“পথ ভুলে এক রাত”
আনুমানিক পঠন সময় : ৮ মিনিট

লেখক : টিংকর পাল
দেশ : India , শহর : Calcutta

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৪ , জুলাই
প্রকাশিত ৪৩ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ২১৪৬৫ জন পড়েছেন।
পৌষ মাস ঠাণ্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে এবছর। কাজের মাঝে কখন যে দেরি হয়ে গেছে লক্ষ্যই পড়েনি সুধীর বাবুর। 
আজ তো তার পিসি বাড়ি যাবার কথা, ছোটবেলায় তিনি এই দুর সম্পর্কের  পিসির কাছেই মানুষ হয়েছেন, কখন যে 
৬ টা বেজেছে টেরই পাননি অথচ আজ পিসি বাড়ি যেতেই হবে। সেই কবে ৭-৮ বছর আগে গিয়েছিল। হটাত পিসির 
শরীর খারাপ শুনে দেখতে যাওয়া। ক্ষিদিরপুরে এক বেসরকারি কোম্পানিতে হিসাবনিকাশের কাজ করেন তিনি। অফিস 
বন্ধুদের বলে গেল “এই তোরা আজ একটু সামলে নিস রে আমার একটু কাজ থাকায় আমি চললাম। তাড়াতাড়ি 
ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সুধীর বাবু। সবে তো ৬ টা বাজে কিন্তু বাইরে এতো অন্ধকার দেখলে মনে হয় যেন 
কাল রাজত্ব নেমে এসেছে। সামনের বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সিগারেটে দুই টান দিতেই বাস এসে গেলো। একটু যেতেই রাস্তায় 
মস্ত এক জ্যামে আটকে পড়লো বাসটা। কিছু লোক বলাবলি করতে লাগলো অনেক আগে থেকেই নাকি জ্যাম। ধুর বাবা 
বড্ড দেরি হয়ে যাবে পৌঁছাতে। আজ আবার পিসিমার বাড়ি না গেলেও নয়। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই আটটা 
বাজলো। হটাত বাস টা চলতে শুরু করলো, আশেপাশে প্যাঁ-পু করে হর্ন যেন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। যাক শেষ 
ট্রেনটা তাহলে পাওয়া যাবে, বাস হাওড়া পৌঁছালো ৮ টা ৩৫ মিনিটে। কোন রকমে টিকিট কেটে দৌড়াতে দৌড়াতে 
গেলেন ট্রেনের কাছে ৫ মিনিটের মধ্যেই নাকি ট্রেন ছাড়বে। প্ল্যাটফর্মের কাছে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাস করলেন আচ্ছা 
সামনের ট্রেন টা কি আমতা লোকাল, লোকটার চেহারা কেমন যেন অদ্ভুত , মুখটাও ঠিক দেখা যাচ্ছেনা চাদরমুড়ি দিয়ে 
ঢাকা, ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন উঠে পড়ুন তাড়াতাড়ি সময় হয়ে গেছে। ট্রেনে ওঠা মাত্রই ছাড়ল ট্রেনটা। একদম ফাঁকা 
ট্রেনটা, জানালার কাছে গিয়ে বসলেন। ভাবছিলেন- যাক বাঁচা গেলো। বাইরের ঠাণ্ডা যেন কাঁপুনি ধরিয়েছে হাড়ে হাড়ে, 
বেশ তন্দ্রাছন্ন ভাব এসেছিলো , একটা মস্ত হাই তুলে চোখ বুজতেই ঘুম যেন জড়িয়ে আসছে চোখে তাছাড়া অফিসে আজ 
অনেক কাজের চাপ ছিল তাই বেশ ক্লান্ত লাগছিলো নিজেকে, হটাত পাশ থেকে কে যেন কানের কাছে মুখ এনে বলে উঠলো 
ফিসফিস করে-জানালার পাশে বসেছেন ঠাণ্ডা লেগে শরীর খারাপ করতে পারে। চোখ খুলে চমকে উঠে দেখেন এতো সেই 
প্ল্যাটফর্মের ভদ্রলোকটি। সুধীর বাবু আসতে করে বললেন – আজ্ঞে হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, কোথায় যাবেন আপনি, আপনাকে 
