(এই কবিতাটা যখন লিখি..
তখন আমার বয়স বিশ-পঁচিশ বছর ছিল..!
=>এই কবিতাটায় বাংলাদেশের প্রকৃতি-ঋতু, জাতি-ধর্ম, উৎসব-আনন্দ,
খাবার, মিষ্টি-পিঠা, শাক-সব্জি, ফল-ফুল, ফসল-শস্য, মসল্লা,
ইতিহাস-ঐতিহ্য, সঙ্গীত, খেলা-ধুলা, পোষাক-পরিচ্ছদ, পেশা,
নদী-বন, বৃক্ষ, পশু-পাখি, মাছ, কীট-পতঙ্গ, রং, ভূ-প্রকৃতি, স্থান,
ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম..)
সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে আছো- তুমি আমার বাংলাদেশ!
কোটি বাঙালীর কোটি হৃদয়ে, তোমার মাতৃ-আবেস।
শান-সৌকর্যে, সংগ্রাম-ধৈর্যে, তুমি অম্লান,
লক্ষ বাঙালী তোমার তরে, করেছে আত্মদান!
শত স্বপ্নের, শত বাসনার, তুমি মোর মাতৃভূমি;
নানা রূপ-রং-গন্ধে ছেয়ে, তোমার ছয়টি মৌসুমী।।
গ্রীষ্মের রোদে ডুবাই মাথা, খেলে দুপুরে তাতা;
বর্ষার বষর্ণে নেয়ে উঠি, পঙ্কে জড়াই পায়ের পাতা।
শরতে ভাসে- হাসি-হাসি বাতাসে- শুভ্র মেঘমুখ;
হেমন্তের দোল খাওয়া ধান্যে, সবুজ-সোনালী সারা বুক।
শীতের কাঁপনে, সন্তর্পণে, কুয়াশার গায়ে লাগে আঁচ;
বসন্তে বায়ুতে ঘ্রাণ; ফুলে-পাতায় ভরে ওঠে গাছ।
তোমার গাঁয়ের রাখালীয়ার মধুর বাঁশির টানে,
মনে চায় ছুটে যাই সেথা, থাকিবা যেইখানে।
বটের তলায়, বৈশাখী মেলায়, চড়কিতে উঠে বসি,
হঠাৎ করে কালবৈশাখী ঝড়ে, মেঘ মাঁখে কালো মসি।
জ্যৈষ্ঠে জঠরে, ধরে রাখ কত পাকা পাকা কাঁঠাল-আম,
ফলের গন্ধে, ভুলে যাই ছন্দে- গরমে গায়ে ঝরা ঘাম।
আষাঢ়ে চাষারে হাসির বার্তা দিয়ে- নামে নির্মল বৃষ্টি,
সুদূরে নদীপার, উতলায় দুইধার, বাড়ি-বন ঝাপসা দৃষ্টি।
শ্রাবণে প্লাবণে পলী পড়ে-পড়ে শস্য চুমিয়া রয়।
কদম্ব, কেয়া, কামিনী ঘ্রানে, জেগে ওঠে কিশোলয়।
ভাদরে সাদরে, পূণর্চাদেরে, ডাকি কৌমুদী দিতে কাছে;
পাকা-পাকা তালে, ধরে থাকে ঠালে, রোদ আর কাশ নাচে।
আশ্বিনের আলোকে, পলকে পলকে ঝলমলায়ে রয় দিন,
রাতে ঝরে শীউলী’ সুবাসা, দোলে বাবুইয়ের বাসা, পাতায় বাঁজে বীণ।
কার্তিকে কাতির্কীচাঁদ, ফসলেতে ভরে মাঠ, ধানের গন্ধ ছোটে;
মনে চায় হাড়াতে সেথা, বধুসনে কহি কথা, হাসি দেখি কৃষানের ঠোঁটে।
অগ্রহায়ণে, দাড়াই বাতায়নে, ধেয়ে আসে হিম-হিম শ্বাস,
ফসল তোলার ধুম, চোখেতে আসে না ঘুম, শিশিরে ভিজে ঘাস।
পৌষে পৌষালী মেলায়, ঘুরিয়া বিকেল বেলায়, সূ্র্য গেলে পাটে-
শীতল হাওয়ার পরশে, অঙ্গের হরষে, হেঁটে চলি গেঁওবাটে।
মাঘের প্রভাতে, রোদ-কুয়াশার সাথে, আমিও রাখি হাত- হাতে,
লুফিয়া শীতের আদর, গাঁয়ে জড়ায়ে চাদর, পিঠা খাই খেঁজুর-রসের- প্রাতে।
ফাল্গুনে খুব শুনি, ভ্রমরের গুনগুনি, আর কোকীলের ডাক,
ফুলের সুবাসে, উৎসবে চারিপাশে, রাঙায় প্রজাপতির ঝাঁক।
তুমি জগতের রূপবতী, তিলত্তমা-মায়াবতী বেস
কোটি কন্ঠের কোলাহলে কল্লোলিত- তুমি আমাদের বাংলাদেশ!
