(সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে সাহায্য শিবির থেকে ফিরে এসে)
- ও কাকু! ও কাকু! একটা রবার দেবে গো?
কাঁচুমাচু মুখটা একহাত দূর থেকে একদম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেও আমার কানে এল কথাটা। কারণ, প্রয়োজনটা একেবারে অন্তর থেকে ছিল। ফিরে তাকাতেই দেখলাম, এই শীতের সময় একটা পাতলা জামা গায়ে। উন্মুক্ত দেহের বাকি অংশে ধুলো কাদা নিয়ে অপরিচ্ছন্নতার কারণে সামান্য ফাটাফুটির ছাপ নিয়ে নিষ্পাপ একটা সরল মুখের পবিত্র দুটি চোখ স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে এক পাওয়া না পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তার কৌতূহল আর শিক্ষিত আর সভ্য জগতের সাথে দারিদ্র্যের দুরত্বের কারণে একরাশ লাজুকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বছর দশেকের ছেলে। মনের মধ্যে আয়লার ধাক্কা অনুভুত হল। আমরা অনেকেই হাজির থাকলেও ওঁর মনে হয়েছিল যে আমার কাছে চাইলে মনে হয় নিশ্চিত পেতে পারে। কারণ একটু আগে যখন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ তাঁর নাতির জন্য আমার কাছ থেকে দুটি খাতা চেয়ে পেয়েছে, সেটা সে কুলগাছের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে। যদিও আমাদের সবাই ওদেরকে দেবার জন্য একগুচ্ছ সহায়তা নিয়ে গেছিলাম। যাইহোক তাঁকে ডাকলাম।
-কাছে এসো। তোমার নাম কি বাবু? তোমার বাবা মা কোথায়?
-‘সুব্রত মণ্ডল। বাবা নি তো। সে জঙ্গলে গে আর আসেই নি! মা নদীতে মীন ধরতি গেছে। দও না একটা রবার’। (ও আমার সাথে এত কথা বললেও লক্ষ্য কিন্তু আমার পাশে থাকা ইরেজার এর জারের দিকে স্থির)
- আচ্ছা এই রাবার দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি কি পড়াশুনো কর?
- ‘আমার রবার দিলি আমি পড়ালেখা করব, আর আমি একটা বাঘ আঁকব, এঁকে মেরে ফেলব’।
আমার চোখের কোণে জল ভরে উঠল সবার অজান্তে। কেউবা তার কথা শুনল, আবার কেউ শুনতে শুনতে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাদের বাচ্চারা প্রতিদিন যে অর্থ শুধুমাত্র টিফিন খেতে ব্যয় করছে কিংবা নেট রিচার্জ করছে, এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সেই টাকাতে এক সপ্তাহ অনেকের সংসার চলে। সরকারী সহায়তায় শিশুদের পড়াশুনার ব্যবস্থা থাকলেও, দারিদ্র্য সমাজের সমান্তরাল সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।
অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলেও মনের মধ্যে একরাশ যন্ত্রনা আর প্রতিশোধের আগুন নিয়ে চোখে স্বপ্ন রচনা করেছে সুব্রত। সেও পড়াশুনা করবে। বাবাকে বাঘে ধরে জীবনের আলো নিভিয়েছে। সত্যিকারের বাঘ না পেলেও চলবে, শিশুমন শুধু একটা বাঘ খুঁজছে। সেটা খাতার পাতায় আঁকা হলেও হবে। তাকে মেরে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেই নেবে।
নাই বা করুক প্রথাগত পড়াশুনা। ওঁর ইচ্ছেকে সম্মান দিতেই হবে। কে বলতে পারে ও একদিন সমাজের অন্য পাঁচ শিশুর থেকে আলাদাভাবে তৈরি করবে নিজেকে। শুধুমাত্র ওঁর অদম্য ইচ্ছায় ও পারবেই পারবে। ওকে কাছে নিয়ে দুটি খাতা, দুটি পেন, এক বাক্স রঙপেন্সিল, দুটি পেন্সিল আর দুটি ইরেজার একটা প্যাকেটে করে গুছিয়ে দিলাম ওঁর হাতে। ব্যাগটা গোছানোর সময় সুব্রত ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি যে তার জন্য এত কিছু বরাদ্দ হচ্ছে। তাই এই কাজ করার সময় ও নির্বিকারভাবে বলেই চলেছে ‘দও না গো, একটা রবার দও না!’
যাইহোক, যখন ওঁর হাতে ব্যাগ দিলাম। সেটা নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর ঠিক যেমন বাঘ শিকার করার পর শিকারটা এক লহমায় পিঠে তুলে নিয়ে চলে যায় গভীর জঙ্গলে, তেমনভাবে সুব্রত ব্যাগটা ঘুরিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে চলে গেল দৌড়ে দারিদ্র্য পীড়িত এক চিরবঞ্চিত, অবহেলিত অন্ধকার গলির দিকে। তার কাঁধে আমাদের সভ্যজগতের কিছু মানবদরদী শিক্ষিত মানুষের সাম্যবাদের থলি। আমি ওঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানালাম যারা শত ব্যস্ততার মাঝে এই স্বার্থপর দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে ওদের জন্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বাস করুন ওদের প্রশান্তি, আপনাদের সুস্থ ভবিষ্যৎ জীবনের আনন্দধারা। সাথে থাকুন, পাশে থাকুন। ওদের মুখে হাসি আর বুকের ছাতিতে এভারেস্ট জয় করার শক্তি প্রদান করতে পেরে আমার পক্ষ থেকে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে।
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।