তো ট্রেনে উঠতেই দেখলাম না। ভদ্রলোকটি বললেন- আমার আবার ঘর, পথই আমার ঘর, আমি দেখা না দিলে কেউ 
আমায় দেখতেই পায়না। তারপর খিল খিল করে হেসে উঠলেন। সুধীর বাবু কিন্তু এসব কথা গা না করে আবার চোখ 
বুঝলেন। চা খাবেন চা, গরম চা খাবেন, ঘুম ভেঙে গেলো চা বিক্রেতার কর্কশ গলা শুনে। এই ভাই এদিকে এক কাপ 
চা দেখি, কতো? বিক্রেতাঃ- বাবু ৫ টাকা মাত্র। চা এর দাম মিটিয়ে এক চুমুক মুখে দিতেই মনে পড়লো সেই ভদ্রলোক 
কোথায় গেলেন যার সারা শরীর চাদর মুড়ি দিয়ে ঢাকা ছিলো, হয়তো ষ্টেশন এসে গিয়েছিলো নেমে গিয়েছে হয়তো মাঝের 
কোন ষ্টেশনে। চা বিক্রেতা তখনো চা বিক্রি করে চলেছে। এই যে ভাই শুনছো, আচ্ছা ভাই বলতে পারো আমতা ষ্টেশন 
কতো গুলো ষ্টেশনের পর একটু বলতে পারবে? চা বিক্রেতা একটু ইতস্তত হয়ে বলল – আজ্ঞে বাবু আমতা? সে তো 
এই লাইনে নয় , আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, মনে হয় ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন বাবু। ভয়ে থতমত খেয়ে সুধীর বাবু 
উঠে দাঁড়ালেন, বলে উঠলেন কি বলছো ভাই তুমি? ঠিকই বলছি বাবু আপনি পথ ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠে পড়েছেন, 
এটা তো পুরুলিয়া যাবার ট্রেন, পরের ষ্টেশনে নেমে পড়ুন বাবু , এই বলে চলে গেলো চা বিক্রেতা। কপালটাই বোধহয় 
খারাপ কে জানে কি লেখা আছে আজ কপালে , তবে সারারাত কি এই ষ্টেশনের থাকতে হবে নাকি তাকে, ভাবনার 
আর কূলকিনারা খুঁজে না পেয়ে সামনের ষ্টেশনে নেমে পড়লেন সুধীর বাবু। একি? কই এখানে তো তিনি ছাড়া আর 
কেউ নামলো না। বুকটা একবার ধড়াস করে উঠলো , কোথা থেকে ঠাণ্ডা এক ঝাঁক বাতাস যেন চারপাশ থেকে ঘিরে 
ধরেছে তাকে। উফ কি ঠাণ্ডা । দুর থেকে একদল শেয়াল ডেকে উঠলো হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে। এবার সত্যি গা 
ছমছম করতে লাগলো। এ কোথায় অজ পাড়াগাঁয়ে এসে পড়লাম রে বাবা চিন্তা করতে লাগলেন তিনি। গুঁটি গুঁটি পায়ে 
এগিয়ে গিয়ে দেখেন কাউন্টার সবই বন্ধ, আশে পাশে স্টেশনমাস্টারকেও তো দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। আলো আঁধারে 
ষ্টেশনের নামটাও ঠিক মতো বোঝা গেলো না। একপাশে আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখেন একটা লোক বসে 
আছে দেখে মনে হয় স্টেশনমাস্টার। সুধীর বাবু জিজ্ঞাস করে জানতে পারলেন আজ আর হাওড়া ফিরে যাওয়ার কোন 
ট্রেন নেই যা আছে কাল সকালে, আজ রাত তাকে মশার কামড় খেয়েই কাটাতে হবে। কি কুক্ষণে যে এসেছিলেন আজ, 
কার মুখ দেখেই বা শুরু হয়েছিলো সকালটা, এখন এসব ভেবেই বা কি হবে। স্টেশনমাস্টারকে আবার জিজ্ঞাস করলেন 
– এখানে কি খবার জন্য কোন হোটেল টোটেল পাওয়া যাবে? লোকটি কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে 
উত্তর দিলেন- পথ ভুলে এসেছেন বুঝি? সোজা গিয়ে ডানদিকে একটা চায়ের দোকান পাবেন , দশ মিনিটের হাঁটা পথ, 
