• ৯ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা (১০৬)

    ২০২০ , মার্চ



ভালোবাসা কারে কয়?
আনুমানিক পঠন সময় : ১৩ মিনিট

লেখিকা : বৈশাখী রায়
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জানুয়ারী
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ২৬ টি দেশ ব্যাপী ১০২৩৪ জন পড়েছেন।
ভালোবাসা কারে কয়?

(১)
দুর্গাপুর থানা। বড়বাবুর টেবিলের ওপর থাকা মান্ধাতার আমলের পুরোনো ল্যান্ড ফোন টা বেজে উঠল।

"হ্যালো"

"আরে দত্তমশাই, আর কতবার বলবো আপনাদের?"

"স্যার আপনি?ইয়ে না মানে..."

"আগেও তো বলেছি বাচ্চা ছেলে, ওরোম একটু মারামারি তো করবেই। ওরা করবে না তো আর কে করবে বলুন? আপনি না আমি?"বলে থামলেন বছর বাহান্নর রণজয় মিত্র। পেশায় স্থানীয় এম এল এ।
বড়বাবু কিছু বলে ওঠার আগেই ওদিক থেকে আবার, " নিন ছেড়ে দিন। আপনারাও পারেন। কথায় কথায় ছেলেপিলেদের এরম লকআপে ভরলে চলে?"
"হ্যা স্যার এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি..... এই নন্দ লকাপ টা খুলে দাও শিগগিরি"

লকাপ ও খোলা হলো আর হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো কুশল দাস। এম এল এ রনজয় মিত্রের ডানহাত বাহাত অজুহাত সব বললেই চলে। কোয়ালিফিকেশন? খুন,রাহাজানি,মারপিট,উচ্ছেদ,তোলাবাজি সবেতেই রিসার্চ স্তরের পড়াশোনা।গোটা শহরটা তাকে কুশ গুন্ডা বলেই চেনে। নিজের ছেলের নামের আড়ালে এমন এক বৈচিত্রময় চরিত্রের অধিকারীকে দেখলে হয়তো স্বয়ং ভগবান রাম ও ডরাতেন। বাইরেই বাইক নিয়ে অপেক্ষমান কুশের শাগরেদ। নাম বিলে। এ নামের মাহাত্মই বা কম কি?নিজেদের নামের মাহাত্ম সম্পর্কে এরা অবগত কিনা তা একমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরই বলতে পারবেন। তা জানলেই বা কি আর না জানলেই বা কি? নিজেদের কাজকর্মে স্বয়ংসৃষ্ট কৃতিত্বের ওপরই তাদের অগাধ বিশ্বাস। মাহাত্ম বদলাতে আর কতক্ষন?
"এই কুশদা ফের এই মালটা তোমায় তুলে নিয়ে এলেনা কেলিয়ে দেব মাইরি। শালা ছোটকা এতবার বারণ করে তবু কথা কানে ঢোকেনা নাকি?"
কুশ কথা বলেনা। বরাবরেরই চুপচাপ সে।অযথা বকবক তার পোশায় না। বরাবরের নির্বাক। অথচ মাথায় একবার রক্ত চেপে গেলে অন্য মানুষ সে। তখন তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই দুটো মানুষ এক ই। কুশ উঠে বসে বাইকের পেছনে। বাইক স্টার্ট।সাথে বিলের মুখ ও। এদিক সেদিকের হাজারো কথা। সিংহীপাড়ায় কোন মেয়ে ওকে দেখে ঝাড়ি মেরেছে? বড়পার্কের উল্টোদিকের বাড়িটায় কোন মেয়েটা রোজ বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে?হিমাংশুবাবুর কাছে সোম বুধ শুক্র কোন মেয়েটা গোলাপি চুড়িদার পরে পড়তে আসে, এইসব গল্প তার। বিলের ওই একটাই দুর্বলতা-নারী চরিত্র। মেয়ে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে রোজই মেডিটেশন করবে ভাবে। কিন্তু কোনো কিছুই আদতে ফলপ্রদায়ী নয়। আর এই মেয়েদের ব্যাপারেই কুশ চিরকালই বড় উদাসীন। এটা ঠিক তার ধাতে নেই। মাথায় দাঙ্গা,হাঙ্গামা,মেশিন, টাকাপয়সা ছাড়া আর কিছুই ঘোরেনা ওর। মেয়ে জাত টার প্ৰতি ঘেন্না ওর সেই ছোট্টবেলা থেকে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো মেয়ের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনা কুশ।বিলে এমন যোগ্য গুরু আর পাবে কোথায়?বিলে জানে এই কথাগুলোর কোনোটারই প্রত্যুত্তর সে পাবেনা কুশের কাছ থেকে।তবুও ওই এক বুলি ও রোজ কপচাবেই।কুশদাকে নারীকাহিনী না শোনালে তার ভাত হজম হয়না।

