• ৯ম বর্ষ ১১তম সংখ্যা (১০৭)

    ২০২০ , এপ্রিল



অ ন্ত্য মি ল
আনুমানিক পঠন সময় : ১৭ মিনিট

লেখিকা : স্বাগতা সরকার
দেশ : India , শহর : জয়নগর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , নভেম্বর
প্রকাশিত ২৩ টি লেখনী ৩৩ টি দেশ ব্যাপী ২০৬৮১ জন পড়েছেন।
-আমি আর পারছি না রে মিতালী।
সংসার টা বুঝি আর হল না আমার দ্বারা।
-কেন মৌ? হঠাৎ এরকম বলছিস? কি হয়েছে?
-ভীষণ ক্লান্ত লাগে রে আজকাল, আমি আর অশান্তি নিতে পারছি না রে।
-কি হয়েছে তো বল?বরের সাথে ঝগড়া?
-না সে সব না রে।
-তবে?
-জানিস, আমার শ্বাশুড়ী আমায় দুচোক্ষে দেখতে পারে না, কি করেছি জানিনা সত্যি, উঠতে বসতে বাপের বাড়ির খোঁটা, আমার বাবা মা নাকি রান্না টাও শেখায়নি ভালো করে। আমি খারাপ আমি খারাপ, শুনতে শুনতে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
-সে কি রে...
-তবে আর বলছি কি, জানিস সেদিন পিরিয়ড হয়েছে, তুই তো জানিস আমার কিরকম ব্যথা হয়, তাও কোনোরকমে উঠে রান্না করেছি, মাছের ঝোল টা না একটু খারাপ ই হয়েছে, পলাশ অফিস থেকে এসে ডিনার টেবিলে যেই খেতে বসেছে, অমনি শাশুড়ি এসে ঠেস মেরে মেরে বলছেন- ইস ম্যাগো তোর বৌ যা রেঁধেছে খোকা, দ্যাখ মুখে তুলতে পারিস কিনা।
এসব শুনে কার মাথার ঠিক থাকে বলবি, একে ঐসময় মুডের দফারফা, আমি ও রাগের মাথায় চার কথা বললাম, পলাশ না খেয়ে উঠে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে আমি মরে যাচ্ছি রে মিতালী।
-সত্যি মৌবনি,এরকম করলে কিন্তু খুব সমস্যা।
-প্রতি মুহূর্তে উঠতে বসতে আমি হ্যান পারিনা, ত্যান পারিনা, চাকরিওয়ালা বৌমা আনার সময় তো ঐসব মনে ছিল না? সংসারের জন্য আমি কি করিনি বলতে পারিস? তাতান যখন হল, শাশুড়ি পড়ে হাত ভাঙল। আমাকে কে দেখবে, তাতান আর ওনাকে কে দেখবে সব মিলিয়ে আমি অত স্যালারীর চাকরি টা ছাড়লাম, তাও যদি আমাকে শুনতে হয়, সংসারের জন্যে কিচ্ছু করিনি কেমন লাগে বল্?

মিতালী একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৌবনি বলে চলল-তাতান টাকে নিয়ে একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাব দেখিস, সব রসাতলে যাক।

মিতালী একটু হাসল।

-ওরকম মনে হয় মৌ। কখখনো পারবি না। এই আমাকেই দ্যাখ না, কতবার রক্তিম কে ডিভোর্স দেবার কথা ভেবেছি, পেরেছি? দিনের পর দিন ও ওর অফিস কলিগের সাথে অ্যাফেয়ার করে গেছে, আর আমি কেঁদে গেছি, বাপের বাড়িও চলে গেছি কতবার, ও ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, কদিন পরে আবার যেই কে সেই। আমি কি ছাড়তে পেরেছি বল?

-সে কি মিতালী? রক্তিম দা এখনো সেই মহিলার সঙ্গে?

-হ্যাঁ, এখনো, আমি জাস্ট ফেড আপ রে। শুধু পড়ে আছি বাচ্চা টার জন্যে। মেয়ে তো আমার মৌ। তুই জানিস আমার আর রক্তিমের যখন ঝগড়া হয়, সৃজা মাঝখানে বসে হাউহাউ করে কাঁদে। আমরা ডিভোর্স করলে ওর কি হবে ভেবে দেখেছিস? এই তোর আমার মত সরল ভালো মেয়ে রা এরকম মুখে অনেক ছেড়ে আসার কথা বলব, কিন্তুু সেই সংসারের বোঝা ঘাড়ে করে সেই তো ধুঁকতে ধুঁকতে....

