'বিদ্যুত্ বিহীন রেফ্রিজারেটর তাও কি হয়! এ যেন সোনার পাথর বাটি। '- বলে উঠল রাজু।
সুভাষ মাঠে গোল হয়ে বসে গল্প করছে একদল ছেলে। ওরা হল রাজু, পটলা, ভোম্বল, গুগুল, হোদল, টিটু। সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে উঠেছে ওরা। এখন কিছুদিন অখণ্ড বিশ্রাম। বিকেল বেলায় টিউশন-এ যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে কিছু দিনের মুক্তি। বিকেল ৩-টে বাজতে না বাজতেই ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পরে ওরা। ৩ ঘন্টা ধরে চলে অবিরাম বল পিটানো। তারপর যখন অন্ধকার হয়ে আসে তখন গোল হয়ে বসে এই আড্ডাটা না দিলে ওদের চলে না।
আজ কথাটা শুরু হয়েছিল ঠান্ডা জল খাওয়া নিয়ে। গত কয়েক দিন ধরে ওদের এলাকায় এই সময়টায় নিয়ম করে লোডশেডিং হচ্ছে। গরম কালে প্রায় ২-৩ ঘন্টা ধরে চলে এই লোডশেডিং। খেলা শেষে মাঠে বসে-ই রাজু বলে উঠল, 'দূর-দূর'।
পটলা বললো, 'তোর আবার কি হল? বেশ তো ভালই ছিলি।'
'আরে খুব জল তেষ্টা পেয়েছে, ঘরে গিয়ে যে একটু ফ্রিজের ঠান্ডা জল খাব, তার জো নেই। কারেন্ট নেই।' রাজু বলল।
'এ আর নতুন কি! এই হোদল, তোর কোল-ড্রিঙ্কস খাওনোর কথা ছিল না। আজ খাওয়াবি', পটলা বললো।
'কেন বাবা, আমাকে ধরে আবার টানাটানি কেন?',হোদল আতকে উঠল, 'তাছাড়া দোকনের ফ্রিজ তো আর জেনারেটার-এ চলে না, সেখানেও তো সব কোল-ড্রিঙ্কস হট-ড্রিঙ্কস হয়ে গেছে।'
পটলা মুষড়ে পড়ে বলল, 'তা ঠিক।'
'এই দেশের কিছু হবে না। দিন দিন এই দেশ-টা উচ্ছনে যাচ্ছে। কারেন্টের মত মৌলিক চাহিদাই মেটে না এখানে!', বিজ্ঞের মত বলে উঠল টিটু।
'কারেন্ট সব জায়গায় যায়। মনে নেই আমেরিকায় ২০০৩-এ কি অবস্থা হয়েছিল! কয়েক দিন ধরে কারেন্ট ছিল না।', বলে চললো পটলা, 'ওদের দেশে তো রান্না-ও হয় কারেন্ট-এ। ভেবে দেখ, ২০-৩০ তলা বাড়ি , কারেন্ট নেই, খাবার নেই, লিফট নেই।'
'তা ঠিক, আসল কথা হলো কারেন্ট-র উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা', হোদল বলল।
রাজু হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো, 'আগেকার দিন হলে তাও ঘরে একটা কুজো থাকত, ঠান্ডা জল পাওয়া যেত।'
'আচ্ছা, বিদ্যুত বিহীন রেফ্রিজারেটর বলে কিছু হয় না?',বলল ভোম্বল। সবাই এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল। ভোম্বল, গোল-গাল বল-র মত দেখতে একটা ছেলে। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলা ওর পুরানো স্বভাব।
'এ যেন সোনার পাথর বাটি!', বলল রাজু ।
পটলা বলল, 'বাপের জন্মে এমন কিছু শুনিনি। বিদ্যুত বিহীন রেফ্রিজারেটর তাও কি হয়!'
টিটু বলল, 'তুই কি এইরকম কিছু শুনেচিস না আন্দাজে ঢিল মারছিস?'
