মেঘনা আজ সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত শ্বশুর বাড়ির লোক আসবে , সকাল থেকেই রান্না ঘরে , কাজের শেষ নেই | পাশের ঘর থেকে হেমলতা দেবী মেঘনার শাশুড়ি জোরে জোরে বলতে শুরু করেছে বৌমা তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে করবে ,তুমি তো ..আমার বোন ভগ্নিপতি অনেকদিন পর আসছে , দেখো যেন ত্রুটি নাহয় | মেঘনা শীল নোড়ায় মশলা বাটছিলো ...শুনে বললো , কোনোদিন কি এমন হয়েছে আপনার আত্মীয় না খেয়ে আপনার বাড়ি থেকে চলে গেছে ? দেখেছো বৌমা তুমি চুপ থাকতে জানো না যেন ...উত্তর দিতেই হবে | আগে তো চুপই থাকতাম মা ..মেঘনা আর কিছু বলার মতো উত্তর দিতে যাবে অনিমেষ দৌড়ে এলো রান্নাঘরে , চুপ করো না মেঘ ...নাইবা তর্ক করলে ...মেঘনা চুপ করে গেলো … নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো |
**
মেঘনা আর অনিমেষের বিয়ে হয়েছে দশ বছর হলো | মেঘনা যখন সতেরো বছর বয়েস তখন অনিমেষের সাথে বিয়ে হয় বাবা মার পছন্দে | অনিমেষ তখন সাতাশ বছরের , দশ বছরের ছোট বড়ো মেঘনা অনিমেষ | যখন প্রথম ফুলসজ্জা হয় মেঘনা ভয়ে বিছানার একপাশে বসে ছিল আজ ও মনে পড়ে মেঘনার ...একটা ছোট্ট মেয়ে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে ...যার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই , তার সাথে আজ কি ঘটতে চলেছে সে বিষয়ে সে যেন অন্ধকারের যাত্রী , মনে ভয় আর শরীরে যৌবনের শিহরণ নিয়ে শুরু হয় তার দাম্পত্য জীবন |
****
এইভাবেই দশ বছর পার করেছে মেঘনা এখন তার বয়েস সাতাশ | এখন সে যুবতী | এক কন্যার জননী |
অনেকটাই পরিণত | ছোট্ট থেকে সংসারে এসে আদর কম অনাদর বেশি পেয়েছে যা তার কিন্তু পাওয়ার কথা ছিল না কারণ সে হেমলতা দেবী আর সুকুমার বাবুর একটিমাত্র ছেলের বৌ | হেমলতা দেবী জাদরেল শাশুড়ি , সংসারে তারই লাঠি ঘুরবে এটাই চেয়েছেন আর পেয়েছেন স্বামী আর ছেলের দৌলতে | লাঠি ঘোরানোর চক্করে অনেক অত্যাচার করেছেন বৌমার ওপরে |
****
প্রতিদিন রাতে নিয়মিত পা টিপে তারপর মেঘনা অনিমেষের কাছে যাবে এইটাই রুটিন সে যত কাজই থাক না কেন | আজ ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি ...শাশুড়ির বোন ভগ্নিপতি চলে যাবার পর সব গুছিয়ে যখন নিজের ঘরে যাবে অমনি হেমলতা দেবী ডাকলেন , বৌমা চললে নাকি ছেলের কাছে ..যাওয়ার আগে পা টিপে দিয়ে যাও ..অগত্যা মেঘনা শাশুড়ির সেবা করে যখন নিজের ঘরে ঢুকছে , অনিমেষ জেগে রয়েছে বিছানায় অপেক্ষা করছে , দেখে একটুও আনন্দ হলো না মেঘনার , কারণ মেঘনা ক্লান্ত , তার মন চাইছে না এখন অনিমেষ এর কাছে মেলে ধরতে তার শরীর কে , কিন্তু কে শুনবে ! মেঘনার ক্লান্তির থেকে অনিমেষ এর শারীরিক খিদে অনেক বেশি , মেঘনার ক্লান্ত শরীর অনিমেষের দানবীয় ইচ্ছে সব যেন মিলেমিশে মেঘনার চোখের জলে রূপ নেয় |
****
মেঘনার দশটা বছর এইভাবেই ইচ্ছে অনিচ্ছে তে কেটেছে | অনিমেষ এমনি ভালো ছেলে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে কিন্তু মেঘনার চাওয়া পাওয়া এর হিসাব সে রাখে না | কখনো মন ভালো থাকলে হয়তো মেঘনা কে নিয়ে বাইরে গেলো , ঘুরে এলো সেও খুব কালে ভদ্রে | মেঘনা তার ছোট্ট মেয়ে ..সংসার এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে ...ভালো লাগা মন্দ লাগা সেদিনই জলাঞ্জলি দিয়েছে যেদিন অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে হয়েছে |