-কাঁদিস না মিতালী। হাতে আলগা চাপ দিয়ে বলল মৌ। তুই তো চাকরি করিস, রক্তিম দা কে ছেড়ে সৃজা কে নিয়ে দিব্যি আলাদা হতে পারিস।

-ভয়। বুঝলি.. একলা থাকার ভয়। আর এত কিছু র পরেও এখনো ভালোবাসি রক্তিম কে।
আমার মত অবস্থা যেন কোনোদিন তোর না হয় মৌ। তোর তো পলাশ আছে তাও। পলাশ তোকে ভালোবাসে।

-হম তা বাসে। তবে?
-কি?
-আজকাল জানিস সব ই কেমন প্রেমহীন মনে হয়। পলাশের ও তো বয়স বাড়ছে। বৌ আর মায়ের অশান্তি, অফিসের চাপ সবমিলিয়ে এক এক সময় ও ও ভীষণ দুর্ব্যবহার করে জানিস। আর তখন মনে হয়, কিসের জন্য কার জন্য পড়ে আছি।

-যাকগে,ছাড় ওসব। বাই দ্য ওয়ে, তোকে এই রেড স্লিভলেস ব্লাউজ আর ব্ল্যাক শাড়িতে আজ কিন্তু দারুণ লাগছে।

-বলছিস? কি বলবি বল তো, আমার শাশুড়ি র তো এতেও সমস্যা, মানে আমাকে সুন্দর লাগলেও সমস্যা।

মিতালী বাঁকা চোখে তাকিয়ে একটু হেসে ওঠে। বলে-যাহ, পরবি না কেন?এত সুন্দর ফিগার তোর, পরবি পরবি, তুই একটু এসব পরলে তো পলাশ দার ও মন ভালো থাকে। হা হা হা।

-দূর, কি যে বলিস মিতালী।
হাসিটা ছুঁয়ে যায় মৌবনি কেও।

মিতালী বলে-যাক এতক্ষণে তাও হাসলি।

ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বাজে। মিতালী আর মৌবনি উঠে এগিয়ে যায় স্কুল গেটের কাছে। মা, মা বলে ছুটে আসে দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে। বছর চারেকের তাতান আর সৃজা। মৌবনি আর মিতালী র ছেলে মেয়ে ওরা। বেস্ট ফ্রেন্ড। স্বাভাবিক ভাবে ওদের মায়েরাও বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্লাস নোট থেকে বই, রং পেন্সিল থেকে টিফিন সব শেয়ার করে ওরা। মিতালী পেশায় নার্স। ওর যেদিন নাইট ডিউটি থাকে, দিনের বেলা মেয়েকে স্কুলে দিতে এসে আড্ডা মারে মৌবনির সঙ্গে, সুখ দুঃখের গল্প চালাচালি হয়।

আজ যেতে যেতে মিতালী মৌবনি কে বলে-দ্যাখ জোকস অ্যাপার্ট। কিন্তু আমি আর পাঁচ জনের মত তোকে বলব না যে মানিয়ে নে। আমি বলব ভাব, সলিউশন বের কর। সেটা constructive হোক বা Destructive, কিন্তু তুই যাতে ভালো থাকবি, এরকম কিছু একটা কর, এটুকুই বলা।

মিতালী আর মৌবনি আলাদা হয়ে যায়, তাতান কে নিয়ে ঢুকে পড়ে পাড়ার গলিতে। বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে। দূরে একটা আইসক্রিম ওলা দাঁড়িয়ে। তাতান বলে -মা একটা আইসক্রিম কিনে দাও না।

মাঝে মাঝে মৌবনি যেন মেয়েবেলায় হারিয়ে যায়। মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ফিরত যখন, পাড়ার ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াত,আইসক্রিম কাকু দাঁড়িয়ে থাকত গলির মোড়ে। মৌবনি বায়না করত। মা কে কিশোরী বেলায় হারিয়েছে, নাহ,, মায়ের অভাব টা এজীবনে আর পূরণ হল না তার।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৌবনি। তাতানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এই গরমের দুপুরে আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে বাবা, তোমার জন্যে একটা ম্যাঙ্গো দই ফ্রিজে রাখা আছে, বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে উঠে খাবে হ্যাঁ সোনা।

-ঠিক আছে মা।

-লক্ষ্মী ছেলেটা আমার।

ওরা পা চালিয়ে বাড়ি পৌঁছয়। দরজা খুলে দেখেন চিত্রাদেবী মানে মৌবনির শাশুড়ি, তাতানের ঠাম্মি তখন টিভি খুলে সিরিয়াল দেখছেন। মৌবনি ঘেমে নেয়ে সোফায় এসে বসে পড়ে, বলে- মা একটু জল দেবেন? উফফ,বাইরে যা গরম।
চিত্রাদেবী একবার কটাক্ষ করে তাকান । পরনে হাল্কা ছাই রঙের শাড়ি । বলেন- ফ্রিজে জলনেই আর, জল শেষ হয়ে গেলে এবার থেকে আমায় ভরে রাখতে হবে?

মৌবনি উঠে গিয়ে বলে- না না ঠিক আছে মা। বলে সে জল ভরতে থাকে । তারপর স্নান করে তাতান কে ফ্রেস করিয়ে তাকে খাইয়ে দেয়। বাইরে গ্রীষ্মের দাবদাহ। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। তাও সারা গায়ে যেন জ্বালা করছে মৌবনির। জ্বালা কি শুধু শরীরের? নাকি মনের? নাকি বুকের?