বাইকটা মধুপুর মোড় ঘুরে বড় দিঘিটাকে পাশে রেখে সোজা গিয়ে থামে লাল সাদা চারতলা বাড়িটার সামনে। রণজয় মিত্রের বাড়ি। গেট খুলে সোজা ভেতরে। সোফায় প্রায় শুয়েই পরে বিলে।কুশ বসে। খানিক বাদে ঘরে ঢুকলেন এম এল এ সাহেব।
"বাজারের একটা দোকান নিয়ে এত বড় কান্ড করার দরকার ছিল কি?তোরা এখনো কাজ শিখলি না কুশ। পাতি একটা দশ বাই বারোর দোকান- তাই নিয়ে আজ আমায় থানায় ফোন করতে হলো?'
কুশ এখনো চুপ। কিছু বলেনা। শুনে যাচ্ছে সে। বিলেই বলে ওঠে,"আরে ছোটকা, ও পাড়ার মালটা, রঘুনাথ বসাক, ব্যাটাচ্ছেলে সমাজসেবা করতে এসছিল। এসেই শালা পুলিশ কে ফোন। আমরাতো সালটেই নিয়েছিলাম নাহলে। একবার সামনে পাইনা! দেব ঠুকে শালাকে।"
"থাক হয়েছে, দোকান বাদ দে। এদিকটা আমি দেখেছি কি করা যায়। কুশ, রংপুরের বাজারের ঠিক সামনেই বড় রাস্তার মোড়ের বাদিকেই একটা বাড়ি আছে। চিনিস? প্রায় কুড়ি একুশ কাঠা জায়গা নিয়ে বাড়িটা। ভাবছি একটা শপিং সেন্টার বানাবো।বাড়িতে একটা বুড়ো আর বুড়ি ছাড়া কেউ থাকেনা।দেখতো তুলতে পারিস নাকি? বেশি চাপ হবেনা"
"ভেবোনা ছোটকা, দু সপ্তাহ টাইম দাও। কাজ হয়ে যাবে।"-এতক্ষনে মুখ খোলে কুশ।

