দৃশ্য ১:
একেবারেই কোনো নড়াচড়া করছেনা। একটুও আশা নেই। তাও , তাওও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন মহিলা। যদি পারেন ছোট্ট প্রাণটির জন্ম দেওয়াতে। মা ও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে চেষ্টা করতে করতে। অনেক চেষ্টায় হাসি ফুটল সবার মুখে। ওয়াঃ শব্দটা আছড়ে পড়ল ডেলিভারি রুমের সব দেওয়ালে। রক্তস্নাত সদ্যজাতিকা কে দুহাতে তুলে বিজয়ীর হাসি হাসলেন প্রবাদ প্রতিম স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞা মনিদিপা ভৌমিক। ফ্রেশ হয়ে ওটি থেকে বাইরে আসতেই উদ্বিগ্ন পরিজনদের দেখে একটুকরো মুচকি হাসির সাথে থাম্বস আপ দেখিয়ে চেম্বারে চলে গেলেন তিনি।
দৃশ্য ২:
সবেমাত্র রাতের ডিউটি সেরে বন্ধুর সাথে বাইরে এসে মায়ের পাঠানো ভেজ বিরিয়ানি টা ভাগ করে খেতে বসেছে ছেলেটা। দুটো টিফিন বক্সে যত্ন করে মা ভরে দিয়েছেন দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর রাতের খাবার। সেটা খেতে খেতেই বন্ধুর থেকে জানলো 10নম্বর ওয়ার্ডের দাদুর নাকি শ্বাসকষ্ট টা বেড়েছে, কাল স্যার এসে হয়তো ওষুধ পাল্টাবেন। হটাৎ হইচই শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই একটা আধলা ইট এসে পড়ল সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার শুভব্রত সরকারের মাথার সামনের অংশে। চোখে অন্ধকার নেমে এলো। লুটিয়ে পড়লো বন্ধুর পায়ের কাছেই।৯৮ বছরের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের মৃত্যুতে পুরো হাসপাতাল চত্বরে ভাঙচুর চালালো দুই লরি ভর্তি লোকজন। তার ই ফল পেলো আগামীর এক ডাক্তার।
দৃশ্য ৩:
কোনোদিন মা হতে পারবেনা জেনেই আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি মেয়েটা। মন প্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করে নিজের জন্য একটা ভালো ভবিষ্যৎ তৈরি করেছে সে। বৃদ্ধ মা বাবার একমাত্র অবলম্বন সে। একটা কনফারেন্সে আমেরিকা গেছে সে।রাতে বাথরুমে উঠে হঠাৎ পা পিছলে পরে গেল তার বাবা। সারারাত বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করলেন বৃদ্ধা মা। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের মতো শহরেও কেউ এগিয়ে এলো না সাহায্য করতে। ভোরবেলা মেয়েকে ফোনে সব জানালেন তিনি। মেয়ে স্থানীয় হাসপাতালে ফোন করে সাহায্য চাইলেন, তড়িঘড়ি এম্বুলেন্স এলো, চিকিৎসা চলল পুরোদমে। হবে নাই বা কেন, মেয়ে যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট সুমেধা ভর্গভ। যে কারণে নিজের জীবনে মা হতে পারেনি সে, সেটা নিয়েই লড়াই তার।
দৃশ্য ৪:
বস্তির ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে অঝোর ধারে ঝরছে বৃষ্টির জল। ঘরের ভিতরের বেশিরভাগ জিনিস ভিজে গেছে। বিছানাটার ওপরে প্লাস্টিক টাঙিয়ে বিপত্নীক, চলঃশক্তি হীন শ্বশুরমশাইকে কোনোক্রমে আগলে রেখেছেন বিধবা বৌমা চন্দাক্রান্তা সেন। চোখের জল আরো বেগে ঝরছে তাঁর। এককালে যে প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতেন তাঁরা, সেটার কথাই মনে পড়ছে বারবার। কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত মা বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাড়ি-গাড়ি