তাতান খেয়ে উঠে বলে- জানো ঠাম্মি আজকে আমি ম্যাংগো দই খাব।
চিত্রা দেবী বলেন- ও বাবা তাই নাকি ?আমারো তো খুব পছন্দ । তুমি একা খাবে? আমারটা কই ??
মৌবনি ফ্রিজ থেকে দইটা বের করে বলে- ওমা আপনি খান আর তাতানকে একটু খাইয়ে দিন, ও তো খেতে পারবে না এতটা ।

চিত্রাদেবী খিঁচিয়ে ওঠেন- কেন বৌমা তুমি কি আমার জন্য এনেছো? তুমি আর তোমার ছেলে খাবে বলে এনেছ ,আমি খাব কেন??

-মা একি বলছেন? তাতান অতটা খেতে পারবে না আপনি খান না। তাতান এই নাও ঠাম্মিকে দাও আর নিজে খাও।
চিত্রা দেবী মুখ বেঁকিয়ে বললেন- না দরকার নেই তোমরা মা ছেলে খাও ।
বলে উঠে চলে গেলেন ঘরের দিকে।
তাতান বলল -মা ঠাম্মা খাবেনা?
মৌবনী বলল -জানিনা।

একেক সময় ভীষণ একা লাগে মৌবনির।বুকের মধ্যে ভীষণ জ্বালা হয়। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটা পুরোনো ছাতা পড়া অ্যালবাম ,মায়ের সাথে ওর ছেলেবেলার ছবি সেগুলোই খুলে খুলে উলটে পালটে বারবার দেখে, হাপিত্যেশ করে। বুকের মধ্যে অনেক অভিমানের পাথর জমে আছে। আজ যদি মা থাকতো একটু হালকা হতে পারতো কথা বলে । বুকটা অনেকদিন থেকেই ভারী হয়ে আছে আর ক্রমশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। খালি হবার সুযোগ নেই । এসিটা বাড়িয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে বালিশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মৌবনি। ছ বছর বিয়ে হয়েছে, এতদিন পরে কেন জানেনা ভীষণ প্রেমহীন অর্থহীন মনে হচ্ছে সবকিছু। শুধু তাতানটা সত্যি। আর বাকি সব কি মিথ্যে!??

হঠাৎ পিঠে আলতো ছোট্ট নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে ওঠে মৌবনি। তাতান।
- কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছো?
-না বাবা কাঁদিনি। এসো সোনা ঘুমু করবে। তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দি ।

-দাদুভাই, ও দাদুভাই।...
চিত্রা দেবীর গলা পাওয়া যায় ..
মৌবনি একটু জোরে বলে- এইতো তাতান এখানে আমার কাছে ।
চিত্রা দেবী হনহনিয়ে এসে বলেন- দাদুভাই আমার একা একা ঘুম আসছে না, চলো আমার সাথে ঘুমাবে চলো।

মৌবনি একটু কাতর গলায় অসহায়ের মত বলে- তাতানটা আজ আমার কাছে ঘুমাতে চাইছিল ।
চিত্রাদেবী বললেন- অ, তা ছেলেকে যখন শিখিয়ে রেখেছ বৌমা তখন আর...

মৌবনি আর কথা বাড়াল না তাতান কে বলল -যাও বাবা। ঠাম্মার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ো ।

সারাদুপুর ঘুম আসে না মৌবনির
বাইরে গ্রীষ্মের দাবদাহ। ভেতরেও । চোখেমুখে জল দিতে দিতে আয়নায় নিজেকে দেখে সে। চোখ দুটোয় দুশ্চিন্তার কালি পড়েছে তার। সেই হাসিখুশি উচ্ছল মৌবনী টাকে আর খুঁজে পায়না সে। বিকেলে টবের ফুল গাছ গুলো যত্ন করে জল দেয় সে। তাতানের মতো এগুলো কেও ভীষণ সত্যি লাগে তবে কি আর বাকি সব মিথ্যে?

এভাবেই চলছিল মৌবনির সংসার । সেদিন বিকেলে অন্যদিনের মতো আলুর পরোটা বানাচ্ছিল মৌবনি। পলাশ অফিস থেকে এসে খাবে । চিত্রাদেবী আর তাতান বেরিয়ে গেল । তাতান বললো- মাম্মাম টাটা.

-সাবধানে যাও দুজনে .।

বিকেল বেলার এই সময়টা মাঝে মাঝে চিত্রা দেবী পার্কে হাঁটতে যান ।তাতন ও সাথে যায়। বাচ্চাদের সঙ্গে পার্কে খেলাধুলো করে ।
কাজকর্ম সেরে একটু টিভি খুলে বসল মৌবনি।

হঠাৎ আধঘন্টা পর ...
ক্রিং ক্রিং...কে যেন সমানে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। মৌবনী বিরক্ত হয়। উফ চোদ্দোবার কে কলিং বেল বাজাচ্ছে ?
দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঢোকেন চিত্রা দেবী।

-বৌমা, বৌমা..তাতান কে পার্কে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা।
-খুঁজে পাচ্ছেন না মানে? -মানে,আমি হাঁটছিলাম ,তাতান বাচ্চাদের সাথে খেলছিল । হঠাৎ দেখি যেখানে তাতান খেলছিল সেখানেও ও নেই , পার্ক ময় খুঁজলাম, কিন্তু তাতেও কোথাও পেলাম না।

-কি বলছেন মা।
টেনশনে কেঁদে ফেলে মৌবনি তাতান চার বছরের ছরের বাচ্চা ছেলে মা।

কাঁদতে কাঁদতে বলে মৌবনি - পলাশ কে ফোন করতে হবে আর আমি পার্কে যাচ্ছি এক্ষুনি..