(২)
"ঠাম্মা ,ও ঠাম্মা" নিচ থেকে হাঁক দিতে দিতে দোতলায় উঠতে থাকে ঝিমলি।
"কৈ গেলে গো তোমরা? দাদু ও দাদু" আবার ডাক।
"উফফ দাঁড়া দাঁড়া, পায়ে এই বাতের ব্যথা নিয়ে এই বয়সে তোর মতো কি আর দৌড়াদৌড়ি করতে পারি?" বলতে বলতে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসেন জয়া।
"কি করছিলে বলোতো?"
"কি করবো?কটা বাজে দেখেছিস? তোর দাদুর জন্য চা করছিলাম। এইতো আমার কাজ।আজীবন খিদমত খেটে গেলাম।"
"বেশ বেশ জীবন সম্পর্কে এত অভিযোগ পরে করবে। একদম ঠিক সময়ে এসছি বুঝলে?"
এতক্ষনে জয়ার চোখে পড়লো ঝিমলির হাতের প্যাকেটটা।
"ওঃ এই ব্যাপার, তা আজ আবার কি আনলি?"
"আরে আর বলোনা। স্কুলের পাশেই একটা নতুন চপের দোকান খুলেছে। যা ক্লাসিক গন্ধ বেরোচ্ছিল না! আহঃ! নিয়ে চলে এলাম খান দশেক।"
"এক্কেবারে দশখানা? কে খাবে অত?"
"কেন আমরা? তিনজনে মিলে দশখানা চপ খেতে পারবোনা? কি যে বল?"
"হ্যা সেইতো, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এই বয়সে গাদা গাদা চপ খেয়ে মরি আর কি?"
"আবার কমপ্লেন?" বলেই জয়া কে চেপে জড়িয়ে ধরে ঝিমলি।
এমন মিষ্টি একটা মেয়ে কে কাছে পেয়ে জীবন টাই বদলে গেছে জয়া আর অরুন এর।
"ওরে ছাড় ছাড়, এই বুড়ো হাড় পট পট করে ভেঙে যাবে এবার। যা তুই দাদুর কাছে গিয়ে বস। আমি চা নিয়ে আসছি। মুড়ি খাবিতো? আর হ্যা দাদুকে কিন্তু একটা চপ দিবি ব্যাস।" বলেই রান্না ঘরে চলে গেল জয়া আর ঝিমলিও দাদুর কাছে।
এই মাসখানেক হলো ঝিমলি ভবনাথপুর গার্লস স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করেছে।ঝিমলি ভৌমিক।কলকাতার মেয়ে, ভারী ছটফটে প্রাণখোলা উচ্ছ্বল মেয়েটা জয়া আর অরুনের বাড়ির একতলায় ভাড়া নিয়ে এসেছে। প্রথমে তো মনেই হয়নি এমন মায়ায় জড়াবে মেয়েটা। এই একমাসেই এতটা কাছের কেউ হয়ে উঠতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস ই করতে পারতো না ওরা।আজ পনেরো বছর হয়েেছে ছেলে বৌমা একসিডেন্ট এ গত হয়েছে। তারপর নাতি কে মানুষ করা। সেও আজ বিদেশেে চলে গেছে পাাঁচ বছর হয়ে গেল। ওখানকারই কোনো এক বিদেশিনী কে বিয়ে করে  গ্রিন কার্ড হোল্ডার।দেশে যে কোনোদিনই আর ফিরবেনা তা বলাই বাহুল্য।অর্ক ফোন করে মাঝে মাঝে। দাদু ঠাম্মা কে ওখানে নিয়েও যেতে চেয়েছে অনেকবার। কিন্তু নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে বসবাস ওদের কারোর ই পোশাবেনা। ফলস্বরূপ এই বিশাল অট্টালিকায় ভুতের মতো দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দিন কাটতো এতকাল। এই একমাস হলো ওদের জীবনটা এক্কেবারে পাল্টে গেছে।কোত্থেকে এক পাহাড়ি ঝর্ণা এসে জুটেছে।সকাল বিকেল তার কলকলানিতেই সারা বাড়ি মেতে থাকে। ঝিমলি এখন সপ্তাহান্তে বাড়ি গেলেও ওদের মন কেমন করে।
জয়া মাঝে মাঝে বলে ওকে," এত দাপাদাপি স্কুলেও করিস? ছাত্রীরা ভয় পায় তোকে আদৌ?"
"ওমা ভয় পেতে যাবে কেনো খামোকা? আমায় ওরা কত ভালোবাসে জানো? আর আমি কি জয়া চক্রবর্তী নাকি যে অরুন চক্রবর্তী দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে?''
"তবে রে?" বলেই দুজনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।এমন হাসির শব্দে বাড়িটা মনে হয় শীত ঘুম থেকে ফের জেগে উঠেছে। জয়া ভাবে কদিনই বা আয়ু আর ওদের? তবুও এই মেয়েটার মুখ চেয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। আরো অনেক দিন....আরো অনেক বছর।

