সৈনিক ।
মুসকান ডালিয়া। (জাহানারা)
----
মাথার উপর তারাভরা আকাশ। সারা পৃথিবী আজ ঘুমের দেশে। ঘুম নেই -সুশান্ত, রেহান, আর তৌশিক এর চোখে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের আরো সাথিরা। কি করে ঘুমাবে? তারা যে সৈনিক। ঘুমের অভাবে দুচোখ জ্বালা করে। তবুও অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জেগে থাকতে হয় ওই দূর আকাশের শুকতারাটির মতো। কার্গিল শ্রীনগরে যুদ্ধ আসন্ন। মেজরের তার পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছে তারা। বহুদিন পর ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল তিন বন্ধু। ছয়জোড়া চোখে ছিল মুগ্ধ স্বপ্নের রাশ।
তৌশিক ঠেলা দেয় রেহানকে। --কিরে কি ভাবছিস? কেমন কাটালি বল দেখি এই কয়দিন।
দীর্ঘশ্বাস আসে রেহানের বুক চিরে। চোখের কোনে জলের ঝিলিক। পাশ ফিরে সুশান্ত জড়িয়ে ধরে বন্ধুকে। বলে- কাঁদছিস?
হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে নেয় রেহান। নাঃ ওদের কাঁদতে নেই। যাদের সারা ভারত বাংলা মায়ের বীর সন্তান বলে ডাকে, তাদের চোখে এরকম জল মানায় না। তবু তারাও যে মানুষ। রক্ত, মাংস দিয়ে গড়া মানুষ। অস্থি,মজ্জা রক্তকণিকায় তাদেরও যে রয়েছে অনুভূতি, মায়া, প্রেম, স্নেহ মমতা, ভালো বাসা, ইচ্ছে অনিচ্ছে।
চোখের জলটুকু সামলে রেহান বলে--আসার সময় ঝিল খুব কাঁদছিল। এতো শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল যে, ওকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল জানিস। মনে হচ্ছিল ঘড়ির কাঁটাটা বন্ধ হয়ে যাক চিরতরে। সময়টা থেমে যাক অনন্তকাল। বাবামা ঠিক করেছিল- এই মাসের শেষেই আমাদের বিয়ে দেবেন। কেনাকাটাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। গাঢ় লাল রঙের বেনারসি কিনেছি। কিন্তু জানিনা ওই বেশে ওকে দেখা হবে কিনা?
প্রানপন চেপেও দুচোখের কোল বেয়ে নোনতা ধারা গড়িয়ে এলো রেহানের। সুশান্ত আর তৌশিকের ও চোখে জল। সুশান্তের মনে পড়ছে অনুর ব্যাথাভরা মুখখানি। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অনু চেয়েছিল তার প্রথম সন্তান জন্মের সময় পাশে থাকুক সুশান্ত। কিন্তু তা আর হয়নি। আসার আগের রাত্রে সারারাত্রি ঘুমায়নি অনু। সারারাত বুকের ভিতর জড়িয়ে নীরবে স্বান্তনার হাত বুলিয়ে দিয়েছিল সুশান্ত। লবনাক্ত কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কি করে কাঁদবে সে? সৈনিকদের যে কাঁদতে নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- জানিনা আমার অনু কেমন আছে? আমার সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করে এসেছি এই দুই হাত দিয়ে। আমি কি পারবো তাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে? আমার আদরের শিশুর জন্মের পর আমিই প্রথম কোলে নেবো ভেবেছিলাম। জানিনা- সে পৃথিবীতে আসার আগেই অনাথ হয়ে যাবে কিনা?
রেহান ব্যাকুল হয়ে মুখে হাত দেয় সুশান্তের। বলে- এমন বলিস না ভাই। তুই ঠিকই ফিরে যাবি। ফিরতে তোকে হবেই। তোর সন্তান কখনোই অনাথ হবে না।
সুশান্তের কথা শুনতে শুনতে তৌশিকের দুইগাল ভেসে যাচ্ছিল কান্নায়। বাড়িতে তার ফুটফুটে তিন বছরের মেয়ে মিষ্টি। কি অপূর্ব সুন্দর, গোলগাল ভরাট মুখ, একমাথা কোঁকড়া চুল, হাসলে দুই গালে টোল পড়ে। সাদা ফ্রক পরে যখন এঘর সেঘর ঘুরে বেড়ায় মনে হয়ে আকাশ থেকে সোনপরী নেমে এসেছে। রঙিন ফ্রক পরে নাচলে মনে হয় একঝাঁক প্রজাপতি পাখা মেলে দিল বুঝি। কিন্তু তৌশিক মেয়েকে কাছে পায় কই? বাবা বাড়ি আসার পর মিষ্টির সে কি আনন্দ!!খুব বাবা ভক্ত মেয়েটা। কিন্তু ফেরার দিন মিষ্টির সে কি কান্না!! কত বুঝিয়ে বলেছে তৌশিক। কিন্তু মিষ্টির একটাই কথা- সবার বাবা তো তাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে তার বাবাই কেন থাকবেনা?
