কেউ তো আছে ওর সাথে এবার।

ভিতরে এসে লোকটা রীতিমত চেঁচিয়ে ওঠে,"আরে এ যে মহিলা,আপনি মশাই সত্যি করে বলুন তো দরজা বন্ধ করে একা মেয়ে পেয়ে এনাকে কি করছিলেন?"

-"উনি কি করবেন আর....উনি তো আমাকে দেখতেও পাননি...আসলে ভয় পেয়ে উনি শুধু সামনের দিকে বারেবারে তাকাচ্ছিলেন ওনার পিছনের সিটেও যে কেউ থাকতে পারে সেটা উনি আর খেয়াল করেননি...আর দোষটা আমারই,আমিই ওনার সিটের পিছনের সিটে উল্টোদিকে বসেছি...."বলেই হাসতে থাকেন ওই মহিলা।

"ও তারমানে বলছেন এতোক্ষণে কিছুই হয়নি তাইতো...তাহলে বেশ...এবার না হয় শুরু হবে...."বলেই বিশ্রীভাবে হাসতে থাকে লোকটা,মহিলাটাও যোগ দেয় ওনার সাথে....

জয়ের ভয় লাগতে শুরু করে..কারা এরা?এরা কি কোনো আততায়ী?জোট বেঁধে জয়ের থেকে কি টাকাপয়সা ছিনতাই করতে এসেছে?এবার কি করবে জয়?রাতবিরেতে কোথায় যাবে?ট্রেনের মধ্যে কে সাহায্য করবে ওকে?ইতিমধ্যেই ট্রেনটাও চলতে শুরু করেছে।

-"টুয়েলভের টেস্টের পর বেলুড়মঠ যাবার কথা মনে পরে জয়?সেদিনও এমন শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলে তুমি!এই ট্রেনেই,তারপর কি হয়েছিল নসিবপুর আর সিঙ্গুরের মাঝে সেটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে...."-কথাটা বলে উঠল সেই অপরিচিত মহিলা।

এক লহমায় মনে পরে গেল জয়ের সেদিনের কথা।ও আর রাজীব এসেছিল বেলুড়মঠ,জয়ই বাধ্য করেছিল রাজীবকে আর বন্ধুর জোড়াজুড়িতে সেদিন রাজীব এসেছিল জয়ের সাথে।তারপর নসিবপুর আর সিঙ্গুরের মাঝে রাজীব চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল,ও সুইসাইড করেছিল কারণ আলিশা ওকে সবার সামনে রিজেক্ট করেছিল,প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়ের চোখের সামনেই ঝাঁপ দিয়েছিল রাজীব,জয়ই খবর দিয়েছিল রাজীবের বাড়িতে,তারপর গ্রাম থেকে কলকাতায় মামারবাড়িতে চলে এসেছিল,বাড়িতে ও একা থাকতে পারতনা,রাজীবের শোকে পড়াতে ওর মনও বসতনা,এমনকি তারপর থেকে একা একা ও আর ট্রেনজার্নিও করতে পারেনি,সেই দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ফুঁটে উঠত সবসময়....তারপর পরীক্ষার শেষে মামাবাড়িতেই বরাবরের জন্য ও চলে এল।কিন্তু এই মহিলা তা জানল কি করে.....

হঠাৎ করেই সেই মহিলা এগিয়ে এল জয়ের দিকে...তার হাত দিয়ে জয়ের ঘাড়টা ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল দরজার দিকে...হাত তো নয় যেন বরফের একটা টুকরো..মাথাটা বাইরেরদিকে ধরে চিৎকার করে তিনি বলে উঠলেন,
"মনে করে দেখ জানোয়ার হিংসার বশবর্তী হয়ে তুই কি করেছিলিস রাজীবের সাথে,যে তোকে চিরকাল বন্ধু ভেবেছিল তাকে তুই ট্রেন থেকে ধাক্কা মারতে দুবারও ভাবিসনি..."
বৃষ্টির ঝাপটায় ভেসে যাচ্ছে জয়ের গোটা শরীর,লাইটপোষ্টের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ওর মুখ,সেই মহিলা তখনও বলে চলেছে,"দ্যাখ শয়তান দ্যাখ তুই, এবার কেমন লাগে,বোঝ এবার আমার রাজীবের ঠিক কতটা কষ্ট হয়েছিল তখন...."

জয় হারিয়ে যাচ্ছে পুরানো দিনে...চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেদিনের ঘটনা...বাবার কাছে একটা কম্পিউটার বায়না করেছিল ও,সেই প্রথম বাবা ওকে না করেছিল,ওর টেস্টে রেজাল্ট সেবার জঘন্য হয়েছিল,তাই বাবা ওকে  বলেছিল ফাইনালে ফার্স্ট না হলে উনি ওটা কিছুতেই জয়কে কিনে দেবেন না,আর জয় ভালো করেই জানত রাজীব যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন শত চেষ্টা করলেও ও প্রথম হতে পারবেনা,তাই পরিকল্পনা করতে শুরু করল ও....রাজীবকে নিয়ে বেলুড়মঠ ঘুরতে গেল,ইচ্ছা করেই শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরল,তারপর শরীর খারাপের নাটক করে গেটের সামনে এগিয়ে গেল হাওয়া খাবে বলে....বেচারা রাজীবও বন্ধুকে দেখতে গিয়ে এগিয়ে গেল গেটের কাছে আর তারপরই ধাক্কা মেরে ফেলে দিল রাজীবকে,ঠিক তখনই ওপাশ থেকে আসা মালগাড়ি ছিন্নভিন্ন করে দিল রাজীবের শরীরটা,শরীরটার এতোটাই খারাপ অবস্থা হয়েছিল যে সবকটা টুকরোয় ঠিকঠাক খুঁজে পাননি মিনতিদেবী।তারপর প্ল্যানমাফিক জয় সবাইকে জানিয়েছিল আলিশার জন্যই রাজীব এমন করেছে,পুলিশ নাকি আলিশাকে দু একবার জেরাও করেছিল...তারপর জয় চলে যায় ওর মামারবাড়ি....হঠাৎ করেই মনে হয় ঘাড়ের কাছে চাপটা শিথিল হয়ে এসেছে জয়ের,উঠে দাঁড়ায় ও....মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে ওর....কিন্তু একি!!!