(৩)
টিং টং...ডোরবেল টা বার দুয়েক বাজতেই দরজা খুললেন জয়া।
"আপনি কি জয়া চক্রবর্তী? বিলে জিজ্ঞেস করে।
এই অসময়ে দুজন অচেনা ছেলেকে দেখে খানিকটা ঘাবড়েই ওঠেন জয়া। এই বুড়োবুড়ি দুটোর সাথে এদের কি দরকার থাকতে পারে ভেবে পায়না।
"হ্যাঁ... কিন্তু", কিছুটা অবাক হয়ে জবাব দেন তিনি।
"কিন্তু টিন্তু পরে হবে ঠাকুমা, আগে দাদুকে ডাকুন দেখি একবার?"
"তোমরা?" আবারো একবার কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করতে যায় জয়া।
"আরে বলছিতো বলবো সব।দাদুকে ডাকুন তো আগে।"
 জয়ার ভারী ভয় করতে লাগলো।এই সময়টা ঝিমলির কথা খুব মনে হতে লাগলো ওঁর। মেয়েটা থাকলে এখন একটু ভরসা পাওয়া যেত।কিন্তু আজ শনিবার।গতকাল বিকেলেই বাড়ি গেছে ও।ফিরতে ফিরতে সেই কাল বিকেল আবার। জয়ার ডাকে ধীর পায়ে নিচে নেমে আসে অরুন।
"কি ব্যাপার?তোমরা কারা?"
"আরে!দাদু যে। এমন কিছুই ব্যাপার না দাদু।।খুব সহজ ব্যাপার..আসলে এই আপনাদের বাড়িটা একটু খালি করতে হবে এই যা..তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব"
নিজের কান কে বিশ্বাস হয়না অরুনের। কি বলছে ছেলেটা?তার নিজের হাতে তিল তিল করে বানানো বাড়িটা খালি করে দেবে কেন বাইরের লোকের কথায়?
"খালি করতে হবে মনে? মামদোবাজি পেয়েছ? এটা আমার বাড়ি। তোমরা কে আমাকে বলার?" গর্জে ওঠেন অরুন।
হঠাৎ করে স্বামী কে এতটা উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে যান জয়া। হাজার হোক এ বয়সে উত্তেজনা মৃত্যুর সামিল।
"আরে দাদু বুঝছেন না কেন? আপনাদের খাটনি কমিয়ে দিচ্ছি তো।বেকার এই বয়সে এত বড় বাড়ি মেনটেন করা মুখের ব্যাপার বলুনতো? তাছাড়া ওই মধুপুর বাজারের পেছন দিকটায় ঘোষপাড়ায় এগারোতলার প্রজেক্টটা দেখেছেন?ওখানে একটা ফ্ল্যাট দেওয়া হবে আপনাদের।সুখে থাকবেন।লিফটে করে উঠবেন নামবেন।বেকার এই পুরোনো লরঝড়ে বাড়ি আগলে পরে থেকে লাভ আছে কোনো?"
ছেলেটা কি যে বলে চলেছে মাথায় ঢোকেনা জয়ার।তবে অরুন সব ই বুঝতে পারছে। নিশ্চই ওই টাকার পিচাশ এম এল এ টার নজর পড়েছে বাড়িটার ওপর।
থাকতে না পেরে জয়াই বলে ওঠেন," কেন তোমরা এসব করছো? বেকার ঝামেলা করে আমাদের বাড়িটা...."
শেষ করতে পারেনা কথাটা। কুশ গর্জে ওঠে জয়া র ওপর,"চোপ, অনেক্ষন ধরে আপনাদের কপচানি শুনছি। ভালোয় ভালোয় কথা না শুনলে কি করতে হয় এই কুশ জানে, বুঝিয়ে দিন বুড়োকে।"
ধমকে ওঠে অরুন,"ছি, নিজের ঠাকুমার সাথে এভাবে কথা বলো বুঝি?"
"এই বুড়ো, বহুত বার বেড়েছে না তোর? রক্ত এখনো টগবগাচ্ছে? আমাকে ঠাকুমা দিদিমা শেখাচ্ছো?''
প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে কিছু পৌঁছনোর আগেই বিলে টানতে টানতে বের করে নিয়ে আসে কুশকে।
