চিত্র ১
-ওঠ... পিকাই বাবু ওঠ... কখন থেকে ডাকছি বাবু, পুজো আছে তো আজ...
মায়ের ডাকে চোখ কচলে উঠে ছোট্ট পিকাই দেখলো ঘড়িতে ৭ টা বাজে। ওহ্ আজ কিসের পুজো?!
গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করল, 'কিসের পুজো মা আজ?'
- তুমি জানো না? আজ তো হ্যাপি নিউ ইয়ার..
- কিন্তু মা ইটস্ এপ্রিল তো!!
- হ্যাঁ কিন্তু এটা হলো বাংলা হ্যাপি নিউ ইয়ার, নববর্ষ। ঠাম্মা শিখিয়েছে না তোমাকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়...
- শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, তারপর কি যেন.. মাথা চুলকায় পিকাই।
- অগ্রহায়ন..
- পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন -চৈত্র.. এক নিশ্বাসে শেষ করে নিজেই খুশি তে হাততালি দিয়ে হেসে উঠলো পিকাই।
মা ও হাততালি দিয়ে বললো, 'তাহলে আজ বৈশাখ এর প্রথম দিন.. আজ হ্যাপি নিউ ইয়ার..'
- না মা, ইট ইজ নববর্ষ
এই বলে কোমরে হাত দিয়ে গটগট করে নামতে থাকল পিকাই।
- মুচকি হেসে মা বললো গুড বয় স্নান করে নাও ব্রাশ করে, পুজো দিতে মন্দিরে যাবো আমরা সবাই....
চিত্র ২
- ঠাম্মা এটা মা কালী, কিন্তু দেখো সিংহ র উপর বসে.. কিন্তু মা কালী তো সিংহ র উপর বসে না ঠাম্মা! আবার দেখো জিভ ও বের করে নেই, মিটি মিটি হাসছে.. এটা কেমন মা কালী?!
- পিকাই সোনা এটা হলেন ভ্রামরী দেবী। তোমাকে না আমি শিখেছিলাম দুর্গা কালী সব একই, সবাই দেবী শক্তির রূপ। ভ্রামরী দেবী হলেন কালো ভ্রমর এর দেবী, খুব জাগ্রত বাবা, নম করো।
কি জানি কি বুঝলো, খুব করে প্রণাম করলো পিকাই।
- বাট ঠাম্মা, ভ্রমর মানে কি?
- 'ভ্রমর মানে Bees..' ; পাশ থেকে বাবা এসে কোলে তুলে নিলো পিকাই কে; 'চলো আরতি হচ্ছে প্রসাদ দেবে। তুমিও চলো মা।'
- না না এই হুইল চেয়ার এ বসে যাতায়াত এই কত সমস্যা, আবার ওই ভিড়ে.. তোরা পুজো দে আমি বাইরে আছি।
চিত্র ৩
- বাবু হাত পাতো, প্রসাদ নাও.. ; এই বলে একটা মোটা লাড্ডু পিকাই এর হাতে দিলো মা।
- বাট মা আমি একটুও মিষ্টি খাই না তুমি জানো।
- জানি বাবু তুমি একটুও মিষ্টি লাইক করো না কিন্তু প্রসাদ তো ফেলে দিতে নেই..
মন খারাপ হয়ে গেলো পিকাই এর। কেনো ফুচকা দেওয়া হয়না প্রসাদ এ?! শুধু মিষ্টি, ফল, লাড্ডু.. ধুর.. মা বললো প্রসাদ ফেলতে নেই, ঠাম্মা বললো খুব জাগ্রত ঠাকুর। কি যে করি?!