ভাটীর দেশে ভাটীয়ালী সুর, ভাওয়ালে ভাওয়াইয়া,
পাহাড়ে পাহাড়ীগান, উজানে উজানী গায় নাইয়া।
কুমারে কুম্ভ গড়ে, কামারে লৌহ করে দহ,
জেলেতে জাঁল ফেলে, মৌয়াল মধু করে সংগ্রহ।
দিঘিতে পদ্ম ফোটে, বিলে-ঝিলে শাপলা মেলে পাঁপড়ি,
মাটিতে মনোহরা, কোথাও ছনে গড়া, কোথাও তালপাতার বাড়ি।
মেঠ-মেঠ গাঁয়ের পথ, একধারে ধানখেত, একধারে ঘাসফুল বোনা,
ছায়া ঘেরা বাড়ী, কলাগাছ সারি, ডাহুক ডাকে, বাঁশঝার এককোণা!
দোঁয়েলের শিস্ শুনি, নীড় করে বোনা-বুনি, কাঠঠোকরা ঠুকে কাঠে;
প্রশান্ত দুপুর বেলা, মাছরাঙা করে খেলা, দেখিতে বসে থাকি ঘাটে।
কাতলায় খাবি খায়, মৃগেল-রুই নেচে বেড়ায়, শিং-কৈ দেয় ঘাঁই,
ইলিশে ডিম পাড়ে, ব্যঙ ডাকে সারে সারে, দুয়ারে বিড়াল তোলে হাই;
মাঠে নাচে ছাগছানা, বলদ-বাছুরের শুনি হাম্বারব,
পেয়ারাপাতায় পিঁপড়া চপল চলে, নদী করে কলকলে কলোরব।
ফড়িং ফুলে ফুলে, মৌপোকা মধু তোলে, পাতায় পাতায় বিটল,
ছোট শিশু ধুলি মাঁখে, বধু চলে কলস কাঁখে, বালিকার গালে পড়ে টোল।
চারিদিকে সবুজবন, করে মনোরঞ্জন, ফিরানো যায় না চোখ,
(চারিপাশে শস্য-দানা, সব্জি-শাক, ঔষোধি, ফল-মণীবক।)
হুংকারে ডোরাকাটা বাঘ, পদার্পণে লাল কাঁকড়া, হর্ষে হরিণ-হাতি,
বরষায় কাঁদাপথ, ছুটে তবু পদোরথ, মাথার উপর বষার্তী।
বুনো ডোবায় কুমির চুবায়, গর্তে ইদুর-শাপ;
সাজানো শনবনে, কলাইয়ে আনমনে- ঘাসফড়িং দেয় লাফ।
ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক ওড়ে, হুতুমপ্যাঁচা গাছে গাছে,
বাদুড়-বানর ঝোলে, শিয়াল শোরে, কাঠবিড়ালির দল নাচে।
পুকুরে কলমীলতা, কচুরি পানার ভেলা. ওর্ষায় পুঁইয়ের মাচা,
শিমফুল ফুটে গাঢ়নীল, হলুদ ফুলে কুমড় ধরে কচি কাঁচা।
সফেদ লাউফুল, বেগুন তুলতুল, টমেটো টকটকে লাল,
মাটি তলে হলুদ বলে, মরিচ-ঢেঁড়সে নোয় ডাল।
এমনই কত কি, বাংলাদেশে দেখি; দু’চোখ ভরিয়া মোরা।
কোথাও কালো কাদা, পলি-বালি সাদা, কোথাও মাটি তার গোরা।
