• ১০ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১০৯)

    ২০২০ , জুন



অতুল প্রসাদ সেন (আন্তর্জাতিক সঙ্গীত দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি)
আনুমানিক পঠন সময় : ১১ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৪৬১ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
             রসিক মানুষ না হলে রসের সন্ধান মেলে না। বেলের খোলকে ঠুকরে ঠুকরে ক্লান্ত হয়ে যারা হতাশ হয়ে প্রচেষ্টা ত্যাগ করে তাঁরা বেল খাবার মজা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, তেমন নারকেলে ছোপা ছাড়াতে ছাড়াতে যারা অতিষ্ঠ হয়ে শেষে যখন দেখে শক্ত খোলকের অবস্থান তখন সেখান থেকে অনেকেই প্রত্যাবর্তন করে বলে মিষ্টি শাঁসের নিকটে থেকেও স্বাদ থেকে হয় বঞ্চিত, ঠিক যেমন প্রকৃতির সন্তান হিমালয়ের রুদ্র মূর্তি, ভয়ঙ্কর চরাই উতরাই ভূমিরূপ দেখে ফিরে আসার ফলে কঠিন প্রস্তরে ঢাকা হিমাদ্রির বক্ষচিরে যে কোমল ঝরনাধারা নেমে আসছে চিরকাল, তাতে অবগাহনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ঠিক তেমন বিস্মৃত বাঙালী জাতি আবেগ কে বিসর্জন দিয়ে আজ যে গতিশীল উন্নত পৃথিবীর বেগ নিয়ে মেতে আছে, তাতে হয়তো অতুল প্রসাদ সেনের মতো মানুষকে বাঙালী মনে রাখতে পারে নি। কেউ কেউ চাইলেও কালের করাল গ্রাসে তাঁরাও ভুলতে বসেছে। কেউ বা তাঁকে বুঝে উঠতে না পেরে তাঁকে ত্যাগ করেছেন বা মন থেকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু তিনি আছেন তাঁর কর্মে, তাঁর সৃষ্টিতে। তাই তো বাঙালী যেটা ভুলতে পারে নি, তা হল অতুল প্রসাদী গান। সঙ্গীতের তাল, লয় বা ছন্দ সবাই না বুঝলেও, তাঁর গানে যে একটা দেশাত্মবোধ বা প্রেমের বসন্ত লুকিয়ে তা সহজেই অনুমেয়। ঠুংরি আর গজলের নতুন ধারার যিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি অতুল প্রসাদ সেন। কেউ বা অতুল দা, আবার কেউবা ভাইদাদা নামে ডাকতে পছন্দ করলেও বেশী পরিচিতি ছিল এ.পি.সেন ও সেনসাহেব নামে। অতুলপ্রসাদ সেন যেমন একজন বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও গীতিকার ছিলেন, তেমন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব বাঙালী মনে না রাখলেও, মনে রেখেছে লখনউ এর সমাজ। কারণ এই লখনউ প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল সেনসাহেব রূপে। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর পরিচিতি নিয়ে লিখতে বসলে এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব হয় না। নানান চরিত্রের ভিড় করে আছে এই অতুল প্রসাদ সেনের জীবন ঘিরে, তবুও তাঁর জীবন এক বর্ণময় চরিত্রের উদাহরণ হয়ে আছে। আমরা একে একে দেখে নেব তাঁর জীবনে নানান চরিত্রের বিভিন্ন আঙ্গিক।

               প্রথমেই বলি তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেই পরিবার প্রধান পিতা রামপ্রসাদ সেন নববিধান আর মামার বাড়ির দাদু বিখ্যাত কালীনারায়ন গুপ্ত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। উনিশ শতকের সংস্কারমুক্ত খোলা আকাশের নিচে বড় হয়ে ওঠেন ছোট্ট অতুল। শোনা যায়, তাঁর বাবাকে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে সাহায্য করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর থেকে বোঝা যায় পরিবারের কৌলীন্য। তাছাড়া স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) বা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)’র সমসাময়িক ছিলেন অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)। পত্রিকায় বিবেকানন্দের শিকাগো বিজয়ের খবরে পুলকিত হয়ে সঙ্গীতের আসর বসিয়েছিলেন যেমন, তেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মতিথি পালনে উদ্যোগী বা মহাত্মা গান্ধীর আব্দারে গান শোনাতে চলে যেতেন তিনি। দীনদরিদ্রের সেবা আর পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো বা উচ্চ নীচ ভেদাভেদা জ্ঞান না করার শিক্ষা দুই পরিবার থেকেই ছোট বেলা থেকে পেয়ে এসেছেন অতুল।