সব বিক্রি করেও মা কে বাঁচাতে পারেননি তাঁর স্বামী। ব্যবসাটাও ধ্বসে পড়ল অনিয়মিত খোলা ও একটানা বন্ধ রাখার ফলে। অবসাদে আত্মহত্যা করলেন তিনি। পাওনা টাকা মেটাতে বাকি গয়না ও শ্বশুরমশাইয়ের পিএফের সব টাকা তুলে দিতে হয়েছিল তাকে। এখন একটা বাড়িতে আয়ার কাজ করে কোনোক্রমে দুজনের পেট চলে, বস্তির ঘর ভাড়া দিতে অর্ধেক টাকা চলে যায়। চিকিৎসার নামে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা শুষে নিলো যে ডাক্তার রঞ্জন মোহান্তি, আজ তারই নতুন ক্যান্সার হাসপাতালের উদ্বোধন অনুষ্ঠান।
দৃশ্য ৫:
রোজকার মতো বিদ্যালয়ে এসে, রেজিস্টারে সই করতে অফিস ঘরে ঢুকে অবাক মেঘলা। তার সিনিয়র টিচার সানন্দা রায় মুখ ভার করে বসে আছেন গালে হাত দিয়ে। জিগ্যেস করে জানলো কাল রাতে যে সরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর হয়েছে সেখানকারই জুনিয়র ডাক্তার ওনার মেয়ে। কাল রাতে একবার ফোন করে বলেছিল সে ঠিক আছে। কোনো চিন্তা যেন না করেন মা বাবা। তারপর থেকে প্রায় ১০ ঘন্টা হয়ে গেলো কোনো খবর নেই। এদিকে টিভিতে তো খবরে বলছে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ; লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস … মেঘলার হাত টা ধরে জলভরা চোখে সানন্দা রায় বললেন " যদি জানতাম মেয়েকে ডাক্তার করতে গেলেও এরকম হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, বিশ্বাস কর , মেয়েকে ডাক্তার করতাম না। আজ যদি ও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তো তাহলে হয়তো এত দুশ্চিন্তা হতো না রে আমার ! "
সিনিয়র টিচারের হাত টা মুঠোয় ধরে মেঘলা বলল, "দিদি, সবাই যদি এবার এরকম করে ভাবে , তাহলে আর কেউ ডাক্তার কিকরে হবে দিদি, ও কত বড়ো বড়ো শারীরিক রোগের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছে ভবিষ্যতে, আপাততঃ এই সামাজিক লড়াই টা লড়তে দাও।"
………
আমরা কেউ না কেউ উপরিউক্ত কোনো না কোনো ঘটনা জানি। অন্য অনেক রূপেও ডাক্তার দেখেছি আমরা।কিন্তু, মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থপর ডাক্তারের জন্য আমরা ভুলে যাই সেইসব দেবতারূপী ডাক্তার দের যারা প্রাণপাত করেন আমাদের সুচিকিৎসা দেওয়ার জন্য। তাই, যে আমাদের সাথে যেমন ব্যবহার করে তাকেই শুধু তেমন টা ফিরিয়ে দেবো এটাই ভাবা উচিত আমাদের। তবে তা কখনোই অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে নয়। শান্তিপূর্ণ অনেক উপায় আছে প্রতিবাদের। সর্বোপরি, আমাদের উদ্দেশ্য হলো নিজেদের দরকারে তাদের সাহায্য নেওয়া ও তাদের যথাযোগ্য সন্মান দেওয়া। তাদের খামতি নিয়ে হইচই কমিয়ে তাদের মহানুভবতা নিয়ে আলোচনা করা। ঈশ্বর কিন্তু নিজে আপনাকে সুস্থ করে তুলবেন না, এই দেবদূতদের সাহায্যই লাগবে আমাদের। আর যদি তারপরেও থাকে ওনাদের নিয়ে আপত্তি, তাহলে রোজ একটা করে আপেল খান, দূরে থাকবেন ডাক্তারের থেকে। নানা, আমার কথা নয় প্রবচন !
বি●দ্র● গল্পের ঘটনাগুলি ও নাম কাল্পনিক, কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে মিল নিতান্ত কালতালীয়।
রচনাকাল : ৩০/৬/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।