বর্ষায় কাদা হাসে, দেহ জড়ায়ে দোঁ-আশে, সবুজেরে আঁকড়ে অনুরাগে,
না বলিয়া কোন কথা, নিজেকে হাড়ায়ে সেথা, কত যে ভাললাগে।
রং ছড়ায় শিমুল গাছ, মেহগনী-শিশু, তুলসী-বাসক;
ডালপালার ছায়াতলে, বেড়ে ওঠে মরিচ-লেবু-তমালক।
আতা-কামরাঙ্গা, সফেদা-বেদানা, বকুল আর বকুল ফুল..
স্বাদে আর গন্ধে, রঙ্গনের রঙিন আনন্দে, মন করে ব্যকুল।
নারিকেল, কুচফল, ডালিমের রসে রসাল দিকদশ,
জলপাই-বরই, তেতুল-জাম, ঘরের পাশে ধরে বেতস।
মন মাতানো, মন রাঙানো, নাই গরবের শেষ
এইতো আমার সুন্দরে গড়া, এক টুকরো বাংলাদেশ।।
প্রভাত/২/১১/২০০৭ইং
কেঁচ কর্ষ করে মাকড়ে জাঁল ছড়ে, জোনাক আনে জোনাকী
খেতে খেতে কলাই ধরে, কৃষাণীর খুশি ঝরে, ঝিঁঝিঁর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা-ডাকি।
মাগুর-বোয়াল-টাকী, ঢেউয়ে ঢেউয়ে মাঁখা-মাঁখি, ছোটে মলা-ঢেলা,
রূপচাঁদা-নাইলটিকা সাগরে পুকুরে ভাসে, পানকৌড়ী-হাঁস করে খেলা।
নীল আকাশ লাগে ভালো, মেঘরাজি সাদাকালো, সোনা রঙে রাঙে ধান,
হলুদ বরণ কণ্যা, রূপে সে অনন্যা- বর থেকে তুলে আনে পান।
বৈশাখে নববর্ষ, মনে মন আকর্ষ, কত জন খোলে হালখাতা,
ভাদ্রে তালের পিঠা, তালরসে তৈরি মিঠা, আশ্বিণে নবান্নের বার্তা।
মুসলিম-হিন্দু, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ- এদেশে মোরা ভাই ভাই;
মগ-চাকমা, বেদে-বিহারী, খাসিয়া-গারো- সবে বাংলাদেশী তাই!
ঈদ-পূজা-বড়দিন-পূর্ণিমা- সব উৎসবে মাতি মিলে মিশে;
হইবা কালো-ধলো, পীত-গোলাপী বলো- লাল রক্তে ভেদাভেদ কিসে?
আমাদের দেশে আছে স্বাধীনতা-শহীদ দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারী,
মাতৃভাষা-স্বাধীনতার অধিকার- দাবাতে পারে নাই- শয়তানের তরবারী!
আছে বিজয়দিবস- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৪ই ডিসেম্বর, ২৫শে মার্চ রাত!
আছে লাল-সবুজের পতাকা-নিষাণ; সোনালী-বিপ্লবী প্রভাত!