অনেক ভাবতে ভাবতে মন্দির থেকে লাড্ডু টা হাতে ধরেই বেরিয়ে এলো পিকাই।
বাইরে বেরিয়ে চোখ পড়লো একটা মাঝ বয়সী ছেলে, গায়ে কিছু নেই, একটা ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে বসে। সে ও পিকাই এর দিকেই চেয়ে। চোখে মুখে খিদে স্পষ্ট।
মাথায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বুদ্ধি খেললো পিকাই এর। মা বলেছে প্রসাদ ফেলতে নেই, কিন্তু খেতেই হয় এটা তো বলেনি।
এগিয়ে গেলো আরো ওই ছেলে টার দিকে। তাকে লাড্ডু টা বাড়িয়ে দিলো। ছেলেটার চোখ ছলছল করে উঠলো। ক্ষুধার্ত একটা পেট এর ধন্যবাদ যেনো জলের ঢেউ হয়ে ওর চোখের কিনারায় এসে ঠেকছিলো।
চিত্র ৪
দূর থেকে গোটা টা দেখেছিল ঠাম্মা। দেখতে দেখতে কখন ঠাম্মার গাল ভিজে গেছিল নিজেও বুঝতে পারেনি।
- 'কি মা, তুমি কাঁদছ কেনো?' পিকাই এর বাবা এসে কাঁধে হাত রাখলো ঠাম্মার।
- সেদিন টা খুব মনে পড়ে রে অভি, সেদিন ও নববর্ষ ই তো ছিল। বউমা যখন প্রথম সন্তান দিয়েছিলো, কত খুশি ছিলাম আমরা। তারপর যখন ডাক্তার বললো আমার নাতি নাকি শুনতে পায়না, ঝুনঝুনির আওয়াজ এ হাত নাড়ায় না।
- মা থাক না, কেনো আবার ও সব..
- না রে অভি, সেটাও আমি সহ্য করে নিয়েছিলাম, কিন্তু মাঝরাতে আমার নাতি টাকে কে চুরি করে নিয়ে গেলো বল তো? তোরা কেউ কিছু করতেও পারলি না বল!
কান্নায় ভেঙে পড়লো ঠাম্মা।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অভি মা এর কাঁধে হাত রেখে বলল, 'মা চলো, পুজো হয়ে গেছে, বাড়ি যাবে চলো।
পিকাই... এদিকে এসো, জলদি এসো।'
হাঁক শুনে ছুটে এলো পিকাই... পিছনে ছেলে টা ততক্ষণে পিছন দিকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে..
চিত্র ৫
- তুমি নাকি আজ প্রসাদ না খেয়ে একজন কে দিয়ে দিয়েছ?!
মায়ের গলা শুনে চুপ পিকাই।
- কি হল বলো..
- আহ বউমা বোকো না ওকে বাচ্চা তো।
- না মা, প্রসাদ খাবে না কেনো ও?
- আজকের দিন টা ওকে বোকো না বউমা, গলা ধরে এলো ঠাম্মার।
এটা শুনে মা ও চুপ করে গেলো।
পিকাই একটু চুপ করে আস্তে করে মায়ের হাত টা ধরে বললো, 'মা ওর খিদে পেয়েছিলো, আমার ও মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করছিলো না, সরি।'
জড়িয়ে ধরে নিলো পিকাই কে মা। 'বেশ করেছো বাবু, কিন্তু আজ থেকে প্রসাদ নিজেও খাবে কেমন?'
- ওকে মা প্রমিস।
গাড়ি চলতে থাকলো নিজের গতি তে.. সবাই নিজের নিজের ভাবনায় জানলার দিকে তাকিয়ে.. পরিবেশ শান্ত, মৌন।
নিঃস্তব্ধতা কাটিয়ে হঠাৎ পিকাই বলে উঠলো,'জানো মা, যাকে লাড্ডু টা দিয়েছিলাম সেই ছেলে টা আজব.. না কথা বলতে পারে না শুনতে পায়.. আমি কতো করে জিজ্ঞেস করলাম আরেকটা লাড্ডু নিবি? কোনো রেসপন্স ই করলো না। বেচারার খিদে পেয়েছিলো মনে হয়। পরের বারে ওকে অনেক গুলো লাড্ডু দেবো মা ওকে? নববর্ষ তে খাবে তাইনা?'.. এই বলে একটা মিষ্টি হাসি দিলো পিকাই।।
রচনাকাল : ১৩/৩/২০২০
© কিশলয় এবং কুশল সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।