"ঠাকুমা দিদিমা শেখাচ্ছে আমায়"নিজেই গজরাতে থাকে কুশ। আসলে এই পিসিমা, দিদিমা, ঠাকুমা, মাসিমা সব মা যুক্ত শব্দ গুলোতেই বড় এলারজি কুশের।শুনলেই আগুন জ্বলতে থাকে মাথায়। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি চিরবিড়িয়ে ওঠে। আর হবে নাই বা কেন? কোন ছোটবেলায় বাপটা ট্রেন এ কাটা পড়লো আর মাটা দুদিন যেতে না যেতেই দুধের শিশু টাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল হারু গোয়ালার সাথে।কতই বা আর বয়স তখন ওর।চার পাঁচ হবে। তখন থেকেই মা জাতটার ওপরেই ঘেন্না ধরে গেছে ওর। একটা কোলের বাচ্ছা কে ফেলে রেখে যে মা পরপুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারে তার জন্য এটুকু অনেক কম ই মনে হয় কুশের। রেলের ঝুপড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো।একদিন স্টেশন রোডের ধারে গনেশদার চায়ের দোকানে কাপ ধুচ্ছিলো। সেখানেই চোখে পড়ে যায় রণজয় মিত্রের। তুলে আনে কুশকে। সেদিন থেকেই বাপ ঠাকুরদা বলতে একজনকেই চিনেছে ও - রণজয় মিত্র, কুশের ভগবান।
(৩)
"এখানে কুশ কে?" পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের পাশের ঠেকটায় হন্তদন্ত হয়ে এসে বেশ জোর গলায় জিজ্ঞেস করে ঝিমলি। খানিকটা হকচকিয়ে যায় সবাই। কুশের সামনে ওর নাম চিৎকার করে বলার মতো কলজে আশপাশের চারপাচঁটা অঞ্চলের কারোর নেই বললেই চলে। কিন্তু এটা কে? তাও আবার একটা কচি মেয়ে?
"আমি কুশ, কি দরকার?" কুশ এগিয়ে আসে। আর বিলে ভাবে আবার মেয়ে? এক্ষুনি কুশ দার সাথে লাগলো বলে।
"আপনি আমার দাদু ঠাকুমা কে শাসিয়ে এসেছেন?"
"কে দাদু ঠাকুমা?....ওঃ ওই রংপুরের কেস টা?"
ঝিমলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে,"লজ্জা করেনা আপনার?ওরকম বয়স্ক দুজন মানুষকে বাড়িতে একা পেয়ে শাসিয়ে এসেছেন?অবশ্য কাজ ই বা কি আপনাদের? পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারেন, বেকার গুন্ডামি ছাড়া আর করবেন ই বা কি? আবার বাড়ি খালি করতে বলেছেন কোন সাহসে? ওটা আপনার বাড়ি? ফের যদি ওই বাড়ির আশেপাশে আপনাকে দেখি তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবেনা" কথা গুলো নিমেষে বলেই চলে গেল ঝিমলি।
কুশ এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে চুপ করে।বরাবরের মতো। বিলেও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন। অন্য কেউ হলে বিলে এতোক্ষন চুপ করে বসে থাকতো না।কিন্তু ওই যে নারী চরিত্র। সামনে সুন্দরী মেয়ে দেখলে হাত পা কেমন যেন পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যায় ওর। অগত্যা গোটা ব্যাপারটাই হজম করতে হলো। 
ঝিমলি মিলিয়ে যাওয়ার পর কুশ বলল," বিলে খোঁজ নেতো মেয়েটা কে?"
