হটাৎ বৃষ্টি থমকে দিলো সময় !
অসহ্য গরমে কাহিল জনজীবন , বৃষ্টিটা প্রায় সকলেরই মনকামনা । - প্রকৃতি বুঝি সেই কামনাই রাখলো । যদিও প্রকৃতিই সব সৃষ্টি করে- ‘তুমি গড়ো তুমি ভাঙো, ভাঙা-গড়া খেলায় মাতো’ ! প্রকৃতির মন বুঝতে কত গবেষনা , যদিও হাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যত বানী অনেক সময়েই মেলেনা। যেমন আজকে ।
মনটাও যেনো সেই প্রকৃতির ধার নেওয়া ! - বা ধার কেন ? আমারা তো সেই প্রকৃতিরই দান । প্রকৃতিই ওই একটাই । আর মন অজস্র, অজস্র মনের প্রকৃতি । - কোনো দিন ই বোঝা গেলনা ।
বৃষ্টিটা আরো বাড়লো । কোনো রকমে মাথা আগলে আর দাঁড়ানো যাচ্ছেনা , এক পাশটা পুরো ভিজে গেছে । সত্যি মানুষের মন ! খানিক আগে যে প্রচন্ড গরমে রোদে পুড়ে হাঁটছিলাম , সে কথা এক ঝটকায় ভুলিয়ে দিলে । এই তো নিয়ম । - কিন্তু সব ভুলে যাওয়া যায়না ! ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দুপুর একটা ।
এখানে মনে হয় কোনো এক সময় কোনো দোকান ঘর ছিলো । বন্ধ হয়ে গেছে । তা এই রকম জায়গায় চলার ও কথা নয়; চারিদিকে ফাকা ধূ ধূ, মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঢিপি – চাষাবাদ হয় বলে মনে হয়না । বাহ! জায়গাটা বেশ সুন্দর রূপ নিয়েছে এই বৃষ্টিতে । অসহ্য গরমে ফাঁকা রাস্তায় যেমনটি লাগছিল- তা নিমেষে বদলে গেল ! –কিছু বদলাতে মনে হয় মুহুর্তই লাগে আর যে মুহুর্তে লুকিয়ে থাকে পেছনের অজস্র সময় । সত্যি হন্ত দন্দ ছুটে চলা সময় বৃষ্টি এসে থমকে দিলো ।
না, এ বৃষ্টি থাম্বার নয় ! ভিজেই যেতে হবে । যদিও আর একটু চললে মনে হয় স্টেশান পেয়ে যাবো, রামসিং তাই বলেছিলো । ওখানে গিয়ে নাহয় কিছু বন্দবস্তো করা যাবে ।
মিতা এই প্রথম আসছে এখানে । আমার বদলির পর ওর মন একদম খারাপ হয়ে যায় । ওকে স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে হবে। বিয়ের আগে আমি বলতাম তোমার চাকরি করার দরকার নেই । আমি করব , তুমি ঘর সামলিও । ও তখন বিদ্রোহী নারীবাদী রমনী । মেয়েদের ও সমান অধিকার । মোদ্দা কথা ও চাকরি করবে । বিয়ের পর ওর আর চাকরি করার ইচ্ছেও ছিলোনা । আমি দেখলাম সারাদিন ঘরে বসে বোর হওয়ার চেয়ে কাছের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যাকনা । আমার এক বন্ধু ও ছিলো, ওতো অসুবিধা হয়নি । বন্ধুটি ওই স্কুলেই চাকরি করত এবং ম্যানেজমেন্টে ছিলো । প্রথম প্রথম ওর ভালো না লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায় । আমি বদলি হয়ে চলে এলাম । আর ও থেকে গেল, স্কুল আর তিন্নি কে সামলাতে । কাল হটাৎ জানায় ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । এখানে আসছে ।