ওর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আর কেউ না এ যে আলিশা...সারা শরীর ছিন্নভিন্ন....গলাটা বেঁকে গেছে,জিভটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে...আর পাশের ওই লোকটা ওটা তো...ওটা তো রাজীব....বিশ্রীভাবে হাসতে থাকে আলিশা,ওর সাথে রাজীবও...
-"কি ভেবেছিলে জয়....আমি তোমাকে রিজেক্ট করেছিলাম আর রাজীবকে ভালোবেসেছিলাম বলে তোমার এতো রাগ..জীবনে কোনোদিন না শোনোনি বলে আমার ওপর এমন করে প্রতিশোধ নিলে...নিজের দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে...মামার অতো পয়সা ছিলনা আমার হয়ে কেস লড়ার...তাই আমি চলে এলাম রাজীবের কাছে....এবার তোমার পালা....এতোদিন পর তোমায় আমরা একা পেয়েছি..পাপের শাস্তি ভোগের জন্য তৈরী হও তুমি..."জয়ের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে আলিশা আর রাজীব....

"তো কি করতাম আমি?বাবা আমাকে সাফ সাফ জানিয়েছিল ফার্স্ট না হলে কম্পিউটার কিনে দেবেনা...আর তুমি?তুমিও বা কম কিসে?বড়োলোকের ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে ভালোবাসলে কিনা গরিব ছেলেকে....কি ছিল ওর?কি দিতে পারত ও তোমায়?জয় যা চায় সেটা ও হাসিল করে তারপরই ছাড়ে"-হিসহিসিয়ে বলে ওঠে জয়।

"আমাকে নিজের পথ থেকে সরিয়েছিস ঠিক আছে কিন্ত নির্দোষ আলিশাকে ফাঁসিয়ে বিশাল বড়ো ভুল করেছিস তুই জয়... তোর পাপের ফল আজ পাবি তুই...হিংসা না করে চেষ্টা করলে হয়ত তুই সফল হতিস...কিন্তু না তা তুই করিসনি...শর্টকাটে ফার্স্ট হতে গিয়ে তিন তিনটে জীবন তুই ধ্বংস করেছিস..."ঘড়ঘড়ে গলায় কথাগুলো বলে রাজীব।

"আমাকে ছেড়ে দে রাজীব... আমি না তোর খুব ভালো বন্ধু... কাকিমাও তো আমাকে কত ভালোবাসতেন... তোর মনে নেই? এবারের মতো আমাকে মাফ কর....আমি কোনোদিনও আর এমন করব না" -মিনতির সুরে বলে জয়।

"মৃত্যুর এপারে ক্ষমা শব্দের কোনো মাহাত্ম্য নেই জয়, এখানে একটা শব্দই রাজ করে আর তা হল প্রতিশোধ, তোর জন্য মা আর আলিশা অকালে চলে গেছে,আমাদের পরিবারটা ধ্বংস হয়েছে শুধুমাত্র তোর জন্য...এসবের মূল্য তো তোকে দিতেই হবে..." হাত দুটোকে সামনে এনে চলন্ত ট্রেন থেকে জয়কে ধাক্কা মারে দুজন.....ট্রেনের চাকায় কাটা পরে যায় জয়ের দুই পা...যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে জয়.. কাটা পা নিয়ে লাইনের ওপরেই ছটফট করতে থাকে ও.. কিন্তু তার কন্ঠস্বর শোনার মতো আশেপাশে কেউ নেই... হঠাৎ করেই রাতের নিস্তব্ধতা চিরে আওয়াজ আসে...কুওও...ঝিক্..ঝিক্...ঝিক্...ঝিক্...চোখে জোরালো আলো এসে পরে জয়ের...পাশ থেকে কে যেনো বলে ওঠে,- "তোমার সময় শেষ জয়...." মালগাড়ির চাকায় টুকরো টুকরো হয়ে যায় জয়ের শরীর।

রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দুটো ছায়ামূর্তি........ বিচারে যেসকল সূক্ষ্মপাপের শাস্তি হয়না সেই সকল পাপীদের তাদের কৃতকর্মের শাস্তি দিতে পৃথিবীতে এভাবেই ফিরেফিরে আসতে হয় ওদের,ওদের মতো সূক্ষ্মদেহীদের... ওরা আজও ফিরে আসে।
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 1  Canada : 5  China : 46  Europe : 1  France : 9  Germany : 6  India : 289  Ireland : 58  Mongolia : 1  
Netherlands : 1  Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 7  Sweden : 21  Ukraine : 14  United Kingdom : 1  United States : 461  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 1  Canada : 5  China : 46  
Europe : 1  France : 9  Germany : 6  India : 289  
Ireland : 58  Mongolia : 1  Netherlands : 1  Russian Federat : 9  
Saudi Arabia : 7  Sweden : 21  Ukraine : 14  United Kingdom : 1  
United States : 461  
  • ৯ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা (১০৬)

    ২০২০ , মার্চ


© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ওরা আজও ফিরে আসে by Sayanti Saha is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৩৮৯৯৭
fingerprintLogin account_circleSignup