• ৯ম বর্ষ ১২তম সংখ্যা (১০৮)

    ২০২০ , মে



~ একরাত ~
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখিকা : কেকা হালদার
দেশ : India , শহর : Arambagh

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , সেপ্টেম্বর
প্রকাশিত ২০ টি লেখনী ২৫ টি দেশ ব্যাপী ১৩৫৫০ জন পড়েছেন।
অফিস থেকে বেরিয়ে রক্তিম দেখলো কেউ কোথাও নেই। যে কজন ছিল তারা সবাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। রক্তিম এতক্ষণ হাতঘড়িটার দিকে দেখেনি। এবার দেখলো ৭:৪০ বাজছে। রক্তিমের মাথায় যেনো বজ্রাঘাত পরলো। প্রত্যেকদিন ৬:৪০ এর বাস ধরে বাড়ি যায়। কিন্তু আজ যে লাস্ট বাসটাও বেরিয়ে গেছে, কি করবে এখন সে। অবশ্য এই সপ্তগ্ৰামের মত জায়গায় এটাই হওয়ার কথা। রক্তিম, মানে রক্তিম পালের বাড়ি শিমলাগড় সেখানেই সে চাকরি করতো। এখন সে বদলি হয়ে  এসেছে এই সপ্তগ্ৰামে এক সপ্তাহ ও হয়নি। আজ কাজের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে কটা বাজছে খেয়ালই করেনি। এখন বাইরে একটা জনপ্রানীও নেই এমনিতেও থাকে না তারউপর শীতকাল। কি করবে খুঁজে না পেয়ে হাঁটতে শুরু করলো। ঠান্ডাটা বেশ পড়েছে রক্তিম জ্যাকেটটা  ভালো করে চাপিয়ে নিল গায়ে। সে এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এখানকার রাস্তাঘাট ও ভালো করে চেনে না। আর অফিসের সবার সাথেও পরিচিত নয় তেমন। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাচ্ছে এমন সময় একটা খনখনে কণ্ঠস্বর, বাবু যাবেন নাকি ? রক্তিম পিছু ফিরে দেখে একটু চমকেই উঠলো। একটা রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো থাকলেও লোকটার মুখটা অনুজ্জ্বল আলোতে ছেয়ে আছে। তার মধ্যেও যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হলো খুব বয়স্ক রুগ্নপ্রায় কঙ্কালসার চেহারা।  চোখগুলো কেমন যেনো অন্ধকারেও জ্বলছে, দাঁত বের করে কেমন একটা অস্বাভাবিক হাসি হাসছে দেখলেই যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রক্তিম কোনো কিছু না ভেবেই উঠে বসলো রিক্সায় বললো চলুন যাবো। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করলো বাবু কোথায় যাবেন? রক্তিম তখন চিন্তায় আচ্ছন্ন। কোথায় যাবে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়েই  বললো আজ রাতটার জন্য ...। রিক্সায় যেতে যেতে রক্তিমের মনে হলো সে যেন কোন মৃত্যুপুরীর দিকে যাত্রা করছে। মাঝে মধ্যে রাস্তায় নিস্তব্ধতা ভেঙে দু-একটা কুকুরের কান্না ছাড়া কোনো শব্দ কানে এলো না। কুকুরের কান্না শুনে রক্তিমের গোটা শরীরে একটা বিদ্যুৎ বয়ে গেল। এই নিস্তব্ধ জায়গায় রিক্সার চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ ও তার কাছে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ অন্ধকার অলিগলি পেরিয়ে রিক্সা গিয়ে থামালো একটা বাড়ির সামনে। রিক্সাওয়ালা রক্তিম কে বললো বাবু এসে গেছি নামুন, আজ রাতটা এই বাড়িতে থেকে যান কাল সকালে একটা ব্যবস্থা হবে বলেই চোখের পলক ফেলার আগেই রিক্সাওয়ালা মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকারে কোথায় যেন একটা মিলিয়ে গেল । রক্তিম দেখলো একটা ছোট্ট ভগ্নপ্রায় মাটির বাড়ি খড়ের চাল ভিতরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। চারপাশটা বেশ অন্ধকার। অনতিদূরে দুএকটা জায়গায় ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। যেটুকু মনে হচ্ছে জায়গাটা কোনো বস্তির কাছাকাছি হবে। মনে মনে ভাবল যাক নিশ্চিন্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই তো পাওয়া গেলো। বাড়িটার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ডাকলো বাড়ির