শিতের সকাল,ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে সকালের রদ্দুরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেটের আমেজ নিচ্ছিলাম। রাস্তায় অফিস যাত্রি মানুষের ভিড়কে ভেদ করে হঠাত একটা চিতকার কানে আসল,চোর-চোর-চোর...। এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম একটা ১২-১৩ বছরের ছেলে খালি পায়ে ছুটে আসছে,আর পিছনে একদল মারমুখি জনতা ছুটছে আদিম উত্তেজনায়।ছেলেটিকে ধরতে যত দেরি হচ্ছে দলটিও সংখায় বাড়ছে।অবশেষে অসম ম্যারাথন শেষ হল।ছেলেটি ধরা পড়ল ব্যাঙ্কের গেটের সামনে।দুবছর আগে হওয়া পকেটমারি থেকে শুরু করে পাঁচমাস আগের মোবাইল চুরি যাওয়া ইত্যাদি অনেক-অনেক দিনের রাগ কয়েক মিনিটের মধ্যেই বর্ষিত হল ছেলেটির উপর।আমি এবং আরো দু-একজনের প্রচেষ্টায় যখন সেই গন-প্রহার থামল, ততক্ষনে ছেলেটির নাক-মুক ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে।কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল ছেলেটি দোকান থেকে একটি পাঁউরুটি চুরি করেছে।একজন বলল,এদের এখন থেকে উচিত শিক্ষা না-দিলে ভবিষ্যতে এরা ডাকাত তৈরি হবে।আমি লোকগুলোকে বললাম,ছেড়ে দিন বাচ্ছাছেলে আর মারবেন না।আমার প্রস্তাবে তারা খুব একটা খুশি হল বলে মনে হলনা।
এরই মধ্যে হঠাত ব্যাঙ্কের মধ্যে গুলি চলার শব্দ শোনা গেল।গ্রাহকের ছদ্মবেশে ডাকাতেরা ঢুকে পড়েছে ব্যাঙ্কে।তাদের একজন গেটের সামনে আমাদেরকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলল।বাকি দুজন তখন ভিতরের সবাইকে বন্দুক দেখিয়ে চমকাচ্চে, আর নিরব জনতা দাঁড়িয়ে দেখছে বোবার মত।এতক্ষন যারা সমাজ,সামাজিকতা আর নৈতিকতার বুলি আওড়াচ্ছিল,তাদের কয়েকজন গুলির শব্দ শুনেই পালিয়েছে,যারা যেতে পারেনি তারা মাথার উপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে কাঠপুতুলের মত।এভাবেই মাত্র তিনজন ডাকাত শ-দেড়েক লোকের সামনে থেকে ব্যাঙ্ক লুটে বেরিয়ে গেল,কেউ একটা শব্দ পর্যন্ত করলনা।ডাকাতদের গাড়িটা দুরে চলে যাওয়ার পর জনতার ঘোর কাটল।সবাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে সরে পড়ল।একজনকে বলতে শুনলাম,"তাড়াতাড়ি চল,পুলিশ আসলেই আরেক হ্যাপা,প্রচুর প্রশ্ন করবে।"
আমি ধীরে ধীরে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম,উঠে বসার ক্ষমতা তার ছিলনা,শতচ্ছিন্ন জামাটায় শুকনো রক্ত,শির্ন দেহটা শিতে এবং ভয়ে কুঁকড়ে গেছে।মুখে চোখে জল দিতে কোনোরকমে উঠে বসল।আমার দিকে তাকিয়ে বলল,- কাকু, ওরা তো লক্ষ-লক্ষ টাকা চুরি করে নিয়ে গেল,ওদেরতো কেউ কিছু বলল না ? আর আমি ক্ষিধে সামলাতে না-পেরে একটা পাঁউরুটি নিয়েছিলাম বলে আমায় এত মারল কেন ? নাঃ, আমার কাছে সেদিন কোনো উত্তর ছিলনা,আজো এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি পাইনি।শুধু সেদিন ছেলেটার ক্ষুধার্ত চোখে সভ্যতার সর্বনাশ দেখেছিলাম। তার হাতে দশটা টাকা দিয়ে পালিয়েছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি।ওর প্রশ্নটা যে পুলিশের থেকেও কঠিন প্রশ্ন ছিল।
রচনাকাল : ২/৭/২০১৪
© কিশলয় এবং সন্দিপ নস্কর কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।