বিলে খোঁজ নিয়েওছিলো।চক্রবর্তী বুড়োর ভাড়াটে, ভবনাথ গার্লসের টিচার, কলকাতার মেয়ে, সেদিন ওদের ঝামেলার পর অরুণকে হস্পিটালাইজড করতে হয়েছিল।ফোন পেয়ে পরদিন সকালেই ছুটে এসছিল ঝিমলি। এই সব কথা বিলে জানিয়েছিল কুশ কে। তারপর থেকে অনেকদিন কুশ দেখেছে ঝিমলিকে রাস্তায়।স্কুল যেতে, স্কুল থেকে ফিরতে, বিকেলবেলায় দাদুকে নিয়ে সামনের পার্কটায় হাঁটতে যেতে, ঠাম্মার সাথে বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে।ঝিমলিও দেখেছে।আর বাইকে সওয়ার মানুষরূপী জন্তুটার প্রতি ঘেন্নায় ওর রন্ধ্র রন্ধ্র ভোরে উঠেছে।অথচ কুশের ঘেন্নাটা অনেকটা হালকা হয়ে জলের সাথে মিশে গেছে মনে হয়। কি একটা জানি হয়েছে কুশের?ঝিমলিকে কুশ দেখে আর ভাবে এরকম মেয়েও হয়?একদিকে ওর মা। যে কিনা রক্তের সম্পর্ক নাড়ির টান সব উপেক্ষা করে নিজের ছেলে কে ফেলে পালিয়ে যেতে পারে, আরেকদিকে ঝিমলি।দাদু ঠাম্মা র সাথে যার কোনো আত্মীয়তা, নিয়ম মাফিক সম্পর্ক কিছুই নেই অথচ সবটাই যেন আছে।অতি পরম কাছের কেউও এভাবে করেনা হয়তো যেভাবে ঝিমলি করে ওর দাদু ঠাম্মার জন্য।নালে সামান্য একজন ভাড়াটে হয়ে বাড়িওয়ালার জন্য কেউ কুশ গুন্ডার সাথে লড়তে আসে? কুশ ভাবে বড়ই অভাগা সে। পেটের সন্তান হয়ে ও কেউ কিচ্ছু পায়না। আবার কাউকে কাউকে ভগবান কিভাবে যেন এতকিছু জুটিয়ে দেন। হিসেব মেলেনা।ও বরাবরই ওই না পাওয়ার দলেই থেকে গেল।
আজকাল কুশ বাড়ি থেকেও বেরোয়না খুব একটা। বিলেই আসে মাঝে মাঝে ওর নারীকাহিনী শোনাতে।আজ ও এসেছে। খানিক বাদে এদিক ওদিকের মেয়ে,মহিলা,বৌদিদের গল্প ছেড়ে আসল কথায় ঢুকলো ও," রংপুরের বাড়িটার কথা কি ভাবলে কুশদা?তোমার দু সপ্তাহ তো দুমাস হতে চলল?'
কুশ নিরুত্তর।বিলের আগের কথাগুলো হু হা করে কাটিয়েছে।কিন্তু এটার কি উত্তর দেবে ও?
"কি হয়েছে বলোতো?ওই মেয়েটাকে ভয় পেয়ে গেলে নাকি?তুমি বলোতো মেয়েটাকে নিয়ে একটু মস্তি..."
কথা শেষ হয়না বিলের। কুশ গিয়ে গলাটা টিপে ধরে ওর,"ফের ঝিমলির নামে একটা খারাপ কথা বললে এখানেই শালা মেরে পুঁতে রেখে দেব।"
বিলে অবাক হয়ে যায়। চিনতে পারেনা। কাকে দেখছে ও? যে কুশদা মেয়ে কথাটার নামেই জ্বলে উঠতো আজ একটা মেয়ের জন্য ওর গায়ে হাত তুললো? বিলে বোঝেনা কিসের জন্য কুশদার এই পরিবর্তন? বা খানিকটা বোঝেও হয়তো।কিন্তু ও এটাও বোঝেনা এটার জন্য ও খুশি হবে না শোক পালন করবে? ও খালি এটা জানে আর যেই খুশি হোক বা না হোক কুশের এই পরিবর্তন রণজয় মিত্র কখনো ভালোভাবে নেবেনা....কোনোদিনও না।
(৪)