ভোম্বল বলল, 'না শুনিনি, কিন্তু এমন-তো হতেও পারে।'
'জানিস তো, এরকম কিছু একটা গুগুল নিউজ -এ একবার দেখেছি মনে হচ্ছে', গুগুল বলল। গুগুল নামটা ওর বন্ধুদের দেওয়া ওর google -র প্রতি অন্ধ-বিশ্বাসের জন্য। ও বলে, 'গোগোল-র দিন gone, এখন google-র যুগ।' কথাটা অবশ্য ও ভুল বলে না। গুগুল সারাক্ষণ মোবাইলে ইন্টারনেটে কিছু একটা করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সময় না কাটলে নিজের নাম-টাই google-এ সার্চ করে ও।
রাজু বলল, 'দেখতো, তোর google -এ, এরম কিছু খুজে পাস কিনা? থাকলে আমাকে একটা গিফ্ট করিস তোরা।'
একটু পরে, গোল গোল চোখে গুগুল বলে উঠল, 'ভোম্বল-টা ঠিক-ই বলেছে-রে।'
'যা দেখছিস চটপট বলে ফেল', রাজু বলল।
গুগুল বলল, 'মনসুখভাই প্রজাপতি নাম-র গুজরাট-র একজন কুমোর এরকম একটা রেফ্রিজারেটর বানিয়েছেন মাটি দিয়ে, যা চালাতে কারেন্ট লাগে না। ওনাদের http://www.mitticool.in/ বলে একটা ওয়েবসাইট-এ এর কথা বলা আছে। উনি এই আবিষ্কার-র জন্য অনেক পুরস্কার-ও পেয়েছেন। ETH Zurich university-তে এর উপর একটা প্রেসেনটেসান-ও দেওয়া হয়েছে। এই দেখ, এখানে ওই বিদ্যুত্ বিহীন রেফ্রিজারেটরের একটা ছবি-ও আছে।'
'কই, দেখি দেখি', সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল গুগুল-র মোবাইলের উপর।
'মাগো!', বলে চেচিয়ে উঠলো রাজু, 'এই শালা হোদল , তোর হাটু দিয়ে আমার হাত-র উপর ভর করে আছিস, বুঝতে পারছিস না!'
'sorry ভাই', বলল হোদল, তারপর কথা ঘোরানোর জন্য বলল, 'এটা দেখতে কিন্তু অনেকটা দোকান-এ রাখা ছোটো কোল-ড্রিঙ্কসের ফ্রিজের মত।' সবাই আবার ছবিটার দিকে নজর দিল।
'এতে সব কিছু রাখা যায়?', প্রশ্ন করল রাজু।
গুগুল বলল,'এনারা দাবি করছেন যে এই ফ্রিজে ২০ লিটার পানীয় জল, ৫ কেজি ফল, শাক-সব্জি এবং ৫ লিটার দুধ রাখা যাবে ২-৩ দিন অবধি।'
'কাজ চালনোর মত যথেষ্ট', বলল রাজু, 'দেখত, এতে বরফ হয় কিনা? আর এর অপারেটিং প্রিন্সিপল-টাই বা কি?'