কান্নাভেজা গলায় আরো বলে তৌশিক, জানিস - মিষ্টিকে কথা দিয়ে এসেছি ফিরে আসবো। কিন্তু জানিনা- সত্যিই আসা হবে কিনা?
তিনজনে এতক্ষণ ডুবে ছিল স্মৃতিতে। লক্ষ্য করেনি মেজর এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বুকে টেনে নিলেন তার তিন প্রিয় ফৌজিকে। তারপর বললেন - সবার আগে আমরা সৈনিক। তারপর কারো বাবা, স্বামী, সন্তান বা প্রেমিক। আমাদের কাঁদতে নেই। আমাদের অনুভূতি গুলো মেরে ফেলতে হয় গলা টিপে। আমাদের আশা, ভালবাসা, পিছুটান যে থাকতে নেই। একটা বন্দুকের গুলি, অথবা একটা বোমা আমাদের শেষ করে দিতে পারে নিমেষে। ভাই সব ভুলে এসো দেশ মাতার সেবা করি। আজকের এই যে মেজর তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে, তার গল্প জানো?
বলছি শোনো- আমার বাবাও ছিলেন ফৌজি। ছুটিতে গেলে আমার মায়ের সাথে বিয়ে হয় প্রায় জোর করেই। বাবা এই অনিশ্চয়তার জীবনে কাউকে আনতে চায়নি। কিন্তু আমার ঠাম্মির কান্নায় রাজি হলেন। কেটেছিল মাত্র নয়দিন। এরপর যুদ্ধে ডাক। বাবা নববিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে চলে এলেন। আর ফিরে যেতে পারেননি। আমি তখন মায়ের গর্ভে। ঠিক দশমাস পর আমি এলাম। আমাকে নিয়েই মা কাটিয়ে দিলেন পুরো জীবন। আমি এখনো একা আছি ভাই। মায়ের মতো আরও কেউ এরকম সারাজীবন একা কাটাক আমি চাইনি।
এমন সময় সেকেন্ড মেজরের বার্তা। মেজর সাবধান। ওরা আক্রমণ করছে।
সবাই নিমেষে সতর্ক হয়ে যায়। নিমেষে ফিকে হয়ে যায় প্রেম, ভালবাসা মমতা। তখন তারা শুধুই সৈনিক।
অবিশ্রাম চলতে থাকে গুলি বারুদ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কার্গিল সীমান্ত। কনকনে ঠান্ডায় হিমে জর্জরিত সেনারা বীরদর্পে ঘায়েল করে যায় শত্রুদের। যুদ্ধ শেষ হয়। চারদিক শান্ত হয়েছে। পিছু হঠেছে শত্রুপক্ষ। বিজয় আসন্ন মেজরের। তিনবন্ধু খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে উল্লাসে। এমন সময় প্রচন্ড জোরে গুলির শব্দ। এক আর্তচিৎকার-" জয় হিন্দ।" ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ কাটতে দেখা গেলো -তিন বন্ধু ছিটকে পড়েছে তিনদিকে। আর গুলিবিদ্ধ মেজর পড়ে আছে অনতিদূরে। ছুটে যায় সবাই। শত্রুকে আগে শেষ করে রেহান, তৌশক,,সুশান্ত। তারপর ছুটে আসে মেজরের কাছে। বেশ কিছু ভারতীয় সেনার লাশ এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। যন্ত্রনায় নীল হয়ে যাওয়া মেজর বললেন -আমি চলে যাচ্ছি। তবে বিজয় কিন্তু আমাদেরই হলো। আমার মাকে একটু দেখো। আর তোমাদের স্বপ্ন পূরণ হোক। জয় হিন্দ। থেমে যায় মেজরের নিথর দেহ। কান্নায় ভিজে ওঠে আকাশ। রক্তে ভেসে যায় কার্গিলের মাটি।
(পুনশ্চঃ - কার্গিলে তো বিজয়ী তারা । কিন্তু ওরা কেউই জানেনা কবে কে কোন মুহূর্তে ওদেরও কফিনে করে ফিরে আসতে হবে। কেউ জানেনা- ঝিল কি ফিরে পাবে তার রেহানকে? সুশান্ত কি তার আগত সন্তানের মুখ দেখতে পাব? আবার কি আদরের মেয়ে মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে সুশান্ত? কেউ জানেনা। এর উত্তর জানা নেই কারোর৷ তবু ওরা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রাতের শুকরাতাটির মতো সীমান্তে রয়ে যাবে আমৃত্যু। যখন আমরা শীতের রাতে নরম কম্বলের নীচে ঘুমাই। ওরা জেগে থাকে কনকনে মাইনাস ঠান্ডায়।
বৃষ্টিতে ভিজে, গাছের পাতার উপর মাটিতে শুয়ে মৃত্যুকে বুকে নিয়ে যাদের সহবস্থান। এসো অন্তর দিয়ে আজ করি তাদের সন্মান।
রচনাকাল : ১৪/৭/২০২০
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।