-পলাশ কে ফোন করো না বৌমা..দয়া করো, চলো খুঁজে দেখি আগে ।

-পলাশ আপনাকে বকবে সেই ভয়ে আপনি....আপনার নাতি হারিয়ে গেছে মা ,এতটা স্বার্থপর কেউ হয় কি করে?

-মুখ সামলে কথা বল। আমি স্বার্থপর ?

মৌবনি পলাশ কে ফোন করতে করতে বেরোতে যায়।

এমন সময় কলিংবেলটা বেজে ওঠে । দরজা খুলে মৌবনী দেখে তাতানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীচের ফ্ল্যাটের প্রতুল বাবু।
মৌবনি চমকে ওঠে, তাতান তুই এখানে?
প্রতুল বাবু বলেন -আমার মেয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে তাতান আমার বাড়ি চলে এসছিল । আমার হঠাৎ কি মনে হলো, মাসিমা তো ওকে নিয়ে পার্কে যান তাহলে এখন নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করছেন। পার্কে গেলাম। মাসিমাকে খুঁজে পেলাম না তাই আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চলে এলাম ।

-আপনাকে যে কি ভাবে ধন্যবাদ জানাব প্রতুলদা। -আরে মৌবনি ঠিক আছে।

চিত্রা দেবী ছুটে এলেন- কোথায় চলে গিয়েছিলি দাদুভাই ???
হবেনা?..সব মায়ের শিক্ষা।

-তুমি আর কোনদিন ঠাম্মার সঙ্গে পার্কে যাবে না।

- বৌমা...চেঁচিয়ে উঠলেন চিত্রাদেবী ।

-না যাবেনা ও । আপনি বুঝতে পারছেন না ও চার বছরের ছোট একটা বাচ্চা । আর আপনার বয়স হয়েছে মা, আজ যদি তাতানের কিছু একটা হয়ে যেত কি নিয়ে বাঁচতাম আমি?

-এমন করে বলছ বৌমা যেন তাতান খালি তোমারি ছেলে, আমাদের কেউ নয় ।
আমার ছেলেটার মাথা তো চিবিয়ে খেয়েছ, নাতিটাকে কেড়ে নিও না ....
অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি ।....

দুঃখগুলোর মাঝে মৌবনির জন্য এক একটা খুশির সন্ধেও আসে । সেদিন অফিস থেকে ফিরে যখন বউকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল পলাশ,
মৌবনি অবাক হয়ে খুশি হয়েছিল।
-কি ব্যাপার ,স্যার আজ এত রোমান্টিক মুডে যে ।
পলাশের সুদর্শন মুখে একগাল হাসি।
- ইনক্রিমেন্ট ম্যাডাম .. স্যালারি বাড়লো তাই।
-আরে দারুন ব্যাপার তো। তোমার জন্য দু দুটো গিফট আছে ।
-আরিব্বাস দু-দুটো..
-একটা ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি তখন কিছু দেওয়া হয়নি আরেকটা ইনক্রিমেন্ট ....পিছন ঘুরে দাঁড়াও তো ।

মৌবনির ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে একটা চুমু খেলো পলাশ। অনেকদিন পর মৌবনির শিহরণ লাগছে আগের মত । ওর গলায় একটা সোনার চেন পরিয়ে দিল পলাশ।

-আরিব্বাস কি সুন্দর লাগছে আমার বউকে।

- ব্যাগে একটা ম্যাক-এর লিপস্টিক আছে ,তোমার প্রিয় শেড ,সেদিন বলছিলে না । পড়ে আসুন তো দেখি ম্যাডাম ,অবশ্য শুধু দেখবো না ,ম্যাডাম চাইলে স্বাদ ও নিতে পারি। পলাশ জড়িয়ে ধরল মৌবনি কে। অনেকদিন পর এত সুন্দর করে হাসল মৌবনি।
লিপস্টিক টা পড়ে সত্যি ওকে ভারী সুন্দর লাগছিল।

কয়েকদিন পর মৌবনির সঙ্গে মিতালীর দেখা হলো মলে। মিতালী বলল -শোন তোদের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, এক বন্ধুর সাথে ও আমাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট আর একজন সাইকোলজিস্ট এর নাম্বার দিয়েছে ..মানে তুই কনসাল্ট করতে পারিস । আমি তোকে নাম্বার দুটো হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি।

মৌবনী বলল -থ্যাংক ইউ রে, তবে তোর কি মনে হয় এভাবে লাভ হবে? শেষকালে মাথার ডাক্তার দেখাতে হবে?