ভিজতে ভিজতে আবার হাঁটা লাগালাম ।
-(২)-
আজ কে মেল ট্রেন টাকে পার করতে সত্যি খুব ঝামেলা হল । মালগাড়িটা ও এসেপৌছেছে। ওদিকের লাইনটা মেরামতির কাজ ,তার মধ্যে হটাৎ বৃষ্টি । যাইহোক চেম্বারে এসে শরিরটা এলিয়ে দিলাম । কাজ সেরে গাঙ্গুরাম ও তার দলবল নিয়ে ফিরে গেছে । নাহ সেই রাতের ট্রেন । আজ আর কোনো সিগ্নাল ঝামেলা নেই ।
ঠাকুরদা নাম রেখেছিলো মণোতোষ । হুগলীর আরামবাগের রায় ফ্যামিলির ছেলে -ছোটবেলা থেকে খোকাবাবু শুনতেই অভ্যস্ত। কিন্তু প্রথম পোষ্টিং এই চরম আরামে এসেছেন , যে আরামে ও শান্তি নেই ।
বিহারের অত্যন্ত প্রত্যন্ত একটা স্টেশান ধুমসাই । সেই ব্রিটিশ পিরিয়োডে খুব নাম ছিলো । কিছু স্বাধিনতা সংগ্রামী এখানে ট্রেনের ওয়াগন লুট করেছিলো । শোনা যায় তখন ইংরেজদের সঙ্গে খুব গুলিচালাচালি হয় । স্পটে কিছু বিপ্লবী মারা যায় । কিছু পালিয়ে যায় । তবে সেইসব কোনো বিপ্লবীদের কোনো খোঁজ পরে আর পাওয়া যায়নি । ব্রিটিশ সরকার ঘটনার সত্যতা শিকার ও করেনি সেই সময় । সবটাই লোকমুখে চলে । তবে সমসাময়িক বিপ্লবী পত্র পত্রিকায় এর উল্লেখ রয়েছে । সেই বিপ্লবীদলে এক মহিলাও ছিলো বলে উল্লেখ পাওয়া যায় ।
বিপ্লবী মহিলা বললে মিতার কথাই মনে পড়ে। আমাদের পাশেই তার বাড়ি ছিলো । পরে ওরা অন্য ফ্ল্যাট কিনে উঠেযায় । এখানে আসার আগে আগে ওর সাথে আবার দেখা হয় । আমার এখান কার ঠাকানা টা দিয়ে এসেছিলাম । চিঠি লিখবে বলেছিল। আমি লিখলেও কোনো উত্তর না পাওয়ায় আমি লেখা ছেড়ে দেই । কাল হটাৎ ওর চিঠি পেলাম , সে এখানে আসছে ! আমি চমকে উঠেছিলাম ।
-(৩)-
বাবুকে এইরকম ছাড়া বোধহয় ঠিক হলনা । পরক্ষনেই ভেবছে রাম সিং ।
বাবুর ও তো খুব তাড়া ছিলো । যতই হোক সারা সপ্তাহের পর বাড়ি যাচ্ছেন ।
বেশ ভালো এই বাঙালীবাবু । সবাই তাপস বাবু বলেই ডাকেন । খুব সহজেই ওদের ওখানে সবার সাথে মিশে গেছে । বাবুরা কলকাতা থেকে এসেছেন । এখানে কি যেন কি ফ্লিম বানাবে । সিনেমায় আবার দেখা যাবেনা – ‘ডোকুমেন্টারি’ । কি জানি এ ক্যাসা এ ফ্লিম । রাম সিং আগে কোলকাতায় ট্যাক্সি চালাতো। বাংলা বেশ শিখে গেছে । এখন নিজের একটা গাড়ি কিনেছে । গ্রামেই থাকে । এই বাবুরা আসার আগে ওই স্টেশানেই দাঁড়ায় । ওই নশিবগঞ্জে যাওয়ার জন্য দিনে এক দুটো ভাড়া পেয়েই যায়। না হলে স্টেশান মাস্টার সাব আছেন । উনিও খুব ভদ্রলোক। ওনার সাথেই গল্প করে । পাশেই ওনার কোয়াটার উনি একাই থাকে । বিয়ে সাদি করেন নি । এই কোলাকাতার বাবুরা আসার পর থেকে রেগুলার বেসিস কাজ পেয়ে গেছে । বাবুদের নিয়ে কত যায়গায় নিয়ে গেছে ।
নাহ , গাড়িটা যখন ঠিক হয়েই গেল । যাই দেখি বাবু কতদূর এগোলো।
