সক্কাল বেলা বলাই বাবুর সঙ্গে ওনার বউ এর একপ্রস্থ হয়ে গেছে। রোববারের বেলা। বলাইবাবু এই তিথিতেই অতিথি ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে চা আর দাবার আড্ডা বসিয়েছিলেন খাসা। দফায় দফায় দানের পর দান খেলা চলছে। যত দফা খেলা তত দফা চা। মাঝে মাঝে কত্তা র কত্তরকম বিজয়উল্লাস ভেসে আসছে-চেক মেট, কিস্তি মাত।
আর গিন্নী কে গদগদ গলায় হাঁক পাড়ছেন-গিন্নী আরেক কাপ চা.....।
চাচা ,চা তো খেয়ে যান। চা মানেই চাঁই চাঁই খিদে। আর খিদে খেদাবেন বা কি করে? কি রে মাধাই মুড়ি বেগুনি চলবে নাকি? বলাই বাহুল্য বলাই বাবুর অতিথিসেবার পেছনে চোরাফন্দি অতিথিকে আরো খানিকক্ষণ আটকে রেখে আরেকদান দাবার ঘুঁটি সাজানো। আপনে হক্ সে তিনি হাঁকেন- "ওগো শুনছ, ও গিন্নি ,চা বেগুনি হল?"
তার গদগদ গলার গদ্য বলাই গিন্নীর একেবারেই সহ্য হয় না। একেই তার গদাইলস্করী চাল। বেগুনের মত মুখ করে তিনি ঘামতে ঘামতে বেগুনি ভাজতে থাকেন ।
পুঁটির মা এসে বলে-ওমা বাবু তাড়া দিচ্ছে গো। গিন্নী র মাথায় খুন চেপে যায়। রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলেন-
- বাবুকে বল্ চা পাতার মুখাগ্নি হচ্ছে । আর বেগুন চিতেয় উঠেছে। বেগুন নামলে আমি চিতেয় উঠব। বলি রোববারের দিন,সকলের ছুটি। আমার একদিন ছুটি নেই কো। কি হাঘরে হাভাতে সংসারে বাবা বিয়ে দিয়েছিল ম্যাগো। খালি খাওয়া খাওয়া আর খাওয়া । পুঁটির মা অবধি আজ একবেলা কাজ করে,ওবেলা আসে না। একঘড়া -একবালতি জল কম দেয়।একবেলা ছুটি পায়। আমার ছুটি নেই, অ্যাঁ এই রাবণের গুষ্টি র পেছনে খাটতে খাটতে গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, বাবাগো.....
গিন্নী একটা ছুটির জন্য ছুটোছুটি করতে থাকেন।
একথালা বেগুনি আর দুকাপ চা,কত্তার বৈঠকখানায় ঠক করে রেখে বলেন -নাও চব্বচোষ্য গেলো।কুটোটি তো নেড়ে খাওনা।পুরুষ মানুষ হয়েছে।আবার দাবা খেলা হচ্ছে উউউ।তাড়াতাড়ি গেলো। আবার চববচোষ্য গুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে নয়ত।
দু একটা বাইরের লোকের সামনে, যদিও ওরা বেশি বেশি প্রতিবেশী তাও কত্তার মানে লাগে।তিনি বলেন -চববচোষ্য হলে তো শুধু আমি একা গিলি না,সবাই গেলে।
গিন্নী তো সেন্টু খেয়ে গেলেন। -কি আমাকে খাবার খোঁটা দিলে তুমি?