***
মেঘনা বসে আছে বারান্দায় হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো ...হ্যালো , মেঘনা শুভ বিবাহ বার্ষিকী ...প্রণাম নিও মা আমাদের , বাবাকে ও আমাদের প্রণাম জানিও , হ্যাঁ তোরাও ভালো থাকিস | হুম মা আমি ভালো আছি , একদম চিন্তা করবে না | মেঘনার মা সুলতা দেবী মেয়ের গলার আওয়াজে সেইভাবে স্বতঃস্ফূর্ততা না পেলেও কিছু বুঝতে দিলেন না ...খবর নিয়ে ফোন রেখে দিলেন | সংসারের প্রতি মোহো মায়া সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে , প্রথম প্রথম বিবাহবার্ষিকী নিয়ে উন্মাদনা ছিল এখন আর নেই , অনেক আশা করে থাকতো অনিমেষ তার জন্য গিফট আনবে , একটা দিন অফিস ছুটি নেবে , সময় কাটবে শুধুই দুজনের , সব ভাবনা বৃথা ! প্রতিবার মেঘনা মনে করাতো তাদের আজ বিবাহবার্ষিকী , মনে করাতে করাতে আজ সে ক্লান্ত , তার আনন্দ চাওয়া পাওয়া তে যেন পলি পড়েছে , সে নিরুত্তাপ থাকে এখন |
আজ অনিমেষ যেমন সময়ে ফেরে অফিস থেকে তেমনই ফিরলো , মেঘনা চা দাও তো ...বড্ডো মাথা ধরেছে , মেঘনা চা নিয়ে আর সাথে বাম নিয়ে হাজির হলো অনিমেষের সামনে | অনিমেষ চা তে চুমুক দিতে যাবে ফোন বেজে উঠলো ...ফোনের ওপার থেকে ছোটবেলার বন্ধু রঞ্জু বলে উঠলো হ্যাপি এনিভার্সারি অনিমেষ | অনিমেষ বলে উঠলো এই রে ...আজ বিবাহবার্ষিকী আমাদের ! দেখেছিস ভুলেই গেছি ...মেঘ আজকাল মনে করায় না আমাকে | মেঘনা যেন শুনেও শুনলো না , সে নিজের ঘরে চলে গেলো | চা খেয়ে বন্ধুর সাথে কথা বলা শেষ করে অনিমেষ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মেঘনাকে ...শুভ বিবাহ বার্ষিকী মেঘ , উত্তরে মেঘনা বললো তোমাকেও শুভেচ্ছা জানাই ..ভালো থেকো ..ছাড়ো আমায় , পর্দা সরানো আছে , কে কি ভাববে আবার | অনিমেষ একটু মনোক্ষুন্ন হয়ে বলে উঠলো তোমার মধ্যে প্রেম বলে বোধহয় কিছু নেই |
সারাদিন শুধু রান্না করা ছাড়া কিছুই বোঝো না , আগে মেঘনার খারাপ লাগতো শুনে এখন আর লাগে না , নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে ভালো লাগা ..সব যেন কোথায় হারিয়ে ফেলেছে , সে নিজেও জানে না ! মুচকি হেসে উত্তর দিলো মেঘনা তবু ভালো তোমার মধ্যে প্রেম বেঁচে আছে ...আমি তো ভাবলাম ..কি ভাবলে মেঘ না ..কিছু না| যাও রেডি হও মেঘ আজ বাইরে খাবো , শুনে মেঘনা বললো , ঘড়ি র দিকে একবার দেখো , কটা বাজে এখন ?
ও ও তাই তো ...এখন গেলে আর খাবার পাওয়া যাবে না তাহলে ঘরেই কিছু রেঁধে নাও | মেঘনা চটজলদি জবাব দিলো , সব রান্না হয়ে গেছে , আমি জানি যাওয়া হবে না তাই আমি ঘরেই রান্না করেছি | যদিও তুমি বললে আমি রান্না ছাড়া কিছু বুঝি না ...কি করবো বলো ...এইটাই জীবন আমার |
টেবিল এ সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মতো উঠে চলে গেলো ...প্রতিদিনের মতো সব কাজ সেরে শাশুড়ির সেবা করে ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় অনিমেষ চেঁচিয়ে বলে উঠলো , আজকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারলে না , আজকের দিনে ও তোমাকে একটু আগে বিছানায় পেলাম না ..তোমার কি মনে হয় না কিছু মেঘ ? মেঘনা নিজের দিকের জায়গা পরিষ্কার করে শুতে যাবে অমনি অনিমেষ যেন ক্ষুধার্থের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো ...বিছানায় পড়ে রইলো মেঘনার নিথর দেহ | নানা প্রশ্ন মেঘনার মনকে সেই মুহূর্তে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগলো আমি কি শুধুই অনিমেষের শয্যাসঙ্গিনী ? অনিমেষ আমার মন কে নয় আমার শরীর কে ভালোবাসে , কিন্তু আমি কি চাই অনিমেষ কি কোনোদিন জানতে চায় ? আমি চাই একজন ভালো বন্ধু ...আমি চাই একজন ভালোবাসার মানুষ যে আমার শরীর নয় মন কে ভালোবাসবে , যে স্ত্রী কে যন্ত্র নয় মানুষ ভাববে , তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে | মেঘনার অন্তর চিৎকার করে যেন বলতে চাইছে ...আমি তো শারীরিক আর মানসিক ভাবে ধর্ষিতা নারী , আমার মনের ক্ষত এর দাগ যে রয়ে যাবে আমৃত্যু অনিমেষ |
রচনাকাল : ৩/৩/২০২০
© কিশলয় এবং ঝিমলি ব্যানার্জি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।