              অতুল প্রসাদ বড় হবার সাথে সাথেই বিড়ম্বনা আর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন। ১৮৭১ সালের ২০ শে অক্টোবর ঢাকা শহরে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও কয়েক বছরের মধ্যে অতুল প্রসাদ পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। কয়েক বছরের মধ্যেই পিতা রামপ্রসাদ সেন মারা যান আর সেখানেই বিপর্যয় নামে। অতুলের মায়ের নাম হেমন্তশশী স্বামীহারা হয়ে আবার বিয়ে করেন প্রখ্যাত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই তথা ব্রাহ্মসমাজের নেতা দুর্গামোহন দাশের সাথে যেটা ছোট্ট অতুল মন থেকে গ্রহণ করতে না পেরে দাদু কালীনারায়ন গুপ্তের বড় ছেলে অর্থাৎ অতুলের বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের কলকাতার বাড়িতে চলে আসেন। মন খারাপ করে মামা বাড়িতে দিন কাটে, তবু অভিমানী, জেদি অতুল আর মায়ের কাছে যান না।

             এখানে অতুলের একাকীত্ব আর মন খারাপের দিনগুলিতে যে চরিত্রের ঘনঘটা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মামার মেয়ে হেমকুসুম। জেদি অতুল কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে পাঠ শেষ করে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাবার স্বপ্ন নিয়ে যেমন এগিয়ে যায় দৃঢ় পদক্ষেপে, তেমনি মায়ের শুন্যতা আর বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। ঠিক এমন সময় হেমকুসুমের কোমল হাত দুটি এগিয়ে আসে চোখের জল মোছাতে। এই পৃথিবী যে এত কঠিন নয় বা জীবনের এখন অনেক বড় অধ্যায় বাকি আছে, সেই যুদ্ধে সামিল হতে হবে অতুলকে, সে সব ঠাণ্ডামাথায় হেমকুসুম তাঁর পেলব কণ্ঠে অতুলকে বোঝাতে থাকে। ধীরে ধীরে মায়ের শুন্যতা ঘুচে যায় মামাতো বোন হেমকুসুমের অভিভাবকত্বে আর পরিচর্যায়। ফুটন্ত যৌবনের অতুলের হৃদয় কেঁপে ওঠে। বসন্তের কোকিল গান গায়। সমাজ কিন্তু তার রক্তচক্ষু নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে। অন্তরে অন্তরে দুজনের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।