আছে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, বায়ান্ন-একাত্তুর;
আছে নীলবিদ্রোহ- ভাসানী-তিতুমীর, গণ-উদ্ভুত্থানের উনোসত্তুর।
আমাদেরই এই স্বপ্ন ছড়ানো সোনালী-হীরক বাংলাদেশ,
যার মাঝে মায়া-মমতা, মানুষে মানুষে সমতা- ঐক্যের আবেস।
এদেশে আছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, সুরমা, কর্ণফুলি,
ব্রাক্ষপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, কালিজিরা, গড়াই, কপোতাক্ষ রাখে অমলী।
গেওয়া, গরান, ঝাউ, সুন্দরী- বনে, আনমনে ডাকে বুনোমোরগ;
(হাতি-ঘোড়া,) শেঁয়াল, কুকুর, নেকড়ে, বানর করে তা উপভোগ।
পাটে পাটে ভরে মাঠ, আখ-আখড়টে ধরে গাঁট; গম-ভুট্টা দোলে;
জিরা-ধুনিয়া, দুন্দুল-হিঙেগ, মটরশুঁটি নিরিবিলি বিকেলে ঢোলে।
চা বাগানে চায়ের কুঁড়ি, আলো-ছায়ে লুকোচুরি, কত খুশি খুশি,
কুয়াশা জড়ান রাত, নিস্তব্ধ মাঠ-বাট, পুঁথিপাঠ শুনি বসি বসি।
তাঁতিরা বোনে তাঁত, নকঁশি কাঁথায় কোমল হাত- সূঁইয়ে দেয় ফোঁড়
নতুন বাসর ঘরে, বালা-ব্যাটার কথার স্বরে- নামিয়া আসে ভোর।
শ্লোক-ধাঁধাঁর সাথে, বিয়েবাড়ি উৎসবরাতে, বসে বয়াতী-আসর।
বায়স্কোপ-পুতুলনাচ, কেউ দেখে যাত্রাপালা, কেউ শোনে জারি-সারি-কোর।
খাই মোরা ভাত-মাছ, শাক-সব্জি, ডাল, আম-দুধ, নানা ভর্তা,
সরষে-ইলিশ সাথে- পোড়া মরিচ গরম ভাতে, কখনো চাটনী-আমসত্ত্বা।
রমনী পরে ব্লাউজ-শাড়ী, কাঁজল-টিপে বঙ্গনারী- রজনীগন্ধা জড়ানো কেশ,
পুরুষে পরে লুঙ্গি-জামা, কোমরে বাঁধে গামছা, সাজ-সজ্জায় লাগে বেস।
দাড়িচা-হাডুডু, কুতকুত-দড়িলাফ, কোথায় এমন খেলা পাবে আর?
নৌকাবাইচ-বালিশপেটা, ইচিংবিচিং-ফুলটোক্কা, জুড়ি মিলবে না কোনটার।
মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু কতজন, মামা-খালা সবাই আপন,
দাদা-দাদী, নানা-নানী, স্ত্রী-সন্তান সবারে লয়ে মোরা, গড়ি যে স্বপন।
কুয়াকাটা-সুন্দরবন, কক্সবাজার-রাঙামাটি, সাগরের জো্য়ার-ভাটি,
পাহার-বন, সমতল-জল, সব’ই মিলে এ মাটি হয়েছে খাঁটি।
শীত-শীত সকালবেলা, ভাপাপিঠা-পাটিসাপ্টা, চিড়ে-নারকোলি মোয়া-নারু খাই;
ফির্নি-পায়েস, মোরব্বা-জর্দা, নঁকশী পিঠার তো কোন জুড়ি নাই।
কত কি-তে ভরপুর, মধু আর মধুর সুর, সকলই আছে এই দেশে,
তাইতো আমি ভাই, যেখানে যখনই যাই, মরিতে চাই এথা এসে!
যতই বলি তবু, আমার দেশের কথা, বলা হবে না শেষ;
দেখাতে বিস্ময়চোখে, মেলিলাম বিশ্বের বুকে- এক টুকরো বাংলাদেশ!!
প্রভাত/৩/১১/২০০৭ইং
রচনাকাল : ১১/১২/২০১২
© কিশলয় এবং বিরহের কবি আমি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।