-না ব্যাপারটা ওইভাবে ভাবিস না । আজকাল বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই ডিপ্রেশনে ভুগছে। রক্তিম এর জন্য আমিই যেভাবে ডিপ্রেসড থাকতাম।

-হ্যাঁ সেই ...কদিন বাদে আমাকে ই না ডিপ্রেসড হয়ে পাগলের ডাক্তার দেখাতে হয়। যাইহোক থ্যাংক ইউ রে । যদি কাজে লাগে দেখবো।

সেদিন বাড়ি ফিরতেই দেখল তাতান সোফায় বসে ছবি আঁকছে। চিত্রাদেবী অর্থাৎ শাশুড়িকে দেখা যাচ্ছে না। এ সময় তো উনি ঘরে থাকেন না সোফায় টিভি দেখেন। যাই হোক নিজের ঘরে ঢুকলো মিতালি । হঠাৎ কি একটা যেন পায়ে ঠেকল।

-দেখেছ তাতান টাকি দুষ্টু..পলাশের দেওয়া দামি লিপস্টিক টা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে।
কিন্তু একি? লিপস্টিক টা ভেতরে ভাঙ্গা ?

মৌবনি অবাক হয়ে গেল। দেখল, তাতান ওই লাল লিপস্টিক টা নিয়ে রং পেন্সিল বানিয়ে খাতায় রং করছে।

-একি করেছিস ??সর্বনাশ।
সেদিন তাতান কে অনেক বকলো মারলো কিন্তু কোথাও গিয়ে একটা যেন খটকা লাগছিল তার ।
ক'দিন বাদে আর একটা জিনিস দেখে ভারী অদ্ভুত লাগলো তার। অবাক হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা ভয়ও পেল সে । তাতান কে স্কুলে দিতে যাওয়ার জন্য রেডি হতে গিয়ে দেখল তার লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ টা কে যেন কুটিকুটি করে কেটে রেখে দিয়েছে।

কোন সিনক্রিয়েট করল না মৌবনী ।
চুপি চুপি তাতান কে বলল-

- একটা সত্যি কথা বলবি তাতান??
-কী মা?
-সেদিন লিপস্টিক টা দিয়ে তোমাকে রং করতে কে বলেছিল ?ঠাম্মা?
তাতান চুপ করে রইল।

-বলো তাতান ,সোনাছেলে আমার ,তুমি সত্যিটা বলো। আমি বকবো না ।
মৌবনি মনেপ্রাণে চাইছিল উত্তরটা না হোক।

কিন্তু ছল ছল চোখে তাতান বলল-

-হ্যাঁ । আর ঠাম্মি বলেছিল, এটা কাউকে বললে ঠাম্মি মরে যাবে ,তুমি কাউকে বলবে না তো মা ???

সিৎজোফ্রেনিয়া।

পলাশকে ব্যাপারটা বলতেই হবে বিশদে। মিতালী ও আজ সৃজা কে ছাড়তে আসেনি দেখছি। চিত্রা দেবী ,ওর শাশুড়ি সিৎজোফ্রেনিয়ার শিকার হচ্ছেন দিন কে দিন।

লিপস্টিক ভেঙে দেওয়া,ব্লাউজ কেটে দেওয়া আর কি কি করবেন কে জানে। সাইক্রিয়াটিস্ট এর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে সত্ত্বর কিছু করা দরকার । কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে তাতান কি স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল মৌবনি।
চিত্রা দেবী তখন স্নান সেরে বেরোচ্ছেন।

মৌবনি দৃঢ় কন্ঠে বলল-
মা, কিছু জরুরী কথা ছিল আপনার সাথে।

চিত্রাদেবী খেঁকিয়ে উঠলেন- আমি পুজো করবো না ?এখন দাঁড়িয়ে তোমার ভাষণ শোনার সময় নেই।

-আমার কথাটা খুব জরুরী মা আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করেছি..আপনি আমার সঙ্গে যাবেন কাল।

-কি সাইক্রিয়াটিস্ট ?পাগলের ডাক্তার ?আমি পাগল? তোমার এত বড় স্পর্ধা কি করে হয় বৌমা ..ছি ছি..এত নিচ হতে পারে কেউ আমি স্বপ্নেও ভাবি নি।

-আপনি যথেষ্ট পাগলামি করেছেন কিছু বলিনি। আমাকে সহ্য করতে পারেন না কিছু বলিনি। কিন্তু আমার লিপস্টিক ভেঙে দেওয়া, ব্লাউজ কেটে কুটিকুটি করে দেওয়া এগুলো পাগলামি নয়? কোন দিন আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেবেন।

-কি তোমার খাবারে বিষ মেশাবো আমি ?এত বড় কথা। তোমার ব্লাউজ আর লিপস্টিক নিয়ে কিছুই জানিনা আমি । নিজে নিজে করে এখন নাটক করে দোষ চাপাতে এসেছ না ?সমস্ত কিছু তোমার প্ল্যান তাইনা ..সমস্ত কিছু..
প্রথমে পলাশ তারপর তার তাতানকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া ,এখন আমাকে পাগল বানিয়ে..সব বুঝি আমি..ছি ছি আর কত নিচে নামবে বৌমা ,আর কত নীচে?