              প্রেসিডেন্সির পাঠ চুকে গেলে বিলেত যেতে হবে, কিন্তু সে ব্যবস্থাপনা কে করবে। মায়ের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও মায়ের প্রাণ সন্তানের জন্য ঠিক কাঁদে। মা তাঁর সৎবাবা দুর্গামোহন দাশকে ছেলের ইচ্ছের কথা জানাতেই বাবা তাঁর বিলেত যাত্রার সকল ব্যবস্থা করে দেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে অতুল বিলেত যান এবং সেখানে গিয়ে অতুল তাঁর সঙ্গীত আর হাসিখুশি স্বভাবের কারণে সবার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে অথেন। যাইহোক, ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে দেশে ফিরে এলে বাবা, মা বা হেমকুসুমসহ সকল আত্মীয়রা খুশিতে ডগমগ। ঘটনার ঘনঘটা তখনি ঘটে গেল, যখন ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেন আর মামাতো বোন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে একি সর্বনাশ, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনদর্শন। কিন্তু অতুলের যৌবনের বাগানে হেমকুসুম যে চারাগাছ রোপণ করে বিলেতে পাঠিয়েছিল তা আজ প্রস্ফুটিত হতে চায়। কোন প্রতিবন্ধকতা যথেষ্ট নয় যে আটকাবে। হিন্দু ভাবধারায় এই বিয়ে কোনভাবেই সিদ্ধ নয়। সমাজচ্যুত হতে হবে, ওদিকে ব্রিটিশ নিয়মেও ভাইবোনের সম্পর্কে বিবাহ বৈধ নয়। কিন্তু, হেমকুসুমের মুখ অতুলের চোখের সামনে ভাসছে, বিনি সুতোর মালাতে ততক্ষণে তাঁরা একে অপরের সাথে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এমনিতেই, বিলেতে পড়তে যাওয়ায় দুজনের বিরহ আর বিনিদ্র রজনী কেটেছে। এখনকার মতো টেলিফোন বা মোবাইলে কথা বলার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। যাইহোক, অতুল প্রসাদ সেন যখন মায়ের কাছ থেকে চলে আসেন অভিমানে তখন তাঁর জীবনে এগিয়ে চলার মার্গ দর্শনে যে সবথেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি তো হেমকুসুম। আজকের প্রতিষ্ঠিত অতুল প্রসাদ কি করে তাঁকে ফেরাবে। তাই কোন কথায় কর্ণপাত না করে সোজা চলে গেলেন লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছে উপায় বের করার জন্য। অতুল প্রসাদ বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতায় ফিরে এঁর কাছে জুনিয়র হিসাবে কলকাতা হাইকোর্টে নাম লিখিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। শেষে পরামর্শ দিলেন বিয়ে করতে হলে বিদেশে গিয়ে বিয়ে করতে হবে, যেখানে তোমাদের এই সম্পর্কের কথা কেউ জানবে না। 

                 কথামত স্কটল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার এক গ্রামের গির্জায় গিয়ে বিয়ে করেন অতুল ও হেমকুসুম। চেষ্টা করলেন বিলেতে যদি থাকা যায়। কিন্তু সেখানে কাজ জোটানো খুব একটা সহজ ছিল না। দুই পুত্র দিলিপকুমার ও নিলিপকুমার জন্মায় বিদেশে। সংসারের টানাপোড়েনে সাতমাসের শিশু নিলিপকুমার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। হেমকুসুম একে একে সব গয়না বিক্রি করে দিয়েও যখন সামাল দেওয়া গেল না, তখন সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় ফিরবেন। কিন্তু কলকাতায় ফিরে প্র্যাকটিস করা খুব চাপের হল। সমাজ আত্মীয় পরিজন বা ক্লায়েন্ট সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করলো। সে এক বীভৎস কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে জীবন নির্বাহ। চিরজেদি অতুল দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু, ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন। অতুলের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার কালো আকাশের মেঘের ছায়া, ঠিক সেই সময় হাজির হন আর এক চরিত্র, নাম মমতাজ হোসেন। ব্যারিস্টার বন্ধু মমতাজ পরামর্শ দিলেন কলকাতা ছেড়ে লখনউ চলে যেতে।

               এই মমতাজ বুঝেছিলেন যে ব্যারিস্টার অতুল কে কেউ না গ্রহণ করলেও, অতুলের আছে এক কবিসত্ত্বা ও সঙ্গীতপ্রতিভা। তা এই সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার অতুল তাঁর ঠুংরি, টপ্পা আর গজলের প্রতিভায় লখনউ এর মাটিতে জায়গা করে যে নিতে পারবে সেই বিশ্বাস ছিল দূরদর্শী মমতাজের। মমতাজের সাথে পরিবার নিয়ে চললেন অতুল লখনউ এর পথে। এখান থেকে অতুল প্রসাদকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। তিনি দুর্নিবার গতিতে তাঁর মজলিস এর পাশাপাশি পেশাদারি জীবন। বাংলার মাটিতে যা মাথা কুটে পেতে চেয়েছিলেন, তা অনায়াসে পেয়ে গেলেন লখনউ এর মাটিতে। আসলে সদাহাস্য, মানবতাবাদী, পরোপকারী অতুল প্রসাদ একে একে লখনউ এর সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করলেন। শিখে নিলেন উর্দু ভাষা। মানুষের মাঝে থেকে মানুষের কাজে জীবন নির্বাহ করেছেন অতুল। বন্যা, খরা কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন দেশ উত্তাল মানুষকে ধরে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ব্যর্থ হলে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। একের পর এক লিখেছেন দেশপ্রেমের গান, মানবতার গান। সুর দিয়েছেন নিজেই। দুঃস্থের সেবায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে টাকা তুলেছেন। লখনউ এর সারস্বত সমাজ তাঁকে মাথায় তুলে নিলেন।
 