ওখানে কিছু পেলে পেতে পারেন। এদিকে খিদেতে পেটে ছুঁচোয় ডন মারতে শুরু করেছে, তাড়াতাড়ি চায়ের দোকানের 
দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। পথটাও ঘন অন্ধকার বেশ গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আঁধারে, আর তেমনি ঠাণ্ডাও 
পড়েছে। পিছনে যেন কেউ আসছে মনে হলো খস খস করে একটা শব্দ কানে আসছে, কুকুর টুকুর হবে হয়তো। পিছন 
ফিরে আর তাকালেন না। রাস্তাটা যেখানে ডানদিকে বেঁকেছে বাঁকটা ঘুরতেই আবার মনে হলো কে যেন পিছু নিয়েছে 
তার– এ তো কুকুরের পায়ের শব্দ নয় , চোর ডাকাত নয়তো। পিছন ফিরে তাকালেন কই কেউ তো নেই। খিদের 
জন্য হয়তো এই ভুলভাল শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কানে। চায়ের দোকানে দোকানিটা ঝাঁপটা বন্ধ করতে যাবে ঠিক  সেই 
সময় পৌঁছালেন সুধীর বাবু। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন এক কাপ কড়া করে চা করে দিন তো। চায়ের 
সাথে আর কি কিছু পাওয়া যাবে? এই বলে সিগারেট ধরাতে গেলেন – দমকা এক ঠাণ্ডা বাতাস এসে নিভিয়ে দিলো 
সেটা , ধুর তেরি , আবার সিগারেট ধরালেন। হটাত লোকটার দিকে লক্ষ্য পড়লো সুধীর বাবুর, কি অদ্ভুত ভাবে 
তাকিয়ে রয়েছে লোকটা তার দিকে।লোকটা যে মুসলিম তা দেখেই বোঝা যায়। কিছু খাবার পাওয়া যাবে কিনা সেটাও 
তো বলল না। আবার বললেন- এই যে ভাই এখানে কিছু খাবার পাওয়া যাবে? লোকটা তার চোখ থেকে চোখ 
ফিরিয়ে বলে উঠলেন- আপনি কি পথ ভুল করে এখানে এসে পড়েছেন?। সবাই দেখছি একই প্রশ্ন করছে , পথ ভুল 
করে কি মানুষ আসতে পারেনা নাকি? লোকটা অদ্ভুত ভাবে খিল খিল করে হেসে উঠলো, বলল মানুষ ভুল করে আসতে 
পারে কিন্তু অন্য কেউ পারেনা, আবার সেই হাসি খিল খিল করে । একি দেখছেন তিনি মানুষের হাসি কি এতোটা 
বীভৎস হতে পারে। দাঁত গেলো যেন বেরিয়ে আসছে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরচ্ছে। এসব দেখে ভয়ে 
সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগলো, হাত পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ কোথায় এসে পড়লেন। বুকে কোনোরকমে 
সাহস এনে বললেন- এখানে কি কোন থাকার জায়াগা পাওয়া যাবে এক রাতের জন্য। লোকটা বলল একটু পাশেই নাকি 
তার বাড়ি একটু হাঁটা পথ রাতটা ওখানেই কাটাবেন না হয়। থাকার কোন অসুবিধা হবেনা। আর ভাড়া-টারা লাগবেনা। 
ভিশন খুসি হয়ে মনে মনে ভাবলেন সুধীর বাবু ব্যাস আজকের রাতটা নিশ্চিন্ত। দোকানি ঝাঁপ ফেলে দিলো দোকানের। 
পিছু পিছু সুধীর বাবু যেতে লাগলেন, বন জঙ্গল, শ্মশান পার করে এগিয়ে চলেছেন শুধু এই দুটো মানুষ। সুধীর বাবু 
মনে মনে ভাবছেন আচ্ছা এই গাঁয়ের আশে পাশে কি কেউ থাকেনা নাকি?এতো দুর এলাম কই একটাও ঘর বাড়ি দেখা 
গেলো না তো। লোকটি যেন তার মনের কথা শুনে নিয়ে বলতে লাগলো- আগে এখানে মানুষ থাকতো কিন্তু এখন 