মাঝে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। সামনে ইলেকশন। জোর কদমে প্রচার চলছে। তাই হয়তো শপিং সেন্টার এর প্ল্যানটা খানিকটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। বিলে,কুশ দুজনেই খুব ব্যস্ত এখন।পোষ্টার, হোর্ডিং,পতাকা সব নিয়ে চারদিকে মিছিল মিটিং। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই ।ঝিমলি মাঝে মাঝে দেখতে পায় ছেলেটাকে। এদিক ওদিক করে। প্রথম প্রথম গাটা জ্বলে উঠতো। এখন আর হয়না। ও ছেলেটাকে বলে আসার পর আর তো কিছু করেনি ছেলেটা।ওর সাথে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করেনি।এমনকি স্কুলের মাধবী দিও বলেছিল কুশ গুন্ডার সাথে লাগতে যাসনা।কৈ? কিছুইতো হলোনা? তবে কি সবাই ওকে এমনি এমনিই ভয় পায়?এসব রাজনীতিও ভালো জিনিস নাকি?কিসব করে বেড়ায় ছেলেটা সারাদিন? যাকগে যা খুশি করুক।শুধু মানুষের ক্ষতি না করলেই হলো।
দাদু ঠাম্মা এতটাই ঝিমলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে এখন আর ও প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়িও যায়না।এসপ্তাহেও যাবেনা।এই রবিবার এখানে ভোট।দাদু ঠাম্মা কে ভোট দিতে নিয়ে যাবে ও।কেই বা আছে ওদের ঝিমলি ছাড়া? এইকদিনে একটা মেয়েকে ওরা এত আপন করে নেবে ঝিমলিও ভেবে উঠতে পারেনি।
এদিকে ভোটের কদিন আগে থেকেই চারদিক উত্তাল। প্রায়শঃই বোমা গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।সন্ধ্যে হলেই লোকজন বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে।জয়াও এখন ঝিমলি কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতে বলে। 
ভোটের দিন সকালটা এখনো অব্দি সব ঠিকঠাক।পরিবেশ শান্তই আছে। পাশের বাড়ির মঞ্জু কাকিমা এখুনি ভোট দিয়ে চলে এসেছে। ঝিমলি দাদু ঠাম্মা কে নিয়ে সবে বেরোলো। ভোট টা দিয়ে এসে ও বলে রেখেছে চিংড়ির মালাইকারি রাঁধবে। বুথের সামনেটা যেতেই চোখে পড়ে একটা জটলা।এতক্ষন তো সবকিছুই ঠিক ছিল।ঝিমলি ভাবে এখনই সব হতে হলো? দূরে ওই ছেলেটাকেও দেখতে পাচ্ছে ঝিমলি। ছেলেটাও বুঝি দেখছে ওকে।আজকাল ছেলেটা ঐভাবে কেন তাকিয়ে থাকে ওর দিকে?কিছু বলবে কি? কে জানে? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি যেন হয়ে যায়? একসাথে আট দশটা বাইক হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে কোত্থেকে?পেছনে বসা লোকগুলোর হাতে রিভলভার।হঠাৎ করেই চারদিকটা ঝাঁজরা হয়ে যায় গুলিতে।এলোপাথাড়ি লোকজন ছুটতে থাকে।ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে যায় গোটা জায়গা টা।আর এর মধ্যেই অতর্কিতে একটা বুলেট এসে লাগে ঝিমলির বুকে।দূর থেকে দেখতে পায় কুশ।মাত্র পাঁচ মিনিটের ধ্বংসলীলা চালিয়ে বাইকগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।কুশএর পা চলছেনা।মাথায় আগুন জ্বলছে, বুকের ভেতরটা পাথর দিয়ে কেউ থেঁতলে দিয়েছে মনে হচ্ছে।আর পারেনা।পাগলের মতো ছুটে আসে কুশ।ঝিমলির রক্তে মাখা দেহটা কোলে তুলে নেয়।