                 দেশাত্মবোধক গান রচনা, সুরদান বা পরিবেশনে সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত ও অতুল প্রসাদ সেন অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। কিন্তু বাংলা ত্যাগ করে চলে যাওয়া আর এঁদের মধ্যে অতুল প্রসাদ কনিষ্ঠ হবার কারণে অতুল প্রসাদের প্রতিষ্ঠা বঙ্গে সেই তুলনায় কম হয়েছিল। বাঙালী হওয়া সত্ত্বেও লখনউ এর বুকে তাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল হিংসে করার মতো। তাঁর বিচক্ষনতা আর ক্ষুরধার বুদ্ধির সাথে মানুষের পাশে হাসি মুখে দাঁড়ানো, নিজের জৌলুস জীবন পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মত জীবন কাটানো তাঁকে মানুষ থেকে দেবত্বে উন্নীত করেছিল। সাধারণত সঙ্গীত চর্চা করেন যারা তাঁদের আইনচর্চা করা একেবারে বিপরীতধর্মী কাজ হলেও অতুল প্রসাদ সেটা করে দেখিয়েছিলেন। একেবারে বিপরীত মেরুর দুই ধারাতে তিনি সমানভাবে সফল হয়েছিলেন। লখনউ এর অওধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম ভারতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাও একজন বাঙালী হয়ে। তাঁর সময়ে বার অ্যাসোসিয়েশনের সকল প্রকার জটিলতা কাটিয়ে লখনউ কোর্টের সুস্থ সংস্কৃতি ফিরে এসেছিল। তিনি লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা নিতেন। সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। অর্থ প্রদান করে বাবা মায়ের নামে ভবন তৈরি করেন। কলকাতা থেকে ওষুধ আনানোর জন্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের বেঙ্গল কেমিকালে যোগাযোগ করে মিশনের পাশে দাঁড়িয়েছেন যেমন, তেমনি কলকাতায় এসে মা সারদার সাথে দেখা করে জীবনের যন্ত্রনা আর অন্তরের প্রার্থনা নিবেদন করে গেছিলেন।

                 জীবনের মধুর সময় কষ্টের কারণ ছিল অতুলের বাবা মা। তাই তাঁদেরকে নিয়ে মাতামাতি করা স্ত্রী হেমকুসুম ভালোভাবে নিতে পারেন নি। তাঁর মা কে নিজের কাছে এনে রাখাটা হেমকুসুম অভিমানে নিতে পারেন নি। তাছাড়া অতুল প্রসাদ অনেক বড় জগত নিয়ে ছিলেন, সেখানে হেমকুসুমের জন্যে সময়ের বরাদ্দ কোন কোন সময় ছিল তো কোন সময় থাকতো না। সবাইয়ের জন্য শিল্পীর এত সময়, তাঁর জন্য ভাবনার বিন্দুমাত্র সময় নেই। এই হেমকুসুম যে যন্ত্রনা নিয়ে কবি শিল্পী অতুল প্রসাদকে জীবনের পরমার্থ করে নিয়েছিলেন, তিনি পরবর্তীকালে ছিলেন ব্রাত্য। শেষের দিকে তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল দীর্ণতায় ভরপুর। লখনউতে আলাদা বাড়িভাড়া করে থাকতেন হেমকুসুম। অভিমান, ভালোবাসার অভিমান, কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা থেকে অভিমান। যখন সঙ্গীতের আসর বসত, তাঁর বাড়িতে মহান কবি শিল্পীদের আগমন ঘটতো, তখন তাঁদের প্রতি আতিথেয়তা থেকে শুরু করে সব কিছু আয়োজন করেন নিজে উপস্থিত থেকে। দিনের শেষে চলে গেছেন তাঁর ভাড়াবাড়িতে। মায়ের মৃত্যুর পর হেমকুসুমকে বাড়িতে আনা হলেও, শোনা যায় মায়ের ছবি রাখা নিয়েও হেমকুসুমের আপত্তি ছিল। তাই আর আমৃত্যু সেই সময়ের ৩৩ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করা অতুল প্রসাদের প্রাসাদসম বাড়িতে হেমকুসুম যান নি। অতুলের মা সম্পর্কে হেমকুসুমের পিসি হলেও তাঁর আচার ও অতুলের প্রতি ব্যবহার আর নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে দ্বিতীয় বিয়ে ইত্যাদি কারণে মন থেকে কাছের করে নিতে পারেন নি ভাইঝি হেমকুসুম। এভাবেই ব্যক্তিগত জীবন বিপর্যয়ের মধ্যে কেটে গেলেও সমাজ জীবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আজও অতুল প্রসাদ সেন। সেই নক্ষত্রের পতন ঘটে ১৯৩৪ সালের ২৬ শে আগস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে।