রামসিং স্টেশানের দিকে রওনা হল ।
-(৫)-
বাথরুম থেকে ফিরে এসে বই টা নিয়ে আবার বসলো । এদিকে বৃষ্টিতে চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে । দারুন একটা বই। ট্রেনে ওঠার সময় কেনে । যদিও প্রায় অনিচ্ছায় কিনতে হয়েছে । প্রায় একপ্রকারে হকারটি জোর করেই ধরিয়ে দেয়। প্রথমে ভেবেছিল কোনো মিশনারী বুক , কারন ওই আধাবিদেশীর মতো দেখতে হকারটি ।
তবে বইটা কোনো গল্পের বই না । একটা স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যি ঘটনার বর্ননা –ও ভাবেই লেখা । দুজন বাঙ্গালি বিপ্লবী, একজন মহিলা আর এক বিহারী গাড়ির ড্রাইভার কিভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে সকল যাত্রিদের রক্ষা করে । ওরা ট্রেনে ওয়াগন লুট করতে এসেছিলো । এক ইংরেজ পুলিশ ওদের পালাতে সাহায্য করে । কিন্তু বাকি পুলিশ ওদের পিছু নেয় ।
আর কয়েকটি পেজ শেষ করলেই জানা যাবে ওদের শেষ পর্যন্ত কি হলো ।
মিতা পাশের জনকে আবার জিগ্যেসা করল ‘ধুমসাই’ আর কত বাকি ?
পাশের লোক টি অবাক চোখে দেখে বলল – ধুমসাই ! এর পর তো পাটনা, ম্যাডাম । আপনি কোথায় যাবেন ?
- ধুম সাই যাবো ।
পাশাপাশি সবাই মুখ চাওয়া চাই করছে । আর একজন বলে উঠলো- ওহ ধুমসাই? মগর উহাপে তো কোই স্টেশান নেহি হ্যায় ।
লোক টি বলল – ট্রেন টা ধুম সাই দিয়েই যাবে , তবে ধুমসাই বলে কোনো স্টেশান নেই । আগে বিহারের একটা গাঁও ছিল । এখন একটা পুরোনো মকান ছাড়া আর কিছু নেই । পাশে নশিবগঞ্জ , পাটনা থেকে বাসে যাওয়া যায় ।
হটাৎ ট্রেন টা থেমে গেলো । মনে হয় কারেন্ট চলে গেছে ! লাইট ফ্যান ও বন্ধ । মিতার মাথায় কিছু ঢুকছেনা। ওতো টিকিট ও কেটেছে ‘ধুমসাই’ এর, তখনি কাউন্টারে বলতো। তাছাড়া, ওতো তাই বলেছিল । পাটনায় নেমে একবার দেখা যাবে , তারপর না হয় …
এমন সময় মিতার চোখ গেলো- ট্রেনটা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানে একটা মাটির ঢিপি, পাশে একটা ভাঙাচোরা চুনশুক্রির বাড়ি। ভালো করে লক্ষ্য করলো বাড়িটার গায় আবছা করে লেখা হিন্দিতে ধুমসাই , যদিও কিছু অক্ষর বোঝা যাচ্ছেনা , হ্যা ও ঠিক ই দেখছে , পাশেই ইংরেজীতে ধুমসাই !
মিতা দ্রুত ব্যাগ এ খোঁজা খুঁজি করে টিকিট তা বের করলো। হ্যা ওতেও ঐ লেখা । নাহ এবার ট্রেন ছাড়বে মিতা দ্রুতো ব্যাগ নিয়ে গেটের দিকে চলল । মিতা ট্রেন থেকে নামতেই , ট্রেন টা হুইশেল বাজিয়ে নিমেষে মিলিয়ে গেলো ।
মিতা হতচকিত হয়ে গেল , সে এ কি করলো !
*****************************************************************
রচনাকাল : ১৩/৭/২০১৪
© কিশলয় এবং সুমন কুমার সাহু কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।