কথায় কথায় আজ অনেক বেলা হয়ে গেলো ডাক্তার অরূপেশের। কাল আসলে ফিরেছে অনেক রাত্রে। স্বাভাবিক ভাবে খেয়ে-দেয়ে শুতেও অনেক রাত। তাই আজ দেরীতে ঘুম ভাঙা।
সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক ড:অরূপেশ, হাসপাতাল লাগোয়া সরকারী কোয়ার্টার এই থাকে। বেশী বয়স নয়। এই বছর দুয়েক হোলো
সবে ডাক্তারী পাশ করেছে। কাজের মাসী রান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজই করেন।
কাজের মাসী র কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙে অরূপেশের। মা-বাবার একটি সন্তান, শুধু চাকরীর জন্যেই কলকাতায় থাকে। মা-বাবা থাকেন উত্তরবঙ্গ তে। মাঝে মাঝে বাড়ী যায় অরূপেশ।
মাসী ঘরে ঢুকেই আগে চা দেয় দাদাবাবুকে। আজ বেলা 12 টায় জয়নিং। চা খেয়ে একটু পেপারে চোখ বুলিয়ে স্নানে যাবে। ততক্ষণ মাসী রান্না করে ফেলবে যে কোনো একটা পদ। সেটা দিয়ে খেয়ে,ও চলে যাবে হসপিটাল। মাসী বাকি রান্না করে,কাজ সেরে তালা দিয়ে চলে যাবে।
কোভিড-১৯ এর জন্যে হাসপাতালে এখন খুব চাপ। জয়নিং এর টাইম আছে, কিন্তু ছুটির কোনো সময় নেই। ওদের রক্ষা-পোষাক হাসপাতালে ই থাকে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে কত রোগীকে যে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনছে,তার ইয়ত্বা নেই।
সাড়ে দশটা বাজে। স্নানে যায় অরূপেশ। ভাবতে থাকে ডিউটি লিস্ট। প্রথমেই গিয়ে ফিমেইল ওয়ার্ডের দুই করোনা আক্রান্ত যমজ বোনের কাছে
যেতে হবে। গোটা পরিবারটাই আক্রান্ত। কিছুদিন আগেই ওদের বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ী গেছেন। বয়সে ছোটো বোনটা বেশি মিষ্টি। আজ আরেকবার সব টেস্টে পাঠাতে হবে। দেখতে হবে কতটা কি ইম্প্রুভ করেছে। বড় টা আবার কথা বলে কম।অরূপেশের খুব মায়া পরে গেছে দুই বোনের উপর।
মাসী খেতে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় অরূপেশ। চলে যায় সোজা হাসপাতাল।
ফিমেইল ওয়ার্ডে সব ডাক্তারদের ভীড় দেখে সন্দেহ হয়।গিয়ে দেখে ছোটো বোনটার ধূম জ্বর আর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। পি পি ই টা তাড়াতাড়ি করে পরে নিয়ে ডিউটি জয়েন করে।
এক সপ্তাহ চলে ডাক্তার আর পেশেন্ট -এর মৃত্যু লড়াই। এই কদিনে একবারের জন্যেও বাড়ী যায়নি অরূপেশ। মাসী এসে খাবার দিয়ে গেছে। বাড়ী যেতে বললে মাসীকে বলেছে, 'বাচ্ছা দুটোর বাড়ীর কাউকে তো ঢুকতে দেওয়া হবে না। এখন তাই ও বাচ্ছা দুটোর অভিভাবক।' চাকরীর শুরুতে নেওয়া শপথের কথা মনে করে।
আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে যমজ দুই বোন। অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নেয় অরূপেশ। লালা -রস পরীক্ষায় ধরা পড়ে করোনা পজিটিভ । পাঠিয়ে দেওয়া হয় হোম কোয়ারেনটাইনে। সোজা উত্তরবঙ্গ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে দুই বোন। ডাক্তার বাবুর সাথে ওদের তৈরী হয়েছেএকটা আত্মার সম্পর্ক। ঈশ্বরের কাছে তার সুস্থ জীবন কামনা করে।
আস্তে আস্তে সুস্থ হয় অরূপেশ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ যে তার সাথে আছে। সে তো ঈশ্বরের দূত। পুরো সুস্থ হয়ে হাসপাতাল জয়েন করে সে। ততদিনে কেটে গেছে অনেকে দিন। ছুটি নিয়ে বাড়ী চলে গেছে দুই বোন।
সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে ওরা কোনো অদৃশ্যমান ঈশ্বরের সহায়তায় দৃশ্যমান ঈশ্বরের কাছে। প্রণাম জানায় ডাক্তারবাবুকে দূর থেকে। ফুল দেয় ঠাকুরের চরণে।
এতো ভালো মনের মানুষ রা আছেন বলেই হয়তো পৃথিবীটা এখনও টিকে আছে। অরূপেশ কে জানাই শতকোটি প্রণাম। এমনভাবেই বেঁচে থাকুক আন্তরিকতা, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান।
রচনাকাল : ১/৭/২০২০
© কিশলয় এবং অসীমা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।