-দেখুন মা আপনি রাজি না হলে আমি কিন্তু পলাশকে সব খুলে বলবো, ভালো হবে তো সেটা?

-কি বলবে? পলাশকে কি বলবে তুমি? বিষিয়ে দেবে না আমার বিরুদ্ধে ?দেখো তোমার মা এরকম, ওরকম নীচ মেয়ে ছেলে, বাড়ির শিক্ষা দীক্ষা নেই।

-মা আপনি কাল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছেন ব্যাস , নয়তো আমি পলাশকে বলব আপনি আমার লিপস্টিক আর ব্লাউজ নিয়ে কি কি করেছেন।

-তুমি যদি পলাশকে বলো বা আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও আমি বুড়ো বয়সে আত্মহত্যা করবো...আমি আমি..

পাগলের মত চিৎকার করে দরজা বন্ধ করে দিলেন চিত্রাদেবী । প্রমাদ গুনলো মৌবনী ।

-দরজা খুলুন মা, পায়ে পড়ছি, দরজাটা খুলুন না। কি করছেন দরজা বন্ধ করে? দোহাই আপনার,মাফ করুন মাফ করুন কাউকে কোথাও যেতে হবে না, আমি চলে যাব দরজা খুলুন মা প্লিজ প্লিজ। কান্নায় ভেঙে পড়ল মৌবনি। পায়ে পড়ছি, দরজাটা খুলুন।

একটু পরে দরজা খুলে বেরোলেন চিত্রাদেবী।
একটা ঝড়ের পর দুজনেই শান্ত, ক্লান্ত ।
মৌ কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমি আর পারছিনা, আমি হেরে গেছি। আপনার পলাশ, আপনার তাতান,আমি কেউ নই ।
আমি ই কাল চলে যাব । পলাশ কিংবা তাতান কে জানাবার কোন দরকার নেই। আপনিও বলবেন না আপনি জানতেন । আপনাদের সকলকে মুক্তি দিয়ে আমি চলে যাব । কাল । যেদিকে দুচোখ যায়।

আর পারছিনা এভাবে। একটু শান্তি চাই। শান্তি। ডুকরে কেঁদে ওঠে মৌবনি। জানলার ওপারের আকাশ টা অজান্তেই ঝাপসা হয়ে ওঠে।

পরদিন পলাশ অফিসে চলে গেলে - ব্যাগ গুছোতে থাকে মৌবনী। জানেনা, কোথায় যাবে কদিনের জন্য, কোনো বান্ধবীর ফ্ল্যাটে বা বাপের বাড়িতে, না পোষালে রেললাইনে মাথা দেবে।

তাতানকে স্কুলে দিয়ে এল সে। মিতালীকে বলল - আমার শরীরটা খারাপ, আজ কী তুই তাতানকে ফিরতি পথে একটু বাড়ি ড্রপ করে দিতে পারবি?
মিতালী বলল-শিয়োর।

বাড়িটা ভীষণ শান্ত আজ। ঠিক যেন ঝড়ের পরের কোন এক থমথমে আকাশ, এই বৃষ্টি হলো বলে।

মৌবনী বলল - মা, যাচ্ছি। আর ফিরবো না মা, ভালো থেকো। আর কোনো সমস্যা হবেনা তোমার।

হঠাৎ চিত্রাদেবী ডাকলেন - বৌমা,

....দাঁড়াও যেও না।

মৌবনী ঘুরে দেখে, চিত্রাদেবীর চোখে জল।

- এ কী মা? চোখে জল?
- তোমারও তো চোখে জল বৌমা।
- কিন্তু আমার মতো একটা খারাপ বৌমা বিদেয় হচ্ছে, আপনার তো খুশি হওয়া উচিত, তাই না?

- তোমার লিপস্টিক টা আমি সেদিন ইচ্ছে করে নষ্ট করিনি বৌমা। জানো ছোট থেকে সাজা-গোজার ভীষণ শখ। তোমার শ্বশুরমশাই আমাকে এতো অল্প বয়সে বিধবা করে চলে গেলেন। সেদিন তোমার ঐ লিপস্টিকটা দেখে ভারী লোভ হলো বৌমা। একটু ঠোঁটে লাগাতে গেছিলাম, বুড়ো বয়সে ভীমরতি। হটাৎ কাজের মেয়েটা ঘর ঝাঁট দিতে ঢুকতেই অপ্রস্তুত হয়ে আমার হাত থেকে ওটা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেল। কাজের মেয়েটা বুঝে যেত, ওটা তোমার লিপস্টিক। আমি তখন ভাঙ্গা টুকরোটা দিয়ে তাতানকে বললাম, 'তোর লাল রং পেনসিলটা হারিয়ে গেছে বাবু'? আমি কী করতাম বলো বৌমা?