কোন মানুষ থাকেনা এখানে শুধু আমরা থাকি। একদল শিয়াল ডেকে উঠলো দুরে কোথাও, মনে হল ওরা যেন কাঁদছে 
কিসের আতঙ্কে। বড় ক্লান্ত লাগছে খুব বিশ্রামের প্রয়োজন, আর যে কতোটা দুর যে যেতে হবে মনে মনে ভাবতে 
লাগলেন সুধীর বাবু। লোকটা মনের কথা আবার শুনে নিয়েই বললেন এই তো বাবু আর একটু খানি। আশ্চর্য ব্যাপার 
তো লোকটা তার মনের কথা বার বার বুঝতে পারছে কি করে? মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর লোকটা কতো গুলো উঁচু 
উঁচু ঢিপীর কাছে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। এ তো মনে হয় কবরস্থান, একি লোকটা কোথায় গেলো এই তো ছিল সামনে? 
সুধীর বাবু বললেন এই যে দাদা শুনছেন, কোথায় গেলেন আপনি। ওটা কি হচ্ছে!!! কি দেখছেন তিনি চোখের সামনে , 
ওই তো একটা লোক বেরিয়ে এল কবর থেকে, ওই তো ওর পাশ থেকে আরও একজন বেরিয়ে আসছে , আশে পাশের 
সব উঁচু উঁচু ঢিপী গুলো নড়তে শুরু করেছে, সবাই বেরিয়ে আসছে একে একে, আর সে কি অট্টহাসি, ভয়ে সারা শরীর 
যেন অবশ হয়ে আসছে, চিৎকার করতে গেলেন, কে যেন গলার স্বর বন্ধ করে দিয়েছে। থর থর করে কাঁপছেন তিনি, 
আজ আর তার রক্ষে নেই। পিছন ফিরে ছুটতে লাগলেন দিশাহারা হয়ে, পিছু পিছু কবর থেকে বেরিয়ে আসা লোক গুলো 
ছুটে আসছে অট্টহাসি করতে করতে। কিছুক্ষণ ছোটার পরই একজন টেনে ধরলো পা-টা। পড়লেন আছাড় খেয়ে। 
চারদিক থেকে সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে জ্ঞান হারালেন তৎক্ষণাৎ আর কিছু মনে নেই। পরদিন জ্ঞান 
ফিরতেই দেখেন অচেনা অজানা মুখ- কেউ তার চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছে কেউ কি সব বলাবলি করছে, পাশ থেকে 
একজন বলল জ্ঞান ফিরেছে রে লোকটার। একজন এরই মাঝ থেকে বলে উঠলো – কি হয়েছিলো কাল রাতে? 
কণ্ঠস্বরটা বড় চেনা - হ্যাঁ প্ল্যাটফর্মে আর ট্রেনে দেখা সেই বুড়োটার গলার স্বর স্পষ্ট মনে আছে তার। সুধীর বাবু কিছু 
উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধিরে ধিরে হাঁটা দিলেন ষ্টেশনের পথে।
রচনাকাল : ২৬/১১/২০১৫
© কিশলয় এবং টিংকর পাল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 1  Canada : 3  China : 16  Germany : 5  Hungary : 2  India : 231  Ireland : 23  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 5  
Ukraine : 34  United Kingdom : 2  United States : 245  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 1  Canada : 3  China : 16  
Germany : 5  Hungary : 2  India : 231  Ireland : 23  
Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 5  Ukraine : 34  United Kingdom : 2  
United States : 245  


© কিশলয় এবং টিংকর পাল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
“পথ ভুলে এক রাত” by Tinkar Pal is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭১১২
fingerprintLogin account_circleSignup