                   সঙ্গীতের চর্চা আর মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পান নি। মায়ের প্রতি অভিমানে সরে এলেও পরে মায়ের একাকিত্বে নিজের বাড়িতে এনে আশ্রয় ও সেবাদান। ভালোবেসে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন এক নিষিদ্ধ সম্পর্কে। সেই স্ত্রী আর মায়ের মধ্যে টালমাটাল সম্পর্কে মা কে দূরে সরাতে পারেন নি। হেমকুসুমের প্রতি অন্যায় হয়েছে, কিন্তু সমাজের কাছে এক অপূর্ব বার্তা তিনি দিয়েছেন। হেমকুসুমের উচিৎ ছিল আরও একটু নরম হয়ে তাঁর অবস্থা বোঝার। আসলে ত্যাগ আর জীবনের যন্ত্রনা তাঁকে মানসিকভাবে কঠোর করে তুলেছিল হয়তো। গভীর কষ্টে তিনি অতুল প্রসাদের লেখা গান গাইতে গাইতে কাঁদতেন, আবার কতশত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন অতুল হেমকুসুমের বিরহ যন্ত্রনা নিয়ে। এটাই ছিল তাঁদের ভালোবাসার করুন পরিণতি। যাইহোক, অতুল প্রসাদ চিরদিন আত্মপ্রচার থেকে দূরে ছিলেন। তাঁর গান বাংলার মানুষ না মনে রাখলেও আজও ২৩ শে জানুয়ারি বা ২৬ শে জানুয়ারি কিংবা ১৫ ই আগস্ট বাজাতে শোনা যায় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। ঠুংরি বা টপ্পা বা গজল নিয়ে লখনউ আজও জ্বালিয়ে রেখেছেন অতুল প্রসাদ সেনের জীবনদীপ। তাঁর গান গুলির মধ্যে বহুল প্রচারিত গান হল – ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী, বল বল বল সবে, হও ধরমেতে ধীর কিংবা আমরি বাংলা ভাষা, মোদের গরব মোদের আশা, সবারে বাস রে ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, সরোজিনী নাইডু, শিবনাথ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সাথে। তাই তাঁর মতো অতুল্য প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন, আছেন, থাকবেন আপাদমস্তক বাঙ্গালিয়ানার মননে, চিন্তনে। তাঁর মতো অনন্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। নশ্বর দেহ চলে যায় কালের নিয়মে, পড়ে থাকে তাঁর অসীম কর্ম আর মানুষের প্রতি ছড়িয়ে থাকা প্রেম। 
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 5  Canada : 24  China : 17  Germany : 3  Hungary : 1  Iceland : 1  India : 275  Ireland : 8  Japan : 2  Russian Federat : 6  
Saudi Arabia : 6  Singapore : 1  Turkey : 1  Ukraine : 10  United States : 273  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 5  Canada : 24  China : 17  Germany : 3  
Hungary : 1  Iceland : 1  India : 275  Ireland : 8  
Japan : 2  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 6  Singapore : 1  
Turkey : 1  Ukraine : 10  United States : 273  
  • ১০ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১০৯)

    ২০২০ , জুন


© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অতুল প্রসাদ সেন (আন্তর্জাতিক সঙ্গীত দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৮৭৪৩
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী
fingerprintLogin account_circleSignup