-সেকি মা, আপনি আমায় আগে এসব বলেননি কেন? আগে জানলে আমি নিজেই আপনাকে লিপস্টিক কিনে দিতাম। আপনি কখনো আমার বন্ধু হতে চাননি মা।

- জানো তোমার মতো আমারও ঐ হাতকাটা জামা পরতে খুব ভাল লাগতো বৌমা। বিয়ের আগে মা আমার জন্যে এক নীল রঙের হাতকাটা জুলিহাতা জামা তৈরি করে দিয়েছিল। বিয়ের পরেও লুকিয়ে লুকিয়ে এক দুবার পরেছিলাম। তোমার শ্বশুরমশাই বলতো, ওটা পরলে আমাকে নাকি পরীর মত দেখায়। একদিন আমার চোখের সামনে শাশুড়িমা ওটা পুড়িয়ে দিলেন,বললেন- বৌ মানুষ ও কি ধিঙ্গিপনা?

খুব কেঁদেছিলাম জানো। খুব রাগ হয়েছিল, কিছু বলতে পারিনি সেদিন।

- আপনি আপনার মন খারাপের গল্পগুলো কোনোদিন আমায় বলেননি কেন মা? জানেন আমার মা আমায় ভীষণ ভালোবাসত। কিশোরী বয়সে মা কে হারিয়েছি। আমি তো আপনাকেই নিজের মায়ের মতো--

- কক্ষনো না। আমাকে নিজের মা ভাবলে আপনি - আপনি করতে না বৌমা।

- সে তো আপনিও নিজের মেয়ে ভাবেননা, উঠতে বসতে খুঁত ধরেন। সেদিন আমার পিরিয়ড নিয়ে রান্না করেছি, ঝোলটা একটু খারাপ হয়েছে বলে কী যাচ্ছেতাই না বললেন পলাশের সামনে। তার বেলা?

-জানো বৌমা, সেদিন ১০২ জ্বর, তাঁর সঙ্গে মাসিকের ব্যাথা। সারাদিন ধরে বাড়িতে পঞ্চাশটা লোকের রান্না করেছি রেহাই পায়নি। শাশুড়ি তাও অকথা কুকথা শুনিয়েছে। আসলে না পাওয়া গুলো পেতে পেতে হতাশা গুলো হজম করতে করতে আমার যত ভয়, যত দুঃখ, যত ক্ষোভ যত রাগ সব তোমার ওপর উগড়ে দিয়েছি বৌমা। ভেবেছিলাম, নিজের পছন্দ করা মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবো, মেয়ে হবে ঘরোয়া, সরল, সাধাসিধে, যাকে মেয়ে বলে ডাকতে আটকাবেনা। যখন শুনলাম পলাশ প্রেম করছে, বৌমা উচ্চশিক্ষিতা, আধুনিকা, MSc, PhD, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম বৌমা। ভয় তো আমরা কম বেশি সবাই পাই বলো! তোমাকে দেখলাম স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি, স্মার্ট, এতো শিক্ষিত, চাকুরীজীবী, এ মেয়ে কী আমায় মানবে? এ মেয়ে কী আমায় সম্মান করবে? মা বলে ডাকবে? আমার মতো সাধাসিধে স্বল্পশিক্ষিত নিতান্ত সাধারণ শাশুড়ির দিকে হয়ত ফিরেও দেখবে না। ভয় হত বৌমা, খুব ভয়।

-মা এসব কি বলছো।

-হ্যাঁ বৌমা, পলাশ আর তোমার প্রেমের বিয়ে। বুঝতে পারি ,পলাশ তোমায় খুব ভালোবাসে, সোহাগ করে। কিন্তু স্বামীসুখ কী জিনিস,আমি কোনো দিন তার স্বাদ ই পাইনি বৌমা,তোমার শশুর মশায়ের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার শ্বশুরকে দেখতুম, উনি অফিস কাছারি যেতেন, শাশুড়ি আমায় টেনে নিয়ে যেতেন হেঁসেলে। তারপর পলাশ যখন খুব ছোট, ওর বাবা চলে গেল, সেই থেকে পলাশকে একা আমি কষ্টে সৃষ্টে বড় করেছি...

আর বলতে পারলেননা চিত্রাদেবী। জল ঝরছে চোখ থেকে। চশমাটা খুলে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি।
মৌবনী কাছে সরে এলো, ওর চোখে ও জল। এই প্রথম সে চিত্রাদেবীর হাতটা ধরলো পরম ভালোবাসায়।
বলল - মা, কেঁদো না প্লিজ।

চিত্রাদেবী বললেন -
তুমি কেন যাবে বৌমা? সংসার তোমার, ভুল আমি করেছি, যত ঝামেলা আমায় নিয়ে, আমার চলে যাওয়া উচিত। পলাশ তোমায় ভালোবাসে, তাতান তোমায় ভালোবাসে।

মৌবনী থামিয়ে বলল - আর তুমি? তুমি আমায় ভালোবাসোনা মা?