'দেখছি', বলল গুগুল।
'এটা বাষ্পায়ন বা evaporation প্রিন্সিপলের উপর দাড়িয়ে। এর উপরের অংশে একটা জল-র ট্যান্ক আছে যার থেকে জল চুইয়ে চুইয়ে দেওয়াল বেয়ে পড়ে আর পড়ার সময় বাষ্প হয়ে যায়। বাষ্প হওয়ার সময় জল ফ্রিজের ভেতর থেকে উত্তাপ শুষে নেয়, ফলে ভেতরের উত্তাপ কমে যায়। তবে এতে বরফ হয় না।', বলল গুগুল।
'অপারেটিং প্রিন্সিপল-টা নতুন কিছু নয়, কুজো-তেও একই প্রিন্সিপাল-এ জল ঠান্ডা হয়। আমরা বই-তে এই প্রিন্সিপল-টা পড়েছি তো', টিটু বলল।
'অপারেটিং প্রিন্সিপল-টা এক হলেও এই ফ্রিজের বিশেষত্ব হলো এর আকৃতি, মাটি এবং এর তাপ-সঞ্চালন ব্যবস্থা (thermodynamics) যেটা মনসুখভাই-র আবিষ্কার', বলে চলল গুগুল, 'এই ফ্রিজ কতটা ঠান্ডা করবে তা নির্ভর করে পরিবেশের উপর। গরমের জায়গায় এই ফ্রিজের কার্যকরিতা (কুলিং ইফেক্ট) বেশি।'
'সেটা অবশ্য কোনো সমস্যা নয়, কারণ গরমে ফ্রিজের দরকার হয় বেশি', বলল পটলা, 'রাজস্থান, গুজরাট-র মত জায়গায় এটা খুব ভালো কাজ করবে। এতে পরিবেশ দুষণ নেই, রক্ষনাবেক্ষণ করার-ও দরকার নেই আর সস্তাও নিশ্চই।'
'এর দাম কত?', জানতে চাইল রাজু।
'৩১০০ টাকায় এটা ঘরে পৌছে যাবে', বলল গুগুল।
'তালে তো কোনো চিন্তাই নেই, আসছে জন্মদিন-এ এটা তোরা আমায় গিফ্ট করছিস', বলল রাজু।
'নিজের শ্বশুর-কে বলিস তোকে বিয়েতে দিতে, আবদার দেখো লোক-জনের। অবশ্য তোর শ্বশুর তোর জন্য এত্তো টাকা খরচ করবে বলে মনে হয় না', বলল পটলা।
'আচ্ছা আগে মানুষ ফ্রিজের বদল-এ কি ব্যবহার করত? বিশেষ করে গরমের জায়গায়? কিছু একটা থাকবে, দেখত', হঠাত্ করে বলে উঠল ভোম্বল।
সাথে সাথে টিটু বলল, 'ঠিক বলেছিস, দেখত, আগে কি ব্যবস্থা ছিল?'
'ok, দেখা যাক', বলল গুগুল।
'কুজো বা ওই জাতীয় পাত্রর ব্যবহার অনেক দিন আগে থেকেই রয়েছে, সেই হরপ্পা, মহেঞ্জদড়-র সময় থেকে। এছাড়া, আর এক রকমের পাত্র আছে যাতে একটা মাটির পাত্রের মধ্যে আরেকটা মাটির পাত্র ঢোকানো থাকে, আর দুই পাত্রের মধ্যে ভেজা বালি রাখা থাকে। সুদানে একে জির-পাত্র বলে। ভারতেও অবশ্য এরকম পাত্রের ব্যবহার আছে। তবে এগুলোকে ঠিক ফ্রিজ বলা যায় না আর এদের ঠান্ডা করার ক্ষমতাও সীমিত।' বলল গুগুল।
'আসলে বিদ্যুত্ আবিষ্কারের সাথে সাথে এই সব পুরোনো পদ্ধতিগুলো মানুষের জীবন থেকে প্রায় হারিয়ে গেছিল। আজ, গ্লোবাল ওয়ারমিং-র যুগে এই পুরানো পদ্ধতিগুলো আবার প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছে। তাছাড়া এগুলো সস্তা এবং গরিব মানুষের নাগালের মধ্যে। মনসুখভাই-র আবিষ্কার হল সেই পুরানো পদ্ধতির আধুনিক এবং আরো উন্নত রূপ', গম্ভীর গলায় বলে উঠল ভোম্বল।
'এই রে অনেক দেরী হয়ে গেল', বলে উঠে পড়ল পটলা। এই সময় রোজ ও কোথায় যেন যায়। ও যে বাড়ি যায় না, এটা সবাই জানে। অন্ধকার-ও হয়ে এসেছে। যাই হোক , আজকের মত আড্ডা শেষ করে সবাই যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
রচনাকাল : ১/৭/২০১৩
© কিশলয় এবং সরসিজ দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।