ততক্ষনে ঝিমলির চোখ বুজে এসেছে। চোখ বুজতে বুজতেই দেখে সেই ছেলেটা না? আমার এত কাছে? তারপর সবটাই কেমন আস্তে আস্তে ধূসর,কালো, অন্ধকার....বিন্দুমাত্র দেরি করেনা কুশ।গাড়িতে করে ঝিমলি কে নিয়ে চলে আসে সদর হাসপাতালে। বিলে পরে দাদু ঠাম্মা কে নিয়ে এসেছে। ঝিমলিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ও.টি তে। আর বাইরের সিটে বসে কেঁদে চলেছে কুশ গুন্ডা। লোহার মতো শক্ত ছেলে টা যার ভয়ে সারা দুর্গাপুর কাঁপে, আজ বাচ্ছা ছেলের মতো হাউ হাউ করে কাঁদছে।সাথে জয়া আর অরুন ও। কুশ কাতরাচ্ছে,"ঝিমলি ভালো হয়ে যাবে তো ঠাম্মা?"
বিলে অবাক হয়ে দেখছে জয়া সান্তনা দিচ্ছে কুশকে।ঝিমলির সেদিনের সেই কুঁচকে যাওয়া চোখ ,রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ টা খুব মনে পড়ছে কুশের। কুশ ভেবে চলেছে ভগবান কেন এত নিষ্ঠুর? জীবনে যে মেয়েটা ওকে ভাবতে শেখালো, কাঁদতে শেখালো, নিজের অজান্তেই ওকে মানুষ করে তুললো, এতদিনে প্রথম যে মেয়েটাকে ও চেয়েও ঘেন্না করতে পারেনি,যার জন্য ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন তাকে কেড়ে নিচ্ছে ভগবান? কেন? ওদিকে জয়া ও ভাবে যে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আরো দশ টা বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো তার আজ এই পরিণতি, ছেলে, বউ, নাতি সবকিছুর সাথে এভাবে এই মেয়েটাকেও ছিনিয়ে নিচ্ছে উপরওয়ালা।কেমন বিচার এ? ঝিমলি নামের অবলম্বন টা এত পাকাপাকি ভাবে গেঁথে গেছে এই তিনটে জীবনে এর একমাত্র প্রতক্ষ্যদরশী বুঝি হসপিটালের এই করিডোর টা। বিলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। কি হচ্ছে ওর চোখের সামনে?

হঠাৎ করে কারোর ফোন বেজে উঠল বোধ হয়,"সখি ভালোবাসা করে কয়?সেকি কেবলই....."
বাইরে তখন ও হয়তো গুলি চলছে........
রচনাকাল : ৬/৩/২০২০
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 18  Germany : 4  Hungary : 1  India : 157  Ireland : 30  Japan : 1  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 5  Singapore : 1  
Sweden : 9  Ukraine : 8  United States : 337  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 18  Germany : 4  Hungary : 1  
India : 157  Ireland : 30  Japan : 1  Russian Federat : 6  
Saudi Arabia : 5  Singapore : 1  Sweden : 9  Ukraine : 8  
United States : 337  
  • ৯ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা (১০৬)

    ২০২০ , মার্চ


© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভালোবাসা কারে কয়? by Baishakhi Roy is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.
fingerprintLogin account_circleSignup