চিত্রাদেবী জলভরা চোখে বললেন - বাসি। ভালোবাসি। এই কথাটা এতোদিন বলা হয়নি বলে এতো কিছু বিপত্তি। জানো আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বৌমা। পলাশ আসলে বলব - আমাকে যেনো কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে --

- ছিঃ মা! তোমার মেয়েটা কি এতোই খারাপ?
- আমি খারাপ ,বৌমা। ভুল আমার।

- না মা, তুমি কোনো ভুল করোনি। আসলে না পাওয়ার শূণ্যতা আর ফ্রাস্ট্রেশন থেকে, একলা হয়ে যাবার ভয় থেকে আমরা এরকম অনেক কিছু করে বসি। তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আমিও এরম করতাম।

- জীবনটা একটা কবিতার মতো, জানো বৌমা। পঙক্তিগুলো প্রেম ভালোবাসা, শব্দগুলো সম্পর্ক। কয়েকটা শব্দ এদিক ওদিক উল্টোপাল্টা হয় হোক, অন্ত্যমিল আর ছন্দটা ঠিক থাকলেই কবিতাটা ঠিক থেকে যায়।

- মা, দারুণ বললে তো। তুমি এতো সুন্দর কথা বলতে পারো, ভাবিনি কখনো।

- লেখাপড়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার, জানো বৌমা। শাশুড়িমাকে লুকিয়ে কতো কবিতা লিখেছি দুপুরবেলায়, পুরো কবিতার খাতা ভরতি করে। তোমার শ্বশুরমশায় কে দু-একটা শোনাতাম ও। ওনার ভালোও লাগতো, কিন্তু আলাদা করে উনি কোনোদিন গা করেননি।

- খাতাগুলো কোথায় এখন মা?
করুণ হাসি হাসলেন চিত্রাদেবী। বললেন - জীবনের কোনো ইচ্ছেপূরণ হয়নি ত, তাই তোমাদের ইচ্ছে পূরণ হলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়, পাগলামি করি। তাই তো বলছি, খোকাকে বলো কোনো বৃদ্ধাশ্রমে --

- ছি ছি ! কি বলছ মা!তুমি কোথাও যাবেনা। আমাদের সাথে থাকবে তুমি।

- আবার যদি পাগলামি করি? তবে কোন এক সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিলে না বৌমা, নিয়ে যাবে কাল?

- আচ্ছা তোমাকে নিয়ে যাবো কাল।

- কোথায় বৌমা? ওই পাগলের ডাক্তারের কাছে?

-উহুঁ বইপাড়ায়, কলেজস্ট্রীটে।
অনেকদিন ওদিকটা যাওয়া হয়না মা, ভাবছি কাল ঘুরে আসবো। তোমায় পছন্দ করে কিছু কবিতার বই, আর কবিতা লেখার খাতা কিনে দেবো। তুমি কবিতা লিখবে, মা মেয়ে তে বসে দুপুর বলায় পড়বো। আর সবচাইতে ভালো কবিতাগুলো আমি ছাপানোর ব্যবস্থা করবো। প্ল্যানটা কি ভালো না বলো মা?

-সত্যি বলছো বৌমা? চিত্রাদেবী র চোখে খুশির কান্না।
চোখ টোক মুছে চিত্রাদেবী বাচ্চা হয়ে গেছেন।

বললেন-
- কাল ফেরার পথে ঝালমুড়ি খাবে বৌমা?অনেকদিন খাইনি।

- একদম। আর ঝালমুড়ি খেয়ে যখন ঝাল লাগবে ,তারপর আমরা কুলপি- মালাই কিনে খাবো হ্যাঁ মা?
রচনাকাল : ১৬/৪/২০২০
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 1  Canada : 20  China : 23  France : 2  Germany : 6  Hungary : 2  India : 374  Ireland : 72  Japan : 1  
Nepal : 1  Romania : 2  Russian Federat : 12  Saudi Arabia : 5  Sweden : 10  Ukraine : 13  United States : 764  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 1  Canada : 20  China : 23  
France : 2  Germany : 6  Hungary : 2  India : 374  
Ireland : 72  Japan : 1  Nepal : 1  Romania : 2  
Russian Federat : 12  Saudi Arabia : 5  Sweden : 10  Ukraine : 13  
United States : 764  
লেখিকা পরিচিতি -
                          স্বাগতা সরকার ২রা মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪-পরগণা জেলাস্থিত বিখ্যাত জয়নগর শহরের মাজিলপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।

বর্তমানে তিনি প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে পাঠরতা। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আবৃত্তিতে, শ্রুতিনাটকে, সঙ্গীতে, চিত্রাঙ্কনে তিনি সমানভাবে পারদর্শীনী। তার লেখা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে যেমন কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, শ্রুতিনাটক ইত্যাদিতে এনার লেখনীর পারদর্শীতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিভিন্ন অনলাইন পত্র-পত্রিকাতেও লেখালেখি করেন। 
                          
  • ৯ম বর্ষ ১১তম সংখ্যা (১০৭)

    ২০২০ , এপ্রিল


© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অ ন্ত্য মি ল by Swagata Sarkar is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০০৬৪
fingerprintLogin account_circleSignup