যাই হোক সেদিন দুপুরে কত্তার ঘরে ভায়োলিন বাজছিল।না মানে কেউ বাজায়নি,রোমান্টিক সিনে যেমন অদৃশ্যে বাজে আর কি।রোববারের দুপুর।এসি চলছিল ।ভাতঘুমের বিছানা।গিন্নীর চোখে একজোড়া জলের ফোঁটা দেখে কত্তা ইমোশনাল হয়ে পড়লেন ।কথায় আছে ঝড়বৃষ্টির পরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়।বলাই বাবু আকাশ পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন ।অদৃশ্যে ভায়োলিন বাজছিল ।গিটার বাজছিল।হারমোনিয়াম, তবলা.....লাল লাল লা লা লা,লাল লাল লা লা....চিরদিনই তুমি যে আমার,যুগে যুগে ....আলো অফ ছিল।জানলা দরজা বন্ধ।এসির ঠান্ডা হাওয়া ।তাই ওটা হয়ে গেল।.......না মানে জড়াজড়ি করে ঘুম।
সন্ধেবেলায় কত্তা গিন্নী দুজনেরই মেজাজ ফুরফুরে।কত্তার বল বেড়ে ডা বল এনার্জি ।কত্তার মধ্যে যুবক ভর করেছে।বাঙালি দের একটা স্বভাব, যুবশক্তি ভর করলেই কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আবৃত্তি করে।বলাই বাবুর ভেতরে থাকা কবি সুকান্ত বেরিয়ে এসে বললেন,
হে মহামানব,আর দাবার ঘুঁটি তে নয়
এবার কড়াই খুন্তি সাঁড়াশি তে তুমি হানো।
গিন্নী কে গিয়ে বললেন- কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি।
বলাই বাহুল্য বলাই গিন্নীর নাম কবিতা ছিল ।
ফ্রিজে রাখা আছে চিকেন।আর বলাই গিন্নী আটা মাখছিলেন।কত্তা বললেন-আজকে রুটি আর মাংস টা আমিই রাঁধব।
খুকি উঁকি মেরে একটু ইন্টারেস্ট দেখাল।
-কি বাবা হেল্প করব নাকি?
কিন্তু না বলাই বাবুর মধ্যে তখন আস্ত আঠারো বছরের যুবক ভর করেছে,তিনি মাথা নাড়লেন ।তিনি তখন একাই একশো চৌষট্টি ।
ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন বলাই বাবু । অন্যদিন যে রিমোট নিয়ে ঝগড়া হয়,কাড়াকাড়ি হয়,আজ যুদ্ধে যাবার আগে গিন্নী র হাতে সেই রিমোটই ধরিয়ে দিয়ে বললেন -তুমি সিরিয়াল দেখো।আমি রান্নাঘরে গেলাম।
Operation theatre (O.T.)র মানে রান্নাঘরের আলো জ্বলে উঠল।গিন্নীর ঘর থেকে ধুম তানা ধুম তানার মিউজিক ভেসে আসছিল।সঙ্গে বাজ পড়ার করাত করাত আওয়াজ ।
O.T. এর আলো নিভল।এদিকে গিন্নীর সিরিয়াল ও শেষ।ঘর্মাক্ত বলাই বাবুর সঙ্গে তার পরিবারের দেখা হল,ডিনার টেবিলে ।বলাইবাবু টেনসনে কবিতা আবৃত্তি করছেন ।তার গলায় তখনও সুকান্ত ভট্টাচার্য ।
"হে মহাজীবন,আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন ,কঠোর গদ্যে আনো।
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।"
-আঃ একবেলা ছুটি দিয়ে আর কবার বলবে বাপু।দেখি খেয়ে দেখি।কি রেঁধেছ।
বলাই বাবু এদিকে দাঁত দিয়ে নখ কাটছেন, বিড়বিড় করছেন ,
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।
ওমা গিন্নী র ভেতরেও সুকান্ত বাবু ভর করলেন নাকি।গিন্নী খাবার মুখে দিয়ে ছন্দ মিলিয়ে বললেন ,
এ কী রান্না করেছ প্রাননাথ?নুন -মশলা ছাড়া চোঁয়া মাংস? আর এটাকি ঝলসানো রুটি?
নাঃ গিন্নী দের নেই ছুটি।
গিন্নী দের সত্যিই ছুটি নেই ।
বলাই কে আর লাই দিলেন না গিন্নী ।
আবার নতুন করে আটা মাখতে হবে তাকে।নুন ছাড়া আসেদ্ধ মাংসটা ফুটিয়ে অন্তত খাওয়ার মত করতে হবে আবার।তিনি হনহনিয়ে রান্নাঘরের দিকে চললেন।
বলাই কন্যা র কাল নাচের ক্লাস।সে ডান্সস্টেপ প্র্যাকটিস করছিল।
-মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি।
গিন্নী র কানে গান যেতেই তিনি gun উচিয়ে রান্নাঘর থেকে ঠেলে উঠলেন -ছুটি ছুটি।আহা ছুটির কি ছিরি।
কত্তার ও বোধকরি রবি ঠাকুরের ওপর রাগ হল।এমন গান বাঁধার কি দরকার বাপু।
হাঁক পাড়লেন -খুকিইইইইই।
-কি বাপি?
-গান থামা।
রচনাকাল : ৩১/১২/২০১৯
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।