লোকজনকে, কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে ধীর গতিতে ভিতরে ঢুকে গেল। দেখলো বাড়ি ফাঁকা কোনো লোকজন নেই আলো খুব সামান্য। ওই সামান্য আলোতেই দেখলো ছোট্ট একটা ঘর আর ছোট্ট একটুখানি দুয়ার আর ঘরের ভিতর একটা খাটিয়া সব অগোছালো হয়ে পড়ে আছে, যেন কেউ এইমাত্র কাজ করতে করতে উঠে গেছে হঠাৎ বাইরে একটা বিড়াল কেঁদে উঠলো। রক্তিমের খুব খিদে পেয়েছিলো কিন্তু কোনো খাবার না থাকায় চুপ করে শুয়ে পড়লো সে। মধ্যেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। বেশ গভীর রাতে কোনোকিছুর শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তার মনে হল যেন অনেক গুলো লোক একসাথে কথা বলছে, অতটা গুরুত্ব না দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ পরে একটা চিৎকার শুনে তার ঘুম আবার ভেঙে যায়। তখন ঘরের বাইরে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায় রক্তিম। বাইরে বেরিয়ে আসে খুব সন্তর্পনে কিন্তু কাউকে দেখতে পায়না।তাও জিজ্ঞাসা করে কে ওখানে? কোনো সাড়া পায়না। তার মনে এবার বেশ ভয়ের সঞ্চার হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েই তার মনে হয় কেউ তার পিছনে হেঁটে চলে গেলো। ভয়ে রক্তিমের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে হাত পা কাঁপছে গোটা শরীরটা টলছে, রক্তিম তাও মন শক্ত করে ভাবলো ঘুমিয়ে পড়লে ঠিক হয়ে যাবে একা অচেনা জায়গায় এসে পড়েছে বলে হয়ত এইরকম হচ্ছে। সে আবার বিছানার কাছে ফিরে এসে শুয়ে পড়লো। তারপর টিমটিম করে যে লাইটটা জ্বলছিল সেটা হঠাৎই নিভে যেতে গোটা ঘর জুড়ে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। দরজাতে একটা ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হতেই থাকে যেন কেউ দরজাটা খুলছে আর বন্ধ করছে। তার মনে হল কেউ যেন গোটা ঘর জুড়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে এটা সেটা জিনিস ঘেঁটে চলেছে। হঠাৎ রক্তিম তার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস অনুভব করে ঠান্ডা একটা নিশ্বাস। রক্তিমের সারা শরীর যেন হিম হয়ে আসে । এমনিতেই রক্তিমের কেমন যেনো অচেতন ভাব আসছিল এবার সে সত্যি জ্ঞান হারায়। **********************সকালে জ্ঞান ফিরলে দেখে অনেক লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে হতচকিত হয়ে উঠে বসে। দেখে সে খোলা একটা নোংরা জায়গায় শুয়ে ছিল এতক্ষণ। কেউ একজন বলে ওঠে এত জায়গা থাকতে এখানে কেনো শুয়েছিল কে জানে। আরও অনেকে অনেক রকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিছিলো তার দিকে কিন্তু রক্তিম কোনো কথারই উত্তর দিতে পারছিল না। সবার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তাদেরই মধ্যে একজন ভিড় ঠেলে এসে বললো দাদা উঠে আসুন জায়গা টা ভালো না আমাদের সাথে আসুন। রক্তিমের নিজস্ব বোধ বিচার ক্ষমতা সব যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ওরা যা বললো রক্তিমও কলের পুতুলের মতো তাই করলো। রক্তিম কে ওরা নিয়ে গেলো ওদের বস্তিতে। দেখলো সেখানে চরম দরিদ্রতা বিরাজ করছে। এক একটা বাড়ি তাঁবুর মতো ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। বাঁশ দিয়ে ঘেরারও সামর্থ্য নেই তাদের। সেখানে একজনের বাড়ির উঠোনে একটা ভাঙ্গা পুরোনো কাঠের চেয়ার দিল বসার জন্য। অন্ধকারের  মধ্যে রক্তিম কাল ঠিকই ঠাওড়ে ছিল যে কাছেই একটা বস্তি আছে, এটা সেই বস্তিটাই। একটা মাঝবয়সী মহিলা এসে তাকে জল আর বিস্কুট খেতে দিল। কাল সারারাত কিছু খায়নি সে, খুব খিদেও পেয়েছিল তাই আর কিছু না বলে জল আর বিস্কুট টা খেয়ে নিল। এরপর একজন তার পাশে জিজ্ঞাসা করে বাবু একটু মনে করে বলেন তো কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল। রক্তিম তখন সব বলে তার এই গ্রামে বদলি হয়ে আসা, কাল রাতের সেই রিক্সাওয়ালা, আর সব থেকে অবাক কাল রাতে অত কিছুর মধ্যেও যেখানে সে একটা মাটির ঘরে ছিল, আজ সকালে দেখে সেখানে কোনো ঘরই নেই সে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। যারা দাঁড়িয়ে শুনছিল তারা সবাই রক্তিমের কথা শুনে বেশ ভয় পেয়েছে বলেই রক্তিমের মনে হল। যে জিজ্ঞাসা করেছিল সে বললো ওখানে কেউ যায়না আর ওখানে কোনো বাড়িও নেই। তবে হ্যাঁ, ছিল একটা বাড়ি একটা ছোট্ট পরিবার থাকতো এক রিক্সাওয়ালা তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে থাকতো ওই বাড়িটায়। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হবে মা লোকের বাড়িতে কাজ করতো। সেদিন এই বস্তিতে একটি ছেলের বিয়ে ছিল, সবাই রাতে বিয়ে দিতে চলে যায়। বস্তিতে থেকে যায় হাতেগোনা গুটিকয়েক লোক। সেই রাতে তিন - চারজন যুবক পথক্লান্ত বলে ওদের বাড়িতে শুধু রাতটার জন্য আশ্রয় চায়। তারপর মেয়েটিকে দেখে লোকগুলো ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। মা বাবা বাধা দিতে গেলে তাদের মেরে ফেলে মেয়েটার সামনেই। তারপর লোকগুলো মিলে এক এক করে মেয়েটি কে ধর্ষণ করে। চিৎকার চেঁচামেচি হয় কিন্তু কোনো লোক না থাকার জন্য কেউ কিছু শুনতে পায়না তারপর ওদের বাড়িটাও তো একটু নির্জন জায়গায় তাই কেউ কিছু জানতেও পারেনা। লোকগুলো চলে যাবার পর মেয়েটিও সেদিন রাত্রে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। সকালে পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে, আর বাড়িটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে ওই বাড়িতে কেউ যেত না। গতবর্ষায় যখন বিশাল বৃষ্টি বন্যা হয় তখন বাড়িটা ভেঙে পড়ে। অনেকে বলে গভীর রাতে এখনও ওই বাড়িটা দেখা যায় ভিতরে আলো জ্বলে আর কেউ যেনো কথা বলে ভিতরে। এসব শুনে রক্তিম এই হাড় কাঁপানো শীতেও দরদর করে ঘামতে থাকে। সেদিন ওই বস্তির লোকেদের অনুরোধে রক্তিম কোনমতে মুখে কিছু খাবার তুলেই শিমলাগড় ফিরে যায়। দরখাস্ত দিয়ে আবার বদলি নিয়ে শিমলাগড়েই থেকে যায়। আর কোনো দিন সে সপ্তগ্ৰামে যায়নি। 
                 ~ কেকা হালদার ~
        
রচনাকাল : ২৪/৪/২০২০
© কিশলয় এবং কেকা হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 48  China : 15  France : 3  Germany : 7  India : 403  Ireland : 67  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 3  Ukraine : 7  United States : 437  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 48  China : 15  France : 3  Germany : 7  
India : 403  Ireland : 67  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 3  
Ukraine : 7  United States : 437  
লেখিকা পরিচিতি -
                          সুনন্দা ওরফে কেকা হালদার ১লা আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার আরামবাগে জন্মগ্রহণ করেন।
বর্তমানে তিনি বাংলা বিষয়ে স্নাতক বিভাগে পাঠরতা। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আবৃত্তিতে বেশ পারদর্শীনী। এছাড়াও অঙ্কন চর্চা, সঙ্গীতচর্চা ও নাটকচর্চা করে থাকেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়ার নেশা বিদ্যমান। বিভিন্ন অনলাইন পত্র - পত্রিকায় লেখালেখি করেন। 
                          
  • ৯ম বর্ষ ১২তম সংখ্যা (১০৮)

    ২০২০ , মে


© কিশলয় এবং কেকা হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
~ একরাত ~ by Keka Halder is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৬২৫১২
fingerprintLogin account_circleSignup